Recent Posts

6/recent/ticker-posts

যোগীরাজ শ্যামাচরন লাহিড়ী M P 5

 



যোগীরাজ শ্যামাচরন লাহিড়ী 

তিনি যে অমূল্য যোগ সাধন লাভ করেছিলেন তাঁর গুরুর নিকট হতে এবং তিনি যা জগৎকে প্রদান করেছিলেন সেসব অনুভবের বিষয়, অনুমানের নয়। এখানে পান্ডিত্য ব্যতীতও আরো অনেক কিছুর অবকাশ আছে। যদি কেউ মূক হয় , যদি কেউ বধির হয় সেও আধ্যাত্মিক  সেও আধ্যাত্মিক রাজ্যে প্রবেশ করতে পারে এবং প্রত্যক্ষ অনুভূতির মাধ্যমে ঈশ্বর তত্ত্বকে সবকিছু দেখতে শুনতে বা  বুঝতে পারে এতে কোন সন্দেহ নেই ।

হাজার হাজার বছর পূর্বে ত্রিকালজ্ঞ মুনি-ঋষিরা যে সাধন পথ দেখিয়েছিলেন কাল ক্রমে তা লুপ্তপ্রায় হয়ে যায়। কিছু সাধনের প্রণালীর বীজ মন্ত্র রক্ষা করা আছে। কিন্তু কালক্রমে সাধনের সেই ক্রিয়াগুলি লুপ্ত হয়ে গেল এবং বীজ মন্ত্র গুলি রয়ে গেল। সাধনের ক্রিয়াগুলি লুপ্ত হওয়ায়  বীজ মন্ত্র গুলি মৃতবৎ নিষ্ক্রিয় হয়ে গেল সেদিকে কারও লক্ষ্য রইল না। সেই ক্রিয়াহীন বীজ মন্ত্রগুলি বর্তমানে গুরু-শিষ্যের কানে দেন। তাহলেই দীক্ষা হয়ে যায়। ক্রিয়া-প্রক্রিয়াগুলির পরিচয়  না থাকায়  না হয় , না হয় শিষ্যের উপকার না হয় গুরুর উপকার। 

গীতায় বলা হয়েছে – 

 ন তদ্ভাসয়তে সুর্য্যো ন শশাঙ্কো ন পাবকঃ। 

যদগত্বা ন নিবর্তন্তে তদ্ধাম পরমং মম। । 

ওই যে একটা কথা আছে না – 

কান ফুকনে কা গুরু আউর হ্যায়,

বেহদ কা গুরু আউর;

বেহদ কা গুরু যো মিলে ,

পঁহুচা দেওয়ে ঠৌর।


এই সব “মম” , “ধাম” এই সকল শব্দগুলি র নিগূঢ় অর্থ বুঝিয়ে ছিলেন তিনি। হ্যাঁ , তিনি আর কেউ নন । তিনি হলেন যোগিরাজ শ্যামাচরণ লাহিড়ী। এসব অর্থ একমাত্র প্রত্যক্ষদর্শী সাধু ব্যতীত কে বোঝাতে পারেন।  মহাভারতের যুদ্ধ আঠারো দিনে সমাপ্ত হয়েছিল , কিন্তু প্রবৃত্তি এবং নিবৃত্তি এই দুই পক্ষের যুদ্ধ আদি অন্তত কাল ধরে চলছে  , চলবে। এ জন্মজন্মান্তরেও শেষ হবার নয়। তবে এর নিষ্পত্তি হবার উপায় কি ? সেই উপায়ের জন্য যে সাধন পথ বা কর্ম্মযোগ অবলম্বন করলে উহার নিষ্পত্তি হতে পারে তা লাহিড়ী মহাশয়আপন গুরুর নিকট হতে জেনে জগৎকে প্রদান করেছেন।এই প্রবৃত্তি ও নিবৃত্তি পক্ষের যুদ্ধ সকলের মধ্যে চলছে । যদি প্রবৃত্তি পক্ষ জয়ী হয় তবে মহামূল্যবান মনুষ্য জীবন বিফল হবে এর যদি নিবৃত্তি পক্ষ জয়ী হয় তবে মনুষ্য জীবন সফল হবে। প্রবৃত্তি অর্থাৎ বহু কিছুর চাহিদা এবং নিবৃত্তি অর্থাৎ জীবনে বেঁচে থাকার জন্য যেটুকু প্রয়োজন হয়। তাই , দুর্যোধন সুচাগ্র মেদিনীও বিনা যুদ্ধে দিতে চান নি আর পাণ্ডবরা  স্বতন্ত্র  অধিকারে পাঁচটি গ্রাম চেয়েছিলেন।  অর্থাৎ একপক্ষ আসক্ত , অন্য পক্ষ অনাসক্ত।

সকল বিষয় এই রকম অনাসক্ত না হতে পারলে সাধনায় জয়ী হওয়া যায় না।  “আমি অনাসক্ত”, এই কথা মুখে বললেই তো হয় না। তাকে হৃদয় থেকে হতে হয়। হৃদয় , মন চঞ্চল হলেই আসক্তির উৎপত্তি হয়। তাই মনকে যদি মনঃশূন্য করতে পারলে তবেই মুক্তি। তার উপায় বা সাধন কৌশল গীতাতে এবং পাতঞ্জল যোগদর্শনে পরিষ্কার ভাবে ব্যাখ্যা করা আছে। কিন্তু বর্তমানে সাধন কৌশল দেখবার লোকের বড় অভাব। এই সকল শাস্ত্রগ্রন্থগুলির ব্যাখ্যা বা টীকা অনেক বড় বড় বিদ্বান বা পন্ডিত গন করেছেন। দার্শনিক ব্যাখ্যা , বুদ্ধিগত ব্যাখ্যা প্রভৃতি অনেক আছে কিন্তু সাধনের দ্বারা প্রত্যক্ষ , কিন্তু সাধনের দ্বারায় প্রত্যক্ষ অনুভবগত বা উপলব্ধিগত ব্যাখ্যা কেউ করেন নি। যে সকল মহাপুরুষ বা মহাযোগিগণ একল কে অনুভব করেছিলেন হয়তো তাঁরা এই কারণেই এসবের আভাস দেননি কারণ তাঁরা মনে করেছিলেন যে , কেবলমাত্র মুখে বা লিখে বললে কে বুঝবে এসব ? নিজে কোনোদিন চিনি না খেয়ে অপরের কথা শুনে চিনির মিষ্টত্বকে কি উপলব্ধি করা যায়। ফলত, কালক্রমে এই বিজ্ঞান সম্মত সাধন কৌশল লুপ্ত হবার উপক্রম হল। 


লাহিড়ী মহাশয়ের গুরুদেব ( যাঁকে তিনি বাবাজী বলতেন এবং তাঁর স্বহস্ত লেখা দিন লিপিতে কেবল বাবাজী এই মাত্র লেখা ব্যতীত আর কোনো উল্লেখ প্রাপ্ত হয় না) তাঁকে রাণীক্ষেত  নিয়ে যান এবং দীক্ষা দান করেন। দীক্ষা প্রাপ্তির পর যখন লাহিড়ী মহাশয় কাশীতে ছিলেন তখন তিনি তাঁর গুরুদেবের সঙ্গে আধ্যাত্মিক আলোচনা হতো তা তাঁর দৈনিক ডায়েরি থেকে প্রাপ্ত হয়। লাহিড়ী মহাশয় তাঁর গুরু বাবাজীর নিকট থেকে সেই বিজ্ঞানসম্মত সাধন কৌশল যা প্রায় লুপ্ত হয়ে এসেছিল তা তিনি পুনরায় পেয়ে জগৎকে দিলেন।

সাধারণত দেখা যায় বেশিরভাগ লোক হঠযোগ অভ্যাস করে । আসনাদি করেই মনে করে যোগাভ্যাস করছে। এগুলিতে শারীরিক উপকার অবশ্যই হয় , কিন্তু এই উপায়ে শরীরস্থ আত্মার কোনো সন্ধান প্রাপ্ত হয় না এবং মনও স্থির হয়ে না। আবার মন স্থির না হলে সাধন রাজ্যে প্রবেশ করা যায় না । মন স্থির করার জন্য রাজযোগের প্রয়োজন। কেবল মন স্থির হলেও হবে না । মনের চঞ্চলতা অনেকটা কমে গেলেও হবে  না। , যতক্ষণ পর্যন্ত আত্মসাক্ষাৎকার না হচ্ছে , ব্রাহ্মীস্থিতিলাভ না হচ্ছে , ভ্রূমধ্য স্থলে কূটস্থচৈতন্যর দর্শনলাভ না হচ্ছে , ততক্ষণ পর্যন্ত মনুষ্য জীবন সফল হল না। 

ভ্রুবোর্ম্মধ্যে প্রাণমাবেশ্য সম্যক্।

স তং পরং পুরুষমুপৈতি দিব্যম্।।

এরজন্য চাই রাজযোগ , হঠযোগ এবং লয়যোগের একত্র সমাবেশ । রাজযোগের  দ্বারা মন স্থির হবে , লয়যোগের দ্বারা আত্মসাক্ষাৎকার হবে এবং এইসব সাধন করার জন্য শরীরে যে ক্লান্তি উপস্থিত হয় তা দূর করবার জন্য হঠযোগ আবশ্যক। 

ঈশ্বরকে আমরা স্বর্গে খুঁজি , এখানে খুঁজি ওখানে খুঁজি, কিন্তু তিনি যে এই জগৎ সংসারের প্রতিটি কণায় , প্রতি শক্তিতে এবং আপন দেহের ভ্রূমধ্যস্থলে সদা বিরাজমান তার সন্ধান জানি না। এই পরমাত্মা পরমব্রহ্মকে সাধনার কথা সকল ত্রিকালজ্ঞ ঋষিগণ বলে গেছেন। সমস্ত ইন্দ্রিয়দ্বার বলপূর্বক রুদ্ধ করে মনকে চারিদিক থেকে গুটিয়ে এনে ভ্রুমধ্যে স্থাপন করে গুরু নির্দিষ্ট পথে অভ্যাস করতে করতে সেই অবিজ্ঞেয় আত্মাকে দর্শন করে সাধক কৃত কৃতার্থ হন । তাঁকে দর্শন করে জন্ম সফল করেন। এই পরমাত্মাকে যিনি দর্শন করেন তাঁর আর জন্ম হয় না। ওই বলে – 

রথে চ বামনং দৃষ্টা পুনর্জন্ম ন বিদ্যতে ।


মরতে মরতে জগ মরা ,

মরনা না জানা কোয়।

এয়সা মরনা কোই না মরা,

জো ফির না মরনা হোয়।।

মরনা হ্যায় দুই ভাঁতি কা,

জো মরনা জানা কোয়।

রামদুয়ারে জো মরে

ফির না মরনা হোয়।।

হ্যাঁ, সেই মৃত্যু অসাধারণ মৃত্যু যা #রামদুয়ারে হয়। সেই রামদুয়ার কি তা লাহিড়ী মশায় ব্যাখ্যা করেছেন। দেহের মধ্যেই পরমাত্মা স্বরূপ থাকেন রাম। সেই রামকে প্রাপ্ত করতে হয়। সেই রামের শক্তি হলে কুলকুন্ডলিনী স্বরূপ মা সীতা। এই দুয়ের মিলনের জন্য সাধনার মাধ্যমে দেহের অভ্যন্তরে বহু যুদ্ধ করতে হয় ।  এই দুই মিলে গেলেই যে পরমব্রহ্ম দর্শন ঘটে তাই হল রাম প্রাপ্তি।  এই দর্শন এই প্রাপ্তি নির্বাণ ঘটায়। একে একদিনের চেষ্টায় লাভ করা যায় না।  সকল জীবনের যোগসাধনায় তা প্রাপ্ত হয় । 

লাহিড়ী মহাশয় আধ্যাত্মিক রাজ্যে প্রবেশের যে পথ দেখিয়েছেন ইদানিংকালে কেউ তেমন করে দেখান নি।


যা হোক , অনেক ভারী ভারী কথা বললাম।  যোগিরাজ শ্যামাচরণ লাহিড়ী মহাশয়ের জীবনের কিছু কথা বলি – 

ধুতি ,পাঞ্জাবি , জুতো পরা টেরিকাটা অফিসের বাবুটি যোগীরাজকে চিনতে মানুষের অনেক সময় লেগেছিল। তাঁর যাপিত জীবন ছিল অতীব সাদাসিধে। ধুতি ,পাঞ্জাবী , ফিতে দেওয়া কাপড়ের জুতো এবং বাড়িতে তিনি খড়ম ব্যবহার করতেন। সম্পূর্ণ নিরামিষাশী লাহিড়ী মহাশয় পাঁচ ফুট চার ইঞ্চি উচ্চতার হলেও তাঁর বিশালত্ব এতই ছিল যে সকলে তাঁর নিকট মাথানত করে দাঁড়াতেন। 


১৮৮৫ সালে কর্মে অবসর নিয়ে কাশীবাসী হন। ততদিনে সমাজে তাঁর যোগীরাজ বা কাশীবাবা নাম খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছে। কেবল নানা প্রদেশের গৃহীভক্ত নন তাঁর সান্নিধ্যে আসতেন বহু সন্ন্যাসী সম্প্রদায়।  তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন  – উত্তরকালেরর দেওঘরের শ্রীমৎ বালানন্দ ব্রহ্মচারী , কাশীর ভাস্করানন্দ স্বরসতী প্রমুখ।কাশীর নরেশ ঈশ্বরীনারায়ণ সিংহও ছিলেন তাঁর শরনাগত। জীবনের শেষ দশটা বছর অসংখ্য অলৌকিক লীলার মধ্যে পরিবেষ্টিত হয়ে তিনি কাশীর গৌড়েশ্বর মহল্লায় থাকতেন বলে জানা যায় । এখানেই তাঁর অত্যন্ত অন্তরঙ্গ শিষ্য ছিলেন যুক্তেশ্বর। কিংবদন্তি আছে যে একদিন যুক্তেশ্বর তাঁর বন্ধু রামের অসুস্থতার কথা শুনে কান্নাকাটি জুরে দিলেন গুরুদেবের নিকট।  গুরুদেব বললেন ডাক্তার দেখাও। বাড়ি ফিরে যুক্তেশ্বর ভেঙে পড়লেন। রাম মৃত্যুপথযাত্রী স্বরে বললেন, ” ভাই গুরুদেবকে বল – আমি চললুম ।”

একথা শুনে যুক্ত ছুটে চললেন লাহিড়ী মহাশয়ের কাছে। যুক্তকে দেখেই যোগিরাজ প্রশ্ন করলেন,  কি খবর? তোমার সখা এখন কেমন আছে বল? ” কান্নায় ভেঙে পড়ে যুক্তেশ্বর বন্ধুর শেষ কথাটি বললেন । শোনা যায় সে যাত্রায় নাকি অদ্ভুতভাবে যুক্তেশ্বরের বন্ধু রাম বেঁচে গিয়েছিলেন এবং সোজা চলে এসেছিলেন গুরুদেবের নিকট প্রণাম জানাতে । হতে পারে অলৌকিকত্ব হতে পারে মনের বিশ্বাস ; সেই বিশ্বাসই হয়তো দেহের মধ্যে সঞ্জীবনী সুধার সৃষ্টি করেছিল। প্রসঙ্গত এই স্বামী যুক্তেশ্বরের প্রকৃত নাম ছিল প্রিয়নাথ কড়ার। তিনি যোগীরাজের অন্যতম প্রিয় শিষ্য ছিলেন। 


এমনই অসংখ্য অলৌকিক ঘটনা যোগিরাজ শ্যামাচরণ লাহিড়ীর জীবনীকারদের কলমে পাওয়া যায় । তাঁর জীবনী যাঁরা ব্যাখ্যা করেন তাঁদের মধ্যে শ্ৰী সত্যচরণ লাহিড়ী ছিলেন অন্যতম। তাঁর কথা এবং আরো নানা কিংবদন্তি থেকে জানা যায় যে , যোগীরাজের জীবনের নানা ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন প্রচুর । তবে কেউই সহজভাবে গোড়ায় এসে এসব কথা মানতে চাননি । অবশ্য এগুলোকে তো কোনোদিন যোগীরাজ মানতে বলেননি। কারণ তিনি নিজে বৈজ্ঞানিক যৌগিক পন্থায় বিশ্বাস করতেন। তিনি তাঁর স্বকীয় ধারায় অবলীলায় জাগতিক সমস্ত যুক্তি তর্ক খন্ড বিখন্ড করে গিয়েছেন বারবার ।

যোগসাধনায় কতটা পারঙ্গম হলে তবে অবিদ্যা স্বরূপ মায়ার জগৎকে সংসারের মধ্যেই ত্যাগ করে বিদ্যা স্বরূপ মহামায়াকে গ্রহণ করে এমন লৌকিকে অলৌকিক খেলা যায় ? এমন কি করেছিলেন তাঁর ৬৭  বছরের লীলার মধ্যে? সে প্রশ্ন সমাধানে ফিরে যেতে হয় আজ থেকে প্রায় একশ সাতান্ন বছর আগে , ১৮৬১ খ্রিস্টাব্দে ।

তখন চাকরি উপলক্ষে শ্যামাচরণ লাহিড়ী রাণীক্ষেতে । সেখান থেকে দ্রোণগিরি ১৫ মাইলের পথ।একদিন সেখানে বেড়াতে এসে জীবনের পট পরিবর্তন হল তাঁর।

সেই  অপরিচিত তুষার রাজ্যে তাঁর নাম ধরে ডাক পড়ল – “শ্যমাচরণ” । চোখে পরলো কাছেই দাঁড়িয়ে আছেন এক জটা জুটোধারী তেজদীপ্ত সন্ন্যাসী। সেই জ্যোতির্ময় পুরুষ এগিয়ে এসে শ্যামাচরণকে ধরলেন । একে একে লাহিড়ী মহাশয়ের পিতৃপুরুষের নামধাম জানিয়ে বললেন “ভয় কি ? জেনো আমি তোমার আপনজন । আমি তোমাকেই ডাকছিলাম।  এখন এসে গেছ..”

সন্ন্যাসীর মুখে  তখন অন্তরঙ্গ হাঁসি। সস্নেহে শ্যামাচরণকে তিনি একটি গুহা নিয়ে  গেলেন। সেখানে পড়েছিল দণ্ড ,কুমন্ডল, ধুনী ইত্যাদি। গুহার মধ্যে শ্যামাচরণ স্বল্প আলোয় সেসব দেখতে পেলেন। যোগী পুরুষ প্রশ্ন করলেন “কিগো ? কিছু চিনতে পারছো?  এসব তো তোমার ব্যবহারের জিনিস ? আগের জন্মে ব্যবহার করতে মনে নেই ?” লাহিড়ী মহাশয় খুব চেষ্টা করলেন স্মৃতি রোমন্থন করার। কিন্তু স্মৃতিতেই কিছু আসে না । কিংবদন্তি আছে গুরুদেবই তাঁর যোগবলে লাহিড়ী মহাশয়ের পূর্বজন্ম স্মৃতির কথা মনে পড়িয়ে ছিলেন। গুরুদেবকে চিনতে পেরে লাহিড়ী মশাই সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করলেন।   গুরুদেব জানালেন , ” পূর্বজন্মের সাধনার  সমুন্নত অবস্থায় তোমার দেহত্যাগ হয়। এ জন্মে ঈশ্বর নির্দিষ্ট কিছু কাজ সম্পাদনের জন্য আবার এসেছো। এখন আমি তোমায় দীক্ষা দেবো। “


কিন্তু গুরু শিষ্য সংযোগ বেশিদিন থাকল না।  সেই দিনই গুরু জানিয়ে দিলেন , ” ৭ দিনের মধ্যে তোমায় দানাপুর ফিরতে হবে – কর্মস্থল থেকে চিঠি পাবে । ” তাই হল… তবু মাঝের কটা দিন রাণীক্ষেত নিজের তাঁবু উঠিয়ে এনে দ্রোণগিরিতেই বাবাজির কাছাকাছি তাঁবু গাড়লেন তিনি এবং সেখান থেকেই চাকরির কাজকর্ম চালাতে লাগলেন। ক্রমে দীক্ষার দিন ঠিক হলো।  গুরুদেব লাহিড়ী মহাশয়কে এক ঘটি তেল জাতীয় পানীয় দিয়ে পানের আদেশ দিলেন ।  লাহিড়ী মহাশয় সেটি পান করে গুরুদেবের নির্দেশের নদীর তীরে চলে এলেন। সঙ্গে সঙ্গে ভেদবমি শুরু হলো। ভীষণ অসুস্থতার মধ্যে নদীতে জোয়ার এলো। 

 কোনোও ক্রমে যমের সঙ্গে লড়াই করে জীবনটুকু সঙ্গে নিয়ে পরদিন ফিরলেন গুরুদেবের নিকট। গুরুদেব তাঁকে দেখে খুশি হয়ে ভালো-মন্দ খাওয়ালেন । সেদিন সন্ধ্যায় তাঁর দীক্ষা হলো।  বাকি দিন গুলোয় গুরুদেবের অকৃপণভাবে তাঁর সর্বস্ব বিদ্যা শক্তি অর্পণ করেছিলেন আর আত্মনিবেদিত শ্যামাচরণ সমস্ত গ্রহণ করেছিলেন ঐতান্তিক নিষ্ঠায় । অল্পদিনের  মধ্যেই তিনি বিপুল যোগ ঐশ্বর্যের অধিকারী।


সেই বিরাট যোগিকে বাহির হতে চেনা বড় কঠিন ছিল। তাঁর বৈশিষ্ট্য হল শত সহস্র বৎসরের সাধনার ফলে প্রাপ্ত সেই স্তরে অধিষ্ঠান করেও ভর্তি সংসার। এই যে তিনি অবিদ্যা স্বরূপ মায়ার সংসারে ছিলেন , সত্য হল তাঁর প্রকৃত সত্তায় সেই মায়ার সংসার ছিল না। ছিলেন কেবল বিদ্যা স্বরূপ মহামায়া। তাঁর সেই বিদ্যার সেবায় অবিদ্যার সংসার কৃতার্থ হয়েছিল। সাধে কি ত্রৈলঙ্গ স্বামী একদিন তাঁকে জড়িয়ে ধরে বলেছিলেন – “সাধনার যে স্তরে পৌঁছনোর জন্য সাধককে তাঁর কৌপীন পর্যন্ত ত্যাগ করতে হয় , তুমি গৃহস্থ আশ্রমে থেকেও সেই স্তর লাভ করেছ । এ বড় সহজ কাজ নয়। ” 


এরপর  আস্তে আস্তে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের সাধারণ সাধক থেকে আরম্ভ করে সাধু , মুমুক্ষু , শরণার্থীর সংখ্যা বাড়তে লাগল ক্রমশ। তিনি সাধনাহীন শূন্য গর্ভ আলোচনায় একেবারেই উৎসাহী ছিলেন না। আসন , প্রাণায়ম, ধ্যান ইত্যাদি যৌগিক ক্রিয়াদির উপর তিনি গুরুত্ব দিতেন। ” প্রকৃত অনুভূতি ও ঈশ্বর লাভ ই একমাত্র কাম্য ” – এই ছিল তাঁর বাণী। সর্বভূতে যে মহাচৈতন্য বিধৃত , যোগিরাজের অনুভূতি তাতে অন্বিত  হয়ে গিয়েছিল। সকলের ডাকে সাড়া দেওয়ার সময় স্থূল দূরত্ব ব্যবধান সৃষ্টি করতে পারেনি কোনোদিনও। তিনি যেখানেই থাকুন সুদূরবর্তী বিশ্বাসী দুঃখ সুখের দিনে তাঁকে নিকটে পেয়েছেন। 

কথিত আছে , চন্দ্রমোহন তখন নতুন ডাক্তার হয়েছেন। মুখে অনেক বিজ্ঞানের কথা । যোগিরাজ একটু কৌতুক করে বুঝিয়ে দিলেন – ” যোগ বিজ্ঞান, আধ্যাত্মিক বিজ্ঞানের নিকট তোমার মৌখিক বিজ্ঞান বিকল।” তারপর লাহিড়ী মহাশয় চন্দ্রমোহনের হাতে তাঁর শরীরটি ছেড়ে বললেন – ” আমি মৃত না জীবিত নির্ণয় করো। ” সুস্থ স্বাভাবিক একটি দেহে বিজ্ঞানসম্মত ভাবে প্রাণের অস্তিত্ব না পেয়ে চন্দ্রমোহন কেবল বিস্মিত হলেন না ,শ্রদ্ধায় তাঁর মাথা নত হয়ে গেল। 


আরো শোনা যায় , একবার খুব জোরাজুড়ি করায় তিনি ছবি তুলতে রাজী হলেন। কিন্তু তাঁর হঠাৎ মনে হল বাক্স বন্দী হবার পূর্বে একবার বাক্সটি কতটা বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা করে দেখা যাক। উৎসাহের সঙ্গে ক্যামেরার ব্যাপারে তিনি অনেক কিছু জানলেন। তারপর হঠাৎ ভিউফাইন্ডারে তাঁকে খুঁজে পাওয়া গেল না। সবাই ক্যামেরায় আসছেন কিন্তু যোগিরাজ নেই। অথচ খালি চোখে তাঁর স্থূল শরীর দেখা যাচ্ছে। সাহেব ক্যামেরা ম্যানের চাতুরী শেষ। মিটি মিটি হেঁসে লাহিড়ী মহাশয় বললেন , ” কীগো ? কী হলো তোমাদের বৈদেশিক বিজ্ঞানের ?”  সবাই নিরুত্তর । কোনওক্রমে সেদিন যে ছবিটি তোলা হয়েছিল সেটিই আজ সর্বজন পরিচিত। 

এসব শুনে কাশীমণি দেবীর ভয়ে মূর্ছা যাওয়ার মতো অবস্থা। যদিও স্বামী সম্পর্কে বহু বহু অলৌকিক কথা তিনি শুনতে পেতেন , তবু সারাদিন স্বাভাবিক জীবনের কথা বার্তায় তাঁকে অন্যভাবে দেখতে কাশীমণি দেবীর একেবারে ইচ্ছে করত না। এসব অতিলৌকিক ব্যাপারে তৈরি ছিলেন না। স্বামীর অলৌকিকত্বের প্রতি শ্রদ্ধা থাকলেও তাঁর বিস্ময় ভক্তিতে রূপান্তরিত হতে সময় লেগেছিল। 

যোগিরাজ শ্যামাচরণ লাহিড়ীর দুই পুত্র এবং তিন কন্যা ছিল। যে সময়ের কথা বলছি সে সময়ে তিনি সকল যোগ গুণ এবং ফল লাভ করেছেন।  পুত্রদের নাম ছিল যথাক্রমে – তিনকড়ি লাহিড়ী ও দুকড়ি লাহিড়ী এবং কন্যাদের নাম ছিল যথাক্রমে – হরিমতী , হরিকামিনী, হরিমোহিনী।  একদিন বিবাহিতা মধ্যমা কন্যা হরিকামিনী বাপের গৃহে আসলেন। সহসা কন্যাটি এশিয়াটিক কলেরায় আক্রান্ত হলেন । কাশীমণি দেবী এসে যোগিরাজের পায়ে পড়লেন , ” ওগো, মেয়েটিকে বাঁচাও। যাহোক কিছু করো। তুমি থাকতে অমন মেয়েটা চলে যাবে ?” যোগিরাজ কিছু আয়ুর্বেদিক ঔষধ দিলেন। কিন্তু বিনাশ কালে বিকৃত বুদ্ধি । কাশীমণি ভাবলেন পরের ঘরের বউ এসব ছাইপাঁশ খাইয়ে কি লাভ ? সেই আয়ুর্বেদিক ঔষধ ফেলে দিয়ে বড় ডাক্তার ডেকে আনা হলো। কিন্তু পরের দিন মেয়ে হরির প্রিয় হয়ে গেলেন। এতসব ঘটল যোগিরাজ নিশ্চল, নিরুদ্বিঘ্ন হয়ে রইলেন। 

অন্যান্য দিনের ন্যায় সেদিনও বৈকালে তিনি গীতার ব্যাখ্যা করছেন। পন্ডিত পঞ্চানন ভট্টাচার্য গীতার মূল শ্লোক পাঠ করছেন। অনেকে সেই পাঠ শুনতে এসেছেন। এমন সময় উপরের ঘরে থেকে ক্রন্দনের রোল উঠল।  কি কারণ এমন মরা কান্নার?

শান্ত কন্ঠে যোগিরাজ বললেন – ” মেয়েটিকে আর ধরে রাখতে পারল না। তাই সকলে কাঁদছেন। বোধয় শ্মশান যাত্রীরা এসেছেন। “

ভট্টাচার্য মহাশয় গীতাখানা বন্ধ করে বললেন , ” আজ তবে থাক।” 

যোগিরাজ শান্ত গম্ভীর কন্ঠে বললেন -” ওদের কাজ ওরা করুক, তোমাদের কাজ তোমার করো।”

উপস্থিত জনরা বললেন,” না , আজ আর এই অবস্থায় কোনো ব্যাখ্যা বুঝতে পারব না।”

যোগিরাজ বললেন , ” তবে থাক।”

পরদিন , যোগিরাজের শ্যালক রাজচন্দ্র স্যান্যাল মহাশয় এসে তাঁকে প্রশ্ন করলেন – ” প্রিয়জন বিয়োগে যে দুঃখ সাধারণ মানুষের হয় তা কি তোমার হয় ? হলে কালকে…”

যোগিরাজ স্মিত হাস্যে বললেন ,- ” দুঃখ তো সকলেরই হয়, তবে জ্ঞানী ব্যক্তির কিছু পার্থক্য থাকে। যেমন – শক্ত পাথরে গুলি করলে গুলি ছিটকে যায় কিন্তু নরম মাটিতে তা গেঁথে বসে; তেমন জ্ঞানী মানুষের কাছে দুঃখ, শোক, তাপ এসে আঘাত করতে পারে না , অমন ছিটকে যায়। কারণ মৃত্যু নিত্য ….অজ্ঞানী কেবল সেই আঘাতে হায় হায় করে। “

ওই যে বলেছিলাম অবিদ্যা মায়ার সংসার তাঁকে পাশে বাঁধতে পারেনি। মহামায়ার বিদ্যাই তাঁর সব ছিল। পদ্মপত্রে জলবিন্দুর সংসারে বাস করেও তিনি গৃহীযোগী ছিলেন। অনায়াসে সকল দুঃখ কষ্ট শোকে নির্লিপ্ত থাকতেন। 

 গীতায় আছে – 

যং হি ন ব্যথয়ন্ত্যে পরুষং পুরুষর্ষভ।

সমদুঃখসুখং ধীরং সোহমৃতাত্বায় কল্পতে।।

দুঃখতাপে ব্যথিত চিতে

নাই বা দিলে সান্ত্বনা,

দুঃখে যেন করিতে পারি জয়।

সহায় মোর না যদি জুটে

নিজের বল না যেন টুটে,

সংসারেতে ঘটিলে ক্ষতি

লভিলে শুধু বঞ্চনা

নিজের মনে না যেন মানি ক্ষয়।

যোগিরাজ প্রতিদিন বৈকালে গঙ্গার তীরে রানামহলঘাটে ভ্রমণে যেতেন। সেখানে গঙ্গাতীরে ভক্ত কৃষ্ণারামের আস্তানা ছিল । যোগিরাজ কিছুক্ষণ ভ্রমণ করে কৃষ্ণারামের বারান্দায় বসে গীতা সম্বন্ধে নানা আলোচনা করতেন। তারপর সন্ধ্যার পূর্বে বাড়ি ফিরে বৈঠকখানা ঘরে বসে গীতা সম্পর্কে নানা উপদেশ দিতেন । রাত্রি নটা বাজলে কথা শুনতে আসা জনসাধারণ চলে যেতেন। এভাবে যখন তিনি বৈঠকখানা ঘরে বসে জনগণকে গীতার নানা কথা শোনাতেন তখন কোন কোনো কোনো সময় দেখা যেত, তিনি হঠাৎ হঠাৎ  হাত জোড় করে কপালে হাত ঠেকিয়ে প্রণাম করতেন।

বৈঠকখানায় থাকা লোকজন, ভক্তবৃন্দ এক আধবার জিজ্ঞাসা করতেন, ”  কেন ? কেন আপনি মাঝে মাঝে এমন করেন? “। উত্তরে যোগিরাজ স্মিত হাঁসতেন।  কাকে প্রনাম করতেন তা ঘরে উপস্থিত লোকজন বুঝতে পারতেন না । সবসময় জিজ্ঞাসা করবার সাহস হতো না।  তাদের মধ্যে কেবল কৌতূহল জাগত।  একদিন যখন তিনি প্রণাম করলেন, সাথে সাথে একজন গিয়ে ঘরের বাইরে দেখলেন কোন এক জনৈক ব্যক্তি যোগীরাজের উদ্দেশ্যে বারান্দায় সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করছেন । আর যোগিরাজ সেই প্রণাম গ্রহণ করছেন ঘরের ভিতরে হতে । কিন্তু অবাক ব্যাপার , ঘরের ভিতর হতে তা দেখবার কিন্তু কোন উপায় ছিল না। এভাবে বাইরে হতে যখনই কেউ তার উদ্দেশ্যে প্রণাম করতেন, তিনিও তাঁর প্রত্যাভিবাদন করতেন। এমনকি বহু দূরে কেউ তাঁকে প্রণাম করলে, তিনি প্রত্যাভিবাদন দিতেন। নিকট ও দূর , ভিতর ও বাহির সকলই তাঁর নিকট  স্বচ্ছ হয়ে গিয়েছিল। সকলের মাঝেই তিনি এককেই দেখতেন। 

এসব তো গেল বিশ্বাসীদের কথা। একটু অবিশ্বাসীদের কথা বলি। তাঁর জীবনে অনাচারী , অবিশ্বাসী মানুষের আগমনও কিছু কম ছিল নক। তাঁদেরও তিনি উচিৎ শিক্ষা প্রদান করতেন। এমনি একজন অবিশ্বাসীকে তিনি সেবার উচিৎ শিক্ষা দিয়েছিলেন। কালীকুমারের সঙ্গে দুষ্ট লোকটি এসেছিল লাহিড়ীমহাশয়কে পরীক্ষা করতে। ইচ্ছা ছিল ভন্ড প্রতিপন্ন করে তিনি খুব তারিফ অর্জন করবেন । কিন্তু লোকটি যে ছাইচাপা আগুনে হাত দিয়েছিলেন।  তাই ভুগতে হয়েছিল ষোলোআনা। তিনি ঘরে ঢুকতেই শ্যামাচরণের নির্দেশে ঘর অন্ধকার করা হলো। সবার সামনে এক তরুণীর আবির্ভাব হলো । শ্যামাচরণ দুষ্ট লোকটিকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ” দেখুন তো একবার এই মাকে চিনতে পারছেন কিনা? ” ভদ্রলোক লজ্জায় অধোবদন স্বীকার করলেন যে, এই মেয়েটিই তাঁর উপপত্নী। বাড়িতে স্ত্রী-পুত্রকন্যাদিতে ভরা সংসার । তবু তিনি এই মহিলার পিছনে বহু অর্থ দীর্ঘদিন ধরে ব্যয় করে চলেছেন। পরীক্ষা করতে এসে ভদ্রলোক নিজেও মুমুক্ষু হয়ে গেলেন। 

পিতা গৌরমোহনের অভিভাবকত্বে কৃষ্ণনগরের ঘূর্ণীতে শ্যামাচরণের প্রথম পাঠ শুরু হয়। আধ্যাত্মিক পরিবেশ পেয়েছিলেন জন্ম থেকেই। 

তাঁর পিতা একটি শিব মন্দির প্রতিষ্ঠা করে ধ্যান , জপ ,তপ নিয়েই থাকতেন। মাতা ছিলেন ভক্তিমতী মুক্তকেশী দেবী। ১৮২৮ সালের , আশ্বিন মাসে তাঁদের সংসারে শ্যামাচরণের আবির্ভাব। তার অল্প দিনের মধ্যেই শ্যামাচরণ মাতৃহারা হন। গৌরমোহন পুত্রকে নিয়ে কাশীবাসী হন। সুপ্রাচীন দেবতীর্থ বারাণসীর আবহাওয়ায় শ্যামাচরণ বড় হন। সংস্কৃত ,বাংলা, ইংরেজি ভাষা ছাড়াও তিনি ফার্সি ভাষায় অসম্ভব পন্ডিত ছিলেন। ২৩ বছর বয়সে শ্যামাচরণ সরকারি চাকরিতে যোগ দেন। পরবর্তীকালে রাণীক্ষেতে সেই অবিস্মরণীয় মুহূর্তের তাঁর আধ্যাত্ম সত্ত্বা প্রকাশিত হয় লোকহিতার্থে।

যে অমর বিজ্ঞানসম্মত সহজ যোগ- সাধন লাহিড়ী মহাশয় আমাদের দিয়েছিলেন তা অল্পস্বল্প কেউ যদি নিষ্ঠা সহকারে পালন করেন, তাতে তাঁর মহান কল্যাণ হয় এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। 

গীতায় বলা হয়েছে –  

নেহাভিক্রমনাশোহস্তি প্রত্যবায়ো ন বিদ্যতে।

স্বল্পমপ্যস্য ধর্ম্মস্য ত্রায়তে মহতো ভয়াৎ ||

এই (কর্ম্মযোগে) প্রারম্ভের নাশ নাই; প্রত্যবায় নাই; এ ধর্ম্মের অল্পতেই মহদ্ভয় হইতে পরিত্রাণ পাওয়া যায়।মানসিক ও শারীরিক এবং সাংসারিক দুঃখ থেকে ত্রাণ প্রাপ্তি ঘটে।  লাহিড়ী মহাশয়ের জীবনে এটিই প্রধানতম বিষয়, যে তিনি অপূর্ব স্বাদ পেয়ে কেবল নিজে ধন্য হননি, তাঁর প্রসাদে আরো বহু মানুষ ধন্য হয়েছিলেন ,পরম শান্তি লাভ করেছিলেন।


লাহিড়ী মহাশয় কোন প্রকার কৃপণতা না করে সেই মহান যোগসাধনা পরবর্তী মানুষকে দিয়ে গিয়েছিলেন ।বিজ্ঞানসম্মত এই #ক্রিয়াযোগসাধন তিনি যা জগৎকে দান করেছেন তা যে “জ্ঞান-বিজ্ঞান সহিতং” সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই এবং এর তুলনাও নেই।  প্রত্যক্ষ অনুভব ,দর্শন , শ্রবণ ইত্যাদি যা যা তিনি করেছেন  কোন প্রকার কৃপণতা না করে তাই তিনি আমাদের দিয়েছেন।

 লিখালিখি কা বাত নহি ,দেখাদেখি কি বাত।দুলহা দুলহিন্ মিল গয়ে,ফিকি পড়ি বাত।

 লেখালিখির কথা নয়, প্রত্যক্ষ অনুভবের কথা। বিয়ের সময় হাজার আতিশয্য , লোকজন , বাদ্য বাজনা থাকে । কিন্তু বরবউ বিবাহিত হয়ে একাত্মা হয়ে গেলে সকল কিছুই সাঙ্গ হয়। অর্থাৎ,  সাধক যখন প্রকৃতি ও পুরুষ বা জীবাত্মা ও পরমাত্মা সহিত মিলিত হতে সমর্থ হন , তখনই  ক্রিয়ার পরাবস্থায় পৌঁছান। এই অবস্থা নিজ বোধগম্য । 

গীতার বহু ব্যাখ্যা হয়েছে।  দেখা যায় তা সবই বিদ্যাগত, বুদ্ধিগত , দার্শনিক তত্ত্বগত ব্যাখ্যা।  কিন্তু অনুভব ব্যাখ্যা কজনই বা দিতে পেরেছেন?

#কুটস্থ_দ্বারা_গীতাকে_অনুভব_করতে_হয়।

 কি অপূর্ব ব্যাখ্যা! প্রাণ জুড়িয়ে যায় । মহাভারতের ১৮ দিনের যুদ্ধে শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে রথের উপর সাক্ষাৎ ভাবে উপদেশ দিয়েছিলেন । কিন্তু এই দেহ মাঝে প্রবৃত্তি ও  নিবৃত্তির যুদ্ধ জন্ম জন্মেও শেষ হবার নয়। শ্ৰীকৃষ্ণ তিনি তো এখনো প্রতি দেহে বর্তমান আছেন এবং চিরকাল থাকবেন । কারণ তিনি অবিনাশী।  তিনি আছেন বলেই আমরা সবকিছু অনুভব করি । তিনিই এই দেহ রথের উপর বসে উপদেশ দেন । 

ঈশ্বরঃ সর্বভূতানাং হৃদ্দেশেহর্জুন তিষ্ঠতি।

ভ্রাময়ন্ সর্বভূতাদি যন্ত্রারূঢ়ানি মায়য়া ॥

তাই, হে জগৎবাসী সেই ঈশ্বরের শরণাগত হও। তাঁর প্রসাদে পরম শান্তি এবং শাশ্বত স্থান প্রাপ্ত হবে। কি করে সেই ঈশ্বর যিনি আমাদের মধ্যে বর্তমান রয়েছেন তাঁর শরণাগত হওয়া যায় ,কি প্রকারে মনকে তৈরি করা যায় তারই বিজ্ঞানসম্মত সাধন লাহিড়ী মহাশয় আমাদের দেখিয়েছেন।  তিনি সারাজীবন গৃহস্থ আশ্রমে বাস করে আদর্শ গৃহী হয়ে সাধনার যে উচ্চস্বরে পৌঁছেছিলেন এমন আদর্শ হাজার হাজার বছরের মধ্যে দেখা যায় না।

ব্রহ্মানন্দং পরমসুখদং কেবলং জ্ঞান মুর্ত্তিং

দ্বন্দ্বাতীতিং গগনসদৃশং তত্ত্বমস্যাদিলক্ষ্যম।

একং নিত্যং বিমলমচলং সর্ব্বদা সাক্ষীভূতম

ভাবাতীতং ত্রিগুণ – রহিতং সদগুরুং তং নমামি।।

তাঁর জীবনের সকল কথা বলতে গেলে একটি বিশাল বই রচনা হয়ে যাবে। তাঁর জীবন ছিল জীবন্ত ও দীপ্যমান।  ” ক্রিয়া কর এবং ক্রিয়ার পরাবস্থায় থাক”। বাহ্যবেশ পরিবর্তন , কোন প্রকার বাহ্যাড়ম্বর তিনি পছন্দ করতেন না। 

পরিশেষে বলি আমার যদিও সামান্য ভাষা জ্ঞান বা লেখার অভ্যাস আছে। তবে কিনা, এসব থাকলেও , এমন সব মহাজীবন নিয়ে লেখা যায় না। এর জন্য চাই সাধন লব্ধ অনুভূতি। যা এখনো আমি প্রাপ্ত করি নাই। মা সরস্বতীর কৃপায় যদি তা কোনো দিন করতে পারি তবে এমন সব মহাজীবনকে নিয়ে না হয় গ্রন্থই রচনা করব।

#সমাপ্ত

দশানন রাবণকৃত শ্রী শিবতান্ডব স্তোত্রম বাংলা অনুবাদ সহঃ



(১) জটাটবীগলজ্জল প্রবাহ পাবিতস্থলে

গলেহবলম্ব‍্য লম্বিতাং ভূজঙ্গতুঙ্গমালিকাম ।

ডমড্ডমড্ডমড্ডমন্নিনাদবড্ডমর্বয়ং

চকার চন্ডতান্ডবং তনোতু নঃ শিবঃ শিবম।


(২) জটাকটাহ সম্ভ্রম ভ্রমন্নিলিম্পনির্ঝরী

বিলোল বীচিবল্লরী বীরাজমানমূদ্ধনি।

ধগদ্ধগদ্ধগজ্জলল্ললাট পট্রপাবকে

কিশোরচন্দ্রশেখরেরতিঃ প্রতিক্ষণং মম।


(৩) ধরাধরেন্দ্রনন্দিনীবিলাসবন্ধুবন্ধুর

স্ফুরদ্দিগন্ত সন্ততি প্রমোদ মানমানসে

কৃপাকটাক্ষ ধোরণীনিরুদ্ধদুর্ধরাপদি

ক্বচিদ্দিগম্বরেমনো বিনোদমেতুবস্তুনি।


(৪) জটাভুজঙ্গ পিঙ্গল স্ফুরৎফণামণিপপ্রভা

কদম্বকঙ্কুমদ্রবপ্রলিপ্তদিগ্বধূমুখে।

মদান্ধসিন্ধুরস্ফুরত্ত্বগুত্তরীয়মেদুরে

মনো বিনোদ মদ্ভূতং বিভর্তু ভূতভর্তরি।


(৫) সহস্রলোচনপ্রভৃত‍্যশেষলেখশেখর

প্রসূনধূলিধোরণীবিধূসরাঙঘ্রিপীঠভূঃ।

ভুজঙ্গরাজমালয়া নিবদ্ধজাটজূটকঃ

শ্রিয়ৈ চিবায় জায়তাং চকোর বন্ধুশেখর।


(৬) ললাটচত্বরজ্বলদ্ধনঞ্জয়স্ফুলিঙ্গভা

নিপীতপঞ্চসায়কং নমন্নিলিম্পনায়কম।

সুদাময়ূখলেখয়াবিরাজমানশেখরং

মহাকপালি সম্পদে শিরো জটালমস্তু নঃ।


(৭) করালভাল পট্টিকাধগদ্ধগদ্ধগজ্জল

দ্ধনঞ্জয়াহুতীকৃতপ্রচন্ড পঞ্চসায়কে।

ধরাধরেন্দ্র নন্দিনী কুচাগ্ৰ চিত্রপত্রক

প্রকল্পনৈকশিল্পিনিত্রিলোচনে রতিমর্ম।


(৮) নবীন মেঘমন্ডলী নিরুদ্ধদুর্ধরস্ফুরৎ

তকুহূনিশীথিনী তমঃপ্রবন্ধবদ্ধকন্ধর

নিলিম্পনিরঝরীধরস্তনোতু কৃত্তিসিন্ধুরঃ

কলানিধানবন্ধুরঃ শ্রিয়ং জগদধুরন্ধরঃ।


(৯) প্রফুল্লনীলপঙ্কজ প্রপঞ্চকালিমপ্রভা

বলন্বিকন্ঠকন্দলীরুচিপ্রবদ্ধকন্ধরম।

স্মরচ্ছিদং পুরচ্ছিদং ভবচ্ছিদং মখচ্ছিদং

গজচ্ছিদান্ধকচ্ছিদং তমন্তকচ্ছিদং ভজে।


(১০) অখর্বসর্ব মঙ্গলা কলা কদম্বমঞ্জরী

রসপ্রবাহমাধুরী বিজৃম্ভণামধুব্রতম্

স্মরান্তকং পুরান্তকং ভবান্তকং মখান্তকং

গজান্তকান্ধকান্তকং তমন্তকান্তকংভজে।


(১১) জয়ত্বদভ্রবিভ্রমভ্রমদ্ভমশ্বসদ

বিনির্গমৎক্রমস্ফুরৎকরালভালহব‍্যবাট।

ধিমিদ্ধিমিদ্ধিমিদধ্বনন্মৃদঙ্গতুঙ্গমঙ্গল

ধ্বনিক্রমপ্রবর্তিতপ্রচন্ডতান্ডবঃ শিবঃ।


(১২) দৃষদ্বি চিত্রতল্পয়োরভূজঙ্গমৌক্তিকস্রজো

গরিষ্ঠ রত্মলোষ্ঠয়োঃ সুহদ্বিপক্ষপক্ষয়োঃ তৃনারবিন্দচক্ষুষোঃ প্রজামহীমহেন্দ্রয়োঃ সমপ্রবৃত্তিকঃ কদা সদাশিবং ভজাম‍্যহম।


(১৩) কদানিলিম্পনিরঝরীনিকুঞ্জকোটরে বসন

বিমুক্তদুরমতিঃ সদা শিরঃস্থমঞ্জলিং বহন্।

বিলোললোচনোললামভাললগ্নকঃ শিবেতিমন্ত্রমুচরন কদা সুখী ভবিমহম।


(১৪) ইমং হী নিত‍্যমেব মুক্তমত্তমোত্তমংস্তবং

পঠনং স্বরনংব্রুবন্নরো বিশুদ্ধিমমেতী সন্ততম

হরে গুরৌ সুভক্তি মাশু যাতি নান‍্যথা গতিং

বিমোহনং হি দেহিনাং সুশঙ্করস‍্য চিন্তনম।


(১৫) পূজাবসান সময়ে দশবক্তগীতং

যঃ শম্ভু পূজন পরং পঠতি প্রদোষে।

তস‍্য স্থিরাং রথ গজেন্দ্র তুরঙ্গ যুক্তাং

লক্ষীং সদৈব সুমুখীং প্রদদাতি শম্ভু।


অনুবাদ:-


(১) যিনি জটারূপ অরণ‍্য থেকে নির্গত গঙ্গাদেবীর প্রবাহে ঐ পবিত্র করা সর্পের বিশাল মালা কন্ঠে ধারণ করে ডম রুতে ডমডম ডম।

এই শব্দ তুলে প্রচন্ড তান্ডব নৃত‍্য করছেন, সেই শিব যেন আমার কল‍্যাণ করে। এবং আমি প্রনাম জানাই।


(২) যার মস্তক জটারুপ কড়াই তে বেগে ভ্রমণ কারী গঙ্গার চঞ্চল তরঙ্গ লতাসমুহে সুশোভিত হচ্ছে;যার ললাটাগ্নি ধক ধক করে জ্বলছে, মস্তকে অর্ধচন্দ্র বিরাজিত, সেই ভগবান শিবে যেন আমার নিরন্তর অনুরাগ থাকে।


(৩) গিরিরাজ কিশোরী পার্বতীর বিশাল কালোপযোগী উচ্চ নিচ মস্তক ভূষণ দ্বারা দশ দিক প্রকাশিত হতে দেখে যার মন আনন্দিত; যার নিত‍্যকৃপাদৃষ্টির ফলে কঠিন বাধা বিপত্তির দূর হয়ে যায়, সেই দিগম্বর স্বরূপ তত্ত্বে যেন আমার মন আনন্দ লাভ করে।


(৪) যার জটাজুটের মধ্যে সর্পের ফণায় অবস্থিত মণির প্রকাশিত পিঙ্গল ছটা দিশা রূপিনী অঙ্গনাদের মুখে কঙ্কুমের রংছড়ায়; মত্তহাতির বিকশিত চর্মকে উত্তরীয় চাদর রূপে ধারণ করায় যিনি স্নিগ্ধ বর্ণ লাভ করেছেন, সেই ভূত নাথে আমার চিত্ত অদ্ভূত তৃপ্তি বোধ করুক।


(৫) যার চরন পাদুকা ইন্দ্রাদি সকল দেবতার প্রনামের সময় মস্তকে ফুলের পরাগে ধূসরিত হয়, নাগরাজের মালায় বাধা জটাসম্পন্ন সেই ভগবান চন্দ্রশেখর আমার জন্য চিরস্থায়ী সম্পত্তির ব‍্যবস্থাপক হয়ে থাকুন।


(৬) যিনি তার ললাট রূপ বেদিতে প্রজ্বলিত অগ্নি স্ফুলিঙ্গের তেজে কাম দেবকে ভস্মীভূত করছিলেন, যাকে ইন্দ্রাদি দেবগণ নমস্কার করেন, চন্দ্রের কলাদ্বারা সুশোভিত মুকুট সম্পন্ন সেই মহাদেবের উন্নত বিশাল ললাটে জটিল মস্তক আমার সম্পত্তির কারণ হোক।


(৭) যিনি তার ভীষণ কপালে ধক ধক রূপে জলন্ত অগ্নিতে প্রচন্ড কাম দেবকে আহুতি দান করেছিলেন, গিরিরাজ কন‍্যার স্তনাগ্ৰে পত্র ভঙ্গ রচনা করার একমাত্র শিল্পী, সেই ভগবান ত্রিলোচনের উপরে আমার যেন রতি অনুরাগ থাকে।


(৮) যার কন্ঠে নবীন মেঘ মালা বেষ্টনীতে অমাস‍্যার অরধরাত্রে ন‍্যায় দুরুহ অন্ধকার সম শ‍্যামলতা বিরাজ করে, যিনি গজচর্ম পরিহিত, সেই জগতভার বহন কারী, চন্দ্রের অদ্ধাকৃতিতে মনোহর ভগবান গঙ্গাধর যেন আমার সম্পতির বিস্তার করেন।


(৯) যার কন্ঠদেশ প্রস্ফুটিত নীল কমল সমুহের শ‍্যামশোভার অনুকরন কারী হরিনীর ছবির ন‍্যায় চিহ্নে সুশোভিত এবং যিনি কামদেব ত্রিপুর,ভব দক্ষ, যজ্ঞ হাতি অন্ধকাসুর এবং যমরাজের ও উচ্ছেদ কারী আমি তার ভজনা করি।


(১০) যিনি নিরভিমান পার্বতীর কলারূপ কদম্বমঞ্জরী মকরন্দস্রোতের বৃদ্ধি প্রাপ্তমাধুরী পান কারী মধূপ এবং কামদেব,ত্রিপুর,ভব; আমি তার ভজনা করি।


(১১) যার মস্তকে উপর অতন্ত‍্য বেগে ঘূর্ণিমান ভূজঙ্গের নিঃশ্বাসের ভয়ঙ্কর অগ্নি ক্রমা গত প্রজ্জ্বলিত হচ্ছে, ধিমি ধিমি শব্দের মৃদঙ্গের গম্ভীর মঙ্গলধ্বনি সঙ্গে যিনি প্রচন্ড তান্ডব নৃত‍্যকরেছেন এই ঈশ্বর কে আমি প্রনাম করি।


(১২) পাথর এবং সুন্দরকোমল বিছানায়, সর্প ও মুক্তা মালা,বহু মূল‍্য রত্ম এবং মৃত্তিকা,মিত্র ও শত্রু পক্ষে,তৃন ও কমল নয়না তরুণীতে, সাধারণ প্রজা ও পৃথিবীর মহারাজ প্রতি যিনি সম ভাব রাখেন, সেই সদা শিব কে আমি যেন প্রতিদিন ভজনা করতে পারি।


(১৩) সুন্দর ললাট সম্পন্ন ভগবান চন্দ্রশেখর চিত্ত সমর্পন করে নিজ কুচিন্তা পরিত‍্যাগ করে, গঙ্গার তীরে কোন কাননের অভ‍্যন্তরে থেকে মস্তকে ওপর হাত জোড় করে বিহ্বল নয়নে শিব মন্ত্র উচ্চারণ করে আমি সুখ লাভ করি।


(১৪) যে ব‍্যাক্তি এইভাবে উক্ত অতি উত্তম স্তোত্র নিত‍্য পাঠ, স্মরণ এবং বর্ননা করে,সে সদা শুদ্ধ থাকে এবং অতি শীঘ্রই সুর গুরু শ্রীশঙ্করের প্রতি প্রকৃত ভক্তি ভাব প্রাপ্ত হয়। সেকখন ও বিপথে যায় না।

কারন শিবের সুচিন্তা প্রানিবরগের মোহ নাশ করে।


(১৫) সায়ং কালে পূজা সমাপ্ত হলে দশানন রাবণ দ্বারা গীত এই শম্ভু পূজন সম্পর্কিত স্তোত্র যিনি পাঠ করেন, ভগবান শঙ্কর সেই ব‍্যাক্তিকে সুখ সম্পত্তি মহাদেব প্রদান করেন।

ওম নমঃ শিবায়ঃ


|| মাতঙ্গী ||


"ওঁ শ‍্যামাঙ্গীং শশিশেখরাং ত্রিনয়নাং রত্নসিংহাসনস্থিতাম্।

বেদৈর্বাহু দন্ডৈরসি খড়্গখেটক পাশাঙ্কুশ ধরাম ।।"


নবমী মহাবিদ‍্যা হলেন দেবী মাতঙ্গী।

ইনি পরমতম বিদ‍্যার অধিশ্বরী দেবী সরস্বতীর তেজস্বিনী মূর্তি। মাতঙ্গী সুরাধিশ্বরী । ইনি তান্ত্রিক সরস্বতী নামে আখ‍্যায়িতা ।

দেবী সরস্বতীর ন‍্যায় শুভ্রতা মাতঙ্গী দেবীর মধ্যে অনুপস্থিত।

মাতঙ্গীদেবী পরমাপ্রকৃতির আদি এবং শুদ্ধ রূপ। তাই তিনি শ‍্যামাঙ্গী হরিদ্বর্ণা শুচিস্মিতা ।

তিনি বিপদনাশিনী এবং অপার বিদ‍্যার আধারস্বরূপা।

তিনি কদম্বকাননে প্রথম আবির্ভূতা হয়েছিলেন এবং বলা হয় দেবীর কদম্বমালিকা অত‍্যন্ত প্রিয়।

তিনি কখনও চতুর্ভূজা কখনওবা অষ্টভূজা।

দেবী কখনও ধারণ করেন অস্ত্র আবার কখনওবা তার চতুর্হস্তে শোভা পায় চতুর্বেদ ।

দেবীর ত্রিনয়ন সুচারুভাবে স্থাপিত এবং তারা সূর্য, চন্দ্র ও অগ্নির প্রতীক ।

দেবীর উৎস নিয়ে কয়েকটি টুকরো টুকরো উপাখ্যান পাওয়া যায়।

দেবী কোথাও অসুরদলনী কোথাও আবার বরদাত্রী কখনও আবার ছলনাময়ী। 

মাতঙ্গীর পুজা বৌদ্ধ যন্ত্র মতেও প্রচলিত। বলা হয়, কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ প্রথম এই দেবীকে তিব্বত থেকে ভারতবর্ষে আনয়ন করেন এবং পুজাপ্রচার করেছিলেন।


একদা পর্বতরাজ হিমালয় তার কন‍্যা পার্বতীকে পিতৃগৃহে আমন্ত্রণ জানালেন। পার্বতী সানন্দে সে আমন্ত্রণ বার্তা কে গ্রহণ করলেন এবং পিত্রালয়ে যাবার উপক্রম করলেন। পার্বতী তার স্বামী অর্থাৎ মহাদেবকেও অনুরোধ করলেন যাতে তিনি তার সহিত শ্বশ্রুগৃহে গমন করেন। কিন্তু দেবাদিদেব তো বিনামন্ত্রণে কোথাও যাননা । এখানেও সেই আদর্শের অমর্যাদা হয়নি। 

মহাদেব ,মহাদেবীর এই অনুরোধ গ্রহণ করলেন না। পরন্তু তাকে এই বলে আশ্বস্ত করলেন যে পার্বতী কে পুনরায় ফিরিয়ে আনতে তিনি অবশ্যই হিমালয়ের ভবনে যাবেন।

অগত্যা, দেবী প্রসন্নবদনা হয়ে পিতৃগৃহে চলে গেলেন। 

এমনি করে বহুদিন অতিবাহিত হয়ে গেল, তবু পার্বতী যখন ফিরলেন না কৈলাসে, তখন ভোলা মহাদেবের খেয়াল হলো তার পূর্বপ্রদত্ত প্রতিশ্রুতির কথা।

মহাদেব তৎক্ষণাৎ চললেন হিমালয়ে, কিন্তু স্বরূপে নয়, এক সামান‍্য মণিকারের বেশে।

শৈলপুত্রী পার্বতীর কাছে মণিকার রূপী মহাদেব এলেন সাজসরঞ্জাম প্রসাধনীর দ্রব‍্য বিক্রয় করতে।

পার্বতী মণিকারের থেকে কিছু রত্নহার সংগ্রহ করে তার মূল‍্য জানতে চাইলেন। মণিকার তখন সহাস্যে জানালেন তার দ্রব্যের বিনিময়ে তিনি পার্বতীর সাথে মিলিত হতে চান।

রুষ্ট হয়ে পার্বতী তাকে অভিসম্পাত দিতে উদ‍্যোত হলে দেবী হঠাৎ অনুধাবন করতে পারলেন, এই মণিকার ছদ্মবেশী ভোলানাথ। ক্রোধমোচন করে পার্বতী মণিকার কে বললেন যে যথাসময়ে তিনি মিলিত হবেন।


এই আশ্বাসবাণী গ্রহণ করে ছদ্মবেশী মহেশ্বর কৈলাস গমন করলেন এবং ধ‍্যানস্থ হলেন।

মহাদেবী এবার এলেন এক অপূর্ব লাব‍ণ‍্যময়ী হরিদ্বর্ণা রূপে। তিনি মহাদেবের সন্নিকটে এলে মহাদেবের ধ‍্যান ভঙ্গ হয় এবং তিনি তার পরিচয় জানতে চান। পার্বতী নিজেকে এক চন্ডালিনী বলে পরিচয় দিলেন এবং বললেন তিনি মহাদেবকে পতিত্বে বরণ করতে চান। মহাদেব বুঝলেন এ মহামায়ার লীলা। তিনি শুচিস্মিত বদনে চন্ডালিনীকে তথাস্তু বললেন এবং দেবীকে মাতঙ্গী নামে অভিহিত করলেন।


ব্রহ্মযামলে মাতঙ্গী রূপের অন‍্য উপাখ্যান পাওয়া যায়। 

একদা মাতঙ্গ নামক এক ঋষি বহুবৃক্ষসমন্বিত এক কদম্বকাননে ধ‍্যানস্থ হবার পরিকল্পনা করেন। কিন্তু ঋষির ধ‍্যানে বিঘ্ন ঘটাচ্ছিলো কাননের অজস্র পশুপাখিরা । কোকিলের সুমধুর কুহুতান, টিয়া কাকাতুয়ার মতো মধুচর্চিতকন্ঠধারী পাখিদের কলরবে ঋষির ধ‍্যান বারবার বিঘ্নিত হচ্ছিলো।

তখন ঋষি মাতঙ্গ ত্রিপুরাসুন্দরী দেবীর জপস্তুতি আরম্ভ করলেন, এই বাসনায় , যাতে তিনি ঐ কাননের সকল প্রাণীকে নিজের বশীভূত করতে পারেন। আরাধনায় তুষ্ট হয়ে দেবী ত্রিপুরাসুন্দরী এলেন এই সালঙ্কারা চন্ডালিনীর বেশে, ঋষির অভিষ্টপূরণকারিণী রূপে। কিন্তু দেবীর শর্ত ছিল যে ঋষি নিজে কখনও প্রাণীদের বশ করতে পারবেননা। তাই স্বয়ং মহাদেবী তার আশ্রমে তার কন‍্যা রূপে আবির্ভূতা হবেন, সেই করবে সমগ্র প্রকৃতির নিয়ন্ত্রণ। এই মর্মে দেবী বিদায় নিলেন এবং আবির্ভূতা হলেন মাতঙ্গ মুনির কন‍্যা রূপে। ঋষি তার নামকরণ করলেন "মাতঙ্গী" ।


মার্কন্ডেয় পুরাণে পাওয়া যায় মাতঙ্গীর অপর একটি উপাখ্যান। সেখানে তিনি অসুরদলনী ।

একদা মতঙ্গাসুর নামক এক দৈত্য মহাদেবের কঠোর তপস্যা আরম্ভ করলো। অবশেষে ভোলা তুষ্ট হয়ে অসুরকে দর্শন দিলেন এবং মনষ্কামনা ব‍্যক্ত করতে বললেন। অসুর বললো, তাকে এমন ক্ষমতা প্রদান করতে যাতে এ জগতের কোনো প্রাণী তার বিনাশ সাধন না করতে পারে এবং কোনো শুদ্ধাচারে পূজিত দেবতাও তার ক্ষমতান্ত করতে পারবেন না।

এই মর্মে মহাদেব তাকে বরদান করলেন। অতঃপর শুরু হলো তান্ডব। মতঙ্গাসুর দেবলোক নয়, আক্রমণ করলো মর্তলোকে। সেখানকার সমস্ত প্রাণীকে সে তার বশবর্তী করে তুললো। পন্ড করতে থাকলো সমস্ত দেবতাদের যজ্ঞ । যজ্ঞের ভোগ না পেয়ে দেবতাদের শক্তিহ্রাস হতে থাকলে তারা সকলে মহামায়ার স্মরণাপন্ন হলেন।

মহামায়া দেখা দিলেন ত্রিপুরাসুন্দরী রুপে। দেবতারা তাদের মনষ্কামনা ব‍্যক্ত করলেন এবং বললেন কোনো শুদ্ধাচারে পূজিত দেবতা তার বিনষ্টের কারণ হতে পারবেন না।

অতঃপর দেবী ধারণ করলেন তার উচ্ছিষ্টভোগ‍্যা মাতঙ্গী রূপ। দেবী মর্তধামে এলেন এবং সৃষ্টির করলেন অভেদ‍্য কুহক। তার টিয়া ও শুকপাখির সুমধুর কন্ঠস্বরে মতঙ্গাসুরকে তিনি আবিষ্ট ক‍রলেন । শুকপাখির স্বর দ্বারা সম্মোহিত মতঙ্গাসুর সমস্ত বুদ্ধিভ্রষ্ট হয়ে দেবীর নিকট এলো। তখন দেবী মাতঙ্গী তাকে সন্মুখসমরে পরাজিত করলেন।

ললিতোপাখ‍্যান অনুসারে, দেবী মাতঙ্গী হলেন ত্রিপুরাসুন্দরীর প্রধানমন্ত্রী। তার অপর নাম মন্ত্রিণী । তিনি ভন্ডাসুর দমনে ত্রিপুরাসুন্দরী কে সহায়তা করেছিলেন।


দেবী মাতঙ্গী রহস‍্যময়ী । হিন্দুপুরাণে একমাত্র এই দেবীই যিনি শুদ্ধাচারে পুজা গ্রহণ করেননা। তিনি উচ্ছিষ্টভোগ‍্যা। 

একবার পার্বতী কৈলাসে সকল দেবগণকে আমন্ত্রণ জানান। কিন্তু বিনানিমন্ত্রণে সেখানে হাজির হয় একদল চন্ডাল সম্প্রদায়ের ব‍্যক্তি। কৈলাসের দ্বার রক্ষী নন্দী ও ভৃঙ্গী তাদের পার্বতীর সাথে সাক্ষাৎকারে বাধাপ্রদান করলেন। এবং বললেন মাতা কখনও চন্ডালদের অশুচি হস্তের নৈবেদ্য গ্রহণ করেননা।

এমতাবস্থায় পার্বতী স্বয়ং এলেন কৈলাসের সিংহদ্বারে। তিনি বললেন, মায়ের কখনও জাতিভেদ, শুদ্ধ অশুদ্ধ ভেদ থাকতে পারেনা। মা সকলের সমান । তাই আজ থেকে তিনি চন্ডালিনীরূপে চন্ডালদের মাঝেই বসবাস করবেন এবং তাদের উচ্ছিষ্ট খেয়েই জীবনধারণ করবেন। 

এই মর্মে দেবী ধারণ করলেন তার মাতঙ্গী রূপ এবং কৈলাস ত‍্যাগ করে চলে গেলেন চন্ডালরাজ‍্যে। 

অতঃপর ধাত্রীহীন কৈলাসে মহাদেব তো স্থির থাকতে পারলেন না। তিনি স্বয়ং নিলেন চন্ডাল রূপ এবং মাতঙ্গীর পতি মাতঙ্গ রূপে চন্ডালরাজ‍্যে গমন করলেন দেবীকে আহরণের জন্য । দেবীর কাছে উপস্থিত হলে তিনি জানিয়ে দেন যে পার্বতী সদাসর্বদা মাতঙ্গী রূপেই চন্ডালদের পুজাগ্রহণ করতে চান । দেবাদিদেব তাকে এই আশীর্বাদ দিয়ে ফিরিয়ে নিয়ে এলেন কৈলাসে।


মাতঙ্গী হলেন সূর্যের ইষ্টদেবী। তন্ত্রশাস্ত্রীয় দেবী ত্রিকোণাকৃতি রত্নমঞ্চে আসীন । তার লোহিতাভ বস্ত্র অগ্নির ত‍্যেজ স্বরূপ । এনার বীণা শব্দ বা নাদের প্রতীক । টিয়া, কাকাতুয়ার কন্ঠনিসৃত  "হ্রীং" ধ্বনি বীজমন্ত্রছর প্রতীক । শুকপাখি হলো পরমবিদ‍্যার প্রতীক। এবং শঙ্খপাত্রের অমৃত মধুরতার প্রতীক। 


এই দেবীকে শিবের যোগ্য শক্তি কল্পনা করা হয় এবং মনে করা হয় ইনিও শ্মশানচারিণী ডোমদের আরাদ্ধ‍্যা। তাই এনাকে "ডামরী'' নামেও পুজা করা হয়ে থাকে। কিছু কিছু মতে ডামরী কোনো দেবী নন, ইনি মাতঙ্গীর উপদেবী, অর্থাৎ মাতঙ্গীর মতোই চরিত্র অথচ মাতঙ্গী নন। হিন্দু শাস্ত্রে তিনটি ভাগে চৌষট্টি টি অর্থাৎ সর্বমোট ১৯২টি তন্ত্রের অস্তিত্ব আছে । ডামর তন্ত্র তার অন‍্যতম । অত‍্যন্ত দুর্লভ এই তন্ত্র পদ্ধতি, অতিভয়াবহ। মাতঙ্গীর সঠিক সাধনায় এই ভয়ংকর ডামরীশক্তি জাগ্রত হয়, যা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সাধকের দ্বারা নিয়ন্ত্রণ অসম্ভব হয়ে যায়। মাতঙ্গীর সাধনাপদ্ধতি গোপন ও গুঢ়ো। পূজারী ক্লিন্নতা মুক্ত হন, তবে এনার সাধনার ফল দুটি- সিদ্ধি অথবা মৃত্যু।

***---

ধূমাবতী কে? 


দেবী ধূমাবতী হল কালীকুলের পূজিতা দেবী। বীরাচারে সাধনা হয় এই দেবির। প্রয়গিক সিদ্ধি বিশেসে এই দেবীর আরও রূপ ভেদ আছে। ইনি মুক্তিদাত্রী, গুপ্ত সিদ্ধিদাত্রি, এবং সর্বশত্রু বিনাশিনী। কৌল এবং অঘোরীরা সাধারানত এই দেবীর সাধনা করে থাকে। বলা হয় জগতে মহামারি, মৃত্যু, যন্ত্রণা, নিপীড়ন, দুরভিক্ষ্যের ইত্যাদির কারণ হল রুদ্র, বায়ু, নৈরিত্তি এবং যম। এদের অধীশটারথি দেবী হল ধূমাবতী। কিছু গুপ্ত সিদ্ধির মধ্যে ইনি অঘরস্ত্র সিদ্ধি, ধূম্রদ্রাবণ সিদ্ধি, অঞ্জন সিদ্ধি,  বিষালুভাতা সিদ্ধি ইত্যাদি আরও ৮ রকম গুপ্ত সিদ্ধি দান করেন।*******


Continue-41

মা - ভুবনেশ্বরী

ইনি শুক্রের ইষ্টদেবীও দশ মহাবিদ‍্যার একটি রুপ।

মহাদেব কালী ও তারা মূর্তির ভয়ঙ্করী রূপ দর্শনে সন্ত্রস্ত হওয়ার পরে কৃপাময়ী মা তাঁর প্রসন্না রাজরাজেশ্বরী মূর্তি দর্শন করিয়ে পতিদেবতাকে কিছুটা ধাতস্থ করবার পরে আরও দুটি তাঁর প্রসন্ন মূর্তি দর্শন করালেন। এটি ভুবনেশ্বরী। ইনি নানা নামে খ্যাত-ত্রিপুটা, জয়দুর্গা, বনদুর্গা, কাত্যায়নী, মহিষঘ্নী, দুর্গা, শূলিনী, মেধা, রাধা ইত্যাদি। এঁর মূর্তিও সুন্দর অভয়প্রদা।

-

“বালরবিদ্যুতিম্ ইন্দুকিরীটাম্, তুঙ্গকুচাম্, নয়ন-ত্রয়যুক্তাম্,

স্মেরমুখীং, বরদাঙ্কুশ পাশভীতিকরাম্ প্রভজে ভুবনেশীম্।”

-

"নবোদিত সূর্যতুল্য প্রভাময়ী। চন্দ্র যাঁর মুকুটমণি রূপে বিরাজিত, যাঁর বক্ষস্থল উন্নত, সদা স্নেহপীযূষধারায় পরিপূর্ণ, ত্রিনয়নী-চতুর্ভুজে বরাভয় ও পাশ, অঙ্কুশধারিণী কমলাসনা সেই দেবী ভুবনেশ্বরীকে ধ্যান প্রণত হই" --- এই ধ্যানমন্ত্রে তাঁর পূজা হয়।

ইনি ষোড়শীর অপর মূর্তি, তাই এঁর প্রকটকাল আলাদা করে কিছু বলা হয়নি।

-

কামাখ্যা মন্দির থেকে কিছু দুরত্বে ব্রহ্মা পর্বতের শিখরে ভুবনেশ্বরী মন্দির। মন্দিরের ভিতরে এক গহ্বরে বিরাজ করছেন দশ মহাবিদ্যার অন্যতম দেবী ভুবনেশ্বরী। ভুবনেশ্বরী মন্দির চত্ত্বর থেকে গুয়াহাটি শহরের দৃশ্য অপরূপ।

-

দেবীভাগবতে বর্ণিত মনিদ্বীপের দেবী হৃল্লেখা মন্ত্রের স্বরুপশক্তি এবং সৃষ্টির ক্রমপর্যায়ে মহা লক্ষ্মী স্বরুপা আদিশক্তি ভাগবতী ভুবনেশ্বরী হচ্ছেন দেবাদিদেব মহাদেবের সমস্ত লীলাবিভূতির সহচরী। জগদম্বা ভুবনেশ্বরীর স্ব-রুপ হচ্ছে সৌমা এবং অঙ্গকান্তি অরুণবর্ণা। ভক্তদের অভয় প্রদান ও সর্বসিদ্ধি প্রদান করাই হল এর স্বাভাবিক গুণ। দশ মহাবিদ্যার মধ্যে ইনি পঞ্চম স্থানাধিকারি।দেবীপুরাণ অনুসারে মূলা প্রকৃতির অপর নামই ভুবনেশ্বরী। ঈশ্বরের জাগতিক ব্যবহার সুপ্ত থাকে সেই সময় একমাত্র ব্রহ্মই অব্যক্ত প্রকৃতিসহ অবশিষ্ট বা বর্তমান থাকেন, সেই সময় সেই ঈশ্বর রাত্রির অধিষ্ঠাত্রী দেবীর নাম ভুবনেশ্বরী। অঙ্কুশ এবং পাশ এঁর মুখ্য অস্ত্র। অঙ্কুশ হল নিয়ন্ত্রনের প্রতীক আর পাশ হল রাগ অর্থাৎ অনুরাগ বা আসক্তির প্রতীক। এইভাবে সর্বরুপে মূল প্রকৃতিই হচ্ছেন ভুবনেশ্বরী, যিনি বিশ্বকে বমন বা উদগীরন করার জন্য বামা, শিবময়ী হওয়ায় জেষ্ঠা এবং কর্মনিয়ন্ত্রন, ফলপ্রদান ও দণ্ডদান করার জন্য হলেন রৌদ্রী। ভগবান শিবের বাম অঙ্গকেই ভুবনেশ্বরী বলা হয়।

মহানির্বাণতন্ত্র মতে সব কটি মহাবিদ্যাই ভাগবতী ভুবনেশ্বরীর সেবায় সদাই নিরত থাকেন। সাত কোটী মহামন্ত্র সর্বদা এর আরাধনা করে। দশ মহাবিদ্যাই দশটী ধাপ। কালী তত্ত্ব থেকে সুরু করে কমলাতত্ত্ব পর্যন্ত দশটী স্থিতি আছে,যার থেকে অব্যক্ত ভুবনেশ্বরী ব্যক্তরুপে ব্রহ্মাণ্ডের রুপ ধারন করতে পারেন আবার প্রলয় কালে কমলার থেকে অর্থাৎ ব্যক্ত জগৎ থেকে ক্রমশ লয় হয়ে কালীরুপে প্রকৃতিতে অধিষ্ঠিতা হন, এইজন্য একে কাল এর জননীও বলা হয়।

শ্রীশ্রীচণ্ডীর একাদশ অধ্যায়ে মঙ্গলাচরণেও বলা হয়েছে যে -- "আমি ভুবনেশ্বরী দেবীর ধ্যান করি। তার শ্রী অঙ্গের শোভা নবারুন সদৃশ অরুনাভ।তার শিরে ত্রিনয়না দেবীর শ্রীমুখে মৃদু হাসির আভা। তার হাতে পাশ, অঙ্কুশ, বরদ এবং অভয় মুদ্রা শোভা পায়।"

বৃহন্নীলতন্ত্রের এই বিবরণ পুরানের বিবরণের দ্বারাও সমর্থিত যে প্রকারন্তরে কালী ভুবনেশ্বরী অভেদাত্মক। অব্যক্ত প্রকৃতি ভুবনেশ্বরীই রক্তবর্ণা কালী, দেবীভাগবত মতে দুর্গম নামক অসুরের অত্যাচারে সন্তপ্ত হয়ে দেবতা ও ব্রাহ্মণের একত্র হয়ে হিমালয়ে অবস্থিতা সর্বকারণস্বরুপা ভাগবতী ভুবনেশ্বীরই আরাধনা করেন। সেই আরাধনায় তুষ্ট হয়ে দেবী ভুবনেশ্বরী তৎক্ষণাৎ সেখানে আবির্ভূত হন।তার হাতে বান, পদ্মফুল ও শাকমূল ছিল। তিনি নিজের চোখ থেকে সহস্র অশ্রুধারা প্রবাহিত করেন।সেই জলে পৃথিবীর সব প্রানী তৃষ্ণা নিবারণ করে।নদ নদী,সমুদ্র অজস্ত্র জলে পূর্ণ হয় এবং সমস্ত ওষধি জলে সঞ্জীবিত হয়। তার হাতে ধরা শাক ও ফলমূলে প্রাণীদের পালন করার জন্য দেবী ভুবনেশ্বরীই শাকম্ভরী নামে খ্যাত হন। ইনিই দুর্গমাসুরকে বধ করে তার দারা অপহৃত বেদগ্রন্থ দেবতাদের হাতে ফিরিয়ে দেন।এর ফলে দেবী ভুবনেশ্বরীর এক নাম হয় দুর্গা। দেবী ভুবনেশ্বরীর উপাসনা পুত্রলাভের জন্য বিশেষ ফলপ্রদ।...



দ্বিতীয় মহাবিদ্যা  মা তারা ,  মা কালী  নীল বর্ণ ধারণ করে তারা রূপ নেন।  সমুদ্র মন্থনের সময় যখন মহাদেব বিষ পান করে অচৈতন্য হন তখন 

শিবকে  রক্ষা করার জন্য আবির্ভূতা হয়েছিলেন এবং ওনাকে নিজ অমৃত সম দুগ্ধ পান করিয়ে আবার উনার চৈতন্য ফিরিয়ে দেন।

ভগবতী তারা আকাশের মতন নীল বর্ণা, ব্যাঘ্র চর্ম পরিহিতা, প্রচণ্ড উগ্র দেবী, জ্বলন্ত চিতায় শবের উপর দণ্ডায়মানা, উনি খর্বা ও লম্বদরা, ওনার অঙ্গে সর্পের আভূষণ, মাথায় জটা বর্তমান, তাতে অক্ষোব্য ভৈরব রুপী সর্প ও পঞ্চ মুদ্রায় ৫ টি করোটি ত্রিকোণাকারে বিরাজমান। উনি সর্পের উপবিত ধারণ করেন, উনি প্রত্যালীর মুদ্রায় শব শিবের উপর বাম চরণ সম্মুখে প্রসারিত করে দণ্ডায়মান।  তারার ত্রিনেত্র নীল পদ্মের ন্যায় স্নিগ্ধ, যার চার হাতে যথাক্রমে খড়গ, কর্তৃকা, নীল পদ্ম ও রক্ত ও শব মাংস পূর্ন করোটি বিদ্যমান, উনি মুহুর্মুহু রক্ত পান করছেন আবার নিজের আবেশেই বিকট ভাবেই হাসছেন, ওনার কেশ গুচ্ছ পিঙ্গল বর্ণের। উনি মহা ভয়ংকর বিপদ থেকে আমাদের পরিত্রাণ করেন বলে উনার আরেক নাম "উগ্রতারা"।


উনার প্রধান দুইজন ভৈরব হলেন সদ্যোজাত ভৈরব এবং সর্পরুপী অক্ষোব্য ভৈরব। তবে তাঁরাপীঠে চন্দ্রচূড় বাবা ও বামদেবকেও উনার তারিণী রূপের ভৈরব বলা হয়।


তারাপীঠে বামদেব কে উনার প্রধান ভৈরব বলা হয়, উনি মা তারার শ্রেষ্ঠ উপাসক, বাকসিদ্ধ ও একজন শ্রেষ্ঠ তন্ত্র সাধকও ছিলেন। উনি মা তারার প্রিয় পুত্র ছিলেন। তারাপীঠে প্রথমে উনাকেই ভোগ দেওয়া হয় তারপর এই ভোগ মা তারা কে দেওয়া হয়।

মা তারার পূজা মূলত "বজ্রযানী বৌদ্ধরা" করে থাকেন, স্বয়ং ঋষি বিশিষ্ট গৌতম বুদ্ধের থেকে তান্ত্রিক মতে তারা পুজো শিখে তারাপীঠে এসে উনি সাধনা করে সিদ্ধ হন, প্রথমে উনি বৈদিক মতে সাধনা করেছিলেন কিন্তু তাতে উনি সফল হন নি, তখন একটি আকাশ বাণী হয় এবং উনাকে তান্ত্রিক মতে সাধনা করার আদেশ দেওয়া হয়, তাই উনি চিন দেশে গিয়ে "চিনাচার" পদ্ধতিতে বুদ্ধ দেব থেকে উনার পূজা অধ্যয়ন করেন। উনার পুজা পঞ্চমকারে অর্থাৎ মৎস্য, মাংস, মুদ্রা, মদিরা ও মৈথুন দিয়ে হয়ে থাকে। তারাপীঠে ভাদ্র মাসের অমাবস্যা তিথিতে (কইশী/কৌশিকী অমাবস্যায়) সারারাত ধরে মা এর বিশেষ পূজা অনুষ্ঠিত হয়। গৃহে মুলত উনার তারিণী রূপেরই পূজা অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। বাকি অন্য সকল পূজা মুলত শ্মশান ঘাটেই হয়ে থাকে। উনি তান্ত্রিকদের আরাধ্যা দেবী। তন্ত্রিকেরাই প্রধানত উনার পূজা করে থাকেন।

মা তারা অভীষ্ট ফল দায়িনী, সাধকেরা বাকসিদ্ধ,তান্ত্রিকবিদ্যা,মোক্ষ ও চরম বিপদ থেকে নিস্তার পেতে তারার  পূজা করে থাকেন। তারা মায়ের  আশীর্বাদে একজন মূর্খ ব্যক্তিও পরম জ্ঞানী হয়ে ওঠেন।বীরভূম  জেলার মহাপীঠ তারাপীঠের মহাশ্মশান হলো তাঁরা মায়ের মূল বিচরণক্ষেত্র।এই মহাশ্মশানে মহাসাধক বামদেব বাবার সমাধি মন্দিরের পাশেই রয়েছে মা তাঁরার পাদপদ্ম(পঞ্চমুন্ডীর আসন/মায়ের চরণ শিলা)।এই চরণ শিলা বহু কাল যাবত পূজিত হয়ে আসছে বহু ভক্ত ও সাধকদের দ্বারা।এই শিলা কে তৈরি করান এই সম্পর্কে কোনো প্রামাণ্য তথ্য না পাওয়া গেলেও জনশ্রুতি মতে,মহা সাধক বৈশিষ্ঠ(ভগবান রামচন্দ্রের কূলগুরু) একবার পঞ্চমুন্ডী সাধনারত অবস্থায় এক নারীর রূপ ধারণকারী মা তাঁরার পায়ের নূপুরের শব্দে সাধনায় বিঘ্ন ঘটায় বৈশিষ্ঠ মুনি শাপ দেন-''যে পায়ে এই নূপুর বাজছে সেই পা পাষাণ শিলায় পরিনত হোক।'' এরপর দেবীর দুই চরণ পাষাণ শিলায় পরিনত হয়।সেই থেকেই দেবীর এই চরণ শিলা এখানে অবস্থিত। শোনা যায়,জয়দত্ত বনিক যখন ওই স্থানে মায়ের ব্রহ্মশিলাটি উদ্ধার করেন তখন‌ও মায়ের ব্রহ্মশিলার নিচে এই চরণ শিলাটি বিদ‍্যমান ছিল।

মা তারা সম্পর্কে কোন কিছু  লেখার স্পর্দ্ধা করার মুর্খামীর পরিচয়  তবু লিখলাম। আসলে আমার মাতুল গোদা বাংলায় শিবনাথ বৈদ্যের পোস্ট দেখে। তিনি লিখেছেন-"তারাপীঠ মহাশ্মশানে লকডাউন এর সময় শ্মশানবাসী সাধুদের ও নিরীহ প্রাণীদের উদ্দেশ্য যদি কেউ ভান্ডারা প্রদান করেন তাহলে শ্মশানবাসিদের উপকৃত হয়।*****


‘কালী’ শব্দের অর্থ ‘কাল+ঈ (কলনার্থে) অর্থাৎ যিনি কালকে কলন করেন, তিনিই কালী। মহানির্বাণতন্ত্র মতে প্রলয়কালে যিনি সমস্ত জগৎকে কলন করেন তিনি মহাকাল এবং এই মহাকালকেও যিনি গ্রাস বা কলন করেন তিনি আদ্যামহাশক্তি কালী। মহাকালকে গ্রাস করার পর আর কিছুই থাকে না, কেবলমাত্র ব্রহ্মরূপা মহাশক্তি তাঁর ‘তমোময়’ (জ্ঞানাতীত-অর্থে) (তম শব্দার্থ তুরীয় বাচকও ),  সেই জ্ঞানাতীত তুরীয় অবস্থায় অবাঙ্মানসগোচর নিরাকার ভাব নিয়ে একাকিনী বিরাজ করেন। 'দক্ষিণা' কথাটির অর্থ আমরা পাই নির্বাণতন্ত্রে যেখানে শিব বলেন, 'পুরুষ দক্ষিণ ও শক্তি বামভাগ স্বরূপ। যতক্ষন এই দুই ভাব সমান ভাবে বিরাজ করে, ততক্ষন ভববন্ধন, সৃষ্টিচক্র । কিন্তু যখন বামাশক্তি জাগরিতা হয়ে দক্ষিণভাগরূপী পুরুষকে জয় করেন বা গ্রাস করেন ও দক্ষিণ ও বাম দুই ভাগেই তিনি একাই সর্বব্যাপিনী পরমাত্মা বিরাজ করেন, তখনি তিনি মোক্ষদায়িনী হন। তাই তাঁর নাম 'দক্ষিণাকালী'।তবে যে মহাকালকে তিনি গ্রাস করেন, তিনি কালীর মধ্যেই সুক্ষ্মরূপে অবস্থিত, কারণ দেবী একাধারে শিব ও শক্তি উভয় স্বরূপা।  এই প্রসঙ্গে রুদ্রযামল বলেন, মহাপ্রলয়কালে কোটিব্রহ্মাণ্ডনায়িকা কালী নিজেকে শিব ও শক্তি এই দুই ভাবকে এক দেহে বিলীন ক’রে  তাঁর মূল নিত্যস্বরূপে বিরাজ করেন। অর্থাৎ পরব্রহ্মময়ী কালীর থেকে শিব শক্তি দুই ভাব উৎপন্ন হয়, এবং শিব শক্তি ভাবও কালীর মধ্যেই বিলীন হয়, 

যখন সেই কালী নিজ স্ববিম্ব দর্শন করেন, তখন সেই বিম্বকেই তিনি মানসিক সংকল্প দ্বারা মায়ারূপ প্রদান ক’রে শিব রূপে প্রকাশ করেন অর্থাৎ শিব সগুন ব্রহ্ম । এই ভাবে সৃষ্টির উদ্দেশ্যে তিনি স্বীয় ভর্তাকে নির্মাণ করেন। নির্বাণতন্ত্রে সত্যলোকে নিরাকারা মহাজ্যোতিস্বরূপিণী ব্রহ্মময়ী কালী নিজ মায়া দ্বারা নিজস্বরূপ আচ্ছাদন ক’রে চণকাকার-রূপে বিরাজিতা। একটি চণক বা চানার মধ্যে যেমন দুইটি দল সর্বদা পরস্পরের সঙ্গে ওতঃপ্রোতঃ ভাবে জড়িত, তেমনি অদ্বৈত ব্রহ্মস্বরূপা দক্ষিণাকালীর মধ্যেও শিব ও শক্তি অভিন্ন রূপে বিদ্যমান। তিনি হস্তপাদাদিরহিতা ও চন্দ্র-সূর্য-অগ্নিস্বরূপ ত্রিবিন্দুময় কামকলারূপিণী। যখন তিনি মায়ারূপ বল্কল ত্যাগ ক’রে দ্বিধা রূপে বিভক্ত হন, তখনি শিব ও শক্তির ভেদ উৎপন্ন হয় ও এই ভেদের মধ্যে দিয়ে সৃষ্টিকল্পনা সঞ্জাত হয়।****


কুন্ডলিনী -০১(নিউ)


কুলকুণ্ডলিনী এক প্রকার শক্তি বিশেষ । এজন্য কুলকুণ্ডলিনী সম্বন্ধে সবিশেষ জানার আগে শক্তি সম্বন্ধে জানা প্রয়োজন । এও বলা প্রয়োজন সহজ - সাধনা অথবা সর্পশক্তি সাধনা কুলকুণ্ডলিনী সাধনার নামান্তর । আধুনিক বিজ্ঞান বলে , কোন এক কালে মহাকাশে এক প্রবল বিস্ফোরণ হয় এবং সেই বিস্ফোরণের ফল স্বরূপ বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টি । এই বিস্ফোরণের ফলে যে ব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টি হলে তার প্রতিটি অংশই পঞ্চ উপাদান- ক্ষিতি , অপ , তেজ , মরুৎ এবং ব্যোমা । এই পঞ্চ - উপাদান ছাড়া কোন কিছুর দেহ সৃষ্টি হতে পারে না । সৃষ্টিতেও এই পঞ্চভূত এবং ধ্বংসের পরেও সেই পঞ্চভূত । এই পঞ্চভূত সমষ্টিগত ভাবে একটি ক্ষুদ্র কণায় পরিবর্তিত হলে আমাদের শাস্ত্র তার নামকরণ করেছে শেষনাগ এবং , যখন সে বৃহৎ এবং বহু হয়  তাকে বলা হয় অনন্তনাগ , অতি ক্ষুদ্র বলে শেষনাগকে  নারূপে চিস্তা করা যায় । এ মনে হয় নাগ  শব্দটি নাগজাতি থেকে উদ্ভুত । প্রাচীন ভারতে দ্রাবিড় , প্রাগার্য এবং আর্য ছাড়াও নাগজাতির অস্তিত্ব ছিল । উত্তর - পশ্চিম এবং মধ্যভারতে এই জাতি প্রভাব বিস্তার করেছিল।  মধ্যভারতে নাগমাত্রা কদ্রু এবং গরুড় মাত্তা বিনতার সবিস্তার বর্ণনা রয়েছে মনে হয় নাগজাতিভুক্ত সমাজবিজ্ঞানীরা এই শক্তির প্রথম উদগাতা । যেহেতু সর্প ছিল তাদের প্রতীক ভাই সম্ভবতঃ শেষনাগের বর্ণনায় দেখি সর্পের মন্তকে পঞ্চবিন্দু যেগুলি ক্ষিতি , অপ , তেজ , মরুৎ ও ব্যোমের প্রতীক । এছাড়াও মহাসমুদ্রে নাগের উপর বিষ্ণু ( অর্থে সৃষ্টি ) নিদ্রিত । অর্থাৎ সৃষ্টি শক্তিতত্ত্বের প্রতিকী রুপ সর্প। প্রতিটি দেবদেবীর মূর্তিতে দেখি সর্পের ছাড়াছাড়ি। সৃস্টির প্রতি অংশে এটি নিদ্রিত রয়েছে কিন্তু স্বয়ংক্রিয় । সমগ্র বিশ্বব্রহ্মাও , যার এক অংশ আমাদের এই পৃথিবী এবং পৃথিবীর একটি শক্তিকণা মানবদেহ । প্রতিটি অংশেই রয়েছে সেই শক্তির খেলা । একটি কণা বা একটি অংশ আর একটি থেকে বিচ্ছিন্ন নয় । মূলতঃ সবাই এক তবু প্রকাশ ভিন্ন ভিন্ন । 

একই বস্তুকে ব্যক্ত অবস্থায় প্রকৃতি এবং অব্যক্ত অবস্থায় ব্রহ্মা বলা হয় । কুলকুণ্ডলিনী সাধনের মূল কথা অব্যক্ত অবস্থার সাথে ব্যক্তের মিলন ঘটানাে । যার মাধ্যমে এটি করা হয় তা প্রতিটি দেহেই অবস্থান করে । এই সাধনা বৈদিক । বেদের বিজ্ঞানীরা ( তখনকার ভাষায় ঋষি - মুনিরা ) নিজ নিজ পরীক্ষা - নিরীক্ষার ফলে যে সত্যের সন্ধান পেয়েছিলেন তারই উপর প্রতিষ্ঠিত এই সত্য । বোদের কথা বিজ্ঞানসম্মত সাধনার ফসল , কোন ব্যক্তি বা গােষ্ঠিসমূহের অনুমান বাক্য নয় । সাধারণতঃ চিন্তা করে মানুষ যে সব কথা বলে তা ঠিক নাও হতে পারে কিন্তু অনুভূতিলব্ধ বাক্য চিন্তাপ্রসূত নয় । সেখানে চিন্তা যেতে পারে না , কেবল মাত্র মহান গম্ভীর হতে অনুভূতি সত্য দর্শন করে । উপনিষদ এবং তন্ত্রে ব্রহ্ম এবং ব্রহ্মশক্তিকে অভেদ বলা হয়েছে । এই দুই অর্থাৎ চিৎ এবং চিৎ শক্তি দুটোকেই যদি এক অখণ্ড সত্ত্বারূপে গ্রহণ করা হয় তবে এই সাধনার মূলে প্রবেশ করা যায় । 

এই কুন্ডলিনী জ্ঞান সম্বন্ধে শ্ৰীশ্ৰীগীতায় রাজবিদ্যা-রাজগুহ্যযোগে  ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে বলেছিলেন , “ এই জ্ঞান শ্রেষ্ঠ জ্ঞান , অতিশয় গুহ্য , পবিত্র , প্রত্যক্ষ ফলপ্রদক , ধর্মামানুগত , সহজে অনুষ্ঠেয় এবং অব্যয়। " গীতা ৯/১২ 


আমাদের ধর্ম ছাড়াও বিভিন্ন দেশে এবং বিভিন্ন ধর্মসমূহও এই কুন্ডলিনী সাধনার কথা কোন না কোন ভাবে ব্যক্ত আছে । শৈব , শক্ত এবং বৈষব ভেদে প্রধানত তিনটি তান্ত্রিক সম্প্রদায় আছে । এই সৰ সপ্রদায়ে যে সৰ কুণ্ডলিনী তত্ত্ব সম্পর্কিত বর্ণনা রয়েছে । 

ইতিহাস বলে মধ্যপ্রাচ্যের ইউফ্রেটিস নদীর অববাহিকায় এই উপাসনা রীতির উন্মেষ লক্ষ্য করা গিয়েছিল । গ্রীক এবং রােমান সভ্যতার শিল্পকলার নিদর্শনে সর্পপূজার  বিবরণ পাওয়া যায় । প্রাচীন মিশরে ফ্যারাগুয়ের দুই যুগলের মধ্যে সর্প প্রতীক অঙ্কিত থাকতো । মেসােপটেমিয়ার মন্দিরে সর্পমূর্তি দেখা যায়।


ঐতিহাসিকরা বলেন , বৌদ্ধ ধর্মের সংকটকাণে নাগবিদর্ভ জনপদের নাগবংশীয় দার্শনিক নাগার্জুন বৌদ্ধ ধর্মমতের এক নতুন ব্যাখ্যা দেন । নালন্দায়  অধ্যাপনারত এই দার্শনিকের নতুন ব্যাখ্যা অনুযায়ী মহাযান মতবাদের উদ্ভব হয় । এই মহাযান মতবাদের মধ্য দিয়ে নাগদের সূক্ষ্ম কায়াসাধন যা কিনা কুণ্ডলিনী সাধনার নামান্তর নতুন বৌদ্ধতন্ত্র নামে পরিচিতি লাভ করে । সাঁচীর বিখ্যাত স্তুপে সর্প সাধনার নিদর্শন পাওয়া যায় । সেখানে দেখা গেছে সাতটি ফণাযুক্ত শিরভূষনা কয়েকজন নারী তাকে ঘিরে রেখেছেন।  অমরাবতীর স্তুপে বুদ্ধদেবের মস্তুকে এবং রাজাদের মতকে সর্প বিরাজ করছে ।


ভগবান বুদ্ধ যে এই মতে সাধনা করেছিলেন তার বড় প্রমাণাদি বৌদ্ধ ধর্ম শাস্ত্রে রয়েছে । তিব্বতী লামারা এই সাধনাই করে থাকেন । কুন্ডলিনী যোগ সাধনে সুষুমা নাড়ীর বিশেষ সম্পর্ক রয়েছে । 

প্রকৃতপক্ষে কুণ্ডলিনী শক্তি প্রাণের আধ্যাত্মিক রূপ ব্যতীত অন্য কিছুই না । সমগ্র বিশ্বব্রক্ষ্মান্ডে যে প্রাণশক্তি কাজ করছে মানবদেহে সেই প্রানশক্তি সংযমিত  হয়ে যে গতিরূপ গ্রহণ করে তাকেই বলে কুন্ডলিনী । কুন্ডলিনী যােগ - সাধন দ্বারা নির্গুন ব্ৰহ্মতত্ত্বকে আশ্রয় করে ' কাম রাগ বর্জিত ' অবস্থায় কূটস্থে স্থির থেকে যে সৃষ্টি , তাকেই পরমাত্মার নান্দনিক সৃষ্টি বলে । সাধনের সিদ্ধ তখনই যখন কূটস্থে জ্যোতি দর্শন হবে , দর্শন স্থায়ী হবে এবং স্বীয় অস্তিত্ব লয় পাবে। রুপ থেকে অরূপে , ব্যক্ত থেকে অব্যক্তে যাওয়ার সাধনা । শ্রীমদভগবদগীতায় শ্রীভগবান বলেছেন- “ এয ব্রাহ্মীস্থিতি পাৰ্থ নৈনাং প্রাপ্ত বিমুহ্যতি । "

কুন্ডলিনী -০২(নিউ)


আমাদের এই দেহ পঞ্চভূতে তৈরী।  এই পঞ্চভূত হচ্ছে ক্ষিতি , অপ , তেজ , বায়ু ও আকাশ । এই ব্রহ্মাণ্ডও পঞ্চভূতে তৈরী । আমাদের দেহ দাড়িয়ে আছে মেরুদণ্ডের উপর ভর করে । এই মেরুদণ্ডে ৬ টি পদ্ম বা চক্র বা গাট রয়েছে । এদের মধ্যে সবচেয়ে উপরে ভ্রদ্বয়ের মাঝখানে যে আজ্ঞা চক্রটি রয়েছে তাকে বাদ দিলে বাকি পাঁচটি মহাভূতকে প্রতিনিধিত্ব করে । সেগুলির ক্রম এইরূপ ( নিচ থেকে উপরে ) মূলাধার ( ক্ষিতি ) , স্বাধিষ্ঠান ( অপ ) , মণিপুর ( তেজ ) , অনাহত ( বায়ু ) এবং বিশুদ্ধ ( আকাশ ) । এই চক্রগুলি যৌগিক । এগুলি আধ্যাত্মিক অনুভূতির ফসল । এই মহাভূতের প্রতিভূ স্বরূপ পাঁচচক্র এবং ষষ্ঠ চক্র বা আজ্ঞাচক্র নামে প্রসিদ্ধ নিয়ে হয় ষটচক্র । শাস্ত্রে এই ষটচক্র ভেদের উপর গুরুত্ব আরােপ করা হয়েছে । বলা হয় যারা এটা পারেন তারা সংসারে বা বনে যেখানেই থাকুন অবশ্যই সিদ্ধি লাভ করেন ।

এই দেহেই সর্বদেবদেবী , সবরকম অসুরাদি , সমস্ত তীর্থ এবং যজ্ঞকুন্ডাদি রয়েছে । সর্ববিদ্যা ( সম্পূর্ণবিজ্ঞান ) এবং সর্বদেবদেবীর প্রলােভন অতিক্রম করে এবার সর্বতীর্থে স্নান করে নিন । মূলাধারে রয়েছে ব্রক্ষ্মতীর্থ বা পুষ্কর তীর্থ প্রথম চক্র ভেদ এখানেই অতিক্রম করতে হবে । তাই প্রথম স্নান , এখানেই । এটা পৃথ্বী স্থান ( ক্ষিতি ) তাই পৃথিবীর সর্ব তীর্থ এখানেই । দ্বিতীয় চক্র স্বাধিষ্ঠান । আপনি পৃথিবীর সর্ব তীর্থে স্নান শেষ করে এসেছেন তাই এবার স্বতীর্থে স্নান । এটা দেবদেবীদের স্থান । তাই তাদেবকে দেখে মােহিত হয়ে যাবেন না । এর পর মণিপুর । এখানকার তত্ত্ব তেজ এবং তীর্থের নাম দেবতীর্থ । উচ্চস্তরের দেবদেবীদের স্থান । আপনার কামনা বাসনা নাশ হলে তবেই এই তীর্থে স্নান । এর পর আসুন মহাকাশে অনাহতে সমস্ত শব্দের মিলন ভূমি ওঙ্কার । এখানে আছে নাদতীর্থ। নাদতীর্থ অতিক্রম করে আপনি পৌছে যাবেন শিবের দুয়ারে যার নাম হরদ্বার বা হরিদ্বার । হরিদ্বারে স্নান সমাপন হলে আপনি যাবেন মুক্তত্রিবেনী বা মানস তীর্থে । মানস তীর্থের আর একটি নাম বিন্দুসরােবার তীর্থ । বিন্দুসরােবরে স্নান করলে নির্বাণ মুক্তি লাভ করবেন।


কুন্ডলিনী-০৩(নিউ)


কুণ্ডলিনী শব্দটি এসেছে কুণ্ড বা কুল শব্দ হতে । যার অর্থ হচ্ছে পেঁচানাে , কুন্ডলায়িত হয়ে থাকা । সাপ যেমন পেঁচিয়ে সুষুপ্ত থাকে সেই রকম মানবদেহে এই শক্তি লিঙ্গমূল ও গুহ্যদ্বারের মাঝখানে , শাস্ত্রের ভাষায় যে স্থানের নাম মূলাধার সেখানে কুন্ডলিনী অবস্থায় থাকে। 


কুন্ডলিনী এক প্রকার যোগ । মানবদেহে কায়সাধনের মাধ্যমেই এটি করা সম্ভব। এটি যােগের যোগ সাধনার সর্বশ্রেষ্ঠ শাখা । একে রাজযােগও বলা হয় । বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডে যে চৈতন্যশক্তি রয়েছে তা মানবদেহেও রয়েছে । এই শক্তিই “ ঈশাবাস্যমিদং সর্বং ” এই মহাশক্তি সর্বভূতে ব্রহ্মরূপে বিরাজিত। শক্তি হতেই সবকিছুর সৃষ্টি এবং শক্তিতেই লয়।


কুন্ডলিনী নাম হয়েছে এটি সুপ্ত থাকলে সর্পের মত কুন্ডলী পাকিয়ে থাকে বলে। সুপ্তা কুন্ডলী শক্তি মূলাধারে সাড়ে তিন পাক কুন্ডলী পাকিয়ে থাকে। এই ক

শক্তিকে জাগরিত করে  অর্থাৎ সুপ্ত অবস্থা থেকে উখিত বা চৈতন্যময় করে সহস্রারে বিন্দুরুপ শিবে যােগ করাই কুন্ডলী যোগ ।


তন্ত্রের শিবশক্তি , বৈষ্ণবদের রাধা - কৃষ্ণ , বেদের ব্রহ্ম - প্রকৃতি সবার মূলে এই একই তত্ত্ব। বাউল সাধনা , সহজ সাধনা , স্বরুপতত্ত্ব , বৌদ্ধ সহজ  জান একই সাধনের কথা বলে । ভগবান বুদ্ধের এই কারণে একটি নাম সহননেত্র।


বেদের ব্রহ্ম , তন্ত্রের শিব , ভগবান বুদ্ধের ভাষায় শূন্য । ভগবান বুদ্ধ যাকে সর্বোপরি  মিলনভূমি , পূর্ণবস্তু বলে বেদের ভাষায় শিক্ষা দিয়েছেন “ পূর্ণমদঃ পূণমিদং পুর্ণাং পূর্নমুবচ্যতে । ” 


গাতীয় রাজযােগ অধ্যায়ে এই যোগের কথা বলা হয়েছে । বিদ্যার ক্ষেত্রে রাজবিদ্যা , গােপনীয়তার ক্ষেত্রের রাজগুহ্য , পবিত্রতার ক্ষেত্রে পবিত্রোত্তম অথচ সহজ সাধ্য সাধনা- এই গীতােক্ত যােগকেই ক্রিয়াযোগ বলে , যাকে আমরা কুলকুণ্ডলিনী যোগ  বলছি । পাণের সংযম বা প্রাণায়ামের উপরেই এই যােগ সাধন করতে হয় । 


কুলকুন্ডলিনী সাধনা কায়া সাধনা । বাউলেরা বলেন দেহতত্ত্ব সাধনা । মানবদেহেই এর স্থিতি , গতি ও লয় । এই শক্তি বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের চৈতন্য - শক্তির সাথে একত্ব । ব্রক্ষ্ম বা শিব স্থির কিন্তু প্রকৃতি বা শক্তি ত্রিগুণাত্মিকা । তিনটি গুণের সাথে সে প্রতিষ্ঠিতা । সত্বগুণে চৈতন্যে প্রকাশ , রজোগুণে গতি এবং তমােগুণে আবরিত ।


দেহের মেরুদণ্ডের ঠিক নিচে , গুহ্যমূল এবং লিঙ্গমূলের মাঝের স্থানটিতে কুণ্ডলিনী অবস্থান করে । মেরুদণ্ডের মধ্য দিয়ে তিনটি অদৃশ্য নাড়ী রয়েছে । সাধারণের সুবিধার জন্য এই তিনটি নাড়ীকে তিনটি সুড়ঙ্গ গােপনীয় পথ বলবাে । বামের নাড়ী বা পথটির নাম ইড়া , দক্ষিণেরটি পিঙ্গলা এবং মাঝেরটি সুষুম্না । ইড়া ও পিঙ্গলা যথাক্রমে ঋণাত্মক ও ধনাত্মক । মানুষের শ্বাস - প্রশ্বাস ক্রিয়া এই ঋণাত্বক এবং ধনাত্মক নাড়ীদুটির সাহায্যে অনুষ্ঠিত হয় । মেরুদণ্ডের বাইরের দিকে থাকে ইড়া ( বামে ) এবং ভিতরের দিকে থাকে পিঙ্গলা । এগুলি বামদিকে থেকে ডানদিকে পেঁচিয়ে থাকে । নাড়ী দুটি ধণাত্মক এবং ঋণাত্বক হওয়ার কারণে বিদ্যুতের ধর্ম অনুযায়ী এদের মধ্যে এক বিদ্যুৎশক্তি ক্রিয়া করে । যার ফলে স্পন্দনের সৃষ্টি হয় । এই স্পন্দনই প্রাণ নামে অভিহিত । এই প্রাণই সমস্ত সৃষ্টির কারণ প্রাণই সকলকে ধরে রাখে । প্রাণ না থাকলে কোন কিছুর অস্তিত্ব থাকেনা । তাই প্রাণকে চেনা , জানা , ভালবাসার নাম সাধনা । প্রাণকে সংযমিত করতে পারলে অভূতপূর্ব শক্তি লাভ ও সঞ্চয় করা যায় । ইড়া পিঙ্গলা এবং সুষুম্না নাড়ীত্রয়কে যথাক্রমে গঙ্গা , যমুনা এবং সরস্বতী বলা হয় । 


ইড়া - পিঙ্গলা  শরীরের যাবতীয় কর্ম শ্বাস - প্রশ্বাস ( প্রাণ ) রূপে সম্পাদন করে দুই ভ্রর মধ্যস্থানে মিলিত হয় । এখানে সুষুম্না নাড়ীও এসে মিলিত হয় । মেরুদন্ডের নীচে মূলাধারে যেখান থেকে এদের যাত্রা শুরু সেই স্থানকে মুক্ত ত্রিবেণী বলে। মুক্ত ত্রিবেণী থেকে আবার নাড়ীত্রয় পৃথক হয়ে নাসারন্ধ্রে প্রবেশ করে । ইড়াকে বলা হয় চন্দ্র এবং পিঙ্গলাকে বলা হয় সূর্য । এই সূর্য ও চন্দ্রকে ধরে রাখে প্রাণশক্তি ।

কুন্দলিনী-০৪


যার ষট্‌চক্র সম্বন্ধে কিছু মাত্র ধারনা নেই অথচ ভগবানের আরাধনা করেন তার দ্বারা তার দিনগত পাপক্ষয়ই হয়ে থাকে মাত্র এবং এতে হয়ত তার সিদ্ধিলাভে সপ্তজন্ম কেটে যেতে পারে । কিন্তু যিনি ষট্‌চক্র ভেদের কৌশল পূর্ণমাত্রায় অবগত হয়ে কৰ্ম্মানুষ্ঠান করে থাকেন তিনি এক বৎসরের মধ্যেই সিদ্ধিলাভ করতে পারেন । এই ষট্চক্রভেদের ক্রিয়াই আত্ম কাৰ্য্য যা প্রাণায়াম ব্যতীত কিছুতেই হবার নয় । তত্ত্বজ্ঞান লাভ করাই সাধন কার্যের চরম ফল । এই জ্ঞান লাভ করতে ষটচক্রাভাস ব্যতীত সুসিদ্ধ হতে পারে না । কেননা চক্ৰজ্ঞানই সকল প্রকার পারমার্থিক জ্ঞানের মূলীভূত কারণ ।


তাই নিগমশাস্ত্রে বলা হয়েছে -

তত্ত্বজ্ঞানং পরং  জ্ঞানমধ্যে প্রতিষ্ঠিতং ।  ষটচক্রাভ্যাসনং জ্ঞানং আদিভূতং ন সংশয়ঃ ।।

ষটচক্র দ্বারা ব্রহ্মা থেকে পৃথিবীমন্ডল পর্যন্ত অতি সুন্দর ভাবে চিন্তা করবার প্রণালী সঙ্কলিত হয়েছে । বাহ্য ব্রহ্মান্ডের ন্যায় মানব শরীর রূপ পিন্ড ব্রহ্মান্ডটি একই ভাবে সৃষ্ট ও পরিচালিত হচ্ছে , তা এই ষট্‌চক্র দ্বারা অনুভূত হয়ে থাকে । আমাদের শরীরের পেছনের মেরুদন্ডটি ফাঁপা । এই মেরুদন্ডের মধ্যে বহু নাড়ী একত্রিত হয়ে ভিন্ন ভিন্ন কয়েকটি কেন্দ্রে মিলিত হয় । এইরূপ ছয়টি বিশিষ্ট কেন্দ্র আছে । এই বিশিষ্ট কেন্দ্রগুলােকে চক্র বা পদ্ম বলে । সুষুম্ননাড়ী নামে মাঝখান দিয়ে একটি ছিদ্রযুক্ত বিশেষ নাড়ী মেরুমধ্যস্থ এই কেন্দ্রগুলাে ভেদ করে গুহ্যদেশ থেকে মস্তিষ্ক পর্যন্ত বিস্তৃত রয়েছে । ঈড়া ও পিঙ্গলা নাড়ীদ্বয়ক্রমে মূলাধারস্থ সুযুম্না মুখের বাম ও দক্ষিণদিক থেকে উত্থিত হয়ে আবার ভরুদ্বয়ের মধ্যে আজ্ঞাচক্রে সুষুম্নার সঙ্গে মিলিত হয়েছে ।


মেরুদন্ডস্থিত চক্রগুলাে হচ্ছে সংবেদক স্নায়ুমন্ডল , এরা এক একটি স্নায়ু বিশেষ । এগুলাে বিভিন্ন প্রকারের উদ্ভুত শক্তির কেন্দ্র । এই সমস্ত চক্র মেরুদন্ডের মূল অংশ থেকে শুরু করে , তার ওপরের অংশ পর্যন্ত জুড়ে থাকে । সাধারণ অবস্থায় এই সব চক্র না ফোটা পদ্ম ফুলের মত অধােমুখ হয়ে অবিকশিত অবস্থায় থাকে । যৌগিক ক্রিয়ার দ্বারা উত্তেজিত হয়ে যখন এগুলাে উর্ধমুখ হয়ে বিকশিত হয়ে ওঠে , তখন তাদের অলৌকিক শক্তিগুলাের বিকাশ হয় । চক্রগুলাের স্থূল আকৃতি তাদের সূক্ষ্ম স্বরূপের বােধ করানাের জন্য শুধুমাত্র প্রতীকাত্মক হয় । তত্ত্বজ্ঞান লাভ করাই সাধন কার্যের চরম ফল । এই জ্ঞান লাভ করতে হলে ষটচক্রাভ্যাস ব্যতীত সুসিদ্ধ হতে পারে না । কেননা ষট্‌চক্ৰজ্ঞানই সকল প্রকার পারমার্থিক জ্ঞানের মূলীভূত কারণ । ইহাই নিগমশাস্ত্রে বলা হয়েছে ।

ষটচক্র দ্বারা ব্রক্ষ্ম থেকে পৃথিবীমন্ডল পর্যন্ত অতি সুন্দররূপে চিন্তা করবার প্রণালী সঙ্কলিত হয়েছে । বাহ্য ব্রহ্মান্ডের ন্যায় মানব শরীর রূপ পিন্ড ব্রহ্মান্ডটি একই ভাবে সৃষ্ট ও পরিচালিত হচ্ছে , তা এই ঘটচক্র দ্বারা অনুভূত হয়ে থাকে । এবার সংক্ষেপ চক্র সম্বন্ধে বর্ননা করা হচ্ছে।

Continue-42

কুন্ডলিনী রহস্য (১ম পর্ব)


কুণ্ডলিনীকে দেবী হিসেবে গণ্য করা হলেও আসলে ইনি হলেন শক্তি। এই শক্তি মানবদেহের সর্বনিম্ন চক্রে অর্থাৎ মূলাধারে ( গুহ্যদ্বার ও লিঙ্গমূলের মাঝখানে ) সর্পাকারে কুণ্ডলায়িত অবস্থায় নিদ্রিত আছে বলে যােগীরা ভেবে থাকেন। এখানে তিনি শিবলিঙ্গকে সাড়ে তিন প্যাচে জড়িয়ে আছেন বলে কল্পনা করা হয়। এই লিঙ্গ হল মানুষের সূক্ষ্ম শরীর বা মুক্ত আত্মস্বরূপ। একে সর্বাঙ্গে জড়িয়ে থাকা

মানে জীবাত্মাকে মায়াশক্তির আবরণে জড়িয়ে রাখা। এই মায়াশক্তির বন্ধন বা আবরন খুলতে না পারলে জীবাত্মার আত্মজ্ঞান জান্মে না। সাড়ে তিন পচ কল্পনা করার অর্থ আপাদমস্তক জড়িয়ে থাকা। প্রত্যেকটি মানুষই তার নিজের হাতের সাড়ে তিন হাত লম্বা সকল মানুষ এই সাড়ে তিন হাতই মায়ায় জড়িয়ে আছে। তাই শক্তি বা মায়ার প্যাচ সাড়ে তিন দেখানাে হয়েছে। সাধাকর কাজ হয় এই সাড়ে তিন প্যাচ জড়িয়ে থাকা এই নিদ্রিত শক্তিকে জাগরিত করা, যাতে সে প্যাচ খুলে অর্থাৎ মানবসত্তায় জড়িয়ে থাকা অবরন খুলে উধর্বগতি হতে পারে। অর্থাৎ যেখান থেকে তার উৎপত্তি হয়েছিল , মানে পরম শুন্যতা থেকে, সেখানে ফিরে যেতে পারে। মানবদেহে এই শূনাস্থান কল্পনা করা হয়েছে ব্রক্ষ্মরন্ধ্রের কেন্দ্রস্থলকে, যাকে বলে কুটস্থান। এই কেন্দ্রকে ঘিরে থাকা যে পদ্মের কল্পনা কর হয়েছে, তার নাম সহস্রার। এই সহস্রারের কেন্দ্রই হল পরম শুন্যতাস্বরূপ। শক্তি সেখানে ফিরে গেলে আবার তার গতি হারিয়ে ফেলে। প্রকৃতির ত্রিয়া বন্ধ হলেই মায়াশক্তি তা জীবাত্মিক চেতনাকে আবরিত করে রাখার ক্ষমতাকে হারিয়ে ফেলে। তাই সাধকের প্রথম কাজ হল এই সুপ্ত শক্তিকে জাগরিত করে তােলা। দেবী মূলাধারে জাগরিত হবার পূর্ব মুহুর্ত পর্যন্ত সাধকের মধ্যে কোনো দিবা অনুভূতির স্পন্দন দেখা যায় না। এই শক্তি বা দেবী জাগরণের সঙ্গে সঙ্গেই আরম্ভ হয় আনন্দময় অনুভূতির স্পন্দন।


শক্তির জাগরণের পরই আরম্ভ হয় তার উর্ধ্বগতি। একটি একটি করে চক্র ভেদ করে শক্তি উর্ধ্ব দিকে এগিয়ে চলেন। সর্বোচ্চ স্থান সহস্রারের কেন্দ্রস্থলে গিয়ে তাঁর পরম স্থিতি ঘটে— অর্থাৎ নির্বিকল্প স্থিতি। শক্তির এক একটি চক্রভেদের সঙ্গে সঙ্গে সাধকের নতুন নতুন আনন্দানুভূতি হতে থাকে। কুণ্ডলিনীকে সহস্রারের কূটস্থানে নিয়ে যাওয়া হলে সাধক পরম শান্তি লাভ করেন। এই শান্ত স্থানই উপনিষৎ বর্ণিত পরমাত্মা , যাকে বােঝানাে হয়ে , এই ধরনের বাক্য প্রয়ােগ করে — ' শান্তো ইয়ম আত্মা' । অর্থাৎ এই আত্মা , পরম শান্ত । তান্ত্রিকেরা বা যােণীরা শক্তির উত্থান ও গতিকে বিচিত্র স্পন্দনাত্মক বিদ্যুৎ প্রবাহের মতো বলে বর্ননা করেছেন ।


জীবাত্মা কে মূলাধার থেকে গুটিয়ে ভ্রুদলের মধ্যে অক্ষর পুরুষ বা কূটস্থ চৈতন্যের সঙ্গে মিলন করতে সক্ষম হলেই সেটি হবে শিব ও শক্তির অথবা বৈষ্ণবগনের রাধা-কৃষ্ণের মিলন।


আত্মোপলব্ধির পথে সাধককে জ্ঞানের যে সাতটি স্তর অতিক্রম করতে হয় তাঁর ক্ষুদ্র ব্যাখা নিম্নরূপ ---


১) ভুঃ লোক (মূলাধার) - পার্থিব জগতের কম্পন…….


২) ভুবঃ লোক (স্বাধিষ্ঠান) - তেজ ও বৈদ্যুতিক গুনাবলীর কম্পন……


৩) স্বঃ লোক (মনিপুর) - চুম্বকের আবেশ ও বৈদ্যুতিন শক্তির কম্পন…….


৪) মহঃ লোক (অনাহত) - চৌম্বিক পরমানুর কম্পন…..


৫) জন লোক (বিশুদ্ধাখ্য) - অন্তঃ চৈতন্যের আভাস কম্পন……


৬) তপঃ লোক (আজ্ঞাচক্র ) - চিদাভাস চৈতন্য ওঁ-কার এর কম্পন বা অন্তর দেবতার দর্শন…….


৭) সত্য লোক (সহস্রার) - বিশুধাত্মাচৈতন্যের বা শ্রীভগবানের দর্শন…….


ষটচক্রঃ

-----

১। মস্তিষ্কে কর্পুর বর্ণ সহস্রদল - সহস্রার পরমাত্মার স্থান। 


২। ভ্রু-যুগল মধ্যে বিদ্যুৎ বর্ণ দ্বিদল - আজ্ঞাচক্র, আত্মার স্থান।


৩। কণ্ঠে ষোড়শ দল ধূম্রবর্ণ - বিশুদ্ধ চক্র, প্রাণের স্থান।


৪। হৃদয়ে পীতবর্ণ দ্বাদশদল - অনাহতচক্র, শিবের স্থান।


৫। নাভিমধ্যে নীলবর্ণ দশদল - মনিপুরচক্র, বিষ্ণুর স্থান।


৬। লিঙ্গমূলে রক্তবর্ণ ষড়দল - স্বাধিষ্ঠানচক্র, ব্রহ্মার স্থান।


৭। লিঙ্গ ও গুহ্য দেশের মধ্যভাগে স্বর্ণবর্ণ চতুর্দল - মূলাধারচক্র, বিঘ্ন বিনাশন গণপতির স্থান।


হিন্দুরা যেমন দেহের মেরুদণ্ড বা সপ্তচক্র ইত্যাদির কল্পনা করেছেন , বৌদ্ধরাও তেমন দেহের মধ্যে চারটি চক্রের কল্পনা করেছেন। যেমন- নাভিতে নির্মাণচক্র , হৃদরে ধর্মচক্র , কণ্ঠে সম্ভোগচক্র ও ' সহস্রারে মহাসুখ চক্র । নির্বাণচক্রে আছে ভগবান বুদ্ধের সম্ভোগ  কায়া । এবং মহাসুখচক্রে পরম প্রশান্তি । হিন্দু তন্ত্র ও বৌদ্ধ তন্ত্র উভয়েই মনে করে যে , মানবদেহ হল মহাবিশ্বেরই ক্ষুদ্র সংস্করণ মাত্র।  মহাবিশ্বের সকল সত্য এই মানবদেহের মধ্যেই আছে । মেরুদণ্ডের বাম ও ডান দিক দিয়ে দুটি নাড়ি বয়ে গেছে , যাকে বলে ইড়া ও পিঙ্গলা । কেউ বলেন চন্দ্র ও সূর্য । মেরুদণ্ডের মধ্য দিয়ে সে নাড়ি বয়ে গেছে , তাকে বলে সুষুম্না । বৌদ্ধরা এই নাভিকে বলেন অবধূতিকা । বৌদ্ধদের মতে এই অবধূতিকা দিয়েই বােধিচিত্ত ঊধ্বদিকে অগ্রসর হয়ে চক্রে চক্রে ভিন্ন ধরনের স্বাদ অনুভব করেন । যে শক্তি এই চক্রগুলাের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বিচিত্র ধরনের আনন্দের শিহরণ দেন , সেই শক্তিই হিন্দুদের কুলকুণ্ডলিনী শক্তি বা বৌদ্ধদের দেবী । এই শক্তি যখন প্রথম নির্মাণচক্রে ওঠেন , তখন অকস্মাৎ প্রজ্জ্বলিত অগ্নির মতো দাহ , অনুভব করা যায়। । শক্তি তথন চন্ড স্বভাবা । সেইজন্য বৌদ্ধরা শক্তির এ অবস্থাকে চন্ডালী বলে বর্ণনা করেছেন ।


ইন্দ্রিয়শক্তি দ্বারা তাকে বােঝা যায় না বলে ডােম্বী নামেও অভিহিত করা হয়েছে।  এই ডোম্বীর অবস্থান দেহরূপ নগরের বাইরে। আচার - বিচার পাণ্ডিত্যাভিমান দ্বারা এ সঙ্গ লাভ করা যায় না ।  সকল অবরণ শূন্য হলে তাবেই এর সঙ্গ লাভ করা যায় । এই শক্তিকে মাতঙী, চণ্ডালী,  শবরী , কিরাতী ইত্যাদি আখ্যাতেও ভূষিত করা হয়েছে । বৌদ্ধ চর্যাপদে এই নিয়ে অনেক মরমিয়া সঙ্গীতও আছে । বহু হিন্দু যােগী ধ্যানকালে চক্রে চক্রে,  শাস্ত্রের বর্ননা অনুযায়ী কল্পনা করে এই শক্তিকে সাধনা করতে বলেন । কিন্তু এ অতি মিথ্যা ধারণা । এর দ্বারা কোনাে উদ্দেশ্য সাধিত হয়।  শক্তির জাগরণও হয় না । এই শক্তিকে জাগরিত করার সহজ পথ আছে।

কুন্ডুলিনী রহস্য (২য় পর্ব)


মনসংযােগ করলে সেই শাস -প্রশ্বাস রূপ বায়ু অত্যন্ত সূক্ষ্ম হয়ে যায় । বায়ু যত সূক্ষ্ম হয়, তার আঘাত করার ক্ষমতা তত বেশি হয় । ফলে দেহের মৌলশক্তি বেশি পরিমাণে নির্গত হয় । মুলাধারস্থ মৌলশক্তি ব্যারােমিটারের পারার মতো উর্ধ্বে উঠতে থাকে । সমগ্র বিশ্ব যেমন বিশেষ একটি কেন্দ্র থেকে বিস্ফোরণজনিত বেগে ছড়িয়ে পড়েছিল এবং প্রান্তে এসে স্থূল  বস্তুসত্তার মধ্যে চুপ কর আছে , দেহের শক্তিও তেমনই ব্রক্ষ্মরন্ধ্র থেকে মূলাধারে এসে স্থির হয়ে আছে । এই শক্তি যেমন বিশ্বে সূক্ষ্ম থেকে কম সূক্ষ্ম অবস্থায় ধাপে ধাপে সূক্ষ্মতার পথে নেমে এসেছিল , দেহ-বিশ্বেও শক্তি তেমনই সহস্রার থেকে নেমে এসে ক্রমশ স্থূল চেতনায় স্থির হয়ে আছে । কিন্তু জড়-অজড়  সর্বত্রই তার একটা স্পন্দন আছে। ইদানীং বিজ্ঞানের সূক্ষ্ম যন্ত্র তা ধরাও পড়েছে। যেভাবে বিশ্ব কেন্দ্র থেকে প্রান্তভাগের স্থূল জগতের দিকে নেমে এসেছিলো সেইভাবে দেহ-বিশ্বে শক্তি সহস্রারের কেন্দ্রস্থল থেকে প্রান্তভাগের স্থূল চেতনার দিকে নেমে এসেছে। বিশ্বের স্থূল প্রান্তভাগ থেকে  উৎসের দিকে ফিরে গেলে যেমন স্থূল থেকে সূক্ষ্মতর অবস্থায় জগতকে দেখা যাবে , দেহ - বিশ্বের মৌলশক্তি কুলকুণ্ডলিনী তেমনই মূলাধার থেকে সহস্রারের দিকে ফিরে যাবার পথে ক্রমশ সূক্ষ্মতর জগতের চিত্রগুলি আমাদের মানসনেত্রের কাছে তুলে ধরে । 


যথাযথ নিয়মে মনসংযােগ করে চুপ করে বসে থাকলেই মূলাধারস্থ কুণ্ডলিনী শক্তি ক্রমশ উর্ধ্ব দিকে উঠতে থাকে । বিভিন্ন চক্রে নিম্ন থেকে উর্ধ্বদিকে যে শক্তিতরঙ্গ আছে তা তরঙ্গের চরিত্র অনুযায়ী সাধকের মানসনেত্রে ভিন্ন ভিন্ন বর্ণ ও দৃশ্য তুলে ধরে । মুলাধারস্থ শক্তি শ্বাস দ্বারা তাড়িত হয়ে উর্ধ্ব দিকে উঠতে থাকলে প্রথম ওঠে পেট দিয়ে । বায়ু তখন দেহকে দোলাতে থাকে । পরে বায়ু দেহচক্রের সুষুম্না নাড়ির মধ্য দিয়ে বইতে থাকে । তখন দেহে  কম্পন অনুভূত হয় । পেট দিয়ে বায়ু ওঠার সময় যে ধরনের কম্পন হয় , তাকে দোলানী বলা যেতে পারে । কিন্তু মেরুদণ্ডের ভেতর দিয়ে বায়ু বা বায়ুতাড়িত শক্তি ওঠার সময় যে কম্পন অনুভূত হয় , তাকে ইংরেজিতে ট্রেম্বলিং বলা হয়।  মেরুদণ্ডের গাঁটে গাঁটে আবর্জনা জমে থাকে । শক্তি উর্ধ্বে ওঠার সময় এই আবর্জনাগুলিকে ধাক্কা মেরে সরিয়ে দেবার চেষ্টা করে । তার ফলে দেহ কেঁপে কেঁপে ওঠে । যতক্ষণ পর্যন্ত না মেরুদণ্ডের সব গাঁটের আবর্জনা দূর হয় , ততক্ষণ পর্যন্ত দেহ কেঁপে কেঁপে ওঠে। আবর্জনা দুর হয়ে গেলে বায়ুবাহিত শক্তির ওঠার পথ পরিষ্কার হয়ে যায় । তখন বায়ু অতিসহজেই উপরের দিকে উঠে সরাসরি মস্তিষ্ক - মণ্ডলে চলে যায় । বায়ুর চাপে মস্তিষ্ককে তখন একটা ফুটবলের ব্লাডারের মতাে মনে হয় । এই ব্লাডার বা বেলুন উপরে উঠে যেতে চায় । তার ভাসমানতা এমন এক হালকা ভাব প্রাপ্ত হয় যে , মনে হয় সমস্ত দেহটাকে নিয়ে সে উপরের দিকে উঠে যাচ্ছে । অনেক সময় দেহ সত্যি সত্যি উপরে উঠে যায় । যােগে এই অবস্থাকে বলে ভূমিত্যাগ ।


যােগে তিনটি অবস্থা আছে । যখন কিছুতেই মন স্থির হয়ে বসতে চায় না , উসখুস করে , সেই অবস্থাকে বলে ঘর্ম । যখন বায়ুতাড়িত শক্তি পেট বা মেরুদণ্ড দিয়ে উঠে দেহে আলোড়ন সৃষ্টি করে , তখন তাকে বলে কম্পন । বায়ু , মস্তিষ্কে উঠে দেহকে ওপরের দিকে তুলে নিলে তাকে বলে ভূমিত্যাগ । ভুমিত্যাগই যোগের চরম প্রাপ্তি ।


শক্তি এক - একটা চক্ৰে উঠলে এক - একরকম বােধ , বর্ণ দর্শন ও চিত্র দর্শন হয়। দেহের মধ্যে এক - একটা চক্রের এক - একরকম কাজ । মূলাধারে কুণ্ডলিনীশক্তি দেহের প্রাণশক্তি হিসেবে কাজ করে । স্বাধিষ্ঠানে এই শক্তি প্রজনন শক্তিক্রিয়া হিসেবে দেখা দেয় । কুলকুণ্ডলিনী শক্তি আধিষ্ঠানে যৌন আবেগ , প্রজনন ক্ষমতা ও পার্থিব সৃষ্টির প্রেরণা দেয় । মণিপুরচক্ৰে কুলকুণ্ডলিনী ইচ্ছাশক্তির সৃষ্টি করে । অনাহতচক্রে কুশুলিনী প্রেম বা ভালােবাসার সৃষ্টি করে । এই শক্তিই বিশ্বব্রহ্মশুকে ধরে রেখেছে । বিশুদ্ধ চক্রে কুণ্ডলিনী চিন্তাশক্তিকে শক্তিশালী করে । কুলকুণ্ডলিনী আজ্ঞাচক্রে উপস্থিত হলে মানুষের অন্তর্দৃষ্টি , অনুভবশক্তি ও আত্মিক ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। এই শক্তি যখন সহস্রারে গিয়ে উপস্থিত হয়, তখন মানুষের জ্ঞান জগত থেকে অজ্ঞান জগতে গিয়ে উপস্থিত হয়। মানুষ ঐশ্বরিক জগতের সন্ধান পায় । এই সহস্ৰারের উর্ধ্বেও অনেকে আরো একটি চক্রের কল্পনা করেছেন।  একে বলে স্টারচক্র ? এর অবস্থান স্থূলদেহের চার ইঞ্চি ওপরে , যাকে সূক্ষ্মদেহ বা বায়াে প্লাজমিক বড়ি বলা হয় । এই চত্ৰ সেই সূক্ষ্মদেহে থাকে । এখান থেকে কুণ্ডলিনীশক্তি মানুষের দেহের জেনেটিক কাঠামাে ঠিক করে দেয় । বিশ্বের সকল অভিজ্ঞতা এখানেই জমা থাকে।


ক্রিয়াযােণগীরা মনসংযোগ করে এই শক্তিকে উপরে ওঠালে যে অভিজ্ঞতা হয় , তা এইরকমঃ কুলকুণ্ডলিনী মূলাধারচক্রে জাগ্রত হলে মানসনেত্রে রক্তিম বর্ণ দেখা যায় । এখানে অনেক ছায়া - ছায়া ছবি ভেসে ওঠে । এগুলি অস্পষ্ট ভৌতিক ছবি । কিছুটা বাইরের স্থূল জগতের শক্তিতরঙ্গের সঙ্গে যােগীর মানসতরঙ্গের সমতা হেতু পার্থিব চিত্রের প্রতিফলন ।

কুণ্ডলিনী শব্দটি দ্রাবিড় শব্দ । ' কুল ' অর্থ দ্রাবিড় ভাষায় শক্তি । কুন্ড অর্থ গর্ত । লিঙ্গমূল ও ওহ্যদেশের মাঝখানে কোথাও এই গর্ত আছে । গর্তটি এত সূক্ষ্ম যে , পরীক্ষা - নিরীক্ষা করেও এর অক্তিত্ব ধরা যায়নি । সেখানেই দেহের মৌলশক্তি বিরাজ করে। ব্যাপারটিকে অসম্ভব মনে হলেও অবিশ্বাস্য না । বিজ্ঞানীরা ইদানীংকালে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের উৎপত্তি যে ক্ষেত্র থেকে হয়েছে , তাকে অণুর কেন্দ্র অপেক্ষাও ছােট মনে করেন । সেখান থেকেই এত বড় বিশ্বের উদয় হয়েছে । দেহ - বিশ্বের সকল শক্তির আধারও তেমনই  ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র একটি বিন্দু মাত্র । এখান থেকে যে তেজ উৎসারিত হয় , তা - ই মানবদেহকে উউজ্জীবিত রাখে । আমাদের শ্বাস - প্রশ্বাস সেই ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র আধারে গিয়ে আঘাত করে । ফলে সেখান থেকে যে তাপ নির্গত হয় তাই আমাদের দেহের সাধারণ তাপ হিসাবে কাজ করে ।


কুন্ডলিনী রহস্য

(৩য় পর্ব)


কুলকুণ্ডলিনী স্বাধিষ্ঠান চক্রে উঠলে প্রথম সবুজাভ একটি বৃত্ত লক্ষ্য করা যায় । সেই বৃত্ত ছড়াতে ছড়াতে ক্রমশ ছায়া ছায়া একটি তরল জাতীয় ভাব সৃষ্টি করে । এতে বহু ছায়ামূর্তি কে বিচরণ করতে দেখা যায় । প্রকৃতপক্ষে , এই দুইটি স্তর হল মৃত্যুর পর সূক্ষ্মদেহীদের সূক্ষ্মদেহের বিচরণ ক্ষেত্র । এখানে স্থূল দৈহিক সত্তা সূক্ষ্মতাপ্রাপ্ত হলেও মানসিক্তার মধ্যে স্থূলতার গন্ধ লেগে থাকে । জীবের সূক্ষ্ম সত্তা এখানে আকাঙ্ক্ষার তাড়নায় বিভ্রান্ত হয়ে ঘুরে বেড়ায় । মণিপুরচক্রে উঠলে কুন্ডলিনীশক্তি গ্রীষ্মের মধ্যাহ্ন আকাশের মতো আকাশের দৃশ্য দেখায়। সাদাটে মেঘের ফাঁকে কিছু নীলাভ ইঙ্গিত মনসনেত্রে, ধরা পড়ে । এখানেও বহু সূক্ষ্ম প্রাণীকে ঘুরে বেড়াতে দেখা যায়। মানুষ এই তিনটি স্তর মৃত্যুর পর পার্থিব কামনা বাসনা দ্বারা তাড়িত হয় বলে এবং স্থূলদেহের অভাবে ভোগবাসনা চরিতার্থ করতে পারে পারেনা বলে মানসিক যন্ত্রণা বোধ করে । তবে এই তিনটি স্তর যে শুধু সুক্ষ্মদেহীদের জগতই দর্শন করায় তা নয় , মানসতরঙ্গের সঙ্গে স্থূলজগতের সমতাহেতু বহু স্থূল পার্থিব দৃশ্যও দেখায় । একেই বলে টেলিপ্যাথিক ভিশন। 


শক্তি , অর্থাৎ কুলকুণ্ডলিনী –এর উপরে উঠলে ছেঁড়া মেঘের ফাঁকে  ফাঁকে অদ্ভুত অদ্ভুত সুন্দর নীল আকাশ দেখা দেয়।  তাতে মিটি মিটি তাঁরাও ফুটে থাকতেও দেখা যায় । এখানে অদ্ভুত একটা প্রশান্ত হাওয়া বইছে , এমন মনে হয়।  এখানে যেসব মানবাত্মার চিত্র লক্ষ্য করা যায় , তাদের প্রশান্ত ভঙ্গিতে দেখা যায় । মাঝে মাঝেই কিছু অগ্নিগােলককেও ছুটে যেতে দেখা যায় । হয়তো মহাবিশ্বে ছুটে চলা কোনো গ্যালাক্সি বা ছায়াপথ হাবে এগুলাে । অনেক সময় স্পষ্টভাবে ভিন্ন কিছু গ্রহের চিত্রও ফুটে ওঠে। দেখা যায় উত্তাল তরঙ্গে তরঙ্গিত সমুদ্র , বড় বড় গাছ , ধূসর পাহাড় , নতুন কোন গ্রহের নানা রঙের  আকাশ -— এইসব । অদ্ভুত কিছু জীবন্ত প্রাণী ও লক্ষ্য করা যায়।  তাদের অনেকেই পশুস্তরীয়, অনেকেই দেবস্তরীয়। পার্থিব কল্পনার দেবদেবীদের সঙ্গে তাদের মিল লক্ষ্য করে মনে হয় সাধু-সন্তেরা  দেব - দেবীর কল্পনা মানসজগতে এই দর্শনের ফলেই করেছিলেন । তাঁদের দেবদেবীর কল্পনা মোটেই ভিত্তিহীন নয়। তবে এটাও সত্য যে , কতকগুলি যথার্থ অনুভূতিকে তারা পৌরাণিক কাহিনীর গল্প তৈরি করে বর্ণনা করেছিলেন — যে কাহিনীগুলির বক্তব্য আধুনিক বিজ্ঞানের ফলশ্রুতির সঙ্গে মিলে যাচ্ছে । যেমন ব্রহ্মা বিষ্ণু মহেশ্বররুপী ত্রিদেবের কল্পনা ।



কুলকুণ্ডলিনী শক্তি বিশুদ্ধচক্রে উঠলে নীলবর্ণ গভীর হয়। এখানে বহু প্রাচীন মুনি ঋষিদের ঘুরে বেড়াতে দেখা যায় । এদের অনেককেই পঠনজনিত জ্ঞানের আলােতে দেখা যায় । মানুষের কর্মফলও অনেক সময় বিভিন্ন চিত্র তৈরি করে রাখে । সেগুলি দেখে মানুষ ও ইতিহাস সম্পর্কে ভবিষ্যৎবাণী করা যায়। এইভাবেই অনেকে ভবিষ্যৎবাণী করে গেছেন ।



কুলকুণ্ডলিনী আজ্ঞাচক্রে উঠলে প্রচণ্ড বিস্ফোরণজনিত আলাের বিকিরণ ঘটে। এই অঞ্চল পার হলেই দিব্যজগতে প্রবেশ করা যায় । সহস্রার অঞ্চলই হলো দিবজগতের অঞ্চল । এই সহস্রারের তিনটি পর্যায় আছে । নিম্ন থেকে উধর্ব দিকে এই স্তরগুলিকে বলা যায় – আনন্দ , চিৎ ও সৎ - এর স্তর । আনন্দ স্তরে জ্যোতিরূপ - আলাে দশদিন হয় । এখানে ভিন্ন কোনাে দৃশ্য নজরে পড়ে না । কারণ এই আলোই হল অপরিচিছন্ন আলাে , যা থেকে নিম্নতর পর্যায়ে পরিচ্ছিন্ন সৃষ্টি আত্মপ্রকাশ করেছে । এর ঊধে দর্পণ - সদৃশ একটি স্বচ্ছ স্তর আছে। একে চিৎ - স্তর বলে । চিৎশক্তি এখানেই দ্বিতীয় বিহীন একের বােধ অনুভব করেছিল। এর ঊর্ধ্বে নিস্তরঙ্গ নিস্তব্ধ প্রশান্ত অন্ধকার , যাকে বলা হয় সৎ - এর স্তর বা পর্যায় , সহস্রারের কূটস্থ নিগুণ ব্রহ্মাণের পর্যায় । চিৎশক্তি ক্রিয়াশীল হবার আগে শক্তি এখানেই স্তব্ধ হয়ে ছিল । চিৎশক্তি ক্রিয়াশীল হলেই তিনি চিৎরুপিণী কুলরূপে অর্থাৎ শক্তিরূপে বিশ্বসৃষ্টিতে প্রকট হন । আদিতেও তিনি ছিলেন কূটস্থানের গর্তে বা গর্ভে অর্থাৎ কুণ্ডে । জগৎ সৃষ্টি হবার পর প্রতিটি সত্তাতে মৌল শক্তি হিসেবে সেই কুণ্ড বা গর্তেই স্তব্ধ হয়ে থাকেন । সেই জন্যই তাঁর ঊধর্বগতি বা অধঃগতি উভয় গতিতেই তিনি কুণ্ডলিনী । প্রকাশের সময় তিনি একে একে প্যাঁচ খুলে বিশ্বব্রক্ষ্মান্ড

রুপে প্রকাশিত হন । প্রান্তভূমি থেকে জাগরণের পর ঊর্ধ্বগতিতে তিনি গােটাতে গােটাতে উৎসে ফিরে চলেন । পরিণতি ও উৎস — উভয় ক্ষেত্রেই তিনি কুণ্ডে থাকেন । তার প্রকাশ ও অন্তর্ধান উভয় পথেই প্যাঁচ খােলা ও প্যাঁচ গােটানাের ব্যাপার আছে । সেই জন্যই সাধকেরা তাকে কুলকুণ্ডলিনী বা সর্প হিসেবে কল্পনা করেছেন ।



আমাদের শরীরের মধ্যে অসংখ্য নাড়ী আছে, তার মধ্যে ১৪টি প্রধান। এগুলো হলো- ইড়া, পিঙ্গলা, সুষুম্না, সরস্বতী, বারূণী, পূষা, হস্তিজিহ্বা, যশস্বিনী, বিশ্বোদরী, কুহূ, শঙ্খিনী, পরদ্বিণী, অম্লম্বুষা ও গান্ধারী। জননেন্দ্রিয় ও গুহ্যদেশের মাঝখানে অবস্থিত কুন্দস্থান থেকে ইড়া, পিঙ্গলা, সুষুম্না, কুহূ, শঙ্খিনী প্রভৃতি প্রধান নাড়ীগুলোর উৎপত্তি হয়েছে। এদের মধ্যে কুহূনাড়ী জননেন্দ্রিয়ের সমস্ত কাজ সুসম্পন্ন করে আর শঙ্খিনী নাড়ী দেহের মলাদি নির্গমনে সহায়তা করে। এই কুন্দস্থানেই কুলকুণ্ডলিনী নিদ্রিত সাপের আকারে বিরাজ করছেন। কুলকুণ্ডলিনী হচ্ছে সমস্ত শক্তির আধার। প্রাচীনকালের সিদ্ধিপ্রাপ্ত যোগী-ঋষিরা মানবদেহ ও মনের কুণ্ডলিত শক্তি-উৎস সম্পর্কে প্রতীকী ব্যঞ্জনায় যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন সে মত অনুসরণ করেই যুগে যুগে সাধকপুরুষরা যোগসাধনায় ব্যাপৃত থেকে এই শক্তিকে জাগরিত করে সিদ্ধিলাভের অন্বিষ্ট খুঁজেছেন।

কুন্ডলিনী রহস্য 

(৪র্থ পর্ব)


বলা হয়ে থাকে, আমাদের শরীরের মধ্যে মৃণালতন্তুর ন্যায় সূক্ষ্ম জগন্মোহিনী আদ্যাশক্তি ও প্রাণশক্তির মূল কুলকুণ্ডলিনী শক্তি নিজের মুখব্যাদান করে ব্রহ্মদ্বারের মুখ আবৃত করে জননেন্দ্রিয় ও গুহ্যদেশের মধ্যবর্তী কুন্দস্থানে সর্বদা নিদ্রিত রয়েছেন। এ স্থানকে বলে মূলাধারচক্র। এটা সুষুম্না নাড়ীর একটি গ্রন্থি। আমাদের স্নায়ুরজ্জুর প্রধান ধারক মেরুদণ্ড মস্তিষ্কের নিম্নাংশ থেকে বের হয়ে গুহ্যদেশে এসে শেষ হয়েছে। যোগ-শাস্ত্রকারীদের মতে মেরুদণ্ডের বাঁদিকে ইড়া (Ida Nadi), মধ্যে সুষুম্না (Sushumna Nadi) ও ডানদিকে পিঙ্গলা (Pingala Nadi) নাড়ী বিরাজমান। আমাদের সঞ্চারণমান প্রাণবায়ু ইড়া-পিঙ্গলা নাড়ীর মধ্যে দিয়ে চক্রাকারে সতত আবর্তিত হচ্ছে। সুষুম্না একটি অতি সূক্ষ্ম, জ্যোতির্ময়, সূত্রাকার ও প্রাণময় পথ- মেরুদণ্ডের পথে যার অবস্থান। সুষুম্না নাড়ীর এই প্রাণময় পথে ছয় স্থানে ছয়টি চক্র বিরাজ করছে, যাকে ষট্চক্র বলা হয়।

বিমুক্তিসোপান গ্রন্থে বলা আছে-

"গুহ্যেলিঙ্গে তথা নাভৌ হৃদয়ে কণ্ঠদেশকে।

ভ্রূমর্ধ্যহেপি বিজানীয়াৎ ষট্চক্রান্তু ক্রমাদিতি।।"

অর্থাৎ, ভ্রূমধ্যে, কণ্ঠদেশে, হৃদয়ে, নাভিমূলে, লিঙ্গদেশে ও গুহ্যস্থানে ষট্চক্র বিরাজ করেন।

এই ষট্চক্র হচ্ছে, 

ললাটে অর্থাৎ ভ্রূমধ্যে আজ্ঞাচক্র (Agnya Chakra),

আজ্ঞাচক্রের নিচে কণ্ঠমূলে বিশুদ্ধিচক্র (Vishuddhi Chakra),

বিশুদ্ধিচক্রের নিচে হৃদিস্থানে অনাহত চক্র (Anahata Chakra),

অনাহত চক্রের নিচে নাভিমূলে নাভিচক্র বা মণিপুর চক্র (Nabhi Chakra/Manipura Chakra),

মণিপুর চক্রের নিচে লিঙ্গমূলে সুষুম্নার মধ্যে স্বাধিষ্ঠান চক্র (Swadhisthana Chakra),

স্বাধিষ্ঠান চক্রের নিচে গুহ্য ও লিঙ্গের মধ্যস্থলে কুন্দস্থানে সুষুম্নানাড়ীর মুখদেশে মূলাধারচক্র (Mooladhara Chakra)। এই মূলাধার প্রদেশেই মুখব্যাদান করে ব্রহ্মদ্বারে সর্পাকৃতি কুলকুণ্ডলিনীর অধিষ্ঠান।

সুষুম্নার এই সূক্ষ্ম, জ্যোতির্ময়, সূত্রাকার ও প্রাণময় পথই মুক্তির পথ। মুক্তির এই পথ দিয়েই কুণ্ডলিনীকে উর্ধ্বদিকে চালিত করতে হয়। কুণ্ডলিনীর অবস্থান সম্বন্ধে সিদ্ধ-যোগীদের বক্তব্য হচ্ছে- ‘মেরুদণ্ডের নিম্নদেশে যে মূলাধার চক্র আছে তা খুব গুরুত্বপূর্ণ। এই স্থানটি হচ্ছে প্রজননশক্তি বীজের আধার। একটি ত্রিকোণ মণ্ডলে একটি ছোট সাপ কুণ্ডলী পাকিয়ে আছে- যোগীরা এঁকে এই প্রতীকে প্রকাশ করেছেন। এই নিদ্রিত সর্পই কুণ্ডলিনী; এঁর ঘুম ভাঙানোই হচ্ছে রাজযোগের একটিমাত্র লক্ষ্য।’

কুণ্ডলিনীকে জাগরিত করার উপায় হিসেবে স্বামী বিবেকানন্দ বলেন- ‘ প্রাণায়ামের পূর্বে ঐ ত্রিকোণ মণ্ডলকে ধ্যানে দেখবার চেষ্টা কর। চোখ বন্ধ করে এঁর ছবি মনে মনে স্পষ্টরূপে কল্পনা কর। ভাবো এর চার পাশে আগুনের শিখা, তার মাঝখানে কুণ্ডলীকৃত সর্প ঘুমিয়ে রয়েছে। ধ্যানে যখন কুণ্ডলিনীশক্তি স্পষ্টভাবে দেখতে পাবে তখন কল্পনায় তাকে মেরুদণ্ডের মূলাধারে স্থাপন কর; এবং তাকে অনুভব করার চেষ্টা কর। প্রাণায়ামসহ বিভিন্ন মুদ্রা ও বন্ধন অভ্যাস কালে কুম্ভকে শ্বাস রুদ্ধ রাখার সময় সুপ্ত কুণ্ডলিনীকে জাগাবার জন্যে ঐ রুদ্ধ বায়ু সবলে তার মস্তকে নিক্ষেপ করবে। যার কল্পনা শক্তি যত বেশি সে তত শীঘ্র ফল পায়, আর তার কুণ্ডলিনীও তত শীঘ্র জাগেন। যতদিন তিনি না জাগেন ততদিন কল্পনা কর- তিনি জাগছেন। আর ইড়া ও পিঙ্গলার গতি অনুভব করার চেষ্টা কর, জোর করে তাদের সুষুম্না পথে চালাতে চেষ্টা করো- এতে কাজ খুব তাড়াতাড়ি হবে। মনের সংযমের দ্বারাই কল্পনা করা সম্ভব।’

মহাসর্প অনন্ত যেমন রত্ন-নিধিসমাকীর্ণা পৃথিবীর একমাত্র আধার, তেমনি কুণ্ডলিনী শক্তি হঠ্তন্ত্রের আধার। ঐ কুণ্ডলিনী শক্তি জাগরিতা হলে শরীরে ষট্চক্রস্থিত অখিল পদ্ম ও গ্রন্থি ভেদ হয়ে যাওয়ায় প্রাণবায়ু সুষুম্নাচ্ছিদ্র দিয়ে অনায়াসে যাতায়াত করতে পারে। প্রাণায়াম অভ্যাসে যা বিশেষ প্রয়োজন।

প্রণয়মূলক চিন্তা বা পাশব-কার্য থেকে যে যৌনশক্তি উত্থিত হয়, তাকে উর্ধ্বদিকে মানব শরীরের মহাবিদ্যুৎ আধার মস্তিষ্কে প্রেরণ করতে পারলে সেখানে সঞ্চিত হয়ে যৌনশক্তি ‘ওজঃ’ বা আধ্যাত্মিক শক্তিলাভে সাহায্য করে। এই ‘ওজস’ হচ্ছে মানুষের মনুষ্যত্ব- একমাত্র মনুষ্যশরীরেই এই শক্তি সঞ্চয় করা সম্ভব। যাঁর ভেতর সমস্ত পাশব যৌনশক্তি ওজঃশক্তিতে পরিণত হয়ে গেছে, তিনি মহাপুরুষ বা দেব পর্যায়ে উন্নীত হন।

কুন্ডলিনী রহস্য

(৫ম পর্ব)


যোগীরা মনে মনে কল্পনা করেন যে এই কুণ্ডলিনী সর্প সুষুম্না পথে স্তরে স্তরে চক্রের পর চক্র ভেদ করে মস্তিষ্কের সহস্রধারে (Sahastrara Chakra) উপনীত হয়। মনুষ্য শরীরের শ্রেষ্ঠ শক্তি যৌন-শক্তি যে পর্যন্ত না ওজঃশক্তিতে পরিণত হয়, সে পর্যন্ত নারী বা পুরুষ কেউই ঠিক ঠিক আধ্যাত্মিক জীবন লাভ করতে পারে না।

কোন শক্তিই সৃষ্টি করা যায় না, তবে তাকে শুধু ঈপ্সিত পথে চালিত করা যেতে পারে। এটাই রাজযোগের উদ্দেশ্য। একমাত্র যোগীরাই যোগ প্রভাবে এই সমস্ত নাড়ী সম্বন্ধে সবিশেষ জানতে পারেন এবং তা অনুভবও করেন। রাজযোগ অভ্যাস করতে হলে প্রথমে হঠযোগ আয়ত্তে আনতে হয়। হঠযোগই রাজযোগের সোপান। আর এই হঠযোগের একটা বিরাট অংশ হলো অষ্টাঙ্গযোগ (Astanga Yoga)। কারণ এর অঙ্গ হলো আটটি-

(১) যম (Yama),

(২) নিয়ম (Niyama), (৩) আসন (Asana), (৪) প্রাণায়াম (Pranayama),

(৫) প্রত্যাহার (Pratyahara),

(৬) ধারণা (Dharana),

(৭) ধ্যান (Dhyana) ও (৮) সমাধি (Samadhi)


তবে সাধারণ চর্চাকারীদের জন্য মূলত প্রথম চারটি অঙ্গের নির্বাচিত অংশই অভ্যাস করা বাঞ্ছনীয়।


ক্রিয়াযােগ অভ্যাস ও কুন্ডলিনী জাগরণের মধ্যে খুব নিকট সম্পর্ক আছে । মূলাধারের অবস্থান , মেরুদণ্ডের উপর পায়ুদেশের দুই আঙ্গুল উপস্থের ( জননেন্দ্রিয় ) চার আঙ্গুল নীচে । মূলাধারে ত্রিকোণ এক অবস্থানের মধ্যে অতি উজ্জ্বল প্রকাশমান দিব্য দ্যুতিকে কুণ্ডলিনী শক্তি বলেন । তন্ত্রশাস্ত্রে যেই কুণ্ডলিনী জাগরণের অভিজ্ঞতা বলা হয়েছে , ক্রিয়াযােগের ক্ষেত্রে সেটা অনেক সৌম্য । কুণ্ডলিনী শক্তি সুষুম্নার মধ্যে প্রাণ শক্তির আধার । ক্রিয়াবানগণ কুণ্ডলিনী শক্তিকে সুষুস্মার মধ্যে এক অতি উজ্জ্বল সােনালী আলাের প্রকাশমান অভিজ্ঞতা লাভ করেন। সাধক মূলাধারে , অগ্নির প্রকাশ অবলােকন করেন । কুণ্ডলিনী শক্তি প্রকৃত " অর্থে সত্ত্ব , রজ ও তমো এই তিনগুণ বিশিষ্ট মাতৃশক্তি , তিনিই প্রকৃতিরূপা ব্রহ্মশক্তি । মানুষের আধ্যাত্মিক অবচেতনার মূল কারণ হচ্ছে তার কুণ্ডলিনী শক্তির , মূলাধার চক্র জড়বৎ সুপ্ত থাকা । প্রাণশক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করার মূলমন্ত্র হচ্ছে কুলকুণ্ডলিনী জাগ্রত করা । প্রাণ নিয়ন্ত্রণের উপায় হচ্ছে , ক্রিয়া করা । কুণ্ডলিনী শক্তিই সমগ্র শরীরে প্রাণরূপ বায়ুর সঞ্চালন করে । মেরুদণ্ডের মধ্যে মূলাধার থেকে সহস্রার এবং সহস্রার থেকে মূলাধার , প্রাণ বায়ুর সঞ্চালিনী ক্রিয়া করে সাধক চূড়ান্ত ধ্যানের অবস্থা প্রাপ্ত করে । এটাই ক্রিয়াযােগের অন্তর্নিহিত গোপন রহস্য ।


তন্ত্রে কথিত আছে যে , কুণ্ডলিনীই জীবনদায়ী শক্তি । যা দেবী বায়বী শক্তি । তিনি জীবনদায়ী বায়ু শক্তির দেবী । ক্রিয়ার নিরন্তর অভ্যাসের দ্বারা মন লয়ের স্থিতি প্রাপ্ত হয় । ক্রিয়ার দ্বারা কুণ্ডলিনী নিম্নদেশ থেকে উর্ধ্বে  ও ঊর্ধ্বদেশ থেকে নিম্ন পর্যপ্ত চলাচল করে । শাস্ত্রে বলছে,

"পিণ্ডং কুণ্ডলিনী শক্তিং হংস ' ইতি উদাহৃতম । 

রূপম্ বিন্দুমিতি জ্ঞেয়ং রূপাতীতং নিরঞ্জনম ”।।


সম্পূর্ণ দেহ , এই মহান শক্তির দ্বারা কার্য করে। মূলাধার চক্রে তিনি সুপ্ত । হৃদকেন্দ্রে অর্থাৎ অনাহত চক্রে তিনি হংস । দুই ভ্রুদেশের মধ্য বিন্দুতে অর্থাৎ কুটন্ত বা আজ্ঞাচক্রে , ধ্যানের পরাবস্থায় তিনি নিরাকার , অনন্ত ব্রহ্ম স্বরূপ । 

পঞ্চবায়ু ও প্রাণবায়ু , কুণ্ডলিনী শক্তির দ্বারা শান্ত বা তরঙ্গিত হয় যেমন গভীর শান্ত সমুদ্র বা তটের অশান্ত ঢেউ । সকল প্রকার জড় বা জীবিত জগৎ কুণ্ডলিনী শক্তির দ্বারাই চালিত । মানুষের শরীর তত্ত্বে কুণ্ডলিনী শক্তি পায়ের নখ থেকে মাথার চুল পর্যন্ত জীবিভূত হয়ে আছে । রূপ , রস , গন্ধ , স্পর্শ এই গুণগুলি কুণ্ডলিনী শক্তির কার্যকারিতা । সকল প্রকার জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার মূল কারণ কুণ্ডলিনী শক্তি । ইড়া নাড়ী , সুষুম্নার বাম পাশে অবস্থিত এবং প্রত্যেকটা  চক্রকে জড়িয়ে উপরে ডান নাসারন্ত্রী হয়ে আজ্ঞাচক্রে প্রবেশ করছে । 


সুষুম্নার ডান পাশে রয়েছে পিঙ্গলা নাড়ী । এই নাড়ী ইড়ার ন্যায় প্রত্যেকটা চক্রকে জড়িয়ে উপরে উঠেছে এবং বাম নাসারন্ধ হয়ে আজ্ঞাচক্রে প্রবেশ করছে । ইড়া , পিঙ্গলা ও সুমুন্না , এই তিনটি নাড়ীর মিলনক্ষেত্র হচ্ছে আজ্ঞাচক্র এবং এই মিলন কেন্দ্রকে বলা হয় ত্রিবেনী । এই তিনটি নাড়ী যথাক্রমে গঙ্গা , যমুনা ও সরস্বতী নদীকে স্মরণ করায় । এই নাড়ী তিনটি আজ্ঞাচক্রে প্রবেশ করার পর আবার নিচে নেমে মূলাধারে এসে মিশেছে । মূলাধার চক্রে এরা মিশে একটি নাড়ী হয়েছে । এই জন্যই আজ্ঞাচক্র ইচ্ছে মুক্ত ত্রিবনী ; অর্থাৎ মুক্তির প্রতীক । মূলাধার বা ধনচক্র হচ্ছে যুক্ত ত্রিবেনী অর্থাৎ বন্ধনের প্রতীক । একমাত্র যােগীরাই পারে , ত্রিনয়ন দিয়ে কুণ্ডলিনী শক্তিকে পরখ করতে।

কুন্ডলিনী রহস্য 

(৬ষ্ঠ পর্ব)


কুণ্ডলিনী শক্তির জাগরন ঘটলে শরীরে চক্রগুলির মধ্যে আলাে উদ্ভাসিত পদ্ম ও তার উজ্জ্বল পাপড়িগুলি দেখা যায়।  ইড়া , পিঙ্গলা ও সুষুম্না ব্যতীত , অন্যান্য শাখা প্রশাখা স্নায়ুগুলিকে আনন্দদায়ী স্নায়ু বলে । এই স্নায়ুতন্ত্র সমগ্র শরীরে পরিব্যাপ্ত । জীবনীশক্তিই আমাদের একমাত্র বন্ধু । অতান্ত স্থির অবস্থায় এই শক্তিই জীবাত্মা , স্বয়ং । 

“ প্রাণেন ধার্যতে লােকঃ সর্বং প্রাণময়ং জগৎ । "

এই জীবনী শক্তিই সমগ্র ব্রহ্মাণ্ড ও বিশ্ব চরাচরের স্থিতিকর্তা । পুরাণে বর্ণিত যে রাধা প্রেমিকা এবং শ্রীকৃষ্ণ প্রেমিক । ' রাধা ' অন্তর্নিহিত অর্থ হচ্ছে -- 'রা' - অর্থাৎ সমগ্র ব্রহ্মান্ড এবং ‘ধা' - অর্থাৎ , যিনি পালন করেন । অতএব প্রাণ শক্তিই কৃষ্ণ , যিনি রাধাকে ধারণ করে রেখেছেন । প্রতিটি জীবের জীবন হচ্ছে এই প্রাণশক্তি । এই জীবনী শক্তি ধনচক্রে ( মূলাধারে ) কুণ্ডলিনী শক্তি রূপে অবস্থান করে । বৈষব শাস্ত্রে কুণ্ডলিনীর অন্তর্নিহিত অর্থ বলতে রাধাকে বলা হয়েছে ।

এই কুণ্ডলিনীর বাস্তবিক অবস্থান বা গৃহ হল সহস্রার । কিন্তু তিনি ( রাধা ) নিজেকে ভগবান কৃষ্ণের কাছে থেকে সরিয়ে নিয়েছেন এবং নিজেকে ধনচক্র মূলাধারে স্থাপন করেছেন । তিনি ( রাধা ) এখন অন্ধকারে বাস করছেন । এটাই হচ্ছে ঈশ্বর চেতনার অভাব । তিনি তার সহস্রারের গৃহের বাস্তবিকতা বিস্মৃত হয়েছেন । তিনি তার গৃহ পরিত্যাগ করেছেন ও নিজের প্রকৃত গৃহ সহস্রারে প্রবেশ করতে পারছেন না । এবং এটার মূল কারণ হল তিনটি গাঁট বা গেড়ো ইড়া , পিঙ্গলা ও সুষুম্না । তিনি এদের দ্বারা মূলাধারে কারাবাস গ্রহণ করেছেন । ধনকেন্দ্রে মূলধারে রাধার স্মৃতিকে মায়ার বন্ধন বলে । এই পরিস্থিতিকে মায়ার গভীর নিদ্রাও বলা যায় । মায়ার এই নিদ্রাগ্রস্ত অবস্থায় মানুষমাত্র ২৪ ( চব্বিশ ) ঘন্টায় ২১৬০০ ( একুশ হাজার ছয়শত ) টি শ্বাস প্রশ্বাস গ্রহণ করে । যদি আমরা এই শক্তিকে মায়ার নিদ্রা থেকে জাগৃত করতে পারি , তবেই আমরা সাধনার প্রকৃত অভ্যাসের স্থিতিতে পোঁছাবাে । এই স্থিতি হল সহস্রার স্থির হয়ে থাকা । কুণ্ডলিনী শক্তিই দিব্যশক্তি যিনি কুণ্ডের ( পাত্র ) মধ্যে আশ্রয় নেন । কুণ্ড একটা পাত্র যেখানে কুণ্ডলিনী শক্তি অবস্থান করে । এটা কুণ্ডলিনীর স্থিতাবস্থা । যখন কুণ্ডলিনী শক্তি পাত্রে অবস্থান না করে স্বতন্ত্র হয়ে যায় এবং কুণ্ড শূন্য হয়ে যায় তখন সেই অবস্থাকে কুলকুণ্ডলিনীর জাগরণ বলে ।


আমাদের বন্ধনের মূল কারণ হচ্ছে আমাদের ছয়টি চক্রের চক্রান্ত ও কপটতা । যদি আমরা এই যষ্ঠচক্র থেকে বিচ্ছিন্ন হতে পারি , তবে এই ছয়টি চক্রকে অতিক্রম করতে পারি । ক্রিয়া অভ্যাসের ফলে সুপ্ত কুণ্ডলিনী মূলাধারে পূর্ণ জাগরিত হয়ে উর্ধে প্রবাহিত হয় । মানুষ তখন বাহ্যিক ও ভৌতিক বিশ্ব সম্বন্ধে জ্ঞান অর্জন করে । ঈশ্বর চেতনা মূলাধার থেকে সুষুন্নার ভিতর দিয়ে ষষ্ঠচক্র অতিক্রম করে দিব্য সাম্রাজ্য , সহস্রারে পৌঁছায় । সহস্ৰারে এই কুণ্ডলিনী শক্তি , পরমপিতা , সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের সঙ্গে যুক্ত হয় । প্রাণশক্তির পূজাই সর্বশ্রেষ্ঠ পূজা ।


অতএব- ‘ প্রাণাে হি ভগবানেষ প্রাণাে বিষ্ণুঃ পিতামহঃ ।

প্রাণেন ধার্য্যতে লােকঃ সর্বং প্রাণময়ং জগৎ।"


জীবন শক্তিই ঈশ্বর , ভগবান শিব , ভগবান বিষ্ণু ভগবান ব্রহ্মা । প্রাণশক্তিই ব্রহ্মাণ্ড ও সৃষ্টি । প্রাণশক্তিই সকল স্থাবর জংগম সকলকে ধারণ করে রেখেছে । শ্রুতিতে বলে যে প্রাণশক্তিই পিতামাতা ও গুরু ।

শাস্ত্রে বলেছে - বায়ুর উপস্থিতি শরীর ও চৈতন্যকে আবহমান করে রাখে । যদি বায়ু শরীরকে ত্যাগ করে , তবে শরীর থাকে না , চৈতন্যও থাকে না । বায়ুই সৃষ্টি কর্তা , পালন কর্তা এবং লয়  কর্তা । সকল প্রকারের সাধনার মধ্যে ক্রিয়াযােগও একটি অন্যতম সাধনা । শ্রুতিতে কথিত যে — ক্রিয়া ও প্রাণায়াম ব্যতীত অন্য কোনও পন্থা নেই , যার দ্বারা প্রকৃত ধ্যানের অবস্থা প্রাপ্ত করা যায় । ক্রিয়া অভ্যাসের দ্বারা মন পবিত্র হয় এবং মানের আলাে প্রবেশ করে । নিষ্ঠার সঙ্গে প্রাণ ক্রিয়া করলে যে কেউ সাধনার সর্বোচ্চ অবস্থান প্রাপ্ত করতে পারে । সাধক তখন স্থিতপ্রজ্ঞা লাভ করেন । তিনি তখন পার্থিব বন্ধন ভ্রম ও ভ্রান্তি থেকে মুক্তি লাভ করেন । গােরক্ষ সংহিতায় বর্ণিত আছে যে — বায়ু যদি সুষুম্নায় স্থিত না হয় তবে শাস্ত্রের শ্লোক বা অন্যান্য জ্ঞানের কথা উচ্চারণ করা বৃথা। প্রাণ শক্তি , সুষুম্নায় নিবন্ধ হতেই হবে । শ্বাসের উপর নিয়ন্ত্রণ এলে তবে বিন্দুর প্রকাশ ও আজ্ঞাচক্রে একাগ্রতা জন্মায় । যদি উচ্চতর মন ধ্যেয় বস্তুর সঙ্গে একাত্ব না হয় তবে ধ্যানের অভ্যাস বৃথা হয় । ঈশ্বরের শক্তির ক্রিয়াই হচ্ছে মহাপ্রাণ । আমাদের শরীরে প্রাণশক্তির ক্রিয়া হচ্ছে “ খণ্ডপ্রাণ ’ একক প্রাণ ও সীমিত প্রাণশক্তি ।

আধ্যাত্ম সাধনার মূল লক্ষ্য হচ্ছে যে , এই সীমিত খণ্ডপ্রাণকে , অসীম পরিব্যাপ্ত মহাপ্রাণ শক্তির সঙ্গে একীভূত করা । ব্রহ্ম চেতনার সঙ্গে সদা মুক্ত থাকাই হচ্ছে ক্রিয়ার লক্ষ্য । ব্রহ্মসত্তা ও স্থিতি হচ্ছে আমাদের প্রকৃত অস্তিত্ব বা পরিচিতি । সর্বোচ্চ মহাপ্রাণ শক্তি স্বয়ং নিজেকে অসংখ্য ভাবে বিভক্ত করে এক একটি একক প্রাণশক্তিতে নিজেকে প্রতি জীবের মধ্যে প্রকাশ করেছেন । এই মহাপ্রাণ শক্তি উর্ধ্বে থেকে প্রাণ বায়ু হয়েছেন এবং নিম্নে গমন করে অপান বায়ু হয়েছেন । যখন প্রাণ ও অপান বায়ুর গতিরুদ্ধ হয়ে যায় তখন কুণ্ডলিনী শক্তি উচ্চতর মনস অবস্থা অর্থাৎ চিত্ততে পরিণত হয় । আত্মা দুঃখ আনন্দ ভাবলেশ এর উর্ধ্বেে , শান্ত উদাস্ত স্থির সমাহিত মনের অবস্থা । প্রাণের অস্থির স্থিতি মন , মন ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে আনন্দ অনুভব করতে চায় । লাহিড়ী বাবা বলেন — প্রাণায়াম কর প্রাণশক্তিকে আবার শান্ত সমাহিত অবস্থায় আনতে হবে । যেই প্রক্রিয়ার দ্বারা প্রাণকে স্থির করা যায় তাকে ক্রিয়া বলে ।

কুন্ডলিনী রহস্য 

(৭ম পর্ব)

পতঞ্জলী দর্শনের সাধনপাদে বলা হয়েছে,

“শ্বাসপ্রশ্বাসয়োগতিবিচ্ছেদঃ প্রাণায়ামঃ ” অর্থাৎ শ্বাস প্রশ্বাসের গতি রুদ্ধ হওয়াই প্রাণায়াম । কিন্তু কি প্রকারে এই শ্বাসের গতি রুদ্ধ অবস্থা আসবে , পতঞ্জলীর দর্শনে উল্লেখ করা নেই।  গীতাতে প্রাণায়ামের প্রক্রিয়া পরিস্কার করে বলা আছে।

প্রানায়াম সম্পর্কে 

গীতাতে বলছে-

“ অপানে জুহুতি প্রাণং প্রাণেহপানং তথাপরে । প্রাণাপাণগতি রুদ্ধা প্রাণায়ামপরায়ণাঃ । ” যােগীদের কুম্ভক প্রাণায়াম প্রাণ ও অপানের রুদ্ধ অবস্থা আসে । প্রাণ বায়ু  উর্ধ্বগতি সম্পন্ন বায়ু যা প্রশ্বাসের সঙ্গে আসে , এবং অপান নিম্নগতি সম্পন্ন বায়ু যেটা নিশ্বাসের সঙ্গে যায় । প্রাণ এবং অপানের ভারসাম্য অবস্থাই কুম্ভক অবস্থা , ক্রিয়ার দ্বারাই করা সম্ভব ।

যে বায়ু ছেড়ে দেওয়া হয় অর্থাৎ নিঃশ্বাস উপর থেকে নিচে নেমে মূলাধারে সুষুম্নার মধ্যে দিয়ে যায় এবং সেখানে নেমে অপান বায়ুর সঙ্গে মেশে । যে প্রশ্বাস নেওয়া হয় সেই বায়ু অপান বায়ুকে মূলাধার থেকে উপর নিয়ে প্রাণবায়ুর সাথে মিলিয়ে দেয় । যােগ শাস্ত্রে এই প্রক্রিয়াকে  "কেবলী প্রাণায়াম” বলে । এই প্রক্রিয়ার দ্বারা প্রাণের এবং অপান-এর গতি নিজের থেকেই রুদ্ধ হয়ে যায় । এর ফলে মন ও প্রাণ স্থির ও শান্ত হয় । সাধক আনন্দ সাগরে  অবগাহন করতে থাকে। তার ঈশ্বর , জ্ঞান উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হতে থাকে । মন ও প্রাণের স্থিতি অবস্থার জন্য , বাহ্যিক শ্বাস ও প্রশ্বাস স্থিতিশীল হয় । সাধকের শরীর দৃষ্টি এবং বাক্য স্থির ও শান্ত হয়ে যায় । সাধকের এই বাহ্য শান্ত স্বরূপ তার আন্তরিক স্থিরতা এবং নিজের মনের উপর নিয়ন্ত্রণের প্রদর্শন করে । প্রাণ শক্তির ক্রিয়া হচ্ছে কেবল কর্ম , এটাই ক্রিয়াযােগ । গীতাতে এই প্রক্রিয়াকে খুব সুক্ষ্ম রূপে বর্ণনা করেছে । অপান বায়ুর অবস্থান হচ্ছে মূলাধারে এবং প্রাণবায়ুর অবস্থান হচ্ছে আজ্ঞাচক্রে অপান বায়ু , নিম্নগামী বায়ু এবং এই বায়ু মনকে অস্থির করে । প্রাণবায়ু উর্ধ্বগামী বায়ু এবং মনকে স্থির করে । উচ্চ মনকে বা চিত্তকে ক্রিয়ার দ্বারা রুদ্ধ করলে ক্রিয়ার পরাবস্থা অর্জন করা যায় ।


পরম ব্রহ্ম বা পরমাত্মা ত্রিগুণাতীত অর্থাৎ সত্ত্ব , রজ ও তমাে গুণের উর্ধ্বে। তিনি অবাংমানসগােচর অর্থাৎ মন বুদ্ধি , অহংকার , চিত্ত , জ্ঞান ও বাক্যের অতীত । ঈশ্বরের মধ্যে বিভিন্নতা বা ভেদভাব নেই । প্রকৃতির এই ত্রিগুণ হচ্ছে তার পার্থিব প্রকৃতি । ভৌতিক পৃথিবী এবং আমাদের শরীর প্রকৃতির এই ত্রিগুণের আবর্তের মধ্যে ঘুরেই যাচ্ছে । এই ত্রিগুণ ( সত্ত্ব , রজ ও তমাে ) প্রাণ রূপে ইড়া , পিঙ্গলা ও সুষুম্নার মধ্যে চলাচল করছে । যােগীদের মতে এই মূল ভূত প্রাণই কুণ্ডলিনী শক্তি । এই শক্তিই সকল জীবের জীবন ।


সকল প্রকার পার্থিব বন্ধন থেকে মুক্ত হলে মানুষ ঈশ্বর প্রণিধান করতে পারে। এই স্তরে সকল বিভিন্নতা এক বা সমান হয়ে যায় । প্রাণশক্তি , যখন হাজার হাজার স্নায়ুতন্ত্রের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয় তখন মানুষ বহির্মুখী আচরণ করে । এই প্রাণশক্তি প্রবাহ যখন অসংখ্য স্নায়ুতন্ত্রিত হতে থাকে তখন মানুষ উন্মাদ হয়ে যেতে পারে । মানুষ পার্থিব নানান বন্ধনে মুগ্ধ হয়ে জড়িয়ে যায় । সুখ , দুঃখ , আনন্দ ও বিষণ্ণতা প্রভৃতি ভাবনা এক এক প্রকারের শ্বাস প্রশ্বাসের সঙ্গে সম্বন্ধিত । এটাই পৃথিবীর লীলা । এই অবস্থা মৃত্যুর দিকে নিয়ে যায় । কিন্তু প্রাণায়ামের আধ্যাত্মিক অভ্যাস মানুষকে পার্থিব বন্ধন ও মৃত্যুর অতীতে নিয়ে যেতে পারে । মন যখন স্থির হয় তখন চিদাকাশের প্রশান্ত অবস্থা অবলােকন হয় । চিদাকাশের স্থিতিতে সাধক মনের চূড়ান্ত শান্ত অবস্থা অনুভব করে । এই অবস্থায় মানুষের বিবেক জাগ্রত হয় । চিদাকাশের বিবেকের আলাের দ্যুতি সূৰ্য্য চন্দ্র ও অগ্নির আলােক অপেক্ষা অনেক বেশি উজ্জ্বল । বলা হয়- “ তৎ শুভং জ্যোতিষাং জ্যোতিঃ । ” এই আলাে সাধনার জন্য সর্বত্তম । যােগীর হৃদচক্র একটি পবিত্রতম গুহা । এই গুহা পবিত্রতা ও স্নিগ্ধ চন্দ্রালােকে পরিপূর্ণ । অনন্ত হৃদয়ের স্থির শূন্য হচ্ছে আত্মা । সমাধির শান্তি , নিদ্রার শান্তি অপেক্ষা অনেক বেশি আনন্দদায়ক । নিদ্রা এবং সমাধির মধ্যে তুলনা মানুষের ভাবনার অগােচর । কারণ সমাধি হচ্ছে ব্যবহারিক অনুভব । কেবলমাত্র দক্ষ যােগী , ঋষি এবং সন্তগণ এই সমাধির অনুভব করে । 


কালাতীত অবস্থা ও মৃত্যুঞ্জয় অবস্থা ঈশ্বর এই শরীরের মধ্যে ক্রিয়াশীল করেন । আমাদের কেবল শ্বাসের দিকে নজর রেখে শ্বাসকে স্থির  করতে হবে , তখনই আমরা জ্ঞানের সঙ্গে সংযুক্ত হব । উপনিষদে বলেছে- “ অবিদ্যায় মৃত্যুং তীত্ত্বা বিদ্যয়ামৃতমশ্নুতে । ” ঈশ্বর প্রণিধানের প্রক্রিয়া হচ্ছে মহাবিদ্যা । ঈশ্বর চেতনা ব্যতীত কোনও অভ্যাস হচ্ছে অবিদ্যা । মহাবিদ্যার অভ্যাস সুষুন্নার মধ্যে করতে হয় । মেরুদণ্ডের মধ্যে সুষুম্না নাড়ীর অবস্থান , একমাত্র ঈশ্বর সাধনার উন্নতির জন্য যখন প্রাণবায়ু সুষুম্নার মধ্যে প্রবেশ করে তখন ঈশর সাধনা সফল হয় । সুষুম্না নাড়ী অমৃতের রাস্তা । এটা দিব্য পথ । শাস্ত্রে কথিত আছে- "মারুতে মধ্যসঞ্চারে মনস্থৈর্য্যং প্রজায়তে , যমনঃ সুস্থিরীভূবা সৈবাবস্থা মনােন্নি ।"


শ্বাস নিয়ন্ত্রণের প্রক্রিয়া দ্বারা যেই স্থির মন প্রাপ্ত হয় , সেই স্থির অবস্থা , মুক্তি বা চূড়ান্ত দক্ষতা এনে দেয় । ব্ৰহ্মচেতনার এই উচচতর মনস্তত্ত্ব দক্ষতার পথ । 

কুন্ডলিনী রহস্য 

(৮ম পর্ব)

যােগ শাস্ত্র বলে যে-

“ যদা সমক্ষীয়তে প্রাণঃ মানসং চ প্রলীয়তে ।

তদা সমরসত্ত্বঞ্চ সমাধিরভিধীয়তে । ” অর্থাৎ ইন্দ্রিয়মসূহের নিয়ন্ত্রণ মনের প্রজ্ঞা বা অন্তদৃষ্টির স্থিতি উন্মোচন করে । ভগবত গীতায় আছে- “ বশে যস্যে বেন্দিয়ানি তস্য প্রজ্ঞা প্রতিষ্ঠিতা ।" অর্থাৎ যাঁর ইন্দ্রিয় তাঁর নিয়ন্ত্রতে করায়ত্ব হয়েছে তার প্রজ্ঞা , অন্তর্দৃষ্টি শক্তি স্থাপিত হয় ।

জ্ঞান সঙ্কলিনী তন্ত্রে বলেছে-

" ন হােম হােম ইত্যাঙ্গঃ ব্রহ্মাগ্নৌ হূয়তে প্রাণঃ হােমকর্ম তদুচ্যতে ।। প্রাণ ক্রিয়াই প্রকৃত হােম বা ঈশ্বরের প্রতি শরণাগতি । এই হােম ক্রিয়া দ্বারা একজন সাধক ব্রহ্মাস্থিতি লাভ করতে পারেন । প্রতি শ্বাস ব্রহ্মকে সমর্পণ করে , কুম্ভক অবস্থা প্রাপ্ত হওয়াই হচ্ছে প্রকৃত হবন ( হােম ) বা যন্ত্র ।

ক্রিয়া অভ্যাসের দ্বারা সকল স্নায়ুতে প্ৰাণবায়ু সঞ্চালিত হয়ে পবিত্র হয় । প্রতিটি চক্রের বন্ধন ও নাকারত্মক প্রকৃতি দূর হয় । স্নায়ুর পবিত্রতা ও পরিশুদ্ধতার হেতু , প্রাণবায়ু সুষুম্নার মধ্যে প্রবেশ করে । প্রাণবায়ু যখন সুষুন্না নাড়ীতে প্রবেশ করে মন তখন শূন্য অবস্থা প্রাপ্ত হয় ।  সুষুস্মার মধ্যে প্রাণবায়ুর নিরন্তর প্রবাহহেতু যােগী কর্মবন্ধন হতে মুক্ত হন । মন যখন স্থিরতা ও প্রসন্নতা প্রাপ্ত হয় তখন সাধকের মধ্যে বিলয়ন আপনাআপ পরিলক্ষিত হয় । প্রাণ বায়ু যদি স্থির না হয় , তবে মনও স্থির হতে পারে না । অতএব প্রাণবায়ুর স্থিরতাই প্রাথমিক মুখ্য লক্ষ্য । যােগী গােরক্ষনাথজী বলেছেন- প্রাণ বায়ুকে সুষুম্না নাড়ীতে স্থির করতে না পারলে জ্ঞানের উন্মােচন হতে পারে না । আত্মজ্ঞান না হলে , সকল বক্তব্যই বৃথা ও নিরর্থক ।


যােগসূত্রে বলেছে — খুব স্বাভাবিক ভাবে ও আরামদায়কভাবে প্রাণবায়ুকে যদি নিয়ন্ত্রণ করা যায় , সেখানে প্রশ্বাস ও নিঃশ্বাস কোনও আলাদাভাবে বা জোর করে নিয়ন্ত্রন করা হয় না , তাকেই কেবল কুম্ভক বলে । প্ৰাণৰায়ু নিয়ন্ত্রণের ক্রিয়া অভ্যাসের দ্বারা স্বাভাবিক ভাবে কেবলই কুম্ভক হতে থাকে ।


অপান বায়ু , মূলাধার থেকে উর্ধ্বে সারে গতি প্রাপ্ত হয় এবং প্রাণবায়ু সহস্রার থেকে নিম্নে মূলাধারে গতিপ্রাপ্ত হয় । এই ঘটনার জন্য নিচের কেন্দ্রগুলি উন্নতিপ্রাপ্ত হয় । নিয়মিত ক্রিয়া অভ্যাসের দ্বারা মস্তিস্কের স্থিরতা আসে । মস্তিষ্কের মধ্যে প্রাণবায়ু অপান বায়ুর সঙ্গে মিশ্রিত হয় । প্রশ্বাস ও নিঃশ্বাসের আকর্ষণ ও বিকর্ষণ বায়ুকে নিজের থেকেই স্থিরতা প্রদান করে , বায়ুর এই স্থিরতাকে কেবল কুম্ভক বলে ।


গঙ্গা , যমুনা ও সরস্বতী নদী যেমন এলাহাবাদে , একসঙ্গে মিশে ত্রিবেণী সঙ্গম করছে , ঠিক সেইভাবে সূৰ্য নাড়ী বা পিঙ্গলা নাড়ী , চন্দ্র নাড়ী বা ইড়ানাড়ী এবং সুষুম্না নাড়ী একসঙ্গে আজ্ঞাচক্রে মিলিত হয়ে সঙ্গম তৈরি করছে । যােণবিশিষ্ট বলছে— “ যেই যােগী , কেবল কুম্ভকে দক্ষ , তিনি সকল প্রকার দুঃখ , জ্বালা ও যন্ত্রণা থেকে মুক্ত থাকেন ।

দূর্গা সপ্তসতীতে বর্ণিত আছে— " ত্বং বৈষ্ণবী শক্তিরনন্তবীৰ্য্যা বিশ্বস্যবীজং পরমাসি মায়া ।

সমাহিতা দেবী সমন্তমেতৎ ত্বং বৈ প্রসন্ন ভুবিমুক্তি হেতুঃ।"


অর্থাৎ, হে দেবী তুমি সমগ্র বিশ্বের মায়া ও ভ্রান্তি প্ৰদায়িনী । তুমি ভগবান বিষ্ণু দ্বারা সৃষ্ট , সর্বশক্তিমান অবিনাশী শক্তি । তুমিই সকলের বীজ স্বরূপ । সমগ্র বিশ্ব তােমার মায়া দ্বারা পরিব্যাপ্ত । তােমার আশীর্বাদ এবং 

ভক্তের প্রতি তােমার সন্তুষ্টি মুক্তির কারণ । ”


সমগ্র বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দু শক্তি হচ্ছে প্রাণ বা জীবনী শক্তি । এই জীবনী শক্তিকেই কুণ্ডলিনী শক্তি বলে।  কুণ্ডলিনী শক্তিই হচ্ছে সমগ্র ব্রহ্মাণ্ডের মাতৃবৎ । বিশ্বও সৃষ্টি হচ্ছে বহির্মুখী প্রাণশক্তিতে । এই মায়াই হচ্ছে সৃষ্টি অর্থাৎ মহামায়া ( ভ্রান্তি ) , প্রাণশক্তি হতে মন উৎপন্ন হয় । মনের উৎপত্তির বিন্দুই হচ্ছে শ্বাস । মন যখন শান্ত সৌম্য শ্বাসের মধ্যে সমাহিত হয় তখন সাধক গভীর ধ্যানের অবস্থা প্রাপ্ত হয় ( পরাবস্থা ) । পরমহংস যােগানন্দ বলতেন, “ প্রাণায়াম জীবন শক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করে , শ্বাসকে নয় । আত্মা হচ্ছে ঈশ্বরের স্বপ্ন । তিনি নিজেকে এই স্বপ্নের খাঁচায় বন্দী করেছেন । শ্বাসের মধ্যে যেই রহস্য আছে সেটাই ঈশ্বরের স্বপ্ন । শ্বাস প্রশ্বাস মানুষের জীবনের গুপ্ত রহস্য , এটাই জীবন দায়ী শক্তি । প্রশ্বাস ও নিঃশ্বাসের গতি , ক্রিয়াযােগ অভ্যাসের

দ্বারা রুদ্ধ হয় । এরপর অভ্যাসের দ্বারা ফুসফুসের গতি কর্ম ও হৃদ্যন্ত্রের গতি কর্ম ধীরে ধীরে রুদ্ধ হয় । এই অতিগুহ্য বিদ্যা অবশ্যই কোন একজন উপলব্ধিপ্রাপ্ত আত্মজ্ঞানী গুরুর নির্দেশ অনুযায়ী অভ্যাস করতে হয় ।"


শাস্ত্রে বলেছে— “ প্রাণ বায়ু হচ্ছে উর্ধগতি শক্তি এবং অপান বায়ু হচ্ছে নিম্নগতি । শক্তি যখন এই দুইটি একস্থানে মিলিত হয় তখন সুষুন্না পূর্ণজাগরিত হয় ।

কুন্ডলিনী রহস্য 

(৯ম পর্ব)

সুষুম্নার পূর্ণজাগরণ ব্ৰহ্মচেতনার দ্বার খুলে দেয় অর্থাৎ পরম পদ লাভ হয় ( সর্বোচ্চ স্তর ) । যেই বায়ু হৃদচক্র থেকে সহস্রারে গমন করে তাকে প্রাণ বায়ু বলে ( জীবনদায়ী বায়ু ) । বায়ুর এই প্রবাহকে ইড়া প্রবাহ বলা হয় । পিঙ্গলার প্রবাহ নিচের চক্রগুলিতে হয়— স্বাধিষ্ঠান ও মূলাধার চক্রে । পিঙ্গলা বায়ুর প্রবাহকে অপানবায়ু , বলা হয় । উপর ও নীচের বায়ু অর্থাৎ অপান ও প্রাণ বায়ু যেখানে একে অপরকে ছেদন করে সেই অবস্থাকে সমান বায়ু  বলে । সমান বায়ুর অবস্থান হচ্ছে মণিপুর চক্র । এটা অগ্নির ন্যায় । এই অগ্নিকে বৈশ্বানর অগ্নি বলে ( পাচন অগ্নি ) । এই অগ্নি সকল কিছু দাহ করতে পারে , এই অগ্নি স্বয়ং এই অগ্নিকে দাহ করতে পারে । প্রাণ বায়ুর বহিগতি , মণিপুরচক্র থেকে সহস্রার চক্র পর্যন্ত পরিব্যাপ্ত এটি ব্রহ্মঅগ্নি । তিন প্রকারের এই বায়ু  নাড়ীচক্রে এসে মিলিত হয় । মণিপুর ( নাভীচক্র ) হতে হৃদচক্র পর্যন্ত বায়ু শান্ত অবস্থায় থাকে । এই বায়ুর এই শান্ত অবস্থা প্রাণশক্তি এবং তার গতিকে সমাহিত করে । পরাবস্থায়, এই স্থিতিপ্রাপ্ত হয় । প্রত্যেক ক্রিয়াবান অনুশীলন দ্বারা এই অভিজ্ঞতা অনুভব করেন । বায়ুর উর্ধ্ব ও নিম্নগতির জন্যই  আমাদের শ্বাস প্রশ্বাস চলাচল করে । খুব সূক্ষ্ম স্তরেও প্রাণ ও অপান বায়ুর নিরন্তর প্রবাহ আমাদের শরীরে চলতে থাকে । আমাদের বায়ুর বহির্গতির সাহায্য নিতে হয় । শ্বাস প্রশ্বাস একটি স্থল বায়ু , কিন্তু প্রাণবায়ু ও অপানবায়ুর গতি একটি সূক্ষ্ম বায়ু । সূক্ষ্ম বায়ু মেরুদণ্ডের মধ্যে চলে । এই সূক্ষ্ম বায়ুর চলাচলের জন্য আমাদের প্রশ্বাস ও নিঃশ্বাসের সাহায্য নিতে হয় ।


প্রাণায়ামের তিনটি অংশ আছে — পূরক , কুম্ভক এবং রেচক ।


এই তিনটি , একটি চক্রাকারে ক্রিয়াভ্যাস করায় । প্রশ্বাসের সঙ্গে যেই বায়ু গ্রহণ করা হল তাকে বলে পূরক । প্রশ্বাস ও নিঃশ্বাসের মাঝে যেই শান্ত বা রুদ্ধ অবস্থা , তাকে কুম্ভক বলে । নিঃশ্বাসের সঙ্গে যেই বায়ু ত্যাগ করা হয় তাকে রেচক বলে । প্রাণ বায়ু ইড়া নাড়ী বা চন্দ্র নাড়ীতে চলাচল করলে শরীরে একটা ঠাণ্ডা ভাব এনে দেয় । চন্দ্র ঠাণ্ডা এবং আরামদায়ক । অতএব পূরক প্রক্রিয়ার সময় , আমাদের

মন , হাদয় এবং শরীর শান্ত হয়ে যায় । রেচক এর সময় শরীর উষ্ণতা অনুভব করে , কারণ বায়ু তখন পিঙ্গলা নাড়ীতে বা সূর্য্য নাড়ীতে চলাচল করে । সূৰ্য্য অত্যন্ত গরম । খাদ্য এই অগ্নিদ্বারা হজম হয় । রেচক এর সময় সূর্য্য শরীরকে পরিশুদ্ধ করে , যার দ্বারা শরীরের সকল প্রকার অদরকারি বর্জ পদার্থ শরীর থেকে বার করে দেয় । সুষুম্না নাড়ী কুম্ভকের নাড়ী এখানে বায়ু সঞ্চালন হয় । সমগ্র শরীরের মধ্যে সুষুম্না একমাত্র নাড়ী , কেবলমাত্র এই নাড়ীতেই বায়ুর সঞ্চলন অবস্থা পাওয়া সম্ভব । শ্বাস-প্রশ্বাসের ক্রিয়ায় দ্বারা মন ও চেতনার উন্নতি সাধন , লাহিড়ী বাবার ক্রিয়াযােগের এক বৈশিষ্ট্য । কোনও প্রকার ভৌতিক বা বিধিবদ্ধ অভ্যাস নেই । যার দ্বারা জোর করে কুম্ভক অবস্থা প্রাপ্ত হয় । ক্রিয়া অভ্যাসের দ্বারা এই কুম্ভক খুব সহজেই হতে থাকে । এক মুহূর্তের মধ্যে বায়ুর গতি স্থির ও সমাহিত হয় । বায়ু তখন শরীরে প্রবেশ করেনা ও শরীর থেকে বায়ু বেরিয়ে যায় না । এই শান্ত ও স্থির অবস্থা আজ্ঞাচক্রে হয়। শান্ত সমাহিত অভিজ্ঞতাই কুম্ভক অবস্থা, এই অবস্থাকে কেবলই কুন্তুক বলে । গীতায় এবং পতঞ্জলী দর্শনে এই অবস্থাকে প্রাণ ও অপান বায়ুর গতিরুদ্ধ অবস্থা বলে ।

কুন্ডলিনী রহস্য 

(১০ম পর্ব)

যােগাবতার লাহিড়ী বাবার অনুসারে কুম্ভক নিজের থেকেই হতে থাকে । লাহিড়ীবাবা সম্পূর্ণ আধ্যাত্মিক সাধনা পদ্ধতিকে বােঝানাের জন্য ক্রিয়া কথাটির বাবহার করেছেন । যতগুলি প্রক্রিয়া আছে যেমন - কুটস্থ দর্শন , খেচরী , মহামুদ্রা । এবং জ্যোতিমুদ্রা এই সবগুলিকেই তিনি ক্রিয়া বলতেন । গ্ৰহজামলে কথিত

“ রেচকং পুরকং তত্ত্বা সুখমত্র বায়ুধারণম্ । পবনং লীয়তে যত্র মনস্তত্র বিলীয়তে ।

দুই ধরনের কুপ্তক আছে ও একটির সহিত ( শ্বাসের সাথে ) এবং অন্যটি কেবল ( শ্বাস রহিত ) । যেই কুম্ভক , শ্বাস প্রশ্বাসের সাহায্যে হয় তাকে সহিত কুম্ভক বলে । যখন বায়ু নিজের থেকে রুদ্ধ হয় ; শ্বাস - প্রশ্বাসের কোনও সাহায্য ছাড়াই তাকে কেবলই কুম্ভক বলে । যখন প্রাণশক্তি সম্পূর্ণ ভাবে শান্ত হয় , তখন রেচক বা পুরকের দরকার হয় না । প্রাণের বা জীবনী শক্তির স্থির অবস্থাই হচ্ছে কেবল কুস্তকের অবস্থা মূলাধার হতে অপান বায়ুর সহস্রারে উর্ধ্ব গমন এবং প্রাণ বায়ুর সহস্রার হতে মূলাধারে গতি এই প্রক্রিয়া দুই বায়ুকে সন্তলান করে। বায়ু সহস্রারে স্থিত হয় । প্রাণ ও অপান বায়ুর স্থিরতাই হচ্ছে কেবল কুস্তক। এই কেবল কর্মকে বলা হয় 

“সহজ কর্ম"।


আত্মজ্ঞানের ও উপলব্ধির পথে উন্নতির জন্য লাহিড়ীবাবা ক্রিয়া অভ্যাসকে চারটি ভাগে ভাগ করেছেন । প্রথম ক্রিয়া , দ্বিতীয় ক্রিয়া , তৃতীয় ক্রিয়া এবং চতুর্থ ক্রিয়া । এর চারটি স্তরের অতিরিক্ত , উনি পঞ্চম ও ষষ্ঠ প্রক্রিয়া এবং উচ্চতর ক্রিয়াবানদের জন্য গুপ্ত প্রক্রিয়া দিয়েছেন । রুদ্রজামলের ১৫ নং পটলে বলা হয়েছে প্রাণায়াম মহান ধর্ম । প্রাণায়াম বা ক্রিয়া বেদের অতীত । ক্রিয়া সকল গুণের মধ্যে শ্রেষ্ঠ এবং সকল পাপের বিনাশক।  ক্রিয়া অভ্যাস লক্ষ লক্ষ কুকর্ম এবং অতীত জন্মগুলির কুপ্রভাব , সংস্কার ও নাকারত্মক প্রভাব থেকে সুরক্ষা প্রদান করে । যে , ক্রিয়া অভ্যাস করে , তার জীবন সার্থক হয় । প্রাণায়াম হচ্ছে ক্রিয়ার ভিত । যােগশাস্ত্রে বলেছে — প্রাণায়ামের দ্বারা মহা শূন্যে প্রবেশের শক্তি ও সামর্থ প্রাপ্ত হয় । মানুয় সকল প্রকারের রোগ হতে , আরােগ্য লাভ করে । কোনও প্রকারের রােগ প্রাণায়াম অভ্যাসের প্রতিবন্ধক হতে পারে না । অমৃত বিন্দু উপনষিদে বলেছে— “ সব প্রকারের অস্থিরতা , পাপ ও কুকর্মের প্রভাব , প্রাণায়ামের দ্বারা পবিত্র হয়ে যায় । ঠিক এই ভাবেই প্রাণায়াম , ক্রিয়াযােগের আধার । কিছুমুদ্রাও ক্রিয়ার জন্য উপযােগী । সেই প্রক্রিয়া যেটা সুখ বা আনন্দ প্রদান করতে পারে , তাকেই মুদ্রা বলে ।  খেচরী মুদ্রা ক্রিয়াযােগের একটি প্রধান অঙ্গ । এই মুদ্রা মুখের লালা গ্রন্থির কার্যকারিতার দক্ষতা প্রদান করে । এই প্রক্রিয়ায় জিভকে গুটিয়ে উপরে আলাজীভের কাছে নিয়ে যেতে হয় এবং আরও উপরে উঠে নাসারন্ধ্রে প্রবেশ করে । মন কুটন্ততে স্থির হয়ে যায় । তখন মস্তিষ্ক থেকে এক ধরনের রস নিঃসৃত হয় এই রসকে অমৃত বলে । এই রসের প্রবাহ , হৃদযন্ত্রের কর্মকে সস্কুলান করে , স্বাস প্রশাসের কাজকেও শান্ত ও সমাহিত করে । এর ফলে প্রাণশক্তি এবং মন শান্ত ও স্থির অবস্থা প্রাপ্ত হয় ।

কুন্ডলিনী রহস্য 

(১১তম পর্ব)


সাধক দক্ষতার সঙ্গে খেচরী মুদ্রা সম্পন্ন করলে নানান ধরনের স্বাদ এই নিঃসৃত রসে আস্বাদন করতে পারেন । খেচরী মুদ্রার দক্ষতা অর্জন করলে , সাধক ক্ষুধা , তৃষ্ণা , এমনকি মৃত্যুকেও জয় করতে পারেন । সাধকের বাইরের চেহারা উজ্জ্বল ও কান্তিময় হয়ে যায় , মুখমণ্ডল আভাযুক্ত হয় । ধীরে ধীরে সাধক সমাধিপদ লাভ করে । “ খ ” অর্থাৎ “ আকাশ ” উচ্চতরতম শূন্যে  ধাবমান হয় , অতএব এই মুদ্রার নাম খেচরী মুদ্রা । 


মানবশরীরে সাতটি পূতাগ্নি আছে। ক্রিয়াযােগী তার কুণ্ডলিনীর উখানে ও অবনমনে এই সাতটি অগ্নি প্রত্যক্ষ করেন । বাহ্যরূপে এগুলি সাতটি আকাঙ্ক্ষার প্রকাশ । আভ্যন্তররূপে এগুলি জ্ঞান , সংবিৎ , অধিসংবিৎ ও ব্রহ্মসংবতে যাওয়ার আলােকবর্তিকা । প্রতিটি কর্মে এই ঈশ্বর-অগ্নিকে প্রত্যক্ষ করলে দেহের ভেতরে ঈশ্বরকেই একমাত্র কর্তারূপে উপলব্ধি করা যায় । এই ঈশ্বর - অগ্নি কর্ম থেকে আমাদের মুক্ত করে পরমাত্মায় মগ্ন করে । 



মন নিয়ন্ত্রণের বিধিবদ্ধ অভ্যাস ব্যতীত , শ্বাস এবং দৃষ্টি স্থির ও শান্ত হতে পারে যদি খেচরী মুদ্রা দক্ষতার সঙ্গে করা যায় । এটাই খেচরী মুদ্রার প্রকৃত গুণ যার দ্বারা মন , শ্বাস এবং দৃষ্টি স্থির ও শান্ত হতে পারে । হঠযােগ প্রদিপীকায় বলেছে — জিহ্বাকে গুটিয়ে আলজিহবার দিকে তালুকুহরে রাখতে হবে । মনকে দুই দেশের মধ্যে নিবদ্ধ করতে হবে । তখন সাধক ধীরে ধীরে অনন্ত শান্ত অবস্থা প্রাপ্ত হবে । প্রাণায়াম , মহামুদ্রা , ভ্রামরী এবং জ্যোতি মুদ্রা , এই প্রক্রিয়াগুলি অভ্যাসের সময় খেচরী মুদ্রা আবশ্যক । খেচরী মুদ্রার নানান প্রকারের গুণাবলী আছে এবং সেই জন্যই লাহিড়ীবাবা এই প্রক্রিয়াকে প্রত্যেকটি আধ্যাত্মিক ক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত করে রেখেছেন ।


মহামুদ্রা সুনিশ্চিত নিয়ম - এর অনুপালন করে এই মহত্বপূর্ণ ক্রিয়া , শরীরের সকল সুস্থ তন্ত্রীকে প্রভাবিত করে । শরীরে বীর্য বর্ধন করে । সাধক আত্মসন্ধানে এগিয়ে চলে । মহামুল্লা অভ্যাসের দ্বারা কুণ্ডলিনী শক্তি , সহস্রারে ব্রহ্মরন্ধ্রে ( ঈশ্বরের গুহা ) উথিত হয় । এই মুদ্রা সর্ব রােগের ওষুধস্বরূপ , হজম শক্তি বিপুল ভাবে বন্ধন হয় ও সাধকের পরমায়ু বৃদ্ধি পায় । শরীর পবিত্র ও উজ্জ্বলকান্তি হয় ।

কুন্ডলিনী রহস্য 

(১২তম পর্ব)

মানুষের শরীরে গঠন প্রণালীতে বিজ্ঞান অনুযায়ী সকল প্রকারের বৃহৎ , ক্ষুদ্র ও ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র , রক্তের শিরা , ধমনী ও স্নায়ুগুলি প্রত্যক্ষ বা পরােক্ষ ভাবে শিরদ্বারার সঙ্গে যুক্ত আছে । সাধক মহামুদ্রা অভ্যাসের দ্বারা শারীরিক ও মানসিক অবস্থার ভারসাম্য রক্ষা করে । মানুষ বহু বৎসর পর্যন্ত যুবা , অবস্থা প্রাপ্ত হয় । এই ক্রিয়ার দ্বারা শরীরের অহেতুক ক্ষয় রােধ হয় । লাহিড়ীবাবার প্রদর্শিত খেচরী মুদ্রা কেবলমাত্র একটি অত্যন্ত জরুরী ক্রিয়া নয় , এইটি ক্রিয়াযােগ অভ্যাসের এবং ভৌতিক মানসিক ও আত্মিক উন্নতির সােপান । সাধক যখন সবল পার্থিব বন্ধন হতে মুক্তিলাভ করে , শান্ত সমাহিত হয়ে ঈশ্বর চেতনায় মগ্ন হয় তখন সেই অবস্থাতে  "সাম্ভবী” বলা হয় । মন আত্মার গভীরে প্রবেশ করে । মনের অন্তলক্ষ্য বা অস্তদৃষ্টি হচ্ছে  "সাম্ভবী" মুদ্রা । যদি কেউ , একজন আত্মজ্ঞানী ও উপলব্ধিকৃত গুরুর নির্দেশ অনুযায়ী তার মনকে দুই দেশের মাঝখানে স্থাপন করে এবং মনকে অস্থিরতা থেকে দূরে সরিয়ে নিতে পারে তবে তার অবশ্যই “সাম্ভবী" মুদ্রা প্রাপ্ত হতে পারে ।  ঘেরও সংহিতায় বলেছে— “ প্রকৃত একাগ্রতার সহিত দুই দেশের মধ্যে সমগ্র ব্রহ্মাণ্ডের আত্মাকে নিরীক্ষণ করলে তবেই সাম্ভবী মুদ্রার দক্ষতা লাভ করা যায় ।"

জ্ঞান সঙ্কলিনীতন্ত্রে বলেছে — শিশু ও নির্বোধ ব্যক্তিদের মন , স্বপ্নালু অবস্থা এবং গভীর নিদ্রার অবস্থার মাঝামাঝি একটা স্মৃতিতে অবস্থান করে । স্বপ্নের মত এক অর্ধচেতন পরিস্থিতিতে ভাসমান থাকে । এই স্থিতি সাম্ভবীর মতন । কিন্তু ঈশ্বরচেতনা যুক্ত , দেহবােধ শূন্য অবস্থা হচ্ছে সাম্ভবী অবস্থা । শিবনেত্র অবস্থায় স্থিতিশীল হওয়ার জন্য মনকে আজ্ঞাচক্র অর্থাৎ তৃতীয় নয়নে নিবদ্ধ করলে সাম্ভবী মুদ্রার প্রক্রিয়ার দক্ষতা প্রাপ্ত হওয়া যায় । এই স্থিতি ঈশ্বরের সঙ্গে সংযুক্তি ঘটায় । খেচরী অবস্থায় চোখদুটি উপর দিকে আজ্ঞাচক্রের দিকে নিবন্ধ করে বন্ধ করতে হয় । “ খ ” -এর অর্থ হল আকাশ ( শূন্য অবস্থা ) , “ চারী ” অর্থ গতিমান বা গতিশীল । সেই জন্য এই নামটি 

“ খেচরী ” মুদ্রা । চক্ষু বন্ধ রাখার জন্য এই অবস্থায় যােগনিদ্রার অবস্থা প্রাপ্ত হয় । যোগনিদ্রা সাধককে  সমাধি  নিকটবর্তী করে । হটযােগ প্রদীপিকা বলে যে — খেচরী মুদ্রা যােগ মুদ্রার অবস্থা এনে দেয়।

গীতায় বলেছে-

“ শ্ৰতিবিপ্রতিপন্না তে মদা স্থাস্যতি নিশ্চলা ।। সমধাৰচলা বুদ্ধিস্তদা যােগমৰাস্মসি । ” অর্থাৎ এই প্ৰণৰ নাদ বা ধ্বনি শ্রবণ যােগের স্তিতির প্রতি অগ্রসর হওয়া । সাধক , পরমপিতা পরমেশ্বরের সাথে যােগ এর স্থিতি প্রাপ্ত করতে পারেন ।


ওঁকার গীতায় বলেছে-  ‘ অনাহতস্য শব্দস্য তস্য শব্দস্য যা ধবনিঃ। 

ধ্বনেন্তর্গতং জ্যোতি জ্যোতে  রন্তগতং মনং । তন্মনাে বিলয়ং যাতি তদ্বিষ্ণোঃ পরমং পদম । ”

যদি মন , অনাহত ধ্বনি বা ওঁ - কার নাদের সঙ্গে মিশে যায় তবে মন ব্রহ্ম চেতনার সঙ্গে সংযুক্ত হয় ও ঈশ্বরের পরম পদ লাভ করে । এটা ক্রিয়াযােগের একটা গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ । এই মুদ্রা অভ্যাসের দ্বারা সাধকের দেহবােধ লয় হয়ে যায় এবং তার চেতন সত্ত্বা ঈশ্বরের বা ব্রহ্মের চেতন সত্ত্বার সঙ্গে মিলিত হয়ে হয় । ক্রিয়া যােগ , মুক্তিমার্গের এক সর্বোচচতম পথ । যােগসূত্র বলেছে— “ মনের সকল প্রকারের বৃত্তির নিরােধ হওয়াই হচ্ছে , যােগ । কিন্তু প্রকৃত অর্থে , যােগ হচ্ছে জীৰ আত্মা ও পরম আত্মার মিলন । আত্মজ্ঞানের অভাসই কৈবল্য মুক্তির প্রকৃত সাধনা । কৈবল্য মুক্তি ও ব্রহ্মআশ্রয়ের জন্য যে জ্ঞান ও সাধনা প্রয়ােজন , তাকেই ব্রহ্মবিদ্যা বলা হয় । মনের সকল প্রকার নাকারাত্মক ও খারাপ ইচছাগুলি সরে গেলেই প্রকৃত জ্ঞানের উদয় হয় । 

কুন্ডলিনী রহস্য 

(১৩ তম পর্ব)


মনের সকল প্রকার নাকারাত্মক ও খারাপ ইচছাগুলি সরে গেলেই প্রকৃত জ্ঞানের উদয় হয় । যােগী যাজ্ঞবল্ক বলেছেন — মনের নাকারত্মক ও খারাপ ইচ্ছাগুলিকে সম্পূর্ণরূপে বলি দিতে হলে একমাত্র উপায় হচ্ছে প্রাণায়াম বা ক্রিয়া । যােগসূত্রে বলেছে , “ প্রকৃত জ্ঞানের উদয়- দ্বারা মুক্তির রাস্তা প্রশস্ত হয় । ঈশ্বর - এর ব্যবহারিক অনুভব ক্রিয়াযােগের মহত্বপূর্ণ একটা দিক ।  সকল সময় সকল কাজের মধ্যে কি করে ঈশ্বরকে অনুভব করতে হয় তা গুরুদেব থেকে শিখে নিতে হয়। এক পলকের জন্যও ঈশ্বরকে ভুলে যেন না যাই , তিনিই আমার শ্বাস , আমার জীবনীশক্তি আমার ভগবান । ঈশ্বর বাতীত কোন অস্তিত্বই নেই । সেইজন্যই আমাদের প্রতিনিয়ত গুরদেব  চরণচিহ্ন অনুসরণ করতে হবে এবং তাঁর নির্দেশ অনুযায়ী অগ্রসর হয়ে হবে। 


ক্রিয়ার গভীরতায়- মনে কি কি চিন্তা বা বিচার, সেটাই ঈশ্বরের প্রকাশ বা ব্রক্ষ্মের প্রকাশ । ইচ্ছার তরঙ্গ ঈশ্বর থেকে আলাদা নয় । একই ভাবে আমাদের এটা উপলব্ধি করতে হবে যে ঈশ্বর সর্বভূতে বিরাজমান । ঈশ্বর ব্যতীত অন্য কোনকিছুই নাই ।


Continue-43

গীতায় বলছে,

“ যাে মাং পশ্যতি সর্বত্র সর্বং চ ময়ি পশ্যতি । তস্যাহং ন প্রণস্যামি স চ মে ন প্রণশ্যতি । ”


অর্থাৎ, যিনি সদা সর্বদা সকল কিছুর মধ্যে ঈশ্বরকেই অবলােকন করেন , তিনি ঈশ্বর ব্যতীত অন্য কোনও সত্ত্বা নন ।


আমাদের পার্থিব বন্ধনের কারণ , আমরা ঈশ্বরকে ভুলে থাকি । ঈশ্বর বিস্মৃতইও  বন্ধন।  আমাদের প্রতিটি কর্মই ঈশ্বরের অনুপ্রেরণার কারণ । এই কৌশলকে প্রাপ্ত করতে হলে , আমাদের প্রতিটি কর্ম ঈশ্বরকে সমর্পণ করতে হবে । ঈশ্বরই কর্তা এবং ঈশ্বরই গুরু। এই ব্যতীত ঈশ্বর উপলদ্ধির আর কোনও দ্বিতীয় পথ নাই । এই দিব্য অনুভবই সমাধির সােপান । পতঞ্জলীর দর্শন অনুযায়ী নিত্য ও নিরন্তর ঈশ্বর উপলব্ধি সমাধির দিকে অগ্রসর হতে সাহায্য করে । প্রজ্ঞা ( অস্তদৃষ্টি ) কৈবল্য মুক্তি বা ঈশ্বর আশ্রয় এর সােপান । সমাধির অবস্থার পর যে প্রজ্ঞা অর্জন হয় সেই প্রজ্ঞাই যথার্থ প্রজ্ঞা । যে যােগী সম্পূর্ণ সমর্পণ করেছেন , তিনিই সমাধিপদ লাভ করবেন । সেইজন্য যােগসূত্রে বলেছে—

“ সমাধিরীশ্বর প্রণিধানাৎ । ”

অর্থাৎ — নিরন্তর ঈশ্বর প্রণিধান সমাধি পদ এনে দিতে সাহায্য করে । ঈশ্বর চেতনার প্রতি একাগ্রতাই হচ্ছে ধ্যান।

প্রত্যাহার , ধারণা , ধ্যান , এবং সমাধি , যােগের চারটি অঙ্গ । ক্রিয়াযােগে ঈশ্বর অনুভূতি , আধ্যাত্মিক সাধনার প্রারম্ভ , মধ্য এবং অন্ত । ক্রিয়াযােগে এবং অষ্টাঙ্গযােগে , য়ম ও নিয়মের পর হচ্ছে আসন । পতঞ্জলীর যােগ সূত্র অনুযায়ী আসনকে বলা হচ্ছে,

" স্থিরসুখ আসন ” । অর্থাৎ আসন হচ্ছে নিশ্চুপ , স্থির ও আরামদায়ক ভাবে বসে সাধনা করার কৌশল । আসন অভ্যাসের দ্বারা শরীর রােগমুক্ত হয় । কিন্তু প্রকৃত যােগ হচ্ছে ঈশ্বর চেতনা। আসনই শুধুমাত্র যোগ , এই ধারণাটা সম্পূর্ণ ভুল । এই ভুল ধারণা ও অভ্যাস হতে আমাদের দূরে থাকতে হবে । 

কুন্ডলিনী রহস্য 

(১৪তম ও অন্তিম পর্ব)


যদি শিরদাড়া সােজা থাকে , তবে শ্বাসের গতিও সােজা ও সহজ হবে । গীতায় বলেছে ' ' সমং কায়শিরোগ্রীবং ধারায়ণচলং স্থিরঃ । ” অর্থাৎ, ধ্যানের সঠিক মুদ্রা হেতু , আমাদের বুক , গলা , মাথা এবং শরীরকে সােজা রাখতে হবে । কিন্তু ধ্যানের প্রকৃত মুদ্রা হচ্ছে সহস্ৰারে স্থিত থাকা । বাহ্য শারিরীক মুদ্রাগুলিকে মহত্ত্ব দেওয়া অনাবশ্যক ।


যােগ অভ্যাসের প্রথম ও প্রধান অঙ্গ হল প্রাণায়াম । ঈশ্বর প্রণিধানার্থে যে প্রাণায়াম করা হয় তাকেই ক্রিয়া বলে । পতঞ্জলীর যােগ সূত্রের সাধনপদে বলেছে — ' তস্মিন্ সতি শাসপ্রশ্বাসয়াের্গতিবিচ্ছেদঃ প্রাণায়ামঃ । ” অর্থাৎ শ্বাস এবং প্রশ্বাসের গতির অবরােধ হচ্ছে প্রাণায়াম । শ্বাসের অবরােধ — অর্থাৎ , যেই অভ্যাস , বাইরের বায়ু শরীরে প্রবেশ করতে দেয় না তাকেই প্রাণায়াম বলে । শরীর ও মনের কম্পন বা তরঙ্গকে সম্পূর্ণরূপে রােধ করাই হচ্ছে প্রাণায়ামের লক্ষ্য । এই অভ্যাসের প্রণালী প্রবর্তন হয়েছে , দেহবােধ ও মনের বােধ বিলুপ্ত হয়ে স্থির হওয়ার জন্য । পূরক ও রেচকের দ্বারা শ্বাসের গতি রুদ্ধ করাই হচ্ছে  প্রাণায়ামের কৌশল। মন যখন স্থির ও শূন্য অবস্থা প্রাপ্ত হয় তখন সাধক অনাবিল আনন্দ অনুভব করেন । এই ধরনের প্রাণায়াম , অত্যন্ত সূক্ষ্মভাবে  মনের বৃত্তিগুলির রােধ করে , এই প্রণালী বহিরঙ্গ কুম্ভকের ও প্রাণায়ামের থেকে পৃথক ।


আমাদের অসংখ্য অতীত জন্মের অগণিত কর্মের প্রভাব নিয়ে আমরা জন্মগ্রহণ করি । শ্রীমৎ ভূপেন্দ্রনাথ সান্যাল মহাশয় বলেছেন — আমাদের সংস্কার ( অতীত জন্মের কর্ম সমূহ ) । আমাদের প্রকৃত জ্ঞান - ও ঈশ্বর প্রণিধানকে একটা অজ্ঞানের চাদর দিয়ে যেন ঢেকে রেখেছে । সংস্কার একটি বহিআস্তরনের মতন । প্রাণায়ামের অভ্যাসের দ্বারা , অতীতের সকল সংস্কার মুক্ত হওয়া যায় এবং জ্ঞানের উন্মেষ হয় । প্রাণায়ামের কৌশল অহংকারকে দূর করে ও নাকারত্মক সত্তাগুলিকে ধ্বংস করে , তখন সাধকের মধ্যে প্রজ্ঞানের উন্মেষ হয় । অবিদ্যা ও অজ্ঞানতা , ঈশ্বর চেতনার বিস্মৃতি ঘটায় । অবিদ্যা অস্থায়ীকে স্থায়ী ভ্রমে বদলে দেয় । অবিদ্যার জন্য আমরা জীবনের দুঃখময় অবস্থাকে সত্যি বলে ভাবতে থাকি । আমরা জড়বৎ ও পার্থিব উন্নতিকে আত্মার প্রকৃত অবস্থা বলে ভাবি । আত্মচেতনার সঙ্গে যখন বুদ্ধি যুক্ত হয় তখন অহংকারবােধের জন্ম হয় । ঈশ্বর চেতনার অভাবই হচ্ছে অবিদ্যা।

রাগ এর অর্থ ঐশ্বর্যানুভূতির অভাব।


দুঃখ থেকে মুক্তি পাওয়ার চেষ্টা করে যে অনুভূতি হয় তাকে বলে 'দ্বেষ' । শরীরে যে অহংকার আছে তাকে বলে 'অভিনিবেশ' । অভিনিবেশের জন্য মৃত্যু ভয় জন্ম নেয় । জ্ঞানী ও অজ্ঞনী উভয় ব্যক্তির মধ্যেই কম বেশি মৃত্যুভয় বিদ্যমান।


উপরে উল্লিখিত পাঁচটি নাকারাত্মক শক্তিকে সমূলে নাশ করার একটিই মাত্র উপায় হল ব্ৰহ্মচেতনা । ব্ৰহ্মচেতনা সমাধির গুণ ও নিত্য ঈশ্বর অনুভূতির স্থিতি । ক্রিয়াযােগ সকল প্রকার নাকারত্মকতা দূর করে সমাধির পথ প্রশস্ত করে।


বিগত জন্মের প্রভাব চিত্ততে জমা হয়ে থাকে । এই প্রভাবগুলি সরিয়ে দেওয়াটা খুব প্রয়োজন। আশা আকাঙ্খা ও ইচ্ছাই দুঃখ ও দুর্দশার কারণ । যদি এই প্রভাব দূর হয় তবে ইচ্ছাও সমাপ্ত হয়ে যায় । চিন্তার তরঙ্গের দুইটি কারণ আছে । একটি ইচ্ছা এবং অন্যটি প্রাণশক্তি । যদি এর মধ্য হতে যে কোনােও একটি সত্ত্বাকে সরিয়ে নেওয়া যায় , তবে মন , চিন্তারহিত অবস্থা প্রাপ্ত হতে পারে সেই হেতু কথিত আছে—

“ পবনং লীয়তে যত্ৰ মনস্তত্র বিলীয়তে ।  “ যদি প্রাণশক্তি স্থির হয় , তবে মন স্থির হয়ে যায় ।


সমগ্র বিশ্বে মন ও প্রাণশক্তির কষ্টের চিত্রটা প্রকট , কেবলমাত্র মন ও প্রাণ এর স্থিরতা ও লয় প্রাপ্ত হওয়া , মুক্তি ও নির্বাণ এর রাস্তায় নিয়ে যেতে পারে । শাস্ত্রে বলেছে— “ যথার্থ নিয়ম অনুসারে যদি প্রতিদিন নিয়মিত অভ্যাস করা যায় , তবে প্রতিটি স্নায়ুচক্র দোষমুক্ত হতে পারে । যার নিমিত্ত সুষুম্নার রাস্তা খুলে যায় ও প্রাণদায়ী বায়ু খুব সহজেই সুষুম্না ভেদ করতে পারে । ”


...........................

চক্রগুলো সম্পর্কে আরো বিস্তারিত জানার আগে জেনে নিই বিজ্ঞানের চোখে কুন্ডলিনীর কথা।


Post a Comment

0 Comments