ক্রিয়ানুভূতি (১ম পর্ব)
ক্রিয়াযােগ কৌশলসমূহ, কর্মযােগ, রাজযােগ এবং ভক্তিযােগের সার। যে জ্ঞান, ভগবান শ্রীকৃষ্ণ শ্রীমদভগবদগীতায় ব্যাখ্যা করেছেন। ক্রিয়াযােগ প্রকৃত অর্থে যােগ শাস্ত্রের ফলিত অংশ। সেইজন্য এই শাস্ত্রকে ঈশ্বর প্রণিধানের বৈজ্ঞানিক কৌশল বলা হয়। ঊনবিংশতি শতাব্দির মধ্যভাগে, এক নতুন যুগের প্রবর্তন হল যখন, অমর কল্পযােগী বাবাজী মহারাজ এই যােগ শাস্ত্রকে একটা নতুন বৈজ্ঞানিক দিক দিয়ে রূপান্তর ঘটিয়ে পৃথিবীকে পরিবেশন করলেন, তাঁর শিষ্য লাহিড়ি মহাশয়ের মাধ্যমে, তিনি এই যােগ মানুষজাতির কল্যাণে
উৎসর্গ করলেন। লাহিড়ী বাবার শিষ্য স্বামী শ্ৰীযুক্তেশ্বরজী এই যােগ শিক্ষা তার শিষ্য পরমহংস যােগানন্দজীকে শেখালেন এবং তিনি এই যােগ পশ্চিম দেশগুলিতে, প্রচার ও প্রসার করলেন। তিনি ১৯২০ সালে ক্যালিফোর্নিয়াতে এলেন এবং পরবর্তী ৩০ ( ত্রিশ ) বৎসর কাল তিনি প্রায় এক লক্ষ মানুষকে ক্রিয়াযােগের প্রথম ক্রিয়ায় দীক্ষিত করেন। এই শক্তিশালী আধ্যাত্মিক পদক্ষেপ আমেরিকা তথা পশ্চিম দেশে একটি বেদি তৈরি করেছে এবং যােগকে জনপ্রিয় আন্দোলনে পরিণত করেছে। যা আজও কুসুমিত হয়ে চলেছে। আত্মজ্ঞানের আত্মবিকাশের পথ শেখাতে গিয়ে বাবাজী মহারাজ, লাহিড়ীবাবাকে যেই ক্রিয়ার পদ্ধতি শিখিয়ে ছিলেন, তা মূলত ছয়ভাগে বিভক্ত এবং সেগুলির একটি সংক্ষিপ্ত বিবরণ নিচে দেওয়া হল। এই কৌশলগুলি আত্মজ্ঞানী গুরু ও যথার্থ যােগ্যতা প্রাপ্ত যােগাচাৰ্য্য শিক্ষক ব্যতীত শেখা সম্পূর্ণ অসম্ভব ও অনুচিত। এই যােগ আধ্যাত্মিক পথে চলার সর্বোচ্চ পাথেয়, এই কৌশল গীতার উল্লিখিত আত্মউপলব্ধির যােগ সাধনার শিক্ষা দেয়।
প্রথম ক্রিয়াঃ
প্রথম ক্রিয়ায় নিজের শিড়দাঁড়ার মধ্যে ঈশ্বর অনুভুতির প্রক্রিয়াকে ক্রিয়াশীল করার পর নিজের স্বাভাবিক মনকে উচ্চতর চেতনায় পরিবর্তন করতে পারা যায়, এবং দিব্য তিনটি গুণ- ধ্বনি, জ্যোতি ও স্পন্দনকে অনুভব করা যায়। নিজের মাথাটা মাটিতে স্পর্শ করিয়ে দিলেই শিরদাঁড়া ও কপালের গােলার্ধ , চৌম্বকীয় আবেশে আবেশিত হয়। মস্তিষ্ক দিব্যজ্যোতি দর্শন করতে পারে। শিরদাঁড়ার মধ্যে অবস্থিত সাতটি চক্রের মধ্যে দেখতে পাওয়া যায় দিব্য শক্তি কিভাবে ওঠা নামা করছে ও মস্তিষ্ক ও আত্মাকে শক্তি প্রদান করছে। প্রথম পাঁচটি চক্র হচ্ছে শয়তানের রাজ্য এখানে অজ্ঞান ও দুষ্টবুদ্ধি ভ্রমণ করে। ছয় ও সাত চক্র হচ্ছে "স্বর্গ রাজ্য” যেখানে ভগবান স্বয়ং সব কাজ সম্পাদন ও ক্রিয়াশীল রাখেন। প্রথম ক্রিয়া, কুণ্ডলিনী শক্তিকে জাগ্রত করে সুপ্ত অবস্থা থেকে মূলাধার থেকে উপরে আজ্ঞাচক্র পর্যন্ত নিয়ে যায়। সাধক উপলব্ধি করতে পারেন যে একটি দিব্য জ্যোতি তাঁর শিরদাঁড়ার ভেতর দিয়ে ওঠা ও নামা করছে। মহামুদ্রায় (শারিরীক মুদ্রার প্রক্রিয়া) শরীরকে কর্ষণ করে এবং শরীরের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ প্রত্যঙ্গগুলি যেমন, হৃদপিণ্ড, পাচনতন্ত্র ও স্নায়ুতন্ত্রগুলিকে সতেজ করে। তথন মন, বুদ্ধি, বিচার এবং অহংকার শান্ত হয়ে যায়। আপনি ঈশ্বরের বানী অর্থাৎ ধ্বনি শুনতে পারা যায়। এই অভ্যাসের দ্বারা সারাদিন ধ্বনী শােনা যায় একে বলা হয় "অনাহত ধ্বনী”। প্রথম ক্রিয়ায় সাধক "শুভেচ্ছা সমাধি ' অর্থাৎ ঈশ্বরকে জানার তীব্র আকাঙ্ক্ষা অনুভব করেন। যখন উচ্চতর চেতন অবস্থা ও মনের শান্ত পরিস্থিতি হয় , তখন -এই অবস্থার উদ্ধব হয়।
দ্বিতীয় ক্রিয়াঃ
দ্বিতীয় ক্রিয়ায়, প্রতিটি চক্রের মধ্যে দিব্যত্রিগুণ উপলদ্ধি করার শিক্ষা দেওয়া হয়। নিচের পাঁচটি চক্রে ভগবান স্বয়ং রয়েছেন ও সেগুলিকে সক্রিয় রেখেছেন, এই উপলদ্ধি হবে এবং এই চক্রগুলির সেই অদম্য ইচ্ছা, অর্থাৎ অর্থ উপার্জন, শারিরীক মিলন, খাদ্যের লালসা, আবেগ এবং সৃজনশীলতা, সেইগুলি এই উপলব্ধির পর রূপান্তরিত হবে। রাগ, অহংকার, গৌরবও নিষ্ঠুরতা, এগুলি প্রেমে পরিণত হবে। ক্রমশঃ শক্তি শিরদাঁড়ার উপরে উঠতে থাকে এবং প্রতিটি চক্রে নানান ধরনের দিব্যধ্বনি শােনা যায়। ধ্যানের মধ্য দিবা জ্যোতির ঝলক ও বারাে ধরনের দিব্য ধ্বনি , যেগুলি স্বর্গলােক হতে আসছে বােঝা যাবে । ব্যোম তত্ত্ব সমগ্র মস্তিষ্ককে ছেয়ে যাবে। ছয়টি চক্রে ৫০ টি পদ্মের পাপড়িতে ধ্যান করতে হয়, সহস্রারের নিচের চক্রগুলিতে, মূলাধারে ৪ দল, স্বাধিষ্ঠানে ৬ দল, মণিপুরে ১০ দল, অনাহততে ১২ দল, বিশুদ্ধতে ১৬ দল এবং আজ্ঞাচক্রে ২ দল, এই পথের দলগুলি আমাদের বহির্মুখী জীবন। একইভাবে শরীরের ৫০ টি অংশকে জানতে হয় এবং আশা আকাক্ষা সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল হতে হয় যে ভগবান এদের মধ্য দিয়ে কাজ করছেন। এই অভ্যাসের মধ্যে দিয়ে বােঝা যায় যে শরীরের প্রতিটি অনু পরমাণুতে ঈশ্বর রয়েছেন। মানুষ সারাদিন যেই কাজই করুক না কেন, বুঝতে পারবে যে ভগবান একটা না একটা চক্র দিয়ে ক্রিয়াশীল হয়ে রয়েছেন। যদি কোনও নাকারাত্মক চিন্তা বা ইচ্ছা উকি মারে, সঙ্গে সঙ্গেই সেইটাকে সরিয়ে দেওয়া সম্ভব । দ্বিতীয় ক্রিয়ার সমাধিকে “বিচরিণী” সমাধি বলা হয়। অর্থাৎ ঈশ্বরের শক্তি একটি একটি করে উপরের চক্রে উঠছে। শিরদাঁড়ার ভেতর দিয়ে, শরীরে মুখ্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গ এবং শরীরের নানান অংশ দিয়ে।
ক্রিয়ানুভূতি (২য় পর্ব)
গতপর্বে আমরা বলেছিলাম, ক্রিয়াযোগের ১ম ও ২য় ক্রিয়ার অনুভূতি সমূহের কথা। আজকের পর্বে চলুন জেনে নেয়া যাক, ক্রিয়াযোগের ৩য় ও ৪র্থ ক্রিয়ার অনুভূতি সমূহ।
তৃতীয় ক্রিয়াঃ
এই ক্রিয়াটি মস্তিষ্কের ভেতরে অনুশীলন করা হয়, তৃতীয় ক্ষেত্রে। মস্তিষ্ক হচ্ছে দিব্য রাজ্য। সত্যিকারের "তুমি” পিটুইটারির ভেতরে লুকিয়ে আছে, ঈশ্বর আত্মারুপে শরীরকে কার্যকরী করে রেখেছেন। এইটাই তৃতীয় ক্রিয়ার সার্থকতা যে ধ্যানের সময় মস্তিষ্কের ভেতর দিব্য ত্রিগুণই শুধু ঘুর্ণিয়মান হয়ে রয়েছে, সেটি উপলব্ধি হবে। সাধক বুঝতে পারেন, আত্মা শরীর থেকে পৃথক হয়ে ব্যোম তত্ত্বে ভাসমান হয়ে রয়েছে। এই স্তরে বােঝা যায়, আত্মা সর্বত্র বিরাজমান এবং উপরের স্বর্গরাজ্য পর্যন্ত বিচরণ করছে। সমগ্র বিশ্বব্রহ্মাণ্ডকে মস্তিষ্কের মধ্যে উপলব্ধি করা যাবে। মাথার মধ্যে সহস্রদলপদ্ম আলােকিত হয়ে ঘুর্ণিয়মান হয়ে রয়েছে এবং আত্মাকে আলােকিত করে রেখেছে। মানুষ যে কাজই করুক না কেন, যতই পার্থিব কাজে ব্যস্ত থাকুক, সে বুঝবে যে একটি অসামান্য শক্তি তার মধ্যে দিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। মানুষ বিচ্ছিন্ন থেকে সকল নাকারাত্মক চিন্তাধারাগুলিকে সরিয়ে দিতে পারবে। তৃতীয় ক্রিয়ার সমাধিকে “তনুমানসা” সমাধি বলা হয়। অর্থাৎ মন জৈবী সত্ত্বার মধ্যে ঘােরাফেরা করছেন। এই মন এখন অন্তরস্থলে কেন্দ্রিভূত হয়েছে এবং এই সাধারণ মনটি এখন জ্ঞানে বিবর্তিত হয়েছে। এটি এখনও ঘুরছে কিন্তু কেবল মাত্র দার্শনিক ক্ষেত্রে, ঈশ্বর উপলব্ধি করছে কিন্তু পার্থিব সংসারে রয়েছে।
চতুর্থ ক্রিয়াঃ
চতুর্থ ক্রিয়া অভ্যাসের ফলে, আত্মার বিশিষ্ট গতির অনুভব হতে থাকে, মাথার ভেতরে কপালে, পন্স ( Pons ), থ্যালামাস ( Thallamus ), হাইপােথ্যালামাস ( Hypothallamus ), পিনিয়াল গ্রন্থি ( Pineal gland ), পিটুইটারির ( Pituitary ) সামনে এবং মধ্য মস্তিস্কে ( Mid Brain )। বােধ হবে উদ্ধে স্বর্গ থেকে আলাের রশ্মি ঘুর্ণিয়মান হয়ে পৃথিবীতে নামছে । এই স্তরে যে সমাধি হয় তাকে “অসংসক্তি সমাধি” বলা হয়। অর্থাৎ সাধক মুক্ত অবস্থায় চৈতন্য সাগরে ভাসছে এবং সর্বাঙ্গে ঈশ্বরের পরশ অনুভব করছে। সাধক নিজেকে ঈশ্বরের প্রতিরূপ সমান অনুভব করে ও ঈশ্বরের দিব্য জ্যোতি ও স্পর্শ আবেশ পায়। সাধক হাজার হাজার আলাের স্ফুলিঙ্গ চোখ বন্ধ ও খােলা দুই অবস্থাতেই দেখতে পায়, সেই আলো অন্তরের পৃথিবীকে প্রদীপ্ত করে। সাধক প্রকৃত অবস্থায় মাথার উপরে আলাের সন্ধার দেখতে পান, সেই আলাে বিশ্বভূবনে ছড়িয়ে আছে। সাধক শরীরে সাত ধরনের আলাে দেখতে পান। সাতটি চক্রের প্রতিটি চক্রে সাধক, দুটি করে অগ্নি দেখতে পান, একটি আরােহণের ও অন্যটি অবরােহণের। সাধক শরীরের ভেতর ও বাইরে দুই দিকেই আলাে দেখতে পান। গুরুদেব সমুখে উপস্থিত হবেন, অন্ধকার থাকবে, কিন্তু তাঁর চারদিকে আলাের দ্যুতি থাকবে।
ঈশ্বর প্রাপ্তিতে ধ্যান
(প্রথম পর্ব)
আধ্যাত্মিক জীবন যাপন করার একমাত্র পথ ধ্যান। ধ্যানের দ্বারা আমাদের বহির্মুখী পার্থিব চেতনাগুলি অন্তর্মুখী আধ্যাত্মিক চেতনায় পরিবর্তিত হয়ে যায়। একজন সাধকের ধ্যান করার জন্য কোনও রকম বহির্গত সাহায্যের দরকার পরে না। ধ্যান একটি সম্পূর্ণ অন্তরঙ্গ বা অন্তর্মুখী কৌশল। স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন— “সহজাত প্রবৃত্তি, জন্তু জানােয়ারদের মধ্যে থাকে, অনুসন্ধিৎসা মানুষের মধ্যে থাকে"। অনুসন্ধিৎসা অজ্ঞানে বিকশিত হয়, অতএব এই দুই - এর মধ্যে কোনও অন্তদ্বন্দ্ব থাকে না। ক্রিয়াযােগের পদ্ধতি মূলত ধ্যান নিয়ে চর্চা করে। ধ্যানের গভীরতা দিয়ে আমরা একজন মানুষের স্তরকে বিচার করতে পারি। ধ্যানই একমাত্র উপায়, যার দ্বারা ঈশ্বরের দরজা খােলার প্রার্থনা জানানাে যায় এবং ফলে প্রকৃতির দরজা খুলে যায় এবং আলাের, বন্যায় ভেসে যায়। আমরা ধ্যানের মাধ্যমে প্রকৃত জ্ঞান আহরণ করতে পারি।
নির্জন জায়গায় যেখানে কোলাহল-আওয়াজ কম বা প্রায় নেই বললেই চলে সেই সব জায়গা হল ধ্যানের আদর্শ জায়গা। আলোর তীব্রতা থাকলে ধ্যান ঠিক মত হয় না। তাই অল্প আলো আছে এমন জায়গা চাই। অন্ধকার ঘরে ধ্যান আরো ভালো হয়। এছাড়া পরিবেশটা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন দরকার। একটা বসার আসন চাই। কম্বল বা হরিনের চামড়ার আসন উত্তম। তবে, স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে এমন হরিনের চামড়া হতে হবে। চোখ বন্ধ করে বসতে হবে। শিরদাড়া খাড়া করে যতটা সম্ভব নিজের সুবিধামত বসতে হবে। পারিপার্শিক পরিবেশ থেকে মন উঠিয়ে নিয়ে মনকে শান্ত করতে হবে।
সাধারণ মনস্তত্ত্ব স্বাভাবিক ভাবেই ধ্যান করতে অসফল হয়। নানান ধরনের চিন্তার জাল, ধ্যানের সময় মনের মধ্যে ঘোরাফেরা করে মনকে চঞ্চল করে দেয়। ক্রিয়াযােগের অভ্যাস মনকে এমন ভাবে তৈরি করে যেখানে মনের মধ্যে কোনও ধরণের চিন্তা বা বিচার প্রবেশ করতে পারে না এবং সাধক অনাবিল প্রশান্তির আনন্দ সাধকের অচেতন ও অবচেতন মনের মধ্যে অনন্তকোটি অতীত জন্মের যে সংস্কার নিবন্ধ থাকে তা ক্রিয়াযােগের প্রাণায়ামের দ্বারা পুড়ে শুদ্ধ ও শূন্য চিত্তে পরিণত হয়। এই প্রক্রিয়াকে “তপঃ” বলা হয়। অবিদ্যা, আত্মজ্ঞান আহরণের মধ্যে একটি বাধা। অবিদ্যা হেতু আমরা কর্ম ও সংস্কারকে অনেক দীর্ঘায়িত করে ফেলি। ক্রিয়াযােগ অভ্যাসের দ্বারা আমাদের কর্ম ও সংস্কারের আবর্তগুলি সংক্ষিপ্ত হতে থাকে। সমাধির কাছে অলৌকিক ক্ষমতা কিছুই নয়। সমাধি আত্মজ্ঞান অর্থাৎ প্রজ্ঞনলােক, ব্রহ্মলােকের ব্ৰহ্মচেতনার দ্বারা উন্মােচন করে দেয়। অতীত জম্মগুলিও তখন সাধকের কাছে একটি খােলা পুস্তকের মতন দেখা দেয়। অলৌকিক ক্ষমতা তখন সমাধিপ্রাপ্ত ব্যক্তির পেছনে পেছনে দৌড়তে থাকে। পতঞ্জলীর মতে, ঈশ্বরের প্রতি নিষ্ঠা ও ভক্তি, যােগ সাধনার পথের পাথেয়। ঈশ্বর কেবল ধ্যানের ধ্যেয় বস্তু নয় তিনিই উপলব্ধির ও আত্মজ্ঞান প্রদানের কর্তা। ঈশ্বরই পারেন উপলব্ধির পথের বাধাগুলি দূর করতে। ইষ্ট, ক্রিয়াযােগের সাধনাকে সফল করেন। ঈশ্বরের সহায়তায় প্রকৃতি ক্রম বিকাশমান হয়। শাশ্বত আনন্দের অস্তিত্ব ঈশ্বর স্বয়ং। ঈশ্বর সর্বভূতে বিরাজমান “ তিনি কালের অতীত , তিনি চিরমুক্ত। মুক্ত আত্মার পৃথিবীর সঙ্গে কোনও বন্ধন থাকে না, কিন্তু ঈশ্বরকে সততই তার সৃষ্টির সঙ্গে যােগসূত্র রাখতে হয়। রহস্যময় ধ্বনী “ওঁ" স্বয়ং ঈশ্বরেরই প্রকাশ ও প্রতিনিধি। একজন ক্রিয়াবান সর্বদাই “ও” ধ্বনী শ্রবণ করেন, এর অর্থ তিনি সততই ঈশ্বরচেতনার সঙ্গে যুক্ত থাকেন। মানুষের ঐকান্তিক ইচ্ছা হয়, প্রকৃতির বন্ধন থেকে মুক্ত হওয়া, কারণ প্রকৃতি মানুষকে ঈশ্বরের থেকে দূরে সরিয়ে রাখে। ঈশ্বরের আদালতে সাজাও নেই, পুরস্কারও নেই। যার যার কর্ম অনুযায়ী সে ফল লাভ করবে। যারা আত্মজ্ঞানের পথের পথিক, ঈশ্বর তাঁদের পবিত্র পথের সন্ধান দেন ও রাস্তার সকল বাধা ও কষ্টকে লাঘব করেন। ঈশ্বর মুক্তির স্বাদ আস্বাদন করান। মানুষের পবিত্র হৃদয়ে ঈশ্বরের স্পন্দন অনুভূত হয়। একজন সাধক যিনি সতত ব্রহ্মারন্ধ্রে ( ঈশ্বরের রাজ্যে ) অবস্থান করেন, তিনিই জীবনের পবিত্রতা ও ঈশ্বর অনুভূতি উপলব্ধি করতে পারেন। জীবাত্মা পরমাত্মাকে তখনই উপলব্ধি করতে পারেন যখন তিনি পরমাত্মার সঙ্গে ব্রহ্মসাগরে বিলীন হয়ে যেতে পারেন। এটাই মানব জীবনের চূড়ান্ত লক্ষ্য। সমাধিতে জীবাত্মা ঈশ্বরের অনুভব করতে থাকেন। জীবাত্মা নিজের স্বতন্ত্র অস্তিত্ব প্রাপ্ত হন। তিনি ইচ্ছা, মনােভাব, ইন্দ্রিয়, বিচার ইত্যাদি থেকে বিরত হয়ে ঈশ্বরের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যান। যােগােসার সংগ্ৰহতে বিজ্ঞান ভিক্ষু বলেছেন— “সকল প্রকার ধ্যানের মধ্যে পরমপিতা পরমেশ্বরের ধ্যান সর্বোচ্চ।" ক্রিয়াযােগের ধ্যান ঈশ্বরের সঙ্গে সরাসরি সংযুক্ত করতে পারে। ক্রিয়াযােগ শরীর, মন, আত্মা ও বুদ্ধিকে একসঙ্গে বিকশিত করে ও আত্মউপলব্ধির জন্য তৈরি করে নেয়। ইদানিংকালে আত্ম উপলব্ধির যে সাধনা যােগীরাজ শ্ৰীশ্ৰীশ্যামাচরণ লাহিড়ী বাবা বিতরণ করে গেছেন, সেই সাধনাকেই ক্রিয়াযােগ বলা হয়। এই ক্রিয়াযােগ, রােগীরাজ শামাচরণ তাঁর গুরু শ্ৰীশ্ৰীবাবাজী মহারাজ এর কাছ থেকে এক রহস্যময় পরিস্থিতিতে প্রাপ্ত করেন। তিনি ক্রিয়াযােগের মূল কৌশলগুলি গীতার মধ্যে পান। গীতাকে যােগশাস্ত্রের উপনিষদ বলা হয়। গীতার আঠারাে অধ্যায় - এর প্রতিটি অধ্যায় এক একটি যােগ। যােগের সাধারণ মানে যুক্ত হওয়া এবং যেই কৌশল বা রাস্তার সাহায্য নেওয়া।
চলবে.....
ঈশ্বর প্রাপ্তিতে ধ্যান
(দ্বিতীয় পর্ব)
যােগীরাজ শ্ৰীশ্ৰীশ্যামাচরণ লাহিড়ী বাবা তার সময়কালে সর্বোচ্চ ও উচ্চতম মার্গের একজন গৃহীযােগী ছিলেন। লাহিড়ীবাবা ১৮৬১ সালে এই যােগ প্রবর্তন করেন। তিনি ১৮৯৫ সালে মহা সমাধি লাভ করেন। স্বামী শ্ৰীযুক্তেশ্বরী, তাঁর দেহ রক্ষার পর যােগের ধারাকে পরবর্তী প্রজন্মে প্রবাহিত করেন। শ্ৰীযুক্তেশ্বর গিরি, পরমহংস যােগানন্দজী ও পরমহংস হরিহরানন্দজী'র গুরুদেব ছিলেন। তাঁর এই দুই সুযােগ্য শিষ্য, যােগের ধারাকে পাশ্চাত্যে প্রবাহিত করেন। পরবর্তীতে পরমহংস হরিহরানন্দজী'র শিষ্য রাজর্ষী রাঘবানন্দ ক্রিয়াযোগের ধারা দেশ-বিদেশে প্রচার করেন। বর্তমানে রাজর্ষী রাধবানন্দ এর অত্যন্ত স্নেহের ও সুযোগ্য শিষ্য যোগাচার্য্য দেবজ্যোতি চক্রবর্তী (বর্তমান নিবাস নদীয়া, পশ্চিমবঙ্গ) ক্রিয়াযোগের প্রচার ও প্রসার করছেন। ইতোমধ্যে ক্রিয়াযোগের উপর তাঁর প্রকাশিত বই সমূহ ব্যাপকভাবে সাড়া জাগিয়েছে।
যােগীরাজ শ্যামাচরণ আত্মউপলব্ধির সাধনার এক ক্রান্তিকারী দিগন্ত খুলে দিলেন। অতীতকালে সাধুসন্ত, মুনি ঋষিগণ সেই অতিগুপ্ত যােগ সাধনা অভ্যাস করতেন, সেই যােগ সাধনার গুপ্ত বিদ্যা ও কৌশল তিনি সাধনেচ্ছু মানুষের মধ্যে প্রসিদ্ধ করলেন। এটি সাধারণ গৃহস্থ মানুষের জন্য একটি বিরাট বড় আশীর্বাদ। ক্রিয়াযােগ ব্যবহারিক কৌশল গৃহীদের জন্য সুলভ করা হলো। তবে কারো মন চাইলো আর সে ক্রিয়ায় দীক্ষা নিয়ে নিলো, এমন হবার নয়। মনে রাখতে হবে, এটি ব্রক্ষ্মবিদ্যা। উপযুক্ত গুরু যেমন চাই, তেমনি শিষ্যকেও উপযুক্ত হতে হবে। প্রবাদ আছে, গুরু মেলে লাখে লাখে, শিষ্য মেলা ভার।
অনেক সময় আমরা মন খারাপ করি যে অমুক আধ্যাত্মিক গুরু আমাকে
শিষ্য করলো না। কিন্তু আপনি তেমন গুরুর দেয়া আধ্যাত্মিক শক্তি ধারনের উপযুক্ত কি না, তা নিশ্চয়ই ভেবে দেখবেন।
যােগীগণ এই শরীরকে ক্ষুদ্র ব্রহ্মান্ড রূপে কল্পনা করেন। মস্তিষ্ককে সর্বপ্রধান কেন্দ্র বা সূর্যের সঙ্গে তুলনা করা হয়। মনকে চন্দ্রের সঙ্গে তুলনা করা হয়। ক্রিয়া অভ্যাসের সময়, শ্বাসের, মেরুদণ্ডের মধ্যে এক চক্র পরিক্রমা ক্রমবিকাশের এক বৎসরের সমান পরিগণিত হয়। উচ্চতর ক্রিয়ার কৌশলগুলি মানব ক্রমবিকাশকে ত্বরান্বিত করার জন্য তৈরি করা হয়েছে। শ্যামাচরণ লাহিড়ী মহাশয় উচ্চতর ক্রিয়া কৌশলগুলির প্রবর্তন করেন, তিনি আধুনিক ক্রিয়াযােগের প্রবক্তা। ক্রিয়া অত্যাসের দ্বারা ঐচ্ছিক এবং অনৈচ্ছিক এই দুই স্নায়ুতন্ত্রই নিয়ন্ত্রিত হয়। সাধারণত আমরা যখন ঘুমােই , তখন আমাদের ঐচ্ছিক স্নায়ুতন্ত্রগুলি বিশ্রাম পায়। কিন্তু ক্রিয়া অভ্যাসের সময় অনৈচ্ছিক স্নায়ুতন্ত্রগুলিও বিশ্রাম পায়। অতএব ক্রিয়া একটি পূর্ণশক্তি প্রদান করার মহত্ত্বপূর্ণ পদ্ধতি। হৎপিণ্ডে রক্ত সঞ্চালনের মাধ্যমে অম্লাজন ( oxygen ) আহরণ করার প্রক্রিয়া। হৃদপিণ্ডের বিশ্রামের দরুন মনও বিশ্রাম পায়। ক্রিয়াযােগের পদ্ধতি একটি অত্যন্ত মহত্বপূর্ণ বৈজ্ঞানিক ও মহামূল্যেবান, যেটা মানব সভ্যতার ক্রমবিকাশ উন্নতি ও কল্যাণের জন্য মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে হবে।
আসুন ক্রিয়াযোগে দীক্ষিত হয় এবং ধ্যান করি, আনন্দে থাকি।
Continue-33
ক্রিয়ায় যোগনিদ্রা
অবচেতনে সচেতন থাকাই যোগনিদ্রা। যোগনিদ্রা আপনাকে শারীরিক ও মানসিকভাবে পরিপূর্ণ প্রশান্তি দেবে। যখন আপনি যোগ নিদ্রা অভ্যেস করবেন, তখন দেখে মনে হবে যেন আপনি ঘুমোচ্ছেন, আসলে কিন্তু সক্রিয় থাকবে আপনার অবচেতন মন।
যােগনিদ্রা ক্রিয়ার পরাবস্থায় যােগীরা জেগে থাকেন তা স্বপ্নং , যথা নিদ্রা। তা বিষয় ব্যাপার শূন্য বলে নিদ্রার মতই সাধারনের নিকট উপেক্ষিত। কিন্তু সাধারণ নিদ্রাতে স্বপ্নই হয়, তা একেবারে, ব্যাপার শূন্য নয়। যােগীদের যােগ নিদ্রায় এসব ব্যাপার কিছুই থাকে না। যােগসমাধিমগ্ন যােগী তাকিয়ে আছেন, তাঁর সামনে কত কান্ড হয়ে যায়, কিন্তু কিছুতেই তার মনকে চঞ্চল করে না। তিনি কাছের মানুষের বিপদ চোখে দেখছেন, অথচ মন তার নিষ্কম্প। যােগীদের এই অবস্থা যেমন সাধারণের নিকট রাত্রির মত, অর্থাৎ সাধারন মানুষ এর রহস্য কিছুই বুঝতে পারে না। সাধারণ লােকে যখন তাদের গৃহকর্ম নিয়ে ব্যস্ত হয়, সে অবস্থাগুলােতেও যােগীরা উদাসীনের মত দেখেন মাত্র। আবার গভীর সমাধির মধ্যে তাও টের পান না।
উপনিষদে আছে—
“ যখন সম্যক দৃষ্টির প্রভাবে সমস্ত আত্মময় হয়ে যায়, তখন তিনি কাকেই বা দেখবেন এবং কিরূপেই বা দেখবেন। ক্রিয়া করে মন যখন নিশ্চল হয়ে যায়, তখন মনের মনন না থাকায়, আত্মদর্শনের বাধা কেটে যায়, তখন এমন এক আত্মমগ্ন অবস্থা ছাড়া অন্য অবস্থার উদয় হয় না।"
ক্রিয়ার পরাবস্থার প্রাথমিক অবস্থা তরলভাবাপন্ন, সুষুপ্তির তরলাবস্থা স্বপ্নের মত। এই অবস্থায় জড়াদি দৃশ্য না থাকলেও সূক্ষ্ম দৃশ্য থাকে। তাতে অনেক দর্শন শ্রবনাদি হয়। ক্রিয়ার পরাবস্থা গভীরতর হলে তা সুষুপ্তির মত। সুষুপ্তিতে যেমন মনের মনন থাকে না, সব অনুভব আচ্ছন্ন হয়ে যায়, তেমন ক্রিয়ার পরাবস্থা গভীর, গভীরতর ও গভীরতম, এই তিন প্রকারের হয়, এতেও মনের মনন থাকে না, তবে তা তমসাচ্ছন্ন নয়, জ্ঞানাচ্ছন্ন অবস্থা তাতে দৃশ্যাদি কিছুই থাকে না, কিন্তু আত্মার অনুভব থাকে, পরে তাও থাকে না। প্রথমটি সবিকল্প ও দ্বিতীয়টি নির্বিকল্প সমাধি। যােগী যােগনিদ্রায় জেগে থাকেন, তখন তার জাগ্রত অবস্থায় বিষয়গুলিকে স্বপ্নদৃষ্ট বস্তুর মত বােধ হয়। তার কিছু পরে যখন আমরা স্বপ্নের কথা ভুলে যাই। তারাও এই জগৎ ব্যাপারকে তেমনি ভুলে যান। সাংসারিক লাভালাভ প্রিয়ায়ি স্থিতপ্রজ্ঞের কাছে স্বপ্ন ব্যাপারের ন্যায় অলীক, সেইজন্য তাতে তিনি উদাসিন থাকেন। আর সাধারণ মানুষ যেখানে সমাধিনিদ্রাকে জড়বৎ বলে উপেক্ষা করেন, তখন কিন্তু স্থিতপ্রজ্ঞ পুরুষ সমাধি প্রজ্ঞাজনিত পরমানন্দে মগ্ন থাকেন।
যতক্ষন যােগনিদ্রা বা সমাধি না আসে ততক্ষণ খেচরী অভ্যাস করতে করতে যােগনিদ্রারূপ সমাধি উপস্থিত হবে। যােগনিদ্ৰাপ্রাপ্ত যােগীর কখনও মৃত্যু হয় না।
সপ্তচক্রে সপ্তদেবী
সপ্তচক্রের প্রতিটি চক্রের শক্তির প্রতিনিধি হিসেবে বিভিন্ন দেবী শক্তির কল্পনা করা হয়েছে। দেবী কল্পনা করা হয়েছে এই কারণে যে, এখানে শক্তি মূলত স্ত্রীলিঙ্গ হিসেবে কল্পিত। বিভিন্ন চক্রের শক্তির নাম ও পরিচয় দেয়া হলো।
★(১) মুলাধারঃ
এখানে শক্তির দেবীর নাম ডাকিনী। তিব্বতের ডাক শব্দ থেকে ডাকিনী শব্দ এসেছে। ডাক অর্থ জ্ঞান। ডাক অর্থ রমনী। এই চক্রে প্রথম জ্ঞানের উদয় হয়। ভিন্ন মতে এই শক্তির নাম শাকিনী। সংস্কৃত 'শক' বা শক্তি থেকে শাকিনী শব্দ এসেছে। এই শক্তিকে অনেকে বলেন কামশক্তি। মুলাধারে আছে অস্থিধাতুব শক্তি।
★(২) সাধিষ্ঠানঃ
স্বাধীষ্ঠান চক্রের দেবী শক্তির নাম রাকিনী। রাকিনী হলেন মধ্যমা শক্তি। রাকিনী মেদ ধাতুর শক্তি।
★(৩) মণিপুর চক্রঃ
এই চক্রের দেবীশক্তির নাম হল লাকিনী। বর্ন শক্তি বিচারে প্রচণ্ড তেজোময় শক্তি। বেীদ্ধ মতে ক্ষুধাতুরা শক্তি। ইনি মাংস ধাতুর শক্তি।
★(৪) অনাহত চক্রঃ
এই চক্রের দেবীশক্তির নাম কাকিনী। ইনি মধ্যমা শক্তি। তিনি রক্তধাতুর শক্তি। হৃদপিন্ডই
রক্তের মূল স্থান।
★(৫) বিশুদ্ধচক্রঃ
এই চক্রের দেবীশক্তির নাম শাকিনী। ইনি একধরনের স্নিগ্ধশক্তির প্রতিনিধি। বৌদ্ধরা একে বলেন সুবেশা যােগিনী। অর্থাৎ সুসন্নিবেশিতা যােগশক্তি। দেহের কুণ্ডলিনীশক্তি এখানে উঠলে নিবিড় নীল রঙ চোখে পড়ে, যে রঙ স্নিগ্ধতায় ভরা।
★(৬) আজ্ঞা চক্রঃ
এই চক্রের দেবীশক্তির নাম হাঁকিনী। বৌদ্ধরা বলেন চিৎকারকারিণী। এখানে একধরনের বিস্ফোরণ জনিত ভাব লক্ষ্য করা যায়। ফলে হাঁক জাতীয় শব্দ হয়। আসলে ওঁ শব্দ তো বিস্ফোরণ জাতীয় ব্যোম শব্দ থেকেই এসেছে। এই শক্তিকে অনেকেই মজ্জাধাতুর শক্তি বলে মনে করেন। মূলত মজ্জাশক্তিই আসল শক্তি। কারণ মেরুদণ্ডের শক্তিই মানবের আসল শক্তি ।
★(৭) সহস্রারঃ
এখানে সহস্ৰ দল পদ্মের কল্পনা করা হয়েছে। এর দ্বারা এমন ফিকোয়েন্সি বােঝানাে হয়েছে, যা বহুমাত্রিক। সহস্রার তিন ভাগে বিভক্ত। নিম্ন থেকে উধর্বদিকে প্রথমে রয়েছে আনন্দ অংশ। এই অংশের দেবীশক্তির নাম হ্লাদিনী। এর উপরে রয়েছে চিৎ অংশ। এই অংশের শক্তির নাম চিৎরুপিণী বা সম্বিত। শক্তি এখানে শূন্যের সঙ্গে শূন্য অবস্থায় এমন করে সন্ধি করে আছে যে, একে সন্ধিনীও বলা হয়।
***#ক্রিয়াযোগে রামায়ন চরিত্র
স্থূল জগতের বাইরেও ভিন্ন মাত্রার সুক্ষ্ম একটি জগত আছে। রামায়ণ শুধু মাত্র একটি মহাকাব্যই নয় এর অনেক যৌগিক প্রতীকী অর্থও আছে ।
***#রাম হালেন পরমাত্মা। তাঁকে রাম বলা হয়েছে এই কারণে যে , তিনি মানবদেহের মধ্যে পরমাত্মা রুপে বাস করে । ৭২,০০০ নাড়ির ওপর প্রভুত্ব করেন । এই প্রভুত্বের জন্যই তাঁকে বলা হয় রাজা রাম ।
***#লক্ষন হলেন মনঃযােগ । এই মনঃসংযােগ দ্বারাই কুণ্ডলিনী শক্তি দেহের স্থূল অংশ থেকে অর্থাৎ , মূলাধার থেকে শূন্যতায় যেতে পারে অর্থাৎ , মস্তিষ্কের পরম শূন্যস্থানে বা সহস্রারের কূটস্থানে যেতে পারে । লক্ষ্মণের একমাত্র লক্ষ্য ছিল মহাশূন্যতা অর্থাৎ পরমাত্মা অর্থাৎ , রাম।
***#সীতা হলেন কুণ্ডলিনী শক্তি। ভূগর্ভ বা মূলাধার থেকে তাঁর উত্থান হয় । জনকের মতাে রাজর্ষি তাকে সাধনা করে জাগরিত করেছিলেন কর্ষণ করে । কর্ষণ হল কুলকুণ্ডলিনী জাগরণের জন্য দেহ কর্ষণ অর্থাৎ কুলকুণ্ডলিনীকে জাগরিত করে দেহের
ষটচক্র ভেদ ।
***#শিবের ধনু , হল Medulla Oblongata অর্থাৎ মস্তিষ্কের সর্বাপেক্ষা পেছনের স্থান, মেরুদণ্ডের সঙ্গে যুক্ত । এই Madula Oblongata দেহের নানান ইন্দ্রিয়ের নিয়ন্ত্রক ।
***#দশরথ হলেন দশটি রথ অর্থাৎ , দশ ইন্দ্রিয়ের প্রভু ।
***#রাবণ হলেন অহঙ্কার পূর্ণ সাধক , এক ধরনের অভিচার ক্রিয়াকারী তান্ত্রিক । তিনি লঙ্কার রাজা । মূলাধার বীজের লং থেকেই লংকা শব্দ এসেছে । মেরুদণ্ডের মধ্যে অবস্থিত যে ছয়টি চক্র আছে তার মধ্যে পাঁচটি হল বস্তুজগত যে উপাদান দিয়ে তৈরি , সেই উপাদানের প্রতীক । যেমন মূলধার হল ক্ষিতি , স্বাধিষ্ঠান হল অপ , মণিপুর হল তেজ, অনাহত হল মরুৎ , বিশুদ্ধ hol ব্যোম । রাবণের ক্রিয়াকলাপ এই মূলাধারকে ঘিরেই । রাবণেব দশমাথা দশটি ইন্দিয়ের প্রতীক।
রাবন শব্দের অর্থ চিৎকারকারী, যে অহংকার ত্যাগ করতে না পেরে আত্মগরিমা প্রদর্শন করে চলছে।
সে কুণ্ডলিনী শক্তিকে মোক্ষের পথে পরিচালিত না করে এরা স্থূল জগতের ক্ষেত্রেই ব্যবহার করতে চায় । তাকে বিপথে চালিত করতে চায় । কুণ্ডলিনীকে তার নিজস্ব পথ থেকে বিচ্যুৎ করে স্থূল জগতের মধ্যে অটিকে রাথাই হল সীতাকে অপহরণ করা।
***#সীতা স্বয়ং কুণ্ডলিনী শক্তি । এই জন্যই রাবণ সীতাকে অপহরণ করেছিলেন বলে বলা হয়েছে । রাবণ মায়াবী , অর্থাৎ যে স্থূল জগৎ মায়াপূর্ণ তারই মধ্যে কুণ্ডলিনী শক্তিকে ধরে রেখে নিচুবাসনা চরিতার্থ করতে চান । রাবণ হলেন নিকৃষ্ট তান্ত্রিক , যে শক্তিকে জাগরিত করে তাকে বিপথে চালায় , দিব্যকাজে বাধা দান করে যেমন- সাধকের সাধনায় বাধা দেয়।
***#লক্ষণ হলেন সাধকের প্রতীক । রামের সঙ্গে রাবণের যুদ্ধ অর্থ রামের নিজেকে মেলে ধরার পথে বাধা সৃষ্টি করা ।
***#হনুমান রাবণের পরমশত্রু , কারণ তিনি হলেন প্রাণবায়ুর প্রতীক । এই প্রাণবায়ুই কুণ্ডলিনী শক্তিকে জাগরিত করে তার পাত্র অর্থাৎ পরমাত্মার কাছে অর্থাৎ রামের কাছে নিয়ে যেতে সাহায্য করে । হনুমান লঙ্কা দাহ করেছিলেন । এর অর্থ মূলাধারে তেজ সৃষ্টি করে সেই তেজ বা তাপের সাহায্যে কুণ্ডলিনী শক্তিকে উধের্ব উঠিয়েছিলেন ।
***#এইভাবে সমগ্র রামায়ণ কাহিনীই যৌগিক প্রতীকী ভাষায় সাধকের সুবিশাল রহস্যময় অভিজ্ঞতা।
#জয় শ্রী রাম
পরমহংস যোগানন্দ গিরি এর "Songs of the Soul" হতে ১০টি কবিতার অনুবাদ
THE NOBLE NEW
Sing songs that none have sung,
Think thoughts that in brain have never rung,
Walk in paths that none have trod,
Weep tears as none have shed for Lord,
Love all with love that none have felt, and brave
The battle of life with strength unchained,
Give peace to all to whom none other gave,
Claim him your own who is e'er disclaimed.
নব উদারতা
গাও সেই গান; যা কেউ গায়নি
ভাবো সেই ভাবনা; যা কেউ ভাবেনি
হাটো সেই পথে; যেখানে কেউ হাটেনি
কাদোঁ ঈশ্বের জন্য; যেমন করে কেউ কাঁদেনি।
সবটুকু দিয়ে ভালোবাসো, যা কেউ অনুভবে সাহস করেনি
জীবন যুদ্ধে পরাক্রমে নিজেকে বন্ধন মুক্ত করো।
সবাইকে এমন শান্তি দাও, যা কেউ দেয়নি
তাকে নিজের করে অর্জন কর, যা কেউ করেনি।
***************
FOR THEE AND THINE
I love to seek
What's mine.
I think, I act
I work with tact
To gain what's mine.
I pass by th' river
In joyous quiver
To soothe this mind of mine.
I smell the flowers
To cheer the hours,
I love to have what's mine.
I sip the gold sunshine
To warm this flesh of mine.
I drink the fresh and flowing air,
For me I lift my prayer,
I try to rake
The world to take
All things for me and mine.
Those dark days are gone,
The old time 's flown,
So lived for me and mine;
In new-born light
I see what's right,
To live for Thee and Thine.
তোমার এবং তোমার জন্য বেঁচে থাকা
আমি খুঁজতে ভালোবাসি,
যা আমার নিজের
আমার মনে হয়, আমি ভান করছি।
আমি কৌশলে কাজ করি
অর্জন করতে; যা আমার।
আমি নদীর পাড়ে হেঁটে যাই
স্ফুরিত আনন্দের সাথে।
আমার মনকে শান্ত করতে;
আমি ফুলের গন্ধ নিই,
এই সময়কে উপভোগ করতে;
আমি আমায় অনুরক্ত।
আমি চুমুক দেই রক্তিম সূর্যাস্তের আভায়,
আমি নিজেকে করি প্রানবন্ত।
আমি পান করি স্রোতে ভাসা বিশুদ্ধ বাতাস,
আমি নিজের জন্য প্রার্থনা করি
আমি আরোহনের চেষ্টা করি
এই পৃথিবী গ্রহন করুক
আমার সবকিছু।
সেইসব অন্ধকার দিনগুলো হারিয়েছে,
পুরোনো সময় পেরিয়ে গেছে।
শুধু আমার নিজের জন্য বেঁচে থাকা
এক নতুন আলোয়,
আমি জানি, আমি ঠিক
তোমার ও আমার জন্য বেঁচে থাকা।
***************
THE BLOOD OF ROSE
I tore the rose,
I bled its slender stem,
Its petals quivered
And I shivered;
Yet I dared to rob its smell!
My heart did break and tell,
"Thy hands are soiled," and mute I stood,
Thus self-condemned and stained with rose's blood.
But I know now,
I love the rose
More than its wealth, and vow
Ne'er its love to desecrate or lose.
গোলাপের রক্ত
আমি গোলাপটিকে ছিঁড়েছিলাম
তার নরম বোটা দিয়ে রক্ত ঝরিয়েছিলাম,
এর পাতা স্ফুরিত হয়েছিলো
এবং আমি শিহরিত হয়েছিলাম।
তবুও গন্ধ কেড়ে নেয়ার দুঃসাহস করেছিলাম
আমার হৃদয় ভেঙে গেলো আর বললো, "তোমার হাতগুলো নিষ্ঠুর" এবং আমি মৌনতায় দাড়িয়েছিলাম
সেই কলংকিত গোলাপের রক্ত আমাকে ধিক্কার জানিয়েছিলো।
কিন্তু এখন আমি জানি
আমি গোলাপটিকে ভালোবাসি,
এর প্রাচুর্যতা ও প্রতিশ্রুতি থেকেও
যার ভালোবাসা অপবিত্র হয়ে হারাবার নয়।
***************
MY NATIVE LAND
The friendly sky,
Inviting shades of banian tree.
The holy Ganges flowing by,
—
How can I forget thee!
I love the waving corn
Of India's fields so bright.
Oh, better than those Heav'nly grown
By deathless gods of might.
My soul's broad love so grand
Was born here first below,
—
In my own native land.
On India's sunny soil aglow
I love thy breeze,
I love thy moon,
I love thy hills and seas,
In thee I wish to cease, or swoon.
Thou taught'st me first to love
Thy sky, the stars, the God above;
So my first homage meets,
India, at thy feet!
From thee I now have learn' d to see. To love all lands alike as thee;
1 bow to thee, my native land.
The Mother of my love so grand.
আমার জন্মভূমি
হে প্রিয় আকাশ!
বটছায়া আমায় জানায় আমন্ত্রণ,
পবিত্র গঙ্গাস্রোত বয়ে যাওয়া
সেইসব নয় ভেলার মতন।
আমি ভালোবাসি দোলায়িত শস্য
চীর আনন্দময় সেই চারনভূমি,
তা যেনো স্বর্গীয় আলো থেকেও পূর্নতা প্রাপ্ত
যেনো মৃত্যুহীন শক্তির দেবতা তুমি।
হৃদয়ের অফুরন্ত ভালোবাসায় তা মহীয়ান
এই পৃথিবীতেই প্রথমবার জন্মেছিলো,
আমার স্বদেশ-ভূমি ভারতের যে পবিত্র মাটি তারে দিলো আলো।
আমি ভালোবাসি তোমার বাতাস
আমার ভালোবাসা তোমার চন্দ্রাঁকায়,
ভালোবাসি তোমার পাহাড় সমুদ্র
আমি অভুভূত তোমার শান্ত বিমুগ্ধতায়।
তুমিই প্রথম শিখিয়েছিলে ভালোবাসতে
হে ঈশ্বর! তোমার আকাশ, তোমার তাঁরা,
গ্রহন করো আমার স্বশ্রদ্ধ অভ্যর্থনা
হে ভারত! আমি তোমার চরনে আত্মহারা।
তোমার থেকেই আমি দেখতে শিখেছি
সকলের তরে সমভালোভাসা, সেতো তোমারই দান,
হে জন্মভূমি! তোমার তরে আমি মাথানত করি
আমার ভালোবাসার মাতৃভূমি, তুমিই মহান।
****************
TOO NEAR
I stood in silence
To worship Thee
In the temple large
With blue etheric dome,
Lighted by the spangling stars.
Shining with the lustrous moon.
Tapestried with the golden clouds,
Where reigns no dogma loud.
I prayed and waited
For Thee to come. I cried,
—
Thou didst not come.
I will wait no more,
Nor send my feeble prayer
Footsteps Thine to hear,
—
They are not heard without.
In me Thou art,—too near.
খুব কাছে
আমি নীরবতায় দাড়িয়েছিলাম
তোমার বন্দনায়,
বিশাল মন্দিরের মাঝে
সীমাহীন নীল প্রাসাদের চূড়ায়।
প্রজ্বালিত তাঁরাগুলো আলো ছড়িয়েছিলো
দীপ্তিময় প্রদীপ্ত চাঁদের আলোয়,
আড়ালে ঢাকা ছিলো সোনালী মেঘ
যে রাজ্যে অনুশাসনের নেই কোলাহল।
আমি প্রার্থনা শেষে অপেক্ষা করেছিলাম
তুমি আসবে বলে- অশ্রুপাত করেছিলাম,
তুমি আসোনি।
আমি আর অপেক্ষা করবো না,
না আর দূর্বল প্রার্থনা জানাবো
তোমার পদধ্বনি শোনার অপেক্ষায়,
তাদের আর অন্য কোথায় শুনতে পাইনি
আমার মাঝেই তুমি- খুব কাছেই।
****************
THOU IN ME
When I smile
Thou dost smile through me;
When I cry
In me Thou dost weep,
When I wake
Thou greetest me.
When I walk
Thou art with me.
Thou dost smile and weep,
Thou dost wake and walk
Like me; my Likeness Thou:
But when I dream,
Thou art awake;
When I stumble.
Thou art sure;
When I die
Thou art my life.
আমার মাঝে তুমি
যখন আমি হাসি
আমার মাঝে তুমিও হাসো,
যখন আমি কাঁদি
আমার মাঝে তুমিও কাঁদো।
যখন আমি জেগে উঠি
তুমি অভিবাদন জানাও,
যখন আমি হাঁটি
তুমি আমার সাথেই থাকো।
তুমি হাসো ও কাঁদো,
তুমি জেগে ওঠো ও হেটে বেড়াও
আমার মতো, আমার সব ভালোলাগাই তোমার।
কিন্তু যখন আমি স্বপ্ন দেখি
তোমার সৃষ্টি জেগে থাকে,
যখন আমি হোঁচট খাই
তোমার নৈপুন্যই নির্ভরতা।
যখন আমি থাকবো না
তোমার সৃষ্টিতেই আমার বেঁচে থাকা।
****************
EVASION
When I do almost see Thee
Thou dost suddenly vanish;
When Thou art almost trapped in me
I find Thee gone.
When I think I have seized Thee
Thou dost most escape.
How long this hide and seek, and play?
I am weary with the toil of the day;
Still I may brook this evasion Thine
If 'tis for a tiny flash of time,
That in the end I may see
Thy face with doubled joy and mind more free.
ছলনা
যখন তোমায় প্রায় দর্শন করে ফেলেছি,
তুমি তখনই অদৃশ্য হলে;
যখন তোমার রহস্য ঠিক ধরে ফেলি,
ঠিক তখনই যাও চলে।
যখনই ভাবি তোমায় ধরে ফেলেছি,
তখনই তুমি যাও পালিয়ে ;
কতদিন আর এই লুকোচুরি খেলা?
চেষ্টার ফাদেঁ পরে আমি দিন শেষে ক্লান্ত,
এখনো আমি তোমার ছলনায় পথভ্রান্ত;
যদি এটা মহাকালের ক্ষণিকের আকস্মিকতা হয়,
এর শেষে আমি হয়তো দেখবো
তোমার চেহারায় দ্বিগুন আনন্দ আর মুক্ত মনে যা রয়।
*****************
THEY ARE THINE
I have nothing to offer Thee,
For all things are Thine;
I grieve not that I can not give,
For nothing is mine, for nothing is mine:
Here I lay at Thy feet
My limbs, my life, my thoughts and speech.
For they are Thine, for they are Thine.
তারা সকলেই তোমার
তোমায় অর্পন করার আমার কিছুই নেই,
কারন সবইতো তোমার।
আমি শোকার্ত নই যে, আমি কিছু দিতে পারছি না
কারন কিছুই নয় আমার, কিছুই নয় আমার।
তোমার চরনে নিজেকে করি সমর্পণ -
আমার অবয়ব, আমার জীবন, আমার চিন্তা, আমার কথা
সবইতো তোমার, সবইতো তোমার।
******************
WHISPERS
Leaves do sigh,
They can not speak
Of One That 's high.
The birds do scream,
They can not sing
What in their bosom springs.
The beasts do howl
In sadness foul,
They can never say as nigh
As doth in their feelings lie.
Since I can sing or say or cry
I will mighty try
To pour out whispers Thine,—one and each
That to heart doth softly reach.
ফিসফিস
পাতাগুলো দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে
তারা বলতে পারে না,
এক উচ্চবৃক্ষের উপরে
পাখিরা আর্তনাদ করে
তারা গাইতে পারে না।
তাদের প্রিয় বসন্তেও
পশুরা গর্জন করছে,
তারা অপবিত্র দুঃখভারাক্রান্ত;
তারা কাছাকাছি হতে পারছে না
তাদের পাপের অনুভূতির তাড়নায়।
তবুও আমি গাইতে বা বলতে বা কাঁদতে পারি
আমি সাহসী প্রচেষ্টা করবো
তোমাদের প্রতিটি ফিসফিস দিবো দূরে সরিয়ে,
হৃদয় দিবো কোমলতায় ভরিয়ে।
******************
CONSECRATION
At Thy feet I come to shower
All my full heart's rhyming flower,
Of Thy breath born.
By Thy love grown.
With my lonely seeking found.
By hands Thou gavest picked and bound;
—
For Thee the sheaves
Within these leaves:
—
Of my life's season
The choicest flowers,
With petals soulful spread.
Their humble perfume shed;
—
Hands folded now I come to give
What's Thine—receive!
উৎসর্গ
অবগাহনে এসেছি আমি তোমার চরন তলে,
সমগ্র হৃদয় আমার ফুলের ছন্দে দোলে।
তোমার প্রতিটি সৃষ্টির জন্ম হয়,
ভালোবাসার পূর্নতায়।
আমার মনোহর চাওয়ায় খুঁজে পেয়েছিলাম
নিজ হাতে তুমি দিয়েছিলে শ্রেষ্ঠতার সীমানা,
তোমার সমগ্র শস্যে
এইসব পাতারা;
আমার এই জীবনকালে
এই অসাধারণ ফুলেরা
যার পাপড়িগুলো গভীরতায় ছড়িয়ে,
দিলো তারা নিরহংকার সৌরভে ভরিয়ে।
নিবেদন করছি তোমায় করজোরে,
তুমি তা নিও স্বীকার করে।
.........★.......★.........★........
Continue-34
***#যোগীর দৃষ্টিতে শ্রী শ্রী চন্ডী
চণ্ডীতে দেবী পাঁচটি অসুবাকে বধ করেছিলেন। এরা হচ্ছে- মধু , কৈটভ , মহিষাসুর এবং শুম্ভ ও নিশুম্ভ ।
***#এই পাঁচটি অসুর মূলত পঞ্চ স্থূল তত্ত্ব অর্থাৎ ক্ষিতি , অপ , তেজ , মরুৎ ও ব্যোম । ক্ষিতি হল মধু এবং অপ হল কৈটভ । তেজ হল মহিষাসুর, মরুৎ হল নিশুম্ভ ও ব্যোম হল শুম্ভ । আসলে এটি অসুরদের সাথে দেবীর সংগ্রাম নয় , মানুষের কুপ্রবৃত্তির সাথে দিব্যশক্তির সংগ্রাম ।
***#সমগ্ৰ চণ্ডীই হল দিব্য জগতে প্রবেশের জন্য সাধকের নিজের বৃত্তির সঙ্গে সংগ্রাম , কুলকুণ্ডলিনী জাগরণের সংগ্রাম । মানুষের বৃত্তি তার মেরুদণ্ডের রন্ধ্রপথে তিনটি স্থানে শক্তির উধর্বগতিতে প্রবল বাধা সৃষ্টি করে থাকে। যেমন- মূলাধার থেকে স্বাধিষ্ঠান অঞ্চলের মধ্যে ব্রক্ষ্মগ্রন্থি। কুলকুণ্ডলিনী এই গ্রন্থি অতিক্রম করতে পারলে মধু ( মূলাধার ) ও কৈটভ ( স্বাধিষ্ঠান ) চক্ররূপ প্রতিবন্ধকতা দূর হয় ।
***#দ্বিতীয় বাধা থাকে মণিপুর ও অনাহত চক্রের মধ্যে অনাহতের কাছাকাছি অবস্থাতে , যাকে বলে বিষ্ণু গ্রন্থি । এই চক্র ভেদ করতে পারলে মানুষ আপন শক্তি সম্পর্কে অহংকার বিস্মৃত হয় ( মণিপুরের তেজ ও অনাহত চক্রের বায়ুমণ্ডল উভয়ই শক্তিদ্যোতক )। আজ্ঞা চক্র অঞ্চলে অর্থাৎ ভূমধ্যস্থ অঞ্চলে রয়েছে দিব্যজগতে প্রবেশের শেষ বাঁধা । এই বাঁধার নাম রুদ্রগস্থি । এই গ্রন্থি পার হতে পারলেই অর্থাৎ কুলকুণ্ডলিনীকে এই গ্রন্থি পার করাতে পারলেই সাধক ব্যোমতত্ত্ব ও সূক্ষ্ম ব্যোম তত্ত্ব অঞ্চল অতিক্রম করতে পারেন । তখন প্রকৃতির খেলা শেষ হয় ।
***#ক্ষিতি , অপ , তেজ , মরুৎ ও ব্যোমাদি পঞ্চ তত্ত্ব অতিক্রম করে সাধক শক্তিবৃত্তের বাইরে অতিশূন্যতা পর্যায়ে চলে যান । তিনি আর শক্তির অধীন থাকেন না । শক্তিই তাঁর অধীন হন। অর্থাৎ সাধক গুণাতীত পুরুষে পরিণত হন , যাঁর গুনই হল শক্তি । সে জন্যই চণ্ডীতে দেবীর মুখে শুম্ভ নিশুম্ভকে লক্ষ্য করে এই কথা বলা হয়েছে -
" যো মাং জয়তি সংগ্রামে যাে মে দর্পং ব্যপোহতি ।
যো মে প্রতিবলো লােকে স মে ভর্তা ভবিষ্যতি ।। "
অর্থাৎ, যিনি আমাকে সংগ্রামে পরাজিত করবেন, যিনি আমার দর্প চূর্ন করবেন, যিনি জগতে আমার তুল্য বলশালী ( অব্যক্ত মায়া পুরুষেরই সমার্থবােধক ) তিনিই আমার পতি হবেন।
***#চণ্ডীতে কোন সাধকই সাধন - সংগ্রামে দেবীকে পরাজিত করতে পারেন নাই । কিন্তু পারেন নাই বলে কেউ পারবেন না এমন নয়। অনেক যোগীগণই তা পেরেছিলেন।
#পুরীর_জগন্নাথ
***#পুরীর জগন্নাথ দেবের মন্দিরের মূর্তি তিনটি লক্ষ্য করে দেখুন, দেখবেন প্রায় একই ভাব । অপরিবর্তনীয় সৎ জগন্নাথ চিৎশক্তিস্বরূপ বলরাম দ্বারা কর্ষিত হয়ে মহাপ্রকৃতিরূপা সুভদ্রা হয়ে ফুটে উঠেছে । কিন্তু এঁদের কারােই হাত পা চোখ মুখ পূর্ণতা লাভ করেনি । কারন, মহৎ ভাব প্রকাশ করার জন্যই এমন করা হয়েছে ।
***#ভাবটি এই ~ যিনি সর্বত্র প্রসারিত তার পায়ের প্রয়ােজনীয়তা নেই । যিনি সর্বকর্মের উৎস আর হাতের প্রয়ােজন নেই । সর্বত্র যাঁর দৃষ্টি তার চোখের প্রয়ােজন নেই যিনি সর্বভূক তার মুখ অপ্রয়ােজনীয়।
***#এই যে নিত্য , অপরিবর্তনীয় সর্বব্যাপ্ত রুপ তা নিজেকে অবিকৃত রাখলেও তার মধ্যে গুণের কর্ষণ চলে , মহা প্রকৃতির উদ্ভব হয় । এই অসমাপ্ত মূর্তিক্রয়ের মধ্যে এক বিরাট ভাব লুকিয়ে আছে।
সপ্তচক্রের রঙ
মেরুদন্ডের বিভিন্ন চক্রে শক্তি গিয়ে পৌছুলে কি ধরনের রঙ দেখা যায় , তা এই চক্রগুলির শক্তি তৈরির ক্ষমতা থেকেই বােঝা যায়। এই শক্তিগুলি বোঝাবার জন্য , বিভিন্ন সূত্রে বিভিন্ন সংখ্যার জপ দিয়ে এবং তাতে সংস্কৃত একান্নটি বর্নের সমাবেশ ঘটিয়ে তা বােঝাবার চেষ্টা করেছেন। এই হিসেবে নিম্নভাবে চক্রগুলি ও তাদের দল উল্লেখ করা হলঃ
(১) মুলাধারঃ চতুর্দল। চতুদর্লে চারটি সংস্কৃত বর্ণ আছে-- বং , শং , ষং , সং । এই বর্ণগুলি নিজস্ব রঙ ও ফ্রিকোয়েন্সি মিলিয়ে সর্বসাকুল্যে যে রঙ তৈরি করে তা হল লাল রঙ। এর মূল হল হলুদ বর্ণ।
(২) স্বাধিষ্ঠানঃ ষড় দল। এই ষড় ছয় দলে যে বৰ্ণ বসানাে আছে তা হল — লং , রং , ভং , মং , যং , রং। বিমর্নগুলির নিজস্ব বর্ণ ও ফ্রিকোয়েন্সি মিলিয়ে সর্বসাকুল্যে যে রঙ তৈরি হয় , তা হল সবুজাভাব।
(৩) মণিপুরঃ দশ দল। দশ দলে সংস্কৃত দশটি বর্ণ আছে এই — ডং , ঢং , শং , তং , থং , দং, ধং , নং, পং , ফং। এই বর্নগুলি নিজস্ব রঙ ও ফ্রিকোয়েন্সি মিলিয়ে য়ে রঙ তৈরি করে তা হল মধ্যাহ্ন আকাশে তেজোময় দীপ্তিসম্পন্ন মেঘের মতাে
(৪) আনাহতঃ দ্বাদশ দল। এই দলগুলিতে সংস্কৃত বর্ণ আছে , এইভাবে কং, খং, গং, ঘং, ঙং, চং, ছং , জং , ঝং , ঞ্চং , টং , ঠং। এর ফলে যে রঙ তৈরি হয় তা হল আকাশী নীল।
(৫) বিশুদ্ধ চক্রঃ
ষোড়শ দল। এই ষোড়শ দলে আছে সংস্কৃত ষােলটি বর্ণ । যেমন- অং , আং, ইং, ঈং , উং , ঊং , ঋং,
এং , ঐং , ওং , ঔং , অং , অঃ এবং আরো তিনটি। এই বর্ণগুলির নিজস্ব বর্ন ও ফ্রিকোয়েন্সি সর্বসাকুল্যে যে রঙ তৈরি করে তা হল গাঢ় নীল বর্ণ।
(৬) আজ্ঞাচক্রঃ এর আছে দ্বিদল। দ্বিদলে আছে হং এবং ক্ষং বর্ণ। মধ্যস্থলে বৃত্তাকার বেষ্টনীর মধ্যে আছে আদি শব্দ ওঁ। এই দুই বর্ন মিলে রঙ তৈরি করে তা হল বিস্ফোরণতুল্য দ্যুতি।
(৭) সহস্রারঃ এর তিনটি স্তর আছে। নীচের দিক থেকে উপরের দিকে- আনন্দ ( জ্যোতি ) + চিৎ ( দর্পন) + সৎ (মহাশূন্যতারূপী অন্ধকার )। এ জায়গায় বর্ণরূপে আদি শক্তি সৎ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে কোন ফ্রিকোয়েন্সি তৈরী করেনি, তাই একখানকার শক্তি ঈ বর্ন বোঝাবার জন্য কোন সংস্কৃত বর্ন ব্যবহার করা হয়নি। বর্নের উৎপত্তি সহস্রারের নিম্ন অংশ থেকে।
সপ্তচক্রে সপ্তদেবী
সপ্তচক্রের প্রতিটি চক্রের শক্তির প্রতিনিধি হিসেবে বিভিন্ন দেবী শক্তির কল্পনা করা হয়েছে। দেবী কল্পনা করা হয়েছে এই কারণে যে, শক্তি মূলত স্ত্রীলিঙ্গ হিসেবে কল্পিত। বিভিন্ন চক্রে শক্তির নাম ও পরিচয় এই ধরনের দেয়া হলো।
(১) মুলাধারঃ এখানে শক্তির দেবীর নাম ডাকিনী। তিব্বতের ডাক শব্দ থেকে ডাকিনী শব্দ এসেছে। ডাক অর্থ জ্ঞান। ডাক অর্থ রমনী। এই চক্রে প্রথম জ্ঞানের উদয় হয়। ভিন্ন মতে এই শক্তির নাম শাকিনী। সংস্কৃত 'শক' বা শক্তি থেকে শাকিনী শব্দ এসেছে। এই শক্তিকে অনেকে বলেন কামশক্তি। মুলাধারে আছে অস্থিধাতুব শক্তি।
(২) সাধিষ্ঠানঃ
স্বাধীষ্ঠান চক্রের দেবী শক্তির নাম রাকিনী। রাকিনী হলেন মধ্যমা শক্তি। রাকিনী মেদ ধাতুর শক্তি।
(৩) মণিপুর চক্রঃ
এই চক্রের দেবীশক্তির নাম হল লাকিনী। বর্ন শক্তি বিচারে প্রচণ্ড তেজোময় শক্তি। বেীদ্ধ মতে ক্ষুধাতুরা শক্তি। ইনি মাংস ধাতুর শক্তি।(৪) অনাহত চক্রঃ
এই চক্র দেবীশক্তির নাম কাকিনী। ইনি মধ্যমা শক্তি। তিনি রক্তধাতুর শক্তি। হৃদপিন্ডই
রক্তের মূল স্থান।
(৫) বিশুদ্ধচক্রঃ
এই চক্রের দেবীশক্তির নাম শাকিনী। ইনি একধরনের স্নিগ্ধশক্তির প্রতিনিধি। বৌদ্ধরা একে বলেন সুবেশা যােগিনী। অর্থাৎ সুসন্নিবেশিতা যােগশক্তি। দেহের কুণ্ডলিনীশক্তি এখানে উঠলে নিবিড় নীল রঙ চোখে পড়ে, যে রঙ স্নিগ্ধতায় ভরা।
(৬) আজ্ঞা চক্রঃ
এই চক্রের দেবীশক্তির নাম হাঁকিনী। বৌদ্ধরা বলেন চিৎকারকারিণী। এখানে একধরনের বিস্ফোরণ জনিত ভাব লক্ষ্য করা যায়। ফলে হাঁক জাতীয় শব্দ হয়। আসলে ওঁ শব্দ তো বিস্ফোরণ জাতীয় ব্যোম শব্দ থেকেই এসেছে। এই শক্তিকে অনেকেই মজ্জাধাতুর শক্তি বলে মনে করেন। মূলত মজ্জাশক্তিই আসল শক্তি। কারণ মেরুনণ্ডের শক্তিই মানবের আসল শক্তি । (৭) সহস্রারঃ
এখানে সহস্ৰ দল পরে পদ্মের কল্পনা করা হয়েছে। এর দ্বারা এমন ফিকোয়েন্সি বােঝানাে হয়েছে, যা বহুমাত্রিক। সহস্রার তিন ভাগে বিভক্ত। নিম্ন থেকে উধর্বদিকে প্রথম রয়েছে আনন্দ অংশ। এই অংশের শক্তির নাম হ্লাদিনী। এর উপরে রয়েছে চিৎ অংশ। এই অংশের শক্তির নাম চিৎরুপিণী বা সম্বিত। শক্তি এখানে শূন্যের সঙ্গে শূন্য অবস্থায় এমন করে সন্ধি করে আছে যে, এক শলে সন্ধিনী।
Continue-35
কুলকুণ্ডলিনী বিজ্ঞান
মহাশূন্যতার বুকে যে কোনােভাবেই হােক প্রথম একটা বিস্ফোরণ ঘটেছিল । বিস্ফোরণের বেগ প্রথমদিকে ছিল অত্যন্ত বেশি । ফলে এইসময় দেশ ও কাল মিলে যে অবস্থার সৃষ্টি হয় , তা হল অতিসূক্ষ্ম অবস্থা । এই সূত্র জগৎকেই বলা যায় মাল্টিডাইমেনশনাল জগৎ । শেষপর্যন্ত তা আমাদের চোখে যে স্থূল জগৎ , সেই স্থূল জগত হিসেবে দেখা দেয় । এই স্থূল জগৎটাই আমাদের ত্রিমাত্রিক জগৎ । এখানকার প্রাণিকুলও ত্রিমাত্রিক । আমরা সেইজন্য ত্রিমাত্রিক জগৎটাকে যত সহজে বুঝতে পারি , এর ওপর কোনো বেশি মাত্রার জগত থাকলে তাকে তেমন বুঝতে পারি না । কিন্তু আমাদের নীচে যদি কোনাে দ্বিমাত্রিক জগৎ , থাকত , আমরা সহজেই তাকে বুঝতে পারতাম । কিন্তু এই দ্বিমাত্রার প্রান্তে কোনো জীব থাকলে আমাদের বুঝতে হিমসিম খেয়ে যেত । কল্পনাই করতে পারত না যে , তাদের মাত্রার উর্ধমাত্রারও কোনাে জগৎ আছে , আমরা যেমন অনুমান করতে পারি না যে , আমাদের মাত্রার উর্ধ্বমাত্রারও কোনাে জগৎ আছে । কিন্তু বিজ্ঞানীরা অনুমান করেন যে , আমাদের মাত্রার উর্ধ্বমাত্রিক জগৎও আছে । এমন
উর্ধ্বমাত্রার জগতও
থাকতে পারে , যেখানে আমাদের জগতে যা সবচেয়ে গতিশীল সেখানে তা স্থির প্রতীয়মান হতে পারে , যেমন — আলাে ।
এই উর্ধ্বমাত্রার
প্রাণীরাও উর্ধ্বমাত্রার।
নিম্ন থেকে উর্ধ্ব দিকে
এই মাত্রার পরিমাণ বেশি । ফলে সেখানকার জগৎ ও প্রাণীর আরও সূক্ষ্মতর। একেবারে নীচের দিকে ( অবশ্য আমাদের ত্রিমাত্রিক জগতের উর্ধ্বে ) ত্রিমাত্রার অধিক মাত্রার জগতে থাকে ভূতপ্রেত জাতীয় প্রাণী। তার উর্ধ্বে
বেশি ক্ষমতাসম্পন্ন প্রাণী । ক্রমশ যত উর্ধ্বে দিক , ততই বেশি সুক্ষ্ম ও বেশি ক্ষমতাসম্পন্ন প্রাণী । এঁদেরই বলা হয় দেবদেবী ।
যেভাবে এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টি , মানুষের দেহও ঠিক তেমনই ভাবে সৃষ্ট । এরও একটা মহাশূন্যতা অঞ্চল আছে । তাকে ঘিরেই ধীরে ধীরে মানুষের স্থূল দেহজগৎ গড়ে উঠেছে । বিগ ব্যাং এর উৎস যেমন শুন্যপ্রমাণ কোনাে স্থান, মানুষের দেহেরও প্রথম সৃষ্টি মস্তিষ্কের শুন্যপ্রায় কোন অঞ্চলে। বায়ো- সায়েন্স ভ্রুনের উৎপত্তি ও বৃদ্ধি বিচার করে একথাই , জানতে পেরেছে । এই অঞ্চলটিই মস্তিষ্কের ব্রহ্মরন্ধ্রস্থ কীন স্থান-
যোগীরা যাকে বলেন সহস্রারের কূটস্থান । এখন থেকেই ধীরে ধীরে নিম্নাঙ্গ পর্যন্ত মানুষের স্থূল দেহ গড়ে উঠেছে । বিশ্বব্রহ্মাণ্ড যেমন ধাপে ধাপে কেন্দ্র থেকে নীচে নেমে এসেছে । শক্তি তেমনই বিশ্বের কেন্দ্রস্থল থেকে প্রান্তে এসে কম ফ্রিকোয়েন্সির ত্রিমাত্রিক জগৎ হয়েছে , মানুষের দেহেরও উর্ধ্ব
অংশের ফ্রিকোয়েন্সি তেমনই নিম্ন অংশের ফ্রিকোয়েন্সি থেকে অনেক বেশি । জগতের প্রান্ত দেশ যদি কেন্দ্রের দিকে ফিরে যাওয়া যায় , তাহলে যেমন ক্রমশ বেশি ফ্রিকোয়েন্সির জগৎ দেখা যাবে , তেমনই মানুষের ইন্দ্রিয়ের নিম্নস্তর থেকে
উর্ধ্বদিকে এগােতে থাকলে ক্রম - সূক্ষ্ম সব জগৎ দেখা যাবে , যােগীরা মানুষের দেহতত্ত্বের এই রহস্য জানতে পেরেছিলেন বলে মানুষের দেহে শক্তির অবতরণ ও উত্তরণ সম্পর্কে কতকগুলি কেন্দ্রের কল্পনা করেছিলেন — এই কেন্দ্রগুলিকে বলে চক্র- তন্ত্রযোগের ষটচক্র
এই চক্রগুলো উর্ধ্ব থেকে নিম্ন দিকে এই ধরনেরঃ সর্বপ্রথম - মহাশূন্যতা- সহস্রারের কূটস্থান। তারপর নির্ভেজাল শক্তি প্রবাহের অঞ্চল পার হয়ে দ্বিতীয়বিহীন ‘এক' বোধ অর্থাৎ বিশুদ্ধ চৈতন্যের পর্যায় । এবং পরে জ্যোতির পর্যায় । একেই ভারতীয় আধ্যাত্মশাস্ত্রে বলে — সৎ ( মহাশূন্যতা) + চিৎ ( দ্বিতীয়বিহীন এক বােধ ) + আনন্দ ( জ্যোতি পর্যায় ) । এরপর থেকেই বিভিন্ন মাত্রার অঞ্চলে শক্তির অবতরণের পর্যায় । যেসব দুয়ার দিয়ে শক্তি এখানে নিম্নদিকে অবতরণ করেছে , সেই দুয়ারগুলিকে তন্ত্রযােগে বলা হয় চক্র। হিন্দু তন্ত্রযােগশাস্ত্রে এমনই ছয়টি চক্র আছে । উর্ধদিক থেকে নিম্নদিকে এই চক্রগুলি হল—
( ১ ) আজ্ঞাচক্র ,
( ২ ) বিশুদ্ধ চক্র ,
( ৩ ) অনাহতচক্র , ( ৪ ) মণিপুরচক্র , ( ৫ ) স্বাধিষ্ঠানচক্র ও ( ৬ ) মূলাধারচক্র ।
এই শেষ চক্রে এসেই শক্তি প্রায় নিষ্ক্রিয়া হয়ে আছে । যদি একে আবার উল্টোদিকে ফেরানো যায় , তাহলে যেসব সুপ্ত স্তর অতিক্রম করে সে নেমে এসেছে , একে একে সেই স্তরগুলি আবার শক্তির চৈতন্য-দৃষ্টিতে ধরা পড়বে । অর্থাৎ স্থূল জগৎ থেকে ক্রম-সূক্ষ্ম জগৎ তার নজরে পড়বে । যারা এই মূলাধারের শক্তিকে ফিরিয়ে উল্টোদিকে ওঠাতে পারেন , তারাই ক্রম-সূক্ষ্ম জগৎ দেখতে পান - সূক্ষ্ম প্রাণী দেখতে পন । এই সূক্ষ্ম প্রাণীরাই হলেন ভূত , প্রেত , উন্নত জীবাত্মা ও দেবদেবী । বিজ্ঞান এখন যন্ত্রের সাহায্যে এই সূক্ষ্ম জগৎ দেখার দুঃসাহস করছে । নানা ক্ষেত্রে সে সফল হয়েছে । এখন সে যন্ত্রের সাহায্যেই সময়কে জয় করে অতীত ও ভবিষ্যতে যাবার দুঃসাহস করছে । তত্ত্বের দিক থেকে তা সম্ভব বলেও মনে হচ্ছে। এখন শুধু হাতেনাতে ফলপ্রাপ্তিরই যা আপেক্ষা । বিজ্ঞান যে তত্ত্বের সাহায্যে এই অসম্ভবকে সম্ভব করতে উদ্যোগী হয়েছে , তার নাম Blackhole- তত্ত্ব । বিজ্ঞান যা সাহায্য করতে উদ্যোগী হয়েছে , মানুষ নিজের দেহযন্ত্রের কৌশল জেনে বহু আগেই তা সম্ভব করেছিল । যন্ত্র একাজ সম্ভব করতে উদ্যত হয়েছে শক্তির সাহায্যে । মানুষও তা সম্ভব করেছে শক্তিরই সহায্যে । বিজ্ঞানের এই শক্তির নাম Kinetic energy. মানুষের দেহস্থ এই শক্তিকে বলে কুলকুণ্ডলিনী শক্তি । সুতরাং দেবদেবীর রহস্য , দিব্যজগতের রহস্য যদি বুঝতে হয় , তাহলে এই কুলকুণ্ডলিনীর কথা স্পষ্ট করে বুঝতে হবে। দিব্যজগতের যথার্থ চরিত্র বুঝতে হলে , দেবদেবীদের যথার্থ অবস্থা বুঝতে হলে , এই কুলকুণ্ডলিনী সম্পর্কে স্পষ্ট জ্ঞান হওয়া দরকার ।
এই কুলকুণ্ডলিনীই কালের জন্ম করেছিলেন বলে কালী নামে পরিচিতা । কালের জন্মদাত্রী এই কালী কালকে অর্থাৎ সময়কে যেমন - তেমনভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন । যিনি দেহের অভ্যন্তরস্থ কুলকুণ্ডলিনীকে ইচ্ছামতাে পরিচালনা করতে পারেন , তিনিই কালের ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ লাভ করেন । তিনি ইচ্ছামতাে অতীতে যেতে পারেন , ইচ্ছামতো ভবিষ্যতেও যেতে পারেন । এটা যে শুধুই একটা রহস্যময় শক্তি তা নয় , বাস্তবে কুলকুণ্ডলিনীর অনুরূপ ভূমিকা পালন করে দেখিয়ে দেওয়া যেতে পারে । সুতরাং কুলকুণ্ডলিনী একটা বৈজ্ঞানিক সত্য বলে এখন প্রতীয়মান ।
ব্লাকহোল- কে যদি ভাষা দিয়ে বােঝাবার চেষ্টা করা হয় , তাহলে বলতে হবে যে , এ হল এক ধরনের বিশাল গর্ত- যে গর্তের সৃষ্টি হয়েছে তা কোনাে নক্ষত্র নিজের ভারে নিজেই তলিয়ে যাবার ফলে । এই গর্তে এমন বিপুল অভিকর্ষ যে , তার টানের মধ্যে পড়লে যে কোনাে বস্তু , পার্শ্বস্থ দেশ , সময় , আলাে , সবই হারিয়ে যায় । তার লৌহবেষ্টনীর বাইরে আর কিছুই বেরিয়ে আসতে পারে না । এখানে উর্ধ্ব, অধঃ, বাম, ডান বলে কিছুই নেই। এই যে অবস্থা , মানুষের দেহের কুলকুণ্ডলিনী শক্তি , সহস্রারের কৃটস্থানে গেলে দেহ-বিশ্বেও এই একই ধরনের অভিজ্ঞতা হয় । তখন চেতনা বলতে কিছু থাকে না । এই অবস্থা থেকেই কুলকুণ্ডলিনী শক্তি বহির্মুখী হয়েছিল। আবার বাইরে থেকে এই অবস্থার মধ্যেই ফিরে যায় । এই যাতায়াতের পথেই সময় কখনো আগে , কখনও পেছনে চলে যায় । আর সেই অনুপাতেই বিচিত্র সব দর্শন হতে থাকে । কারণ যে - কোনো ঘটনা তা সবসময়ই দেশ ও কাল দ্বারাই ঘটে। দেশ না থাকলে , কাল না থাকলে কোনাে ঘটনাও নেই । নিউটনের মাধ্যাকর্ষীয় শক্তির তত্ত্ব থেকেই এই বিশাসে এসেছিলো যে , কোনাে নক্ষত্রের ঘনত্ব যদি আমাদের পৃথিবীর ঘনত্বের মতোও হয় , তবে তার মাধ্যাকর্ষীয় শক্তি এত প্রবল হবে যে , তা থেকে আলো বেরিয়ে আসতে পারবে না । ব্লাকহোল প্রচণ্ড কোনাে বিস্ফোরণজাত নয় । বরং অনন্ত আকর্ষণীয় অন্ধকার মাত্র । এই অন্ধকারই হল গর্ত , যাতে বস্তুপুঞ্জ এমনভাবে আকর্ষিত হয়ে ঢুকে পড়ে যে , আন্তর - আকর্ষণের চাপে কল্পনাতীতভাবে ঘনীভূত হয়ে যায় । দেশ ও সময় সাধারণভাবে সমল । কিন্তু যদি এর মধ্যে কোনো ভারী বস্তু সত্তার উদয় হয় , তবে তার চারদিকে দেশ ও সময় বেঁকে যায় । তবে এই বস্তুপুঞ্জের আন্তর- অভিকর্ষ যিদি প্রচন্ড রকমের হয় , তাহলে শূন্যতাকে বেঁকেচুরে , দুমড়ে , সময়কে নুইয়ে দিয়ে প্রচণ্ড কৃষ্ণগহৰর সৃষ্টি করতে পারে , যে - কৃষ্ণগহবর তার চারপাশের দেশ ও সময়কেও তার মধ্যে টেনে নিয়ে যাবে । প্রথম দিকে দেশের বক্রতার জন্য সোজা- সবলভাবে সেখানে চলা যাবে না , সময়ের গতিরও হেরফের ঘটে যাবে ।
মহাবিশ্বের এ মহাবিশাল মানস কারিগর মানুষেরই গঠন - শৈলীতে যে যন্ত্র তৈরি করেছেন মানুষ যদি সেই গঠন - শৈলী নিজে অর্জন করতে পারে , মানুষ যদি নিজের হাতে মানুষ তৈরি করতে পারে , তবে সেই মানুষই বলে দেবে মহাবিশ্বজগতের চরিত্র কি , কোথায় রয়েছে , তার কোন প্রান্ত এবং কোথায়ই বা কি ধরনের দেশকাল ও প্রাকৃতিক নিয়মাবলী । মানুষ বুদ্ধিমান হলে যন্ত্রে আর মানুষ তৈরি করতে যাবে না —- যে রহস্যময় যা সে নিজেই সেই দেহটিকে ব্যবহার করলেই পেয়ে যাবে মহাবিশ্বের ঠিকনা । এজন্য যা প্রয়ােজন , তা হচ্ছে যোগ । যােগে কুলকুণ্ডলিনীকে জাগানাে গেলে তা বিচিত্র এই মহাবিশ্বের ঠিকানা মানুষকে দিবে। বৈজ্ঞানিকেরা যে ধরনের অনুমান করছেন , যােগে কুলকুণ্ডলিনী জাগরিত হলে মানুষ নিজের অন্তর্জগতেই সে সব দেখতে পাবে। যোগের সাহায্যে যা জানা যাবে তা সরাসরি সত্য,
অনুমনসাপেক্ষ নয় । সর্বাপেক্ষা বড় ব্ল্যাকহােল হল মহাশূন্যতা — যেখানে সময় নেই , দেশ নেই , আলাে নেই , অন্ধকার নেই , অথচ সবই আছে। মানুষ নিজের মনের মধ্যে ডুব দিলেই সেই যথার্থ এবং আদি ব্লাকহােলের সন্ধান পাবে । কার্তিকের মতাে বিশ্ব না ঘুরে গণেশের মতাে অপন গহন অন্তঃপুরের প্রাণসত্তাকে পরিক্রমা করা অনেক সহজ ।
কুলকুণ্ডলিনী বিজ্ঞান
মহাশূন্যতার বুকে যে কোনােভাবেই হােক প্রথম একটা বিস্ফোরণ ঘটেছিল । বিস্ফোরণের বেগ প্রথমদিকে ছিল অত্যন্ত বেশি । ফলে এইসময় দেশ ও কাল মিলে যে অবস্থার সৃষ্টি হয় , তা হল অতিসূক্ষ্ম অবস্থা । এই সূত্র জগৎকেই বলা যায় মাল্টিডাইমেনশনাল জগৎ । শেষপর্যন্ত তা আমাদের চোখে যে স্থূল জগৎ , সেই স্থূল জগত হিসেবে দেখা দেয় । এই স্থূল জগৎটাই আমাদের ত্রিমাত্রিক জগৎ । এখানকার প্রাণিকুলও ত্রিমাত্রিক । আমরা সেইজন্য ত্রিমাত্রিক জগৎটাকে যত সহজে বুঝতে পারি , এর ওপর কোনো বেশি মাত্রার জগত থাকলে তাকে তেমন বুঝতে পারি না । কিন্তু আমাদের নীচে যদি কোনাে দ্বিমাত্রিক জগৎ , থাকত , আমরা সহজেই তাকে বুঝতে পারতাম । কিন্তু এই দ্বিমাত্রার প্রান্তে কোনো জীব থাকলে আমাদের বুঝতে হিমসিম খেয়ে যেত । কল্পনাই করতে পারত না যে , তাদের মাত্রার উর্ধমাত্রারও কোনাে জগৎ আছে , আমরা যেমন অনুমান করতে পারি না যে , আমাদের মাত্রার উর্ধ্বমাত্রারও কোনাে জগৎ আছে । কিন্তু বিজ্ঞানীরা অনুমান করেন যে , আমাদের মাত্রার উর্ধ্বমাত্রিক জগৎও আছে । এমন
উর্ধ্বমাত্রার জগতও
থাকতে পারে , যেখানে আমাদের জগতে যা সবচেয়ে গতিশীল সেখানে তা স্থির প্রতীয়মান হতে পারে , যেমন — আলাে ।
এই উর্ধ্বমাত্রার
প্রাণীরাও উর্ধ্বমাত্রার।
নিম্ন থেকে উর্ধ্ব দিকে
এই মাত্রার পরিমাণ বেশি । ফলে সেখানকার জগৎ ও প্রাণীর আরও সূক্ষ্মতর। একেবারে নীচের দিকে ( অবশ্য আমাদের ত্রিমাত্রিক জগতের উর্ধ্বে ) ত্রিমাত্রার অধিক মাত্রার জগতে থাকে ভূতপ্রেত জাতীয় প্রাণী। তার উর্ধ্বে
বেশি ক্ষমতাসম্পন্ন প্রাণী । ক্রমশ যত উর্ধ্বে দিক , ততই বেশি সুক্ষ্ম ও বেশি ক্ষমতাসম্পন্ন প্রাণী । এঁদেরই বলা হয় দেবদেবী ।
যেভাবে এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টি , মানুষের দেহও ঠিক তেমনই ভাবে সৃষ্ট । এরও একটা মহাশূন্যতা অঞ্চল আছে । তাকে ঘিরেই ধীরে ধীরে মানুষের স্থূল দেহজগৎ গড়ে উঠেছে । বিগ ব্যাং এর উৎস যেমন শুন্যপ্রমাণ কোনাে স্থান, মানুষের দেহেরও প্রথম সৃষ্টি মস্তিষ্কের শুন্যপ্রায় কোন অঞ্চলে। বায়ো- সায়েন্স ভ্রুনের উৎপত্তি ও বৃদ্ধি বিচার করে একথাই , জানতে পেরেছে । এই অঞ্চলটিই মস্তিষ্কের ব্রহ্মরন্ধ্রস্থ কীন স্থান-
যোগীরা যাকে বলেন সহস্রারের কূটস্থান । এখন থেকেই ধীরে ধীরে নিম্নাঙ্গ পর্যন্ত মানুষের স্থূল দেহ গড়ে উঠেছে । বিশ্বব্রহ্মাণ্ড যেমন ধাপে ধাপে কেন্দ্র থেকে নীচে নেমে এসেছে । শক্তি তেমনই বিশ্বের কেন্দ্রস্থল থেকে প্রান্তে এসে কম ফ্রিকোয়েন্সির ত্রিমাত্রিক জগৎ হয়েছে , মানুষের দেহেরও উর্ধ্ব
অংশের ফ্রিকোয়েন্সি তেমনই নিম্ন অংশের ফ্রিকোয়েন্সি থেকে অনেক বেশি । জগতের প্রান্ত দেশ যদি কেন্দ্রের দিকে ফিরে যাওয়া যায় , তাহলে যেমন ক্রমশ বেশি ফ্রিকোয়েন্সির জগৎ দেখা যাবে , তেমনই মানুষের ইন্দ্রিয়ের নিম্নস্তর থেকে
উর্ধ্বদিকে এগােতে থাকলে ক্রম - সূক্ষ্ম সব জগৎ দেখা যাবে , যােগীরা মানুষের দেহতত্ত্বের এই রহস্য জানতে পেরেছিলেন বলে মানুষের দেহে শক্তির অবতরণ ও উত্তরণ সম্পর্কে কতকগুলি কেন্দ্রের কল্পনা করেছিলেন — এই কেন্দ্রগুলিকে বলে চক্র- তন্ত্রযোগের ষটচক্র
এই চক্রগুলো উর্ধ্ব থেকে নিম্ন দিকে এই ধরনেরঃ সর্বপ্রথম - মহাশূন্যতা- সহস্রারের কূটস্থান। তারপর নির্ভেজাল শক্তি প্রবাহের অঞ্চল পার হয়ে দ্বিতীয়বিহীন ‘এক' বোধ অর্থাৎ বিশুদ্ধ চৈতন্যের পর্যায় । এবং পরে জ্যোতির পর্যায় । একেই ভারতীয় আধ্যাত্মশাস্ত্রে বলে — সৎ ( মহাশূন্যতা) + চিৎ ( দ্বিতীয়বিহীন এক বােধ ) + আনন্দ ( জ্যোতি পর্যায় ) । এরপর থেকেই বিভিন্ন মাত্রার অঞ্চলে শক্তির অবতরণের পর্যায় । যেসব দুয়ার দিয়ে শক্তি এখানে নিম্নদিকে অবতরণ করেছে , সেই দুয়ারগুলিকে তন্ত্রযােগে বলা হয় চক্র। হিন্দু তন্ত্রযােগশাস্ত্রে এমনই ছয়টি চক্র আছে । উর্ধদিক থেকে নিম্নদিকে এই চক্রগুলি হল—
( ১ ) আজ্ঞাচক্র ,
( ২ ) বিশুদ্ধ চক্র ,
( ৩ ) অনাহতচক্র , ( ৪ ) মণিপুরচক্র , ( ৫ ) স্বাধিষ্ঠানচক্র ও ( ৬ ) মূলাধারচক্র ।
এই শেষ চক্রে এসেই শক্তি প্রায় নিষ্ক্রিয়া হয়ে আছে । যদি একে আবার উল্টোদিকে ফেরানো যায় , তাহলে যেসব সুপ্ত স্তর অতিক্রম করে সে নেমে এসেছে , একে একে সেই স্তরগুলি আবার শক্তির চৈতন্য-দৃষ্টিতে ধরা পড়বে । অর্থাৎ স্থূল জগৎ থেকে ক্রম-সূক্ষ্ম জগৎ তার নজরে পড়বে । যারা এই মূলাধারের শক্তিকে ফিরিয়ে উল্টোদিকে ওঠাতে পারেন , তারাই ক্রম-সূক্ষ্ম জগৎ দেখতে পান - সূক্ষ্ম প্রাণী দেখতে পন । এই সূক্ষ্ম প্রাণীরাই হলেন ভূত , প্রেত , উন্নত জীবাত্মা ও দেবদেবী । বিজ্ঞান এখন যন্ত্রের সাহায্যে এই সূক্ষ্ম জগৎ দেখার দুঃসাহস করছে । নানা ক্ষেত্রে সে সফল হয়েছে । এখন সে যন্ত্রের সাহায্যেই সময়কে জয় করে অতীত ও ভবিষ্যতে যাবার দুঃসাহস করছে । তত্ত্বের দিক থেকে তা সম্ভব বলেও মনে হচ্ছে। এখন শুধু হাতেনাতে ফলপ্রাপ্তিরই যা আপেক্ষা । বিজ্ঞান যে তত্ত্বের সাহায্যে এই অসম্ভবকে সম্ভব করতে উদ্যোগী হয়েছে , তার নাম Blackhole- তত্ত্ব । বিজ্ঞান যা সাহায্য করতে উদ্যোগী হয়েছে , মানুষ নিজের দেহযন্ত্রের কৌশল জেনে বহু আগেই তা সম্ভব করেছিল । যন্ত্র একাজ সম্ভব করতে উদ্যত হয়েছে শক্তির সাহায্যে । মানুষও তা সম্ভব করেছে শক্তিরই সহায্যে । বিজ্ঞানের এই শক্তির নাম Kinetic energy. মানুষের দেহস্থ এই শক্তিকে বলে কুলকুণ্ডলিনী শক্তি । সুতরাং দেবদেবীর রহস্য , দিব্যজগতের রহস্য যদি বুঝতে হয় , তাহলে এই কুলকুণ্ডলিনীর কথা স্পষ্ট করে বুঝতে হবে। দিব্যজগতের যথার্থ চরিত্র বুঝতে হলে , দেবদেবীদের যথার্থ অবস্থা বুঝতে হলে , এই কুলকুণ্ডলিনী সম্পর্কে স্পষ্ট জ্ঞান হওয়া দরকার ।
এই কুলকুণ্ডলিনীই কালের জন্ম করেছিলেন বলে কালী নামে পরিচিতা । কালের জন্মদাত্রী এই কালী কালকে অর্থাৎ সময়কে যেমন - তেমনভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন । যিনি দেহের অভ্যন্তরস্থ কুলকুণ্ডলিনীকে ইচ্ছামতাে পরিচালনা করতে পারেন , তিনিই কালের ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ লাভ করেন । তিনি ইচ্ছামতাে অতীতে যেতে পারেন , ইচ্ছামতো ভবিষ্যতেও যেতে পারেন । এটা যে শুধুই একটা রহস্যময় শক্তি তা নয় , বাস্তবে কুলকুণ্ডলিনীর অনুরূপ ভূমিকা পালন করে দেখিয়ে দেওয়া যেতে পারে । সুতরাং কুলকুণ্ডলিনী একটা বৈজ্ঞানিক সত্য বলে এখন প্রতীয়মান ।
ব্লাকহোল- কে যদি ভাষা দিয়ে বােঝাবার চেষ্টা করা হয় , তাহলে বলতে হবে যে , এ হল এক ধরনের বিশাল গর্ত- যে গর্তের সৃষ্টি হয়েছে তা কোনাে নক্ষত্র নিজের ভারে নিজেই তলিয়ে যাবার ফলে । এই গর্তে এমন বিপুল অভিকর্ষ যে , তার টানের মধ্যে পড়লে যে কোনাে বস্তু , পার্শ্বস্থ দেশ , সময় , আলাে , সবই হারিয়ে যায় । তার লৌহবেষ্টনীর বাইরে আর কিছুই বেরিয়ে আসতে পারে না । এখানে উর্ধ্ব, অধঃ, বাম, ডান বলে কিছুই নেই। এই যে অবস্থা , মানুষের দেহের কুলকুণ্ডলিনী শক্তি , সহস্রারের কৃটস্থানে গেলে দেহ-বিশ্বেও এই একই ধরনের অভিজ্ঞতা হয় । তখন চেতনা বলতে কিছু থাকে না । এই অবস্থা থেকেই কুলকুণ্ডলিনী শক্তি বহির্মুখী হয়েছিল। আবার বাইরে থেকে এই অবস্থার মধ্যেই ফিরে যায় । এই যাতায়াতের পথেই সময় কখনো আগে , কখনও পেছনে চলে যায় । আর সেই অনুপাতেই বিচিত্র সব দর্শন হতে থাকে । কারণ যে - কোনো ঘটনা তা সবসময়ই দেশ ও কাল দ্বারাই ঘটে। দেশ না থাকলে , কাল না থাকলে কোনাে ঘটনাও নেই । নিউটনের মাধ্যাকর্ষীয় শক্তির তত্ত্ব থেকেই এই বিশাসে এসেছিলো যে , কোনাে নক্ষত্রের ঘনত্ব যদি আমাদের পৃথিবীর ঘনত্বের মতোও হয় , তবে তার মাধ্যাকর্ষীয় শক্তি এত প্রবল হবে যে , তা থেকে আলো বেরিয়ে আসতে পারবে না । ব্লাকহোল প্রচণ্ড কোনাে বিস্ফোরণজাত নয় । বরং অনন্ত আকর্ষণীয় অন্ধকার মাত্র । এই অন্ধকারই হল গর্ত , যাতে বস্তুপুঞ্জ এমনভাবে আকর্ষিত হয়ে ঢুকে পড়ে যে , আন্তর - আকর্ষণের চাপে কল্পনাতীতভাবে ঘনীভূত হয়ে যায় । দেশ ও সময় সাধারণভাবে সমল । কিন্তু যদি এর মধ্যে কোনো ভারী বস্তু সত্তার উদয় হয় , তবে তার চারদিকে দেশ ও সময় বেঁকে যায় । তবে এই বস্তুপুঞ্জের আন্তর- অভিকর্ষ যিদি প্রচন্ড রকমের হয় , তাহলে শূন্যতাকে বেঁকেচুরে , দুমড়ে , সময়কে নুইয়ে দিয়ে প্রচণ্ড কৃষ্ণগহৰর সৃষ্টি করতে পারে , যে - কৃষ্ণগহবর তার চারপাশের দেশ ও সময়কেও তার মধ্যে টেনে নিয়ে যাবে । প্রথম দিকে দেশের বক্রতার জন্য সোজা- সবলভাবে সেখানে চলা যাবে না , সময়ের গতিরও হেরফের ঘটে যাবে ।
মহাবিশ্বের এ মহাবিশাল মানস কারিগর মানুষেরই গঠন - শৈলীতে যে যন্ত্র তৈরি করেছেন মানুষ যদি সেই গঠন - শৈলী নিজে অর্জন করতে পারে , মানুষ যদি নিজের হাতে মানুষ তৈরি করতে পারে , তবে সেই মানুষই বলে দেবে মহাবিশ্বজগতের চরিত্র কি , কোথায় রয়েছে , তার কোন প্রান্ত এবং কোথায়ই বা কি ধরনের দেশকাল ও প্রাকৃতিক নিয়মাবলী । মানুষ বুদ্ধিমান হলে যন্ত্রে আর মানুষ তৈরি করতে যাবে না —- যে রহস্যময় যা সে নিজেই সেই দেহটিকে ব্যবহার করলেই পেয়ে যাবে মহাবিশ্বের ঠিকনা । এজন্য যা প্রয়ােজন , তা হচ্ছে যোগ । যােগে কুলকুণ্ডলিনীকে জাগানাে গেলে তা বিচিত্র এই মহাবিশ্বের ঠিকানা মানুষকে দিবে। বৈজ্ঞানিকেরা যে ধরনের অনুমান করছেন , যােগে কুলকুণ্ডলিনী জাগরিত হলে মানুষ নিজের অন্তর্জগতেই সে সব দেখতে পাবে। যোগের সাহায্যে যা জানা যাবে তা সরাসরি সত্য,
অনুমনসাপেক্ষ নয় । সর্বাপেক্ষা বড় ব্ল্যাকহােল হল মহাশূন্যতা — যেখানে সময় নেই , দেশ নেই , আলাে নেই , অন্ধকার নেই , অথচ সবই আছে। মানুষ নিজের মনের মধ্যে ডুব দিলেই সেই যথার্থ এবং আদি ব্লাকহােলের সন্ধান পাবে । কার্তিকের মতাে বিশ্ব না ঘুরে গণেশের মতাে অপন গহন অন্তঃপুরের প্রাণসত্তাকে পরিক্রমা করা অনেক সহজ ।
Continue-36
কুন্ডলিনী কথা
কুণ্ডলিনীকে দেবী হিসেবে গণ্য করা হলেও আসলে ইনি হলেন শক্তি। এই শক্তি মানবদেহের সর্বনিম্ন চক্রে অর্থাৎ মূলাধারে ( গুহ্যদ্বার ও লিঙ্গমূলের মাঝখানে ) সর্পাকারে কুণ্ডলায়িত অবস্থায় নিদ্রিত আছে বলে যােগীরা ভেবে থাকেন। এখানে তিনি শিবলিঙ্গকে সাড়ে তিন প্যাচে জড়িয়ে আছেন বলে কল্পনা করা হয়। এই লিঙ্গ হল মানুষের সূক্ষ্ম শরীর বা মুক্ত আত্মস্বরূপ। একে সর্বাঙ্গে জড়িয়ে থাকা
মানে জীবাত্মাকে মায়াশক্তির আবরণে জড়িয়ে রাখা। এই মায়াশক্তির বন্ধন বা আবরন খুলতে না পারলে জীবাত্মার আত্মজ্ঞান জান্মে না। সাড়ে তিন পচ কল্পনা করার অর্থ আপাদমস্তক জড়িয়ে থাকা। প্রত্যেকটি মানুষই তার নিজের হাতের সাড়ে তিন হাত লম্বা সকল মানুষ এই সাড়ে তিন হাতই মায়ায় জড়িয়ে আছে। তাই শক্তি বা মায়ার প্যাচ সাড়ে তিন দেখানাে হয়েছে। সাধাকর কাজ হয় এই সাড়ে তিন প্যাচ জড়িয়ে থাকা এই নিদ্রিত শক্তিকে জাগরিত করা, যাতে সে প্যাচ খুলে অর্থাৎ মানবসত্তায় জড়িয়ে থাকা অবরন খুলে উধর্বগতি হতে পারে। অর্থাৎ যেখান থেকে তার উৎপত্তি হয়েছিল , মানে পরম শুন্যতা থেকে, সেখানে ফিরে যেতে পারে। মানবদেহে এই শূনাস্থান কল্পনা করা হয়েছে ব্রক্ষ্মরন্ধ্রের কেন্দ্রস্থলকে, যাকে বলে কুটস্থান। এই কেন্দ্রকে ঘিরে থাকা যে পদ্মের কল্পনা কর হয়েছে, তার নাম সহস্রার। এই সহস্রারের কেন্দ্রই হল পরম শুন্যতাস্বরূপ। শক্তি সেখানে ফিরে গেলে আবার তার গতি হারিয়ে ফেলে। প্রকৃতির ত্রিয়া বন্ধ হলেই মায়াশক্তি তা জীবাত্মিক চেতনাকে আবরিত করে রাখার ক্ষমতাকে হারিয়ে ফেলে। তাই সাধকের প্রথম কাজ হল এই সুপ্ত শক্তিকে জাগরিত করে তােলা। দেবী মূলাধারে জাগরিত হবার পূর্ব মুহুর্ত পর্যন্ত সাধকের মধ্যে কোনো দিবা অনুভূতির স্পন্দন দেখা যায় না। এই শক্তি বা দেবী জাগরণের সঙ্গে সঙ্গেই আরম্ভ হয় আনন্দময় অনুভূতির স্পন্দন।
শক্তির জাগরণের পরই আরম্ভ হয় তার উর্ধ্বগতি। একটি একটি করে চক্র ভেদ করে শক্তি উর্ধ্ব দিকে এগিয়ে চলেন। সর্বোচ্চ স্থান সহস্রারের কেন্দ্রস্থলে গিয়ে তাঁর পরম স্থিতি ঘটে— অর্থাৎ নির্বিকল্প স্থিতি। শক্তির এক একটি চক্রভেদের সঙ্গে সঙ্গে সাধকের নতুন নতুন আনন্দানুভূতি হতে থাকে। কুণ্ডলিনীকে সহস্রারের কূটস্থানে নিয়ে যাওয়া হলে সাধক পরম শান্তি লাভ করেন। এই শান্ত স্থানই উপনিষৎ বর্ণিত পরমাত্মা , যাকে বােঝানাে হয়ে , এই ধরনের বাক্য প্রয়ােগ করে — ' শান্তো ইয়ম আত্মা' । অর্থাৎ এই আত্মা , পরম শান্ত । তান্ত্রিকেরা বা যােণীরা শক্তির উত্থান ও গতিকে বিচিত্র স্পন্দনাত্মক বিদ্যুৎ প্রবাহের মতো বলে বর্ননা করেছেন ।
হিন্দুরা যেমন দেহের মেরুদণ্ড বা সপ্তচক্র ইত্যাদির কল্পনা করেছেন , বৌদ্ধরাও তেমন দেহের মধ্যে চারটি চক্রের কল্পনা করেছেন। যেমন- নাভিতে নির্মাণচক্র , হৃদরে ধর্মচক্র , কণ্ঠে সম্ভোগচক্র ও ' সহস্রারে মহাসুখ চক্র । নির্বাণচক্রে আছে ভগবান বুদ্ধের সম্ভোগ কায়া । এবং মহাসুখচক্রে পরম প্রশান্তি । হিন্দু তন্ত্র ও বৌদ্ধ তন্ত্র উভয়েই মনে করে যে , মানবদেহ হল মহাবিশ্বেরই ক্ষুদ্র সংস্করণ মাত্র। মহাবিশ্বের সকল সত্য এই মানবদেহের মধ্যেই আছে । মেরুদণ্ডের বাম ও ডান দিক দিয়ে দুটি নাড়ি বয়ে গেছে , যাকে বলে ইড়া ও পিঙ্গলা । কেউ বলেন চন্দ্র ও সূর্য । মেরুদণ্ডের মধ্য দিয়ে সে নাড়ি বয়ে গেছে , তাকে বলে সুষুম্না । বৌদ্ধরা এই নাভিকে বলেন অবধূতিকা । বৌদ্ধদের মতে এই অবধূতিকা দিয়েই বােধিচিত্ত ঊধ্বদিকে অগ্রসর হয়ে চক্রে চক্রে ভিন্ন ধরনের স্বাদ অনুভব করেন । যে শক্তি এই চক্রগুলাের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বিচিত্র ধরনের আনন্দের শিহরণ দেন , সেই শক্তিই হিন্দুদের কুলকুণ্ডলিনী শক্তি বা বৌদ্ধদের দেবী । এই শক্তি যখন প্রথম নির্মাণচক্রে ওঠেন , তখন অকস্মাৎ প্রজ্জ্বলিত অগ্নির মতো দাহ , অনুভব করা যায়। । শক্তি তথন চন্ড স্বভাবা । সেইজন্য বৌদ্ধরা শক্তির এ অবস্থাকে চন্ডালী বলে বর্ণনা করেছেন ।
ইন্দ্রিয়শক্তি দ্বারা তাকে বােঝা যায় না বলে ডােম্বী নামেও অভিহিত করা হয়েছে। এই ডোম্বীর অবস্থান দেহরূপ নগরের বাইরে। আচার - বিচার পাণ্ডিত্যাভিমান দ্বারা এ সঙ্গ লাভ করা যায় না । সকল অবরণ শূন্য হলে তাবেই এর সঙ্গ লাভ করা যায় । এই শক্তিকে মাতঙী, চণ্ডালী, শবরী , কিরাতী ইত্যাদি আখ্যাতেও ভূষিত করা হয়েছে । বৌদ্ধ চর্যাপদে এই নিয়ে অনেক মরমিয়া সঙ্গীতও আছে । বহু হিন্দু যােগী ধ্যানকালে চক্রে চক্রে, শাস্ত্রের বর্ননা অনুযায়ী কল্পনা করে এই শক্তিকে সাধনা করতে বলেন । কিন্তু এ অতি মিথ্যা ধারণা । এর দ্বারা কোনাে উদ্দেশ্য সাধিত হয়। শক্তির জাগরণও হয় না । এই শক্তিকে জাগরিত করার সহজ পথ আছে।
কুণ্ডলিনী শব্দটি দ্রাবিড় শব্দ । ' কুল ' অর্থ দ্রাবিড় ভাষায় শক্তি । কুন্ড অর্থ গর্ত । লিঙ্গমূল ও ওহ্যদেশের মাঝখানে কোথাও এই গর্ত আছে । গর্তটি এত সূক্ষ্ম যে , পরীক্ষা - নিরীক্ষা করেও এর অক্তিত্ব ধরা যায়নি । সেখানেই দেহের মৌলশক্তি বিরাজ করে। ব্যাপারটিকে অসম্ভব মনে হলেও অবিশ্বাস্য না । বিজ্ঞানীরা ইদানীংকালে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের উৎপত্তি যে ক্ষেত্র থেকে হয়েছে , তাকে অণুর কেন্দ্র অপেক্ষাও ছােট মনে করেন । সেখান থেকেই এত বড় বিশ্বের উদয় হয়েছে । দেহ - বিশ্বের সকল শক্তির আধারও তেমনই ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র একটি বিন্দু মাত্র । এখান থেকে যে তেজ উৎসারিত হয় , তা - ই মানবদেহকে উউজ্জীবিত রাখে । আমাদের শ্বাস - প্রশ্বাস সেই ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র আধারে গিয়ে আঘাত করে । ফলে সেখান থেকে যে তাপ নির্গত হয় তাই আমাদের দেহের সাধারণ তাপ হিসাবে কাজ করে । মনসংযােগ করলে সেই শাস -প্রশ্বাস রূপ বায়ু অত্যন্ত সূক্ষ্ম হয়ে যায় । বায়ু যত সূক্ষ্ম হয়, তার আঘাত করার ক্ষমতা তত বেশি হয় । ফলে দেহের মৌলশক্তি বেশি পরিমাণে নির্গত হয় । মুলাধারস্থ মৌলশক্তি ব্যারােমিটারের পারার মতো উর্ধ্বে উঠতে থাকে । সমগ্র বিশ্ব যেমন বিশেষ একটি কেন্দ্র থেকে বিস্ফোরণজনিত বেগে ছড়িয়ে পড়েছিল এবং প্রান্তে এসে স্থূল বস্তুসত্তার মধ্যে চুপ কর আছে , দেহের শক্তিও তেমনই ব্রক্ষ্মরন্ধ্র থেকে মূলাধারে এসে স্থির হয়ে আছে । এই শক্তি যেমন বিশ্বে সূক্ষ্ম
থেকে কম সূক্ষ্ম অবস্থায় ধাপে ধাপে সূক্ষ্মতার পথে নেমে এসেছিল , দেহ-বিশ্বেও শক্তি তেমনই সহস্রার থেকে নেমে এসে ক্রমশ স্থূল চেতনায় স্থির হয়ে আছে । কিন্তু জড়-অজড় সর্বত্রই তার একটা স্পন্দন আছে। ইদানীং বিজ্ঞানের সূক্ষ্ম যন্ত্র তা ধরাও পড়েছে। যেভাবে বিশ্ব কেন্দ্র থেকে প্রান্তভাগের স্থূল জগতের দিকে নেমে এসেছিলো সেইভাবে দেহ-বিশ্বে শক্তি সহস্রারের কেন্দ্রস্থল থেকে প্রান্তভাগের স্থূল চেতনার দিকে নেমে এসেছে। বিশ্বের স্থূল প্রান্তভাগ থেকে উৎসের দিকে ফিরে গেলে যেমন স্থূল থেকে সূক্ষ্মতর অবস্থায় জগতকে দেখা যাবে , দেহ - বিশ্বের মৌলশক্তি কুলকুণ্ডলিনী তেমনই মূলাধার থেকে সহস্রারের দিকে ফিরে যাবার পথে ক্রমশ সূক্ষ্মতর জগতের চিত্রগুলি আমাদের মানসনেত্রের কাছে তুলে ধরে ।
যথাযথ নিয়মে মনসংযােগ করে চুপ করে বসে থাকলেই মূলাধারস্থ কুণ্ডলিনী শক্তি ক্রমশ উর্ধ্ব দিকে উঠতে থাকে । বিভিন্ন চক্রে নিম্ন থেকে উর্ধ্বদিকে যে শক্তিতরঙ্গ আছে তা তরঙ্গের চরিত্র অনুযায়ী সাধকের মানসনেত্রে ভিন্ন ভিন্ন বর্ণ ও দৃশ্য তুলে ধরে । মুলাধারস্থ শক্তি শ্বাস দ্বারা তাড়িত হয়ে উর্ধ্ব দিকে উঠতে থাকলে প্রথম ওঠে পেট দিয়ে । বায়ু তখন দেহকে দোলাতে থাকে । পরে বায়ু দেহচক্রের সুষুম্না নাড়ির মধ্য দিয়ে বইতে থাকে । তখন দেহে কম্পন অনুভূত হয় । পেট দিয়ে বায়ু ওঠার সময় যে ধরনের কম্পন হয় , তাকে দোলানী বলা যেতে পারে । কিন্তু মেরুদণ্ডের ভেতর দিয়ে বায়ু বা বায়ুতাড়িত শক্তি ওঠার সময় যে কম্পন অনুভূত হয় , তাকে ইংরেজিতে ট্রেম্বলিং বলা হয়। মেরুদণ্ডের গাঁটে গাঁটে আবর্জনা জমে থাকে । শক্তি উর্ধ্বে ওঠার সময় এই আবর্জনাগুলিকে ধাক্কা মেরে সরিয়ে দেবার চেষ্টা করে । তার ফলে দেহ কেঁপে কেঁপে ওঠে । যতক্ষণ পর্যন্ত না মেরুদণ্ডের সব গাঁটের আবর্জনা দূর হয় , ততক্ষণ পর্যন্ত দেহ কেঁপে কেঁপে ওঠে। আবর্জনা দুর হয়ে গেলে বায়ুবাহিত শক্তির ওঠার পথ পরিষ্কার হয়ে যায় । তখন বায়ু অতিসহজেই উপরের দিকে উঠে সরাসরি মস্তিষ্ক - মণ্ডলে চলে যায় । বায়ুর চাপে মস্তিষ্ককে তখন একটা ফুটবলের ব্লাডারের মতাে মনে হয় । এই ব্লাডার বা বেলুন উপরে উঠে যেতে চায় । তার ভাসমানতা এমন এক হালকা ভাব প্রাপ্ত হয় যে , মনে হয় সমস্ত দেহটাকে নিয়ে সে উপরের দিকে উঠে যাচ্ছে । অনেক সময় দেহ সত্যি সত্যি উপরে উঠে যায় । যােগে এই অবস্থাকে বলে ভূমিত্যাগ ।
যােগে তিনটি অবস্থা আছে । যখন কিছুতেই মন স্থির হয়ে বসতে চায় না , উসখুস করে , সেই অবস্থাকে বলে ঘর্ম । যখন বায়ুতাড়িত শক্তি পেট বা মেরুদণ্ড দিয়ে উঠে দেহে আলোড়ন সৃষ্টি করে , তখন তাকে বলে কম্পন । বায়ু , মস্তিষ্কে উঠে দেহকে ওপরের দিকে তুলে নিলে তাকে বলে ভূমিত্যাগ । ভুমিত্যাগই যোগের চরম প্রাপ্তি ।
শক্তি এক - একটা চক্ৰে উঠলে এক - একরকম বােধ , বর্ণ দর্শন ও চিত্র দর্শন হয়। দেহের মধ্যে এক - একটা চক্রের এক - একরকম কাজ । মূলাধারে কুণ্ডলিনীশক্তি দেহের প্রাণশক্তি হিসেবে কাজ করে । স্বাধিষ্ঠানে এই শক্তি প্রজনন শক্তিক্রিয়া হিসেবে দেখা দেয় । কুলকুণ্ডলিনী শক্তি আধিষ্ঠানে যৌন আবেগ , প্রজনন ক্ষমতা ও পার্থিব সৃষ্টির প্রেরণা দেয় । মণিপুরচক্ৰে কুলকুণ্ডলিনী ইচ্ছাশক্তির সৃষ্টি করে । অনাহতচক্রে কুশুলিনী প্রেম বা ভালােবাসার সৃষ্টি করে । এই শক্তিই বিশ্বব্রহ্মশুকে ধরে রেখেছে । বিশুদ্ধ চক্রে কুণ্ডলিনী চিন্তাশক্তিকে শক্তিশালী করে । কুলকুণ্ডলিনী আজ্ঞাচক্রে উপস্থিত হলে মানুষের অন্তর্দৃষ্টি , অনুভবশক্তি ও আত্মিক ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। এই শক্তি যখন সহস্রারে গিয়ে উপস্থিত হয়, তখন মানুষের জ্ঞান জগত থেকে অজ্ঞান জগতে গিয়ে উপস্থিত হয়। মানুষ ঐশ্বরিক জগতের সন্ধান পায় । এই সহস্ৰারের উর্ধ্বেও অনেকে আরো একটি চক্রের কল্পনা করেছেন। একে বলে স্টারচক্র ? এর অবস্থান স্থূলদেহের চার ইঞ্চি ওপরে , যাকে সূক্ষ্মদেহ বা বায়াে প্লাজমিক বড়ি বলা হয় । এই চত্ৰ সেই সূক্ষ্মদেহে থাকে । এখান থেকে কুণ্ডলিনীশক্তি মানুষের দেহের জেনেটিক কাঠামাে ঠিক করে দেয় । বিশ্বের সকল অভিজ্ঞতা এখানেই জমা থাকে।
ক্রিয়াযােণীরা মনসংযোগ করে এই শক্তিকে উপরে ওঠালে যে অভিজ্ঞতা হয় , তা এইরকমঃ কুলকুণ্ডলিনী মূলাধারচক্রে জাগ্রত হলে মানসনেত্রে রক্তিম বর্ণ দেখা যায় । এখানে অনেক ছায়া - ছায়া ছবি ভেসে ওঠে । এগুলি অস্পষ্ট ভৌতিক ছবি । কিছুটা বাইরের স্থূল জগতের শক্তিতরঙ্গের সঙ্গে যােগীর মানসতরঙ্গের সমতা হেতু পার্থিব চিত্রের প্রতিফলন । কুলকুণ্ডলিনী স্বাধিষ্ঠান চক্রে উঠলে প্রথম সবুজাভ একটি বৃত্ত লক্ষ্য করা যায় । সেই বৃত্ত ছড়াতে ছড়াতে ক্রমশ ছায়া ছায়া একটি তরল জাতীয় ভাব সৃষ্টি করে । এতে বহু ছায়ামূর্তি কে বিচরণ করতে দেখা যায় । প্রকৃতপক্ষে , এই দুইটি স্তর হল মৃত্যুর পর সূক্ষ্মদেহীদের সূক্ষ্মদেহের বিচরণ ক্ষেত্র । এখানে স্থূল দৈহিক সত্তা সূক্ষ্মতাপ্রাপ্ত হলেও মানসিক্তার মধ্যে স্থূলতার গন্ধ লেগে থাকে । জীবের সূক্ষ্ম সত্তা এখানে আকাঙ্ক্ষার তাড়নায় বিভ্রান্ত হয়ে ঘুরে বেড়ায় । মণিপুরচক্রে উঠলে কুন্ডলিনীশক্তি গ্রীষ্মের মধ্যাহ্ন আকাশের মতো আকাশের দৃশ্য দেখায়। সাদাটে মেঘের ফাঁকে কিছু নীলাভ ইঙ্গিত মনসনেত্রে, ধরা পড়ে । এখানেও বহু সূক্ষ্ম প্রাণীকে ঘুরে বেড়াতে দেখা যায়। মানুষ এই তিনটি স্তর মৃত্যুর পর পার্থিব কামনা বাসনা দ্বারা তাড়িত হয় বলে এবং স্থূলদেহের অভাবে ভোগবাসনা চরিতার্থ করতে পারে পারেনা বলে মানসিক যন্ত্রণা বোধ করে । তবে এই তিনটি স্তর যে শুধু সুক্ষ্মদেহীদের জগতই দর্শন করায় তা নয় , মানসতরঙ্গের সঙ্গে স্থূলজগতের সমতাহেতু বহু স্থূল পার্থিব দৃশ্যও দেখায় । একেই বলে টেলিপ্যাথিক ভিশন।
শক্তি , অর্থাৎ কুলকুণ্ডলিনী –এর উপরে উঠলে ছেঁড়া মেঘের ফাঁকে ফাঁকে অদ্ভুত অদ্ভুত সুন্দর নীল আকাশ দেখা দেয়। তাতে মিটি মিটি তাঁরাও ফুটে থাকতেও দেখা যায় । এখানে অদ্ভুত একটা প্রশান্ত হাওয়া বইছে , এমন মনে হয়। এখানে যেসব মানবাত্মার চিত্র লক্ষ্য করা যায় , তাদের প্রশান্ত ভঙ্গিতে দেখা যায় । মাঝে মাঝেই কিছু অগ্নিগােলককেও ছুটে যেতে দেখা যায় । হয়তো মহাবিশ্বে ছুটে চলা কোনো গ্যালাক্সি বা ছায়াপথ হাবে এগুলাে । অনেক সময় স্পষ্টভাবে ভিন্ন কিছু গ্রহের চিত্রও ফুটে ওঠে। দেখা যায় উত্তাল তরঙ্গে তরঙ্গিত সমুদ্র , বড় বড় গাছ , ধূসর পাহাড় , নতুন কোন গ্রহের নানা রঙের আকাশ -— এইসব । অদ্ভুত কিছু জীবন্ত প্রাণী ও লক্ষ্য করা যায়। তাদের অনেকেই পশুস্তরীয়, অনেকেই দেবস্তরীয়। পার্থিব কল্পনার দেবদেবীদের সঙ্গে তাদের মিল লক্ষ্য করে মনে হয় সাধু-সন্তেরা দেব - দেবীর কল্পনা মানসজগতে এই দর্শনের ফলেই করেছিলেন । তাঁদের দেবদেবীর কল্পনা মোটেই ভিত্তিহীন নয়। তবে এটাও সত্য যে , কতকগুলি যথার্থ অনুভূতিকে তারা পৌরাণিক কাহিনীর গল্প তৈরি করে বর্ণনা করেছিলেন — যে কাহিনীগুলির বক্তব্য আধুনিক বিজ্ঞানের ফলশ্রুতির সঙ্গে মিলে যাচ্ছে । যেমন ব্রহ্মা বিষ্ণু মহেশ্বররুপী ত্রিদেবের কল্পনা ।
কুলকুণ্ডলিনী শক্তি বিশুদ্ধচক্রে উঠলে নীলবর্ণ গভীর হয়। এখানে বহু প্রাচীন মুনি ঋষিদের ঘুরে বেড়াতে দেখা যায় । এদের অনেককেই পঠনজনিত জ্ঞানের আলােতে দেখা যায় । মানুষের কর্মফলও অনেক সময় বিভিন্ন চিত্র তৈরি করে রাখে । সেগুলি দেখে মানুষ ও ইতিহাস সম্পর্কে ভবিষ্যৎবাণী করা যায়। এইভাবেই অনেকে ভবিষ্যৎবাণী করে গেছেন ।
কুলকুণ্ডলিনী আজ্ঞাচক্রে উঠলে প্রচণ্ড বিস্ফোরণজনিত আলাের বিকিরণ ঘটে। এই অঞ্চল পার হলেই দিব্যজগতে প্রবেশ করা যায় । সহস্রার অঞ্চলই হলো দিবজগতের অঞ্চল । এই সহস্রারের তিনটি পর্যায় আছে । নিম্ন থেকে উধর্ব দিকে এই স্তরগুলিকে বলা যায় – আনন্দ , চিৎ ও সৎ - এর স্তর । আনন্দ স্তরে জ্যোতিরূপ - আলাে দশদিন হয় । এখানে ভিন্ন কোনাে দৃশ্য নজরে পড়ে না । কারণ এই আলোই হল অপরিচিছন্ন আলাে , যা থেকে নিম্নতর পর্যায়ে পরিচ্ছিন্ন সৃষ্টি আত্মপ্রকাশ করেছে । এর ঊধে দর্পণ - সদৃশ একটি স্বচ্ছ স্তর আছে। একে চিৎ - স্তর বলে । চিৎশক্তি এখানেই দ্বিতীয় বিহীন একের বােধ অনুভব করেছিল। এর ঊর্ধ্বে নিস্তরঙ্গ নিস্তব্ধ প্রশান্ত অন্ধকার , যাকে বলা হয় সৎ - এর স্তর বা পর্যায় , সহস্রারের কূটস্থ নিগুণ ব্রহ্মাণের পর্যায় । চিৎশক্তি ক্রিয়াশীল হবার আগে শক্তি এখানেই স্তব্ধ হয়ে ছিল । চিৎশক্তি ক্রিয়াশীল হলেই তিনি চিৎরুপিণী কুলরূপে অর্থাৎ শক্তিরূপে বিশ্বসৃষ্টিতে প্রকট হন । আদিতেও তিনি ছিলেন কূটস্থানের গর্তে বা গর্ভে অর্থাৎ কুণ্ডে । জগৎ সৃষ্টি হবার পর প্রতিটি সত্তাতে মৌল শক্তি হিসেবে সেই কুণ্ড বা গর্তেই স্তব্ধ হয়ে থাকেন । সেই জন্যই তাঁর ঊধর্বগতি বা অধঃগতি উভয় গতিতেই তিনি কুণ্ডলিনী । প্রকাশের সময় তিনি একে একে প্যাঁচ খুলে বিশ্বব্রক্ষ্মান্ড
রুপে প্রকাশিত হন । প্রান্তভূমি থেকে জাগরণের পর ঊর্ধ্বগতিতে তিনি গােটাতে গােটাতে উৎসে ফিরে চলেন । পরিণতি ও উৎস — উভয় ক্ষেত্রেই তিনি কুণ্ডে থাকেন । তার প্রকাশ ও অন্তর্ধান উভয় পথেই প্যাঁচ খােলা ও প্যাঁচ গােটানাের ব্যাপার আছে । সেই জন্যই সাধকেরা তাকে কুলকুণ্ডলিনী বা সর্প হিসেবে কল্পনা করেছেন ।
আমাদের শরীরের মধ্যে অসংখ্য নাড়ী আছে, তার মধ্যে ১৪টি প্রধান। এগুলো হলো- ইড়া, পিঙ্গলা, সুষুম্না, সরস্বতী, বারূণী, পূষা, হস্তিজিহ্বা, যশস্বিনী, বিশ্বোদরী, কুহূ, শঙ্খিনী, পরদ্বিণী, অম্লম্বুষা ও গান্ধারী। জননেন্দ্রিয় ও গুহ্যদেশের মাঝখানে অবস্থিত কুন্দস্থান থেকে ইড়া, পিঙ্গলা, সুষুম্না, কুহূ, শঙ্খিনী প্রভৃতি প্রধান নাড়ীগুলোর উৎপত্তি হয়েছে। এদের মধ্যে কুহূনাড়ী জননেন্দ্রিয়ের সমস্ত কাজ সুসম্পন্ন করে আর শঙ্খিনী নাড়ী দেহের মলাদি নির্গমনে সহায়তা করে। এই কুন্দস্থানেই কুলকুণ্ডলিনী নিদ্রিত সাপের আকারে বিরাজ করছেন। কুলকুণ্ডলিনী হচ্ছে সমস্ত শক্তির আধার। প্রাচীনকালের সিদ্ধিপ্রাপ্ত যোগী-ঋষিরা মানবদেহ ও মনের কুণ্ডলিত শক্তি-উৎস সম্পর্কে প্রতীকী ব্যঞ্জনায় যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন সে মত অনুসরণ করেই যুগে যুগে সাধকপুরুষরা যোগসাধনায় ব্যাপৃত থেকে এই শক্তিকে জাগরিত করে সিদ্ধিলাভের অন্বিষ্ট খুঁজেছেন।
বলা হয়ে থাকে, আমাদের শরীরের মধ্যে মৃণালতন্তুর ন্যায় সূক্ষ্ম জগন্মোহিনী আদ্যাশক্তি ও প্রাণশক্তির মূল কুলকুণ্ডলিনী শক্তি নিজের মুখব্যাদান করে ব্রহ্মদ্বারের মুখ আবৃত করে জননেন্দ্রিয় ও গুহ্যদেশের মধ্যবর্তী কুন্দস্থানে সর্বদা নিদ্রিত রয়েছেন। এ স্থানকে বলে মূলাধারচক্র। এটা সুষুম্না নাড়ীর একটি গ্রন্থি। আমাদের স্নায়ুরজ্জুর প্রধান ধারক মেরুদণ্ড মস্তিষ্কের নিম্নাংশ থেকে বের হয়ে গুহ্যদেশে এসে শেষ হয়েছে। যোগ-শাস্ত্রকারীদের মতে মেরুদণ্ডের বাঁদিকে ইড়া (Ida Nadi), মধ্যে সুষুম্না (Sushumna Nadi) ও ডানদিকে পিঙ্গলা (Pingala Nadi) নাড়ী বিরাজমান। আমাদের সঞ্চারণমান প্রাণবায়ু ইড়া-পিঙ্গলা নাড়ীর মধ্যে দিয়ে চক্রাকারে সতত আবর্তিত হচ্ছে। সুষুম্না একটি অতি সূক্ষ্ম, জ্যোতির্ময়, সূত্রাকার ও প্রাণময় পথ- মেরুদণ্ডের পথে যার অবস্থান। সুষুম্না নাড়ীর এই প্রাণময় পথে ছয় স্থানে ছয়টি চক্র বিরাজ করছে, যাকে ষট্চক্র বলা হয়।
বিমুক্তিসোপান গ্রন্থে বলা আছে-
"গুহ্যেলিঙ্গে তথা নাভৌ হৃদয়ে কণ্ঠদেশকে।
ভ্রূমর্ধ্যহেপি বিজানীয়াৎ ষট্চক্রান্তু ক্রমাদিতি।।"
অর্থাৎ, ভ্রূমধ্যে, কণ্ঠদেশে, হৃদয়ে, নাভিমূলে, লিঙ্গদেশে ও গুহ্যস্থানে ষট্চক্র বিরাজ করেন।
এই ষট্চক্র হচ্ছে,
ললাটে অর্থাৎ ভ্রূমধ্যে আজ্ঞাচক্র (Agnya Chakra),
আজ্ঞাচক্রের নিচে কণ্ঠমূলে বিশুদ্ধিচক্র (Vishuddhi Chakra),
বিশুদ্ধিচক্রের নিচে হৃদিস্থানে অনাহত চক্র (Anahata Chakra),
অনাহত চক্রের নিচে নাভিমূলে নাভিচক্র বা মণিপুর চক্র (Nabhi Chakra/Manipura Chakra),
মণিপুর চক্রের নিচে লিঙ্গমূলে সুষুম্নার মধ্যে স্বাধিষ্ঠান চক্র (Swadhisthana Chakra),
স্বাধিষ্ঠান চক্রের নিচে গুহ্য ও লিঙ্গের মধ্যস্থলে কুন্দস্থানে সুষুম্নানাড়ীর মুখদেশে মূলাধারচক্র (Mooladhara Chakra)। এই মূলাধার প্রদেশেই মুখব্যাদান করে ব্রহ্মদ্বারে সর্পাকৃতি কুলকুণ্ডলিনীর অধিষ্ঠান।
সুষুম্নার এই সূক্ষ্ম, জ্যোতির্ময়, সূত্রাকার ও প্রাণময় পথই মুক্তির পথ। মুক্তির এই পথ দিয়েই কুণ্ডলিনীকে উর্ধ্বদিকে চালিত করতে হয়। কুণ্ডলিনীর অবস্থান সম্বন্ধে সিদ্ধ-যোগীদের বক্তব্য হচ্ছে- ‘মেরুদণ্ডের নিম্নদেশে যে মূলাধার চক্র আছে তা খুব গুরুত্বপূর্ণ। এই স্থানটি হচ্ছে প্রজননশক্তি বীজের আধার। একটি ত্রিকোণ মণ্ডলে একটি ছোট সাপ কুণ্ডলী পাকিয়ে আছে- যোগীরা এঁকে এই প্রতীকে প্রকাশ করেছেন। এই নিদ্রিত সর্পই কুণ্ডলিনী; এঁর ঘুম ভাঙানোই হচ্ছে রাজযোগের একটিমাত্র লক্ষ্য।’
কুণ্ডলিনীকে জাগরিত করার উপায় হিসেবে স্বামী বিবেকানন্দ বলেন- ‘ প্রাণায়ামের পূর্বে ঐ ত্রিকোণ মণ্ডলকে ধ্যানে দেখবার চেষ্টা কর। চোখ বন্ধ করে এঁর ছবি মনে মনে স্পষ্টরূপে কল্পনা কর। ভাবো এর চার পাশে আগুনের শিখা, তার মাঝখানে কুণ্ডলীকৃত সর্প ঘুমিয়ে রয়েছে। ধ্যানে যখন কুণ্ডলিনীশক্তি স্পষ্টভাবে দেখতে পাবে তখন কল্পনায় তাকে মেরুদণ্ডের মূলাধারে স্থাপন কর; এবং তাকে অনুভব করার চেষ্টা কর। প্রাণায়ামসহ বিভিন্ন মুদ্রা ও বন্ধন অভ্যাস কালে কুম্ভকে শ্বাস রুদ্ধ রাখার সময় সুপ্ত কুণ্ডলিনীকে জাগাবার জন্যে ঐ রুদ্ধ বায়ু সবলে তার মস্তকে নিক্ষেপ করবে। যার কল্পনা শক্তি যত বেশি সে তত শীঘ্র ফল পায়, আর তার কুণ্ডলিনীও তত শীঘ্র জাগেন। যতদিন তিনি না জাগেন ততদিন কল্পনা কর- তিনি জাগছেন। আর ইড়া ও পিঙ্গলার গতি অনুভব করার চেষ্টা কর, জোর করে তাদের সুষুম্না পথে চালাতে চেষ্টা করো- এতে কাজ খুব তাড়াতাড়ি হবে। মনের সংযমের দ্বারাই কল্পনা করা সম্ভব।’
মহাসর্প অনন্ত যেমন রত্ন-নিধিসমাকীর্ণা পৃথিবীর একমাত্র আধার, তেমনি কুণ্ডলিনী শক্তি হঠ্তন্ত্রের আধার। ঐ কুণ্ডলিনী শক্তি জাগরিতা হলে শরীরে ষট্চক্রস্থিত অখিল পদ্ম ও গ্রন্থি ভেদ হয়ে যাওয়ায় প্রাণবায়ু সুষুম্নাচ্ছিদ্র দিয়ে অনায়াসে যাতায়াত করতে পারে। প্রাণায়াম অভ্যাসে যা বিশেষ প্রয়োজন।
প্রণয়মূলক চিন্তা বা পাশব-কার্য থেকে যে যৌনশক্তি উত্থিত হয়, তাকে উর্ধ্বদিকে মানব শরীরের মহাবিদ্যুৎ আধার মস্তিষ্কে প্রেরণ করতে পারলে সেখানে সঞ্চিত হয়ে যৌনশক্তি ‘ওজঃ’ বা আধ্যাত্মিক শক্তিলাভে সাহায্য করে। এই ‘ওজস’ হচ্ছে মানুষের মনুষ্যত্ব- একমাত্র মনুষ্যশরীরেই এই শক্তি সঞ্চয় করা সম্ভব। যাঁর ভেতর সমস্ত পাশব যৌনশক্তি ওজঃশক্তিতে পরিণত হয়ে গেছে, তিনি মহাপুরুষ বা দেব পর্যায়ে উন্নীত হন।
যোগীরা মনে মনে কল্পনা করেন যে এই কুণ্ডলিনী সর্প সুষুম্না পথে স্তরে স্তরে চক্রের পর চক্র ভেদ করে মস্তিষ্কের সহস্রধারে (Sahastrara Chakra) উপনীত হয়। মনুষ্য শরীরের শ্রেষ্ঠ শক্তি যৌন-শক্তি যে পর্যন্ত না ওজঃশক্তিতে পরিণত হয়, সে পর্যন্ত নারী বা পুরুষ কেউই ঠিক ঠিক আধ্যাত্মিক জীবন লাভ করতে পারে না।
কোন শক্তিই সৃষ্টি করা যায় না, তবে তাকে শুধু ঈপ্সিত পথে চালিত করা যেতে পারে। এটাই রাজযোগের উদ্দেশ্য। একমাত্র যোগীরাই যোগ প্রভাবে এই সমস্ত নাড়ী সম্বন্ধে সবিশেষ জানতে পারেন এবং তা অনুভবও করেন। রাজযোগ অভ্যাস করতে হলে প্রথমে হঠযোগ আয়ত্তে আনতে হয়। হঠযোগই রাজযোগের সোপান। আর এই হঠযোগের একটা বিরাট অংশ হলো অষ্টাঙ্গযোগ (Astanga Yoga)। কারণ এর অঙ্গ হলো আটটি-
(১) যম (Yama),
(২) নিয়ম (Niyama), (৩) আসন (Asana), (৪) প্রাণায়াম (Pranayama),
(৫) প্রত্যাহার (Pratyahara),
(৬) ধারণা (Dharana),
(৭) ধ্যান (Dhyana) ও (৮) সমাধি (Samadhi)
তবে সাধারণ চর্চাকারীদের জন্য মূলত প্রথম চারটি অঙ্গের নির্বাচিত অংশই অভ্যাস করা বাঞ্ছনীয়।
ক্রিয়াযােগ অভ্যাস ও কুন্ডলিনী জাগরণের মধ্যে খুব নিকট সম্পর্ক আছে । মূলাধারের অবস্থান , মেরুদণ্ডের উপর পায়ুদেশের দুই আঙ্গুল উপস্থের ( জননেন্দ্রিয় ) চার আঙ্গুল নীচে । মূলাধারে ত্রিকোণ এক অবস্থানের মধ্যে অতি উজ্জ্বল প্রকাশমান দিব্য দ্যুতিকে কুণ্ডলিনী শক্তি বলেন । তন্ত্রশাস্ত্রে যেই কুণ্ডলিনী জাগরণের অভিজ্ঞতা বলা হয়েছে , ক্রিয়াযােগের ক্ষেত্রে সেটা অনেক সৌম্য । কুণ্ডলিনী শক্তি সুষুম্নার মধ্যে প্রাণ শক্তির আধার । ক্রিয়াবানগণ কুণ্ডলিনী শক্তিকে সুষুস্মার মধ্যে এক অতি উজ্জ্বল সােনালী আলাের প্রকাশমান অভিজ্ঞতা লাভ করেন। সাধক মূলাধারে , অগ্নির প্রকাশ অবলােকন করেন । কুণ্ডলিনী শক্তি প্রকৃত " অর্থে সত্ত্ব , রজ ও তমো এই তিনগুণ বিশিষ্ট মাতৃশক্তি , তিনিই প্রকৃতিরূপা ব্রহ্মশক্তি । মানুষের আধ্যাত্মিক অবচেতনার মূল কারণ হচ্ছে তার কুণ্ডলিনী শক্তির , মূলাধার চক্র জড়বৎ সুপ্ত থাকা । প্রাণশক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করার মূলমন্ত্র হচ্ছে কুলকুণ্ডলিনী জাগ্রত করা । প্রাণ নিয়ন্ত্রণের উপায় হচ্ছে , ক্রিয়া করা । কুণ্ডলিনী শক্তিই সমগ্র শরীরে প্রাণরূপ বায়ুর সঞ্চালন করে । মেরুদণ্ডের মধ্যে মূলাধার থেকে সহস্রার এবং সহস্রার থেকে মূলাধার , প্রাণ বায়ুর সঞ্চালিনী ক্রিয়া করে সাধক চূড়ান্ত ধ্যানের অবস্থা প্রাপ্ত করে । এটাই ক্রিয়াযােগের অন্তর্নিহিত গোপন রহস্য ।
তন্ত্রে কথিত আছে যে , কুণ্ডলিনীই জীবনদায়ী শক্তি । যা দেবী বায়বী শক্তি । তিনি জীবনদায়ী বায়ু শক্তির দেবী । ক্রিয়ার নিরন্তর অভ্যাসের দ্বারা মন লয়ের স্থিতি প্রাপ্ত হয় । ক্রিয়ার দ্বারা কুণ্ডলিনী নিম্নদেশ থেকে উর্ধ্বে ও ঊর্ধ্বদেশ থেকে নিম্ন পর্যপ্ত চলাচল করে । শাস্ত্রে বলছে,
"পিণ্ডং কুণ্ডলিনী শক্তিং হংস ' ইতি উদাহৃতম ।
রূপম্ বিন্দুমিতি জ্ঞেয়ং রূপাতীতং নিরঞ্জনম ”।।
সম্পূর্ণ দেহ , এই মহান শক্তির দ্বারা কার্য করে। মূলাধার চক্রে তিনি সুপ্ত । হৃদকেন্দ্রে অর্থাৎ অনাহত চক্রে তিনি হংস । দুই ভ্রুদেশের মধ্য বিন্দুতে অর্থাৎ কুটন্ত বা আজ্ঞাচক্রে , ধ্যানের পরাবস্থায় তিনি নিরাকার , অনন্ত ব্রহ্ম স্বরূপ ।
পঞ্চবায়ু ও প্রাণবায়ু , কুণ্ডলিনী শক্তির দ্বারা শান্ত বা তরঙ্গিত হয় যেমন গভীর শান্ত সমুদ্র বা তটের অশান্ত ঢেউ । সকল প্রকার জড় বা জীবিত জগৎ কুণ্ডলিনী শক্তির দ্বারাই চালিত । মানুষের শরীর তত্ত্বে কুণ্ডলিনী শক্তি পায়ের নখ থেকে মাথার চুল পর্যন্ত জীবিভূত হয়ে আছে । রূপ , রস , গন্ধ , স্পর্শ এই গুণগুলি কুণ্ডলিনী শক্তির কার্যকারিতা । সকল প্রকার জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার মূল কারণ কুণ্ডলিনী শক্তি । ইড়া নাড়ী , সুষুম্নার বাম পাশে অবস্থিত এবং প্রত্যেকটা চক্রকে জড়িয়ে উপরে ডান নাসারন্ত্রী হয়ে আজ্ঞাচক্রে প্রবেশ করছে ।
সুষুম্নার ডান পাশে রয়েছে পিঙ্গলা নাড়ী । এই নাড়ী ইড়ার ন্যায় প্রত্যেকটা চক্রকে জড়িয়ে উপরে উঠেছে এবং বাম নাসারন্ধ হয়ে আজ্ঞাচক্রে প্রবেশ করছে । ইড়া , পিঙ্গলা ও সুমুন্না , এই তিনটি নাড়ীর মিলনক্ষেত্র হচ্ছে আজ্ঞাচক্র এবং এই মিলন কেন্দ্রকে বলা হয় ত্রিবেনী । এই তিনটি নাড়ী যথাক্রমে গঙ্গা , যমুনা ও সরস্বতী নদীকে স্মরণ করায় । এই নাড়ী তিনটি আজ্ঞাচক্রে প্রবেশ করার পর আবার নিচে নেমে মূলাধারে এসে মিশেছে । মূলাধার চক্রে এরা মিশে একটি নাড়ী হয়েছে । এই জন্যই আজ্ঞাচক্র ইচ্ছে মুক্ত ত্রিবনী ; অর্থাৎ মুক্তির প্রতীক । মূলাধার বা ধনচক্র হচ্ছে যুক্ত ত্রিবেনী অর্থাৎ বন্ধনের প্রতীক । একমাত্র যােগীরাই পারে , ত্রিনয়ন দিয়ে কুণ্ডলিনী শক্তিকে পরখ করতে।
কুণ্ডলিনী শক্তির জাগরন ঘটলে শরীরে চক্রগুলির মধ্যে আলাে উদ্ভাসিত পদ্ম ও তার উজ্জ্বল পাপড়িগুলি দেখা যায়। ইড়া , পিঙ্গলা ও সুষুম্না ব্যতীত , অন্যান্য শাখা প্রশাখা স্নায়ুগুলিকে আনন্দদায়ী স্নায়ু বলে । এই স্নায়ুতন্ত্র সমগ্র শরীরে পরিব্যাপ্ত । জীবনীশক্তিই আমাদের একমাত্র বন্ধু । অতান্ত স্থির অবস্থায় এই শক্তিই জীবাত্মা , স্বয়ং ।
“ প্রাণেন ধার্যতে লােকঃ সর্বং প্রাণময়ং জগৎ । "
এই জীবনী শক্তিই সমগ্র ব্রহ্মাণ্ড ও বিশ্ব চরাচরের স্থিতিকর্তা । পুরাণে বর্ণিত যে রাধা প্রেমিকা এবং শ্রীকৃষ্ণ প্রেমিক । ' রাধা ' অন্তর্নিহিত অর্থ হচ্ছে -- 'রা' - অর্থাৎ সমগ্র ব্রহ্মান্ড এবং ‘ধা' - অর্থাৎ , যিনি পালন করেন । অতএব প্রাণ শক্তিই কৃষ্ণ , যিনি রাধাকে ধারণ করে রেখেছেন । প্রতিটি জীবের জীবন হচ্ছে এই প্রাণশক্তি । এই জীবনী শক্তি ধনচক্রে ( মূলাধারে ) কুণ্ডলিনী শক্তি রূপে অবস্থান করে । বৈষব শাস্ত্রে কুণ্ডলিনীর অন্তর্নিহিত অর্থ বলতে রাধাকে বলা হয়েছে ।
এই কুণ্ডলিনীর বাস্তবিক অবস্থান বা গৃহ হল সহস্রার । কিন্তু তিনি ( রাধা ) নিজেকে ভগবান কৃষ্ণের কাছে থেকে সরিয়ে নিয়েছেন এবং নিজেকে ধনচক্র মূলাধারে স্থাপন করেছেন । তিনি ( রাধা ) এখন অন্ধকারে বাস করছেন । এটাই হচ্ছে ঈশ্বর চেতনার অভাব । তিনি তার সহস্রারের গৃহের বাস্তবিকতা বিস্মৃত হয়েছেন । তিনি তার গৃহ পরিত্যাগ করেছেন ও নিজের প্রকৃত গৃহ সহস্রারে প্রবেশ করতে পারছেন না । এবং এটার মূল কারণ হল তিনটি গাঁট বা গেড়ো ইড়া , পিঙ্গলা ও সুষুম্না । তিনি এদের দ্বারা মূলাধারে কারাবাস গ্রহণ করেছেন । ধনকেন্দ্রে মূলধারে রাধার স্মৃতিকে মায়ার বন্ধন বলে । এই পরিস্থিতিকে মায়ার গভীর নিদ্রাও বলা যায় । মায়ার এই নিদ্রাগ্রস্ত অবস্থায় মানুষমাত্র ২৪ ( চব্বিশ ) ঘন্টায় ২১৬০০ ( একুশ হাজার ছয়শত ) টি শ্বাস প্রশ্বাস গ্রহণ করে । যদি আমরা এই শক্তিকে মায়ার নিদ্রা থেকে জাগৃত করতে পারি , তবেই আমরা সাধনার প্রকৃত অভ্যাসের স্থিতিতে পোঁছাবাে । এই স্থিতি হল সহস্রার স্থির হয়ে থাকা । কুণ্ডলিনী শক্তিই দিব্যশক্তি যিনি কুণ্ডের ( পাত্র ) মধ্যে আশ্রয় নেন । কুণ্ড একটা পাত্র যেখানে কুণ্ডলিনী শক্তি অবস্থান করে । এটা কুণ্ডলিনীর স্থিতাবস্থা । যখন কুণ্ডলিনী শক্তি পাত্রে অবস্থান না করে স্বতন্ত্র হয়ে যায় এবং কুণ্ড শূন্য হয়ে যায় তখন সেই অবস্থাকে কুলকুণ্ডলিনীর জাগরণ বলে ।
আমাদের বন্ধনের মূল কারণ হচ্ছে আমাদের ছয়টি চক্রের চক্রান্ত ও কপটতা । যদি আমরা এই যষ্ঠচক্র থেকে বিচ্ছিন্ন হতে পারি , তবে এই ছয়টি চক্রকে অতিক্রম করতে পারি । ক্রিয়া অভ্যাসের ফলে সুপ্ত কুণ্ডলিনী মূলাধারে পূর্ণ জাগরিত হয়ে উর্ধে প্রবাহিত হয় । মানুষ তখন বাহ্যিক ও ভৌতিক বিশ্ব সম্বন্ধে জ্ঞান অর্জন করে । ঈশ্বর চেতনা মূলাধার থেকে সুষুন্নার ভিতর দিয়ে ষষ্ঠচক্র অতিক্রম করে দিব্য সাম্রাজ্য , সহস্রারে পৌঁছায় । সহস্ৰারে এই কুণ্ডলিনী শক্তি , পরমপিতা , সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের সঙ্গে যুক্ত হয় । প্রাণশক্তির পূজাই সর্বশ্রেষ্ঠ পূজা ।
অতএব- ‘ প্রাণাে হি ভগবানেষ প্রাণাে বিষ্ণুঃ পিতামহঃ ।
প্রাণেন ধার্য্যতে লােকঃ সর্বং প্রাণময়ং জগৎ।"
জীবন শক্তিই ঈশ্বর , ভগবান শিব , ভগবান বিষ্ণু ভগবান ব্রহ্মা । প্রাণশক্তিই ব্রহ্মাণ্ড ও সৃষ্টি । প্রাণশক্তিই সকল স্থাবর জংগম সকলকে ধারণ করে রেখেছে । শ্রুতিতে বলে যে প্রাণশক্তিই পিতামাতা ও গুরু ।
শাস্ত্রে বলেছে - বায়ুর উপস্থিতি শরীর ও চৈতন্যকে আবহমান করে রাখে । যদি বায়ু শরীরকে ত্যাগ করে , তবে শরীর থাকে না , চৈতন্যও থাকে না । বায়ুই সৃষ্টি কর্তা , পালন কর্তা এবং লয় কর্তা । সকল প্রকারের সাধনার মধ্যে ক্রিয়াযােগও একটি অন্যতম সাধনা । শ্রুতিতে কথিত যে — ক্রিয়া ও প্রাণায়াম ব্যতীত অন্য কোনও পন্থা নেই , যার দ্বারা প্রকৃত ধ্যানের অবস্থা প্রাপ্ত করা যায় । ক্রিয়া অভ্যাসের দ্বারা মন পবিত্র হয় এবং মানের আলাে প্রবেশ করে । নিষ্ঠার সঙ্গে প্রাণ ক্রিয়া করলে যে কেউ সাধনার সর্বোচ্চ অবস্থান প্রাপ্ত করতে পারে । সাধক তখন স্থিতপ্রজ্ঞা লাভ করেন । তিনি তখন পার্থিব বন্ধন ভ্রম ও ভ্রান্তি থেকে মুক্তি লাভ করেন । গােরক্ষ সংহিতায় বর্ণিত আছে যে — বায়ু যদি সুষুম্নায় স্থিত না হয় তবে শাস্ত্রের শ্লোক বা অন্যান্য জ্ঞানের কথা উচ্চারণ করা বৃথা। প্রাণ শক্তি , সুষুম্নায় নিবন্ধ হতেই হবে । শ্বাসের উপর নিয়ন্ত্রণ এলে তবে বিন্দুর প্রকাশ ও আজ্ঞাচক্রে একাগ্রতা জন্মায় । যদি উচ্চতর মন ধ্যেয় বস্তুর সঙ্গে একাত্ব না হয় তবে ধ্যানের অভ্যাস বৃথা হয় । ঈশ্বরের শক্তির ক্রিয়াই হচ্ছে মহাপ্রাণ । আমাদের শরীরে প্রাণশক্তির ক্রিয়া হচ্ছে “ খণ্ডপ্রাণ ’ একক প্রাণ ও সীমিত প্রাণশক্তি ।
আধ্যাত্ম সাধনার মূল লক্ষ্য হচ্ছে যে , এই সীমিত খণ্ডপ্রাণকে , অসীম পরিব্যাপ্ত মহাপ্রাণ শক্তির সঙ্গে একীভূত করা । ব্রহ্ম চেতনার সঙ্গে সদা মুক্ত থাকাই হচ্ছে ক্রিয়ার লক্ষ্য । ব্রহ্মসত্তা ও স্থিতি হচ্ছে আমাদের প্রকৃত অস্তিত্ব বা পরিচিতি । সর্বোচ্চ মহাপ্রাণ শক্তি স্বয়ং নিজেকে অসংখ্য ভাবে বিভক্ত করে এক একটি একক প্রাণশক্তিতে নিজেকে প্রতি জীবের মধ্যে প্রকাশ করেছেন । এই মহাপ্রাণ শক্তি উর্ধ্বে থেকে প্রাণ বায়ু হয়েছেন এবং নিম্নে গমন করে অপান বায়ু হয়েছেন । যখন প্রাণ ও অপান বায়ুর গতিরুদ্ধ হয়ে যায় তখন কুণ্ডলিনী শক্তি উচ্চতর মনস অবস্থা অর্থাৎ চিত্ততে পরিণত হয় । আত্মা দুঃখ আনন্দ ভাবলেশ এর উর্ধ্বেে , শান্ত উদাস্ত স্থির সমাহিত মনের অবস্থা । প্রাণের অস্থির স্থিতি মন , মন ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে আনন্দ অনুভব করতে চায় । লাহিড়ী বাবা বলেন — প্রাণায়াম কর প্রাণশক্তিকে আবার শান্ত সমাহিত অবস্থায় আনতে হবে । যেই প্রক্রিয়ার দ্বারা প্রাণকে স্থির করা যায় তাকে ক্রিয়া বলে । পতঞ্জলী দর্শনের সাধনপাদে বলা হয়েছে—
“শ্বাসপ্রশ্বাসয়োগতিবিচ্ছেদঃ প্রাণায়ামঃ ” অর্থাৎ শ্বাস প্রশ্বাসের গতি রুদ্ধ হওয়াই প্রাণায়াম । কিন্তু কি প্রকারে এই শ্বাসের গতি রুদ্ধ অবস্থা আসবে , পতঞ্জলীর দর্শনে উল্লেখ করা নেই । গীতাতে প্রাণায়ামের প্রক্রিয়া পরিস্কার করে বলা আছে।
পরিষ্কার করে বলা আছে ।
Continue-37
প্রানায়াম সম্পর্কে
গীতাতে বলছে-
“ অপানে জুহুতি প্রাণং প্রাণেহপানং তথাপরে । প্রাণাপাণগতি রুদ্ধা প্রাণায়ামপরায়ণাঃ । ” যােগীদের কুম্ভক প্রাণায়াম প্রাণ ও অপানের রুদ্ধ অবস্থা আসে । প্রাণ বায়ু উর্ধ্বগতি সম্পন্ন বায়ু যা প্রশ্বাসের সঙ্গে আসে , এবং অপান নিম্নগতি সম্পন্ন বায়ু যেটা নিশ্বাসের সঙ্গে যায় । প্রাণ এবং অপানের ভারসাম্য অবস্থাই কুম্ভক অবস্থা , ক্রিয়ার দ্বারাই করা সম্ভব ।
যে বায়ু ছেড়ে দেওয়া হয় অর্থাৎ নিঃশ্বাস উপর থেকে নিচে নেমে মূলাধারে সুষুম্নার মধ্যে দিয়ে যায় এবং সেখানে নেমে অপান বায়ুর সঙ্গে মেশে । যে প্রশ্বাস নেওয়া হয় সেই বায়ু অপান বায়ুকে মূলাধার থেকে উপর নিয়ে প্রাণবায়ুর সাথে মিলিয়ে দেয় । যােগ শাস্ত্রে এই প্রক্রিয়াকে "কেবলী প্রাণায়াম” বলে । এই প্রক্রিয়ার দ্বারা প্রাণের এবং অপান-এর গতি নিজের থেকেই রুদ্ধ হয়ে যায় । এর ফলে মন ও প্রাণ স্থির ও শান্ত হয় । সাধক আনন্দ সাগরে অবগাহন করতে থাকে। তার ঈশ্বর , জ্ঞান উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হতে থাকে । মন ও প্রাণের স্থিতি অবস্থার জন্য , বাহ্যিক শ্বাস ও প্রশ্বাস স্থিতিশীল হয় । সাধকের শরীর দৃষ্টি এবং বাক্য স্থির ও শান্ত হয়ে যায় । সাধকের এই বাহ্য শান্ত স্বরূপ তার আন্তরিক স্থিরতা এবং নিজের মনের উপর নিয়ন্ত্রণের প্রদর্শন করে । প্রাণ শক্তির ক্রিয়া হচ্ছে কেবল কর্ম , এটাই ক্রিয়াযােগ । গীতাতে এই প্রক্রিয়াকে খুব সুক্ষ্ম রূপে বর্ণনা করেছে । অপান বায়ুর অবস্থান হচ্ছে মূলাধারে এবং প্রাণবায়ুর অবস্থান হচ্ছে আজ্ঞাচক্রে অপান বায়ু , নিম্নগামী বায়ু এবং এই বায়ু মনকে অস্থির করে । প্রাণবায়ু উর্ধ্বগামী বায়ু এবং মনকে স্থির করে । উচ্চ মনকে বা চিত্তকে ক্রিয়ার দ্বারা রুদ্ধ করলে ক্রিয়ার পরাবস্থা অর্জন করা যায় ।
পরম ব্রহ্ম বা পরমাত্মা ত্রিগুণাতীত অর্থাৎ সত্ত্ব , রজ ও তমাে গুণের উর্ধ্বে। তিনি অবাংমানসগােচর অর্থাৎ মন বুদ্ধি , অহংকার , চিত্ত , জ্ঞান ও বাক্যের অতীত । ঈশ্বরের মধ্যে বিভিন্নতা বা ভেদভাব নেই । প্রকৃতির এই ত্রিগুণ হচ্ছে তার পার্থিব প্রকৃতি । ভৌতিক পৃথিবী এবং আমাদের শরীর প্রকৃতির এই ত্রিগুণের আবর্তের মধ্যে ঘুরেই যাচ্ছে । এই ত্রিগুণ ( সত্ত্ব , রজ ও তমাে ) প্রাণ রূপে ইড়া , পিঙ্গলা ও সুষুম্নার মধ্যে চলাচল করছে । যােগীদের মতে এই মূল ভূত প্রাণই কুণ্ডলিনী শক্তি । এই শক্তিই সকল জীবের জীবন ।
সকল প্রকার পার্থিব বন্ধন থেকে মুক্ত হলে মানুষ ঈশ্বর প্রণিধান করতে পারে। এই স্তরে সকল বিভিন্নতা এক বা সমান হয়ে যায় । প্রাণশক্তি , যখন হাজার হাজার স্নায়ুতন্ত্রের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয় তখন মানুষ বহির্মুখী আচরণ করে । এই প্রাণশক্তি প্রবাহ যখন অসংখ্য স্নায়ুতন্ত্রিত হতে থাকে তখন মানুষ উন্মাদ হয়ে যেতে পারে । মানুষ পার্থিব নানান বন্ধনে মুগ্ধ হয়ে জড়িয়ে যায় । সুখ , দুঃখ , আনন্দ ও বিষণ্ণতা প্রভৃতি ভাবনা এক এক প্রকারের শ্বাস প্রশ্বাসের সঙ্গে সম্বন্ধিত । এটাই পৃথিবীর লীলা । এই অবস্থা মৃত্যুর দিকে নিয়ে যায় । কিন্তু প্রাণায়ামের আধ্যাত্মিক অভ্যাস মানুষকে পার্থিব বন্ধন ও মৃত্যুর অতীতে নিয়ে যেতে পারে । মন যখন স্থির হয় তখন চিদাকাশের প্রশান্ত অবস্থা অবলােকন হয় । চিদাকাশের স্থিতিতে সাধক মনের চূড়ান্ত শান্ত অবস্থা অনুভব করে । এই অবস্থায় মানুষের বিবেক জাগ্রত হয় । চিদাকাশের বিবেকের আলাের দ্যুতি সূৰ্য্য চন্দ্র ও অগ্নির আলােক অপেক্ষা অনেক বেশি উজ্জ্বল । বলা হয়- “ তৎ শুভং জ্যোতিষাং জ্যোতিঃ । ” এই আলাে সাধনার জন্য সর্বত্তম । যােগীর হৃদচক্র একটি পবিত্রতম গুহা । এই গুহা পবিত্রতা ও স্নিগ্ধ চন্দ্রালােকে পরিপূর্ণ । অনন্ত হৃদয়ের স্থির শূন্য হচ্ছে আত্মা । সমাধির শান্তি , নিদ্রার শান্তি অপেক্ষা অনেক বেশি আনন্দদায়ক । নিদ্রা এবং সমাধির মধ্যে তুলনা মানুষের ভাবনার অগােচর । কারণ সমাধি হচ্ছে ব্যবহারিক অনুভব । কেবলমাত্র দক্ষ যােগী , ঋষি এবং সন্তগণ এই সমাধির অনুভব করেন ।
কালাতীত অবস্থা ও মৃত্যুঞ্জয় অবস্থা ঈশ্বর এই শরীরের মধ্যে ক্রিয়াশীল করেন । আমাদের কেবল শ্বাসের দিকে নজর রেখে শ্বাসকে স্থির করতে হবে , তখনই আমরা জ্ঞানের সঙ্গে সংযুক্ত হব । উপনিষদে বলেছে- “ অবিদ্যায় মৃত্যুং তীত্ত্বা বিদ্যয়ামৃতমশ্নুতে । ” ঈশ্বর প্রণিধানের প্রক্রিয়া হচ্ছে মহাবিদ্যা । ঈশ্বর চেতনা ব্যতীত কোনও অভ্যাস হচ্ছে অবিদ্যা । মহাবিদ্যার অভ্যাস সুষুন্নার মধ্যে করতে হয় । মেরুদণ্ডের মধ্যে সুষুম্না নাড়ীর অবস্থান , একমাত্র ঈশ্বর সাধনার উন্নতির জন্য যখন প্রাণবায়ু সুষুম্নার মধ্যে প্রবেশ করে তখন ঈশর সাধনা সফল হয় । সুষুম্না নাড়ী অমৃতের রাস্তা । এটা দিব্য পথ । শাস্ত্রে কথিত আছে- "মারুতে মধ্যসঞ্চারে মনস্থৈর্য্যং প্রজায়তে , যমনঃ সুস্থিরীভূবা সৈবাবস্থা মনােন্নি ।"
শ্বাস নিয়ন্ত্রণের প্রক্রিয়া দ্বারা যেই স্থির মন প্রাপ্ত হয় , সেই স্থির অবস্থা , মুক্তি বা চূড়ান্ত দক্ষতা এনে দেয় । ব্ৰহ্মচেতনার এই উচচতর মনস্তত্ত্ব দক্ষতার পথ । যােগ শাস্ত্র বলে যে-
“ যদা সমক্ষীয়তে প্রাণঃ মানসং চ প্রলীয়তে ।
তদা সমরসত্ত্বঞ্চ সমাধিরভিধীয়তে । ” অর্থাৎ ইন্দ্রিয়মসূহের নিয়ন্ত্রণ মনের প্রজ্ঞা বা অন্তদৃষ্টির স্থিতি উন্মোচন করে । ভগবত গীতায় আছে- “ বশে যস্যে বেন্দিয়ানি তস্য প্রজ্ঞা প্রতিষ্ঠিতা ।" অর্থাৎ যাঁর ইন্দ্রিয় তাঁর নিয়ন্ত্রতে করায়ত্ব হয়েছে তার প্রজ্ঞা , অন্তর্দৃষ্টি শক্তি স্থাপিত হয় ।
জ্ঞান সঙ্কলিনী তন্ত্রে বলেছে-
" ন হােম হােম ইত্যাঙ্গঃ ব্রহ্মাগ্নৌ হূয়তে প্রাণঃ হােমকর্ম তদুচ্যতে ।। প্রাণ ক্রিয়াই প্রকৃত হােম বা ঈশ্বরের প্রতি শরণাগতি । এই হােম ক্রিয়া দ্বারা একজন সাধক ব্রহ্মাস্থিতি লাভ করতে পারেন । প্রতি শ্বাস ব্রহ্মকে সমর্পণ করে , কুম্ভক অবস্থা প্রাপ্ত হওয়াই হচ্ছে প্রকৃত হবন ( হােম ) বা যন্ত্র ।
ক্রিয়া অভ্যাসের দ্বারা সকল স্নায়ুতে প্ৰাণবায়ু সঞ্চালিত হয়ে পবিত্র হয় । প্রতিটি চক্রের বন্ধন ও নাকারত্মক প্রকৃতি দূর হয় । স্নায়ুর পবিত্রতা ও পরিশুদ্ধতার হেতু , প্রাণবায়ু সুষুম্নার মধ্যে প্রবেশ করে । প্রাণবায়ু যখন সুষুন্না নাড়ীতে প্রবেশ করে মন তখন শূন্য অবস্থা প্রাপ্ত হয় । সুষুস্মার মধ্যে প্রাণবায়ুর নিরন্তর প্রবাহহেতু যােগী কর্মবন্ধন হতে মুক্ত হন । মন যখন স্থিরতা ও প্রসন্নতা প্রাপ্ত হয় তখন সাধকের মধ্যে বিলয়ন আপনাআপ পরিলক্ষিত হয় । প্রাণ বায়ু যদি স্থির না হয় , তবে মনও স্থির হতে পারে না । অতএব প্রাণবায়ুর স্থিরতাই প্রাথমিক মুখ্য লক্ষ্য । যােগী গােরক্ষনাথজী বলেছেন- প্রাণ বায়ুকে সুষুম্না নাড়ীতে স্থির করতে না পারলে জ্ঞানের উন্মােচন হতে পারে না । আত্মজ্ঞান না হলে , সকল বক্তব্যই বৃথা ও নিরর্থক ।
যােগসূত্রে বলেছে — খুব স্বাভাবিক ভাবে ও আরামদায়কভাবে প্রাণবায়ুকে যদি নিয়ন্ত্রণ করা যায় , সেখানে প্রশ্বাস ও নিঃশ্বাস কোনও আলাদাভাবে বা জোর করে নিয়ন্ত্রন করা হয় না , তাকেই কেবল কুম্ভক বলে । প্ৰাণৰায়ু নিয়ন্ত্রণের ক্রিয়া অভ্যাসের দ্বারা স্বাভাবিক ভাবে কেবলই কুম্ভক হতে থাকে ।
অপান বায়ু , মূলাধার থেকে উর্ধ্বে সারে গতি প্রাপ্ত হয় এবং প্রাণবায়ু সহস্রার থেকে নিম্নে মূলাধারে গতিপ্রাপ্ত হয় । এই ঘটনার জন্য নিচের কেন্দ্রগুলি উন্নতিপ্রাপ্ত হয় । নিয়মিত ক্রিয়া অভ্যাসের দ্বারা মস্তিস্কের স্থিরতা আসে । মস্তিষ্কের মধ্যে প্রাণবায়ু অপান বায়ুর সঙ্গে মিশ্রিত হয় । প্রশ্বাস ও নিঃশ্বাসের আকর্ষণ ও বিকর্ষণ বায়ুকে নিজের থেকেই স্থিরতা প্রদান করে , বায়ুর এই স্থিরতাকে কেবল কুম্ভক বলে ।
গঙ্গা , যমুনা ও সরস্বতী নদী যেমন এলাহাবাদে , একসঙ্গে মিশে ত্রিবেণী সঙ্গম করছে , ঠিক সেইভাবে সূৰ্য নাড়ী বা পিঙ্গলা নাড়ী , চন্দ্র নাড়ী বা ইড়ানাড়ী এবং সুষুম্না নাড়ী একসঙ্গে আজ্ঞাচক্রে মিলিত হয়ে সঙ্গম তৈরি করছে । যােণবিশিষ্ট বলছে— “ যেই যােগী , কেবল কুম্ভকে দক্ষ , তিনি সকল প্রকার দুঃখ , জ্বালা ও যন্ত্রণা থেকে মুক্ত থাকেন ।
দূর্গা সপ্তসতীতে বর্ণিত আছে— " ত্বং বৈষ্ণবী শক্তিরনন্তবীৰ্য্যা বিশ্বস্যবীজং পরমাসি মায়া ।
সমাহিতা দেবী সমন্তমেতৎ ত্বং বৈ প্রসন্ন ভুবিমুক্তি হেতুঃ।"
অর্থাৎ, হে দেবী তুমি সমগ্র বিশ্বের মায়া ও ভ্রান্তি প্ৰদায়িনী । তুমি ভগবান বিষ্ণু দ্বারা সৃষ্ট , সর্বশক্তিমান অবিনাশী শক্তি । তুমিই সকলের বীজ স্বরূপ । সমগ্র বিশ্ব তােমার মায়া দ্বারা পরিব্যাপ্ত । তােমার আশীর্বাদ এবং
ভক্তের প্রতি তােমার সন্তুষ্টি মুক্তির কারণ । ”
সমগ্র বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দু শক্তি হচ্ছে প্রাণ বা জীবনী শক্তি । এই জীবনী শক্তিকেই কুণ্ডলিনী শক্তি বলে। কুণ্ডলিনী শক্তিই হচ্ছে সমগ্র ব্রহ্মাণ্ডের মাতৃবৎ । বিশ্বও সৃষ্টি হচ্ছে বহির্মুখী প্রাণশক্তিতে । এই মায়াই হচ্ছে সৃষ্টি অর্থাৎ মহামায়া ( ভ্রান্তি ) , প্রাণশক্তি হতে মন উৎপন্ন হয় । মনের উৎপত্তির বিন্দুই হচ্ছে শ্বাস । মন যখন শান্ত সৌম্য শ্বাসের মধ্যে সমাহিত হয় তখন সাধক গভীর ধ্যানের অবস্থা প্রাপ্ত হয় ( পরাবস্থা ) । পরমহংস যােগানন্দ বলতেন, “ প্রাণায়াম জীবন শক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করে , শ্বাসকে নয় । আত্মা হচ্ছে ঈশ্বরের স্বপ্ন । তিনি নিজেকে এই স্বপ্নের খাঁচায় বন্দী করেছেন । শ্বাসের মধ্যে যেই রহস্য আছে সেটাই ঈশ্বরের স্বপ্ন । শ্বাস প্রশ্বাস মানুষের জীবনের গুপ্ত রহস্য , এটাই জীবন দায়ী শক্তি । প্রশ্বাস ও নিঃশ্বাসের গতি , ক্রিয়াযােগ অভ্যাসের
দ্বারা রুদ্ধ হয় । এরপর অভ্যাসের দ্বারা ফুসফুসের গতি কর্ম ও হৃদ্যন্ত্রের গতি কর্ম ধীরে ধীরে রুদ্ধ হয় । এই অতিগুহ্য বিদ্যা অবশ্যই কোন একজন উপলব্ধিপ্রাপ্ত আত্মজ্ঞানী গুরুর নির্দেশ অনুযায়ী অভ্যাস করতে হয় ।"
শাস্ত্রে বলেছে— “ প্রাণ বায়ু হচ্ছে উর্ধগতি শক্তি এবং অপান বায়ু হচ্ছে নিম্নগতি । শক্তি যখন এই দুইটি একস্থানে মিলিত হয় তখন সুষুন্না পূর্ণজাগরিত হয় । সুষুম্নার পূর্ণজাগরণ ব্ৰহ্মচেতনার দ্বার খুলে দেয় অর্থাৎ পরম পদ লাভ হয় ( সর্বোচ্চ স্তর ) । যেই বায়ু হৃদচক্র থেকে সহস্রারে গমন করে তাকে প্রাণ বায়ু বলে ( জীবনদায়ী বায়ু ) । বায়ুর এই প্রবাহকে ইড়া প্রবাহ বলা হয় । পিঙ্গলার প্রবাহ নিচের চক্রগুলিতে হয়— স্বাধিষ্ঠান ও মূলাধার চক্রে । পিঙ্গলা বায়ুর প্রবাহকে অপানবায়ু , বলা হয় । উপর ও নীচের বায়ু অর্থাৎ অপান ও প্রাণ বায়ু যেখানে একে অপরকে ছেদন করে সেই অবস্থাকে সমান বায়ু বলে । সমান বায়ুর অবস্থান হচ্ছে মণিপুর চক্র । এটা অগ্নির ন্যায় । এই অগ্নিকে বৈশ্বানর অগ্নি বলে ( পাচন অগ্নি ) । এই অগ্নি সকল কিছু দাহ করতে পারে , এই অগ্নি স্বয়ং এই অগ্নিকে দাহ করতে পারে । প্রাণ বায়ুর বহিগতি , মণিপুরচক্র থেকে সহস্রার চক্র পর্যন্ত পরিব্যাপ্ত এটি ব্রহ্মঅগ্নি । তিন প্রকারের এই বায়ু নাড়ীচক্রে এসে মিলিত হয় । মণিপুর ( নাভীচক্র ) হতে হৃদচক্র পর্যন্ত বায়ু শান্ত অবস্থায় থাকে । এই বায়ুর এই শান্ত অবস্থা প্রাণশক্তি এবং তার গতিকে সমাহিত করে । পরাবস্থায়, এই স্থিতিপ্রাপ্ত হয় । প্রত্যেক ক্রিয়াবান অনুশীলন দ্বারা এই অভিজ্ঞতা অনুভব করেন । বায়ুর উর্ধ্ব ও নিম্নগতির জন্যই আমাদের শ্বাস প্রশ্বাস চলাচল করে । খুব সূক্ষ্ম স্তরেও প্রাণ ও অপান বায়ুর নিরন্তর প্রবাহ আমাদের শরীরে চলতে থাকে । আমাদের বায়ুর বহির্গতির সাহায্য নিতে হয় । শ্বাস প্রশ্বাস একটি স্থল বায়ু , কিন্তু প্রাণবায়ু ও অপানবায়ুর গতি একটি সূক্ষ্ম বায়ু । সূক্ষ্ম বায়ু মেরুদণ্ডের মধ্যে চলে । এই সূক্ষ্ম বায়ুর চলাচলের জন্য আমাদের প্রশ্বাস ও নিঃশ্বাসের সাহায্য নিতে হয় ।
প্রাণায়ামের তিনটি অংশ আছে — পূরক , কুম্ভক এবং রেচক । এই তিনটি , একটি চক্রাকারে ক্রিয়াভ্যাস করায় । প্রশ্বাসের সঙ্গে যেই বায়ু গ্রহণ করা হল তাকে বলে পূরক । প্রশ্বাস ও নিঃশ্বাসের মাঝে যেই শান্ত বা রুদ্ধ অবস্থা , তাকে কুম্ভক বলে । নিঃশ্বাসের সঙ্গে যেই বায়ু ত্যাগ করা হয় তাকে রেচক বলে । প্রাণ বায়ু ইড়া নাড়ী বা চন্দ্র নাড়ীতে চলাচল করলে শরীরে একটা ঠাণ্ডা ভাব এনে দেয় । চন্দ্র ঠাণ্ডা এবং আরামদায়ক । অতএব পূরক প্রক্রিয়ার সময় , আমাদের
মন , হাদয় এবং শরীর শান্ত হয়ে যায় । রেচক এর সময় শরীর উষ্ণতা অনুভব করে , কারণ বায়ু তখন পিঙ্গলা নাড়ীতে বা সূর্য্য নাড়ীতে চলাচল করে । সূৰ্য্য অত্যন্ত গরম । খাদ্য এই অগ্নিদ্বারা হজম হয় । রেচক এর সময় সূর্য্য শরীরকে পরিশুদ্ধ করে , যার দ্বারা শরীরের সকল প্রকার অদরকারি বর্জ পদার্থ শরীর থেকে বার করে দেয় । সুষুম্না নাড়ী কুম্ভকের নাড়ী এখানে বায়ু সঞ্চালন হয় । সমগ্র শরীরের মধ্যে সুষুম্না একমাত্র নাড়ী , কেবলমাত্র এই নাড়ীতেই বায়ুর সঞ্চলন অবস্থা পাওয়া সম্ভব । শ্বাস-প্রশ্বাসের ক্রিয়ায় দ্বারা মন ও চেতনার উন্নতি সাধন , লাহিড়ী বাবার ক্রিয়াযােগের এক বৈশিষ্ট্য । কোনও প্রকার ভৌতিক বা বিধিবদ্ধ অভ্যাস নেই । যার দ্বারা জোর করে কুম্ভক অবস্থা প্রাপ্ত হয় । ক্রিয়া অভ্যাসের দ্বারা এই কুম্ভক খুব সহজেই হতে থাকে । এক মুহূর্তের মধ্যে বায়ুর গতি স্থির ও সমাহিত হয় । বায়ু তখন শরীরে প্রবেশ করেনা ও শরীর থেকে বায়ু বেরিয়ে যায় না । এই শান্ত ও স্থির অবস্থা আজ্ঞাচক্রে হয়। শান্ত সমাহিত অভিজ্ঞতাই কুম্ভক অবস্থা, এই অবস্থাকে কেবলই কুন্তুক বলে । গীতায় এবং পতঞ্জলী দর্শনে এই অবস্থাকে প্রাণ ও অপান বায়ুর গতিরুদ্ধ অবস্থা বলে ।
যােগাবতার লাহিড়ী বাবার অনুসারে কুম্ভক নিজের থেকেই হতে থাকে । লাহিড়ীবাবা সম্পূর্ণ আধ্যাত্মিক সাধনা পদ্ধতিকে বােঝানাের জন্য ক্রিয়া কথাটির বাবহার করেছেন । যতগুলি প্রক্রিয়া আছে যেমন - কুটস্থ দর্শন , খেচরী , মহামুদ্রা । এবং জ্যোতিমুদ্রা এই সবগুলিকেই তিনি ক্রিয়া বলতেন । গ্ৰহজামলে কথিত
“ রেচকং পুরকং তত্ত্বা সুখমত্র বায়ুধারণম্ । পবনং লীয়তে যত্র মনস্তত্র বিলীয়তে ।
দুই ধরনের কুপ্তক আছে ও একটির সহিত ( শ্বাসের সাথে ) এবং অন্যটি কেবল ( শ্বাস রহিত ) । যেই কুম্ভক , শ্বাস প্রশ্বাসের সাহায্যে হয় তাকে সহিত কুম্ভক বলে । যখন বায়ু নিজের থেকে রুদ্ধ হয় ; শ্বাস - প্রশ্বাসের কোনও সাহায্য ছাড়াই তাকে কেবলই কুম্ভক বলে । যখন প্রাণশক্তি সম্পূর্ণ ভাবে শান্ত হয় , তখন রেচক বা পুরকের দরকার হয় না । প্রাণের বা জীবনী শক্তির স্থির অবস্থাই হচ্ছে কেবল কুস্তকের অবস্থা মূলাধার হতে অপান বায়ুর সহস্রারে উর্ধ্ব গমন এবং প্রাণ বায়ুর সহস্রার হতে মূলাধারে গতি এই প্রক্রিয়া দুই বায়ুকে সন্তলান করে। বায়ু সহস্রারে স্থিত হয় । প্রাণ ও অপান বায়ুর স্থিরতাই হচ্ছে কেবল কুস্তক। এই কেবল কর্মকে বলা হয়
“সহজ কর্ম"।
আত্মজ্ঞানের ও উপলব্ধির পথে উন্নতির জন্য লাহিড়ীবাবা ক্রিয়া অভ্যাসকে চারটি ভাগে ভাগ করেছেন । প্রথম ক্রিয়া , দ্বিতীয় ক্রিয়া , তৃতীয় ক্রিয়া এবং চতুর্থ ক্রিয়া । এর চারটি স্তরের অতিরিক্ত , উনি পঞ্চম ও ষষ্ঠ প্রক্রিয়া এবং উচ্চতর ক্রিয়াবানদের জন্য গুপ্ত প্রক্রিয়া দিয়েছেন । রুদ্রজামলের ১৫ নং পটলে বলা হয়েছে প্রাণায়াম মহান ধর্ম । প্রাণায়াম বা ক্রিয়া বেদের অতীত । ক্রিয়া সকল গুণের মধ্যে শ্রেষ্ঠ এবং সকল পাপের বিনাশক। ক্রিয়া অভ্যাস লক্ষ লক্ষ কুকর্ম এবং অতীত জন্মগুলির কুপ্রভাব , সংস্কার ও নাকারত্মক প্রভাব থেকে সুরক্ষা প্রদান করে । যে , ক্রিয়া অভ্যাস করে , তার জীবন সার্থক হয় । প্রাণায়াম হচ্ছে ক্রিয়ার ভিত । যােগশাস্ত্রে বলেছে — প্রাণায়ামের দ্বারা মহা শূন্যে প্রবেশের শক্তি ও সামর্থ প্রাপ্ত হয় । মানুয় সকল প্রকারের রোগ হতে , আরােগ্য লাভ করে । কোনও প্রকারের রােগ প্রাণায়াম অভ্যাসের প্রতিবন্ধক হতে পারে না । অমৃত বিন্দু উপনষিদে বলেছে— “ সব প্রকারের অস্থিরতা , পাপ ও কুকর্মের প্রভাব , প্রাণায়ামের দ্বারা পবিত্র হয়ে যায় । ঠিক এই ভাবেই প্রাণায়াম , ক্রিয়াযােগের আধার । কিছুমুদ্রাও ক্রিয়ার জন্য উপযােগী । সেই প্রক্রিয়া যেটা সুখ বা আনন্দ প্রদান করতে পারে , তাকেই মুদ্রা বলে । খেচরী মুদ্রা ক্রিয়াযােগের একটি প্রধান অঙ্গ । এই মুদ্রা মুখের লালা গ্রন্থির কার্যকারিতার দক্ষতা প্রদান করে । এই প্রক্রিয়ায় জিভকে গুটিয়ে উপরে আলাজীভের কাছে নিয়ে যেতে হয় এবং আরও উপরে উঠে নাসারন্ধ্রে প্রবেশ করে । মন কুটন্ততে স্থির হয়ে যায় । তখন মস্তিষ্ক থেকে এক ধরনের রস নিঃসৃত হয় এই রসকে অমৃত বলে । এই রসের প্রবাহ , হৃদযন্ত্রের কর্মকে সস্কুলান করে , স্বাস প্রশাসের কাজকেও শান্ত ও সমাহিত করে । এর ফলে প্রাণশক্তি এবং মন শান্ত ও স্থির অবস্থা প্রাপ্ত হয় । সাধক দক্ষতার সঙ্গে খেচরী মুদ্রা সম্পন্ন করলে নানান ধরনের স্বাদ এই নিঃসৃত রসে আস্বাদন করতে পারেন । খেচরী মুদ্রার দক্ষতা অর্জন করলে , সাধক ক্ষুধা , তৃষ্ণা , এমনকি মৃত্যুকেও জয় করতে পারেন । সাধকের বাইরের চেহারা উজ্জ্বল ও কান্তিময় হয়ে যায় , মুখমণ্ডল আভাযুক্ত হয় । ধীরে ধীরে সাধক সমাধিপদ লাভ করে । “ খ ” অর্থাৎ “ আকাশ ” উচ্চতরতম শূন্যে ধাবমান হয় , অতএব এই মুদ্রার নাম খেচরী মুদ্রা ।
মানবশরীরে সাতটি পূতাগ্নি আছে। ক্রিয়াযােগী তার কুণ্ডলিনীর উখানে ও অবনমনে এই সাতটি অগ্নি প্রত্যক্ষ করেন । বাহ্যরূপে এগুলি সাতটি আকাঙ্ক্ষার প্রকাশ । আভ্যন্তররূপে এগুলি জ্ঞান , সংবিৎ , অধিসংবিৎ ও ব্রহ্মসংবতে যাওয়ার আলােকবর্তিকা । প্রতিটি কর্মে এই ঈশ্বর-অগ্নিকে প্রত্যক্ষ করলে দেহের ভেতরে ঈশ্বরকেই একমাত্র কর্তারূপে উপলব্ধি করা যায় । এই ঈশ্বর - অগ্নি কর্ম থেকে আমাদের মুক্ত করে পরমাত্মায় মগ্ন করে ।
মন নিয়ন্ত্রণের বিধিবদ্ধ অভ্যাস ব্যতীত , শ্বাস এবং দৃষ্টি স্থির ও শান্ত হতে পারে যদি খেচরী মুদ্রা দক্ষতার সঙ্গে করা যায় । এটাই খেচরী মুদ্রার প্রকৃত গুণ যার দ্বারা মন , শ্বাস এবং দৃষ্টি স্থির ও শান্ত হতে পারে । হঠযােগ প্রদিপীকায় বলেছে — জিহ্বাকে গুটিয়ে আলজিহবার দিকে তালুকুহরে রাখতে হবে । মনকে দুই দেশের মধ্যে নিবদ্ধ করতে হবে । তখন সাধক ধীরে ধীরে অনন্ত শান্ত অবস্থা প্রাপ্ত হবে । প্রাণায়াম , মহামুদ্রা , ভ্রামরী এবং জ্যোতি মুদ্রা , এই প্রক্রিয়াগুলি অভ্যাসের সময় খেচরী মুদ্রা আবশ্যক । খেচরী মুদ্রার নানান প্রকারের গুণাবলী আছে এবং সেই জন্যই লাহিড়ীবাবা এই প্রক্রিয়াকে প্রত্যেকটি আধ্যাত্মিক ক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত করে রেখেছেন ।
মহামুদ্রা সুনিশ্চিত নিয়ম - এর অনুপালন করে এই মহত্বপূর্ণ ক্রিয়া , শরীরের সকল সুস্থ তন্ত্রীকে প্রভাবিত করে । শরীরে বীর্য বর্ধন করে । সাধক আত্মসন্ধানে এগিয়ে চলে । মহামুল্লা অভ্যাসের দ্বারা কুণ্ডলিনী শক্তি , সহস্রারে ব্রহ্মরন্ধ্রে ( ঈশ্বরের গুহা ) উথিত হয় । এই মুদ্রা সর্ব রােগের ওষুধস্বরূপ , হজম শক্তি বিপুল ভাবে বন্ধন হয় ও সাধকের পরমায়ু বৃদ্ধি পায় । শরীর পবিত্র ও উজ্জ্বলকান্তি হয় ।
মানুষের শরীরে গঠন প্রণালীতে বিজ্ঞান অনুযায়ী সকল প্রকারের বৃহৎ , ক্ষুদ্র ও ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র , রক্তের শিরা , ধমনী ও স্নায়ুগুলি প্রত্যক্ষ বা পরােক্ষ ভাবে শিরদ্বারার সঙ্গে যুক্ত আছে । সাধক মহামুদ্রা অভ্যাসের দ্বারা শারীরিক ও মানসিক অবস্থার ভারসাম্য রক্ষা করে । মানুষ বহু বৎসর পর্যন্ত যুবা , অবস্থা প্রাপ্ত হয় । এই ক্রিয়ার দ্বারা শরীরের অহেতুক ক্ষয় রােধ হয় । লাহিড়ীবাবার প্রদর্শিত খেচরী মুদ্রা কেবলমাত্র একটি অত্যন্ত জরুরী ক্রিয়া নয় , এইটি ক্রিয়াযােগ অভ্যাসের এবং ভৌতিক মানসিক ও আত্মিক উন্নতির সােপান । সাধক যখন সবল পার্থিব বন্ধন হতে মুক্তিলাভ করে , শান্ত সমাহিত হয়ে ঈশ্বর চেতনায় মগ্ন হয় তখন সেই অবস্থাতে "সাম্ভবী” বলা হয় । মন আত্মার গভীরে প্রবেশ করে । মনের অন্তলক্ষ্য বা অস্তদৃষ্টি হচ্ছে "সাম্ভবী" মুদ্রা । যদি কেউ , একজন আত্মজ্ঞানী ও উপলব্ধিকৃত গুরুর নির্দেশ অনুযায়ী তার মনকে দুই দেশের মাঝখানে স্থাপন করে এবং মনকে অস্থিরতা থেকে দূরে সরিয়ে নিতে পারে তবে তার অবশ্যই “সাম্ভবী" মুদ্রা প্রাপ্ত হতে পারে । ঘেরও সংহিতায় বলেছে— “ প্রকৃত একাগ্রতার সহিত দুই দেশের মধ্যে সমগ্র ব্রহ্মাণ্ডের আত্মাকে নিরীক্ষণ করলে তবেই সাম্ভবী মুদ্রার দক্ষতা লাভ করা যায় ।"
জ্ঞান সঙ্কলিনীতন্ত্রে বলেছে — শিশু ও নির্বোধ ব্যক্তিদের মন , স্বপ্নালু অবস্থা এবং গভীর নিদ্রার অবস্থার মাঝামাঝি একটা স্মৃতিতে অবস্থান করে । স্বপ্নের মত এক অর্ধচেতন পরিস্থিতিতে ভাসমান থাকে । এই স্থিতি সাম্ভবীর মতন । কিন্তু ঈশ্বরচেতনা যুক্ত , দেহবােধ শূন্য অবস্থা হচ্ছে সাম্ভবী অবস্থা । শিবনেত্র অবস্থায় স্থিতিশীল হওয়ার জন্য মনকে আজ্ঞাচক্র অর্থাৎ তৃতীয় নয়নে নিবদ্ধ করলে সাম্ভবী মুদ্রার প্রক্রিয়ার দক্ষতা প্রাপ্ত হওয়া যায় । এই স্থিতি ঈশ্বরের সঙ্গে সংযুক্তি ঘটায় । খেচরী অবস্থায় চোখদুটি উপর দিকে আজ্ঞাচক্রের দিকে নিবন্ধ করে বন্ধ করতে হয় । “ খ ” -এর অর্থ হল আকাশ ( শূন্য অবস্থা ) , “ চারী ” অর্থ গতিমান বা গতিশীল । সেই জন্য এই নামটি
“ খেচরী ” মুদ্রা । চক্ষু বন্ধ রাখার জন্য এই অবস্থায় যােগনিদ্রার অবস্থা প্রাপ্ত হয় । যোগনিদ্রা সাধককে সমাধি নিকটবর্তী করে । হটযােগ প্রদীপিকা বলে যে — খেচরী মুদ্রা যােগ মুদ্রার অবস্থা এনে দেয় ।
ঘেরণ্ড সংহিতায় বলেছে— “ যদি সাধক প্রতিটি কর্মে , প্রতিটি সময় , সকল পরিস্থিতিতে জিহ্বাকে গুটিয়ে তালুতে তুলে রেখে বায়ুকে , প্রাণায়ামের প্রক্রিয়া দ্বারা রুদ্ধ রাখে তবে এই অবস্থায়
“ নােভােমুদ্রা " প্রাপ্ত হয় । মূলাবন্ধ , মহামুদ্রার একটি অংশ বিশেষ । কিন্তু এই প্রতিটি প্রক্রিয়া একজন আত্মজ্ঞানী গুরুর নির্দেশে ও তাঁর সান্নিধ্যে অভ্যাস করতে হবে । একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রক্রিয়া হল- “ নাদশ্রবণ " ক্রিয়াযােগে দক্ষতা অর্জনের একটি অপরিহার্য অঙ্গ । এই ক্রিয়ার দ্বারা সাধক হৃদগ্রন্থি হতে আগত নানান ধরনের মধুর সুর শুনতে পান । এই দিব্য ক্ষনিকে প্রণবনাদ অথবা অনাহত শব্দ বলা হয় । এই শব্দ ব্রহ্মই হচ্ছে, ব্রক্ষ্মার শব্দ । এটা নিস্তব্ধতার শব্দ ।
গীতায় বলেছে-
“ শ্ৰতিবিপ্রতিপন্না তে মদা স্থাস্যতি নিশ্চলা ।। সমধাৰচলা বুদ্ধিস্তদা যােগমৰাস্মসি । ” অর্থাৎ এই প্ৰণৰ নাদ বা ধ্বনি শ্রবণ যােগের স্তিতির প্রতি অগ্রসর হওয়া । সাধক , পরমপিতা পরমেশ্বরের সাথে যােগ এর স্থিতি প্রাপ্ত করতে পারেন ।
ওঁকার গীতায় বলেছে- ‘ অনাহতস্য শব্দস্য তস্য শব্দস্য যা ধবনিঃ।
ধ্বনেন্তর্গতং জ্যোতি জ্যোতে রন্তগতং মনং । তন্মনাে বিলয়ং যাতি তদ্বিষ্ণোঃ পরমং পদম । ”
যদি মন , অনাহত ধ্বনি বা ওঁ - কার নাদের সঙ্গে মিশে যায় তবে মন ব্রহ্ম চেতনার সঙ্গে সংযুক্ত হয় ও ঈশ্বরের পরম পদ লাভ করে । এটা ক্রিয়াযােগের একটা গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ । এই মুদ্রা অভ্যাসের দ্বারা সাধকের দেহবােধ লয় হয়ে যায় এবং তার চেতন সত্ত্বা ঈশ্বরের বা ব্রহ্মের চেতন সত্ত্বার সঙ্গে মিলিত হয়ে হয় । ক্রিয়া যােগ , মুক্তিমার্গের এক সর্বোচচতম পথ । যােগসূত্র বলেছে— “ মনের সকল প্রকারের বৃত্তির নিরােধ হওয়াই হচ্ছে , যােগ । কিন্তু প্রকৃত অর্থে , যােগ হচ্ছে জীৰ আত্মা ও পরম আত্মার মিলন । আত্মজ্ঞানের অভাসই কৈবল্য মুক্তির প্রকৃত সাধনা । কৈবল্য মুক্তি ও ব্রহ্মআশ্রয়ের জন্য যে জ্ঞান ও সাধনা প্রয়ােজন , তাকেই ব্রহ্মবিদ্যা বলা হয় । মনের সকল প্রকার নাকারাত্মক ও খারাপ ইচছাগুলি সরে গেলেই প্রকৃত জ্ঞানের উদয় হয় । যােগী যাজ্ঞবল্ক বলেছেন — মনের নাকারত্মক ও খারাপ ইচ্ছাগুলিকে সম্পূর্ণরূপে বলি দিতে হলে একমাত্র উপায় হচ্ছে প্রাণায়াম বা ক্রিয়া । যােগসূত্রে বলেছে , “ প্রকৃত জ্ঞানের উদয়- দ্বারা মুক্তির রাস্তা প্রশস্ত হয় । ঈশ্বর - এর ব্যবহারিক অনুভব ক্রিয়াযােগের মহত্বপূর্ণ একটা দিক । সকল সময় সকল কাজের মধ্যে কি করে ঈশ্বরকে অনুভব করতে হয় তা গুরুদেব থেকে শিখে নিতে হয়। এক পলকের জন্যও ঈশ্বরকে ভুলে যেন না যাই , তিনিই আমার শ্বাস , আমার জীবনীশক্তি আমার ভগবান । ঈশ্বর বাতীত কোন অস্তিত্বই নেই । সেইজন্যই আমাদের প্রতিনিয়ত গুরদেব চরণচিহ্ন অনুসরণ করতে হবে এবং তাঁর নির্দেশ অনুযায়ী অগ্রসর হয়ে হবে।
ক্রিয়ার গভীরতায়- মনে কি কি চিন্তা বা বিচার, সেটাই ঈশ্বরের প্রকাশ বা ব্রক্ষ্মের প্রকাশ । ইচ্ছার তরঙ্গ ঈশ্বর থেকে আলাদা নয় । একই ভাবে আমাদের এটা উপলব্ধি করতে হবে যে ঈশ্বর সর্বভূতে বিরাজমান । ঈশ্বর ব্যতীত অন্য কোনকিছুই নাই ।
গীতায় বলছে,
“ যাে মাং পশ্যতি সর্বত্র সর্বং চ ময়ি পশ্যতি । তস্যাহং ন প্রণস্যামি স চ মে ন প্রণশ্যতি । ”
অর্থাৎ, যিনি সদা সর্বদা সকল কিছুর মধ্যে ঈশ্বরকেই অবলােকন করেন , তিনি ঈশ্বর ব্যতীত অন্য কোনও সত্ত্বা নন ।
আমাদের পার্থিব বন্ধনের কারণ , আমরা ঈশ্বরকে ভুলে থাকি । ঈশ্বর বিস্মৃতইও বন্ধন। আমাদের প্রতিটি কর্মই ঈশ্বরের অনুপ্রেরণার কারণ । এই কৌশলকে প্রাপ্ত করতে হলে , আমাদের প্রতিটি কর্ম ঈশ্বরকে সমর্পণ করতে হবে । ঈশ্বরই কর্তা এবং ঈশ্বরই গুরু। এই ব্যতীত ঈশ্বর উপলদ্ধির আর কোনও দ্বিতীয় পথ নাই । এই দিব্য অনুভবই সমাধির সােপান । পতঞ্জলীর দর্শন অনুযায়ী নিত্য ও নিরন্তর ঈশ্বর উপলব্ধি সমাধির দিকে অগ্রসর হতে সাহায্য করে । প্রজ্ঞা ( অস্তদৃষ্টি ) কৈবল্য মুক্তি বা ঈশ্বর আশ্রয় এর সােপান । সমাধির অবস্থার পর যে প্রজ্ঞা অর্জন হয় সেই প্রজ্ঞাই যথার্থ প্রজ্ঞা । যে যােগী সম্পূর্ণ সমর্পণ করেছেন , তিনিই সমাধিপদ লাভ করবেন । সেইজন্য যােগসূত্রে বলেছে—
“ সমাধিরীশ্বর প্রণিধানাৎ । ”
অর্থাৎ — নিরন্তর ঈশ্বর প্রণিধান সমাধি পদ এনে দিতে সাহায্য করে । ঈশ্বর চেতনার প্রতি একাগ্রতাই হচ্ছে ধ্যান ।
প্রত্যাহার , ধারণা , ধ্যান , এবং সমাধি , যােগের চারটি অঙ্গ । ক্রিয়াযােগে ঈশ্বর অনুভূতি , আধ্যাত্মিক সাধনার প্রারম্ভ , মধ্য এবং অন্ত । ক্রিয়াযােগে এবং অষ্টাঙ্গযােগে , য়ম ও নিয়মের পর হচ্ছে আসন । পতঞ্জলীর যােগ সূত্র অনুযায়ী আসনকে বলা হচ্ছে,
" স্থিরসুখ আসন ” । অর্থাৎ আসন হচ্ছে নিশ্চুপ , স্থির ও আরামদায়ক ভাবে বসে সাধনা করার কৌশল । আসন অভ্যাসের দ্বারা শরীর রােগমুক্ত হয় । কিন্তু প্রকৃত যােগ হচ্ছে ঈশ্বর চেতনা। আসনই শুধুমাত্র যোগ , এই ধারণাটা সম্পূর্ণ ভুল । এই ভুল ধারণা ও অভ্যাস হতে আমাদের দূরে থাকতে হবে ।
যদি শিরদাড়া সােজা থাকে , তবে শ্বাসের গতিও সােজা ও সহজ হবে । গীতায় বলেছে ' ' সমং কায়শিরোগ্রীবং ধারায়ণচলং স্থিরঃ । ” অর্থাৎ, ধ্যানের সঠিক মুদ্রা হেতু , আমাদের বুক , গলা , মাথা এবং শরীরকে সােজা রাখতে হবে । কিন্তু ধ্যানের প্রকৃত মুদ্রা হচ্ছে সহস্ৰারে স্থিত থাকা । বাহ্য শারিরীক মুদ্রাগুলিকে মহত্ত্ব দেওয়া অনাবশ্যক ।
যােগ অভ্যাসের প্রথম ও প্রধান অঙ্গ হল প্রাণায়াম । ঈশ্বর প্রণিধানার্থে যে প্রাণায়াম করা হয় তাকেই ক্রিয়া বলে । পতঞ্জলীর যােগ সূত্রের সাধনপদে বলেছে — ' তস্মিন্ সতি শাসপ্রশ্বাসয়াের্গতিবিচ্ছেদঃ প্রাণায়ামঃ । ” অর্থাৎ শ্বাস এবং প্রশ্বাসের গতির অবরােধ হচ্ছে প্রাণায়াম । শ্বাসের অবরােধ — অর্থাৎ , যেই অভ্যাস , বাইরের বায়ু শরীরে প্রবেশ করতে দেয় না তাকেই প্রাণায়াম বলে । শরীর ও মনের কম্পন বা তরঙ্গকে সম্পূর্ণরূপে রােধ করাই হচ্ছে প্রাণায়ামের লক্ষ্য । এই অভ্যাসের প্রণালী প্রবর্তন হয়েছে , দেহবােধ ও মনের বােধ বিলুপ্ত হয়ে স্থির হওয়ার জন্য । পূরক ও রেচকের দ্বারা শ্বাসের গতি রুদ্ধ করাই হচ্ছে প্রাণায়ামের কৌশল। মন যখন স্থির ও শূন্য অবস্থা প্রাপ্ত হয় তখন সাধক অনাবিল আনন্দ অনুভব করেন । এই ধরনের প্রাণায়াম , অত্যন্ত সূক্ষ্মভাবে মনের বৃত্তিগুলির রােধ করে , এই প্রণালী বহিরঙ্গ কুম্ভকের ও প্রাণায়ামের থেকে পৃথক ।
আমাদের অসংখ্য অতীত জন্মের অগণিত কর্মের প্রভাব নিয়ে আমরা জন্মগ্রহণ করি । শ্রীমৎ ভূপেন্দ্রনাথ সান্যাল মহাশয় বলেছেন — আমাদের সংস্কার ( অতীত জন্মের কর্ম সমূহ ) । আমাদের প্রকৃত জ্ঞান - ও ঈশ্বর প্রণিধানকে একটা অজ্ঞানের চাদর দিয়ে যেন ঢেকে রেখেছে । সংস্কার একটি বহিআস্তরনের মতন । প্রাণায়ামের অভ্যাসের দ্বারা , অতীতের সকল সংস্কার মুক্ত হওয়া যায় এবং জ্ঞানের উন্মেষ হয় । প্রাণায়ামের কৌশল অহংকারকে দূর করে ও নাকারত্মক সত্তাগুলিকে ধ্বংস করে , তখন সাধকের মধ্যে প্রজ্ঞানের উন্মেষ হয় । অবিদ্যা ও অজ্ঞানতা , ঈশ্বর চেতনার বিস্মৃতি ঘটায় । অবিদ্যা অস্থায়ীকে স্থায়ী ভ্রমে বদলে দেয় । অবিদ্যার জন্য আমরা জীবনের দুঃখময় অবস্থাকে সত্যি বলে ভাবতে থাকি । আমরা জড়বৎ ও পার্থিব উন্নতিকে আত্মার প্রকৃত অবস্থা বলে ভাবি । আত্মচেতনার সঙ্গে যখন বুদ্ধি যুক্ত হয় তখন অহংকারবােধের জন্ম হয় । ঈশ্বর চেতনার অভাবই হচ্ছে অবিদ্যা।
রাগ এর অর্থ ঐশ্বর্যানুভূতির অভাব।
দুঃখ থেকে মুক্তি পাওয়ার চেষ্টা করে যে অনুভূতি হয় তাকে বলে 'দ্বেষ' । শরীরে যে অহংকার আছে তাকে বলে 'অভিনিবেশ' । অভিনিবেশের জন্য মৃত্যু ভয় জন্ম নেয় । জ্ঞানী ও অজ্ঞনী উভয় ব্যক্তির মধ্যেই কম বেশি মৃত্যুভয় বিদ্যমান।
উপরে উল্লিখিত পাঁচটি নাকারাত্মক শক্তিকে সমূলে নাশ করার একটিই মাত্র উপায় হল ব্ৰহ্মচেতনা । ব্ৰহ্মচেতনা সমাধির গুণ ও নিত্য ঈশ্বর অনুভূতির স্থিতি । ক্রিয়াযােগ সকল প্রকার নাকারত্মকতা দূর করে সমাধির পথ প্রশস্ত করে।
বিগত জন্মের প্রভাব চিত্ততে জমা হয়ে থাকে । এই প্রভাবগুলি সরিয়ে দেওয়াটা খুব প্রয়োজন। আশা আকাঙ্খা ও ইচ্ছাই দুঃখ ও দুর্দশার কারণ । যদি এই প্রভাব দূর হয় তবে ইচ্ছাও সমাপ্ত হয়ে যায় । চিন্তার তরঙ্গের দুইটি কারণ আছে । একটি ইচ্ছা এবং অন্যটি প্রাণশক্তি । যদি এর মধ্য হতে যে কোনােও একটি সত্ত্বাকে সরিয়ে নেওয়া যায় , তবে মন , চিন্তারহিত অবস্থা প্রাপ্ত হতে পারে সেই হেতু কথিত আছে—
“ পবনং লীয়তে যত্ৰ মনস্তত্র বিলীয়তে । “ যদি প্রাণশক্তি স্থির হয় , তবে মন স্থির হয়ে যায় ।
সমগ্র বিশ্বে মন ও প্রাণশক্তির কষ্টের চিত্রটা প্রকট , কেবলমাত্র মন ও প্রাণ এর স্থিরতা ও লয় প্রাপ্ত হওয়া , মুক্তি ও নির্বাণ এর রাস্তায় নিয়ে যেতে পারে । শাস্ত্রে বলেছে— “ যথার্থ নিয়ম অনুসারে যদি প্রতিদিন নিয়মিত অভ্যাস করা যায় , তবে প্রতিটি স্নায়ুচক্র দোষমুক্ত হতে পারে । যার নিমিত্ত সুষুম্নার রাস্তা খুলে যায় ও প্রাণদায়ী বায়ু খুব সহজেই সুষুম্না ভেদ করতে পারে । ”
Continue-38
১ম থেকে ৬ষ্ঠ ক্রিয়া
(সকল পর্ব একত্রে)
১ম পর্বঃ
ক্রিয়াযােগ কৌশলসমূহ, কর্মযােগ, রাজযােগ এবং ভক্তিযােগের সার। যে জ্ঞান, ভগবান শ্রীকৃষ্ণ শ্রীমদভগবদগীতায় ব্যাখ্যা করেছেন। ক্রিয়াযােগ প্রকৃত অর্থে যােগ শাস্ত্রের ফলিত অংশ। সেইজন্য এই শাস্ত্রকে ঈশ্বর প্রণিধানের বৈজ্ঞানিক কৌশল বলা হয়। ঊনবিংশতি শতাব্দির মধ্যভাগে, এক নতুন যুগের প্রবর্তন হল যখন, অমর কল্পযােগী বাবাজী মহারাজ এই যােগ শাস্ত্রকে একটা নতুন বৈজ্ঞানিক দিক দিয়ে রূপান্তর ঘটিয়ে পৃথিবীকে পরিবেশন করলেন, তাঁর শিষ্য লাহিড়ি মহাশয়ের মাধ্যমে, তিনি এই যােগ মানুষজাতির কল্যাণে
উৎসর্গ করলেন। লাহিড়ী বাবার শিষ্য স্বামী শ্ৰীযুক্তেশ্বরজী এই যােগ শিক্ষা তার শিষ্য পরমহংস যােগানন্দজীকে শেখালেন এবং তিনি এই যােগ পশ্চিম দেশগুলিতে, প্রচার ও প্রসার করলেন। তিনি ১৯২০ সালে ক্যালিফোর্নিয়াতে এলেন এবং পরবর্তী ৩০ ( ত্রিশ ) বৎসর কাল তিনি প্রায় এক লক্ষ মানুষকে ক্রিয়াযােগের প্রথম ক্রিয়ায় দীক্ষিত করেন। এই শক্তিশালী আধ্যাত্মিক পদক্ষেপ আমেরিকা তথা পশ্চিম দেশে একটি বেদি তৈরি করেছে এবং যােগকে জনপ্রিয় আন্দোলনে পরিণত করেছে। যা আজও কুসুমিত হয়ে চলেছে। আত্মজ্ঞানের আত্মবিকাশের পথ শেখাতে গিয়ে বাবাজী মহারাজ, লাহিড়ীবাবাকে যেই ক্রিয়ার পদ্ধতি শিখিয়ে ছিলেন, তা মূলত ছয়ভাগে বিভক্ত এবং সেগুলির একটি সংক্ষিপ্ত বিবরণ নিচে দেওয়া হল। এই কৌশলগুলি আত্মজ্ঞানী গুরু ও যথার্থ যােগ্যতা প্রাপ্ত যােগাচাৰ্য্য শিক্ষক ব্যতীত শেখা সম্পূর্ণ অসম্ভব ও অনুচিত। এই যােগ আধ্যাত্মিক পথে চলার সর্বোচ্চ পাথেয়, এই কৌশল গীতার উল্লিখিত আত্মউপলব্ধির যােগ সাধনার শিক্ষা দেয়।
প্রথম ক্রিয়াঃ
প্রথম ক্রিয়ায় নিজের শিড়দাঁড়ার মধ্যে ঈশ্বর অনুভুতির প্রক্রিয়াকে ক্রিয়াশীল করার পর নিজের স্বাভাবিক মনকে উচ্চতর চেতনায় পরিবর্তন করতে পারা যায়, এবং দিব্য তিনটি গুণ- ধ্বনি, জ্যোতি ও স্পন্দনকে অনুভব করা যায়। নিজের মাথাটা মাটিতে স্পর্শ করিয়ে দিলেই শিরদাঁড়া ও কপালের গােলার্ধ , চৌম্বকীয় আবেশে আবেশিত হয়। মস্তিষ্ক দিব্যজ্যোতি দর্শন করতে পারে। শিরদাঁড়ার মধ্যে অবস্থিত সাতটি চক্রের মধ্যে দেখতে পাওয়া যায় দিব্য শক্তি কিভাবে ওঠা নামা করছে ও মস্তিষ্ক ও আত্মাকে শক্তি প্রদান করছে। প্রথম পাঁচটি চক্র হচ্ছে শয়তানের রাজ্য এখানে অজ্ঞান ও দুষ্টবুদ্ধি ভ্রমণ করে। ছয় ও সাত চক্র হচ্ছে "স্বর্গ রাজ্য” যেখানে ভগবান স্বয়ং সব কাজ সম্পাদন ও ক্রিয়াশীল রাখেন। প্রথম ক্রিয়া, কুণ্ডলিনী শক্তিকে জাগ্রত করে সুপ্ত অবস্থা থেকে মূলাধার থেকে উপরে আজ্ঞাচক্র পর্যন্ত নিয়ে যায়। সাধক উপলব্ধি করতে পারেন যে একটি দিব্য জ্যোতি তাঁর শিরদাঁড়ার ভেতর দিয়ে ওঠা ও নামা করছে। মহামুদ্রায় (শারিরীক মুদ্রার প্রক্রিয়া) শরীরকে কর্ষণ করে এবং শরীরের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ প্রত্যঙ্গগুলি যেমন, হৃদপিণ্ড, পাচনতন্ত্র ও স্নায়ুতন্ত্রগুলিকে সতেজ করে। তথন মন, বুদ্ধি, বিচার এবং অহংকার শান্ত হয়ে যায়। আপনি ঈশ্বরের বানী অর্থাৎ ধ্বনি শুনতে পারা যায়। এই অভ্যাসের দ্বারা সারাদিন ধ্বনী শােনা যায় একে বলা হয় "অনাহত ধ্বনী”। প্রথম ক্রিয়ায় সাধক "শুভেচ্ছা সমাধি ' অর্থাৎ ঈশ্বরকে জানার তীব্র আকাঙ্ক্ষা অনুভব করেন। যখন উচ্চতর চেতন অবস্থা ও মনের শান্ত পরিস্থিতি হয় , তখন -এই অবস্থার উদ্ধব হয়।
দ্বিতীয় ক্রিয়াঃ
দ্বিতীয় ক্রিয়ায়, প্রতিটি চক্রের মধ্যে দিব্যত্রিগুণ উপলদ্ধি করার শিক্ষা দেওয়া হয়। নিচের পাঁচটি চক্রে ভগবান স্বয়ং রয়েছেন ও সেগুলিকে সক্রিয় রেখেছেন, এই উপলদ্ধি হবে এবং এই চক্রগুলির সেই অদম্য ইচ্ছা, অর্থাৎ অর্থ উপার্জন, শারিরীক মিলন, খাদ্যের লালসা, আবেগ এবং সৃজনশীলতা, সেইগুলি এই উপলব্ধির পর রূপান্তরিত হবে। রাগ, অহংকার, গৌরবও নিষ্ঠুরতা, এগুলি প্রেমে পরিণত হবে। ক্রমশঃ শক্তি শিরদাঁড়ার উপরে উঠতে থাকে এবং প্রতিটি চক্রে নানান ধরনের দিব্যধ্বনি শােনা যায়। ধ্যানের মধ্য দিবা জ্যোতির ঝলক ও বারাে ধরনের দিব্য ধ্বনি , যেগুলি স্বর্গলােক হতে আসছে বােঝা যাবে । ব্যোম তত্ত্ব সমগ্র মস্তিষ্ককে ছেয়ে যাবে। ছয়টি চক্রে ৫০ টি পদ্মের পাপড়িতে ধ্যান করতে হয়, সহস্রারের নিচের চক্রগুলিতে, মূলাধারে ৪ দল, স্বাধিষ্ঠানে ৬ দল, মণিপুরে ১০ দল, অনাহততে ১২ দল, বিশুদ্ধতে ১৬ দল এবং আজ্ঞাচক্রে ২ দল, এই পথের দলগুলি আমাদের বহির্মুখী জীবন। একইভাবে শরীরের ৫০ টি অংশকে জানতে হয় এবং আশা আকাক্ষা সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল হতে হয় যে ভগবান এদের মধ্য দিয়ে কাজ করছেন। এই অভ্যাসের মধ্যে দিয়ে বােঝা যায় যে শরীরের প্রতিটি অনু পরমাণুতে ঈশ্বর রয়েছেন। মানুষ সারাদিন যেই কাজই করুক না কেন, বুঝতে পারবে যে ভগবান একটা না একটা চক্র দিয়ে ক্রিয়াশীল হয়ে রয়েছেন। যদি কোনও নাকারাত্মক চিন্তা বা ইচ্ছা উকি মারে, সঙ্গে সঙ্গেই সেইটাকে সরিয়ে দেওয়া সম্ভব । দ্বিতীয় ক্রিয়ার সমাধিকে “বিচরিণী” সমাধি বলা হয়। অর্থাৎ ঈশ্বরের শক্তি একটি একটি করে উপরের চক্রে উঠছে। শিরদাঁড়ার ভেতর দিয়ে, শরীরে মুখ্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গ এবং শরীরের নানান অংশ দিয়ে।
২য় পর্বঃ
গতপর্বে আমরা জেনেছিলাম, ক্রিয়াযোগের ১ম ও ২য় ক্রিয়ার অনুভূতি সমূহ। আজকের পর্বে চলুন জেনে নেয়া যাক, ক্রিয়াযোগের ৩য় ও ৪র্থ ক্রিয়ার অনুভূতি সমূহ।
তৃতীয় ক্রিয়াঃ
এই ক্রিয়াটি মস্তিষ্কের ভেতরে অনুশীলন করা হয়, তৃতীয় ক্ষেত্রে। মস্তিষ্ক হচ্ছে দিব্য রাজ্য। সত্যিকারের "তুমি” পিটুইটারির ভেতরে লুকিয়ে আছে, ঈশ্বর আত্মারুপে শরীরকে কার্যকরী করে রেখেছেন। এইটাই তৃতীয় ক্রিয়ার সার্থকতা যে ধ্যানের সময় মস্তিষ্কের ভেতর দিব্য ত্রিগুণই শুধু ঘুর্ণিয়মান হয়ে রয়েছে, সেটি উপলব্ধি হবে। সাধক বুঝতে পারেন, আত্মা শরীর থেকে পৃথক হয়ে ব্যোম তত্ত্বে ভাসমান হয়ে রয়েছে। এই স্তরে বােঝা যায়, আত্মা সর্বত্র বিরাজমান এবং উপরের স্বর্গরাজ্য পর্যন্ত বিচরণ করছে। সমগ্র বিশ্বব্রহ্মাণ্ডকে মস্তিষ্কের মধ্যে উপলব্ধি করা যাবে। মাথার মধ্যে সহস্রদলপদ্ম আলােকিত হয়ে ঘুর্ণিয়মান হয়ে রয়েছে এবং আত্মাকে আলােকিত করে রেখেছে। মানুষ যে কাজই করুক না কেন, যতই পার্থিব কাজে ব্যস্ত থাকুক, সে বুঝবে যে একটি অসামান্য শক্তি তার মধ্যে দিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। মানুষ বিচ্ছিন্ন থেকে সকল নাকারাত্মক চিন্তাধারাগুলিকে সরিয়ে দিতে পারবে। তৃতীয় ক্রিয়ার সমাধিকে “তনুমানসা” সমাধি বলা হয়। অর্থাৎ মন জৈবী সত্ত্বার মধ্যে ঘােরাফেরা করছেন। এই মন এখন অন্তরস্থলে কেন্দ্রিভূত হয়েছে এবং এই সাধারণ মনটি এখন জ্ঞানে বিবর্তিত হয়েছে। এটি এখনও ঘুরছে কিন্তু কেবল মাত্র দার্শনিক ক্ষেত্রে, ঈশ্বর উপলব্ধি করছে কিন্তু পার্থিব সংসারে রয়েছে।
চতুর্থ ক্রিয়াঃ
চতুর্থ ক্রিয়া অভ্যাসের ফলে, আত্মার বিশিষ্ট গতির অনুভব হতে থাকে, মাথার ভেতরে কপালে, পন্স ( Pons ), থ্যালামাস ( Thallamus ), হাইপােথ্যালামাস ( Hypothallamus ), পিনিয়াল গ্রন্থি ( Pineal gland ), পিটুইটারির ( Pituitary ) সামনে এবং মধ্য মস্তিস্কে ( Mid Brain )। বােধ হবে উদ্ধে স্বর্গ থেকে আলাের রশ্মি ঘুর্ণিয়মান হয়ে পৃথিবীতে নামছে । এই স্তরে যে সমাধি হয় তাকে “অসংসক্তি সমাধি” বলা হয়। অর্থাৎ সাধক মুক্ত অবস্থায় চৈতন্য সাগরে ভাসছে এবং সর্বাঙ্গে ঈশ্বরের পরশ অনুভব করছে। সাধক নিজেকে ঈশ্বরের প্রতিরূপ সমান অনুভব করে ও ঈশ্বরের দিব্য জ্যোতি ও স্পর্শ আবেশ পায়। সাধক হাজার হাজার আলাের স্ফুলিঙ্গ চোখ বন্ধ ও খােলা দুই অবস্থাতেই দেখতে পায়, সেই আলো অন্তরের পৃথিবীকে প্রদীপ্ত করে। সাধক প্রকৃত অবস্থায় মাথার উপরে আলাের সন্ধার দেখতে পান, সেই আলাে বিশ্বভূবনে ছড়িয়ে আছে। সাধক শরীরে সাত ধরনের আলাে দেখতে পান। সাতটি চক্রের প্রতিটি চক্রে সাধক, দুটি করে অগ্নি দেখতে পান, একটি আরােহণের ও অন্যটি অবরােহণের। সাধক শরীরের ভেতর ও বাইরে দুই দিকেই আলাে দেখতে পান। গুরুদেব সমুখে উপস্থিত হবেন, অন্ধকার থাকবে, কিন্তু তাঁর চারদিকে আলাের দ্যুতি থাকবে।
৩য় ও শেষ পর্বঃ
গত দুই পর্বে ১ম থেকে ৪র্থ ক্রিয়ানুভূতি নিয়ে লিখেছিলাম। তবে যোগী যোগ্যতা অনুযায়ী এ সকল অনুভূতির তারতম্য হতে পারে।
আজ চলুন জেনে নিই, ৫ম ও ৬ষ্ঠ ক্রিয়ার অনুভূতি সম্পর্কে।
পঞ্চম ক্রিয়াঃ
পঞ্চম ক্রিয়ায় সাধক তার লঘু মস্তিষ্কে দিব্য অনুভূতি পেয়ে থাকেন। সাধক ক্রমশঃ আপ্রাণ চেষ্টা করে, তার ভেতর প্রবেশ করার। যেমন মেঘ বৃষ্টির সময় বিদ্যুৎ চমকায় ঠিক তেমন আলাের ঝলকানি মূলাধার থেকে উঠে সাধকের সমস্ত পৃথিবী আলােয় ভরে দেয়, সাঙ্গে ধ্বনি জ্যোতি ও কম্পন দিব্য অনুভূতি সাধককে ঈশ্বর প্রেমে মাতােয়ারা করে দেয়। সে তখন বুঝতে পারে যে সে স্বয়ং ঈশ্বরের জীবন্ত প্রকাশ। পঞ্চম স্তরের এই সমাধিকে “সন্তোৎপত্তি সমাধি” বলা হয়। আত্মা প্রকাশিত হচ্ছেন ও পিনিয়াল গ্রন্থিতে প্রবেশ করতে প্রচেষ্ট হচ্ছেন। অর্থাৎ সাধক নির্বিকল্প সমাধির কাছাকাছি এসে গেছেন। পঞ্চম ক্রিয়ার দ্বারা সাধক যন্ঠ ক্রিয়ার সমাধি প্রাপ্ত করতে পারেন, এই সমাধিকে “পদার্থভাবিনী সমাধি” বলা হয়। অর্থাৎ, সাধক প্রজ্ঞান এর কাছাকাছি এসে গেছেন। এই অবস্থায় সাধকের বিশ্ব ব্রহ্মান্ড বােধ আর থাকে না। সাধক বােধ করেন যে ঈশ্বরের দরজা খোলা কিন্তু ধ্যানের দ্বারা অবলােকন করেন যে, ঈশ্বর সকল মানুষ, জীবজন্তু, লতা, গাছ, বৃক্ষ সকলের মধ্যে সমান ভাবে হয়েছেন। পঞ্চ মহাভূতের মধ্যে ভগবান রয়েছেন। সাধক ঈশ্বরের সঙ্গে দ্রবীভূত হয়ে যান ও ব্রহ্ম চেতনায় লীন হয়ে যান।
৬ষ্ঠ ক্রিয়াঃ
৬ষ্ঠ ক্রিয়া হচ্ছে দিব্য রাজ্যে বাস করা। সাধক প্রতিমুহূর্তে ঈশ্বর চেতনায় মাগ্ন থাকেন। কোনও বিশ্ববোধ থাকে না। জীবন্ত প্রজ্ঞান অবস্থা। অর্থাৎ, সাধক বিশ্বকে অনুধাবন করছেন না, শুধুমাত্র সত্যকে জানতে চাইছেন। সাধক বিশ্ব সত্ত্বা থেকে আলাদা নয়, সাধক ও সর্বশক্তিমান এক। যে কোনও মুহূর্তে সাধক নির্বিকল্প সমাধিতে প্রবেশ করতে পারেন। অর্থাৎ, সাধক পৃথিবীতে আছেন অথচ নেই এমন একটা পরিস্থিতি সাধক যে কোনও মুহূর্তে শ্বাস রহিত ও হৃদস্পন্দন রহিত অবস্থায় পৌঁছতে পারেন। এই স্থিতিকে "তুরীয় সমাধি” বলা হয় , যার অর্থ হল—ভগবানের সাথে এক হয়ে যাওয়া। এই অবস্থাতে, কোনও শারিরীক বা মানসিক দুঃখ বা ব্যথা থাকে না, কারণ সাধকের সম্পূর্ণ সত্ত্বা ও আত্মা ঈশ্বরের সঙ্গে একাত্ব হয়ে গেছে। সাধক তাঁর দৈনন্দিন জীবনে ঈশ্বরকে তাঁর স্কুল, সূক্ষ্ম ও কারণ, এই তিনটি শরীরের মধ্যে দেখতে পায় অনুভব করে ও পরিপূর্ণতা অর্জন করে। সাধক বুঝতে পারেন যে, সে ঈশ্বর, পরম পিতা বা পরমেশ্বরের সাথে মিলেমিশে একাকার। সাধক নিজের অন্তকরণে সদা সর্বদা ঈশ্বরের প্রকৃত প্রেম অনুভব করতে থাকেন। সুতরাং, ঈশ্বর সর্বদা সাধকের সঙ্গেই থাকেন। এইরূপে ষষ্ঠ ক্রিয়া সম্পূর্ণ ঈশ্বর উপলব্ধির কৈবল্যমুক্তি এবং শরীর, মন ও আত্মার সার্বিক উন্নতি সাধন করে।
প্রথম ছয়টি স্তরের সমাধিকে একত্রিত সবিকল্প সমাধি বলে। সাধকের বােধ ও চৈতন্য এক্ষেত্রে পার্থিব জগতের সঙ্গে যুক্ত থেকে যায় । কিন্তু সাধক প্রতিটি চক্রের থেকে বিচ্ছিন্ন থাকে, আত্মা ঈশ্বরে নিমজ্জিত থাকে। তৃতীয় , চতুর্থ এবং পঞ্চম ক্রিয়ার দ্বারা ঈশ্বরের প্রতি গভীর প্রেম জন্মায়, ঈশ্বর প্রেমে মাতােয়ারা হয়ে যায়, সাধক খুঁজে পান যে এই ছােট্ট শরীরের মধ্যে তিনটি শরীর কার্যশীল হয়ে রয়েছে অথচ বহির্জগতে ঈশ্বরের প্রেমের মহানুভবতাও উপলব্ধি করেন। ষষ্ঠ ক্রিয়া এবং সপ্তম সমাধিতে সাধক অনন্ত অসীমে গিয়ে মিশে যান, সব কিছু ছাড়িয়ে। ঈশ্বরের প্রতি অটুট বিশ্বাস জন্মায়, এই একমাত্র আশা ও তার প্রখর দীপ্তি, ভয় সন্দেহ ও অজ্ঞানতার মায়াজাল সম্পূর্ণ ছিন্ন করে দেয়।
✍️ রতন কর্মকার
বিজ্ঞানের চোখে ত্রিনয়ন
এই ত্রিনয়ন হল বিজ্ঞানের ভাষায় Pineal gland— ভ্রুযুগলের মধ্যে যার অবস্থান । এখান থেকেই চিৎশক্তি সমগ্র দেহে রক্ত ও স্নায়ুতন্ত্রী দ্বারা ছড়িয়ে পড়ে । দার্শনিক ডেকার্টের মতে এর মধ্যেই মনের বা আত্মার বাস ।
দেহের শক্তি মূলাধার থেকে ( অর্থাৎ লিঙ্গমূল ও গুহ্যদ্বারের মাঝখানে যে গর্ত আছে সেখান থেকে) বেরিয়ে উধর্বগামী হলে এই পিনীয়াল গ্লাণ্ডে প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করে । গ্লান্ডটি যেন ফুলে উঠে ফেটে পড়তে চায় । ফলে ভিসুয়াল নার্ভে অদ্ভুত শক্তি বৃদ্ধি পায় অর্থাৎ শক্তির মাত্রা বৃদ্ধি পায় । তখন স্থূল দুই চোখের প্রয়োজন হয় না । চোখ বুজেও বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সব কিছু দেয়া যায় ।
এই প্ল্যাগুটি সাধারণ মানুষের কাছে কার্যকর নয় , কিছুটা এখনো নিম্ন শ্রেণীর প্রাণীর মধ্যে যেমন কুকুর , মৎস্য এই জাতীয় প্রাণীর মধ্যে কার্যকর । এই জন্য এদের দৃষ্টিশক্তি সাধারণ মানুষ অপেক্ষা বেশি ।
যোগে কুলকুণ্ডলিনীকে যার মূলাধার থেকে পিনীয়াল প্ল্যাণ্ডে এনে তাকে সঞ্জীবিত করতে পারেন তাঁরাও তাই দূরদৃষ্টি অর্জন করেন । যারা যােগ করেন তাদের অভিজ্ঞতা এ বিষয়ে স্পষ্ট । তখন তারা চোখ বুজেও বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের ছবি দেখতে পান ।
দেবদেবীর সর্বদৃষ্টি । তাদের এই দৃষ্টি বােঝাবার জন্যই মুখ্য দেবদেবীর কপালে ত্রিনয়ন আঁকা হয় । তবে যাদের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা নেই তারা এটা বুঝতে পারবেন না।
Continue-39
বিজ্ঞানের চোখে পৌরানিক-কাহিনী
বিষ্ণু হলেন দেশ ( space ) । দেশের সঙ্গে কাল অবিচ্ছিন্ন ভাবে যুক্ত । এই কাল চক্রবৎ ঘূর্ণায়মান হয় । যে চক্র দ্বারা তিনি সতীর দেহ ছিন্ন করেছিলেন সেই চক্র হলো কাল চক্র।
সতী নামের তাৎপর্যও মনে রাখতে হবে । সৎ অর্থাৎ অতিশূন্যতাস্থিত যে শক্তি সেই শক্তি হিসেবেই স্ত্রীলিঙ্গে সতের সঙ্গিনী হিসেবে সতী । শিবের তিনটি রুপ আছে। যেমন কৃষ্ণ শিব ( সৎ ) শ্বেত শিব ( অর্থাৎ সৃষ্টির বেগ ) ও শিবলিঙ্গ ( বিন্দু ) অর্থাৎ বিস্ফোরণ জাত প্রথম ঘূর্ণায়মান আলাে । দক্ষযজ্ঞ নাশ মানে প্রলয় , যে প্রলয়ে বিশ্বব্রহ্মাণ্ড একতায় ডুবে যায় , আবার ঘনীভূত শক্তির চাপের ফলে তা এনার্জি হয়ে বাইরে ছড়িয়ে পড়ে দেশ ও কালের সঙ্গে ধাপে ধাপে অগ্রসর হয়ে মূল জগৎ তৈরি করে । ব্ৰহ্মণ হলেন singularity যা থেকে শিবের kinetic এনার্জিবলে শক্তি বিস্ফোরিত হয়ে বাইরে আসে । বাইরে এসেই এই এনার্জিকৃত দেশের কবলে পড়ে অর্থাৎ বিষ্ণুর । দেশস্থিত কাল তখন তাকে Kinetic এনার্জির ধাক্কায় ধাপে ধাপে এগিয়ে নিয়ে চলে । এই ধাপে ধাপে এগুনাে মানে কালচক্রে সতীর ( শক্তির ) দেহ ছিন্ন বিচ্ছিন্ন হওয়া । এই বৈজ্ঞানিক মহাজাগতিক ঘটনাটিই — দক্ষযজজ্ঞনাশ নামক রূপক গল্পে স্থান লাভ করেছে । শিবের উন্মাদ নৃত্য মানে chaos within the singularity .
দেবতারা হলেন পার্টিকুল — যা প্রলয় কালে ব্রহ্মরূপী ঘনসংবদ্ধ neutron field- এ গিয়ে ক্ষণকালের জন্য নিস্তব্ধ থাকে । তারপর আবার আপনা আপনিই সেখান থেকে নির্গত হয় । ব্রহ্মা সৃষ্টি করতে পারেন , তাকে ধবংস বা অন্য কোন প্রকারে প্রভাবিত করতে পারেন না । বিষ্ণু — দেশ ও কালরূপে সৃষ্টিকে প্রতিপালন করেন । শিব Kinetic energy রূপে তাকে ঠেলে দিয়ে বৃদ্ধি করেন । এই সময় শিবের যে রুপ তা মঙ্গলময় । কিন্তু বিস্ফোরণের বেগ কমে গেলে আবার সব কিছু দ্রুত গতিতে কেন্দ্রে ফিরে যেতে আরম্ভ করে । যখন ফিরে যেতে আরম্ভ করে তখনই তার রুদ্র মূর্তি বা ধবংসের মূর্তি । এই তিনের কার্যকলাপ পয়স্পর এমন ভাবে যুক্ত যে , এই তিন মূর্তি একত্রে ব্রহ্মা - বিষ্ণু - মহেশ্বর হিসেবে ত্রিমুর্তি নামে পরিচিত । সতীর দেহের বিভিন্ন অঙ্গ প্রত্যঙ্গ হল কোয়ান্টাম লীপ । কোয়ান্টাম লীপের এক একটি স্তরে শক্তির frequency হিসেবে ভারতবর্ষের বিভিন্ন স্থানে সতীঅঙ্গের নামে একান্নটি মহাশাক্তপীঠ গড়ে উঠেছে । বিভিন্ন স্থানে শক্তির বিভিন্ন নাম তার frequency তারতম্য হেতু ।
আসলে কাহিনীটি মহাজাগতিক ঘটনার একটি রূপক গল্প। অতি প্রাকৃত দর্শনজাত যোগীদের এই উপলব্ধি সাধারণ মানুষ ন বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিতে নয় অধ্যাত্ম দৃষ্টিতে বুঝতে পারেন । সেই জন্য তারা পার্থিব জ্ঞানের বৃত্তের মধ্যে একে ব্যাখ্যা করেন ।
সেই হিসেবে গল্পটি অনার্য শিব ও আর্য প্রতিনিধি পক্ষের মধ্যে একটি সংঘাতের কাহিনী রূপে দেখা দেয় , যাতে শিব জয়লাভ করে আর্যদের পূজার বেদীতে স্থান লাভ করেন ।
অপর পক্ষে সর্তীর দেহের বিভিন্ন অংশ থেকে পীঠস্থান গড়ে উঠার কাহিনী হল এই যে , শিবের ভক্তরা তাদের গুরুপত্নীর মৃত্যুর পর তার দেহের বিভিন্ন অংশ ভারতের বিভিন্ন স্থানে সংরক্ষণ করে সেখানে শিব প্রবর্তিত শাক্ততত্ত্ব চর্চার ব্যবস্থা করেন ।
শ্রীকৃষ্ণের বাঁশী
বিশ্ব ব্রক্ষ্মান্ড মূলত একান্নটি ধাপে সৃষ্ট হয়েছে। এই একান্নটি স্তরের মধ্যে ছয়টি আছে অতি স্থূল স্তর । কিন্তু প্রত্যেকটি স্তরই সাতটি সূক্ষ্ম স্তরে বিভক্ত । অর্থাৎ বিয়াল্লিশটি সূক্ষ্ম স্তর আছে । দেহের মধ্যে ছয়টি স্তরের নাম হল মূলাধার , স্বাধিষ্ঠান , মণিপুর , অনাহত , বিশুদ্ধ এবং আজ্ঞাচক্র। এর আজ্ঞাচক্র হল এমনই এক চক্র ব্রহ্মাণ্ডে দেশেরও উর্ধ্বে যার স্থান । এখানে অতি সূক্ষ্ম বিশেষ আকাশ তৈরির কাজে ব্যস্ত থাকে । এই আজ্ঞাচক্রের উপর কল্পনাতীত আরো সাতটি স্তর আছে, যাকে বলা হয় তত্ত্ব। মূলত ছয়টিই মূল ধাপ। এই ছটি মূল ধাপই হল কৃষ্ণের হাতের বাঁশীর যড়রন্ধ্র। বাঁশীর ষড়রন্ধ্র হল এই শব্দঝঙ্কারের প্রতীকী রূপ -- যার মধ্য দিয়ে ওঁ - এর সুরছন্দ নৃত্যায়িত হচ্ছে । ওঁ - ই হল আদি শব্দ ।
চতুমাত্রিক জগতের দেবদেবী
উর্ধ্ব থেকে গিরিনদীর মতো পিরিনদীর এই দশমাত্রা চতুর্মাত্রার জগতে নেমে আসতে চায় বলেই একদিকে দেবীকে যেমন বলা হয়েছে পার্বতী তেমনই গিরিনদীর স্বভাব অনুযায়ী গৌরী। চতুর্মাত্রিক বিশ্বের মাত্রা হিসেবে রয়েছে , দৈর্ঘ্যে সরস্বতী ( যার বীণার তার হল একমাত্ৰীয় অনন্ত দৈর্ঘ্য ) , প্রস্থে লক্ষ্মী ( ঐশ্বর্যের অধিকারী লক্ষ্মী দ্বারা ব্যাপ্তিকে বােঝানাে যেতে পারে) বেধ বা ঘনত্বে গণেশ ( হস্তমুণ্ড ও মাংসল দেহ এই ঘনত্বরই ইঙ্গিত দেয় ) । কার্তিককে ধরা যেতে পারে গতির প্রতীক হিসেবে 'সময়' বলে । এবং তার বাহন নীল বর্ণের ময়ুরকে দেশ হিসেবে ( দৃশ্য দেশ নীলবর্ণেরই হয় , ' অদৃশ্য দেশ কৃষ্ণবর্নের ) । কার্তিক তারকাসুরকে বধ করেছিলেন অর্থৎ আকাশের নক্ষত্রাদি ( তারকাদি ) তাতে লুপ্ত হয়েছিল । সুতরাং এই মূর্তি চতুষ্টয় চতুমাত্রিক জগৎ- ~ -দৈর্ঘ্য , প্রস্থ , বেধ ও দেশকাল , যেখানে দশমাত্রিক শক্তি নেমে এসেছিল ।
চিত্রগুপ্ত
পুরাণ কাহিনীতে চিত্রগুপ্তের একটি গল্প আছে । তিনি নাকি মানুষের সকল কর্মের হিসেব রাখেন । মত্যুর পর হিসেবের খাতা খুলে মানুষের কর্ম অনুযায়ী তাকে নরক বা স্বর্গবাসের অনুমতি দেন । গল্পটি হাস্যকর প্রমাণিত হবেই — যদি না তার অন্তর্নিহিত সত্যকে ধরা যায় । আসলে জড় জগতের অন্তরালে সূক্ষ্ম এক জগৎ আছে , যেমন- আমাদের নির্দিষ্ট দৃষ্টি গ্রাহ্য আলাের বাইরে একটি সূক্ষ্ম আলাে আছে । সেই সূক্ষ্ম জগৎ সূক্ষ্ম আলাের মতই আমাদের কাছে থেকে গুপ্ত থাকে । সেই সক্ষম জগতের চরিত্র অনেকটা ফটোর নিগেটিভের মত । মানুষের কর্মজনিত তরঙ্গ তাতে কর্মকারীর সম আকৃতির তরঙ্গ সষ্টি করে ফটোর নিগেটিভের উপর দাগ ফেলার মত ব্যক্তিমানুষের সূক্ষ্ম ছাপ ফেলে যায় । তাতে কর্মজনিত কম্পনের ফল স্বরপ তার সূক্ষ্ম চিত্র ফুটে ওঠে । এই চিত্রটি সাধারণ মানুষের স্থূল দৃষ্টির অগােচরে চিত্তে গুপ্তভাবে থাকে বলেই একে ‘ চিত্রগুপ্ত ’ বলা হয়েছে।
সূক্ষ্ম দৃষ্টির অধিকারী সাধক সেই সূক্ষ্ম চিত্র দেখতে পেয়ে প্রতিটি মানুষের ভবিষ্যৎ বলে দিতে পারেন । এই সূক্ষ্ম দৃষ্টির কথাই চিত্রগুপ্তের কাহিনী আকারে পুরাণে স্থান লাভ করে আছে । সেই পুরাণ পড়ে কেউ যদি চিত্রগুপ্ত হাত পা - ওয়ালা কোন জীব বলে ধরে নেন , তিনি অজ্ঞ। এইভাবেই পুরাণ বিকৃতরণে প্রতিফলিত হয়ে আছে ।
সাধকের দিব্যদর্শন
শক্তির আরোহ পর্যায়ে যখন সে মূলাধার চক্রে নড়ে ওঠে — তখন সাধক অদ্ভুত এক রঙ দেখতে পান । সে রঙ সন্ধ্যার ছায়ায় ঢাকা লালবর্নের আকাশের মত অর্থাৎ ফ্যাকাসে । লালরঙের কিছুটা ঘন তরল অবস্থা । কেউ কেউ এই সময় একটি কালো হাতের আশির্বাদ ভঙ্গীর লাল করতল দেখতে পান । তান্ত্রিকরা একেই বলেন মায়ের হাত । যাঁরা এ হাত দেখতে পান তাঁদের উর্ধ্ব গতি ও অতীন্দ্রিয় দর্শন অনিবার্য । এ ছাড়া ম
মূলাধার অকস্মাৎ বিদ্যুৎঝলকের মত তীব্র আলােকচ্ছটাও দেখতে পান কেউ কেউ । এ হল ঐশ্বরিক দীপ্তির ক্ষণিক প্রকাশ । তন্ত্রে এ ধরনের আলােকে বলা হয়েছে — 'কোটি সূৰ্য বিভাযিতম ।' অর্থাৎ অকস্মাৎ যেন কোটি সূর্য জ্বলে ওঠে । সে এত তীব্র আলাে যে , সাধকের মনে হয় চোখ ধাঁধিয়ে গেল । হয়তো বা অন্ধ হয়ে যাবে । শক্তি যখন আর একটি উর্ধ্ব পর্যায়ে ওঠে তখন অর্থাৎ শক্তি স্বাধিষ্ঠান মণ্ডলে এলে তখন সেই ফ্যাকাসে লাভাতুল্য লাল রঙের মধ্যে বৃত্তাকার একটি সবুজ বৃত্ত দেখা যায় । সেই সবুজ বৃত্ত ক্রমশ ছড়িয়ে পড়ে জলো জলো ছায়া ছায়া এক জগতে প্রবেশ করে । দিনের বেলা পুকুরে ডুব দিয়ে চোখ মেলে তাকালে যেমন সবুজ
সবুজ ভাব দেখা যায় সেই রকম । পরে তা ধীরে ধীরে ছায়া ছায়া হয়ে ছড়িয়ে পড়ে , সন্ধ্যা বেলা পুকুরে ডুব দিয়ে চোখ মেলে তাকালে যেমন দেখা যায় সেই রকম হয় । মূলাধার শক্তি যখন আর এক ধাপ উপরে ওঠে অর্থাৎ মণিপুর চক্রে আসে , তখন সে তেজোময় ধূম্রপুঞ্জ দেখতে পায় । সেই ধূম্রপুঞ্জ দেখতে অনেকটা নিদাঘদগ্ধ মধ্যাহ্ন গগনের মত । এর পর শক্তি যখন আরও উর্ধ্বে উঠতে আরম্ভ করে তখন সাদা মেঘের আকাশে যেন কোদালে মেঘের মউজ উঠে , অর্থাৎ সাদা মেঘ থোকায় থোকায় কাটতে আরম্ভ করে , এবং তার ফাঁকে ফাঁকে শরতের নীল আকাশের মত আকাশ উঁকি দেয়। যখনই অনাহত চক্রের দিকে শক্তির অগ্রগতি পথে সাদা জ্যোতির্ময় মেঘের ফাঁকে ফাঁকে নীল আকাশ উঁকি দেয় তখনই গবেষক নিজের সারা দেহমনে অদ্ভুত এক আনন্দের শিহরণ অনুভব করেন । কখনও কখনও যেন বহুদূর আকাশ থেকে সেই নীল অংশ বেয়ে খণ্ড খণ্ড সাদা মেঘের ফাঁকে ফাঁকে গম্ভীর এক ধ্বনি ভেসে আসে- অ - উ - ম , অ - উ - ম , অ - উ - ম । পাহাড়ের গুহা থেকে শব্দ করলে যেমন গমগম করে প্রতিধ্বনি
হয় — অনেকটা যেন সেইরকম রহস্যময় ধ্বনি।
এরপর শক্তি যখন অনাহত চক্রে গিয়ে স্থির হয় তখন শুধু , নীল , নীল আর নীল । পরতে পরতে নীল সরে গিয়ে আরও সূক্ষ্ম জ্যোতির্ময় নীল দেখা দিতে থাকে । সেই নীলের মধ্যে নানা ধরনের ছবি ফুটে উঠতে থাকে । যেমন , দূর দেশ , পর্বতশৃঙ্গ , সাগর , মরুভূমি , গ্রহান্তর , গ্রহান্তরের জীব , দেবদেবীর জীবন্ত ছবি , কখনও কখনও ভিন্ন গ্রহে রক্তমাংসের উন্নত জীব , যাদের মধ্যে কারাে কারাে আকৃতি আমাদের পূজ্য দেব - দেবীদেরই মত। যােগীরা ধ্যানে এইসব দূরবর্তী গ্রহের জীব দেখেই দেবদেবীর কল্পনা করেছিলেন , যে জন্য বলা হয়েছে ,
“ যােগীনাম ধ্যান নির্মিতম । " এই ধ্যানলব্ধ মূর্তির সঙ্গে তত্ত্ব যুক্ত করে তাকে ভিন্নতর রপ দেওয়া হয়েছে , যেমন কালী । শক্তির দুর্বোধ্য শিহরণরপে তাঁর বর্ণ করা হয়েছে কালো , অর্থাৎ যে আদি , যে শক্তির স্বরুপ ধারণার মধ্যে আনা যায় না । কৃষ্ণ বা কালাে বর্ন হল দুর্বোধ্যতার প্রতীক । নিস্ক্রিয় শ্বেতশিবের বুকের উপর তাঁকে দাঁড় করিয়ে এইটুকু বােঝানাের চেষ্টা করা হয়েছে যে , শূন্যের বুকে নিষ্পম্প আবেগ বা চিৎ বা চৈতন্য ( শ্বেতবর্ণ ) থেকে তাঁর জন্ম । তাঁর নাম ' কালী দেওয়া হয়েছে এই কারণে যে , শক্তি রপে তিনি নড়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই কালের জন্ম হয়েছে । কালের জন্মদাত্রী হিসেবেই তিনি কালী । তাঁকে চার হাত দান করা হয়েছে এই কারণে যে , তার দ্বারা মহৎ একটি তত্ত্ব বােঝানাের চেষ্টা হয়েছে , অর্থাৎ মহাশক্তি , যিনি জগৎরপে ফুটে আছেন , তিনিই তা পালন করছেন , তিনিই তা ধ্বংস করছেন ।
দক্ষিণ দুই করে বর ও অভয় , খরগধৃত বাম করে ধ্বংস ও মুন্ডধৃত করে সৃস্টি।
তাঁর গলায় পঞ্চাশটি ও হাতে একটি মুণ্ড দিয়ে বােঝানাের চেষ্টা করা হয়েছে যে , একান্নটি তরঙ্গে শক্তিরুপে তিনি সূক্ষ্ম জগতের আকৃতি গ্রহণ করেছেন । তাঁর বিলম্বিত জিহৰা খেচরী মুদ্রার প্রতীক , অর্থাৎ তিনি প্রকৃতি সৃষ্টি করে তাতে সাম্য রক্ষা করছেন । যেভাবে সাধকের দেহ ভূমিত্যাগ করলে খেচরী মুদ্রার সাহায্যে তিনি দেহের সাম্য রক্ষা করেন।
মূলত শক্তির উর্ধ্বগতিতে মস্তিষ্কতন্ত্রীর তরঙ্গমাত্রার সঙ্গে সমপর্যায়ে তরঙ্গায়িত যত গ্রহ , গ্রহান্তর , জীব , সবই দেখা যায় । গঠন এবং আকৃতিতে তারা পার্থিব জগতের জীব থেকে ভিন্ন নয় । এমন কি উন্নত জীব , যাঁদের দেখে যােগীরা ধ্যানে দেবদেবী কল্পনা করেছেন , তারাও মানুষেরই মত দ্বিহস্ত দ্বিপদ যুক্ত । পৃথিবীতে তাঁদের রুপান্তর মানুষের ভাবাদর্শ যােগ হবার জন্য , না হলে জীবজগতের চূড়ান্ত আকৃতিগত পরিণতি দ্বিহস্ত দ্বিপদের মধ্যেই রয়েছে , কারণ — মনুষ্যাকৃতি এই দেহের মধ্যেই জীবজগৎ তার চূড়ান্ত সিদ্ধি অর্জন করেছে । সূষ্টিতত্বের মূল কথা — যেখান থেকে উৎপত্তি সেখানেই পরিণতি । এই বৃত্ত শেষ হলেই সৃষ্টির উদ্দেশ্য চূড়ান্ত পরিণতি লাভ করে ।
সৃষ্টির যে পর্যায়ে জীব বা প্রাণিজগৎ আত্মপ্রকাশ করেছে , তা হল জড় পর্যায় । সৃষ্টি প্রথম দৃশ্যমান হয় হল স্থূল জগতে । কিন্তু সৃষ্টি একটি অন্ধ আবেগে আপন পরিণতির দিকেই এগিয়ে চলেছে , অর্থাৎ যেখান থেকে সে এসেছে সেখানেই ফিরে যাবার পথে সে এগিয়ে চলেছে । স্থূল থেকে ব্যাখ্যাতীত রহস্যে প্রাণের আবির্ভাব হয়েছে । প্রাণ থেকে মনের , মন থেকে বুদ্ধির , চিত্তবৃত্তি ও অহংকারের । এই বুদ্ধি দ্বারা মানুষ বুঝতে শিখেছে যে , শুন্যতা থেকে সৃষ্টি , শুন্যতাতেই আবার ফিরে যেতে হবে । শুধু তাই নয় , ব্যবহারিক জীবনে বহু , সাধুসন্ত এই শূন্যতাতে ফিরেও গেছেন । ফলে মনুষ্যদেহের বাইরে উৎকৃষ্টতর অন্য কোন দেহের প্রয়ােজন নেই বলেই ভিন্ন গ্রহেও যে - সব উন্নত জীব দেখা যায় তারা ক্ষুদ্রাকার বা বৃহদাকার হলেও দ্বিহস্ত দ্বিপদ বিশিষ্টই , তার বাইরে নয় ।
অনাহত চক্রের স্বচ্ছ নীল আকাশেই যে প্রথম অলৌকিক দর্শন হয় , তা নয় । তার আগেও মাঝে মাঝে নানা অলৌকিক জ্ঞান হয় । তার মধ্যে কিছু হয় তাে আপন মনের সংস্কারের প্রতিফলন , কিছু হয়তাে বা সত্য , যেমন ঘূর্ণায়মান শিবলিঙ্গ বা বলয়যুক্ত শনিগ্রহ । শিবলিঙ্গ আর কিছুই নয় বিন্দু — যাতে পুরষ ( শুন্যতা ) ও প্রকৃতি একাত্ম হয়ে আছে । আনন্দ অর্থাৎ বিন্দু পর্যায়ে শূন্যের চতুর্দিকে এই বিন্দু , ঘূর্নায়মান হয় , অর্থাৎ বিন্দু , শূন্যে বা পুরুষের চতুর্দিকে গৌরীপট্রের মত বিরাজ করে । যােগীরা হয়তাে এ - দেখেই শিবলিঙ্গের কল্পনা করেছিলেন ।
অনাহত চক্র ছাড়িয়ে শক্তি উপরের দিকে উঠতে থাকে । তখন নীলরঙ ক্রমশ উজ্জলতর ও সূক্ষ্মতর হতে আরম্ভ করে । অবশেষে বিশুদ্ধচক্রে এসে পৌঁছলে তা নীল জ্যোতির আকার ধারণ করে । এই জ্যোতির্ময় নীল দিব্যজগতের খুব কাছাকাছি । এখানে নানা দিব্যমূর্তি দর্শন হয় । তবে তাঁরা কেউ রক্তমাংসের নন । হয় যোগীর মনের প্রক্ষেপণ অথবা দৈবীসত্তার সূক্ষ্মরুপ । শক্তিকে এখানে তুলতে পারলে নানা দৈবীভাবে দেহ অনুরণিত হতে থাকে । বিশুদ্ধচক্র থেকে শক্তি যখন আরও উধর্ব দিকে এগিয়ে চলে তখন "জ্যোতির্ময় নীল" আরও সূক্ষ্মতর হতে আরম্ভ করে । এখানে নানা দিব্যদর্শন ও পার্থিব জগতের বিগত মহাত্মাদের অর্থাৎ উচ্চকোটী সাধকদের বহু সূক্ষ্মদেহ দর্শন হয় । এরপর শক্তি যখন ভ্রুমধ্যে আজ্ঞাচক্রে প্রবেশ করে তখন নানা রঙের বিস্ফোরণ হতে থাকে । মাঝে মাঝে এখানেও নানা দিব্যদশনও হতে থাকে ।
আজ্ঞাচক্র অর্থাৎ অনুমতিচক্র পার হলে সপ্ততলে অর্থাৎ স্থায়ী দিব্যজগতে প্রবেশের অধিকার পাওয়া যায় । এখানে পূর্বে - বণিত সকল রঙের তন্মাত্র অর্থাৎ অস্তিত্ত্ব পূনরার সূক্ষ্ম রূপে দেখা যায় । তারই মাঝে মাঝে দৈবী - সত্তার তন্মাত্ররপ চোখে পড়তে থাকে । আজ্ঞাচক্র হল দিব্যজগতে প্রবেশের ছাড়পত্র স্বরপ ।
মেরুদণ্ডের রন্ধ্রপথ তখন পরিষ্কার হয়ে যায় । মূলাধারের কুম্ভস্থিত শক্তির উর্ধ্বযাত্রাপথে তখন আর কোন বাধাই থাকে । বিনা বাধায় শক্তি দ্রুত উর্ধ্বে উঠে সপ্ততলে চলে যায় । সপ্ততলে নানা বর্ণের ও নানা দৃশ্যের তন্মাত্র দর্শনের পর শক্তি প্রবেশ করে বিন্দুতে । তখন বিন্দু , অদৃশ্য হয় । বিন্দুর পরিবর্তে শুধুমাত্র জ্যোতি দর্শন হতে থাকে । সপ্ততলে নানাবর্ণ মাঝে মাঝেই অনন্ত আকাশে কোটিচন্দ্রপ্লাবিত জ্যোৎস্নার প্লাবনে মনপ্রাণকে স্নিগ্ধ করে দেয় । বিন্দুতে ঢুকলে সূক্ষ্ম অহংবােধ ও দিব্যবােধ একাত্ম হয়ে অদ্ভুত এক পরিপূর্ণ আনন্দ দান করতে থাকে । যেন ঈশ্বরের সঙ্গে একাত্ম হয়েছি অথচ তাকে বােধ করে আনন্দও পাচ্ছি , এইভাব । বিন্দুর এই জ্যোতির্মণ্ডলে প্রবেশ করলে ব্যক্তিমানুষের নিজের মধ্যেই দৈবী ক্ষমতা দেখা দেয় ।
বিন্দুর জগতে প্রবেশ করলে জ্যোতি ছাড়া সে তখন আর কিছুই দেখে না । কিন্তু জাগ্রত অবস্থায় চোখ বুজলে সেই দিব্যজ্যোতি নানা রুপ অঙ্কন করে প্রতীকী ভাষায় কথা বলে । ঠিক যেন আকাশের মেঘ । আকাশের মেঘ যেমন এক এক সময় এক এক রপ ধারণ করে সেই জ্যোতিও নানারুপ ধারণ করে ইঙ্গিতে কথা বলতে থাকে । জগতের অতীত , বর্তমান , ভবিষ্যৎ সবই যেন তার চৈতন্যসত্তায় ধৃত হয়ে আছে । ইচ্ছামাত্র প্রতীকীরপে সে সম্পর্কে নানা ইঙ্গিত দেয় ।
শক্তি যখন আরও এগিয়ে যায় তখন দেহভার আর থাকেই না । দেহ শূন্যে ভাসমান হয় । জিহ্বা নাসারন্ধে প্রবেশ করে কুম্ভক হয় । পার্থিব জগৎ লুপ্ত হয়ে শুধুমাত্র স্বচ্ছ দর্পণতুল্য এক দেশ বিরাজ করে । সেই দর্পণে জগৎব্রহ্মাণ্ড প্রতিবিম্ব হিসেবে বিরাজ করে । বাক্তি সর্বদ্রষ্টা হন । ইচ্ছাশক্তি করায়ত্ত হয় । ইচ্ছামাত্র সৃষ্টি স্থিতি লয়ের ক্ষমতা জন্মে । শক্তি এই চিৎ পর্যায়ে পৌছবার অনেক আগেই মানুষের মধ্যে আত্মিক শক্তি জন্মায়। এই আত্মিকবলে বহু লােক রােগ নিরাময় ইত্যাদি করে থাকে । চিৎ পর্যায়ে স্থিত হলে মৃতকেও জীবন দান করা যায় , অর্থাৎ ইচ্ছাশক্তি করায়ত্ত হয় । কারণ , এই চিৎ পর্যায় থেকেই শক্তি আত্মপ্রকাশ করে - এই জন্য শক্তির নাম চিন্ময়ীও বটে । এর উপর শক্তি যখন আরও এগােয় তখন ক্রমশ বােধশক্তি লােপ পেতে থাকে । এক সময় সব কিছুই হারিয়ে যায় । কোন কিছুই বােধের মধ্যে থাকে না । এই হল শূন্যস্থিত শক্তির জগৎরুপ। গতিশীলরুপ ত্যাগ করে পুনরায় শুন্যে সুপ্ত হওয়া — শাস্ত্রে যাকে বলা হয়েছে সমাধি । শক্তিকে বিপরীত মুখে ফিরিয়ে নিয়ে এই অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করা যায় বলে এই আচারকে বাম ( বিপরীত ) আচার বা বামাচার নাম দেওয়া হয়েছে ।
Continue-40
ভীষ্মের শরশয্যা
মহাভারতের যুদ্ধের শেষ ভাগে ভীষ্ম শরশয্যায় দীর্ঘদিন শায়িত ছিলেন ।
শ্রীকৃষ্ণের পরামর্শেই অর্জুন যুদ্ধের দশমদিনে সূর্যাস্তের কিছু পূর্বে শিখণ্ডীকে রথের সামনে বসিয়ে ভীষ্মের সম্মুখে আসেন
এবং শরনিক্ষেপে ভীষ্মের পতন ঘটান।
অর্জুনের শর নিক্ষেপের ক্ষিপ্রতা এতই তীব্র ছিল যে- ভীষ্মের শরীরের এক
ইঞ্চি পরিমাণ জায়গাও অবিদ্ধ ছিল না। দিনের শেষে ভীষ্ম রথ থেকে পড়ে যান। কিন্তু অসংখ্য শর
বিদ্ধ থাকার কারণে ভীষ্মর শরীর
মাটি স্পর্শ করলো না।
ফলে ইনি শরশয্যায় থেকে গেলেন।
আর আটদিন পর যুদ্ধের শেষ হলে-
যুধিষ্ঠির রাজ্যলাভ করে অভিষিক্ত
হলেন। এই সময় কৃষ্ণের
পরামর্শে যুধিষ্ঠির শরশয্যায় শায়িত
ভীষ্মের কাছে আসেন।
সেখানে কৃষ্ণের অনুরোধে ভীষ্ম
যুধিষ্ঠিরকে বিবিধ পরামর্শ দেন।
শ্ৰীকৃষ্ণকে দেখে ভীষ্ম বললেন, " হে জনার্দন, আমি পূর্ব জন্মেএমন কি পাপ করেছিলাম ,, যে এই জন্মে এত বড় শাস্তি এত কষ্ট আমাকে ভোগ করতে হচ্ছে ?"
ভগবান বললেন, " আপনি তো নিজেই পূর্ব জন্মের কথা স্মরন করতে পারেন, তাহলে আপনি নিজেই দেখুন না আপনি পূর্ব জন্মে কি পাপ করেছিলেন?" ভীষ্ম বললেন, " আমি তো দেখতে দেখতে গত ১০০ জনমের কর্ম দেখে ফেলেছি, কিন্তু এই ১০০ জনমের মধ্যে আমি এমন কোনো কর্ম করিনি যেটাতে আমি এত বড় শাস্তি পেতে পারি । "
ভগবান_বললেন, " আপনি কৃপা করে এই ১০০ জনমের ঠিক একটি জনম আগে দেখুন (অর্থাৎ ১০১ নং জনম), উওর আপনি পেয়ে যাবেন।" তখন পিতামহ ভীষ্ম চোখ বন্ধ করে ধ্যান পূর্বক দেখতে লাগলেন- ঐ জনমে তিনি একজন খুবই ধার্মিক রাজা ছিলেন। একদিন তিনি বিশাল সৈন্যদল নিয়ে কোথাও যাচ্ছিলেন। পথের মাঝে একটি সাপ এসে তাদের যাত্রায় বাধা হয়ে দাঁড়ায়।এক সৈনিক এসে বললো, " মহারাজ, একটি সাপ রাস্তার মাঝে বসে আছে, কি করবো? " রাজা বললেন, " তুমি সাপটিকে একটি লাকড়িতে বেঁধে পাশের জঙ্গলে ফেলে দাও।" সৈনিক তাই করলো, কিন্তু সাপটি জঙ্গলে একটি বিশাল কাঁটার ঝোপের মধ্যে আটকে গিয়ে প্রচন্ড যন্ত্রনায় ছটফট করতে করতে অবশেষে পাঁচদিন পর মারা গেল।
পিতামহ ভীষ্ম তখন ভগবান শ্রীকৃষ্ণ কে বললেন, দেখলাম আমার পাপ কর্ম, কিন্তু আমিতো সাপটিকে বাঁচানোর জন্য জঙ্গলে ফেলেদিয়েছিলাম, নাহলে তো সাপটি আমার রথের চাকার নীচে চাপা পরেই মারা যেতো।" ভগবান বললেন, " কিন্তু আপনিতো ঐ সাপটির কি পরিনতি হলো তা একবারও ফিরে দেখলেন না বা ঐ সাপটিকে বাঁচানোর চেষ্টাও করেন নি, তাই আজ আপনার এই পরিনাম। অথচ আপনার পুন্য কর্ম এত বেশী ছিল যে গত ১০০ জনমেও আপনি কোন পাপের ফল ভোগ করেন নি। "
শরশয্যায় মোট আটান্ন দিন থাকার পর
ভীষ্ম মাঘ মাসের শুক্ল পক্ষের অষ্টমী তিথিতে যোগযুক্ত হয়ে ইচ্ছামৃত্যু গ্রহণ করেন।
এই শরশয্যা আসলে সংসার শরশয্যা । সংসার তাে প্রতিনিয়তই আমাদের বিদ্ধ করছে ।
ভীষ্ম দক্ষিণায়ণে শরবিদ্ধ হয়েছিলেন কিন্তু উত্তরায়ণ না হলে প্রাণত্যাগ করবেন না বলে অপেক্ষা করতে লাগলেন । অর্থাৎ তার বক্তব্য এই যে , শীতকালে মৃত্যু হলে স্বর্গপ্রাপ্তি ঘটবে না । গ্রীষ্মকালে মৃত্যু হলে স্বর্গ প্রাপ্তি ঘটবে । তা হলে পৃথিবীতে কোন সাধকের কি শীতকালে মৃত্যু হয়নি? যদি হয়ে থাকে তবে কি তাঁরা নরকে গিয়েছেন?
এই সঙ্গত প্রশ্ন অনেকের মনেই আসতে পারে। দক্ষিণায়ণে থাকা কালে নিশ্চয়ই বহু সাধকের মৃত্যু হয়েছে । সুতরাং তারা নরকে গেছেন এমন হতে পারে না । আসলে এ গল্পও একটি রূপক গল্প । দক্ষিণায়ণ অর্থ অবতরণ। মানুষের সহস্রারের ব্রক্ষ্মরন্ধ্র
থেকে মূলাধারে অবতরণ। অর্থাৎ এটি হল সংসার জীবন যাপনের পথে মােক্ষের বিপরীত দিকের পথ অর্থাৎ অবতরণের পথ । হিন্দুদের ক্ষেত্রে এই অবতরণের পথ মূলত চতুরাশ্রমের গার্হস্থ্যশ্রমের
পথ। ব্রহ্মচর্যাশ্রমে জীবনকে সংসার এবং মােক্ষ দুইয়ের জন্যই তৈরি করা হয় ।গার্হস্থ্যশ্রমের সংসার জীবন যাপন করা হয় । বানপ্রস্থাশ্রমে ধীরে ধীরে সংসার ত্যাগের প্রস্তুতি হয় । সন্নাসাশ্রমে সংসার থেকে সম্পূর্ণ মুক্তি দেওয়া হয় ।
কুলকুণ্ডলিনীর অবতরণের পথ সংসারের পথ । উত্তরণের পথ অর্থাৎ ব্রহ্মমুখী হবার পথ, মােক্ষের পথ । ভীষ্ম উত্তরায়ণে মৃত্যুর ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন এই অর্থে যে , সংসার জীবনের চতুর্থাশ্রম যথাযথ পালনের পর তবে তিনি দেহ রক্ষা করবেন । অর্থাৎ কুলকুণ্ডলিনীকে ব্রক্ষ্মরন্ধ্রে নিয়ে গিয়ে প্রাণত্যাগ করবেন । এই দক্ষিণায়ণ ও উত্তরায়ণ হিন্দুদের চতুরাশ্রমের অঙ্গীভূত অর্থাৎ সংসার জীবনের কাল ও মােক্ষলাভের কাল । সূর্যের দক্ষিণায়ন বা উত্তরায়ণের সঙ্গে তার কোন যােগ নেই । কুলকুণ্ডলিনীর বিপরীত চলনই উত্তরায়ণ । মানুষের মস্তিষ্ক হল দেহের উত্তর দিক । কুলকুণ্ডলিনীর তেজই সূর্য ।
উত্তরায়ণের যে সুর্যের কথা ভীষ্ম বলেছিলেন তা প্রাণসূর্য অর্থাৎ কুলকুণ্ডলিনী । সংসারের পথে এর বিপরীত গতিই উওরায়ণ অর্থাৎ সংসারের উল্টোপথে প্রাণশক্তিকে প্রবাহিত করা ।
প্রয়াগ
প্রয়াগে মাথা মুড়িয়ে ত্রিবেণীতে স্নানের অর্থ এই যে , প্রয়াগ অর্থে যে তীর্থে ত্রিবেণী আছে ।
ত্রিবেণী অর্থে ত্রিধারা - ইড়া , পিঙ্গলা , সুষুম্না বা গঙ্গা , যমুনা ও সরস্বতী সেই ত্রিকুট বা আজ্ঞাচক্রে মাথা অর্থে মস্তিষ্ক ( জ্ঞানবুদ্ধির আধার ) অতি উচ্চ স্থান , মুড়িয়ে অর্থে পরিষ্কার করে অর্থাৎ অবিদ্যা চরণ ছেদন করা ।
ত্রিবেণী অথাৎ ইড়া , পিঙ্গলা , সুষুম্না বা গঙ্গা , যমুনা ও সরস্বতী এই তিনটি মহানদীর মিলনস্থান বা সঙ্গম স্থান , স্নান অর্থে অবিদ্যামল ধৌত করা অর্থাৎ যে জ্ঞান দ্বারা অজ্ঞান অন্ধকার নাশ হয় , সেই জ্ঞানের উপর যে অবিদ্যার আবরণ সেই আবরণ গুরূপদিষ্ট জ্ঞান খড়্গ দ্বারা ছেদন করবে । পরে প্রত্যেক অনুভূতির জন্য কুটস্থে অর্থাৎ ত্রিবেণীতে তিনগুণের মিলন স্থানে ডুব দেবে , অর্থাৎ মনকে লয় করবে ।
এই সাধনা দ্বারা নিস্কাম হয়ে জীব শিবত্ব লাভ করতঃ প্রয়াগ তীর্থে যথার্থ সুখ উপভােগ করতে পারবে ।
*#জ্ঞান_গঙ্গায়_অবগাহন
*#শাস্ত্রে আছে , মহামায়া শ্ৰী শ্রী গঙ্গা দশহরার দিন মার্তে আগমন করেছিলেন । দশহরা অর্থে যিনি জীবের দশবিধ পাপ হরণ করেন , তিনিই দশহরা ; অথবা তিনি যেদিন এই মর্ত্যে পতিতােদ্ধারিণীরূপে সাক্ষাৎ জ্ঞানময়ীরূপে অবতীর্ণ হয়েছিলেন , সেই দিনের নামই দশহরা । যাইহোক , তাঁর আবির্ভাবে পাপী তাপী মর্তবাসীর যে দশপ্রকার মহাপাপ বিনষ্ট বা বিধৌত হয় তাও এই প্রসঙ্গে সকলের জেনে রাখা দরকার ।
*#দশবিধ পাপ যথাঃ-
( ১ ) অদত্ত বস্তুর গ্রহণ বা অপহরণ
( ২ ) অবৈধ বা বিনাযজ্ঞে হিংসা , ( ৩ ) পরদার বা পরপুরুষে গমন অর্থাৎ ব্যভিচার এই তিন প্রকার কায়িক মহাপাপ ;
( ১ ) পীড়াদায়ক বাক্য বা পরুষ ব্যবহার ,
( ২ ) মিথ্যা কথন ,
( ৩ ) ক্রুরতাপূর্ণ ও অসংবদ্ধ প্রলাপ বাক্য এবং
( ৪ ) পরনিন্দা এই চারিপ্রকার বাচিক মহাপাপ ।
( ১ ) শাস্ত্রে , গুরুবাক্যে ও সত্যে অবিশ্বাস বা মিথ্যা অভিনিবেশ , ( ২ ) অন্যের কোন বস্তুলাভে ইচ্ছা বা পরদ্রব্যে লােভ এবং
( ৩ ) মনে মনে পরের অনিষ্ট চিন্তা এই তিন প্রকার মানসিক মহাপাপ
*#সব মিলে জীবের এই ১০ প্রকার মহাপাপ ভক্তি যুক্ত অন্তরে গঙ্গাস্নানে দূর হয় । গঙ্গা জ্ঞানময়ী বা জ্ঞান প্রবাহিনী । শ্রীভগবান শঙ্করাচাৰ্য্য " জ্ঞান প্রবাহা- বিমলাদি গঙ্গা ” অর্থাৎ ত্রিভুবন জননী ও ব্যাপিনী জ্ঞানকে গঙ্গা বলে অভিহিত করেছেন । মহাত্মা রামপ্রসাদও এই জ্ঞানকে খড়্গরূপে বর্ণনা করে ধর্ম ও অধর্ম বা , পুণ্য ও পাপরূপ অথবা আসক্তি বা বিরক্তিরূপ অজাদ্বয়কে অর্থাৎ ভােগ বন্ধন দুইটিকে বিনাশ করার ভাব প্রকাশ করেছেন । ভাবই জীবের ধর্ম ও অধর্ম , বিরক্তি ও আসক্তি অথবা প্রবৃত্তি ও নিবৃত্তি বস্তুর আধার । নামরূপাত্মক লৌকিক ও অলৌকিক ভাবময় সাধন ক্রিয়া অবলম্বন দ্বারা জীব অবিদ্যা নাশ ও অজ্ঞানতা হতে চিরমুক্ত হতে পারেন ।
*#সাত্ত্বিক জ্ঞানই প্রকৃত গঙ্গাস্নান পদবাচ্য । তখন সত্ত্বগুণের আর্বিভাবে রজস্তমঃ ভাব নষ্ট হয়ে সমস্ত পাপ হতে সাধক মুক্তিলাভ করেন । এটিই জ্ঞান-গঙ্গায় অবগাহন ।
Please join this group:
"যোগ সাধনায় পরমাত্মা প্রাপ্তি"
https://www.facebook.com/groups/353473076140599/?ref=share
0 Comments