Recent Posts

6/recent/ticker-posts

বেদ-গীতার আলোকে আধুনিক জীবনে কর্তব্য ও ধর্মচর্চা

 



বেদ-গীতার আলোকে আধুনিক জীবনে কর্তব্য ও ধর্মচর্চা


মানুষের জীবনে কর্তব্য এক অন্তর্জাত আহ্বান। এটি বাইরের কোনো নিয়ম নয়, বরং আত্মার গভীরতম স্তর থেকে উদ্ভূত একটি ধ্বনি, যা বলে—"উঠো, জাগো, নিজেকে চেনো, যা করণীয় তা করো।" এই কর্তব্যবোধই হল ধর্ম। আর এই ধর্মের প্রকৃত স্বরূপ বোঝাতে বেদ, উপনিষদ, গীতা ও পুরাণসমূহ যুগ যুগ ধরে আমাদেরকে এক অন্তর্জাগতিক আলোকবর্তিকা দিয়েছে।


বেদের রচয়িতারা কখনও ধর্মকে কোনো দণ্ডনিয়ম বা বিধান হিসেবে দাঁড় করাননি; বরং তারা এটিকে জীবনের অন্তরতম স্বরূপ বলে চিহ্নিত করেছেন। ঋগ্বেদ বলে—"ঋতম্ চ সৎ্যং চ অভিধাৎ তপসোধ্যজায়েত"—অর্থাৎ ঋত (সার্বজনীন নিয়ম) ও সত্য (আত্মার প্রকাশ) উদ্ভূত হয় তপস্যা থেকে। এই তপস্যা মানে শুধু কষ্টসাধ্য সংযম নয়, বরং একটি এমন জীবনযাত্রা, যেখানে নিজের সত্য কর্তব্য নিরূপণ করে তা নির্ভীকভাবে পালন করা হয়।


আধুনিক যুগে কর্তব্য এক বিভ্রান্ত ধারণায় পরিণত হয়েছে। মানুষ কর্তব্য মানে বোঝে কাজের বোঝা, বাহ্যিক দায়িত্ব, সমাজের চাপ। কিন্তু শাস্ত্রীয় দৃষ্টিতে কর্তব্য মানে হচ্ছে নিজের স্বধর্ম অনুসারে আত্মিক বিকাশের পথে থাকা। শ্রীকৃষ্ণ গীতায় বারংবার বলছেন—"স্বধর্মে निधनং শ্রেয়ঃ, পরধর্মো ভয়াবহঃ"—অর্থাৎ নিজের প্রকৃতি অনুযায়ী ধর্ম পালন করাই শ্রেয়, অপরের পথ অনুকরণ করে বাঁচা বিপজ্জনক।


এই “স্বধর্ম” শব্দটি বুঝতে গেলে আত্মাকে জানতে হবে। একজন ব্রাহ্মণের কর্তব্য ও একজন ক্ষত্রিয়ের কর্তব্য এক নয়; একজন যোগীর কর্তব্য ও একজন গৃহস্থের কর্তব্য পৃথক। এই প্রভেদ বাহ্য নয়, এটি অন্তর্জাত। প্রতিটি সত্তার নিজস্ব “ধর্ম” আছে, যেমন অগ্নির ধর্ম জ্বালা, জলের ধর্ম শীতলতা। তেমনই মানুষের ধর্ম হল চেতনা-বিকাশ, আত্ম-সাধনা, অপরের কল্যাণে নিজেকে উৎসর্গ করা।


পুরাণসমূহে আমরা দেখি—প্রত্যেক দেবতারই নিজস্ব কর্তব্যচক্র আছে। ব্রহ্মা সৃষ্টি করেন, বিষ্ণু পালন করেন, রুদ্র সংহার করেন। তারা একে অপরের কর্ম নেন না। প্রতিটি সত্তা তার নিজ নিজ ধর্মে নিষ্ঠ থাকে বলেই সমগ্র সৃষ্টির ভারসাম্য বজায় থাকে। এখানেই এক গভীর শিক্ষার ইঙ্গিত আছে—তুমি যা নও, তা হবার চেষ্টা কোরো না; তুমি যা, সেই সত্তার মধ্যেই সর্বোচ্চ প্রকাশ খুঁজো।


গীতায় এক অদ্ভুত সমতা-চেতনা আছে। শ্রীকৃষ্ণ বলেন—কর্ম করো, কিন্তু ফলের আসক্তি রেখো না। এই কথার মানে কেবল নির্লিপ্ততা নয়, বরং দায়িত্ববোধের গভীর উপলব্ধি। কারণ যদি কেউ ফল চায় বলেই কাজ করে, তবে সে নিজের কর্তব্য নয়, নিজের কামনাকে পূরণ করছে। আর যিনি নিঃস্বার্থভাবে কর্ম করেন, তিনি প্রকৃত কর্মযোগী—তিনি নিজের ভিতরের ধর্ম পালনে ব্রতী।


এই কর্মযোগই আধুনিক যুগে সর্বাপেক্ষা প্রয়োজন। আজ মানুষের জীবনে কাজ আছে, ব্যস্ততা আছে, অর্জন আছে—কিন্তু কর্তব্যবোধ নেই। সে কাজ করে টাকার জন্য, প্রভাবের জন্য, স্বীকৃতির জন্য। কিন্তু তার নিজের আত্মা চুপ করে বসে থাকে, কারণ সে জানেই না কেন সে কাজ করছে। শাস্ত্রের শিক্ষা বলে—যদি কর্তব্য আত্মার সঙ্গে সংযুক্ত না হয়, তবে তা দাসত্ব হয়ে দাঁড়ায়। আর যদি কর্তব্য হয় আত্মাবোধের প্রকাশ, তবে তা মুক্তির পথ।


বেদের ভাষায়—“কর্মণ্যেবাধিকারস্তে” নয় কেবল, বরং “যজ্ঞান্ন্যত্‍ ক্রিয়ো অন্যত্র” (যজ্ঞান্বিত কর্মই শ্রেয়)—এই যজ্ঞ মানে হচ্ছে প্রতিটি কাজকে আত্মার উত্সর্গ হিসেবে দেখা। কৃষক যখন মাঠে কাজ করে, শিক্ষক যখন পাঠদান করে, মা যখন সন্তানকে আহার দেয়—সেগুলো যদি যজ্ঞভাবনায় করা হয়, তবে তা মোক্ষের সোপান। কর্তব্য তখন আর দায় নয়, তা হয়ে ওঠে তপস্যা।


এই তপস্যার একটি মৌলিক দিক হচ্ছে অভ্যন্তরীণ একাগ্রতা। আজ মানুষ বহির্মুখ, তাই কর্তব্যও বিচ্ছিন্ন। সে একদিকে বাবা, একদিকে কর্মচারী, একদিকে নাগরিক, একদিকে ধর্মবিশ্বাসী—কিন্তু তার সমস্ত পরিচয় বিচ্ছিন্ন খণ্ডে বিভক্ত। শাস্ত্র আমাদের শেখায়—এই খণ্ডিত সত্তাকে ঐক্যবদ্ধ করতে হলে প্রতিটি কর্তব্যকেই আত্মজ্ঞানের সাথে যুক্ত করতে হবে। গীতা তাই বলে—“যোগঃ কর্মসু कौशलম্”—যে কাজ আত্মার উপলব্ধিতে রঞ্জিত, সেটাই যোগ।


এইভাবে যখন আমরা কর্তব্যকে পুনরাবিষ্কার করি, তখন বোঝা যায়, আধুনিক জীবনে কর্তব্য মানে কেবল অফিস যাওয়া, বিল জমা দেওয়া, বা সামাজিক অনুশাসন মানা নয়। এটি নিজেকে আত্মিকভাবে বিকশিত করার এক যাত্রা, যেখানে প্রতিটি সম্পর্ক, প্রতিটি ভূমিকা একটি সুযোগ—নিজেকে জানার, নিজের আত্মাকে শুদ্ধ করার।


গীতায় আমরা আরও দেখি—শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে বলেন, “তোমার এখন যুদ্ধ করা কর্তব্য, কারণ তুমি একজন ক্ষত্রিয়, এবং এই ধর্মত্যাগ করলে তুমি নিজের আত্মাকে বিকৃত করবে।” কিন্তু একই গীতায় তিনি বলেন—“সর্বধর্মান্ পরিত্যজ্য, মামেকং শরণং ব্রজ।” এই দুই স্তরের বার্তা একত্রে ধরে নিতে না পারলে মনে হবে বিরোধ। কিন্তু প্রকৃতার্থে প্রথমটি বাহ্য কর্তব্য, দ্বিতীয়টি আত্মার সর্বোচ্চ কর্তব্য। একজন মানুষকে তার ভূমিকা অনুযায়ী কাজ করতে হয়, কিন্তু সেই কাজের অন্তরে যদি পরমার্থবোধ না থাকে, তবে তা তাকে পূর্ণতা দেয় না।


এই দ্বৈত সত্তা—বাহ্য কর্তব্য আর অন্তর্জাগতিক কর্তব্য—আধুনিক মানুষের সবচেয়ে বড় দ্বন্দ্ব। সে চায় মুক্তি, আবার সে সংসার ছাড়তে পারে না। এইখানেই বেদ ও গীতার মেলবন্ধন ঘটে। বেদ বলে—“সহ নَو यशঃ”—আমরা একসাথে উন্নতি লাভ করি। গীতা বলে—“লোকসংগ্রহার্থং”—সমাজের মঙ্গলের জন্য নিজের কর্তব্য পালন করো।


আজকের যুগে একেকজন মানুষ একেক পেশায় যুক্ত, কিন্তু তার অন্তরে যদি কর্তব্যবোধের শিখা না জ্বলে, তবে সে কেবল শ্রমিক, সে সাধক নয়। ধর্ম মানে চাকরি নয়, ধর্ম মানে সাধনা। এই সাধনার ক্ষেত্র সব জায়গা হতে পারে—রান্নাঘর, অফিস, ক্ষেতখামার, আদালত, রাজনীতি—যদি তা অন্তর থেকে আসে।


এই আত্মনিষ্ঠ কর্মই হল “ধর্ম”। শাস্ত্র বলছে না—সবাই তপস্বী হও, সবাই গুহায় যাও। বরং বলছে—যেখানে আছো, যেভাবে আছো, নিজের কর্তব্য পালন করো এই অনুভবে যে তুমি ঈশ্বরের হাত। এই অবস্থায় দাঁড়িয়েই গীতা বলে—“মাম অনুস্মর যুদ্ধ্য চ”—অর্থাৎ আমায় স্মরণ করে যুদ্ধ করো। এই বাক্যটি আধুনিক মানুষের জন্য পথনির্দেশ: জীবনযুদ্ধে লিপ্ত থেকেও আত্মস্মরণে থাকো। তাহলেই জীবন পূর্ণ, কর্তব্য পবিত্র।


এভাবেই, বেদ ও গীতার সমন্বয়ে কর্তব্য একটি দ্বৈত সেতু রচনা করে—যার এক প্রান্তে রয়েছে বাহ্যিক দায়িত্ব, আর অপর প্রান্তে রয়েছে আত্মার মুক্তি। এই দুইকে একত্র করে নেওয়াই আধুনিক মানুষের সবচেয়ে বড় সাধনা।


✍️ ব্যাখ্যাঃ রতন কর্মকার

(whatsapp: +8801811760600)

Post a Comment

0 Comments