বেদে ধর্ম ও আত্মজ্ঞান
ভারতীয় সভ্যতার আত্মা নিহিত আছে বেদের মধ্যে। হাজার হাজার বছরের প্রাচীন এই গ্রন্থসমূহ কেবলমাত্র ধর্মীয় বা আচারিক নয়—এগুলি আত্মানুসন্ধানের এক নিরন্তর ধারা, যেখানে মানুষ, বিশ্ব এবং চেতনার গভীর সম্পর্ক আলোচিত হয়েছে। বেদের মধ্যে ধর্মের ধারণা ও আত্মজ্ঞান একে অপরের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। ধর্ম কেবল সামাজিক বিধি নয়, বরং আত্মার পথ ধরে চূড়ান্ত সত্য উপলব্ধির এক অভিযাত্রা। এই পর্বে আমরা বেদে ধর্মের ধারণা, আত্মজ্ঞান সম্পর্কিত বাণী, এবং আধুনিক জীবনে তার প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে বিশদ আলোচনা করব।
বেদের চার স্তম্ভ ও ধর্ম
বেদ চার ভাগে বিভক্ত—ঋগ্বেদ, যজুর্বেদ, সামবেদ ও অথর্ববেদ। এগুলিকে দুটি প্রধান ভাগে বিভক্ত করা হয়:
১. সংহিতা (মন্ত্রবিভাগ) – দেবতার স্তব ও প্রার্থনা।
২. ব্রাহ্মণ, আরণ্যক ও উপনিষদ – যজ্ঞকেন্দ্রিক ব্যাখ্যা থেকে শুরু করে ধীরে ধীরে দর্শনের দিকে অগ্রসর হওয়া।
এখানে আমরা মূলত বেদের অন্তর্নিহিত আত্মিক দর্শন এবং উপনিষদীয় শিক্ষার মধ্য দিয়ে ধর্ম ও আত্মজ্ঞান কিভাবে একাকার হয়, তা বুঝব।
ধর্মের সংজ্ঞা বেদে:
“ধরণাৎ ধর্মঃ” এই সংজ্ঞা স্মৃতিতে আছে, কিন্তু বেদের ভাষায় ধর্ম মানে কেবলমাত্র আচরণ নয়, বরং সত্তার প্রকৃত গতি। ঋগ্বেদে বলা হয়েছে:
ঋতম্ চ সত্যং চ অভি দুর্গে অপরি শশ্রথুঃ। (ঋগ্বেদ ১০.১৯০.১)
অর্থাৎ ঋত (সাজানো মহাজাগতিক নিয়ম) এবং সত্য (চেতনার নির্ভুল প্রকাশ)—এই দুইয়ের সংহতিই ধর্ম। এখানে ধর্ম বলতে বোঝানো হচ্ছে—সেই নীতিগুলি, যা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডকে সুসংহত রাখে এবং জীবের চেতনায় সত্যকে স্থাপন করে।
আত্মজ্ঞান: উপনিষদের অন্তর্জাগরণ
উপনিষদ হলো বেদের অন্তরভাগ—যেখানে দেবতা থেকে চেতনা, যজ্ঞ থেকে যোগ, বাহ্য থেকে আত্মাভিমুখী যাত্রা শুরু হয়। উপনিষদের মূল লক্ষ্য আত্মার প্রকৃতি ও ব্রহ্মতত্ত্ব উপলব্ধি করা।
“আত্মা বস্তু বিজ্ঞানীয়ঃ।” – (বৃহদারণ্যক উপনিষদ)
“তত্ত্বমসিঃ” – (ছান্দোগ্য উপনিষদ)
“অহং ব্রহ্মাস্মি।” – (বৃহদারণ্যক)
এই তিনটি মহাবাক্যই আত্মজ্ঞানকে সর্বোচ্চ সত্য হিসেবে তুলে ধরে।
ধর্ম ও আত্মজ্ঞান: সম্বন্ধের গভীরতা
ধর্ম যদি হয় জীবনের নৈতিক দিকচিহ্ন, তবে আত্মজ্ঞান হলো সেই ধর্মের মর্ম। ধর্ম চর্চা আত্মাকে বিশুদ্ধ করে তোলে এবং সেই বিশুদ্ধতার মধ্যে দিয়েই আত্মজ্ঞান জন্ম নেয়। বেদের ভাষায়:
“বিদ্যা ও অবিদ্যা—উভয়ের মধ্য দিয়ে অমৃতত্ব লাভ করা যায়।” – ঈশ উপনিষদ
এখানে স্পষ্টভাবে বোঝানো হয়েছে যে, ধর্মীয় আচরণ (কর্ম) ও আত্মজ্ঞান (জ্ঞান) পরস্পরের পরিপূরক।
ঋষি-চিন্তায় আত্মা
ঋষিরা বলেছিলেন:
আত্মা অবিনশ্বর
আত্মা স্বয়ং জ্যোতির্ময়
আত্মা অদ্বিতীয়
কঠ উপনিষদে মৃত্যুর দেবতা যম নচিকেতাকে আত্মার প্রকৃতি বোঝাতে গিয়ে বলেন:
“ন জয়তে ম্রিয়তে বা কদাচিত্… ন hanyতে hanyমানে শরীরে।” – কঠ উপনিষদ ২.১৮
অর্থাৎ আত্মা কখনো জন্মায় না, কখনো মরে না। শরীর বিনষ্ট হলেও আত্মার মৃত্যু নেই।
বেদের দৃষ্টিতে ধর্ম মানে সচেতনতা
ধর্ম মানে হচ্ছে নিজের কর্তব্য ও সত্তার সম্পর্কে সজাগ থাকা। ঋগ্বেদে আছে:
“কর্মণি প্রবিশত ধিয়ং ধিয়া। – অর্থাৎ জ্ঞান ও কর্মের সমন্বয়েই চেতনা প্রবাহিত হয়।
আধুনিক জীবনে এটি স্পষ্টভাবে বোঝায়—আমরা কেবল বাহ্যিক কাজ নয়, সেই কাজের অন্তর্নিহিত চেতনার দিকেও মনোযোগী হই। এটি ধর্মের আধ্যাত্মিক রূপ।
আধ্যাত্মিকতা বনাম রীতিনীতির ধর্ম
যেখানে ধর্মকে শুধুমাত্র যজ্ঞ, হোম, ব্রত, উপবাস, পূজা ইত্যাদিতে সীমাবদ্ধ করা হয়, সেখানে আত্মজ্ঞান একে উতরে নিয়ে যায়। উপনিষদের প্রতিটি বাণী বলে—
> “ন বহবতা পুস্তকে ঈশ্বর লাভ হয় না, আত্মদর্শনেই হয়।”
যেমন মুণ্ডক উপনিষদ বলছে:
“পরীক্ষ্য লোকান্, কর্মচিতান্… গুরুমেব অভিগচ্ছেত্।”
অর্থাৎ সমস্ত কর্মফল বিশ্লেষণ করে বোঝো—শাশ্বত কিছু নেই, তাই জ্ঞানের জন্য গুরুর কাছে যাও।
ধর্ম মানে সত্যে প্রতিষ্ঠা:
বেদের ভাষায় ধর্ম মানে সত্য ও ঋতের অনুসন্ধান। ঋত মানে জগতের অন্তর্নিহিত শৃঙ্খলা। সেই শৃঙ্খলায় স্থিত হয়ে জীবন যাপন করাই হলো বেদীয় ধর্মচর্চা।
সত্যমেব জয়তে, নানৃতম্। – মুণ্ডক উপনিষদ
ধর্ম মানে সেই সত্যের ওপর স্থিত থাকা, মিথ্যার দ্বারা বিভ্রান্ত না হওয়া।
আত্মজ্ঞান ও আধুনিক মনঃসংস্থান:
আজকের দিনে আত্মজ্ঞান মানে—নিজের মন ও চিন্তার প্রকৃতি বোঝা। আমরা যান্ত্রিক জীবনে নানা পরিচয়ে বাঁধা পড়ে যাই। উপনিষদ বলছে--“তুমি শরীর নও, নামও নও, আত্মা সেই, যা চিরন্তন।”
এই উপলব্ধি আধুনিক মানসিক রোগ যেমন হতাশা, একাকীত্ব, মূল্যহীনতা প্রভৃতির উপশম করতে পারে। আত্মজ্ঞান মানে চেতনায় এক বিশালতা আনা, যা কেবল মন নয়, আত্মাকে মুক্ত করে।
যোগের সূত্রপাত: বেদ থেকেই
বেদের গভীরে যে সাধনার ধারা প্রবাহিত, তা-ই পরবর্তীকালে যোগশাস্ত্রের ভিত্তি রচনা করেছে। ঋগ্বেদের বহু মন্ত্র ধ্যান, মনসংযম ও অভ্যন্তরীণ তপস্যার দিক নির্দেশ করে।
“দ্যৌঃ শান্তিঃ, অন্তরীক্ষং শান্তিঃ…” – শান্তি মন্ত্র
এই বিশ্বশান্তির মন্ত্র কেবল বাহ্যিক নয়, আত্মিক অবস্থার প্রতিফলন। যোগ, প্রণায়াম, ধ্যান—এসবই বেদের আত্মজ্ঞানচর্চার বাস্তব রূপ।
বেদে গুরু ও শিক্ষার গুরুত্ব:
উপনিষদের এক মৌলিক উপাদান হল “শ্রুতি”—অর্থাৎ শ্রবণের মাধ্যমে জ্ঞান আহরণ। গুরু ছাড়া জ্ঞান অসম্ভব। তাই বলা হয়েছে:
“গুরুর সঙ্গে উপনিষদ অর্থাৎ নিকটে বসে জ্ঞানলাভ।”
আধুনিক জীবনে এটি নির্দেশ করে—কেবল বই পড়ে নয়, সত্যিকারের পথপ্রদর্শকের মাধ্যমে আত্মানুসন্ধান সম্ভব।
বেদীয় ধর্ম ও আধুনিক মূল্যবোধ:
আধুনিক সমাজে ধর্মকে যদি বেদীয় চেতনায় ফিরে দেখা যায় তবে দেখা যাবে, এই ধর্ম:
সত্যনিষ্ঠ
সহিষ্ণু
নির্বিকল্প ও সার্বজনীন
আত্মসন্ধানমুখী
আজকের বিশ্বে যদি আত্মজ্ঞানকে কেন্দ্র করে শিক্ষাব্যবস্থা, পারিবারিক সম্পর্ক ও কর্মক্ষেত্র গড়ে তোলা যায়, তবে সামাজিক শান্তি ও ব্যক্তিগত সার্থকতা দুটোই অর্জিত হবে।
বেদে ধর্ম মানে কেবলমাত্র নিয়ম নয়, এক অন্তরযাত্রা। আত্মজ্ঞানই তার কেন্দ্রবিন্দু। শাস্ত্রীয়ভাবে বেদ ও উপনিষদ আমাদের শেখায়—জীবন মানে আত্মাকে চিনে নেওয়া, সত্যে প্রতিষ্ঠিত হওয়া এবং নিজের কর্তব্যপথে অটল থাকা। এই শিক্ষা আজও ততটাই প্রাসঙ্গিক যতটা ছিল পাঁচ হাজার বছর আগে।
বেদীয় জ্ঞান কেবল প্রাচীনতার ভার নয়, বরং জীবনের চিরন্তন আলো। আধুনিক মানুষ যদি তার ভেতরকার আত্মাকে উপলব্ধি করতে চায়, তবে বেদই হতে পারে সেই প্রথম ও শেষ পথপ্রদর্শক।
✍️ রতন কর্মকার
(whatsapp: +8801715982155)
0 Comments