আধুনিক জীবনে ধর্মচর্চার প্রয়োজনীয়তা
আধুনিক সভ্যতা, প্রযুক্তি, বিজ্ঞান ও বুদ্ধিবৃত্তির অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে মানুষের জীবনে ধর্মচর্চা ও আধ্যাত্মিকতার স্থান যেন ক্রমশ সংকুচিত হয়ে এসেছে। একদিকে জাগতিক প্রাপ্তির মোহ, অপরদিকে জীবনের উদ্বেগ, নিঃসঙ্গতা ও অর্থহীনতার বোধ মানুষের মধ্যে এক গভীর অন্তঃসারশূন্যতা সৃষ্টি করেছে। ঠিক এইখানেই ধর্মচর্চা ও আধ্যাত্মিকতা নতুন করে প্রয়োজনীয় হয়ে উঠেছে। কিন্তু এই ধর্ম হবে না কেবলমাত্র রীতিনীতির অনুসরণ, হবে না কেবলমাত্র কুসংস্কারজাত সংস্কার। বরং এই ধর্ম হবে জীবনের মর্মে প্রবিষ্ট, আত্মানুসন্ধানময় এবং বাস্তব জীবনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। এই প্রবন্ধে আমরা অন্বেষণ করব—আধুনিক জীবনে ধর্মচর্চার গুরুত্ব, প্রয়োজনীয়তা এবং তার প্রয়োগযোগ্য রূপরেখা।
*#ধর্মের মৌলিক ব্যাখ্যা: শাস্ত্রসম্মত দৃষ্টিকোণ:
বেদের ভাষায় ধর্ম হল—"ধরণাৎ ধর্মঃ" অর্থাৎ যা ধারণ করে, যা রক্ষা করে তা-ই ধর্ম। এটি কোনো নির্দিষ্ট মতবাদ নয়, বরং চেতনার এক অবিচ্ছেদ্য গতি। ঋগ্বেদ, উপনিষদ, গীতা—সবখানেই ধর্ম মানে আত্মজ্ঞানের পথে চলা, সত্তার বিশুদ্ধি, অন্যের মঙ্গল চিন্তা ও আত্মিক বিকাশ।
শ্রীমদ্ভগবদগীতায় ধর্মকে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে একজন ব্যক্তির স্বধর্ম পালন ও আত্মিক কল্যাণের প্রেক্ষিতে:
"স্বধর্মে নিধনং শ্রেয়ঃ পরধর্মো ভয়াবহঃ" (গীতা ৩/৩৫)
অর্থাৎ, নিজের ধর্ম পালন করেই মরণ শ্রেয়, অপরের ধর্ম পালন ভয়ঙ্কর। এখানে ধর্ম মানে one's inner nature—স্বভাব, স্বকীয় কর্তব্য। ধর্ম মানে আত্মাকে উপলব্ধি করার নিরন্তর প্রয়াস, যার মাধ্যমে মানবজীবনের প্রকৃত অর্থ অনুধাবন করা যায়।
*#আধুনিক জীবনের চিত্র:
আজকের সমাজে ধর্মকে অনেক সময় অন্ধ বিশ্বাস, গোঁড়ামি বা প্রথাবাদ হিসেবে দেখানো হয়। অথচ এই মনোভাবের ফলে আমরা ধর্মের আধ্যাত্মিক গভীরতা হারাচ্ছি। শহুরে মানুষ ধর্মকে অনেক সময় দূরে সরিয়ে রাখে, ভাবেন এটি অবসরপ্রাপ্ত বৃদ্ধদের কাজ। আবার অনেকে ধর্মকে শুধুমাত্র উৎসবের রীতিনীতিতে সীমাবদ্ধ রাখেন। কিন্তু আধুনিক মানুষ যেসব সমস্যার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে—
মানসিক চাপ ও উদ্বেগ,
নিঃসঙ্গতা ও অস্তিত্বহীনতার বোধ,
সম্পর্কের জটিলতা ও মানবিকতা হ্রাস,
প্রযুক্তিনির্ভর বিচ্ছিন্নতা,
সেগুলির মোকাবিলায় ধর্ম ও আধ্যাত্মিকতা একটি গভীর ভিত দিতে পারে।
*#ধর্ম মানে জীবনদর্শন:
ধর্মকে যদি আমরা শাস্ত্রীয় আকারে নয়, বরং জীবনদর্শন হিসেবে দেখি, তবে তার প্রাসঙ্গিকতা বর্তমানেও তীব্রভাবে উপলব্ধ হয়। ধর্ম হল এক ধরণের অন্তর্মুখীনতা—যেখানে মানুষ নিজেকে, নিজের চিন্তা, কাজ ও চেতনার মূল উদ্দেশ্যকে বুঝতে চায়। আধুনিক মনোবিজ্ঞানী কার্ল ইউং বলেছেন, “People do not suffer from diseases, they suffer from meaninglessness.” ধর্ম এই অর্থহীনতা ঘোচাতে পারে।
ধর্ম চর্চা মানে আত্মাকে জাগ্রত করা, নিজের সত্তার প্রকৃত লক্ষ্য খুঁজে পাওয়া এবং সেই পথে ধীরে ধীরে নিজেকে পরিপূর্ণরূপে গড়ে তোলা।
*#আধ্যাত্মিকতা বনাম প্রথাগত ধর্মীয়তা:
প্রথাগত ধর্ম মানে বহু ক্ষেত্রেই আচারানুষ্ঠান, সংস্কার, জাতপাত বা গোঁড়ামিতে আবদ্ধ এক জীবনপদ্ধতি। কিন্তু আধ্যাত্মিকতা (Spirituality) হল ব্যক্তিগতভাবে ঈশ্বর বা চেতন শক্তির সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করার অভ্যন্তরীণ প্রয়াস। গীতায় বলা হয়েছে:
"উদ্ধরেদাত্মনাত্মানং নাত্মানমবসাদয়েত্। আত্মৈব হ্যত্মনো বন্ধুরাত্মৈব রিপুরাত্মনঃ" (গীতা ৬.৫)
অর্থাৎ, নিজের দ্বারা নিজের উন্নতি করো, নিজের দ্বারা নিজের পতন ঘটিও না। নিজের আত্মাই নিজের বন্ধু, আবার আত্মাই নিজের শত্রু। এই আত্ম-উন্নয়নই আধুনিক আধ্যাত্মিকতার সারমর্ম।
ধর্মচর্চার আধুনিক প্রয়োগযোগ্যতা:
আধুনিক জীবনে ধর্মচর্চা মানে কেবলমাত্র পুজো বা প্রার্থনা নয়; বরং তার অন্তর্নিহিত দর্শনের অনুশীলন। যেমন:
যোগ ও ধ্যান: মানসিক চাপ কমাতে, মনসংযমে সাহায্য করে।
জপ ও মনঃসংযোগ: চেতনার বিশুদ্ধতা আনে, অস্থিরতা কমায়।
সত্য ও অহিংসার চর্চা: গাঁধীজির জীবন তার প্রমাণ।
কর্মে নিষ্ঠা ও নৈতিকতা: পেশাগত জীবনে ধর্মচর্চার বাস্তব রূপ।
সেবার মনোভাব: অপরের জন্য কাজ করেও আত্মোন্নয়ন সম্ভব।
আত্মপর্যালোচনা: প্রতিদিন অন্তর্জিজ্ঞাসা ও বিবেক-অন্বেষণ।
এই প্রয়োগগুলো কেবল ব্যক্তিগত নয়, সমাজিক ক্ষেত্রেও প্রাসঙ্গিক। একজন আত্মসচেতন ব্যক্তি পরিবার, সমাজ, কর্মজীবন ও বৃহত্তর মানবসমাজের পক্ষে আশীর্বাদস্বরূপ।
আধুনিক বিজ্ঞান ও ধর্মচর্চার সংহতি:
বিজ্ঞান ও ধর্মকে অনেক সময় পরস্পরের বিপরীত ভাবা হয়। কিন্তু আধুনিক নিউরোসায়েন্স বা কোয়ান্টাম ফিজিক্সে অনেক জায়গায় আত্মচেতনা, সচেতনতার স্তর, মনোসংযোগের শক্তি এসব বিষয় উঠে আসছে, যা আধ্যাত্মিক চর্চার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। ধ্যান যে মস্তিষ্কে পজিটিভ পরিবর্তন আনে, তা আজ প্রমাণিত। ধর্মশাস্ত্র যে আত্মজ্ঞান ও মানসিক ভারসাম্যের কথা বলে, তা বিজ্ঞানের পর্যবেক্ষণেও সঠিক প্রমাণিত হচ্ছে।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আজ 'Mindfulness-Based Stress Reduction (MBSR)' প্রোগ্রাম, 'Transcendental Meditation' ও 'Spiritual Psychology' রীতিমতো একাডেমিক বিষয়। যেটি আমাদের বুঝিয়ে দেয়, ধর্ম ও বিজ্ঞান পরস্পরের পরিপূরক হতে পারে।
ধর্মচর্চার ফলাফল:
একজন ব্যক্তি নিয়মিত ও অন্তর্মুখী ধর্মচর্চা করলে তার মধ্যে যে পরিবর্তন আসে তা হলো:
মানসিক স্থৈর্য ও আত্মবিশ্বাস,
সহিষ্ণুতা ও সহানুভূতি,
আত্মনিয়ন্ত্রণ ও আত্মনিবেদন,
সম্পর্কে সৌহার্দ্য ও দায়িত্ববোধ,
জীবনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে পরিষ্কার দৃষ্টিভঙ্গি।
ধর্মচর্চা এক ধরনের অন্তরশক্তিকে জাগিয়ে তোলে, যা বাহ্যিক জটিলতাকে সহজ করে দেখতে সাহায্য করে।
আধুনিক জীবনে ধর্মচর্চা প্রয়োজন, কারণ এটি কেবলমাত্র অতীতের সংস্কার নয়; এটি বর্তমানের সংকটময় জীবনের একমাত্র সুশৃঙ্খল, সচেতন, অর্থবহ পথ। বেদের বাণী, পুরাণের প্রতীক, গীতার দর্শন ও মহাপুরুষদের জীবনী এক গভীর অন্তর্জাগরণ ডেকে আনে, যার দ্বারা আধুনিক মানুষ নিজের ভেতর ফিরে যেতে পারে এবং সত্যিকারের শান্তি ও আনন্দ লাভ করতে পারে।
ধর্ম মানে কেবলমাত্র ঈশ্বরের উপাসনা নয়, বরং জীবনের প্রতিটি কর্মে চেতনাসম্পন্ন থাকা, নিজেকে বিশুদ্ধতর করে তোলা এবং এই জগতের কল্যাণে আত্মনিয়োগ করা। তাই আধুনিক মানুষ যদি ধর্মকে নতুন দৃষ্টিতে, গভীরভাবে গ্রহণ করে, তবে সে নিজেকে এবং সমাজকে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যেতে পারে।
এটাই ধর্মচর্চার আধুনিক আবেদন—অন্তর থেকে অন্তরে, মানুষ থেকে মহত্ত্বে।
✍️ রতন কর্মকার
(whatsapp: +8801715982155)
0 Comments