যোগ সাধনা
শাস্ত্রে যােগশব্দের বিভিন্ন সংজ্ঞা নির্দেশ করা হয়েছে । গৌতমীয়তন্ত্রে বলা হয়েছে যােগশব্দের অর্থ সংসার উত্তীর্ণ হবার উপায় । যােগবিশারদেরা জীবাত্মা ও পরমাত্মার ঐক্যকে যােগ বলেন। শারদাতিলক , কুলার্নব, মহানির্বাণ প্রভৃতি তন্ত্রেও যােগের এই সংজ্ঞাই নির্দেশ করা হয়েছে । শারদাতিলকের টীকাকার রাঘরভট্ট বলেন, যােগের এই সংজ্ঞা বেদান্তপক্ষের প্রদত্ত সংজ্ঞা । শারদাতিলকে বিভিন্নমতের যোগসংজ্ঞা নির্দেশ করা হয়েছে । শৈবরা শিব এবং আত্মার অভেদজ্ঞানকে বলেন যােগ । আগমবিদরা বলেন শিবশক্ত্যাত্মক জ্ঞান যােগ । ভেদবাদী বৈষ্ণবাদি বিশারদদের মতে পুরাণপুরুষের জ্ঞানই যােগ । রাঘবভট্ট বলেন এই পুরাণপুরুষ সাংখ্যমতে পুরুষ , ন্যায়মতে ঈশ্বর এবং বৈষ্ণবমতে নারায়ণ । মায়াতন্ত্রে বলা হয়েছে প্রকৃতিবাদীরা শিবশক্তির সামঞ্জস্যকে যোগ বলেন।
প্রসঞ্চসারতন্ত্রমতে নিজের মধ্যে করপাদমুখাদিবিহীন আত্মার অবিরত নির্বোধ দর্শনকে তত্ত্ববিদেরা যােগ বলেন । পাতঞ্জল যােগদর্শনে চিত্তবৃত্তিনিবােধকে যােগ বলা হয়েছে । তার সঙ্গে তন্ত্রোক্ত যােগসংজ্ঞার কোনাে বিরােধ নাই । কেন না চিত্তবৃত্তিনিবােধ অর্থ কোনাে এক অভীষ্ট বিষয়ে চিত্তকে স্থির রাখা । তন্ত্রোক্ত যােগসংজ্ঞায় সেই অভীষ্ট বিষয়ের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে ।
যােগসাধন
(১)
যোগ সম্বন্ধে আমাদের দেশে বহু বছর ধরে বিভিন্ন ভ্রম চলে আসছে । তার কারণ যােগ এই কথাটি অনেক অর্থে ব্যবহৃত হয়। যোগ বলতে জীবাত্মা ও পরমাত্মার মিলনকে বোঝায়। এই মিলন একীভূত হয়ে যাওয়া নয়, এতে মানবের আত্মা ব্রহ্মে বিলীন হইয়া নিরস্তিত্ব হন। ইংরাজিতে যাহাকে annihilation অর্থাৎ লয় বলে। তার সাথে এর কোন সম্পর্ক নেই। জীবাত্মার জ্ঞান প্রেম ও ইচ্ছা এই ত্রিবিধ প্রকৃতি পরমাত্মার পূর্ণ ও অনন্ত প্রকৃতির ঐ তিন অঙ্গের সাথে একজাতীয়তা লাভ করবে। সাধকের পরিমিত জ্ঞান তার পূর্ণ ও অনন্ত জ্ঞানে সংযুক্ত হবে, তার হৃদয়ের ভাব তার অনন্ত প্রেমের অনুবৰ্ত্তী হবে , এবং তার স্বাধীন ইচ্ছা তাঁর পূর্ণ পৰিত্ৰ ইচ্ছার অনুসরন করবে। যােগ শাস্ত্রে এই ত্রিযোগেই বিষয় লেখা আছে।
(২)
পরমেশ্বরকে লাভ করা অর্থাৎ জ্ঞানচক্ষু দ্বারা তার নিরাকার সচ্চিদানন্দ রূপ দর্শন করা এবং তার বাণী শ্রবণ করা , জ্ঞান রসনায় তাকে আস্বাদন করা , জ্ঞান নাসিকায় তার ঘ্রাণ নেয়া , জ্ঞানত্বের মাধ্যমে তাকে সুস্পষ্ট স্পর্শ করা — এইভাবে আমাদের সমস্ত আধ্যাত্মিক প্রকৃতি দিয়ে তাকে সম্পূর্ণ ভাবে প্রাপ্ত করাই যোগের লক্ষ্য। এই প্রাপ্তিই মানবাত্মার অনন্ত কালের পথ যাত্রার সমাপ্তি। এর মাধ্যমেই প্রত্যক্ষ বিশ্বাস হয়ে থাকে। নতুবা বিশ্বাস শুধু পরোক্ষ জ্ঞান মাত্র । সুতরাং, দেখা গেল যে যোগ ব্যতীত প্রকৃত ও স্থায়ী ধৰ্মলাভ অসম্ভব।
(৩)
পরব্রহ্মকে লাভ করার কোন নির্দিষ্ট প্রণালী বা উপায় নেই ; তিনি স্বপ্ৰকাশ , তার কৃপাই তাকে লাভ করার একমাত্র উপায়। সরল ভাবে অজস্র প্রার্থনাই প্রকৃত সাধন। আপন সাধন বলে সাধক সেই সর্বশক্তিমান অনন্ত পুরুষকে লাভ করতে পারে। মানবের প্রকৃতিই মানবের ধর্ম । এই জন্য যখন তিনি প্রাণে এই মহা অভাব অনুভব করেন তখন বাকুল ভাবে তার প্রতি প্রার্থনা না করে থাকতে পারেন না। এই ভাবে অবিশ্রান্ত প্রার্থনার মাধ্যমে ধৰ্ম্ম লাভের প্রতিকূল অবস্থা গুলো তার প্রাণ হতে অঙ্করিত হলে শুভ মূহুর্তে করুণাময় পরমেশ্বর তার আশা পূরন করেন। সুতরাং দেখা গেল যে সাধন কেবল ঈশ্বরের জন্য প্রস্তুত হয়ে থাকা মাত্র ; যেন তাহার অবির্ভাব হলে চিনে নিয়ে পারি তার ইচ্ছা না হলে, কোন রকম ধর্ম-কৰ্ম্ম , জ্ঞানালােচনা বা প্রার্থনা কিছুর মাধ্যনেই তাকে পাওয়া যায়না। কারণ তিনি স্বপ্রকাশ , স্বয়ং প্রকাশ না হলে কোন উপায়ে তাকে প্রকাশ করতে পারা যায় না।
(৪)
প্রার্থনা আত্মার একটি স্বভাব । যদি কেউ নিজের আত্মার মধ্যে অনেক প্রবল অভাব অনুভব করে , পরে সেই অভাব মোচনের জন্য তার প্রাণে নিতান্ত ব্যাকুলতা জন্মে , তখন পুনঃ পুনঃ চেষ্টা করেও সে যদি দেখে ঐ অভাব দুর করার তাহার নিজের তিল ক্ষমতা নেই , অপর কোন সৰ্ব্বশক্তিমান ও করুণাময় পুরুষের সেই শক্তি আছে , তখন তার আত্মার যে অবস্থা হয় সেই অবস্থাটির নাম প্রার্থনার অবস্থা। সে তখন কথা বলুক অথবা রোদন করুক , অস্থির হয়ে ধূলিতে লুটিয়ে পড়ুক বা কারো
কাছে দীর্ধনিম্বাস ত্যাগ করুক , অথবা সম্পূর্ণ ধীর ভাবে প্রাণের মধ্যে তাকে স্মরণ করুক , সে প্রার্থনা করছে।
(৫) সাধককে প্রথম ও প্রধানত সররকম পাপ ধৰ্ম্ম বিরোধী, তৎপরে অহঙ্কার ও সংসারে অনাশক্তি হতে হবে। এই সমস্ত চলে না গেলে প্রকৃত ব্যাকুলতা আসে না । যােগ শান্ত্রে এই বিষয় নিয়ে অনেক ব্যাখ্যা আছে। কিন্তু যা বলা হল তাই প্রকৃত কথা। আমি ব্রাহ্ম ধৰ্ম্ম অতিরিক্ত এক চুলও যাই নাই। যা সত্য তাই ব্রাহ্মধর্ম। মানবাত্মা ব্রাহ্মধর্ম কখনও পরিত্যাগ করতে পারে না। এমন সম্প্রদায় নাই , এমন লােকই নাই যার মধ্যে অল্প বা অধিক পরিমাণে সত্যধৰ্ম্ম নেই । যদি কোন নাস্তিক সরল ভাবে অনুসন্ধান করেও ঈশ্বরে বিশ্বাস করতে না পারেন , অথচ যদি তার জীবনে নানা সদগুণ লক্ষিত হয় , তাহলে ঐ সমন্থই ব্রাহ্ম ধর্ম বলে আমি তার কাছে শিক্ষা করতে পারি। সুতরাং যে কেহ যে পরিমাণে সত্য পথ অরাধন করিয়া থাকে সে সেই পরিমাণে ব্রাহ্ম ধর্মের অনুসারী। কিন্তু ব্রাহ্ম সমাজ ও ব্রাহ্ম ধৰ্ম্ম এক নয়। ব্রাহ্ম ধৰ্ম্মের আদর্শে জীবন গঠন করার উদ্দেশ্য সে সকল লোক একত্র হয়েছেন তাদের সম্মিলিত নাম ব্রাহ্ম সমাজ। ব্রাহ্ম ধৰ্ম্ম সকল জাতির মধ্যে এবং সকল ধর্ম সম্প্রদায়ের মধ্যেই কম বেশি আছে।
(৬) শক্তিশালী জীবন্ত প্রার্থনাই প্রকৃত সাধন। অনেকে একে অজপা সাধন বলে থাকেন। কারণ এতে অবিশ্রাম সাধন করতে হয়। পারানায়াম কে অনেকে ভূতগুদ্ধি বলে থাকেন , কারণ এর মাধ্যমে শরীর শুদ্ধ হয় এবং তার সাথে মন ও কিছুটা একাগ্রতা লাভ করে থাকে
এটি বাইরের অবলম্বন মাত্র। যেমন খােল, করতাল, সঙ্গীত, স্তব, স্তুতি ইত্যাদি বহিরের অবলম্বন দিয়ে সাধনের কিঞ্চিৎ সাহায্য হয় প্রানায়ামেও তেমন হয়ে থাকে।
(২)
দীক্ষার পূর্বে যখন যে ভাব প্রবল হয় ও মিষ্ট বােধ হয় তখন সেই নামই জপ করলে উপকার হয়। পরমেশ্বরের কোন নির্দিষ্ট নাম নাই । ব্ৰহ্ম, ঈশ্বর, হরি, দুর্গা, কালী, কৃষ্ণ, গড যে কোন নামে সেই পূর্ণ পরাৎপর অদ্বিতীয় ঈশ্বরকে ডাক, ক্ষতি নেই। তবে, নাম বাইরের জিনিষ, যোগসাধন প্রাণের বন্তু। একে এক কথায় জীবন্ত প্রার্থনা ৰা ব্ৰহ্ম সাধন বলা যেতে পারে। এর সাথে যে নামের যােগ তাও প্রাণায়ামের মতো বাইরের অবলম্বন মাত্র। কিন্তু কোন একটি নির্দিষ্ট নাম যে সকলকেই গ্রহণ করতে হবে তাও নয়।
(৬) যোগসাধনা নাম সাধনা নয়। এটি সাক্ষাৎ ব্রহ্ম সাধনা। এ সাধনার প্রকৃত তথ্য সম্পূর্ণ আধ্যাত্মিক ; তা ভাষায় বা অন্য কোনও উপায়ে ব্যক্ত করা যায়না। যদি ব্ৰহ্ম কৃপায় উপযুক্ত সময়ে কারো ভাগ্যে সেই অবস্থা প্রস্ফুটিত হয় তবে তিনিই বুঝতে পারেন এই সাধন কি। নয়তো কেবল প্রাণায়াম বা নাম সাধনই সার। তবে ঐ নামটির উপকারিতা এটুকু যে তাতে একটু বিশেষ ভাৰযােগ হয়। স্মরণ করতে করতে পূর্বের লন্ধ অবস্থা আবার প্রাণে কিছুটা জেগে ওঠে। যাহা কিছু ধৰ্ম্ম ও মানবাত্মার কল্যাণকর তা লোক শিক্ষার জন্য সবার সামনেই করা উচিত বলে অনেকে মনে করেন। কিন্তু এই সাধনের প্রকৃতি যেরূপ বর্ননা করা হলো তা একটু চিন্তা করে দেখলেই বোঝা যাবে যে ব্রাহ্ম ধর্মের অন্যান্য সত্য প্রচারের মতো। প্রার্থনার অবস্থা কি প্রচার করা যায় ? এজন্য বাস্তবিকই প্রতিনিয়ত স্বজনে নির্জনে সবসময়ই আমাদের সাধন চলতে থাকে, অথচ কেউ তা জানতে পারেনা বুঝতেও পারেনা। তবে যখন সকলে প্রকাশ্যে একত্রে প্রাণায়ামাদি সাধন করলে একটি মহৎ অপকার এই হয় যে ভিতরের কথা কিছুই না বুঝে দর্শকগণ প্রাণাআমের বিরুদ্ধে উপহাস করতে পারেন। এই আশঙ্কায় প্রকাশ্যে প্রানায়ামাদি না করাই উত্তম।
(৭) সর্বশক্তিমান পরমেশ্বর যখন আমাদের সাধনের লক্ষ্য এবং কেন্দ্র , সিদ্ধি এবং উপায় , তখন তিনি ইচ্ছা করলে মানবের যােগ শক্তি স্বয়ং বিকশিত করে দিতে পাবেন। কিন্তু এরূপ অনুকুল অবস্থা অতি বিরল। এমন স্বয়ংসিদ্ধ লােক জগতে অধিক দেখা যায় না, যােগ শক্তি প্রত্যেক মনুষ্যেরই মধ্যে বর্তমান আছে। কিন্তু ঐ শক্তি জাগ্রত না হলে বাইরের প্রার্থনা ভেতরে প্রবেশ করে না। ঐ নিদ্রিত শক্তির জাগরণ বা বিকাশ করতে হলে অপর কোন জাগ্রত বা বিকাশপ্রাপ্ত শক্তির অর্থাৎ ঐ রকম শক্তিশালী গুরুর সাহায্য দরকার। আদি গুরু পরমেশ্বর আমাদেরকে জল, অগ্নি, বায়ু, পৰ্বত, নদ, সমুদ্র, প্রভৃতির মধ্য দিয়ে নানা উপায়ে ধৰ্ম্ম শিক্ষা দিয়ে থাকেন। তেমন মানুষের মধ্যমেও শিক্ষা দেন। এভাবে বিশ্ব সংসারের যাবতীয় পদার্থ এবং মানুষের সাহায্য দরকার। জাগ্রত শক্তিশালী বিশেষ মানুষের সাহায্য সাধারনের নিতান্ত দরকার; একেই দীক্ষা বলে। আধ্যাত্মিক অবস্থা অনুকুল থাকলে ভগবং কৃপায় দীক্ষায় শক্তি লাভ করা যায়। এক সাধক প্রথমে ব্রাহ্মণ গুরুদেবের কাছে সাধন প্রণালী শিক্ষা লাভ করেন , তারপর ছয় বছর কঠোর তপস্যা করেও তার শক্তির জাগ্রত হয়নি। অবশেষে তীব্র ব্যাকুলতা নিয়ে বােধিন তলে যখন দৃঢ় প্রতিজ্ঞার সাথে বসলেন সেই সময়ে ঈশ্বর কৃপায় তার মধ্যে বুদ্ধের যােগ শক্তি প্রবেশ করলো এবং তিনি বুদ্ধত্ব লাভ করলেন। এরকম ব্যাকুল হয়েছিলেন বলেই এই শক্তি লাভ করেছিলেন।
(৩)
সাধনের ভিতরের তত্ত্ব ভাষায় প্রকাশ করা যদি অসস্তব হয় তবে একজন অন্য একজনকে কিভাবে সাধন দিয়া থাকেন, এমন প্রশ্ন অনেকের মনে আসতে পারে। কথায় সাধনের বাইরের প্রক্রিয়া ও নিয়মাবলি বুঝিয়ে দেয়া হয়ে থাকে, ভিতরকার তত্ত্ব অর্থাৎ পূর্বোক্ত জাগ্রত প্রার্থনা উপদেশের মাধ্যমে শিক্ষা দেয়া অসম্ভব। কিন্তু যেমন শরীরে শরীরে, মনে মনে, স্বাভাবিক সম্বন্ধ ও সহানুভূতি আছে তেমন, আত্মীয় আত্মীয়ও সহানুভূতি দেখা হয়। ব্রাহ্ম সমাজে এমন উদাহরণ সর্বদাই পাওয়া যায়। আচাৰ্য যখন বেদী হতে উপাসনা করেন তখন যদি কোনদিন তার সত্যভাবে উপাসনা হয়, সেদিন ভক্তদের প্রাণ স্পর্শ করে, নতুবা অন্যদিনের মতো নীরস
ও প্রাণহীন কথা শুনে তারা উঠে পড়েন। অধ্যাত্মিক সহানুভূতিই এর মূল। যেমন আচার্যের সত্য প্রার্থনা উপাসকদের প্রাণ স্পর্শ করে ও তাদের প্রাণেও জাগ্রত প্রার্থনার উদয় করে দেয়, তেমন উপাসকদের মধ্যে যদি কারো প্রাণে বাস্তবিক সত্য প্রার্থনা জাগ্রত হয় তা হলেও তেমন ঘটনা হয়ে থাকে। হয়ত আচাৰ্য নীরস ভাবে কিছু কথা মাত্র উচ্চারণ করতে ছিলেন , কারো প্রাণ স্পর্শ করছিল না, হঠাৎ ঐ সৌভাগ্যবান উপাসকের জীবন্ত প্রার্থনার ভাব আধ্যাত্মিক সহানুভুতি বশতঃ আচার্যের এবং অনেক উপাসকের প্রাণে সংক্রামিত হয়ে তাদেরকে একেবারে বিহবল করে দিলো। এই নিয়মানুসারেই প্রতি বছর উৎসবাদিতে এমন ঘটনা অনেক দেখা যায়। কেউ প্রকৃত ব্যাকুলতার সাথে ঐ প্রার্থনার অবস্থা আপনার প্রাণে অবতীর্ণ করবার জন্য ইচ্ছুক হলে কোন জাগ্রত শক্তিশালী পুরুষ নিজের ইচ্ছা শক্তিতে ও ভগবানের কৃপায় নিজের অভ্যন্তরীণ প্রার্থনার অবস্থা তার প্রাণে সংক্রামিত করে দিতে পারেন। বস্তুতও তাই হয় ; যিনি নিতান্ত ব্যাকুল প্রাণে প্রার্থী হন আমি সমস্ত প্রাণের সহিত তাহার সম্মুখে প্রার্থনা করি। এবং এই সময়ে আমার পুজনীয় গুরু আমাকে সাহায্য করে থাকেন। ঈশ্বরের কৃপা দৃষ্টি হলে অল্পক্ষণের মধ্যেই ঐ ব্যক্তির হৃদয়ে সেই রকম শক্তির সঞ্চার ঘটান।
(৯) প্রার্থনা জাগ্রত হয় এবং তার অন্তর্নিহিত যোগশক্তি প্রখটিত হয়। তিনি ছাড়া বাইরের অন্য কেউ বুঝিতে পারে না। এই অবস্থাকে যােগীরা সঞ্চারের অবস্থা বলেন। তারপর হতে যিনি যে পরিমাণে ব্যাকুলতা ও নিষ্ঠার সাথে এই সাধন করতে থাকেন তিনি ততই গভীর হতে গভীরতরত সকল প্রত্যক্ষ করে আশ্চর্য হন। ক্রমেই নতুন নতুন রাজ্য তার অন্তরে প্রকাশ হতে থাকে। অবশেষে সব আকাঙ্খা পূর্ণ হয়, অনন্ত উৎস খুলে যায় এবং ব্ৰহ্ম কৃপায় সাধনের উচ্চ অবস্থায় যোগ আরম্ভ হয় ও অনন্তকাল চলিতে থাকে। যোগ প্রাপ্তির জন্য যিনি ব্যাকুল হন, যার বিবেক যোগ প্রতিপালন করতে প্রস্তুত হয় , তিনিই এই সাধন গ্রহণ করতে পারেন।
(১০) সত্যজ্ঞান ছাড়া ধর্ম হয় না। প্রাণে প্রকৃত সত্য ধর্ম অবতীর্ণ হলে ধর্মের লক্ষণ সমুহ প্রকাশিত হয়। সত্যের সূর্য উদিত হলে তবে কুসংস্কার, ভ্রম দূর হবে। পাপ ও দুর্বলতাও কেউ নিজের চেষ্টায় দূর করে ধাৰ্মিক হতে পারে না। যখন প্রার্থনা, জ্ঞান, প্রেম ও পবিত্রতার অনন্ত আধার পরমেশ্বর নিজগুণে কৃপা করে আত্ম স্বরূপ সাধকের আত্মার সম্মুখে প্রকাশ করেন, তখনি তার সমন্ত অজ্ঞানতা ও মলিনতা দূর হয়। আলাে আনবার পূর্বে সহস্র চেষ্টা করেও গৃহের অন্ধকার দূর করা যায় না, তবে যে পরিমাণে আলােকরশ্নি গৃহে প্রবেশ লাভ করে, সেই পরিমাণেই গৃহ আলােকিত হয়ে থাকে। ধর্ম সাধন অবলম্বন করা মাত্রই কেউ উদ্ধার হয় না। সাধনের পরিণত অবস্থার নামই মুক্তি। যারা সাধনহীন হয়ে পাপের মধ্যে নিমগ্ন ছিল তাদেরকে এই পথের পথিক করে ভবিষ্যতের দরজা খুলে দেয়াই মঙ্গল।
(৪)
সাধনের লক্ষ্য যদি স্থির থাকে এবং নিষ্ঠা যদি অটল হয়, তবে তার পথে কোন প্রকার বাধাই প্রকট হয় না। যারা এর লক্ষ্য স্বরূপ পরব্রহ্মকে বিস্তৃত হয়ে অন্য কিছু অবলম্বন করবেন তাদেরকে সাধ্যমত সুপথে আনবার চেষ্টা করবেন, না পারিলেই বিপদ। সেসকল লােক কিন্তু সেদিনই সাধন ভ্রষ্ট বলে পরিগণিত হবে। মনে রাখতে হবে যে ব্রাহ্মধর্মের লক্ষ্য একমাত্র ব্রহ্ম লাভ , এবং ব্রহ্মসাধন পাপী তাপী ও ভ্রান্ত জনগনের সুচিকিৎসার হাসপাতাল।
(১১) মানুষ অপূর্ণ। এখনও অপূর্ণ , সেই প্রাচীন কালেও অপূর্ণ ছিলো। সুতরাং আজ যা সত্যজ্ঞান হচ্ছে কাল হয়তো তা কুসংস্কার বলে পরিত্যক্ত হবে, তাতে আশ্চৰ্য্য কি ? একটু বিবেচনা করে দেখলে বোঝা যাবে যে, অনেক শতাব্দী আগে ঋষিদিগের মধ্যে যে সকল মত আমরা এখন দূষিত বলে মনে করছি তা সেকালে শুদ্ধ ও সত্য মত ছিলো।
(১১)
বর্তমান সময়ের সাধকগণের মধ্যে যাঁরা ব্রহ্ম কৃপা লাভ করবেন তাদের পক্ষে এই সব ভ্রম ও কুসংস্কার থাকা অসম্ভব। তবে তাঁরা বর্তমানের অপুর্ণ জ্ঞানে যাকে সত্য বলে বিশ্বাস করবেন , সহস্র বৎসর পরে যােগীর চোখে হয়ত তার অনেক কথাকে ভ্রান্ত দেখবেন এবং নতন বিষয় সকল তখন তাদের চোখে সত্য মনে হবে। এভাবে অনন্তকাল মানবাত্মার উন্নতি হতে থাকবে।
(১২) কেউ ব্যাকুল ভাবে প্রার্থী কিনা তা কিভাবে স্থির হয় ? মহাত্মাদের অন্যের আত্মবিচারের শক্তি আছে। মানুষ যতই ঈশ্বরের দিকে অগ্রসর হবে ততই তাদের আভ্যন্তরীণ সমস্ত শক্তি বিকশিত হয়ে ধীরে ধীরে পূর্ণতার দিকে অগ্রসর হবে। যার জ্ঞানের জড়তা যত বেশি তার এই শক্তি তত অল্প এবং যার যে পরিমাণে অন্তদৃষ্টি খুলেছে তিনি সেই পরিমাণে বিশ্ব সংসারের যাবতীয় বস্তুর প্রকৃত তত্ত্ব উপলব্ধি করতে সমর্থ। এইরূপে মহাত্মারা সাধারণ লােকের চেয়ে বেশি তত্ত্ব অবগত হন। মানুষের আত্মার অবস্থা এমন কি বহুদূর হতেও লক্ষ্য করেন।
সাধনের নিয়ম দুই জাতীয়- বিশেষ ও সাধারণ। বিশেষ নিয়ম এই যে ( ১ ) এতে কোন সম্প্রদায় নেই। তিল , মুসলমান , খৃষ্টান , বৌদ্ধ , বৈষ্ণব , শাক্ত , শৈব , নানক পষ্ঠী ইত্যাদি পৃথিবীতে মত বিভিন্ন সম্প্রদায় আছেন তাদের সকলেরই মধ্যে সত্য ধৰ্ম্ম বিদ্যমান আছে। সেই সত্য সৰ্ব্বত্র হতে গ্রহণ করতে হবে ও যেখানে কিছু পেলে তারই নিকট মাথা অবনত করে ভক্তি শ্রদ্ধা প্রকাশ করবে। জগতের সমস্ত সাধুর প্রতি সরল ও অবিমিশ্ৰ শ্রদ্ধা করা চাই। এইসব অবলম্বীরা কোন স্বতন্ত্র সম্প্রদায় গড়তে পারবেন না।
(২) এতে মানুষ বা অন্য কিছুই অবলম্বন নয়। ঈশ্বর স্বয়ংই এর একমাত্র গুরু ও মানুষ সাধারণ ভাবে শুরু বা উপদেষ্টা। জ্ঞানীর চোখের দৃষ্টিশক্তি ঈশ্বর প্রদত্ত, কিন্তু কোন কারণে ঐ শক্তি অবরুদ্ধ হলে মানুষের সাহায্য প্রয়োজন হয় , এখানেও সেই রকম। ব্ৰহ্মই এর একমাত্র ও অদ্বিতীয় লক্ষ্য ও গমস্থল এবং সত্যই এর একমাত্র পথ।
(১৩ ) দেহ ও মন সৰ্ব্বতোভাবে পবিত্র রাখা কর্তব্য । অর্থাৎ বিবিধ উপায়ে শারিরীক সুস্থতা বজায় না রাখলে সাধন হয় না। কুচিন্তা এমন কি মন্দ কল্পনা পর্যন্ত মনে আসলে সাধনের বিশেষ ক্ষতি হয়।
দিবানিশি অৰিভ্রান্ত প্রার্থনা করা দরকার। জীবনের যে সকল কর্তব্য কাজ সম্পন্ন করার তা উপযুক্ত সময় মত করে অবশিষ্ট সমস্ত সময় সাধনে নিমগ্ন থাকা উচিত। এগুলো সকলের প্রতি পালনীয় বিশেষ নিয়ম। আরো কতকগুলি সাধারণ নিয়ম আছেঃ ( ১ ) মাংস খাওয়া নিষেধ। তবে চিকিৎসকের ব্যবস্থা মতে নিতান্ত প্রয়োজন হলে খাওয়া যেতে পারে। মাংসের উগ্ৰকারিতা শক্তির কারনে তা চিত্ত সংযমনের বিরােধী। সাধকেরা চিরকাল মাংস ভােজন নিষেধ করেন। অনেকে মাছ খান৷ তবে ক্রমে মাছ-মাংস খাওয়া বন্ধ করাই উত্তম।
(৫)
অপরের উচ্ছিষ্ট ভােজন নিষেধ। কারন এর মাধ্যমে নানাবিধ রােগ সংক্রামিত হতে পারে। তবে পিতা মাতা গুরুজনেরা কিংবা কোন বন্ধু আদর করিয়া কিছু দিলে তা গ্রহন করা যেতে পারে।
সামাজিকতায় পড়ে অনেক কিছু ইচ্ছার বিরুদ্ধেও করতে হয়। কোন ধর্মাত্মা সাধুগণের ভুক্তাৰশেষ ভোজনে শ্রদ্ধা হলে তা গ্রহণে ক্ষতি নেই বরং উপকার হয় । এমন স্থানে প্রেমের প্রবল স্বাভাবিকীশক্তির কারনে কোথায় খাওয়া উচিত কোথায় নয় তা পরিবেশ পরিস্থিতি বুঝে স্থির করা কঠিন বলে এমন নিয়ম অবধারিত হয়েছে। আর যখন এতে বিবেকের কোন হানি নেই তখন ঋগ্বেদের সময় হইতে যে সাধন চলে আসছে তার বহুশতাব্দির পরীক্ষিত নিয়ম কানুন জোড় করে পরিবর্তনের প্রয়োজন নেই। তবে সকল ক্ষেত্রেই অতি সতর্ক হওয়া উচিত। কোনভাবে নিজের মধ্যে যেন অপরিত্রতার লেশ মাত্র প্রবেশ না করে। যতদিন সাধক পবিত্র স্বরূপে নিমগ্ন হয়ে নিজের প্রবৃত্তিসমূহ সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ করতে না পারেন ততদিন তাকে সদাসর্বদা সতর্ক থাকাই বিধান।
যদি আমাদেরকে সম্পূর্ণ নিজের চেষ্টায় যোগ পথে চলতে হতো তা হলে যুগযুগান্তর ও হয়ত কোন গৃহস্থ সিদ্ধাবস্থা লাভ করতে পারতেন কি না সন্দেহ। কিন্তু সৌভাগ্য ক্রমে কয়েকজন সিদ্ধ মহাত্মা পৃথিবীর বর্তমান সময়ের ধর্ম সম্বন্ধীয় অবনতি দেখে কৃপা করে তা দূর করার জন্য এগিয়ে এসেছেন। তারাই দেশ বিদেশে ভ্রমণ করে উপযুক্ত ধর্ম পিপাসু ব্যক্তিদের এই সাধন শিক্ষা দিচ্ছেন।
(১৩) কেউ যদি নিজ চেস্টায় গবেষণা বলে এইসকল মহাত্মাদের সত্যসমূহ পুনরায় নতুন ভাবে আবিষ্কার করতে চান তাহলে হাজার বৎসরেও পারেন কিনা সন্দেহ । অথচ সংসারের নানান উৎপাত ও ব্যাঘাত সত্ত্বেও অনেকেই আধ্যাত্মিক সহায়তা লাভ করে অল্পসময়ের মধ্যেই কৃতকার্য হয়েছেন এবং অনেকেই হবেন সন্দেহ নেই।
(১৪) কোন সৃষ্ট বস্তু জীব বা মনুষকে বিশ্ব নিয়ন্তা সর্বশক্তিমান পরমেশ্বর জ্ঞানে পূজা করার নাম অবতার বাদ । তবে ব্রাহ্ম ধৰ্ম্মের সঙ্গে এর কোন সম্বন্ধ নেই। পূর্বোক্ত সাধনের নিয়মগুলো এককালে বিলুপ্ত হলে এ সাধনের মধ্যে অবতারবাদ আসতে পারে।
অপূর্ণ সেই মনুষ্যকে , তার উপদেশকে , অথবা তার উল্লেখিত শাস্ত্রকে অভ্রান্ত মনে করে তার কাছে নিজের বিবেককে নত করার নাম গুরুবাদ । বিবেকই ঈখর লাভের প্রকৃত পথ , এজন্য সবাই বিবেকই মানবের সর্বোচ্চ স্থান মনে করে।
যেখানে কারো উপদেশ বিবেকের বিরুদ্ধ হলে তা অনুসরনীয় নয়। যতক্ষন ভক্তির সাথে জ্ঞান অবলম্বন করা না হয় ততক্ষণ সাধন পরিণত হতে পারে না।
(১৪) বিনীত হৃদয়ে কৃতজ্ঞতার সাথে গুরুজন , শিক্ষক ও ধর্মোপদেষ্টাকে ভূমিষ্ট হয়ে প্রণাম করা ও তাদের পদধুলি গ্রহনের মাধ্যমে ভক্তি প্রদর্শন করা আমাদের দেশের চিরন্তন রীতি। পাশ্চাত্য শিক্ষা ও তাদের জীবন প্রনালীর প্রভাবে এই নির্দোষ ও কল্যাণকর চিরান্তন দেশীয় প্রথা বিলুপ্তর পথে। ব্রাহ্ম ধর্ম দেশীয় রীতি নীতি সমস্তকে কুসংস্কার ও বর্জনীয় মনে করা দুরে থাকুক যথা সম্ভব দেশীয় রীতি নীতিই অবলম্বন করবেন। তারমধ্যে যা কিছু অসত্য তা সর্বতোভাবে পরিত্যাগ বা পরিবৰ্তন করে নিবেন । যেটুকু সত্য ও বিশুদ্ধ তা শ্ৰদ্ধার সাথে গ্ৰহণ করবেন । নতুবা ব্রাহ্মধর্ম আমাদের জাতীয় ধৰ্ম্ম হতে পারবে না। আর যে অবস্থায় একজনের আত্মা অনেকের কাছে অবনত মস্তকে পদধূলি গ্রহণে ব্যাকুল হয় , তা অতি সুন্দর ও কল্যানকর মনে করি । এই জন্য আমি ছােট বড় সকলেরই চরণে প্রণত হই এবং কেউ সেই ভাবে আমাকে প্রণাম করিয়া পদধূলি গ্রহণে উপকৃত হবে বুঝতে পারলে তাকে বাধা দিই না । কিন্তু ঐ সমস্ত প্ৰণাম বিশ্ব গুরুর প্রাপ্য বলে প্রতি প্রণাম করিও ' জয় গুরু জয় গুরু এই শব্দ উচ্চারণ করি - তখন যে পদস্পর্শ করে প্রণাম করা হয় তাকে আমি অবৈধ মনে করি না।
(৬)
কাউকে অযথা ঈশ্বরের অবতার মনে করে অতি ভক্তির সাথে যথা তথা প্রনাম করাও অনুচিত। এটি ঘাের অধৰ্ম্ম।
(১৫) সকলের জন্য একনাম ব্যবস্থা নয়। প্রত্যেক নামের অর্থ সুস্পষ্ট ভাবে বুঝিয়ে দেয়া দরকার।
কিন্তু না হলেও ক্ষতি হয় না ; কেননা ঈশ্বরের কোন নির্দিষ্ট নাম নেই । যে শব্দই তাতে প্রয়ােগ কর তাই তাহার নাম।
অভক্তিতে ওঁ উচ্চারণ করলে এর কোন অর্থই হয় না, কিন্তু ওঁ এই সাঙ্কেতিক বীজের মধ্যে ঈশ্বরের সমস্ত স্বরূপ নিহিত রেখেছেন। ঈশ্বরের জপের নির্দিষ্ট কোন নাম নেই আবার সবই তার নাম। তুমি ভক্তির সাথে হরি , কৃষ্ণ , কালী যে নামে ইচ্ছা , এমন কি ইক , কলকে , টেকি বলে ডাকলেও সময়ে উত্তর পাবে এবং প্রত্যক্ষ দেখতে পাবে । তখন আর তােমার নামের প্রয়োজন থাকবেনা । এইজন্য অর্থ বুঝি বা না বুঝি , ঐ শব্দে যদি আমার উপাস্য দেবতাকেই লক্ষ্য করে স্মরণ করি তাহলেই হলো , নতুবা ঈশ্বর বললে বড় রাজা বুঝাতে পারে , হরি বলতে বড় কোন প্রানী বা আপনার পাড়ার ধনী কোন ব্যক্তিকে বোঝাতে পারে।
(১৬) যারা আধ্যাত্মিক ভাব গ্রহণে অসমর্থ , তাদের উপাসনাদিতে , রাধাকৃষ্ণের নাম গান বাবহার করেন। কিন্তু যতদিন রাধাকৃষ্ণের ঐতিহাসিক লজ্জাকর দৈহিক প্রেমের ভাব দূর হয়ে তাদের সুন্দর আধ্যাত্মিক ভাব জনসাণারণের মধ্যে প্রচারিত না হয় , ততদিন তেমন কাজ উচিত বলে বিবেচনা করি না । অর্থাৎ প্রাণ ভগবানের যে নামে তৃপ্ত হয় সেই নামই করা উচিত । যতদিন কোন নামে ঈশ্বর ব্যতীত অন্য কোন পরিমিত বস্তু ব্যক্তি বা মুৰ্ত্তি সাধারণের বোধগম্য থাকিবে ততদিন তমন করলে সত্য প্রচারের হানি হতে পারে । তবে যতক্ষণ মনে ভক্তি আছে আর সেই ভক্তির শক্তি আছে ততক্ষন নামের বিভিন্নতায় কিছু আসে যায় না । হিন্দুদিগের নিকট ধর্ম প্রচার করতে হলে দুর্গা, কালী প্রভৃতি দেব দেবীর প্রকৃত তত্ত্ব তাদের হৃদয়ঙ্গম করিয়ে দেয়াতেই বিশেষ উপকার হবে। রামপ্রসাদ প্রভৃতি প্রকৃত সাধকগণ কালী দুর্গা নামের ছলে ব্রক্ষ্মাকেই সাধন করেছেন তাদের সঙ্গীতে।
( ১৭ ) তাদের প্রমাণ পাওয়া কাজ । কিন্তু কোন প্রকারে ঐ সব দেশ দেশীর মূর্তি বা রূপের প্রশংসা করে পৌলিকতায় প্রশ্রয় দেওয়া উচিত নয় । ঈশ্বরকে যে নামে ইচ্ছে ডাকলেই পাওয়া যায়।
এটা অবশ্যই ভুলে গেলে চলবে না যে হিন্দুরা মূর্তি পূজা করে না, মূর্তিতে পূজা করে।
তাই লোক দেখানো নয় বরং প্রকৃত পূজা হলে পূজা সত্য, নামও সত্য।
এই সাধন দেবার অধিকার কোন ব্যক্তিবিশেষে নিবদ্ধ নয়। ভগবানের সত্যধৰ্ম্ম যিনি যে পরিমাণে প্রানে লাভ করবেন তার সেই পরিমাণে পরােপকার করবার শক্তি জন্মে । কিন্তু যার নিজের চোখ খোলেনি, নিজের যোগশক্তি নেই সে অন্যের চোখ খুলে দিতে, অন্যের যােগ শক্তি প্রস্ফুটিত করে দিতে যে শক্তি প্রয়োজন, সেশক্তি যিনি লাভ করেননি তিনি কখন ও এই সাধনে অপরকে দীক্ষিত করতে অধিকারী নন।
প্রবর্তক অবস্থার মধ্যে ধর্মের প্রাথমিক কয়েকটা ভাব মাত্র উন্মেষিত হয় ; যথাঃ বৈরাগ্য , প্রেম , পবিত্রতা। এমন সাধন অবস্থায় ভগবানের আবির্ভাব অল্পই প্রকাশ হতে থাকে।
যােগ শিক্ষা করতে হলে এমন কোন সিদ্ধ যোগীর কাছেই দীক্ষালাভ করা উচিত । কিন্তু যে সকল যােগীদের সাথে কোন সিদ্ধ মহাপুরুষের সাক্ষাৎ যোগ আছে তাদেরকে যদি ঐ মহাত্মার মধ্যে শক্তি সঞ্চারের ক্ষমতা দিয়ে দীক্ষিত করতে আদেশ করেন তাহলেও সেইরূপ ফল লাভ করা যায় । নতুবা যার তার কাছে দীক্ষিত হওয়া অকর্তব্য । যে অন্ধ সে অপরকে পথ দেখাবে কি করে? যার শক্তি অনন্তশক্তিমান পরমেশ্বরে যুক্ত হয়েছে তিনিই শক্তির অনন্ত প্রস্রবণ লাভ করেছেন। এছাড়া কারো দীক্ষা দেবার অধিকার নাই । এইরূপ হীনাবস্থার লােকের নিকট দীক্ষা নিয়েই আমাদের দেশের মানুষদের দুর্গতির অন্ত নেই।
আধুনিক ইন্টারনেটের যুগে দীক্ষা রীতিমতো ব্যবসায় পরিনত হয়েছে। কিছুদিন আগে শুনেছি মোবাইলে বিয়ে হয়।তেমনি, আজ কাল শুনতে পাই, মোবাইলে দীক্ষা হয়। তাহলে বুঝুন কেমন গুরু। অনেক গুরু ছদ্মবেশীরা ফেইসবুকে একাধিক আইডি চালিয়ে সরল ভক্তদের প্রতারিত করছে৷ এক ব্যক্তিই মাতাশ্রী, পিতাশ্রী হচ্ছেন। পুরুষ হয়েও মহিলাদের ইনবক্সে মাতাজীর ছদ্মবেশে তাদের ব্যক্তিগত রোগের প্রতিকাররের পরামর্শ দিচ্ছেন। তারা সরল প্রান ভক্ত-শিষ্যদের মনগড়া নিয়ম কানুনের ফাঁদে ফেলে জন্মদাত্রী মায়ের রান্না খাওয়া যাবে না এমন ফতোয়াও দিয়ে থাকে। এমন অনলাইল গুরুদের, অনলাইনেই মুখোশ উন্মোচন করে দিন। সমাজ ও জাতিকে রক্ষা করুন।
(৭)
যিনি মুক্তির জন্য ব্যাকুল হয়ে তাঁর আছে প্রার্থণ করবেন , তিনিই মুক্তি লাভ করবেন। এতে কোন সন্দেহ নেই। তাহার ধৰ্ম্ম লাভের জন্য যে উপায় শ্রেষ্ঠ তা, তার কাছে প্রকাশ করবেন। তাঁর উপর সম্পূর্ণ নির্ভর করে চলার বিকল্প নেই। এমন কি আমি বিশ্বাস করি পৃথিবীর পাপী তাপী যাবতীয় নর নারীই মুক্তির অধিকারী । এ জন্মে না হলেও, জন্ম জন্মান্তরে প্রত্যেক মানবাত্মা পূর্ণতার দিকে চলবেই চলবে ।
ঘােগী দের সংবাদ পত্র নাই , বক্তৃতা নাই , বা কোন চাহিদা । তাদের সংবাদ প্রকাশিত হয় না, তারা প্রায়ই গোপনে , নির্জন কাননে বা গিরিতে বাস করেন , লােকালয়ে যখন আসেন তখনও সচরাচর সাধারণ লোকের সাথে দুচারিটা কথা বলে চলে যান। এইসব কারণে যদি কেউ মনে করেন যে তারা অলস - প্রকৃতি , ধ্যান সর্বস্ব , সংসা - বিমুখ ভিক্ষুক মাত্র , তাহলে তার , ঘোরতর অপরাধ হয় মনে করি । যদি একটি সপ্তাহ কোন প্রকৃত যোগীর সাথে কাটানো যায় তাহলে বুঝা যায় যে তারা কেমন পরােপকারী , সংসারের কল্যানের জন্য কত চিন্তা করেন ও কিরূপ ভয়ানক ত্যাগ স্বীকার করেন।
এবং ঈশ্বরের কৃপায় ও নিজেদের শক্তি বলে নিশ্চয়ই কৃতকার্য হন । যারা জীবনে কখনও কোন যােগীর সথে সাক্ষাৎ করেননি , কখন কোন মহাত্মা সঙ্গ লাভে জীবন সার্থক করেননি , বরং কতগুলো ভন্ড অলস ও ব্যবসায়ী সন্ন্যাসী - মাত্র দেখে যােগ- দর্শনের জ্ঞান পেয়েছেন তারা যােগী - চরিত্রের অদ্ভুত রহস্য কি বুঝবেন ? তাদেরদের এ সম্বন্ধে কোন কথা বলারই অধিকার নেই । যে দেশের ঋষিরা কবি , ঋষিরা দার্শনিক , ঋষিরা সাহিত্য লেখক , ঋষিরা বিজ্ঞানী হয়ে প্রভৃতির আবিষ্কর্তা , ঋষিরা জ্যোতিবিদ , ঋষিরা গণিত শাস্ত্রের উদ্ভাবক , ঋষিরা দৈহিক যন্ত্র বিজ্ঞান ও আয়ুৰ্ব্বেদের সৃষ্টিকর্তা , যে দেশের ঋষিরাই সংসারের আদি , মধ্য ও অন্ত — সেই দেশে যে আজ যােগ , তপাস্যা উপেক্ষিত এরচেয়ে অধিক আশ্চৰ্য্য ও দুঃখজনক ব্যাপার আর হতে পারে না।
যে দেশে জনক , বশিষ্ঠ- প্রভৃতি মহাযোগীগণ জন্ম গ্রহণ করে সংসারত্ব ও ধর্ম যে একই বস্তু এই মহাসত্যের পরিষ্কার দৃষ্টান্ত দেখিয়ে গেছেন , যে দেশের তাপস্বী বুদ্ধদেব , শঙ্করাচাৰ্য , নানক , কবীর ও চৈতন্য সকলেই মঙ্গলের জন্য নিজ নিজ সুখ - শান্তি, সম্পত্তি সহ সমস্ত জীবন উৎসর্গ করে
গেছেন , এখনো যে দেশের আধ্যাত্মিক অবনতি ও নৈতিক অবক্ষয় দূর করার জন্য কত কত সিদ্ধ মহাপুরুষগণ অরণ্যের বা পর্ব গুহার নির্জন সাধন পরায়ন হয়ে, সুখ-শান্তি পরিত্যাগ করে অনাহার , অনিদ্রা , ইত্যাদি শত সহস্র ক্লেশ উপেক্ষা করে দূর দূরান্তর পদব্রজে পরিভ্রমণ করছেন , এবং বিধিমতে ধৰ্ম্ম পালন করে জনগণের অন্ধকারময় জীবনকে প্রেম , পবিত্রতা ও সত্যধৰ্ম্মের জ্যোতিতে উদ্ভাসিত করছেন, অজ্ঞানকে জ্ঞান ও হতাশকে আশা দিয়ে প্রতিদিন এই হতভাগ্য দেশে পুনরায় সৌভাগ্য - লক্ষ্মী আনার জন্য অবিশ্রান্ত - পরিশ্রম করছেন - সে দেশের লােক হয়ে চোখ থাকতেও আমরা অন্ধের মতো চীৎকার করছি।
(১৯)
যাদের ষড়ৈশ্বর্যশালিত্ব , মহত্ত্ব ও আধ্যাত্মিক বীরত্বের কিছুমাত্র আভাস পেয়ে ইউরােপ ও আমেরিকা স্তম্ভিত ও বিস্ময়ে স্তব্ধ , পশিম জয়কারী যোগীদের দুই চারটি কথার প্রতিধবনি উশবিংশ শতাব্দী হতে পশ্চিমারা উপাসনা করছেন, তাদের আজ এমন দূর্দশা কাম্য নয়।
বর্তমান সময়ে সাধারণ ব্রাহ্মসমাজে এই যোগ সাধন নিয়ে যে আন্দোলন হচ্ছে তা আমি খুব ভাল মনে করি । আমি নিশ্চিত জানি যে এই আন্দোলনের মূলে অতি উচ্চ চিন্তা ভাবনা আছে এবং এর ফলে সমগ্র ব্রক্ষ্ম
সমাজ ও দেশের সাধারণ লােকের মঙ্গলই হবে । মানুষ তথনই স্থিতিশীলতার পক্ষপাতী হয় যখন তার আদর্শ সঙ্কীর্ণ হইয়া পড়ে । আমার আশঙ্কা হয় যে ব্রাহ্মসমাজের হিন্দুদের মধ্যে যারা সংসারের খাতিরে ধর্মকে নির্বাসিত করতে চান তাঁরাই ধর্ম ও সংসার সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র বলে প্রচার করেন এবং সংসারে থেকে ধৰ্ম্ম হয়না বলেন । ব্রাহ্ম সমাজেও আদর্শ যদি সঙ্কীর্ণ হয়ে না পড়ে , তা হলে তাঁরা বলবেন যে ব্রাহ্মধৰ্ম্ম ও যােগ স্বতন্ত্র।
মঙ্গলমারের ইচ্ছা পূর্ণ হোক ।
(২)
ধর্ম , মানব জাতির সাধারণ - সম্পত্তি । এর মধ্যে গোপনীয় কিছু থাকতে পারে আমি মনে করি না । তবে যে স্থানে যে কথা বললে লােকের অপকার হবার সম্ভাবনা সে স্থানে সে কথা বলা উচিত নয়। এই জন্য যােগ চিরকাল গােপন হয়ে আসছে । যোগ সাধন সমস্তই প্রত্যক্ষ বিষয়, এখানে মতামত বা প্রণালী কিছুই নাই । এজন্য এর কিছুই প্রকাশ করে শিক্ষা দেয়া যায় না । কৃপাদৃষ্টি হলে ঈশ্বরের করুণায় যার সঙ্গে এই সাধন রহস্য ধরা দেয় তিনিই বোঝেন যে যোগ কেমন বন্ধু। নিজে নিজে ,
প্রাণায়াম প্রভৃতি বাহিরের প্রক্রিয়া , যারা করবার চেষ্টা করছেন তাদের বিনীতভাবে সাবধান করছি যে, এ কর্মটি অত্যন্ত বিপজ্জনক । শত লোক ঐরূপ , করতে গিয়ে কুষ্ঠ , হার্ণিয়া প্রভৃতি দুরারােগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে ক্লেশ পাচ্ছে।
(৮)
যারা যোগের জন্য ব্যাকুল তারা যেন অতি ব্যস্ত না হন । ঈশ্বরে নির্ভর করে তার কাছে প্রার্থনায় সুপথ অন্বেষণ করুন সময় হলে তিনিই সমস্ত ব্যবস্থা কর দিবেন।
যোগ
যে পদ্ধতিতে ঈশ্বরের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করা হয় তাকে যোগ বলে। যম, নিয়ম, আসন, প্রাণায়াম, প্রত্যাহার, ধারণা, ধ্যান ও সমাধি এই আট প্রকার অঙ্গ বিশিষ্ট যোগই অষ্টাঙ্গ-যোগ। এই অষ্টাঙ্গ-যোগকে রাজযোগও বলে। ঋষি পতঞ্জলি অষ্টাঙ্গ-যোগ বা রাজযোগের প্রবর্তক। ঋষি পতঞ্জলি বিরচিত সূত্রকে পতঞ্জল যোগসূত্র বলে। পতঞ্জল যোগসূত্রে সবিস্তরে অষ্টাঙ্গ-যোগের বর্ণনা আছে। নিচে উক্ত অষ্টাঙ্গ-যোগের আটটি অঙ্গের বর্ণনা দেয়া হল-
যম
অষ্টাঙ্গ-যোগ সাধনার প্রথম অঙ্গ যম। যম বলতে মূলত ইন্দ্রিয়-সংযমকেই বোঝায়। ঋষি পতঞ্জলি প্রবর্তিত যোগসূত্রে আছে- অহিংসা, সত্য, অস্তেয় (অচৌর্য), ব্রহ্মচর্য ও অপরিগ্রহ এ পাঁচটি গুণকে যম বলে। কায়-মন-বাক্যে কোন প্রাণীকে বধ না করা বা ব্যথা না দেওয়াকে অহিংসা বলে। যথাজ্ঞাত বিষয়কে যথাযথ প্রকাশ করার নাম সত্য। অন্যের ধন চুরি না করাকে অস্তেয় বলে। বীর্য-ধারণ করাকে ব্রহ্মচর্য এবং প্রয়োজনের অতিরিক্ত কোন দ্রব্য গ্রহণ না করাকে অপিরগ্রহ বলে। যোগের প্রথমেই যম অভ্যাস করতে হয় কেন? অন্তরে অহিংসা প্রতিষ্ঠিত হলে অন্যের প্রতি শত্রু মনোভাব হ্রাস পায়। হৃদয়ে সত্য প্রকাশিত হলে কোন মিথ্যা ও কুকর্মকে সহজেই দূরিভূত করা যায়। সত্যবাদীর মুখ-নিঃশ্রিত বাণীও সত্য হয়। অর্থাৎ সত্যবাদী ব্যক্তির মধ্যে সততার শক্তি সঞ্চারিত হয়। ফলে তিনি যা বলেন, তাই সত্য হয়। অচৌর্য বা অস্তেয় প্রতিষ্ঠার দ্বারা যোগী সমুদয় ধন-রত্নাদি লাভ করে থাকেন। ব্রহ্মচর্য প্রতিষ্ঠিত হলে বীর্য বা শক্তি লাভ হয়। অপরিগ্রহ দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হলে পূর্বজন্মের স্মৃতিও স্মরণ করা সম্ভব হয়।
নিয়ম
অষ্টাঙ্গ-যোগ সাধনার ক্ষেত্রে শৌচ, সন্তোষ, তপস্যা, স্বাধ্যায় ও ঈশ্বর প্রণিধান এই পাঁচটি গুণকে নিয়ম বলে। শৌচ বলতে বাহ্যিক ও আভ্যন্তরীণ শুদ্ধতা বোঝায়। সণান, আচমন প্রভৃতির দ্বারা বাহ্যশৌচ এবং সৎচিন্তা, দয়া প্রভৃতির দ্বারা অন্তঃশৌচ সম্পন্ন করা হয়। শৌচ হতে সত্ত্বশুদ্ধি, সৌমনস্য (মনের প্রফুল্ল ভাব), একাগ্রতা, ইন্দ্রিয়জয় প্রভৃতি লাভ হয়ে থাকে। সহজ চেষ্টায় যা পাওয়া যায় তাতে তৃপ্ত থাকাকে সন্তোষ বলে। সন্তোষ হতে পরম সুখলাভ হয়। শ্রদ্ধার সাথে শাস্ত্রবিধি অনুসারে ব্রত করাকে তপস্যা বলে। তপস্যা হতে দেহ ও ইন্দ্রিয়ে নানাবিধ শক্তি আসে। বেদ-বেদান্ত প্রভৃতি ধর্মশাস্ত্র নিয়মিত যথাযথভাবে অধ্যয়ন করাই স্বাধ্যায়। স্বাধ্যায়ের মাধ্যমে ইষ্ট দেবতার দর্শন লাভ হয়। ঈশ্বরের নিকট সমুদায় অর্পণ করাকে ঈশ্বর প্রণিধান বলে।
আসন
অষ্টাঙ্গ-যোগ সাধনার তৃতীয় অঙ্গ আসন। যেভাবে অনেকক্ষণ স্থিরভাবে সুখে বসে থাকা যায়, তাকে আসন বলে। বিভিন্ন প্রকার আসন আছে, যথা- পদ্মাসন, সুখাসন, বীরাসন, ভদ্রাসন, ভূজঙ্গাসন প্রভৃতি। প্রাণায়াম যথাযথভাবে সম্পন্ন করার জন্য নিদিষ্ট আসন একান্ত প্রয়োজন। আসন শরীরের অঙ্গ-প্রতঙ্গগুলোকে স্থির ও শিথিল করতে সাহায্যে করে। শাস্ত্রে বলা হয়েছে, এমন স্থানে আসন পাততে হয়ে যেখানে নদীর কুলুকুল তরঙ্গ-ধ্বনি ও পাখির কুজন শোনা যায় এবং যেখানে শোরগোল ও কোলাহল থাকে না। নিয়মিত আসন অভ্যাস করলে নানাবিধ রোগব্যাধি থেকেও মুক্ত হওয়া যায়।
প্রাণায়াম
নিশ্বাস ও প্রশ্বাস উভয়ের গতি সংযত করাকে প্রাণায়াম বলে। অন্য কথায় প্রাণ ও অপান বায়ুর সংযোগকে প্রাণায়াম বলে। পূরক, কুম্ভক ও রেচক এই তিনটি প্রক্রিয়া দ্বারা প্রাণায়াম করা হয়। বহিঃস্থ বায়ুকে আকর্ষণ করে দেহের অভ্যন্তরের নাড়ীগুলো পূরণ করাকে পূরক বলে। সহজ কথায় নির্দিষ্ট নিয়মে মন্ত্র উচ্চারণ করে শ্বাস ভেতরে নেয়ার নাম পূরক। অভ্যন্তরের বায়ু কুম্ভ বা কলসের মত ধারণ করাকে কুম্ভক বলে। ঐ ধারণ করা বায়ুকে বাইরে রেচন বা নিঃসরণ করাকে রেচক বলে। সহজ কথায় নির্দিষ্ট নিয়মে মন্ত্র উচ্চারণের সাথে শ্বাসতাগের নাম রেচক। প্রাণায়ামের সময় বৃদ্ধাঙ্গুলি দ্বারা ডান নাসাছিদ্র বন্ধ করে বাম নাসাছিদ্র থেকে ৪ বার ‘‘ওঁ’’ বা ইষ্ট-মন্ত্র জপ করতে করতে শাস নিতে হয়। এভাবে শ্বাস গ্রহণই পূরক। তারপর বৃদ্ধঙ্গুলি দ্বারা ডান নাসাছিদ্র এবং কনিষ্ঠা ও অনামিকা দ্বারা বাম নাসাছিদ্র বন্ধ করে ঐ শ্বাস ধরে
অষ্টাঙ্গ-যোগ
(৯)
তারপর বৃদ্ধঙ্গুলি দ্বারা ডান নাসাছিদ্র এবং কনিষ্ঠা ও অনামিকা দ্বারা বাম নাসাছিদ্র বন্ধ করে ঐ শ্বাস ধরে
অষ্টাঙ্গ-যোগ
রেখে ১৬ বার ‘‘ওঁ’’ বা ইষ্ট-মন্ত্র জপ করতে হয়। এভাবে শ্বাস ধরে রেখে জপ করা কুম্ভক। কুম্ভকের পর বৃদ্ধাঙ্গুলি ডান নাসাছিদ্র থেকে সরিয়ে নিলে বন্ধ ডান নাসাছিদ্র খুলে যায় এবং ঐ পথে ধরে রাখা শ্বাস ধীরে ধীরে ত্যাগ করার সময় ৮ বার ‘‘ওঁ’’ বা ইষ্ট-মন্ত্র জপ করতে হয়। এরকম শ্বাসত্যাগের এই প্রকৃয়াই রেচক। ইড়া নামক নাড়ীতে পূরক, সুষুম্না নামক নাড়ীতে কুম্ভক এবং পিঙ্গলা নামক নাড়ীতে রেচক সম্পন্ন করা হয়। পূরকের সময় ইড়া নামক নাড়ী পথে বায়ু প্রবেশ করে এবং কুম্ভকের সময় নিমণগামী বায়ুপ্রবাহ ঊর্ধমুখী হয়ে পিঙ্গলা নাড়ী পথে বাইরে গমন করে। উক্ত প্রাণায়ামে পূরক, কুম্ভক ও রেচক ৮। ৩২। ১৬ এবং ১৬। ৬৪। ৩২ অনুপাতেও হতে পারে। তন্ত্রমতে দশটি চক্রের সর্বনিম্ন চক্র মূলাধারে কুলকুণ্ডলিনী শক্তি ঘুমন্ত অবস্থায় থাকে। প্রাণায়ামের ফলে ঐ ঘুমমত্ম কুলকুণ্ডলিনী শক্তিকে জাগ্রত করা যায়। কুলকুণ্ডলিনী শক্তিকে সহস্রার চক্রে অবস্তিত পরমাত্মারূপী শিবের সাথে মিলন ঘটাতে পারলেই সমাধি লাভ সম্ভব।
প্রত্যাহার
প্রত্যাহার বলতে ধেয় বস্তু ব্যতীত অন্যান্য বৈষায়িক চিন্তা প্রত্যাহার বা ত্যাগ বোঝায়। যখন ইন্দ্রিয়গণ তাদের নিজ নিজ বিষয় পরিত্যাগ করে চিত্তের অনুগামী হয়, তখন তাকে প্রত্যাহার বলে। ইন্দ্রিয়গুলো বহির্মুখী এবং এরা বিভিন্ন বাহ্যিক চিন্তা দ্বারা মনকে পরিপূর্ণ করে। ধরা যাক, যোগী চন্দ্র বা সূর্যের জ্যোতির ধ্যান করবে। কিন্তু ধ্যান শুরু করলে যোগীর মনে চন্দ্র বা সূর্য ছাড়াও বিভিন্ন চিন্তা আসতে পারে। চন্দ্র বা সূর্য ব্যতীত অন্যান্য চিন্তা বা কল্পনাকে দূরীভূত করাই প্রত্যাহার।
ধারণা
অষ্টাঙ্গ-যোগ সাধনার ষষ্ঠ অঙ্গ হল ধারনা। চিত্তকে কোন বিশেষ বস্ত্ততে ধরে রাখার নাম ধারণা। চিত্ত স্বভাবতই বিক্ষিপ্ত থাকতে চায়। চিত্তে বিভিন্ন ধরণের চিন্তা, কল্পনা, অতীত-স্মৃতি প্রভৃতি এসে উপস্থিত হয়। প্রত্যাহারের মাধ্যমে ঐ সব বাহ্যিক বিষয় দূর করে কোন একটি নির্দিষ্ট বিষয়ে (যেমন- চন্দ্র, সূর্য, অগ্নিশিখা, কোন দেবতা বা গুরুর মূর্তিতে) মনকে নিবিষ্ট করাই ধারণা। ধারণার মাধ্যম বিক্ষিপ্ত মন একাগ্র হয়। ফলে যোগী অমিত শক্তির অধিকারী হন।
ধ্যান
ধেয় বস্তু বিষয়ক জ্ঞান নিরন্তর একভাবে প্রবাহিত হতে থাকলে তাকে ধ্যান বলে। কোন বস্ত্ত বা বিষয়ে বেশ কিছুক্ষণ যাবৎ ধারণা করতে পারলে, সে ধারণাই ধ্যানে পরিণত হয়। সোজা কথায় অবিচ্ছিন্ন ধারণাকেই ধ্যান বলে। ধারণার সময় মন অন্য দিকে চলে যেতে পারে। কিন্তু পুনরায় মনকে ধেয় বস্তুতে স্থাপন করে কিছুক্ষণ ধরে রাখাতে পারলেই ধ্যান সম্পন্ন করা সম্ভব হবে।
সমাধি
অষ্টাঙ্গ-যোগ সাধনার সর্বশেষ অঙ্গের নাম সমাধী। ধ্যান যখন সমুদয় বাহ্য-উপাধি পরিত্যাগ করে কেবল অর্থমাত্রকে প্রকাশ করে, তখন তাকে সমাধি বলে। ধ্যান গাঢ় হলে ধেয় বস্তু (যে বস্তুর ধ্যান করা হয়) ও আমি এরকম জ্ঞান থাকে না এবং চিত্ত তখন ধ্যেয় বস্তুতেই লীন হয়। সেই লয় অবস্থাকেই সমাধি বলে। কেবল সেই ধেয় বস্তু আছেন, সেরকম আভাস জ্ঞান মাত্র থাকবে আর কিছু থাকবে না, চিত্তের ধেয় বস্তুতে এরকম তন্ময়তাকেই সমাধি বলে। মূলত ধ্যানের পরিণামই সমাধি। ধ্যানের সময় সাধকের এই ভাব থাকে যে, তিনি একটি বিষয়ে চিন্তা করছেন কিন্তু সমাধির ক্ষেত্রে সে ভাবটিও থাকে না। সমাধি দুই প্রকার, যথা- সবিকল্প বা সম্প্রজ্ঞাত এবং নির্বিকল্প বা অসস্প্রজ্ঞাত। জ্ঞাত, জ্ঞান, জ্ঞেয় এই তিনটি পদার্থের ভিন্ন ভিন্ন জ্ঞান সত্ত্বেও অদ্বিতীয় ব্রহ্মবস্তুতে অখণ্ডাকারে চিত্তবৃত্তির অবস্থানকে সবিকল্প সমাধি বলে। সবিকল্প সমাধিতে চিত্ত নিরবিচ্ছিন্নভাবে ব্রহ্মবস্তু বা আত্মাতে স্থির হলেও জ্ঞাত (যোগী নিজে), জ্ঞান (ধেয় বস্ত্ত সম্পর্কিত জ্ঞান) এবং জ্ঞেয় (ধেয় বস্তু দ্বারা যে বিষয়গুলো জানা যায়) এই তিনটি বিষয়ে পৃথক চৈতন্য থাকে। জ্ঞাত, জ্ঞান ও জ্ঞেয় এই তিনটি পদার্থে ভিন্ন ভিন্ন উপলব্ধি না হয়ে অদ্বিতীয় ব্রহ্মবস্তুতে অখণ্ডাকার চিত্তবৃত্তির অবস্থানেকে নির্বিকল্প সমাধি বলে। নির্বিকল্প সমাধিতে জ্ঞাতা, জ্ঞান ও জ্ঞেয় এই তিনটি পদার্থ সম্পর্কেই যোগীর কোন পৃথক চৈতন্য থাকে না। সহজ কথায় যোগী বাহ্য-সংজ্ঞা হারিয়ে এক ধেয় বস্তুতেই নিবিষ্টি থাকেন। নির্বিকল্প সমাধিতে জীবাত্মা ও পরমাত্মার মিলন ঘটে। সমাধি-সত্মরে গিয়ে সাধক এক অনির্বচনীয় আনন্দ ও ব্রহ্মজ্ঞান লাভ করেন। সাধক সমাধি-স্তর থেকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসলে সমাধি-স্তরে কি উপলব্ধি করেছিলেন, তা স্মরণ করতে পারেন না। সুতরাং সমাধিকে ভাষা দ্বারা ব্যক্ত করা সম্ভব নয়। সমাধি স্তরে যে পৌঁছাতে পারে কেবল সেই সমাধি-স্তরকে উপলব্ধি করতে পারে।
(১০)
অষ্টাঙ্গ যোগ বা রাজ যোগ ছাড়াও যোগশাস্ত্রে আরও তিন ধরণের বিশেষ যোগ রয়েছে, যথা- মন্ত্র যোগ, হঠযোগ এবং লয়যোগ। মন্ত্রজপ করতে করতে যে মনোলয় হয় তাকে মন্ত্রযোগ বলে। ‘‘হ’’ শব্দের অর্থ সূর্য এবং ‘‘ঠ’’ শব্দের অর্থ চন্দ্র। তাই ‘‘হঠ’’ দ্বারা চন্দ্র ও সূর্যের সংযোগ বোঝায়। মূলত চন্দ্র দ্বারা অপান বায়ু এবং সূর্য দ্বারা প্রাণ বায়ু বোঝায়। অতএব প্রাণ ও অপান বায়ুর একত্র সংযোগের নাম হঠযোগ। যে যোগের মাধ্যমে চিত্তকে যে কোন পদার্থের উপর স্থির করা যায়, তাকে লয় করাকে লয়যোগ বলে। লয়যোগ চার প্রকার, যথা- শাম্ভরী-মুদ্রা দ্বারা ধ্যান, খেচরী-মুদ্রা দ্বারা রসাস্বাদন, ভ্রামরী-কুম্ভক দ্বারা নাদ শ্রবণ এবং যোনিমুদ্রা দ্বারা আনন্দভোগ। লয়যোগ-সাধনা দ্বারা দর্শন, শ্রবণ ও ঘ্রাণ ইন্দ্রিয়কে অতি শক্তিশালী করা যায়।
ত্রিনয়না
Thursday, June 13, 2019
Continue-44
চিত্তবৃত্তি নিরোধ ও সমাধি
যোগদর্শনে চিত্তের কতগুলি বিকারকে একত্রে চিত্ত বলা হয়। এই বিকারগুলি হলো মন, বুদ্ধি এবং অহঙ্কার। এবং যোগমতে চিত্তবৃত্তির নিরোধকে যোগ বলা হয়েছে। যোগসূত্রকার পতঞ্জলি যোগের লক্ষণ প্রসঙ্গে তাই বলেন-
‘যোগশ্চিত্তবৃত্তি নিরোধঃ’- (যোগসূত্র)
অর্থাৎ : চিত্তের বিভিন্ন প্রকারের বৃত্তির নিরোধই যোগ।
.
এই যোগ বা চিত্তবৃত্তির নিরোধ কিভাবে হবে ? যোগশাস্ত্রকারদের মতে অভ্যাস ও বৈরাগ্যের দ্বারাই চিত্তবৃত্তির নিরোধ হয়। পাতঞ্জলসূত্রে বলা হয়েছে-
‘অভ্যাসবৈরাগ্যাভ্যাং তন্নিরোধঃ।’- (পাতঞ্জলসূত্র-১/১২)
অর্থাৎ : অভ্যাস এবং বৈরাগ্যের সাহায্যে প্রত্যেক মনোবৃত্তিই নিরুদ্ধ হতে পারে (পাতঞ্জল-১/১২)।
এ বক্তব্যের প্রতিফলন শ্রীমদ্ভগবদ্গীতায়ও দেখা যায়-
‘অসংশয়ং মহাবাহো মনো দুর্নিগ্রহং চলম্ ।
অভ্যাসেন তু কৌন্তেয় বৈরাগ্যেন চ গৃহ্যতে।।’- (শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা : ৬/৩৫)
‘অসংযতাত্মনা যোগো দুষ্প্রাপ ইতি মে মতিঃ।
বশ্যাত্মনা তু যততা শক্যোহবাপ্তুমুপায়তঃ।।’- (শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা : ৬/৩৬)
অর্থাৎ : হে মহাবাহো, মন যে দুর্নিরোধ ও চঞ্চল তাতে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু হে কৌন্তেয়, অভ্যাস ও বৈরাগ্য দ্বারা তাকে সংযত করা যায়। (৬/৩৫)
অসংযত ব্যক্তির পক্ষে সমাধি দুষ্প্রাপ্য। কিন্তু পুনঃ পুনঃ যত্নশীল ও জিতেন্দ্রিয় ব্যক্তি ধ্যানাভ্যাস ও বৈরাগ্যসাধন দ্বারা এই সমাধি লাভ করতে পারেন। (৬/৩৬)
.
সাংখ্য-যোগ দার্শনিকগণ অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ- এই ত্রিতাপ ব্যাপী দুঃখের উপস্থিতি উপলব্ধি করে জগতকে দুঃখময় বলে অভিহিত করেন। এই ত্রিতাপ হলো- তাপ-দুঃখ, পরিণাম-দুঃখ এবং সংস্কার-দুঃখ। সংস্কার-দুঃখ অতীত, তাপ-দুঃখ বর্তমান ও পরিণাম-দুঃখ ভবিষ্যৎ সম্পর্কিত।
.
জন্ম মৃত্যু তাপ জরা ইত্যাদিই বর্তমানের তাপ-দুঃখ। জগতে সুখ ও দুঃখ দুটোই আছে বলে সাধারণ ধারণা। কিন্তু যোগশাস্ত্রকারদের মতে চিরায়ত সুখপ্রদ এমন কোন বস্তু জগতে নেই। জগৎ যেমন পরিবর্তনশীল, তেমনি সুখপ্রদ বস্তুও পরিবর্তনশীল। সুখপ্রদ বস্তু আপাতত সুখের কারণ হলেও পরিণামে বিয়োগজনিত দুঃখেরই কারণ। সুখ ভোগের তৃষ্ণা বৃদ্ধির জন্য পরিণামে দুঃখ বাড়ে। এটাই পরিণাম-দুঃখ। সে কারণে পরিণাম-দুঃখ ভবিষ্যৎ সম্পর্কিত।
সুখ ও দুঃখের অনুভূতির ফলে জীবের মনে সংস্কার উৎপন্ন হয়। সুখানুভূতি সুখ সংস্কারের এবং দুঃখানুভূতি দুঃখ সংস্কারের সৃষ্টি করে। যোগশাস্ত্রকারগণ বাসনাকে সংস্কার মনে করেন। তাই সুখ-সংস্কারের ফলে জীব বারবার সুখপ্রদ বস্তুর প্রতি আসক্ত হয় এবং দুঃখ-সংস্কারের ফলে দুঃখপ্রদ বস্তুর প্রতি বিদ্বেষ ভাবাপন্ন হয়। এর ফলে পুনরায় দুঃখ ভোগ করে। সংস্কার হতে এই যে দুঃখের সৃষ্টি তা-ই সংস্কার-দুঃখ। এসব দুঃখের নিবৃত্তিই হলো জীবের পরম পুরুষার্থ। এর উপায়ই হলো চিত্তবৃত্তি নিরোধ বা যোগ। ধ্যানাভ্যাস ও বৈরাগ্য সাধনের মাধ্যমে তার নিরোধ করা সম্ভব বলে যোগশাস্ত্রে স্বীকৃত।
অভ্যাস প্রসঙ্গে পাতঞ্জলসূত্রে বলা হয়েছে-
‘তত্র স্থিতৌ যত্নোহভ্যাসঃ।’- (পাতঞ্জলসূত্র-১/১৩)
‘স তু দীর্ঘকালনৈরন্তর্ষ্যসৎকারা সেবিতো দৃঢ়ভূমিঃ।’- (পাতঞ্জলসূত্র-১/১৪)
অর্থাৎ :
চিত্ত স্থিার করবার জন্য রজস্তমোবৃত্তিশূন্য যে যত্ন, তাকেই অভ্যাস বলা হয় (পাতঞ্জল-১/১৩)। প্রযত্নসহকারে মনোনিবেশপূর্বক দীর্ঘকাল ঐ প্রকার অভ্যাস করতে করতে তবে তা সুদৃঢ় ও নিশ্চল হয় (পাতঞ্জল-১/১৪)।
.
এবং বৈরাগ্য প্রসঙ্গে পাতঞ্জলসূত্রে বলা হয়েছে-
‘দৃষ্টানুশ্রবিক বিষয়বিতৃষ্ণস্য বশীকারসংজ্ঞা বৈরাগ্যম্’।- (পাতঞ্জলসূত্র-১/১৫)
‘তৎপরং পুরুষখ্যাতের্গুণবৈতৃষ্ণ্যম্’।- (পাতঞ্জলসূত্র-১/১৬)
অর্থাৎ :
যাঁর সমস্ত শাস্ত্রীয় অশাস্ত্রীয় বিষয়ে বিতৃষ্ণা জন্মেছে, যিনি সমস্ত দৃষ্টবিষয়ে বীতস্পৃহ হয়েছেন, তাঁরই বশীকার সংজ্ঞক বৈরাগ্য জন্মেছে (পাতঞ্জল-১/১৫)।
(১১)
পরমবৈরাগ্য স্ফূরিত হলে, প্রকৃতি পুরুষ যে পরস্পর অভেদ নয়, সে সম্বন্ধে বিশেষ জ্ঞান জন্মে। সেই জ্ঞানপ্রভাবে প্রাকৃতিক গুণনিচয়ের প্রতিও বীতস্পৃহ হতে হয় (পাতঞ্জল-১/১৬)।
.
যোগমতে, বৈরাগ্য দু’প্রকার- বশীকার বা অপর এবং পর বা ধর্মমেষ। ভোগের বিষয়গুলিকে দুভাগে ভাগ করা যায়। যথা- দৃষ্ট অর্থাৎ যা সাধারণ লৌকিক অভিজ্ঞতায় গম্য এবং আনুশ্রবিক অর্থাৎ শ্রুতির উপর আস্থার ফলে যে বিষয়গুলি সম্বন্ধে আমাদের জ্ঞান ও আকর্ষণ হয়। দৃষ্ট বিষয়গুলি হলো খাদ্য, পানীয়, কাপড়, শয্যা, বাড়ি, রথ বা গাড়ি ইত্যাদি। আনুশ্রবিক বিষয় হলো যথাক্রমে স্বর্গ, প্রকৃতিলয়, বিদেহলয় ইত্যাদি। এই বিষয়গুলি আপাতমনোরম হলেও এরা ত্রিতাপের আকার।
.
এই বিষয়গুলি যখন আমাদের আয়ত্তে আসে তখন যদি তত্ত্বজ্ঞানের ফলে আমরা তাদের দোষ দেখে তাদের প্রতি বিরক্ত বা নিরাসক্ত হয়ে থাকতে পারি, তাহলে আমাদের চিত্তে বশীকার বৈরাগ্য হয়েছে বলে বোঝা যাবে। পরবৈরাগ্য হলো আরও উচ্চস্তরের অবস্থা। যে জ্ঞান বা বুদ্ধির দ্বারা পুরুষতত্ত্বের সাক্ষাৎকার হয়, তাকে অগ্র্যাবুদ্ধি বা চরমজ্ঞান বলে। পুরুষ-সাক্ষাৎকার হলে ত্রিগুণাপ্রকৃতি থেকে আত্মা বা পুরুষের ভেদজ্ঞান বা বিবেকখ্যাতি হয় এবং তার ফলে দুঃখের আত্যন্তিক নিবৃত্তি ঘটে। পরবৈরাগ্যের ফলও দুঃখের আত্যন্তিক নিবৃত্তি। পরবৈরাগ্যে প্রবৃত্তির আত্যন্তিক নাশ হয় এবং খ্যাতি বা জ্ঞানবিষয়েও বৈরাগ্য দেখা যায়।
.
চিত্তের বৃত্তিগুলির পরিপূর্ণ লয় বা নিরোধই মূলত সমাধি অবস্থা। যোগদর্শন মতে, সহজ বা স্বাভাবিক অবস্থা থেকেই চিত্ত সমাধি স্তরে উন্নীত হয়। চিত্তের সহজ বা স্বাভাবিক অবস্থাকে বলা হয় চিত্তভূমি। চিত্তভূমি পাঁচ প্রকার। যথা- ক্ষিপ্ত, মূঢ়, বিক্ষিপ্ত, একাগ্র এবং নিরুদ্ধ। সকল জীবের চিত্তই স্থূলত এই পাঁচ অবস্থায় থাকে। যোগমতে এই পঞ্চবিধ চিত্তভূমির শেষোক্ত দুটি ভূমি অর্থাৎ একাগ্র ও নিরুদ্ধ অবস্থাই যোগ সাধনার অনুকূল। তবে এই দুই ভূমি যোগানুকূল হলেও যোগপ্রক্রিয়া অতি জটিল। একাগ্র অবস্থায় বিষয়মাত্র অবশিষ্ট থাকায় চিত্তের পরিপূর্ণ লয় সম্ভব হয় না। নিরুদ্ধ অবস্থায় চিত্তের পরিপূর্ণ লয় হয় এবং পুরুষ স্বস্বরূপে অবস্থান করে। একাগ্র অবস্থা থেকে চিত্তের পূর্ণ লয়ের অবস্থা পর্যন্ত যোগের অনেকগুলি পর্যায় বর্তমান। যোগের বিভিন্ন পর্যায় অনুযায়ী যোগের নানা প্রকারভেদ যোগদর্শনে স্বীকৃত হয়েছে।
.
অভ্যাস ও বৈরাগ্যের দ্বারা চিত্তবৃত্তি নিরোধের পর্যায় অনুযায়ী যোগ বা সমাধিকে প্রধাণত দু’ভাগে ভাগ করা হয়েছে- (১) সম্প্রজ্ঞাত সমাধি ও (২) অসম্প্রজ্ঞাত সমাধি।
.
(১) সম্প্রজ্ঞাত সমাধি
যোগশাস্ত্রমতে অভ্যাস ও বৈরাগ্যের দ্বারা চিত্তবৃত্তিগুলি নিরুদ্ধ হলে প্রথমে সম্প্রজ্ঞাত সমাধি হয়। বৈরাগ্যের দ্বারা বিষয়স্রোত মন্দীভূত হয় এবং অভ্যাসের দ্বারা বিবেকস্রোত উদ্ঘাটিত হয়। এই উপায়দ্বয়ের দ্বারা প্রথম যে যোগ বা সমাধিপ্রাপ্তি ঘটে তাকেই সম্প্রজ্ঞাত সমাধি বলা হয়। এই অবস্থায় একই বিষয়াকারে বৃত্তি দীর্ঘকাল ধরে একাগ্র চিত্তভূমিতে অবস্থান করে। ‘সম্প্রজ্ঞাত’ শব্দের ব্যুৎপত্তিগত অর্থ হলো সম্যক্ বা প্রকৃষ্টরূপে জ্ঞাত। এ অবস্থায় ধ্যেয় বস্তুকে সম্যক্ ভাবে জানা যায় বলে এই সমাধিকে সম্প্রজ্ঞাত বলে। এ বিষয়ে যোগসূত্রের সমাধিপাদে বলা হয়েছে-
‘বিতর্কবিচারানন্দাস্মিতারূপানুগমাৎ সম্প্রজ্ঞাতঃ’- (যোগসূত্র : ১/১৭)
অর্থাৎ : বিতর্ক, বিচার, আনন্দ ও অস্মিতা এই ভাবচতুষ্টয়ানুগত সমাধি হলো সম্প্রজ্ঞাত সমাধি।
.
যোগাভ্যাসের প্রাথমিক স্তরে কোন স্থূল দেবমূর্তি বা ভৌতিক পদার্থকে অবলম্বন করে অগ্রসর হতে হয়। স্থূলবস্তু থেকেই ক্রমশ সূক্ষ্ম বস্তুর দিকে চিত্ত প্রবাহিত হয়। তাই যোগমতে ধ্যেয় বা ভাব্য বস্তু দ্বিবিধ- স্থূল ও সূক্ষ্ম। এই দ্বিবিধ বস্তুই আবার বাহ্য ও আন্তর ভেদে দ্বিবিধ। সুতরাং মোট চারপ্রকার ধ্যেয় বস্তু বর্তমান। এগুলি হলো- (১) স্থূল বাহ্যবস্তু, যেমন- ক্ষিতি, অপ্, তেজ, মরুৎ ও ব্যোম এই পঞ্চভূত, (২) স্থূল আন্তরবস্তু, যেমন- একাদশ ইন্দ্রিয়সমূহ, চক্ষু-কর্ণ-নাসিকা-জিহ্বা-ত্বক এই পঞ্চজ্ঞানেন্দ্রিয়, বাক্-পানি-পাদ-পায়ু-উপস্থ এই পঞ্চকর্মেন্দ্রিয় ও উভয়-ইন্দ্রিয় মন, (৩) সূক্ষ্ম বাহ্যবস্তু, যেমন- শব্দ, স্পর্শ, রূপ, রস, গন্ধ এই পঞ্চতন্মাত্রসমূহ ও (৪) সূক্ষ্ম আন্তরবস্তু, যেমন- অহং ও বুদ্ধি।
(১২)
এই চারপ্রকার ধ্যেয় বস্তুকে বিষয় হিসেবে বলা হয় যথাক্রমে- বিতর্ক, বিচার, আনন্দ ও অস্মিতা। এই চারপ্রকার বিষয় তথা অবলম্বন ভেদে যোগ বা সমাধিও চারপ্রকার- (১) সবিতর্ক, (২) সবিচার, (৩) সানন্দ ও (৪) সাস্মিত।
.
সাধারণত ইন্দ্রিয়ের দ্বারা যে সকল বিষয় গৃহীত হয় তারা স্থূল বিষয়। যেমন গরু, ঘোড়া, ঘট ইত্যাদি। এইসব স্থূল বিষয় যখন শব্দের বাচ্যরূপে অর্থাৎ নামজ্ঞান ও সংকেতজ্ঞান হিসেবে সমাধিপ্রজ্ঞার বিষয় হয় তখন সেই সমাধিকে বলা হয় সবিতর্ক সমাধি। অর্থাৎ, এই অবস্থায় যোগীর কোন একটি শব্দের বাচ্য স্থূল বিষয়ের পুঙ্খানুপুঙ্খ ও সম্যক্ জ্ঞান হয়।
.
এরপর, অর্থাৎ স্থূলবিষয়ক সমাধি আয়ত্ত হলে যোগীর বিচারবিশেষের দ্বারা তন্মাত্র প্রভৃতির সূক্ষ্ম বিষয়ের জ্ঞান হয়। একেই বলে সবিচার সম্প্রজ্ঞাত সমাধি। যেহেতু শব্দ ব্যতীত বিচার হয় না, তাই সবিচার সমাধিতেও বাচকশব্দের অপেক্ষা থাকে।
.
সানন্দ অবস্থা হলো অপেক্ষাকৃত উচ্চস্তরের অবস্থা। এই অবস্থায় বাচক শব্দের ততো অপেক্ষা নেই। আমাদের শরীর হলো জ্ঞানেন্দ্রিয়, কর্মেন্দ্রিয়, চিত্ত ও প্রাণের অধিষ্ঠাতা। অভ্যাসের ফলে ইন্দ্রিয় প্রভৃতি করণাদির সঙ্গে অধিষ্ঠাতা শরীরের যখন বিশেষ একপ্রকার স্থৈর্য সিদ্ধ হয় তখন এক সর্বব্যাপী সাত্ত্বিক সুখ অনুভূত হয়। সর্বশরীরে ঐ আনন্দময় সাত্ত্বিক ভাবের সহজ বোধই সানন্দ সমাধির বিষয়।
.
সাস্মিত সমাধির বিষয় হলো মহান আত্মা বা ব্যবহারিক গ্রহীতা। এই ব্যবহারিক গ্রহীতা কিন্তু স্বরূপত পুরুষ নন। সাংখ্যদর্শনে এঁকে মহৎ-তত্ত্ব বলা হয়েছে। ‘আমি’ এই বোধমাত্রই সাস্মিত সমাধির বিষয়। এইটি হলো বুদ্ধি বা মহৎ-এর অভিমান। সত্ত্বগুণের আধিক্য থাকায় একে পুরুষ বলে ভ্রম হয়। এই সাস্মিত অবস্থাই সম্প্রজ্ঞাত সমাধির সর্বোচ্চ অবস্থা।
.
কিন্তু সম্প্রজ্ঞাত সমাধি অবস্থায় চিত্তবৃত্তি কখনই সম্পূর্ণ নিরুদ্ধ হতে পারে না। কারণ অত্যন্ত সূক্ষ্ম আকারে হলেও বিষয়াকার আলম্বন থেকেই যায়। এই সমাধিতে সংসার বীজ সম্পূর্ণ বিনষ্ট হয় না, সুপ্ত অবস্থাপ্রাপ্ত হয় বলে এই সমাধিকে সবীজ সমাধিও বলা হয়।
.
(২) অসম্প্রজ্ঞাত সমাধি
সম্প্রজ্ঞাত সমাধির দ্বারা চিত্ত যখন বিষয় চিন্তা থেকে মুক্ত হয় তখন অসম্প্রজ্ঞাত সমাধির উদ্ভব হয়। অসম্প্রজ্ঞাত সমাধি সম্পূর্ণ আলম্বন বা বিষয়হীন। এটি পরবৈরাগ্যের অভ্যাসসাধ্য সংস্কার। অসম্প্রজ্ঞাত সমাধির বর্ণনায় যোগসূত্রের সমাধিপাদে বলা হয়েছে-
‘বিরামপ্রত্যয়াভ্যাসপূর্ব্বঃ সংস্কারশেষোহন্যাঃ’- (যোগসূত্র : ১/১৮)
অর্থাৎ : অসম্প্রজ্ঞাত সমাধি হলো পরবৈরাগ্যের অভ্যাসের দ্বারা সংস্কার শেষ স্বরূপ সমাধি। প্রবল বৈরাগ্যবশত যখন সমস্ত চিত্তবৃত্তির নিবৃত্তি হয়, তখন চিত্ত প্রত্যেক সংস্কার পরিশূন্য, সেই অবলম্বনরহিত অপূর্ব অবস্থাকেই অসম্প্রজ্ঞাত সমাধি বলা হয়।
.
সকলপ্রকার চিত্তবৃত্তির নিরোধকে বলা হয় বিরাম। এই বিরাম লাভের উপায় হলো বৈরাগ্য। বৈরাগ্যের দ্বারা চিত্তবৃত্তিসমূহ নিরুদ্ধ হয়। অভ্যাসের দ্বারা এই বৈরাগ্য দৃঢ় হয়। বৈরাগ্য দৃঢ় হলে চিত্তবৃত্তির পুনরুৎপত্তির সম্ভাবনা থাকে না। চিত্ত তখন দগ্ধবীজের ন্যায় শক্তিশূন্য হয়ে পড়ে।
শাস্ত্রবাক্যে ‘অসম্প্রজ্ঞাত’ শব্দের অর্থ হলো-
‘ন কিঞ্চিৎ প্রজ্ঞায়তে ইতি অসম্প্রজ্ঞাতঃ’।
অর্থাৎ : যে অবস্থায় বিষয়ের কোন অস্তিত্ব থাকে না।
.
এইরূপ নিরালম্ব ও নির্বীজ সমাধিকে বলা হয় অসম্প্রজ্ঞাত সমাধি। সম্প্রজ্ঞাত সমাধিতে স্থূলতত্ত্ব থেকে ক্রমান্বয়ে অস্মিভাবে চিত্ত সমাহিত হয়। অস্মিভাবে কোন স্থূল ইন্দ্রিয়জাত জ্ঞান থাকে না। কিন্তু ঐ অবস্থায়ও অত্যন্ত সূক্ষ্ম বিজ্ঞানের জ্ঞান বা সংস্কার থাকে। যখন ঐ অস্মিভাবও চাই না মনে করে যোগী নিরোধ আনতে পারেন, তখন তাঁর চিত্তবৃত্তি রুদ্ধ হয়ে যায়। এ অবস্থাই অসম্প্রজ্ঞাত সমাধি। যোগমতে, এই অবস্থায় মনের সঙ্গে শরীরযন্ত্রের ক্রিয়াও রুদ্ধ হয়ে যায় এবং স্থম্ভিতপ্রাণ অবস্থায় থাকে। নিরোধ ভঙ্গ হলে আবার শরীরের যান্ত্রিক ক্রিয়া ফিরে এসে আগের অবস্থা হয়। অসম্প্রজ্ঞাত সমাধিতে পুরুষ প্রকৃতির সকল প্রকার সংযোগ ছিন্ন করে স্ব স্ব রূপে অবস্থান করে। প্রকৃতির বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে পুরুষ জন্ম-মৃত্যু ও সুখ-দুঃখকে অতিক্রম করে কৈবল্যপ্রাপ্ত হয়। এইরূপ কৈবল্য-প্রাপ্তিকে যোগদর্শনে মোক্ষ বলা হয়।
(১৩)
যোগশাস্ত্রে অসম্প্রজ্ঞাত সমাধিকে দু’ভাগে ভাগ করা হয়। যথা- ভবপ্রত্যয় এবং উপায়প্রত্যয়। ভব অর্থ জন্ম এবং প্রত্যয় অর্থ কারণ। বিদেহলীন ও প্রকৃতিলীন যোগীদের এজাতীয় ভবপ্রত্যয় হয়। পাতঞ্জলসূত্রের সমাধিপাদে বলা হয়েছে-
‘ভব প্রত্যয়োবিদেহপ্রকৃতিলয়ানাম্’।- (পাতঞ্জলসূত্র-১/১৯)
অর্থাৎ : সম্প্রজ্ঞাত সমাধিমূলক বিদেহলয়, কিংবা প্রকৃতিলয় উভয়ই মুক্তির কারণ হয় না। যেহেতু উভয়ই অবিদ্যা পরিশূন্য নয়। নিদ্রার পর জাগরণ হলে যেমন নানা কার্যে ব্যাপৃত থাকতে হয়, তেমনি ঐ উভয়বিধ অনাত্মলয়ের পরেও চিত্ত বারবার সাংসারিক ব্যাপারে আসক্ত হয় (পাতঞ্জল-১/১৯)।
যে যোগী সব বিষয়ের ত্যাগকে চূড়ান্ত মনে করে তাতেই আনন্দ লাভ করেন, তাঁদের ক্ষেত্রে বিষয়ের অস্তিত্ব না থাকায় ইন্দ্রিয় প্রভৃতি করণগুলি লয়প্রাপ্ত হয়ে যায়। তাদের দেহের নাশ হলে তারা অসম্প্রজ্ঞাত সমাধি লাভ করেন। এঁরাই বিদেহলীন নামে পরিচিত। কিন্তু পরমপুরুষতত্ত্ব-সাক্ষাৎকার না হওয়াতে এরা কৈবল্য লাভ করতে পারেন না। আবার যে সব যোগী পরমপুরুষতত্ত্ব-সাক্ষাৎ করেননি কিন্তু বিষয়ের ত্যাগ জন্য তাঁদের অন্তঃকরণ মূলা প্রকৃতিতে লয়প্রাপ্ত হয়েছে, তাঁরা প্রকৃতিলীন নামে পরিচিত। এঁদেরও মুক্তিলাভ সম্ভব নয়।
.
অপরপক্ষে উপায়প্রত্যয় হলো প্রকৃত অসম্প্রজ্ঞাত সমাধি। উপায় অর্থ যথাবিহিত উপায় এবং প্রত্যয় অর্থ কারণ। উপায়প্রত্যয় প্রকৃত যোগীর হয়ে থাকে। এর উপায়গুলি হলো শ্রদ্ধা, বীর্য, স্মৃতি, সমাধি, প্রজ্ঞা ইত্যাদি। শ্রদ্ধা অর্থ হলো প্রসন্নচিত্তে ও আসক্তিসহ বিষয়ের গুণ আবিষ্কার করে জানার ইচ্ছা। বীর্য হলো অন্য বিষয়ের থেকে সরিয়ে নিয়ে চিত্তকে সাধনে নিযুক্ত করা। স্মৃতি হলো ধ্যেয় বিষয়কে বারবার অনুভব করা। বীর্য হলো শ্রদ্ধার ফল এবং স্মৃতি হলো বীর্যের ফল। যখন স্মৃতি স্থির এবং ধ্রুব হয়, তখন সমাধি হয়। সমাধি অবস্থাতেই প্রজ্ঞা বা সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্মের প্রকাশ হয়। পাতঞ্জলসূত্রের সমাধিপাদে বলা হয়েছে-
‘শ্রদ্ধাবীর্য্যস্মৃতিসমাধিপ্রজ্ঞাপূর্ব্বক ইতরেষাম্’।- (পাতঞ্জলসূত্র-১/২০)
অর্থাৎ : যিনি যোগ সম্বন্ধীয় শ্রদ্ধা, বীর্য, স্মৃতি, সমাধিবলে অতুল প্রজ্ঞা লাভ করেছেন, তিনিই মুক্ত হয়েছেন। কোন প্রাকৃতিক প্রলোভন আর তাঁকে প্রলোভিত করতে পারে না। তিনিই বিদেহলয় এবং প্রকৃতিলয় বিহীন উপায় প্রত্যয়শীল নিত্যমুক্ত যোগী হয়েছেন। তিনিই চিরকালের জন্য স্ব-স্বরূপে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন (পাতঞ্জল-১/২০)।
.
এই সমাধিপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে যোগশাস্ত্রে বলা হয়, তীব্র সম্বেগসম্পন্ন যোগীরই শীঘ্র সমাধিলাভ ঘটে। সম্বেগ হলো তীব্র কার্যশক্তিসম্পন্ন সংস্কারের নাম। পাতঞ্জলসূত্রের সমাধিপাদে তাই বলা হয়েছে-
‘তীব্রসম্বেগানামাসন্নঃ।’- (পাতঞ্জলসূত্র-১/২১)
‘মৃদুমধ্যাধিমাত্রত্বাত্ততোহপি বিশেষঃ।’- (পাতঞ্জলসূত্র-১/২২)
অর্থাৎ :
তীব্র সম্বেগশালী যোগীরই শীঘ্র সমাধি হয় (পাতঞ্জল-১/২১)। মৃদু, মধ্য ও অধিমাত্র ভেদে তিন প্রকার সম্বেগ আছে। মৃদু সম্বেগশীল যোগীর সমাধি বিলম্বে হয়। মধ্য সম্বেগবিশিষ্ট হলে তারচেয়ে শীঘ্র হয়। যাঁর অধিমাত্র সম্বেগ হয়েছে, অতি শীঘ্রই তিনি সমাধিমগ্ন হন (পাতঞ্জল-১/২২)।
..
অভ্যাস, বৈরাগ্য, শ্রদ্ধা, বীর্য, স্মৃতি ইত্যাদি ছাড়াও ঈশ্বরপ্রণিধানকে সমাধির অন্যতম সাধন বলেছেন যোগসূত্রকার পতঞ্জলি।
‘ঈশ্বর প্রণিধানাৎ বা।’- (পাতঞ্জলসূত্র-১/২৩)
‘তস্য বাচকঃ প্রণবঃ।’- (পাতঞ্জলসূত্র-১/২৭)
‘তজ্জপস্তদর্থ ভাবনম্’।- (পাতঞ্জলসূত্র-১/২৮)
অর্থাৎ : শুদ্ধভক্তি সহকারে ঈশ্বরের অর্চনা করলেও সম্প্রজ্ঞাত সমাধির অধিকারী হওয়া যায় (পাতঞ্জল-১/২৩)। তিনি ওঙ্কারের বাচ্য। তাঁর নাম ওঁ (পাতঞ্জল-১/২৭)। ঈশ্বরবাচক প্রণব জপ করতে করতে, সেই ঈশ্বরবাচক প্রণবের অর্থ ভাবতে ভাবতে একাত্ম হওয়া যায়। সম্যক্ একাগ্রতার উদয়ে সমাধি হয় (পাতঞ্জল-১/২৮)।
এজন্যেই এ প্রসঙ্গে যোগদর্শনে ঈশ্বরতত্ত্বের আলোচনা স্থান পেয়েছে। সুতরাং, বিবেকখ্যাতি বা সম্পূর্ণ ভেদজ্ঞানলব্ধ হয়ে পুরুষ সাক্ষাৎকার হলে তবেই সম্পূর্ণ সমাধিলাভ হয়। এই অসম্প্রজ্ঞাত সমাধির ফলে দ্রুত প্রারব্ধ কর্মের ক্ষয় হওয়ার ফলে কৈবল্যলাভের পথ প্রশস্ত হয়।
(১৪)
যোগদর্শনে ঈশ্বরতত্ত্ব
ভারতীয় জনশ্রুতি অনুসারে সাংখ্যদর্শন নিরীশ্বর সাংখ্য এবং যোগদর্শন সেশ্বর সাংখ্যরূপে গণ্য হয়। অর্থাৎ, সাংখ্যদর্শনে ঈশ্বরের অস্তিত্ব অস্বীকৃত হয়েছে, কিন্তু সাংখ্যকথিত পঞ্চবিংশতি তত্ত্ব ছাড়াও যোগ দর্শনে ঈশ্বরতত্ত্ব স্বীকৃত হয়েছে। তবে অন্যান্য ঈশ্বরবাদী দর্শনের মতো যোগদর্শনে জগতের সৃষ্টিকর্তারূপে ঈশ্বরকে স্বীকার করা হয়নি। এখানে ঈশ্বর প্রধান নয়, আবার পুরুষমাত্র নন। তিনি ঐশ্বর্যযুক্ত, চিত্তবান, সদামুক্ত, পুরুষবিশেষ।
যোগসূত্রকার মহর্ষি পতঞ্জলি ঈশ্বরপ্রণিধানকে সমাধি লাভের অন্যতম উপায় বলে মনে করেন। যোগসূত্রের সমাধিপাদে ঈশ্বরের উল্লেখ ও নিরূপণ করে বলা হয়েছে-
‘ঈশ্বরপ্রণিধানাৎ বা’- (যোগসূত্র : ১/২৩)
অর্থাৎ : সমাধি ও তার ফললাভের জন্য ঈশ্বর-উপাসনা ও ঈশ্বরে সর্বসমর্পণ করা।
পতঞ্জলি বর্ণিত সম্প্রজ্ঞাত সমাধি লাভের উপায় অষ্টাঙ্গিক যোগের একটি তথা দ্বিতীয় যোগাঙ্গ হলো নিয়ম। ঈশ্বরপ্রণিধান নিয়মেরই অন্তর্ভুক্ত। ঈশ্বরচিন্তা সমাধিলাভে সহায়ক হয়। তাছাড়া ঈশ্বর ধারণারও বিষয় হতে পারেন এবং তার ফলে সমাধিপ্রাপ্তি ত্বরান্বিত হতে পারে। পতঞ্জলি ঈশ্বরের এই ব্যবহারিক প্রয়োজন ছাড়া কোন তাত্ত্বিক প্রয়োজনের কথা বলেন নি। সমাধি লাভের বিকল্প উপায়রূপেই তিনি ঈশ্বরপ্রণিধানের কথা বলেছেন। ঈশ্বরপ্রণিধান হলো ঈশ্বরে সর্বকর্ম অর্পণপূর্বক তাঁর নিরন্তর ভাবনা, শুধু কর্ম অর্পণমাত্র নয়। তাই ঈশ্বরপ্রণিধান হলো একপ্রকার ভক্তি। ঈশ্বরে আত্মসমর্পণ বা আমিত্বকে সম্পূর্ণভাবে নিবেদনের ফলে ঈশ্বর সাধককে ইচ্ছার দ্বারা অনুগৃহীত করেন এবং সাধকের সমাধিলাভ সমাসন্ন হয়। পতঞ্জলির পরবর্তীকালের যোগ দার্শনিকরা যোগদর্শনে উক্ত ব্যবহারিক প্রয়োজন ছাড়াও ঈশ্বরের তাত্ত্বিক প্রয়োজন স্বীকার করেছেন এবং ঈশ্বরের অস্তিত্বের পক্ষে নানা প্রমাণও উপস্থাপন করা হয়েছে।
ঈশ্বরের লক্ষণ প্রসঙ্গে পতঞ্জলির যোগসূত্রের সমাধিপাদে বলা হয়েছে-
‘ক্লেশ-কর্ম-বিপাকাশয়ৈঃ অপরামৃষ্টঃ পুরুষবিশেষ ঈশ্বরঃ’- (যোগসূত্র : ১/২৪)
অর্থাৎ : ঈশ্বর হলেন ক্লেশ, কর্ম, বিপাক এবং আশয় দ্বারা অপরামৃষ্ট পুরুষ বিশেষ।
.
অপরামৃষ্ট অর্থ প্রভাবিত না হওয়া। যোগশাস্ত্রে ঈশ্বর কখনোই পুরুষ বা প্রকৃতির স্রষ্টা নয়। তবে তিনি পুরুষবিশেষ। ক্লেশ, কর্ম, বিপাক ও আশয়ের দ্বারা বদ্ধ না হওয়াই তার বৈশিষ্ট্য।
যোগশাস্ত্রে পঞ্চবিধ ক্লেশের কথা বলা হয়। এই পঞ্চক্লেশ হলো- অবিদ্যা, অস্মিতা, রাগ, দ্বেষ ও অভিনিবেশ বা মৃত্যুভয়। এই পঞ্চক্লেশ ঈশ্বরকে কখনোই স্পর্শ করে না, যেহেতু ঈশ্বর ঐ সকল ক্লেশের মূল অবিদ্যারহিত।
কর্ম হলো পাপ ও পূণ্য। যোগদর্শনে কর্মকে দুভাগে ভাগ করা হয়েছে, যথা- ধর্ম এবং অধর্ম। ধর্ম হলো বেদবিহিত কর্ম এবং অধর্ম হলো বেদনিষিদ্ধ কর্ম। ঈশ্বরের ক্ষেত্রে বিধি অথবা নিষেধ সম্পূর্ণ অর্থহীন। কারণ ঈশ্বর যেহেতু আপ্তকাম, সেহেতু তার কর্মে প্রবৃত্তি অসম্ভব। ফলে ঈশ্বর পাপ-পূণ্যরহিত।
বিপাক অর্থ কর্মফল। কর্মফল তিনটি, যথা- জাতি, আয়ু এবং ভোগ। জাতি বলতে বোঝায় আমরা কোন্ পরিবেশে জন্মাবো। যেমন, আমি সৎ ও শুচি পিতামাতার সংসারে জন্মাবো না-কি কৃমিকীটের সন্তান হয়ে জন্মাবো তা নির্ভর করে আমারই কর্মের উপর। সৎ কর্মের ফল হলো পূণ্য এবং অসৎ কর্মের ফল হলো পাপ। এই পূণ্য এবং পাপ সঞ্চিত থাকার ফলে আমাদের সুখ এবং দুঃখভোগ হয়। সুখভোগ এবং দুঃখভোগের দ্বারাই সঞ্চিত কর্মফলের ক্ষয় হয়। নির্দিষ্ট পরিমাণ ভোগের জন্য প্রয়োজন হলো নির্দিষ্ট আয়ুষ্কাল। এইজন্য দ্বিতীয় বিপাক হিসেবে আয়ুর কথা বলা হয়েছে। সুতরাং, কর্মের ফলের জন্য ব্যক্তির আয়ু নির্দিষ্ট হয় এবং সুখ-দুঃখের ভোগের ব্যবস্থা হয়। যেহেতু ঈশ্বরের কর্ম নেই, সেহেতু তার জাতি, আয়ু ও ভোগরূপ বিপাক থাকতে পারে না।
আশয় হলো সংস্কার বা কর্মফল জন্য বাসনা। সংস্কার অর্থ এক্ষেত্রে পূণ্য কর্মজন্য অথবা পাপ কর্মজন্য সংস্কার। কিন্তু যেহেতু ঈশ্বরের কর্ম নেই, সেহেতু আশয়ও নেই।
ঈশ্বরকে পুরুষবিশেষ বলার হেতু হলো, ঈশ্বর অন্যান্য পুরুষ বা আত্মা থেকে ভিন্ন। ঈশ্বরভিন্ন অন্যান্য পুরুষ কৈবল্যপ্রাপ্ত হন এবং যখন কৈবল্যপ্রাপ্ত হন তখন তিনিও ক্লেশাদিঅপরামৃষ্ট থাকেন। মুক্ত পুরুষের ক্লেশ প্রভৃতি মুক্তি বা কৈবল্যপ্রাপ্তির পূর্বে ছিলো, বর্তমানে নেই। কিন্তু ঈশ্বরের ক্ষেত্রে ক্লেশ প্রভৃতি কোনকালেই ছিলো না। ঈশ্বর কৈবল্যপ্রাপ্ত হন না। ঈশ্বরের সঙ্গে কৈবল্যের বর্তমান, ভূত বা ভাবী কোন সম্বন্ধই নেই। এজন্য ঈশ্বর মুক্ত পুরুষ থেকে স্বতন্ত্র। তিনি সদামুক্ত। তিনি বর্তমানে, অতীতে বা ভবিষ্যতে কৈবল্যপ্রাপ্ত হবেন এমন নন। বাচস্পতি মিশ্রের মতে জ্ঞান, ক্রিয়া, শক্তি প্রভৃতি সম্পদই ঈশ্বরের স্বরূপ বা ঐশ্বর্য। ঈশ্বরের ঐশ্বর্য সর্বাপেক্ষা মহৎ। এই ঐশ্বর্য অসাম্য ও নিরতিশয়। এই ঐশ্বর্যের তুল্য অথবা তা অপেক্ষা উৎকৃষ্ট ঐশ্বর্য আর কারোর থাকতে পারে না। তাই বলা যায়, কাষ্ঠাপ্রাপ্ত ঐশ্বর্যযুক্ত বিলক্ষণ পুরুষই ঈশ্বর। সুতরাং, ঈশ্বর নামক পুরুষ নিত্য, শুদ্ধ, বুদ্ধ এবং মুক্তস্বভাব।
(১৫)
যোগদর্শনে ত্রিবিধ বন্ধনের কথা বলা হয়েছে। এই তিনপ্রকার বন্ধন হলো- প্রাকৃতিক, বৈকৃতিক ও দাক্ষিণ।
প্রকৃতিলীনদের প্রাকৃতিক বন্ধন, বিদেহলীনদের বৈকৃতিক বন্ধন এবং দক্ষিণা-নিষ্পাদ্য যাগযজ্ঞাদি ক্রিয়াকারীদের দাক্ষিণ বন্ধন। সাধারণ কৈবল্যপ্রাপ্ত পুরুষগণ এই ত্রিবিধ বন্ধনের অধীনতার বশবর্তী ছিলেন এবং কালক্রমে তা থেকে মুক্ত হয়েছেন। কিন্তু ঈশ্বরকে এসকল বন্ধন কোনভাবেই স্পর্শ করতে পারে না। তাছাড়া ঈশ্বর সর্বজ্ঞ হলেও অন্যান্য পুরুষের ন্যায় চিত্তবৃত্তি তাঁর থাকে না। ঈশ্বরে চিত্ত স্বীকার করলেও সে চিত্ত হবে নির্মাণচিত্ত। পরম করুণাময় জীবের দুঃখ-ক্লেশ দূর করার জন্য চিত্ত গ্রহণের ইচ্ছা প্রকাশ করলে তাঁর চিত্ত নির্মিত হয়। রজস্তম অপহত এরূপ সাত্ত্বিক চিত্তকেই নির্মাণ চিত্ত বলা হয়।
যোগমতে পরমপুরুষ ঈশ্বর কিন্তু জগৎস্রষ্টা নন। নৈতিক দিক থেকে জীবের অদৃষ্ট রক্ষণাবেক্ষণ এবং অদৃষ্ট অনুযায়ী প্রকৃতির বিবর্তনের জন্য ঈশ্বরকে প্রকৃতি-পুরুষ সংযোগের নিমিত্ত কারণ বলা হয়। কিন্তু তিনি স্বয়ং জগৎ সৃষ্টি করেন না। জগৎ সৃষ্টি যোগমতে ব্রহ্মার কাজ। শ্রুতিতে বলা হয়েছে দেবতাদের মধ্যে হিরণ্যগর্ভ ব্রহ্মা প্রথম উৎপন্ন হয়েছিলেন। তিনিই বিশ্বের কর্তা এবং ভুবনের পালয়িতা। স্মৃতিতে আছে, জগৎস্রষ্টা ব্রহ্মা মুক্তপুরুষ নন। পরে তাঁর মুক্তি হয়। নিত্যমুক্ত ঈশ্বরের পক্ষে জগৎ সৃষ্টি তাই যুক্তি-বিরুদ্ধ ও শাস্ত্রবিরোধী। ঈশ্বরের উপদেশ অনুযায়ী ব্রহ্মা জগৎ সৃষ্টি করেন। যোগমতে সৃষ্টিকালে ও কল্পান্তে ব্রহ্মাদি দেবগণের সৃষ্টি ও বিনাশ হয়। কিন্তু ঈশ্বর সৃষ্টি-বিনাশরহিত। তিনি কালের দ্বারা অবচ্ছিন্ন নন। তিনি শুধু সাধারণ জীবেরই গুরু বা উপদেষ্টা নন, পূর্বাপূর্ব সৃষ্টিকর্তাদের তথা গুরুদেরও গুরু বা উপদেষ্টা।
.
.
যোগশাস্ত্রে ঈশ্বরের অস্তিত্ব বিষয়ে প্রমাণ
মহর্ষি পতঞ্জলি পৃথকভাবে ঈশ্বরের অস্তিত্ব বিষয়ে কোন প্রমাণ দেননি। ঈশ্বরের প্রণিধান প্রসঙ্গেই তিনি ঈশ্বরের লক্ষণ বা পরিচয় দিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে যোগসূত্রের সমাধিপাদে তিনি বলেন-
‘তত্র নিরতিশয়ং সর্বজ্ঞবীজম্’- (যোগসূত্র : ১/২৫)
অর্থাৎ : ঈশ্বরেই সর্বজ্ঞবীজ নিরতিশয়ত্ব প্রাপ্ত হয়েছে।
.
পরবর্তীকালে এই সূত্রটিকে ঈশ্বরের অস্তিত্বের প্রমাণ বলে গ্রহণ করা হয়েছে। এছাড়াও পরবর্তী যোগ দার্শনিকরা ঈশ্বরের অস্তিত্বের পক্ষে অনুমান ও আগমপ্রমাণ উপস্থাপন করেছেন। তাঁদের উপস্থাপিত প্রমাণগুলি নিম্নরূপ।
(১) প্রথমত, যে জিনিসের মাত্রাভেদ আছে তার একটি উচ্চতম বা চরমতম এবং নিম্নতম বা ন্যূনতম মাত্রা থাকতে বাধ্য। উচ্চতম বা চরমতম মাত্রাকে বলে কাষ্ঠা। জ্ঞান ও শক্তির মাত্রাভেদ আছে। ব্যবহারিক জীবনে কোন জীবের জ্ঞান ও শক্তি বেশি আবার কারো কম। যেখানেই আমরা অল্প, বহু, বহুতর, বহুতম- এইভাবে ক্রমবর্ধমান কোন গুণকে সাজাই, সেখানেই যুক্তিসঙ্গতভাবে আমাদের একটি নিরতিশয় বা পরাকাষ্ঠা স্বীকার করতে হয়। সর্বজ্ঞতার বিচারে প্রাণীদের এরূপ ক্রমিক তারতম্যের প্রেক্ষিতে পূর্ণজ্ঞান ও পূর্ণশক্তির একটি নিরতিশয় পরাকাষ্ঠাও স্বীকার করতে হবে। পূর্ণজ্ঞান ও পূর্ণশক্তির অধিকারী কোন সসীম জীব হতে পারে না। অতএব, পূর্ণজ্ঞান ও পূর্ণশক্তির অধিকারী এক সর্বজ্ঞবীজস্বরূপ ঈশ্বরের অস্তিত্ব স্বীকার করতে হয়।
(২) দ্বিতীয়ত, বেদ, উপনিষদ প্রভৃতি শ্রুতি ও স্মৃতিশাস্ত্রকে ঈশ্বরের অস্তিত্বের পক্ষে প্রমাণ হিসেবে গণ্য করা হয়। যোগদর্শন আস্তিক দর্শন। এই দর্শন বেদ তথা বেদানুসারী শাস্ত্রসমূহে বিশ্বাসী। শ্রুতিতে নিত্য, শুদ্ধ, মুক্তস্বভাব ঈশ্বরের কথা বলা হয়েছে। সুতরাং বেদ যদি অভ্রান্ত হয় তাহলে ঈশ্বরের অস্তিত্ব স্বীকার করা ছাড়া উপায় নেই।
প্রশ্ন হতে পারে, বেদ, উপনিষদ প্রভৃতি যেসব শাস্ত্র ঈশ্বরের রচিত বলে স্বীকার করা হয়, তারা ঈশ্বরের অস্তিত্ব কিভাবে প্রমাণ করে ? এর উত্তরে যোগভাষ্যকার বেদব্যাস বলেন, বেদের মাধ্যমে ঈশ্বরের অস্তিত্বের কথা জানা যায়। যদিও ঈশ্বর বেদের রচয়িতা তবু অস্তিত্বের দিক থেকে বিচার করলে ঈশ্বরের অস্তিত্ব বেদের অস্তিত্বের পূর্বে। অতএব, ঈশ্বরের অস্তিত্ব অস্বীকার করা যায় না।
(৩) তৃতীয়ত, প্রকৃতির অভিব্যক্তির নিমিত্তকারণরূপেও ঈশ্বরের অস্তিত্ব সিদ্ধ হয়। পুরুষের সঙ্গে সংযোগ ভিন্ন প্রকৃতির অভিব্যক্তি সম্ভব নয়। অচেতন প্রকৃতি ও সচেতন পুরুষের স্বাভাবিক সংযোগ সম্ভব নয়। পুরুষ নিষ্ক্রিয় হওয়ায় তার পক্ষে প্রকৃতির সান্নিধ্যে আসা সম্ভব নয়। আবার প্রকৃতি অচেতন হওয়ায় তার পক্ষে পুরুষের অবস্থান জানা সম্ভব নয়। তাছাড়া জগৎ সৃষ্টি বা প্রকৃতির বিবর্তন জীবের অদৃষ্ট অনুসারেই হয়। জীবের অদৃষ্ট সর্বজ্ঞ ঈশ্বর ছাড়া কারোর পক্ষেই জানা সম্ভব নয়।
(১৬)
স্বীকার করতে হয় যে, অদৃষ্টানুসারে ঈশ্বর জগতের বিবর্তনের ইচ্ছা করেন এবং তাঁরই ইচ্ছায় প্রকৃতি ও পুরুষের সংযোগ সম্ভব হয়। ঈশ্বরের অস্তিত্ব ব্যতীত এসব সম্ভব নয় বলে ঈশ্বরের অস্তিত্ব স্বীকার করতে হয়।
(৪) চতুর্থত, সৃষ্টির আদিতে বা অতীত সৃষ্টিতে যে মোক্ষজ্ঞান ও মোক্ষাভিলাষ পরিলক্ষিত হয়, সেই জ্ঞানের উন্মেষের জন্য কোন জ্ঞানী গুরু স্বীকার করা প্রয়োজন। কিন্তু এই জ্ঞানের কারণ হিসেবে কোন মানুষ অথবা স্বর্গের কেউ গুরু, একথা বলা যায় না। কারণ, যোগমতে কপিলাদি পূর্বাচার্যগণ এমনকি ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর প্রভৃতি দেবগণ কালাবচ্ছিন্ন। কল্পেই তাঁদের আবির্ভাব আবার কল্পান্তে তাঁদের বিনাশ হয় বলে শ্রুতিতে উক্ত হয়েছে। যেহেতু তাঁরা সকলেই সীমিত, সেহেতু তাঁদেরও গুরু ছিলেন, একথা স্বীকার করা প্রয়োজন। ফলে অতীত ও অনাগত সৃষ্টিতে মোক্ষজ্ঞানের বা প্রকর্ষগতির হেতুরূপে কালের দ্বারা সীমাবদ্ধ নন এমন একজন গুরু স্বীকার করতে হবে যিনি অনাদি ও অনন্তজ্ঞানসম্পন্ন। সেই গুরুই নিত্যমুক্ত ঈশ্বর। এজন্যেই যোগসূত্রের সমাধিপাদে বলা হয়েছে-
‘স পূর্বেষামপি গুরুঃ কালেন অনবচ্ছেদাৎ’- (যোগসূত্র : ১/২৬)
অর্থাৎ : তিনি (ঈশ্বর) অনাদি গুরু, যিনি কালের দ্বারা অবচ্ছিন্ন বা সীমাবদ্ধ নন।
.
যোগমতে ‘প্রণব’ বা ‘ওঁ’-কার শব্দ ঈশ্বরের বাচক শব্দ। এ প্রেক্ষিতে যোগসূত্রের সমাধিপাদে বলা হয়েছে-
‘তস্য বাচকঃ প্রণবঃ’- (যোগসূত্র : ১/২৭)
অর্থাৎ : প্রণব বা ওঁকারই ঈশ্বরের বাচক।
.
প্রতিটি বস্তুরই একটি বাচক শব্দ আছে। বাচ্য পদার্থ এবং বাচক শব্দের সম্বন্ধ হলো নিত্য অর্থাৎ স্বাভাবিক। তাই বাচক শব্দটি উচ্চারণ করলে বাচ্য পদার্থের একটি আকার বা চেহারা আমাদের মনে ভেসে ওঠে। যেমন- ‘গরু’ শব্দ উচ্চারণ করলে শিং ও লেজযুক্ত একটি পশুর আকার আমাদের মনে ভেসে ওঠে। অর্থাৎ বাচক শব্দের দ্বারা বাচ্যপদার্থ জ্ঞাত হয়। তবে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য পদার্থসমূহ বাচক শব্দ ছাড়াও জ্ঞাত হতে পারে, যেমন নীল সবুজ ইত্যাদি বর্ণ বা বৃক্ষাদি দ্রব্য।
কিন্তু সব পদার্থ এরূপ নয়। ‘পিতা’, ‘পুত্র’ প্রভৃতি শব্দের অর্থ কেবলমাত্র শব্দশ্রবণ বা শব্দস্মরণের মাধ্যমেই হতে পারে। যিনি পুত্র উৎপাদন করেন তিনিই পিতা। তাই ‘পিতা’ শব্দের অর্থ নির্ধারণ বিষয়ের ইন্দ্রিয়গ্রাহ্যতার উপর নির্ভর করে না। অনুরূপভাবে ‘প্রণব’ বা ‘ওঁ’ শব্দ সংকেতমাত্রের দ্বারাই বোধব্য। এ স্থলে বাচ্য-বাচক সম্বন্ধ প্রদীপপ্রকাশবৎ। প্রদীপ যেমন স্বভাবতই প্রকাশস্বভাব, তেমনি ‘ওঁ’ শব্দ শ্রবণমাত্রই ঈশ্বর বা ‘ওঁ’ শব্দের অর্থ অন্তরে প্রকাশিত হন।
‘ওঁ’ শব্দ শ্রবণমাত্রই যার নিকট সর্বজ্ঞ ঈশ্বরের স্মৃতি উপস্থিত হয় তিনিই বিজ্ঞ যোগী। সেইরূপ যোগীর দ্বারা প্রণবের জপ ও তাঁর ভাবনাই হলো ঈশ্বর-প্রণিধান। নিরন্তর প্রণব জপ থেকে চিত্তের একাগ্র সম্পাদিত হয়। এবং এইভাবে ঈশ্বরের প্রণিধানের মাধ্যমে সমাধিস্থ যোগীর আত্ম-চৈতন্য অধিগত হয়। আত্ম-চৈতন্যের এরূপ উপলব্ধি ও তার কারণরূপ পুরুষের স্বরূপতা নিত্য-শুদ্ধ-মুক্ত স্বভাবে অবস্থানকেই কৈবল্য বলে।
উল্লেখ্য, মহর্ষি পতঞ্জলির যোগসূত্রের সমাধিপাদে এভাবে ঈশ্বরপ্রণিধানকে সমাধি বা কৈবল্যলাভের বিকল্প উপায় বলে উল্লেখ করা হলেও পরবর্তী পরিচ্ছদ সাধনপাদে অন্যতম যোগাঙ্গ ‘নিয়ম’-এর আলোচনা প্রসঙ্গে ঈশ্বরপ্রণিধানের আলোচনা থেকে বোঝা যায় যে এটি সমাধিলাভের পক্ষে অবশ্যকর্তব্য।
এখানে বলা হয়েছে, ঈশ্বরপ্রণিধান করতে হলে মৈত্রী, করুণা, মুদিতা ও উপেক্ষা- এই চারটি ভাবনার অভ্যাস করতে হবে। সর্বজীবে মৈত্রীভাবনার অর্থ শত্রুর সুখেও মিত্রের সুখের মতো সুখী হওয়া। দ্বিতীয়ত, শত্রুর দুঃখকে প্রিয়জনের দুঃখ মনে করে করুণাভাবের সাধন করতে হবে। তৃতীয়ত, সধর্মী ও বিধর্মী সকলের পূণ্য আচরণেই মনে মুদিতাভাব আনতে হবে এবং অপরের দোষ দেখেও অগ্রাহ্য করতে হবে। চতুর্থত, ক্রোধ বর্জন করে উপেক্ষাভাবের সাধনাই কর্তব্য।
সুতরাং, এসব আলোচনা থেকে প্রতীয়মান হয় যে, সৃষ্টির ব্যাপারে ঈশ্বরের বিশেষ অবদান যোগদর্শনে স্বীকৃত না হলেও যোগসাধনার ক্ষেত্রে ঈশ্বরপ্রণিধান অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করে আছে।
সমাপ্ত
Continue-45
কালী কথা-০১
কালী মায়ের প্রনাম মন্ত্রঃ
“ ওঁ জয়ন্তী মঙ্গলা কালী ভদ্রকালী কপালিনী ।
দুর্গা শিবা ক্ষমা ধাত্রী স্বাহা স্বধা নমোহস্তু তে ।।”
এই প্রনাম মন্ত্রে মায়ের যে রূপের বনর্ণা আছে সেগুলি সম্বন্ধে জানা যাক ।
জয়ন্তীঃ- সর্বোৎকৃষ্টা ব্রহ্মরূপিণী ভগবতী সকল পদার্থের মূলীভূত কারণ তাই শ্রেষ্ঠা – সর্বত্র জয়লাভ করেন ‘জয়ন্তী জয়নাখ্যাতা’।
মঙ্গলাঃ- ভক্তদের জন্মমরণরূপ সংস্কৃতিকে নাশ করেন তাই মঙ্গলময়ী মঙ্গলা- “মঙ্গং- ভক্তানাং জননমরণরূপং সর্পণং – লাতি, নাশয়তি- সা মোক্ষপ্রদা মঙ্গলা ইত্যুচ্যতে।”
কালীঃ- “কলয়তি ভক্ষয়তি সর্বমেতদত্র প্রলয়কালে ইতি কালী”- যিনি প্রলয়কালে এই জগত প্রপঞ্চ ভক্ষণ করেন, গ্রাস করেন, তিনিই কালী । মহাকাল সর্ব প্রাণীকে গ্রাস করেন তাই তিনি মহাকাল । আর মহাকালকে যিনি কলন করেন তিনি আদ্যা পরমা কালিকা । “কলনাৎ সর্বভূতানাম্ মহাকালঃ প্রকীর্ত্তিতঃ । মহাকালস্য কলণাৎ ত্বম্যাদা কালিকা পরা।”
ভদ্রকালীঃ- “ভদ্রং মঙ্গলং- সুখং কলয়তি স্বীকারতি , ভক্তেভ্যো দাতুমিতি ভদ্রকালী।” যিনি ভক্তদের মঙ্গল বা সুখদান করেন , তিনিই ভদ্রকালী। “ভদ্রকালী সুখপ্রদা”( রহস্যাগম )।
কপালিনীঃ- যিনি প্রলয়কালে ব্রহ্মাদিকে নাশ করে তাঁদের কপাল হাতে নিয়ে থাকেন তিনি কপালিনী । যিনি সর্বদা হাতে ব্রহ্মকপাল ধারন করেন বা পালন করেন তিনি কপালী বা কপালিনী । ভাগ্যনির্ধারিণী , অদৃষ্টবিধায়িনী। “কপালং ব্রহ্মকং জাতং করে ধারয়তে সদা। কপালী তেন সা প্রোক্তা পালনাদ্ বা কপালিনী।” (দেবীপুরাণ )
দূর্গাঃ- যিনি দুঃখ দ্বারা প্রাপ্য অর্থাৎ যাঁকে বহু তপস্যা ও উপাসনার ক্লেশের দ্বারা পাওয়া যায় তিনি দূর্গা । স্মরণ মাত্রেই দেবী ইন্দ্রাদি দেবগণকে দুর্গম শত্রুর বিপদ থেকে রক্ষা করেছিলেন বলে তিনি দূর্গা। (দেবীপুরাণ)। যিনি দুর্গম বিপদ থেকে উদ্ধার করেন তিনি দূর্গা ।
শিবাঃ- শিব অর্থে মুক্তি, দেবী সাধকদের মোক্ষ ফল বা মুক্তি প্রদান করেন । এই শিব ফলের জন্য দেবীর উপাসনা করা হয় তাই তিনি শিবা। “শিবা মুক্তি সমাখ্যাতা । যোগিনাম মোক্ষদায়িনী করুণাময়ী ।”
ক্ষমাঃ- দেবী ক্ষমাশীলা । তিনি আদি জননী ।
ধাত্রীঃ- “সর্বপ্রপঞ্চ ধারণকর্ত্রী”। “ধাত্রীমাতাসমাখ্যাতা – ধারণে চোপগীয়তে”- জননী ও সবকিছু ধারন করে আছেন। ত্রিভুবন জননী । ত্রৈলোক্যধারিনী। তাঁর ওপর সব আছে ।
স্বাহাঃ- সমস্ত যজ্ঞে যে স্বাহা মন্ত্র অগ্নির শক্তির উচ্চারণে সমস্ত দেবগণ পরিতৃপ্ত হন সেই হব্যবাহণ । দেবতাদের পরিতৃপ্তি।
তাহলে শ্রী শ্রী কালী মায়ের প্রনাম মন্ত্রের সংক্ষিপ্ত রুপ হচ্ছেঃ
🌺🌺মা কালীর প্রণাম মন্ত্র 🌺🌺
ॐ জয়ন্তী মঙ্গলা কালী ভদ্রকালী কপালিনী ।
দূর্গা শিবা ক্ষমা ধাত্রী স্বাহা স্বধা নমোঽস্তুতে ।।
অর্থ :
হে দেবী, তুমি সর্বোৎকৃষ্টা জয়যুক্তা দেবী জয়ন্তী; তুমি জন্মমৃত্যুবিনাশিনী মোক্ষপ্রদায়িনী দেবী মঙ্গলা; তুমি সর্বসংহারকারিণী কালী; তুমি সুখদায়িনী ভদ্রকালী; আবার তুমিই প্রলয়কালে ব্রহ্মা প্রমুখের মাথার খুলি হস্তে নৃত্যরতা কপালিনী। তুমি দূর্গা, কারণ বহু কষ্ট স্বীকার করে তবে তোমায় লাভ করা যায়; তুমি চৈতন্যময়ী শিবা; তুমি করুণাময়ী ক্ষমা; তুমি বিশ্বধারিণী ধাত্রী; তুমি দেবগণের পোষণকর্ত্রী স্বাহা ও পিতৃগণের পোষণকর্ত্রী স্বধা। তোমায় নমস্কার করি।
কালী কথা-০২
শক্তিপুজোর দুটো ধারা আছে : একটি হল দক্ষিণাচারী বা দক্ষিণমার্গ । অপরটি বামাচারী বা বামমার্গী । দক্ষিণাচারীদের পূজোয় মদ্য , মাংস , মৈথুন ইত্যাদি পঞ্চ ‘ ম ’ কার সহকারে পূজো করা হয় না । অপরপক্ষে বামাচারীদের পূজোয় পঞ্চ ‘ ম ’ - কার সহকারে পুজো করা হয় । উদ্দেশ্য , এক ধরনের সিদ্ধি অর্জন করা । এক ধরনের কুমারীপূজোর মাধ্যমেও এক ধরনের শক্তি আহ্বান করা হয় । কুমারী নারী সম্পর্কে শাস্ত্রে বলা হয়েছে , যাবৎ পুষ্পং ন বিন্দ্যতে ' । অর্থাৎ নারী ততক্ষণই কুমারী যতক্ষণ সে বিকাশের পূর্বাবস্থায় । যে শক্তি কুমারীরূপে স্থিতা সেই শক্তি হল সিসৃক্ষু — অর্থাৎ ব্রহ্মশক্তির সঙ্গে তুলনীয়া।
তবে দক্ষিণাচারী ও বামাচারী ক্রিয়া সম্পর্কে ভিন্ন ধারণাও আছে । বৈদিক সাধারণ পূজার ধারা ধরে যে পূজী করা হয় তাই দক্ষিনাচারী। প্রচলিত প্রথার উল্টোদিকে যে সাধনা করা হয় তাই বামাচারী । তবে এই বামাচার যে , ' তথাকথিত তন্ত্রের মৈথুন সহ আচার এ নয় অর্থাৎ বামা ( নারী ) সহ আচার । যারা বামাচারকে মহিলা - সহ আচার মনে করে তআরাই স্থূল পঞ্চ ‘ ম ' - কার সহকারে পূজাে করে । কিন্তু অনেকে এর ভিন্ন ধরনের ব্যাখ্যা করেন । তাঁরা এই শক্তিকে মানবদেহস্থিত কূল বা শক্তি বলে মনে করেন । এই শক্তি মানবদেহের সহস্রারস্থ কূট স্থানের শক্তি যা মানবদেহের ব্রহ্মর থেকে নির্গত হয়ে মূলাধার অঞ্চলে এসে মহা শক্তি রূপে বিরাজ করে । সেখান থেকে তাকে বিপরীত গতিতে প্রবাহিত করে কূটস্থানে ফিরিয়ে নেওয়ার অর্থাৎ উল্টো বা বামদিকে ফিরিয়ে নেবার পদ্ধতি বা আচারকেই বামাচার বলে । মূলত যােগে কুলকুণ্ডলিনীকে সহস্রাবের দিকে উর্ধ্বগতি করার নামই বামাচার । কূল বা দেহস্থ শক্তিকে অর্থাৎ প্রাণশক্তিকে উর্ধ্বগামী করার যার সাধনা করেন তাঁদেরই বলা হয় কৌল।
শৈব সাহিত্যে এই শক্তি শিবের সহধর্মিণী হিসেবে চিহ্নিত । শিবের শক্তি হিসেবে তাকে বহু নামে ডাকা হয় যেমন , দেবী , উমা, পার্বতী, শিবানী, কালী, কপালিনী, চামুন্ডা ইত্যাদি। পুরান কাহিনীতে দেখা যায় সব দেবতাই একজন করে শক্তি বা সহধর্মিণী আছেন । কিন্তু বড় শক্তি হিসেবে শিবের এই সহধর্মিণীটিই দেখা দিয়েছেন । শিবের সহধর্মিণী হলেও শিব অপেক্ষা কোনােরকমেই তিনি নিকৃষ্ট নন । শিবের সঙ্গে তার এই সমমর্যাদার সম্পর্কই তাঁকে ভারতবর্ষে অর্ধনারীশ্বর মূর্তি হিসেবে স্বতন্ত্রভাবে চিহ্নিত করেছে ।
দেবীর অসংখ্য নাম ও নানা ধরনের চরিত্র এটাই প্রমাণ করে যে , হয়তাে ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে নানা নরগােষ্ঠী দ্বারা পূজিতা শক্তি বা দেবীরা এক সময় তাঁর মধ্যে মিশে গিয়েছিলেন । এইভাবেই শিবের সহধর্মিণীরুপে এসে গেছেন সুদূর দক্ষিণের কন্যাকুমারীর কুমারী দেবী । ঠিক এমনই ভাবে এসেছেন অম্বিকা। আদিতে এই অম্বিকা ছিলেন মাতৃস্থানীয় শক্তিসমূহের প্রতিনিধি বিশেষ । এইভাবেই কুশিক জাতির দেবী কৌশিকী হিসেবে এবং কাত্যজাতির দেবী কাত্যায়নী হিসেবে এই মহামাতৃকার অঙ্গিভূত হয়েছেন ।
পুরাণ কাহিনীর মতে উমা ছিলেন হিমালয় দুহিতা --- যাঁকে শিব বিবাহ করেছিলেন । কিন্তু এর আগে উমাকে যখন উল্লেখ করা হয়েছে তখন , যেমন , কেন উপনিষবে , তখন কে দিব্য নারী সত্তা হিসেবে দেথানাে হয়েছে — যিনি ব্রাহ্মণ সম্পর্কে সম্পূর্ণ অবহিত ছিলেন । আদিতে তিনি কোনাে স্বতন্ত্র দেবী ছিলেন । সম্ভবত হিমালয়ের কোনাে নারীর বিদেহী শক্তি , পরে শিবের পত্নী হয়েছেন । বিন্ধ্যারণ্যের দেবী বিন্ধ্যবাসিনী শিবের পত্নী হিসেবে স্বীকৃতা । কোনাে কোনাে ক্ষেত্রে এই দেবীকে অগ্নির সঙ্গে যুক্ত দেখা যায় । মুণ্ডক উপনিষদে অগ্নির সাতটি জিহ্বার মধ্যে দুটি জিহার নাম করা হয়েছে কালী ও করালী । অগ্নির সাতটি জিহ্বা আদিতে কোন প্রাচীন নরগােষ্ঠীর সাতটি ভয়ঙ্করী নারীশক্তি ছিল । দেবী দূর্গার মধ্যে এখনাে সেই ভয়ঙ্কারিতা রয়ে গেছে । এই জন্য আজও দূর্গা পূজা বলি সহকারে করা হয় । এসব দেখে এটাই বােঝা যায় যে , ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্তের নানা নরগােষ্ঠী যে বিভিন্ন মাতৃদেবতার পূজা করত তারা সবাই ভারষ্টীয় হিন্দু - সংস্কৃতির একীকরণ প্রচেষ্টা থেকে এক মহাশক্তির মধ্যে মিশে গেছেন । এই মেশানাের জন্য নানা ধরনের গল্প তৈরি করা হয়েছে , যেমন দক্ষযজ্ঞনাশ গল্প । দক্ষযজ্ঞনাশ গল্পে একান্ন শক্তিপীঠের নানা মাতৃদেবীকে এনে এক মহাদেবীর অঙ্গি'ভূতা করা হয়েছে । বিভিন্ন দেবদেবীর শত বা সহস্র নামকরণের যে প্রবণতা ভারতবর্যে লক্ষ্য করা যায় তারও ইতিহাস ঠিক অনুরূপ ।
কোথাও কোথাও এই দেবীকে কালী বলা হয় । কারণ তিনি ভয়ানক কৃষ্ণবর্ণা । কালাে বলেই এই দেবীর নম কালী , সাধারণ এরকম ধারণাই প্রবল । কিন্তু তা ঠিক নয় | কালের অর্থাৎ সময়ের জন্মদান করেছেন বলেই তিনি কালী । তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তিনি কল্যাণময়ী দেবী রূপেই চিহ্নিতা ।
কালী কথা-০৩
কোনো গ্রামে গ্রামের অধিষ্ঠাত্রী দেবী দুর্গা নামেও পরিচিতা । এক্ষেত্রে দেবীর বেদী এমন দুর্গমস্থানে স্থাপিত হতো যে , সাধাৰণে সেখানে যেতে পারে না । স্থানটি হয় কোনাে অন্ধকার গুহায় , সংকীর্ণ উপত্যকায় , দুর্গম পাহাড়ের কিনারে বা নদীর উৎসমুখে । নদীর উৎসমুখে ভারতের একান্ন শক্তিপীঠে মাতৃশক্তির এরকম কয়েকটি পীঠ আছে , যেমন কালী-গণ্ডকীর উৎস মাসতং - এ গণ্ডকী পীঠ , অমরকন্টক তীর্থে নর্মদা নদীর উৎসে নর্মদাতীর , শােন বা শৈলপীঠ ইত্যাদি । এইসব তীর্থকে বহু নৃতত্ত্ববিদ আদিকালে কোনাে নরগােষ্ঠীর বিদেহী শক্তির অধিষ্ঠান ক্ষেত্র বলে মনে করেন । পরে এইসব পীঠ মহাদেবীর পীঠ হিসেবে গণ্য হয়েছে ।
সমাজ যখন মাতৃতান্ত্রিক ছিল , তখনই শক্তি মাতৃরূপে সমাজের দৃষ্টি বেশি আকর্ষণ করে । সেইজন্য হিন্দুদের দেখা যায় , মাতৃশক্তিকে তারা এইভাবে সম্বােধন করছেন : “ হে মাতে , তুমি প্রশংসার অতীত । জগতের প্রতি অণু - পরমাণুতে তােমারই উপস্থিতি । সকল জ্ঞানের উৎস তুমিই । সমস্ত নারীরূপের মধ্যে রয়েছে তোমারই উপস্থিতি ।
কালীকে তিব্বতের মহাযান বৌদ্ধধর্মেও গ্রহণ করা হয়েছে । এই বৌদ্ধকালী সম্ভবত হিন্দুদের অনার্য মাতৃদেবী থেকে এসেছে । এঁকে বিন্ধ্যবাসিনী কালীর সঙ্গে এক করে দেখা যেতে পারে । আদি বৈদিক বা ব্রাহ্মণসাহিত্যে কালী নামে কোনাে মাতৃদেবীকে দেখা যায় না । তবে এমন মাতৃদেবী আছেন , যাঁকে সহজেই কালীর সঙ্গে যুক্ত করা যায় । সপ্তম শতাব্দীতে এই বৈদিক মাতৃশক্তির সঙ্গে কালীকে এক করে দেখানাের প্রয়াস চলে । বৈদিক অশুভ শক্তির দেবী নিতির সঙ্গে তাঁকে এক করে দেখানাে হয় । এইজন্য তাঁর চরিত্রে ভয়ঙ্করী দিকের প্রকাশ ঘটেছে । কিন্তু যখন তাকে সিংহবাহন করে দেখানাে হয় , তখন মনে হয় উৎসে এই দেবী পশুশক্তির সঙ্গে অবিচেছদ্য সম্পর্কে যুক্ত ছিলেন । ক্রমশ মানুষ যখন নিজের সম্পর্কে বেশি করে জানতে পারেন , তখনই পশুশক্তি থেকে মাতৃশক্তি নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে নারীরূপে প্রতিষ্ঠিত করেন । সুতরাং বলা যায় যে , সারা পৃথিবীব্যাপী মাতৃসাধনার যে ধারা গড়ে উঠেছিল , ভারতীয় শাক্ততত্ত্ব সেই ধারাটিরই একটি শাখা মাত্র এবং যেভাবে ইশতাব , এশটির বা শটোরেখ , আফ্রোদি , ফ্রিগিয়ান কাইবেলী বা শাইবেলী ও এফেনিসের ডুয়ানার আশ্বপ্রকাশ ঘটেছে সেইস্টাবেই ভারতে শক্তিদেবীসমূহ আত্মপ্রকাশ করেছে । এঁদের নানা নাম , নানা গুণ । এরা প্রত্যেকেই আবার কোনাে না - কোনাে মহান দেবতার শক্তি হিসেবে দেখা দিয়েছেন । নেপালে কীর্তিপূরের গণেশ বেদীতে আটটি মাতৃমূর্তি আছে । গুজরাটে এদেরই কেউ কেউ কিছু চারণ মহিলাকবির প্লেতশক্তি হিসেবে চিহ্নিত । এই মহিলা চারণকবিদের কোনো - না - কোনাে বেদনাদায়ক কারণে দেহত্যাগ ঘটেছিল । এদের প্রধান হলেন , থারিয়ার ! মাদ্রাকেও বহু মাতৃশক্তির উৎস মানবী সত্তা ।
তবে শক্তিপুজোর ধারা অসম ও বঙ্গদেশে যত জনপ্রিয় , অন্য কোথাও তত জনপ্রিয় নয় । এখানকার শক্তিপূজার ধারা লক্ষ্য করলে বােঝা যায় যে , অনার্য ভয়ঙ্করী শক্তির সঙ্গে তাঁর নিবিড় যােগাযােগ । পূর্ব ভারতে একসময় বৌদ্ধ ধর্মের প্রাধান্য সত্ত্বেও এই শক্তিপূজার ধারাকে সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন করা যায়নি । সাময়িক কালের জন্য আড়ালে চলে গেলেও আবার তা ফিরে এসেছে।
হতে পারে যে , এই শক্তিপূজার উদ্ভব ঘটেছিল অসমের কামরূপ অঞ্চলে । এবং গৌতম বুদ্ধের অনেক আগেই এই মাতৃশক্তি পূজার ধারা সৃষ্টি হয়েছিল । এই দেবী ছিলেন শোনিতপ্রিয়া । বলি দেওয়া পশুর মাংস পেলে তিনি তৃপ্ত হন। অসম এই দেবীর প্রধান রুপ হল কামাক্ষ্য হিসাবে । এরই সঙ্গে এই সেদিন পর্যন্ত নরবলি প্রথাও প্রচলিত ছিল । বৈদিক হিরণ্যকশিপুর গল্পে যদিও নরবলির কথা শােনা যায় , তবুও বৈদিক ধর্মের চৌহদ্দির মধ্যে নবাবলির কোনাে কথা নেই । এই জন্যই মনে হয় নরবলি প্রথা এসেছিল কোনাে অনার্য সংস্কৃতি থেকেই । আগে অসমে দেবী কালিকার বেদীতে নরবলি দেওয়া হত । ১৫৬৫ খ্রিস্টাব্দে নরনারায়ণ যখন কামাক্ষা মন্দির তৈরি করেন , তখন বহু সদ্যকর্তিত নরমুণ্ড তাম্রপাত্রে বা তামার টাটে দেবীকে উপহার দেওয়া হয়েছিল । কামরূপের বেলতোলাহ - এর সদিয়া তাহমন্দিরেও অনুরুপ বলিপ্রথা ছিল । ১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দে চারজন ব্রিটিশ প্রজাকে এই মন্দিরে বলি দেবার জন্য জয়ন্তিয়ার রাজাকে ক্ষমতাচ্যুত করেছিলেন।
এই যে শক্তি , মহাশূন্যতা থেকে যা প্রথম নির্গত হয়েছিলেন তাই আদিশক্তি অর্থাৎ আদ্যাশক্তি । এই আদ্যাশক্তির সঙ্গে শূনতারুপী পুরুষের প্রত্যক্ষ যোগ । পুরুষের সঙ্গে এই সম্পর্ককেই রমণ বলা হয়েছে । এইজন্য ; তন্ত্রশাস্ত্রে কালীকে রমণী বলে । অপরপক্ষে এই আদিশক্তি থেকে আকাশরুপ দেশের অর্থাৎ নীলবর্ণা দেবী তারার সৃষ্টি হয়েছিল । সেই আকাশেই সৃষ্টি ধৃত হয়ে আছে । মায়ের বুকে যেমন শিশু থাকে , বাপারটা তেমনই । সেইজন্য তন্ত্রে বলা হয়- “ কালী রমণী , তারা জননী ।
মহানির্বাণতন্ত্রে অবশ্য কালীর অর্থ করা হয়েছে , এইভাবে : ‘ সর্বপ্রাণীকে কলন ” অর্থাৎ গ্রাস করেন বলে শিব অর্থাৎ পরমপুরুষ অর্থাৎ মহাশূন্যতা ‘ মহাকাল ' নামে পরিচিত । এই মহাকালকেই গ্রাস করেন আদ্যাশক্তি কালিকা। কালকে গ্রাস করেন বলেই তিনি কালী ।
কালী কথা-০৪
কালীর বর্তমান যে রূপ বঙ্গদেশে দেখতে পাওয়া যায় , গল্প আছে , সেই রূপ স্বপ্নে মা কৃষ্ণানন্দকে আদেশ করেন যে , আমাকে মূর্তিরূপে প্রতিষ্ঠা করো । কিন্তু তথন ও মায়ের কোনাে রূপ ছিল না । কৃষ্ণানন্দ জিজ্ঞাসা করেন , কি রূপে তােমাকে প্রতিষ্ঠা করব ? ' মা জানান , আগামী কাল ঘুম থেকে উঠেই আমার রূপ দেখতে পাবি । ঘুম থেকে উঠে ঘরের বার হতেই কৃষ্ণানন্দ দেখেন যে খুঁটেকুড়ােনীর এক কালাে মেয়ে দেয়ালে ঘুটে দিচ্ছে । আলীড় ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে সেই মেয়ে , অর্থাৎ দক্ষিণ চরণ বাড়িয়ে দিয়েছে সামনের দেয়ালের দিকে । ঢালু ভঙ্গিতে দৃঢ়ভাবে বাঁ পায়ের ওপর ভর করে দাঁড়িয়ে আছে । বাঁ হাতে রয়েছে একতাল গােবর । ডান হাতে খুঁটে দেবার মতো গােবরের সামান্য অংশ । কৃষ্ণানন্দকে দেখে লজ্জায় জিব কাটে সেই মেয়ে । অর্থাৎ লাল টকটকে জিব বের করে তার ওপর রাখে শুভ্র উর্ধ্ব দন্তপাটি । কৃষ্ণানন্দের অন্তরে সঙ্গে সঙ্গে সাড়া জাগে । এই হল মায়ের মূর্তি । এই মূর্তিই মা তাকে দেখালেন । কৃষ্ণানন্দ নিজের হাতে মাটি দিয়ে তৈরি করালেন সেই মূর্তি । তারপর যথারীতি পূজা দিলেন । এইভাবে অরুপা মা রুপ ধরে দেখা দিলেন।
কৃষ্ণান শ । তিন গত পরে বাপের রাঙা + ভান কীর্তিক মাসের জন্য , এগিয়ে বিশাল মূতি । তিনি নিত্যদিন নতুন মূর্তি তৈরি করে পুজো দিতেন । পরদিনই আবার বিসর্জন দিয়েন গংগাতে।
কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশের ' তন্ত্রসার ' গ্রন্থে মায়ের এই রুপেরই বর্ণনা দেওয়া আছে । তবে মা হিন্দুবেদীতে স্থান লাভ করলেও সংস্কৃত সাহিত্যে কালীর বর্ণনা খুব কম পাওয়া যায় । বীজমন্ত্রে মায়ের যে পূজা করার পদ্ধতি রয়েছে , তাকে সংস্কৃতজাত বলে মনে হয় না । হ্রীং, ক্লীং, হৈং, ক্রীং এই জাতীয় শব্দের মধ্যে সংস্কৃতের গন্ধ নেই । তাছাড়া 'ফট' শব্দের মধ্যেও সংস্কৃতের গন্ধ পাওয়া যায় না । “ ফট ' শব্দের অর্থ সর্বাঙ্গে । যেমন -- “ ফট স্বাহা ' । ফট স্বাহা অর্থ — সর্বাঙ্গে প্রণিপাত করি । অবশ্য যাঁরা সব হিন্দু পূজাকেই বেদজাত বলে মনে করেন , তারা এই বীজমন্ত্রের মধ্যেও সংস্কৃতের গন্ধ পান । যেমন , এইভাবে শব্দগুলােকে সংস্কৃতজাত বলে দেখার চেষ্টা হয়েছে -- ক্রীং ( কামনা) এ কামনা -( ক ) , প্রাণাগ্নি শক্তি ( র ) -র সঙ্গে যুক্ত হয়ে যে অগ্রগতি ( ঈ ) সৃষ্টি করে , তা - ই হল বীজমন্ত্র ক্রীং । ক্লীং বা কামনা = ( ক ) স্থূলত্বে ( ল ) পরিণত হয়ে যে অগ্রগতি ( ঈ ) সৃষ্টি করে তা - ই হল ক্লীং । এর ভিন্নতর অর্থও আছে । যেমন , বর্গাদ্য শব্দে ' ক ' , বহ্নি শব্দে ' র ' , রতি শব্দে ‘ ঈ ' এবং তাতে বিন্দু সংযুক্ত হয়ে সৃষ্টি করেছে ক্রীং। অপরপক্ষে নকুলীশ শব্দে ' হ ' , ' অগ্নি । শব্দে ' র ' , বাম নেত্র শব্দে ' ঈ ' , ' অর্ধচন্দ্র শব্দে চদবিন্দু এইসব মিলে হয়েছে ‘ হ্রীং ইত্যাদি ।
শক্তিপূজায় তন্ত্রে দেহের ষচক্রের অধিশ্বরী ছটি দেবী আছে , যেমন- ডাকিনী , রাকিনী , লাকিনী , কাকিনী , শাকিনী ও হাঁকিনী- এদের উৎস কোনাে সংস্কৃত শব্দ বলে মনে হয় না । এর মধ্যে কয়েকটা নাম বাইরে থেকে আগত তা বেশ বােঝা যায় । যেমন- ' ডাকিনী ' শব্দ তিব্বতে ‘ ডাক ’ বলে একটি শব্দ আছে , যার অর্থ জ্ঞান বা জ্ঞানী । তারই স্ত্রীলিঙ্গ ডাকিনী অর্থাৎ জ্ঞানী নারী ।
ঘটচক্রের অন্যান্য দেবীর নামের অর্থ তেমন খুঁজে পাওয়া যায়নি । তবে দুটো দেবীর অস্তিত্ব তিব্বতের সীমান্ত অঞ্চলে খুঁজে পাওয়া গেছে — লাকিনী ও হাঁকিনী । এই দুই দেবীর সন্ধান পাওয়া গেছে ভুটানে । এই ছটি দেবীর অস্তিত্ব হিমালয় - সংলগ্ন দেশগুলিতেই ছিল , যাকে বলা হয় মহাচীন । শক্তিপূজার ধারা সেখান থেকেও আসতে পারে । কারণ দেখা যায় , শক্তিপূজায় যে ফুলের চাহিদা সবচেয়ে বেশি , অর্থাৎ জবা, তার অস্তিত্ত্ব মহাচীন অঞ্চলেই ছিলো।
কালীর ইতিহাস ও পুরাণ - কাহিনী হল এই ধরনেরঃ পার্বতী , উমা , সতী ও দূর্গা - চণ্ডিকার ধারা মিলে পুরাণ ও তন্ত্রে যে মহাদেশীর বিবর্তন ঘটেছে , তার সঙ্গে আর একটা ধারা এসে মিলেছে কালিকা বা কালীর ধারা । যেভাবেই হােক কালী বা কালিকাই বঙ্গদেশের শক্তি সাধনার ক্ষেত্রে সর্বেশ্বরী হায়ে উঠেছে। সেই জন্য শাস্ত্রে বলা হয়েছে , “ কালিকা বঙ্গদেশে চ '।
বৈদিক সাহিত্য কালী নামটি দেখতে পাওয়া যায় মুণ্ডক উপনিষদে । সেখানে যজ্ঞাগ্নির সপ্ত জিহবার একটি জিহ্বার নাম কালী । যেমন , ' কালী করালী চ মনোজবা চ ' তবে এখানে কালী আহুতি গ্রহণকারী অগ্নিজিহবা মাত্র। দার্শনিকভাবে -- পঞ্চ ইন্দ্রিয় , বুদ্ধি ও মন এই সাতটিই হল ' অগ্নির সপ্ত'জিহবা ।
মহাভারতে একাধিক স্থানে কালীর উল্লেখ আছে । মহাভারতের কালীর সঙ্গে পুরাণের কালীর অনেক মিলও আছে । মহাভারতে অশ্বথামা পাণ্ডব - শিবিরে প্রবেশকালে যে কালীমূর্তি দেখেছিলেন তিনি রক্তাস্যনয়না , রক্তমাল্যানুলেপনা , পাশহস্তা ও ভয়ঙ্করী । কিন্তু অনেকে মনে করেন যে , মহাভারতে কালীর এই উল্লেখ পরবর্তীকালের সংযােজন হতে পারে । তবে এখানে কালীর মধ্যে দেবত্বের আভাস প্রধান হিসেবে গৃহীতা হননি । পরে সংস্কৃত সাহিত্যে রক্তলােলুপ এক ভয়ঙ্করী দেবীর উল্লেখ পাওয়া যায় । খিল হরিবংশে মদ্য - মাংসপ্রিয় এই দেবীকে শবর , বর্বর ও পুলিন্দদের দ্বারা পূজিতা হতে দেখা যায় । কালী প্রসঙ্গেই ( ষষ্ঠ ও সপ্তম শতাব্দী ) বাসবদত্তায় ভগবতী বা কাত্যায়নীর কথা শুনতে পাই।
কালী কথা-০৫
কালীর সঙ্গে একসময় শিবেরও যোগ হয়ে যায় । শিব কালীর স্বামীরুপে চিহ্নিত হন । কিন্তু, তিনি স্বামীর বক্ষরূঢ়া । হিন্দুচিন্তায় স্ত্রী স্বামীর বুকের ওপর দাঁড়িয়ে আছে এমন ভাবাই যায় না । সাধারণ গল্পে এর ব্যাখা দেখার চেষ্টা করা হয়েছে এইভাবে ; যুদ্ধে অসুর নিধন করতে করতে দেবীর পায়ের কাছে শিব নিজেকে শায়িত করে দেন । তাঁর বুকের ওপর পা দিয়ে দেবীর চৈতন্য হয় । তিনি লজ্জায় জিব কাটেন । সেই জন্যই তিনি জিহবা প্রসারিত করে আছেন ।
তবে এর ভিন্ন অর্থটাই আসল । মূর্তিটি সম্পূর্ণই প্রতীকী মূর্তি । বস্তুত ভারতীয় ভাস্কর্য শিল্পের সব মূর্তিরই একধরনের প্রতীকী ভাষা আছে। কালি যে শিবের বুকের ওপর দাঁড়িয়ে আছেন তার অর্থ হল — পুরুষের বুক থেকে শক্তির উদ্ভব হয়েছে । এই পুরুষ , যিনি মূলতই ক্রিয়াহীন , তথাপি অব্যক্তভাবে নিজের ভেতর থেকে শক্তিকে নির্গত করে শবের মতো পড়ে আছেন ।
মুণ্ডকোপনিষৎ ১.২.৪ অনুসারে কালী, করালী, মনোজবা, সুলোহিতা, সুধূম্রবর্ণা, স্ফুলিঙ্গিনী এবং বিশ্বরুচী যাজ্ঞিক অগ্নির জিহ্বা সমূহ। যা প্রতিক অর্থে যাজ্ঞিকঅগ্নি স্বরূপী ঈশ্বরের একটি শক্তি।
এই ধারণার ভিত্তিতে শিবপুরাণের রুদ্র সংহিতা ও উমা সংহিতাতে মা কালী পরমা প্রকৃতির (মাতা সতী ও মাতা পার্বতীর) একটি উগ্র স্বরূপ। যেহেতু দার্শনিক দৃষ্টিকোণে মা কালী হল পরম পুরুষের শক্তি স্বরূপী পরমা প্রকৃতির একটি উগ্র স্বরূপ, তাই মা কালীই হল এক দিক থেকে পরমা প্রকৃতি। তন্ত্রদর্শনে উক্ত সিদ্ধান্তটি গ্রহণ করে মা কালীকে আদ্যাশক্তিহিসাবে নামকরণ করেছে। পরে এই কালীই শাক্ত দর্শনের আধারে বিভিন্ন রূপভেদে বিভক্ত হয়েছে যেমন :- সিদ্ধকালী, ভদ্রকালী, গৃহ্যকালী, শ্মশানকালী, রক্ষাকালী, মহাকালী, ফলহারিণী কালী, রটন্তী কালী প্রভৃতি। এমনই একটি রূপের বর্ণনা পাওয়া যায় কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাস মহাভারতের সৌপ্তিকপর্বে (মহাভারত ১০.৮.৬৪) যেখানে মা কালীর প্রাচীনতমকালরাত্রি স্বরূপের বর্ণনা করা হয়েছে।
[প্রতিমার উদ্দেশ্য]
কালীমূর্তির তত্ত্ব জানার আগে বুঝতে হবে এই কালীমূর্তি সর্বপ্রথম কে বা কাদের দ্বারা এবং কিসের ভিত্তিতে তৈরী হয়েছে? অবশ্যয় আদ্যাশক্তিরসাধকদের দ্বারা! তবে তাদের কোনো কল্পনা বা কারো রূপকে নকল করে নয়, তারা এই মূর্তি নির্মাণ করেছে তাদের ধ্যান ও সাধনা থেকে প্রাপ্ত জ্ঞানের ভিত্তিতে।
ব্রহ্মের দুটি অবস্থা একটি মনুষ্য মনস্থিত অপরটি সর্ব্ব্যাপী। যার জন্য বৈদিক সময়কাল থেকে ঋষিগণেরা যোগ ও যজ্ঞ দুটি উপায়ে ব্রহ্মকে পূজিত করে আসছেন।
যোগের দ্বারা মনস্থিত ব্রহ্ম পূজিত হয়। এইক্ষেত্রে যোগীরা অন্তঃকরণ সংযম ও যোগবলের মাধ্যমে ঔঁকার আদি মন্ত্রবীজ জপের দ্বারা মনের অগোচরে পরমাত্মাকে স্থাপিত করে যোগাচারে তার উপাসনা করেন।
যজ্ঞের দ্বারা সর্ব্ব্যাপী স্বরূপী ব্রহ্ম পূজিত হয়, এইক্ষেত্রে যজ্ঞের সম্পাদক (ঋত্ত্বিক) বিভিন্ন মন্ত্র উপচার পালনের মাধ্যমে, যজ্ঞকুণ্ডে পুরোহিত রূপী অগ্নিকে স্থাপন এবং যাজ্ঞিক অগ্নির দ্বারা স্থূল যাজ্ঞিক হাবি সমূহের দহনের ফলে প্রাপ্ত সূক্ষ্ম হাবি সমূহের দ্বারা সর্ব্ব্যাপী ব্রহ্মের উপাসনা করেন।
কিন্তু কলিযুগের মানুষদের যোগবল ও আধ্যাত্মবল নাই বললেই চলে! তাই যোগ ও যজ্ঞ এর দ্বারা সূক্ষ্ম উপাসনা করতে বর্তমান মানুষেরা অসমর্থ। তাই স্থূল উপাসনার প্রসার ঘটেছে, এইক্ষেত্রে ব্রহ্মের প্রতিক স্বরূপী "প্রতিমা" ব্যাবহার করা হয়। এই প্রতিমাটি তৈরী করা হয় সাধকদের সাধনা থেকে প্রাপ্ত বিভিন্ন জ্ঞান ও ধ্যানে সময় চিন্তার ভিত্তিতে।এই তথ্য ও জ্ঞানের সমাহার কে প্রতিমাতত্ত্ব বলা হয়।
এই স্থূল উপাসনার মাধ্যমে ভক্তিযোগ প্রশস্ততা লাভ করে, সাধকের মনেআধ্যাত্মবলের সঞ্চার হয়। সাধক যোগীদের ন্যায় সম্পূর্ণরূপে অন্তঃকরণ সংযমের আসক্তি লাভ করে এবং প্রতিমা তত্ত্ব, আরাধ্য তত্ত্ব ও উপাসনা তত্ত্ব প্রভৃতির বিশ্লেষণ করতে সক্ষম হয়। উক্ত যোগ্যতা গুলো অর্জন করতে পারলেই, তবে সে এই ভরা কলিযুগে সূক্ষ্ম উপাসনা বা মানসোপচারে মানস পূজা করার জন্য সামর্থতা লাভ করে।
কালী কথা-০৬
এই মানস পূজাই হল প্রতিমা পূজার অবিচ্ছেদ অঙ্গ ও উদ্দেশ্য। যা প্রায় যোগাচারে মনস্থিত ব্রহ্মের পূজার অনুরূপ। এই মানস পূজোটি কিরূপ?
মহানির্ব্বাণ তন্ত্রের সাপেক্ষে অতি সংক্ষেপে সেটা বলছি।
* প্রথমে সাধক ধ্যানের মাধ্যমে মনে আরাধ্যের আহ্বান করে, নিজ হৃদয়পদ্মকে আসনস্বরূপে প্রদান করবে।
* সহস্রাধার চ্যুত অমৃতের দ্বারা আরাধ্যের পাদমূলে পাদ্য প্রদান করবে।
নিজ মনকে অর্ঘ্যস্বরূপে নিবেদন করবে।
* পূর্ব্বোক্ত সহস্রারচ্যুত অমৃত দ্বারাই আচমনীয় ও স্নানীয় জল নিবেদন করবে।
* আকাশতত্ত্ব কে বসন, গন্ধতত্ত্ব কে সুগন্ধ, ভাব কে পুস্প এবং প্রাণকে ধূপ, অগ্নিতত্ত্বকে দীপ, অমৃত রূপী ভক্তিকে নৈবেদ্যরূপে প্রদান করবে।
* হৃদয়মধ্যস্থ অনাহতধ্বনিকে ঘন্টা এবং বায়ুতত্ত্বকে চামর, অনন্তর ইন্দ্রিয়ের কার্য্যসমূদয় এবং মনের চঞ্চলতাকে নৃত্যরূপে কল্পনা করে আরাধ্যের উদ্দেশ্যে নিবেদন করবে।
ভাব পুস্প গুলি হল - অমায়িকতা, নিরহঙ্কার, রাগশূন্যতা, মদহীনতা, দম্ভশূন্যতা, মোহশূন্যতা, দ্বেষহীনতা, ক্ষোভরহিততা, মাৎসর্য্যহীনতা ও নির্লোভতা - এই দশবিধ পুস্প এবং এদের মধ্যে আরাধ্যের প্রতি ভক্তি হলপরম পুস্প।
স্থূল পূজা বা প্রতিকের পূজোতে ব্যবহৃত বিভিন্ন রং ও আকারের ফুল গুলি হল এই ভাব পুস্পের প্রতিক। একই ভাবে ব্যাবহৃত আসন,ধূপ, দীপ, চামর, নৈবেদ্য, ঘন্টা ইত্যাদি গুলো মানস পূজাতে ব্যাবহৃত বিভিন্ন তত্ত্বসমূহের প্রতিক।
Continue-46
[ কালী প্রতিমার তত্ত্ব ও তার আধ্যাত্ম ব্যাখা ]
(১) মা কালীর সূক্ষ্ম ও স্থূল স্বরূপ
মা কালী সূক্ষ্ম স্বরূপে মূর্তিহীন! অভীষ্টসিদ্ধি ও সূক্ষ্মধ্যান বোধের জন্যই মাতৃ সাধকরা এই কালী মূর্তির নির্মাণ করেছেন। এই প্রসঙ্গে মহানির্ব্বাণ তন্ত্রে সদাশিব মাতা পার্বতীকে বলছেন :-
মনসো ধারণার্থায় শীঘ্রং স্বাভীষ্টসিদ্ধয়ে।
সূক্ষ্মধ্যানপ্রবোধায় স্থূলধ্যানং বদামি তে।। ৫.১৩৯
অরূপায়াঃ কালিকায়াঃ কালমাতুর্মহাদ্যুতেঃ।
গুণক্রিয়ানুসারেণ ক্রিয়তে রূপকল্পনা।। ৫.১৪০
এক্ষণে মনের ধারণার জন্য সত্বর অভীষ্টসিদ্ধি এবং সূক্ষ্মধ্যানাববোধের জন্য তোমার নিকটে স্থূলধ্যানতত্ত্ব বলিতেছি। ৫.১৩৯
প্রকৃতপক্ষে মহাকালজননী মহাদ্যুতি কালিকার রূপ নাই, সত্ত্বাদিগুণত্রয়েয় প্রাদুর্ভাব বশতঃ সৃষ্ট্যাদিকার্য্যানুসারে ইদানীং তাঁহার রূপকল্পনা করা যাইতেছে। ৫.১৪০
অর্থ্যাৎ, আমরা যে কালী মূর্তি বা স্থূল স্বরূপ দেখে থাকি তা বাস্তবিক নয়!এই মূর্তিটি একটি প্রতিক, সেই সব তথ্য ও জ্ঞানের যা মা কালীর সূক্ষ্ম উপাসনা করতে আবশ্যক। উক্ত তথ্য ও জ্ঞান গুলিকেই একত্রে প্রতিমাতত্ত্ব বলা হয়।
(২) মা কালীর রূপভেদ
সূক্ষ্ম স্বরূপে মা কালীই হল পরমা প্রকৃতি। যেহেতু আদি প্রকৃতি থেকে সমস্থ জীব ও জড়ের উৎপত্তি হয়েছে, তাই তিনি জগৎমাতা। তার বিভিন্ন রূপভেদের জন্য তাকে বিভিন্ন নামে নামাঙ্কিত করা হয়েছে। এই প্রসঙ্গে মহানির্ব্বাণ তন্ত্রে সদাশিব মাতা পার্ব্বতীকে বলছেন :-
শৃণু দেবি মহাভাগে তবারাধনকারণম।
তব সাধনতো যেন ব্রহ্মসাষুজ্যমশ্নতে।।৪.৯
ত্বং পরা প্রকৃতিঃ সাক্ষাৎ ব্রহ্মণঃ পরমাত্মনঃ।
ত্বত্তো জাতং জগৎ সর্ব্বৎত্বং জগজ্জননী শিবে।। ৪.১০
মহদাদ্যণুপর্য্যন্তং বদেতৎ সচরাচরম।
ত্বয়ৈবোৎপাদিত ভদ্রে ত্বদধীনমিদং জগৎ।। ৪.১১
ত্বমাদ্যা সর্ব্ববিদ্যানামস্মাকমপি জন্মতুঃ।
ত্বং জানাসি জগৎ সর্ব্বং ন ত্বাং জানাতি কশ্চন।। ৪.১২
ত্বং কালী তারিণী দুর্গা ষোড়শী ভুবনেশ্বরী।
ধূমাবতী ত্বং বগলা ভৈরবী ছিন্নমস্তকা।। ৪.১৩
ত্বমন্নপূর্ণা বাগ্দেবী ত্বং দেবী কমলালয়া।
সর্ব্বশক্তিস্বরূপা ত্বং সর্ব্বদেবময়ী তনুঃ।। ৪.১৪
ত্বমেব সূক্ষ্মা ত্বং স্থূলা ব্যক্তাব্যক্তস্বরূপিণী।
নিরাকারাপি সাকারা কস্থাং বেদিতুমহতি।। ৪.১৫
উপাসকানাং কার্য্যার্থং শ্রেয়সে জগতামপি।
দানবানাং বিনাশায় ধৎসে নানাবিধাস্তনূঃ।। ৪.১৬
চতুর্ভূজা ত্বং দ্বিভূজা ষড়ভুজাষ্টভূজা তথা।
ত্বমেব বিশ্বরক্ষার্থং নানাশস্ত্রাস্ত্রধারিণী।। ৪.১৭
তত্তদ্রূপবিভেদেন মন্ত্রযন্ত্রাদিসাধনম।
কথিতং সর্ব্বতন্ত্রেষু ভাবাশ্চ কথিতাস্ত্রয়ঃ।। ৪.১৮
কালী কথা-০৭
সদাশিব কহিলেন, হে মহাভাগে দেবি! লোকে তোমার সাধনায় ব্রহ্মসাযুজ্য লাভ করিতে পারে, এজন্য আমি তোমারই উপাসনার কথা বলিতেছি, শ্রবণ কর। ৯
তুমিই পরমাত্মা পরব্রহ্মের সাক্ষাৎ পরমা প্রকৃতি। হে শিবে, তোমা হইতে জগতের উৎপত্তি হইয়াছে, তুমি জীবের জননী। ১০
হে ভদ্রে! মহত্তত্ব হইতে পরমাণু পর্য্যন্ত এবং সমস্ত চরাচর সহিত এই জগৎ তোমা হইতে উৎপাদিত হইয়াছে, এই নিখিল জগৎ একমাত্র তোমারই অধীনতায় আবদ্ধ। ১১
তুমি সমুদয় বিদ্যাব আদিভূত এবং আমাদের জন্মভূমি, তুমি সমগ্র জগৎকে অবগত আছ, কিন্তু তোমাকে কেহই জানিতে পারে না। ১২
তুমি কালী, দূর্গা, তারিণী, ষোড়শী, ভুবনেশ্বরী, ধূমাবতী, বগলা, ভৈরবী ও ছিন্নমস্তা ; তুমিই অন্নপূর্ণা, সরস্বতী ও লক্ষ্মী ; তোমার দেহ সর্ব্বদেবময় ও তুমি সর্ব্বশক্তি স্বরূপিণী। ১৩-১৪
তুমিই স্থূল, তুমিই সূক্ষ্ম, তুমিই ব্যক্ত এবং অব্যক্তস্বরূপিণী ; তুমি নিরাকার হইয়া সাকার, তোমার প্রকৃততত্ত্ব কেহই অবগত নহে। ১৫
তুমি উপাসকগণের কার্য্যার্থ, মঙ্গলার্থ এবং দানবগণের দমনার্থে নানাবিধ মূর্ত্তি ধারণ করিয়া থাক। ১৬
তুমি বিশ্বরক্ষার জন্য নানাবিধ অস্ত্রশস্ত্র ধারণপূর্ব্বক কখনও দ্বিভূজা, কখনও চতুর্ভূজা, কখনও ষড়ভূজা মূর্ত্তি ধারণ করিয়া থাক। ১৭
সকল তন্ত্রে তোমার নানাপ্রকার রূপভেদ, যন্ত্রভেদ ও মন্ত্রভেদ কথার উল্লেখ আছে এবং তোমার ত্রিবিধ ভাবময় উপাসনার কথাও প্রকটিত আছে। ১৮
(৩) কালী নামের তাৎপর্য
মায়ের নাম কালী, এর কারণ অর্থ্যাৎ সূক্ষ্ম ব্যাখ্যা কি রূপ? সেই প্রসঙ্গে মহানির্ব্বাণ তন্ত্রে সদাশিব বলছেন :-
কালসংগ্রসনাৎ কালী সর্ব্বেষামাদিরূপিণী।
কালত্বাদাদিভূতত্বাদাদ্যা কালীতি গীয়তে।। ৪.৩২
তুমি কালকে গ্রাস কর বলিয়া তোমার নাম কালী, সকলের আদিকালত্ব ও আদিভূতত্ব নিবন্ধন লোকে তোমাকে আদ্যাকালী বলিয়া থাকে। ৪.৩২
অতয়েব মায়ের কালী নামের তাৎপর্য হল - যিনি ভবিষ্যৎ বর্তমান অতীত এই তিন কাল কে গ্রাস করেন অর্থ্যাৎ ত্রি-কালের অন্তিম গন্তব্যস্থল হল মা কালী। সেই অর্থে মায়ের নামকরণ করা হয়েছে "কালী"।
(৪) মা কালী কেনো কালো?
মা কালীর প্রকৃত মূর্তির বর্ণ কালো। এই কৃষ্ণ বর্ণ হওয়ার তাৎপর্য কি? সেই প্রসঙ্গে মহানির্ব্বাণ তন্ত্রে সদাশিব বলছেন :-
শ্বেতপীতাদিকো বর্ণো যথা কৃষ্ণে বিলীয়তে।
প্রবিশক্তি তথা কাল্যাং সর্ব্বভূতানি শৈলজে।। ১৩.৫
অতস্তস্যাঃ কালশক্তের্নির্গুণায়া নিরাকৃতেঃ।
হিতায়াঃ প্রাপ্তযোগানাং বর্ণঃ কৃষ্ণো নিরূপিতঃ।। ১৩.৬
হে শৈলজে! শ্বেত, পীত, প্রভৃতি বর্ণ সকল যেরূপ একমাত্র কৃষ্ণবর্ণে বিলীন হয়, তাহার ন্যায় সমুদয় পদার্থ ই আদ্যাকালীতে বিলীন হইয়া থাকে। ৫
এই জন্য যাঁহারা যোগী, তাঁহারা সেই নির্গুণা, নিরাকার, বিশ্বহিতৈষিণী কালশক্তির কৃষ্ণবর্ণ কল্পিত করিয়াছেন। ৬
প্রতিটি বর্ণ কিছু নির্দিষ্ট গুণাবলী বহন করে। যেমন শ্বেত বর্ণ - পবিত্রতা, শুভ্রতা, পূর্ণতা, আশা, শুভ, শান্তির প্রভৃতির প্রতিক। পীত বর্ণ - জ্ঞান, প্রজ্ঞা, আলো, তাপ, ভালোবাসার প্রভৃতির প্রতিক। নীল - প্রশান্তি, শীতলতা, নিদ্রা, স্বপ্ন, মৃত্যু প্রভৃতির প্রতিক। এই ভাবে সমস্ত বর্ণ (গুণাবলী) মিলে কালো রঙ সৃষ্টি করে, তাই মা কালী হল সমস্ত গুণাবলীর সমাহার।এছাড়া যদি আমরা জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানের সাপেক্ষে দেখি তবে এটাই পাবো সৌর জগত ধ্বংশের পরে সেই ব্যাকহোল আদিতেই সৌর জগত মিশে যায়। সেই সাপেক্ষে মা কালীর বর্ণ কালো।
তবে মায়ের কিছু কিছু মূর্তিতে আকাশী নীল রং করা হয়। এটার দ্বারা ব্যাক্ত করা হয় মায়ের দেহটিই আকাশ দ্বারা গঠিত। আকাশ হল বাস্তবে নিরাকার ও বিমূর্ত, তাই মা সূক্ষ্ম স্বরূপে যে নিরাকার ও বিমূর্ত, তাই ব্যক্ত করার জন্য মায়ের মূর্তির রং আকাশী নীল রঙে রঞ্জিত করা হয়।
(৫) মায়ের কপালে অর্ধচন্দ্রকৃতির চন্দ্র কেনো?
যদি আমরা মায়ের মূর্তিটি ভালোভাবে দেখি তবে দেখতে পাবো তৃতীয় নয়নের নিচে একটি অর্ধচন্দ্র আছে। এর তাৎপর্য প্রসঙ্গে মহানির্ব্বাণ তন্ত্রে সদাশিব বলছেন :-
নিত্যায়াঃ কালরূপায়া অব্যয়ায়াঃ শিবাত্মনঃ।
অমৃতত্বাল্ললাটেহস্যাঃ শশিচিহ্নং নিরূপিতম।। ১৩.৭
কালী কথা-০৮
তিনি কালরূপিণী, নিত্যা, অব্যয়া, শিবাত্মিকা ও কল্যাণময়ী সুতরাং তিনি অমৃতস্বরূপ হেতু তদীয় ললাটে চন্দ্রকলা কল্পিত হইয়াছে।
(৬) মা কালীর কেনো তিনটি চোখ?
এই প্রসঙ্গে মহানির্ব্বাণ তন্ত্রে সদাশিব বলছেন :-
শশিসূর্য্যাগ্নিভির্নেত্রৈরখিলং কালিকং জগৎ।
সম্পশ্যতি যতস্তস্মাৎ কল্পিতং নয়নত্রয়ম।। ১৩.৮
তিনি চন্দ্র, সূর্য্য ও অগ্নিরূপ ত্রিনেত্র দ্বারা কালসম্ভূত এই জগৎ পর্য্যবেক্ষণ করিতেছেন। এই হেতু যোগিগণ তাঁহার ত্রিনয়ন কল্পনা করিয়াছেন। ৮
অর্থ্যাৎ আলোর তিনটি প্রাকৃতিক উৎসই হল মা কালীর প্রকৃত নয়ন। এই আলো দ্বারাই তিনি এই অন্ধকারময় জগৎকে পর্যবেক্ষণ করছেন। অর্থ্যাৎ বিজ্ঞান যাকে আলোশক্তি বলছে, তাই হল সনাতন ধর্মের দৃষ্টিকোণে দেবীর নয়ন।
(৭) মা কালীর পরিধান ও কাঠামোর তাৎপর্য
মহানির্ব্বাণ তন্ত্রে মাতৃকা ধ্যানে উল্লেখ করা বর্ণনা অনুসারে -
মেঘাঙ্গীং শশিশেখরাং ত্রিনয়নাং রক্তাম্বয়ং বিভ্রতীং,
পাণিভ্যামভয়ং বরঞ্চ বিলসদরক্তারবিন্দস্থিতাম।
নৃত্যন্তং পুরতো নিপীয় মধুরং মাধ্বীকমদ্যং মহাকালং
বীক্ষ্য বিকাসিতাননবরামাদ্যাং ভজে কালিকাম।। ৫.১৪১
যাহার বর্ণ মেঘতুল্য, ললাটে চন্দ্রলেখা জাজ্বল্যমান, যাহার তিন চক্ষু, পরিধান রক্তবস্ত্র, দুই হস্তে বর ও অভয়, যিনি ফুল্লারবিন্দে উপবিষ্ট, যাঁহার সম্মুখে মাধ্বীকপুষ্পজাত সুমধুর মদ্য পান করিয়া মহাকাল নৃত্য করিতেছেন, যিনি মহাকালের এরূপ অবস্থা দর্শনে হাস্য করিতেছেন, সেই আদ্যা কালিকাকে ভজন করি। ৫.১৪১
অতয়েব মায়ের ধ্যান করার সময় মাকে রক্তবস্ত্র পরিধানত রূপে, যিনি প্রস্ফুটিত কমলে অধ্যাসিত, দ্বিভূজা রূপে বিরাজমান এবং যিনি মহাকাল রূপী সময়ের লীলা দেখে প্রফুল্লিত হচ্ছেন, উক্ত মূর্তিতেই মায়ের ধ্যান করা বাঞ্ছনীয়।
অর্থ্যাৎ মা সুধু আমাদের স্থূল কামনা বাসনা পূর্ণ দৃষ্টিকোণেই বিবসনা! সূক্ষ্ম দৃষ্টিকোণে তিনি রক্তবস্ত্র পরিধানত মাতৃকা দেবী।উক্ত জিনিসটিকেই রামকৃষ্ণদেব তার কথামৃতে বলেছেন। তিনি সেখানে বলেছেন মা কে দূরে থেকে দেখছি বলেই মা বিবসনা, কাছে থেকে দেখলে মায়ের মতো তিনি বস্ত্র পরিধানত।
কিন্তু কালী মূর্তিই কি সত্যিই বিবসনা?
একদম নয়!!! না পুরাণে না হিন্দু তন্ত্র সমূহে মা কালী কে বিবসনা হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে। এইক্ষেত্রে মা কালী ব্যাঘ্রচর্ম পরিধানত অথবা অসুরের হস্ত, মস্তক ও রক্তবর্ণের পুস্প দ্বারা গঠিত পরিচ্ছদ আচ্ছাদিত ভয়ঙ্করী দেবী হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে। বৌদ্ধ তন্ত্রের আদব কাইদাতে রচিত আধুনিক তন্ত্র সমূহেই মা কালী কেবল বিবসনা, যা হিন্দু তন্ত্রের সাথে বিরোধীতা পূর্ণ।
কিন্তু এই ব্যাঘ্রচর্ম পরিধান অথবা অসুরের হস্ত, মস্তক দ্বারা গঠিত পরিচ্ছদে আচ্ছাদিত করে রাখার তাৎপর্য কি?
মহানির্ব্বাণ তন্ত্রে সদাশিব বলছেন :-
গ্রসনাৎ সর্ব্বসত্ত্বানাং কালদন্তেন চর্ব্বণাৎ।
তদ্রক্তসঙ্ঘো দেবেশ্যা বাসোরূপেণ ভাষিতম।। ১৩.৯
তিনি প্রলয়সময়ে সর্ব্বপ্রাণীকে গ্রাস ও কালদন্তে চর্ব্বণ করেন বলিয়া জীবের রুধিরসঙ্ঘাত সেই মহাকালীর রক্তবস্ত্ররূপে কল্পিত হইয়াছে। ১৩.৯
অর্থ্যাৎ ব্যাঘ্রচর্ম পরিধান অথবা অসুরের হস্ত, মস্তক দ্বারা গঠিত পরিচ্ছদে আচ্ছাদিত করা হল সেই রক্তবস্ত্রেরই একটি প্রতিক। ছেদিত হস্ত, মস্তক ও চর্ম গুলো এই ইঙ্গিত বহন করছে প্রলয়কালে সমস্ত জীবকূল জগতের ধ্বংশকারী দেবী দ্বারা আগ্রাসিত ও চর্বণিত হবে। অতয়েব মায়ের পরিধান বা পরিচ্ছদ উভয়ে মৃত্যুকে বর্ণনা করে।
মায়ের গলাই রক্ত জবার মালা ও গা ভর্তি সোনার গহনা থাকার তাৎপর্য কি?
মা রজোগুণজাত বিশ্বে অধিষ্ঠান করেন (পরের অংশে তথ্যসূত্র উল্লেখ আছে) বলেই রক্ত জবার মালা ও স্বর্ণ অলঙ্কারে সজ্জিত হয়েছেন। কারণ দুটিই রজঃ গুণের প্রতিক বহন করে।
মায়ের খোলা অগুচ্ছিত কেশরাশির তাৎপর্য?
মহানির্ব্বাণ তন্ত্রে সদাশিব বলছেন :-
পুনঃ স্বরূপমাসাদ্য তমোরূপং নিরাকৃতিঃ।
বাচাতীতং মনোহগম্যং ত্বমেকৈবাবশিষ্যসে।।৪.৩৩
তুমি প্রলয় সময়ে বাক্যের অতীত, মনের অগোচর, নিরাকারস্বরূপ তমোময় রূপ অবলম্বন করিয়া একমাত্র বিদ্যমান থাক। ৪.৩৩
মায়ের পায়ের হাঁটু অবদি থাকা খোলা অগুচ্ছিত কেশরাশি সেই প্রলয় কালে অতীতময়, মনের অগোচর, নির্দিষ্ট আকার বিহীন ও তমরূপে আচ্ছাদিত সেই জগৎ কে নির্দেশিত করে। যাকে অবলম্বন করে মা কালী অবস্থান করছে।
কালী কথা-০৯
(৮) মা কালীর চারটি হাতের তাৎপর্য ?
ধ্যানমূর্তিতে মা দ্বিভূজা, কিন্তু প্রতিমাতে চর্তুভূজা! কারণ প্রতিমাতে মায়ের চারটি হাত কালীতত্ত্বের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ অর্থকে তুলে ধরে। মহানির্ব্বাণ তন্ত্রে সদাশিব বলছেন :-
সাকারাপি নিরাকারা মায়য়া বহুরূপিণী।
ত্বং সর্ব্বাদিরনাদিস্ত্বং কর্ত্রী হর্ত্রী চ পালিকা।। ৪.৩৪
তুমি সাকারা হইয়াও নিরাকার, কিন্তু মায়ার আশ্রয় গ্রহণ করিয়া নানাবিধ রূপ ধারণ করিয়া থাক; তুমি সকলের আদি কিন্তু তোমার আদি কেহই নাই, তুমি রজোগুণ দ্বারা সৃষ্টিকর্ত্রী, সত্ত্বগুণে পালনকর্ত্রী এবং তমোগুণ দ্বারা সকলের নিধনকর্ত্রী। ৪.৩৪
সময়ে সময়ে জীবরক্ষণং বিপদঃ শিবে।
প্রেরণং স্বস্বকার্য্যেষু বরশ্চাভয়মীরিতম।। ১৩.১০
হে শিবে! তিনি বিপদ হইতে যথাযথ সময়ে জীবগণকে রক্ষা ও স্ব স্ব কার্য্যে প্রেরণ করেন বলিয়া তাঁহার হস্তে বর ও অভয় শোভা পাইয়া থাকে। ১৩.১০
মা বাম হাতের এক হাতে অভয় ও আরেক হাতে বর মুদ্রা ধারণ করেছে।এই অভয় মুদ্রার দ্বারা তিনি ভক্তদের প্রতি সুরক্ষা, মুক্তি ও শক্তি প্রদান করছেন এবং বর মুদ্রা দিয়ে তিনি দান, দয়া ও আর্শিবাদ প্রদান করছেন।যার দ্বারা তিনি সত্ত্বগুণে পালনকর্ত্রীর ধর্ম প্রদর্শন করছেন।
মাতৃস্তনের দ্বারা তিনি রজোগুণে একজন মায়ের বা সৃষ্টিকর্ত্রীর ধর্ম প্রদর্শন করছেন।
ডান হাতে রক্তমাখা খড়গ ও ছেদিত মস্তক ধারণ করে তিনি তমোগুণে সকলের নিধনকর্ত্রীর ধর্ম প্রদর্শন করছেন।
আরেকটি অর্থে যেহেতু ছেদিত মস্তুকটি একটি অসুরের, তাই মা কালী অজ্ঞান কে ছেদিত করে জ্ঞানের প্রতিষ্ঠা করছেন। এই সাপেক্ষে মা কালীকে অজ্ঞান নাশীনি বলা হয়।
(৯) মা কালীর পায়ের নিচে শিব কেনো ?
উক্ত বিষয়টি মূলত পুরাণজাত! তবে তন্ত্রসার সহ কয়েকটি আধুনিক তন্ত্রে মা কালীকে শবারূঢ়া হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে। মহানির্ব্বাণ তন্ত্র অনুসারে :-
রজোজনিতবিশ্বানি বিষ্টভ্য পরিতিষ্ঠতি।
অতো হি কথিতং ভদ্রে রক্তপদ্মাসনস্থিতা।। ১৩.১১
হে ভদ্রে! তিনি রজোগুণজাত বিশ্বে অধিষ্ঠান করেন বলিয়া তাঁহার রক্তপদ্মে অধিষ্ঠান কথিত হইয়া থাকে। ১৩.১১
ক্রীড়ন্তং কালিকং কালং পীত্বা মোহময়ীং সুরাম।
পশ্যন্তী চিন্ময়ী দেবী সর্ব্বসাক্ষিস্বরূপিণী।। ১৩.১২
সৃষ্টিকালসম্ভূত মহাকাল মোহময়ী সুরাপান করিয়া ক্রীড়া করিতেছেন, অর্থ্যাৎ কালের প্রভাবে শূন্যস্থানে নুতন জগৎ প্রতিষ্ঠিত হইতেছে, কোথাও জীবসঙ্কুল জগৎ শূন্য হইয়া যাইতেছে, কোথাও ঘোর তিমিরাবৃত স্থান আলোকিত হইতেছে, কোথাও আলোকিত স্থান তিমিরাবৃত হইয়া পড়িতেছে। প্রত্যেক জগৎ প্রতি নক্ষত্র যথাযথ মার্গে প্রভাবিত হইয়া পড়িতেছে, চিন্ময়ী সর্ব্বসাক্ষিস্বরূপিণী দেবী ইহা দর্শন করিয়া থাকেন। ১৩.১২
পুরাণজাত তথ্য অনুসারে একবার মা কালী ক্রোধোন্মত্ত হয়ে সৃষ্টির বিনাসে নিয়োজিত হন, তখন মহাদেব মা কালীকে শান্ত করার উদ্দেশ্যে শব রূপে শায়িত হন মায়ের চরণে। পরমা প্রকৃতির ক্রোধ স্বরূপী মহাকালী নিজ চরণের তলে পরম পুরুষ মহাদেবকে দেখতে পেয়ে ত্রপান্বিত হয়ে নিজ জিহ্বা অবারিত করেন এবং ক্রোধ স্বরূপ থেকে বেরিয়ে আসেন।
মহানির্ব্বাণ তন্ত্রে ১৩.৯ তে উল্লেখ আছে :-
"তিনি প্রলয়সময়ে সর্ব্বপ্রাণীকে গ্রাস ও কালদন্তে চর্ব্বণ করেন বলিয়া জীবের রুধিরসঙ্ঘাত সেই মহাকালীর রক্তবস্ত্ররূপে কল্পিত হইয়াছে"
প্রলয় কালে যেহেতু মা কালী সর্ব্বপ্রাণীকে গ্রাস ও কালদন্তে চর্ব্বণ করেন,তাই তার জিভের বর্ণ রক্তিম লাল। মা কালী দন্ত দ্বারা জিহ্বাকে আটকে মুখকে উন্মুক্ত হওয়া থেকে রোধ করেছেন, যা জগতের স্থিতি মুদ্রা কে বর্ণিত করে। যার জন্য পৌরাণিক ঘটনাতে মা কালী যখন উক্ত মুদ্রাটি ধারণ করেন তখন জগতের প্রলয় বন্ধ হয় এবং মা তার ক্রোধ স্বরূপ থেকে বেড়িয়ে আসেন।
মায়ের চরণের নিচে অবস্থানকারী শবরূপী শিব হল বিশ্ব জগতের প্রতিক(শিব পুরাণ ২.৪৯.২১), কারণ শিব শব্দটি শী ধাতু থেকে উৎপত্তি লাভ করেছে যার অর্থ "শায়িত" অর্থ্যাৎ যিনি বিশ্বব্যাপী শায়িত আছেন।মহানির্ব্বাণ তন্ত্রে উল্লেখিত মায়ের আসন রূপী রক্তপদ্মটি সেই শায়িত শিবেরই একটি প্রতিক। শিব স্বরূপী এই নিখিল জগতের যেখানে যেখানে মা কালীর চরণ পড়ছে সেখানে সেখানে জগৎ (Clime) ঘন তিমিরাবৃত হয়ে ধ্বংশ হচ্ছে।
কালী কথা-১০
মহানির্বাণতন্ত্রে কালীর প্রচলিত রুপের একটি চমৎকার ব্যাখ্যা রয়েছে । পার্বতীর একটি প্রশ্নের শিব এইভাবে জবাব দিচ্ছে : হে প্রিয় ! পূর্বেই বলা হয়েছে যে , সাধকদের কাজের জন্য গুণক্রিয়া আনুসারে দেবীর রূপ কল্পিত হয় । শ্বেত , পীত ইত্যাদি বর্ণ যেমন কৃষ্ণবর্নে বিলীন হয় , সর্বভূতসমূহও তেমনই কালীতে প্রবেশ করে । যােগীদের হিতের জন্য সেই নির্গুনা নিরাকারা কালশক্তির বর্ণ কৃষ্ণ হয়েছে । অমৃতত্ত্ব হেতুই এই নিত্য কালরূপা অব্যয়া কালরূপিণীর ললাটে চন্দ্রচিহ্ন নিরূপিত হয়েছে । নিত্যকালীন চন্দ্র সূর্য অগ্নি দ্বারা তিনি এই কালকৃত জগৎ নৰ্শন করেন বলে তাঁর তিনটি নয়ন কলিত হয়েছে । সর্বপ্রাণীকে গ্রাস করেন বলে এবং কালদণ্ডের দ্বারা চর্বণ করেন বলে তাদের রক্তসমূহ এই দেবীর বসনের রূপ নিয়েছে । বিপদে - আপদে জীবকে রক্ষা করে নিজ নিজ কার্যে প্রেরণা দেন বলে তাঁর হাতে বর ও অভয় প্রদান করা হয়েছে । রজোগুণজনিত বিশ্বসমূহকে ব্যাপ্ত করে অবস্থান করেন , সেইজন্য তিনি রক্ত পদ্মাসনস্থিতা বলে কথিত হন। এই ভাবে ভক্তদের গুন অনুসারে দেবীর বিভিন্ন রুপ কল্পিত হয়ে থাকে।
হিন্দু পূজারহস্যের তাত্ত্বিক ও যৌগিক ব্যাখ্যা ' গ্রন্থে স্বামী হরিহরানন্দ গিরি কালীর ব্যাখ্যা এইভাবে করেছেন : কালী শব্দের ব্যুৎপত্তি হচ্ছে কাল + ঈ = কালী । কালের সঙ্গে ঈ শক্তি যুক্ত হয়ে কালী হয়েছেন । ঈ হচ্ছে ঈশ্বরী , সগুনব্রক্ষ্ম। কালী হচ্ছেন কালকে উপলব্ধি করার প্রাণশক্তি ।
তিনি মহাশক্তির রূপের বর্ণনা দিয়েছেন এইভাবে : কালী যে উলঙ্গ তার তাৎপর্য আছে । মহাকালী আমাদের পঞ্চ ইন্দ্রিয়ে কলন করছে । তাই কালী শক্তিরূপে প্রকাশিত । আমরা যদি কান ঢেকে রাখি তবে শ্রবণশক্তি থাকবে না । যদি চোখ বুজে থাকি তবে দর্শনশক্তি থাকবে না । যদি মুখ বন্ধ করে থাকি তবে ভােজনশক্তি বাকশক্তিরহিত হয়ে থাকব । শরীরের অন্য'না শক্তি সম্পর্কেও একই কথা । তাই দর্শনশক্তি , ঘ্রাণশক্তি , শ্রবণশক্তি , শক্তি , প্রাণশক্তি , কামশক্তি — সবই অনাবৃত রাখতে হবে । ' আবরণ ' প্রকাশকে রুদ্ধ করে । সেই জন্য মহাকালীর মূর্তিকে বিবসনা করে কল্পনা করা হয়েছে । যিনি আব্রক্ষ্ম পরিব্যাপ্ত , তাঁকে আবৃত করা সম্ভব নয় । এইজন্যই তিনি দিগবসনা , দিগম্বরা ।
সাধারণ লােকের ধারণা — কালী তাঁর স্বামীর বুকে পা পড়েছে বলেই লজ্জায় জিব কেটেছে । কিন্তু আসল তাৎপর্য তা নয় । কালী আদ্যাশক্তি । আদ্যাশক্তি অর্থ অদনময়ী । অদন মানে ভােগ । আমরা যা কিছু ভােগ করছি , তা শুধু পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের দ্বারাই করছি না , করছি সর্বাঙ্গ দিয়ে । তবু ভোগের বা আস্বাদনের প্রধান মাধ্যম হল জিব । আদ্যাশক্তির লোলুপ জিহবা সর্বদা প্রসারিত হয়ে আছে । প্রতি জীবে জীবীভূতা কালীর লােলুপতা প্রসারিত ।
মহাকালীর কন্ঠে পঞ্চাশটি মুণ্ড দেখি তা পঞ্চাশটি মাতৃকা বা জীবন্ত কালী । অ থেকে ক্ষ পর্যন্ত পঞ্চাশটি অক্ষর বা বর্নরুপে প্রকাশিত । এই অক্ষরগুলো জীবশরীরের কন্ঠদেশে ঈশ্বররুপে বিরাজ করে বর্ন, শব্দ ও বাক্য আকারে প্রতিটি মানুষের কন্ঠ থেকে বেরিয়ে চর্বিত হয়ে মাতৃকারূপে প্রকাশিত হয়েছে । নির্গুন স্বরূপ মা , সেজন্য জীবের মধ্যে ভীবীভূতা হয়ে বাঙময়ীরুপে স্বগুনা স্বরুপা সেজেছেন।
কালীমূর্তির অধরােষ্ঠ যে রক্তধারা দেখা যায় , তাকে আমাদের মুখ থেকে নিঃসৃত রসাল গল্পগুচ্ছ বলা যেতে পারে । কালী ভেতর থেকে কলকল রূপে কলন করছেন । ফলে এই বর্ণগুলাে জিবে দাঁতে পিষ্ট হয়ে বাক্য ও গল্পের আকারে প্রকাশ পাচ্ছে । আমরা সাধারণ মানুষ সেই কথায় ও গল্পে আমােদিত হয়ে আছি , সেই রস আস্বাদন করছি ।
মহাশক্তির দুটি বাম হস্তে রয়েছে মুণ্ড ও খড়গ । প্রতি জীবে জীবীভূতা হয়ে আছেন মহাকালী । অন্যায় কাজের সামনে প্রতিটি মানুষ যদি বিবেকী শক্তির দ্বারা নিজের মুণ্ড নিজের হাতে চেপে ধরে রাখতে না পারে , তবে তার দ্রুত উত্থান সম্ভব নয় । সে ব্যবহারিক জগতে চলতে গিয়ে অনেক ভুল করবে। আর ভুল করলে অবশ্যই শাস্তি পেতে হবে। খড়গ শাসনের প্রতীক। আবার জীবরূপী কালী যদি সব সময় তার সামনে এই বিবেকরুপ অস্ত্র দেখে , তবে নিশ্চয়ই সে ভুল করবে না । অন্তর্নিবাসী মহাকালের কাছ থেকে বর ও অভয় পাবে । কালীমূর্তির দুটি দক্ষিণ হস্তে তাই বর ও অভয় মুদ্রা দেওয়া হয়েছে ।
কালীর মূর্তি যে সম্পূর্ণ রূপক , তাতে সন্দেহ নেই । আমরা দেখতে পাই যে , মহাকাল শিবের বুকের ওপর পা দিয়ে মহাকালী দাড়িয়ে আছেন । যিনি মহাকাল , বিশ্বের সর্বত্র পরিব্যাপ্ত , তার ওপর দিয়ে আমরা চলেছি । অথচ এই জ্ঞান আমাদের নেই । আমরা সবাই নির্গুন ব্রক্ষ্ম হলেও জীবীভূতা মহাকালী হয়ে শিবের বুকের ওপর দাঁড়িয়ে আছি । শির কালীর যে মূর্তাি কল্পনা করা হয়েছে , তা শুধু এই ভাবেরই প্রতিমূর্তি । মহাকাল ও মহাকালী আসলে দেহতত্ত্ব । শুধু মানুষের দেহের মধ্যে নয় , বিশ্বের অণু - পরমাণুতে , সমস্ত জীব শরীরে যেখানে যেখানে দৃষ্টি পড়ে সেখানকার সব সত্তায় এই শিবশক্তি প্রকৃতি - পুরুষরুপে মূর্তি ধারণ করেছে । এই ভাবরুপকে মহাকাল ও মহাকালীর মধ্যে অভিব্যক্ত করা হয়েছে।
কালী কথা-১১
মায়ের মূর্ত্তিতত্ত্ব অতীব নিগূঢ় রহস্যবস্তু। আজ থেকে প্রায় সাড়ে পাঁচশো বছর আগে নবদ্বীপের বিশিষ্ট তন্ত্রসাধক কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ এই কালীমূর্তির প্রচলন করেছিলেন। মহাকাল সংহিতা অনুসারে আদ্যাকালী দক্ষিণাকালী। দক্ষিণদিকে যমের অবস্থান, কালী নামে ভীত হয়ে সে ছুটে পালায়, এজন্যেই ত্রিজগতে কালিকাদেবী ‘দক্ষিনা’ নামে পরিচিতা।
এ সম্পর্কে তন্ত্রতত্ত্বের আলোচনা গভীর তাৎপর্য পূর্ণ। শিবচন্দ্র লিখেছেন —“পুরুষের নাম দক্ষিন (দক্ষিনাঙ্গ স্বরূপ বলে) এবং শক্তির নাম বামা (বামাঙ্গ স্বরূপ বলে)। যতদিন এই বাম আর দক্ষিন, স্ত্রী ও পুরুষ সমবলে অবস্থিত, ততদিন সংসার বন্ধন। সাধনার প্রখর প্রভাবে বামাশক্তি জাগরিতা হলে তিনি দক্ষিনশক্তি পুরুষকে জয় করে তদুপরি স্বয়ং দক্ষিণানন্দে নিমগ্না হয়েন অর্থাৎ কি বাম, কি দক্ষিন উভয় অংশই যখন তাঁর প্রভাবে পূর্ণ হয়ে যায়, তখন সেই কেবলানন্দরূপিণী জীবের মহামোক্ষ প্রদান করেন। তাই ত্রৈলোক্য মোক্ষদা মায়ের নাম দক্ষিনাকালী।”
আবার, স্বয়ং শিব বলেছেন –“যজ্ঞাদি কর্মের শেষে দক্ষিনা যেমন যজ্ঞাদিকে সফল করে তেমনি হে দেবী! কালিকা সকলকে বাঞ্ছিত ফল এবং মুক্তি দেন বলে সেই বরবর্ণিনীকে দক্ষিণাকালী বলা হয়।”
কৃষ্ণবর্ণা — দক্ষিনাকালী কৃষ্ণা। ধ্যানে তাঁকে মহামেঘপ্রভাং শ্যামা এবং অঞ্জনাদ্রিনিভা বলা হয়েছে।
কামাক্ষ্যাতন্ত্রে আছে –কালী সদা কৃষ্ণবর্ণা এটি আগমের নির্ণয় —
কৃষ্ণাবর্ণা সদা কালী আগমস্যেতি নির্ণয়ঃ।
–কামাক্ষ্যা তন্ত্র,পঃ ৯
কালীর বর্ণ কৃষ্ণ কেন সে সম্বন্ধে মহানির্বাণতন্ত্রে বলা হয়েছে–শ্বেত পীতাদি বর্ণ যেমন কৃষ্ণ বর্ণে বিলীন হয়ে যায় তেমনি সর্বভূত কালীর মধ্যে প্রবেশ করে অর্থাৎ বিলীন হয়। এইজন্য যাঁরা মোক্ষের উপায় ব্রহ্মজ্ঞান লাভ করেছেন তাঁরা নির্গুণা নিরাকারা কল্যাণময়ী কালশক্তির কৃষ্ণাবর্ণ নিরূপণ করেছেন –
স্বেতপীতাদিকো বর্ণে যথা কৃষ্ণে বিলীয়তে।
প্রবিশন্তি তথা কাল্যাং সর্বভূতানি শৈলজে।।
অতস্তস্যাঃ কালশক্তের্নিগুণায়া নিরাকৃতেঃ।
হিতায়াঃ প্রাপ্তযোগানাং বর্ণঃ কৃষ্ণো নিরূপিতঃ।।
–মহানির্বাণতন্ত্র ১৩/৫-৬
“পরাশক্তি অরূপা সুতরাং বর্ণহীন। যেখানে সর্ববর্ণের অভাব তাহাই নিবিড় কৃষ্ণাবর্ণ, একথা বিজ্ঞানসম্মত। বিজ্ঞান আরও বলে যে-জ্যোতিঃ আমাদের চক্ষু ধারনা করিতে পারে না, তাহাই নিবিড় কৃষ্ণবর্ণ দেখায়। তাই মহাজ্যোতিঃ কালী কৃষ্ণাবর্ণা। কিন্তু জ্ঞাননেত্রে মহাজ্যোতিঃ রূপে দৃশ্য হন।”
কর্পূরাদিস্তোত্রের প্রথম শ্লোকে কালীকা দেবীকে বলা হয়েছে ধ্বান্তধারাধররুচিরুচিরা অর্থাৎ নীলমেঘের মতো মনোজ্ঞা। এর ব্যাখ্যায় বিমলানন্দস্বামী লিখেছেন দেবী শুদ্ধসত্ত্ব গুনাত্মক ঘনীভূত তেজোময়ী এবং চিদাকাশ। এইজন্য তাঁর নীলবর্ণ চিন্তা করতে হয় —
“ধ্বান্তধারারুচিরুচিরে শুদ্ধসত্ত্বগুনাত্মক ঘনীভূততেজোময়ত্বাৎ তথা চিদাকাশত্বাচ্চ নীলবর্ণচিন্তনীয়ে।”
--কর্পূরাদিস্তোত্র ১ম শ্লোকের স্বরূপ ব্যাখ্যা এখানে নীলবর্ণ অর্থ কৃষ্ণবর্ণ। কেন না স্বামীজী আপন ব্যাখ্যার সমর্থনে যোগবাশিষ্ট থেকে যে-বচন উদ্ধার করেছেন তাতে আছে--
শিবর্যোব্যোমরূপত্বাদসিতং লক্ষ্যতে বপুঃ। (উক্ত স্বরূপ ব্যাখ্যা, পাদটীকা)
শিব ও শিবার ব্যোমরূপ বলে তাঁদের বপু অসিত অর্থাৎ কৃষ্ণ।
ঋগবেদে আছে অগ্রে অর্থাৎ সৃষ্টির পূর্বে ছিল তমঃ।সেই তমসায় সমস্তই আচ্ছন্ন ছিল —
তমঃ আসীত্তমসা গূঢ়মগ্রে।
–ঋকবেদ ১০/১২৯/৩
মৈত্রায়ণী-উপনিষদেও বলা হয়েছে সৃষ্টির পূর্বে একমাত্র তমঃ ছিল —
তমো বা ইদমেকমাস। -মৈ-উপঃ, ৪র্থ প্রপাঠক।
এই আদি তমঃই কালী। মহানির্বাণতন্ত্রে সদাশিব দেবীকে বলেছেন –সৃষ্টির পূর্বে বাক্য ও মনের অতীত তমোরূপে তুমি একা বিরাজমানা ছিলে। আবার বলেছেন –প্রলয়ের পর তুমি আবার তোমার নিরাকার, বাক্যের অতীত ও মনের অগম্য তমোরূপ স্বরূপ প্রাপ্ত হও এবং তখন অদ্বিতীয়া তুমিই অবশিষ্ট থাক–
সৃষ্টেরাদৌ ত্বমেকাসীৎ তমোরূপমগোচরম।
পুনঃ স্বরূপনাসাদ্য তমোরূপং নিরাকৃতিঃ।।
বাচাতীতং মনোহগম্যং ত্বমেকৈবাবশিষ্যসে।
—মহানির্বাণতন্ত্র
কালী দিগম্বরী বা দিগবস্ত্রা। বস্ত্র আবরণ। সব চেয়ে সূক্ষ্ম আবরণ মায়া। কালী পূর্ণব্রহ্মময়ী বলে মায়াতীতা। তাই তিনি আবরণশূন্যা দিগম্বরী।
এই প্রসঙ্গে একটা কথা বলার আছে, অনেক অতত্ত্বজ্ঞ ব্যক্তি কালীমূর্ত্তি দিগম্বরী বলে নাসিকা কুঞ্চিত করেন। তাঁরা জানেন কিনা জানিনে, মেডোনার অনেক নগ্নচিত্র অঙ্কিত হয়েছে। পোপের আপন গীর্জা সিসটাইন চ্যাপেল – মাইকেল এঞ্জেলো অঙ্কিত লাস্ট জাজমেন্ট নামক প্রখ্যাত ছবি আছে। তাতে যীশুখৃষ্টের নগ্নমূর্তি অঙ্কিত হয়েছে। এ ছাড়া ক্রুশবিদ্ধ যীশুখৃষ্টের লক্ষ লক্ষ নগ্নমূর্তি সারা খৃষ্টান জগতের শ্রদ্ধাভক্তি লাভ করেছে। মূর্তি নগ্ন হলেই নাসিকা কুঞ্চিত করার কোন কারন ঘটে না।
মুক্তকেশীঃ- কালী মায়াতীতা কিন্তু অনন্ত জীবকোটিকে মায়াপাশে বদ্ধ করেন। তার মুক্তকেশ জাল মায়াপাশের প্রতীক। আবার কালী ব্রহ্মা, বিষ্ণু এবং শিবেরও মুক্তিবিধান করেন বলে তিনি মুক্তকেশী। ক-অ-ঈশ= কেশ। ক ব্রহ্মা, অ বিষ্ণু এবং ঈশ শিব। কাজেই কেশ বলতে বুঝায় ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও শিব। কেশকে মুক্ত করেন বলে দেবী মুক্তকেশী।
কালী যে ব্রহ্মা, বিষ্ণু এবং শিবকেও ভুক্তিমুক্তি প্রদান করেন নিরুত্তরতন্ত্রে তা স্পষ্ট করেই বলা হয়েছে। বলা হয়েছে –অনিরুদ্ধসরস্বতী কালী মহাকল্পতরু। তিনি ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও শিবেরও ভুক্তিমুক্তির কারণ–
মহাকল্পতরুঃ কালী অনিরুদ্ধসরস্বতী।
ব্রহ্মবিষ্ণুমহেশানাং ভুক্তিমুক্তোককারনম।।
—–নিরুত্তর তন্ত্র পঃ ২
কালী কথা-১২
আবার মুক্তকেশীর অন্যরকম ব্যাখ্যাও আছে –কেশবিন্যাসাদি বিলাস-বিকার। দেবী নির্বিকার। এইজন্যই তিনি বিগলিতচিকুরা বা মুক্তকেশী।
কোথাও কোথাও বর্ননা আছে কালীর ললাটে অর্ধচন্দ্র শোভা পাচ্ছে। এ সম্বন্ধে মহানির্বাণতন্ত্রে বলা হয়েছে নিত্যা কালরুপা অব্যয়া শিবস্বরূপা কালীর ললাটে অমৃতত্বহেতু চন্দ্রকলা অঙ্কিত —
নিত্যায়াঃ কালরূপায়া অব্যয়ায়াঃ শিবাত্মনঃ।
অমৃতত্বাল্ললাটেহস্যাঃ শশিচিহ্নং নিরূপিতম।।
——মহানির্বাণতন্ত্র ১৩/৭
চন্দ্রের থেকে অমৃত ক্ষরিত হয়। দেবীর ললাটে আছে চন্দ্রের সপ্তদশী কলা -অমাকলা। দেবী অমৃতত্ব অর্থাৎ নির্বাণমোক্ষ প্রদান করেন বলে তাঁর ললাটে অর্ধচন্দ্র বা চন্দ্রকলা।
ত্রিনয়না—– অতীত, বর্ত্তমান ও ভবিষ্যৎ সমস্তই সেই ত্রিগুণময়ী ত্রিকালদর্শিনী মায়ের নয়নপথে সর্বক্ষণ প্রতিভাত রয়েছে। ধ্যানান্তরে দেখতে পাওয়া যায় –‘বহ্ন্যর্কশশিনেত্রাঞ্চ রক্ত বিস্ফুরিতাননাং ‘মায়ের নয়নত্রয়ে বিশ্বের বহ্নি, সূর্য্য ও চন্দ্ররূপী তিনটি নয়ন সর্বক্ষণ উদ্ভাসিত রয়েছে। তা যথাক্রমে বিশ্বের তেজঃ বা দীপ্তিতে –প্রথম, জ্যোতিঃ বা প্রকাশে — দ্বিতীয় এবং শান্তি বা রূপে –তৃতীয় ভাব বিকাশ করছে। রক্তই জীবের শক্তিস্বরূপ, তাই তাঁর নয়নত্রয় শক্তি-সহযোগে রক্তবিস্ফুরিত হয়ে উদ্দীপ্ত রয়েছে।
সাধারণতঃ জীবের দুইটি নয়ন দেখতে পাওয়া যায়, কিন্তু তাতে কোনও বস্তুর দ্বিত্ব কখনই প্রতীত হয় না, দুই চক্ষে দেখলেও প্রত্যেক বস্তু সর্বদা একটিই দেখা যায়। ব্রহ্মের সৎ ও চিৎ অভিন্ন বস্তু হলেও, সাধকের বুঝবার সময় তা দুইটি ভিন্ন ভাবেই দেখতে বা বুঝতে হয়। কিন্তু বিশ্বের সর্বত্রই সৎ চিৎ অংশ একাধারে বিদ্যমান আছে। যে কোন একটি জঙ্গমরূপ–জীব বা একটি স্থাবর রূপ বৃক্ষই দেখ, তার বহিরাবরণ বা স্থুলরূপ সৎ-শক্তি-প্রধান, তা জড়েরই অনুরূপ, কিন্ত তার অন্তরে চিৎ-প্রধান যে অব্যক্ত প্রকাশশক্তি বিদ্যমান আছে, যার দ্বারা তার পুষ্টি ও বৃদ্ধিরূপে ক্রমান্বয়ে পত্র, পল্লব, পুষ্প ও ফলাদি প্রস্ফুটিত হচ্ছে, যার বলে তাকে চৈতন্যযুক্ত বুঝতে পারা যাচ্ছে এবং যার অভাবে সে যেন সময়ে মরেও যায়, সেই চৈতন্যসত্তার স্বত্নন্ত্র অস্তিত্ব কেউ তার জড়াঙ্গে পৃথকভাবে দেখতে পায় না বা তা দেখতে চেষ্টাও করে না।
‘জ্ঞান-প্রদীপে’ ‘রাজযোগের’ উপদেশ, ‘ব্রহ্ম-ধ্যান’-উপলক্ষে তাঁর (১) বিরাট (২) ঈশ্বর ও (৩) র্নিগুণ-ব্রহ্ম ধ্যানের বিষয় যা উক্ত হয়েছে তা অবশ্য সাধারণ সাধকের এক্ষনে ধারণাতীত। তবে সাধারণত বা তদনুগত জ্ঞানের ত্রিবিধ প্রাথমিক দৃষ্টি-পথেও স্থুল-দেহাভিমানী আত্মা (১) বিশ্ব, সূক্ষ্ম-দেহাভিমানী আত্মা (২) তৈজস এবং কারন-দেহাভিমানী আত্মা (৩) প্রাজ্ঞ এই ত্রিবিধ আত্মার পরিদর্শন-কল্পে যে নয়নের প্রয়োজন হয়, তাই সাধকের উপনয়ন, তৃতীয়-নয়ম বা জ্ঞানচক্ষু।
জীবের জ্ঞানাধার মস্তিষ্ক, তার সম্মুখাংশ, বুদ্ধি-বিচারের ক্ষেত্ররূপ–বিজ্ঞানময়-যন্ত্র। তারই মধ্যে অর্থাৎ ভ্রূ-দ্বয়ের পিছনে আজ্ঞাচক্রের ঠিক সম্মুখস্থিত কুটস্থ-বিন্দুই বিরাজিত রয়েছে। সেই বিন্দু-স্থলই উচ্চ সাধকের দিব্য-দৃষ্টির আধার উপনয়ন বা তৃতীয়-নয়ন।
দ্বিদল-বিশিষ্ট আজ্ঞা-চক্রস্থিত বাম দিকের চন্দ্রাধারদলের চন্দ্রাত্মক হং-বীজ থেকেই দেবীর বাম-নয়ন এবং সেই আজ্ঞাচক্রের দক্ষিন দিকস্থিত সূর্য্যাধার-দলের সূর্য্যাত্মক ক্ষং বীজ থেকেই দেবীর দক্ষিন-নয়ন এবং আজ্ঞাচক্র-কমলের কর্ণিকারূপ অগ্ন্যাধার-স্থিত অগ্ন্যাত্মক তৃতীয় লং বীজ থেকেই উক্ত তেজঃ, বা জ্ঞানাগ্নি-দিপ্ত দেবীর ‘তৃতীয়-নয়ন’ যথাক্রমে চন্দ্র,সূর্য্য ও অগ্নিরূপে তাঁর অব্যক্ত নয়নত্রয় উদ্ভাসিত হয়ে আছে।
“কালীকরাল-বদনা”— ‘কালী’ এই শব্দ উচ্চারণ করলে ‘কালই’ বা ‘কাল-ঈ’ বুজায়। অনাদি ও অনন্ত মহাকাল–ঈ অর্থাৎ ভূত,ভবিষ্যৎ ও বর্তমান-রূপী মহাকাল–ঈ = কালী বা মহাকালী অথবা দক্ষিনা আদি অষ্ট কালীরূপে সাধকের ধ্যেয়।
কালের কোলে সকলকেই লয় হতে হয়। ‘মহাকাল’ সৃষ্টি থেকে চিরকাল ধরে সমস্তই ‘কলন’ অর্থাৎ গ্রাস বা কালগ্রস্ত করছেন, সেই কারণে তিনি জগৎ-সংহারক ‘মহাকাল’ নামে কীর্ত্তিত। মহাপ্রলয় কালে সেই মহাকালকেও যিনি গ্রাস করেন বা নিজ অঙ্গে লয় করে নেন, তিনিই ‘করাল-বদনা কালী’।
বিশ্বের সেই শেষ দিনের মধ্যে বা সেই অন্তিম লয়-লীলার মধ্যেও যিনি কালকে সতত ‘ঈ’ অর্থাৎ ‘ঈক্ষণ’ অথবা দর্শন করছেন, তিনি কাল -ঈ = কালী।
কালী কথা-১৩
মহাকালের অন্তর্গত খন্ডকালের মধ্যে সংসারের নিত্য সৃষ্টি, স্থিতি ও লয় কার্য্য যা অহরহঃ অবিরত ভাবে পরিচালিত হচ্ছে, তাও যিনি ‘ঈ’ বা ঈক্ষণ করছেন বা সেই অনাদি কাল থেকেই কাল-সংহারিণী কালীর করালবদনের মধ্যে নিত্য কত কি যে নিক্ষিপ্ত হচ্ছে, সে সবও যিনি সতত ‘ঈ’ বা ঈক্ষণ অথবা দর্শন করছেন, তিনিই ‘কালী’।
জগতের নিত্য সৃষ্টি ও পুষ্টির ন্যায় সংহার কার্য্যও তাঁতে সম্পন্ন হচ্ছে, তাঁর করাল-বদনে তাই সতত প্রকটিত হচ্ছে।
সংসারের জীবসমুহের মুখই স্থুল ভাবে তাঁর করাল-বদনের মহিমা সর্বদা প্রকাশ করছে। উদ্ভিজ্জ, স্বেদজ, অণ্ডজ, ও জরায়ুজ রূপে একে অন্যের ভক্ষক হয়ে সংসারে সর্বদা তাঁর লয়-লীলা অক্ষুণ্ণ রেখেছে। আমরাও আজন্ম কত কি যে, আমাদের এই ক্ষুদ্রায়তন মুখমণ্ডল দিয়েই গ্রাস করছি, আমাদের দেহ-পরিমাণের তুলনায় তাঁর সমষ্টি যে কতগুণ, একবার ভেবে দেখলে তা বোঝা যায়।
‘করাল-বদন’ আবার তাঁর কঠোরতারও নিদর্শন। অসুরনাশিনী মায়ের মুখমন্ডলে সেই আদি দেবাসুরের যুদ্ধের স্বরূপ ঘোর সময়নিষ্ঠুরতাও প্রতিভাত হয়েছে।
পক্ষানন্তরে তিনি যে, তাঁর প্রিয়তম সাধক-সন্তানের অন্তরের অতি হেয় ও ভীষণ কামাদি রিপুরূপ আসুরীপ্রবৃত্তি বা আসুরী-সম্পদময় অসুর সমুহের সঙ্গে সর্তত সমর-রতা! কোন অতীত যুগে মা, দানব-দলনের জন্য আবির্ভূতা হয়েছিলেন,আজও সেই অসুরনাশিনী মায়ের মূর্ত্তি ভক্তের হৃদয়ে দেদীপ্যমানা।
তাঁর ধ্যান করতে গিয়ে একাগ্রচিত্ত হলেই, সাধক অন্তরের মধ্যে এক ভীষণ কোলাহলের অস্তিত্ব অনুভব করে থাকে। সে কালাহলের কারণ অনুসন্ধান করলে, পরক্ষণেই মুমুক্ষ-সাধক জানতে পারে যে, দেবাসুর সময়ের সে যুগ-যুগান্তরের ব্যবধান আজ যেন বিলীন হয়েছে। দেবতা ও দানব উভয়ই যে মায়েরই সন্তান! তবে শান্ত-প্রকৃতি দেবতাগণ ও সজ্জন সাধুদের রক্ষার জন্য অসুরদের তখন সাময়িকভাবে যেন ভীষণ তাড়না বা বিনাশ-প্রায় করেছিলেন, কিন্তু তারা ত মরে নি। তারা যে আবার মাতৃশক্তি-পুষ্ট বা দৈবীশক্তি-সম্পন্ন অসুর-গুরুর মৃতসঞ্জীবনী মন্ত্রবলে পুনঃ জীবিত হয়ে যেন মৃতকল্পভাবে রিপুরূপে অভিনব দানবদেহ গ্রহণ পুর্বক মানব-ইন্দ্রিয়ের পঞ্চ-ভূতাত্মক হয়ে রয়েছে।
মানব যে, দেবতা ও দানব উভয় আত্মারই প্রতীক-স্বরূপ। মানবের ভিতরে নিয়তই যে, সেই দেবাসুরের ভীষণ সমর বিরাজিত রয়েছে। ভক্তবৎসলা মা, সেই কারণ প্রিয় ভক্তগণকে শ্রীশ্রীচন্ডীর একাদশ অধ্যায়ে আশ্বাসবাণী দিয়েছন, —
“ইথং যদা যদা বাধা দানবোথা ভবিষ্যতি।
তদাতদাবতীর্য্যাহং করিষ্যাম্যরিসংক্ষয়ম।।” — ১১/৫৪
Continue-47
ভক্তের হৃদয়ে সেই দানবী-কোলাহল অনুভূত হলেই তিনি অবিলম্বে সেখানে অবতীর্ণা হবেন। অসুর-বিনাশিনী মা অসুর-দলনের জন্যই যেন সতত করাল-বদনা, কিন্তু ভক্তের প্রতি তিনি যে, সদাই করুণাময়ী। সেই কারন তাঁর ‘ধ্যান ‘ মন্ত্রের মধ্যে তিনি আবার ‘হসম্মুখীং’ অর্থাৎ হাস্যমুখী এবং সুখপ্রসন্নবদনাং, স্মেরাননসরোরুহাং অর্থাৎ তিনি প্রসন্নমুখী ও হাস্যযুক্তাও বটে। তিনি একাধারে কঠোর হয়েও করুণাময়ী, প্রসন্নবদনা, স্মেরাননা! এই একীভূত কঠোর-কোমলতাই তাঁর অপূর্ব স্বরূপ। তাই চন্ডীর ৪র্থ-অধ্যায়ের ২২-নং শ্লোকে স্পষ্টই উক্ত হয়েছে :–
চিত্যেকৃপা সমরনিষ্ঠুরতাশ্চ দৃষ্টা।
ত্বয্যেব দেবী বরদে ভূবনত্রয়োহপি।।
অর্থাৎ “হে দেবি! তোমার চিত্তে অনির্ব্বচনীয় কোমলতাপূর্ণ কৃপাও বাইরের সমরনিষ্ঠুরতার ভীষণ প্রচন্ডভাব, এই অপুর্ব স্বরূপ একাধারে কেবল তোমাতেই পরিলক্ষিত হয়। তুমি ত্রিভুবনের বরপ্রদায়িনী।”
মায়ের মুখমন্ডল যেন অনিচ্ছায় কেবল কঠোর কর্তব্য-কর্মের প্রভাবস্বরূপ অসুর-বিনাশ-কার্য্যে প্রদীপ্ত হয়েছে, কিন্ত তাঁর অন্তরের অতীব স্নেহপূর্ণ বিচিত্র বাৎসল্য-ভাবও সেই সঙ্গে ফুটে উঠেছে। পুত্রের প্রতি মায়ের শাসন যে, এইরূপ স্নেহ-তিরস্কারপূর্ণ!
পুর্বেই বলা হয়েছে “সাধকই প্রকৃতি -মাতার প্রকৃতরূপ বা ভক্তই ভগবানের যথার্থ স্বরূপ, পক্ষান্তরে ভগবানই যেন ভক্তের প্রত্যক্ষ ভাব-স্বরূপ, “সেই কারন সময়ে দুইই যে এক, অভেদ-ভাবাপন্ন অদ্বৈত বস্তু। উপাস্য-উপাসক ভাব-সমতায় তার অতি মধুর মিলন-সম্ভুত উপাসকভাবই উপাস্য মুর্ত্তিতে যেন প্রস্ফুটিত হয়ে থাকে। তাই মায়ের মুখ-কমল কেমন অদ্ভুত যোগমুক্ত বা কি এক অব্যক্ত ভাবপূর্ণ। সাধক, তন্ময় বা তাঁতে যোগযুক্ত হলেই সে ভাব অন্তরে স্পষ্ট অনুভব করতে পারবে, অন্যথায় তা বোঝান যাবে না।
কালীর দন্তশ্রেণীঃ- দেবীর করালবদনের ঘোর দন্তশ্রেণী তাঁর অবিশ্রান্ত লয় ক্রীয়ারই নিদর্শন। ধ্যানান্তরে দেখতে পাওয়া যায় “দেবীং লোলজিহ্বাং দিগম্বরীং।” দন্তসমুহ দ্বারা আবার তাঁর উক্ত লোলজিহ্বা সদা নিপীড়িত হচ্ছে। জিহ্বার অন্য নাম ‘রসনা’, ‘রসনাই সকল রস গ্রহনের মুখ্য যন্ত্র। জীবের রসনাই যেন সর্ব-রসের জ্ঞানরূপ -বিন্দুটি চ্যুত হয়ে বাসনা বা কামনাস্বরূপে কার্য্য করে। রসনা ও উপস্থ দুটিই জীবের ভীষণ ইন্দ্রিয়। এই দুটি ইন্দ্রিয় প্রত্যেকেই দুটি দুটি করে কার্য্য করে। জিহ্বা যেমন কূর্চ্চরসের-আস্বাদ সুখ ভোগ করবার যন্ত্র, তেমনি বাক্য বা কথা বলবার পক্ষেও জিহ্বা অপরিহার্য বস্তু। উপস্থ’ও সেইরূপ স্ত্রী-পুরুষের উভয়েরই সম্ভোগ ক্রিয়ার রস বা সুখভোগরূপ ‘বিন্দুত্যাগ’ ও ‘বিন্দুগ্রহণাত্মক’ সৃষ্টি-যন্ত্র। এখানে ‘বিন্দু’ অর্থে বীর্য্য বা জীবের চৈতন্য-বিন্দু।
কালী কথা-১৪
পক্ষান্তরে মুত্রাদি ক্রিয়াও এই যন্ত্র-সাহায্যে সাধিত হয়। সুতরাং এই দুটি ইন্দ্রিয়ই জীবের কাম-রস বা বাসনা অথবা ভোগ লালসার যন্ত্র। অষ্টাঙ্গ যোগ সাধনার প্রথম ক্রিয়ার অভ্যাস, এই দুটি যন্ত্রের উপর দিয়েই সাধককে করতে হয়। এটাই যম বা সংযম ক্রীয়া। স্থুলদেহের সার বস্তু ‘বিন্দু বা বীর্য্যের’ ধারণ বা ‘বীর্য্য রক্ষা’ এবং সুক্ষ্ণদেহের প্রথম স্তর প্রাণ-শরীরের সার ধন ‘বাক্য-সংযম’ ও পক্ষান্তরে ভোজন-সংযম’ও এর অন্তর্গত বলতে হবে। মন-সংযম এটারই অন্তনির্হিত অপেক্ষাকৃত সূক্ষ্ম ক্রিয়া, তা প্রাণায়াম ও প্রত্যাহার আদি যোগের অন্যান্য অঙ্গ বা ক্রিয়ার অন্তর্গত। মা, সেই লোলজিহ্বা নিপীড়ন দ্বারাই সাধককে তার সর্ববিধ লালসা-সংযমেরই ইঙ্গিত করেছেন।
‘রসনা’ সততই রক্তাভ লালবর্ণ বিশিষ্ট। ঘোর রক্তবর্ণই যথার্থ রজোবর্ণ, কিন্তু রসনার বর্ণ ঘোর লাল নয়, ঈষৎ গোলাপি অর্থাৎ লালের সঙ্গে সামান্য শ্বেতাভাযুক্তা। এই লাল বর্ণই পূর্ব কথিত রজোগুণের বর্ণ এবং শ্বেতবর্ণ সত্ত্বগুণের বর্ণ। সুতরাং রজোপ্রধান ঈষৎ সত্ত্বমিশ্রিত ভাবই রসনা। রজোগুণের কার্য্যই ক্রিয়া এবং সত্ত্বগুণের কার্য্যই সুখ। অতএব সুখাত্মকক্রিয়া বা কার্য্যের আধার রসনা বা বাসনা জিহ্বা নামে অভিহিত। এটাই জীবের সংসার-বন্ধনের কার্য্য। এটাকেই শ্বেতাভ শুদ্ধ বা অচঞ্চল ও অপেক্ষাকৃত স্থায়ী সত্ত্বগুণের দ্বারা দমন করবার আদর্শপ্রদান ছলে তাঁর শুভ্রোজ্জ্বল কঠিন দন্তশ্রেণীর দ্বারা রসনা বা জিহ্বার নিপীড়ন। রজোগুণ সাধারণতঃ সত্ত্বগুণের দ্বারাই বশীভূত হয়। সাধক সংযম-সাধনা যোগেই তা সম্পন্ন করতে পারে।
ব্যক্ত ষটচক্রের অতীত যে, গুপ্ত আরও তিনটি চক্র আছে। তার প্রথমটি ললনা-চক্র বলে কথিত। এত ললনাচক্রের স্থান সেই মেরুদণ্ডান্তর্গত সুষুন্মা মধ্যেই, তা জীবের কণ্ঠের উপরিস্থিত এবং তালুমুলের সমীপবর্তী ‘ঘণ্টিকা’ বা আলজিহ্বার ঠিক সমসুত্রপাতে অবস্থিত। তা চতুঃষষ্টিদল (কোন শাস্ত্রমতে আবার দ্বাদশদল) যুক্ত বিচিত্র কমল। এতেই অমৃত-স্থালী আছে। এটা থেকেই জীবের রসনায় সর্ববিধ রসগ্রাহীতার গূঢ় শক্তি সঞ্চারিত হয়ে থাকে। উন্নতকোটির সাধক এই চক্রের গুপ্ত সাধনায় সিদ্ধ হতে পারলেই মায়ের দন্তনিপীড়িত লোল বা লোলজিহ্বার গভীরতম তত্ত্ব অনুভব করে ধন্য হন।
অসুরদের বুদ্ধি, রক্ত ঝরছে -রজোগুণ বেরিয়ে যাচ্ছে, আর সত্ত্বগুণের দ্বারা তাদের অসুরভাব নির্জিত করে তাদের বুদ্ধিকে দৈবী সম্পদে পরিণত করে মা মালা করে পরে আছেন।
অথবা যোগবাশিষ্টের নির্বাণ প্রকরণ এবং কর্পূরাদিস্তুতির টিকাকাররা বলেন, আগামী সৃষ্টির জন্য পূর্ব-সৃষ্টির সংস্কার মুলমায়াকে মালা করা হয়েছে।
আবার তন্ত্র বলছেন, “পঞ্চাশৎ বর্ণমুন্ডালী”। শব্দ ছাড়া অর্থের অভিব্যক্তি হয় না। শব্দের সার স্বর ও ব্যঞ্জন। স্থুল অর্থ বা প্রত্যয় যখন নাশ হয়, তখন সূক্ষ্ণ স্বর ব্যঞ্জন সংস্কার প্রভৃতিকে আশ্রয় করে থাকে। আর মুক্তামালা হলো তাঁর কোটি কোটি বিভুতিশক্তি।
পদ্মপূরাণে আছে, ত্রিপুরাসুন্দরী অর্জুনকে দেখালেন, এক-একটি মুক্তদানায় এক-একটি অভুতপূর্ব ব্রহ্মাণ্ড, যা আমাদের ব্রহ্মার জ্ঞানের বাইরে। আমরা ভাবি, দৃশ্য-জগৎ ছাড়া বুঝি আর কোন জগৎ থাকতে পারে না। শ্রীকৃষ্ণ, অর্জুনকে দেখালেন, কালী কল্পতরুতে থলো থলো কৃষ্ণ ফলে রয়েছে।
কালী কথা-১৫
কালীর শাস্ত্রীয় ব্যাখ্য ! আবার অনেকটাই আলাদা । কালী করালবদনা । শাস্ত্রমতে , কালী সমগ্র বিশ্বকে গ্রাস করেন , আবার মহাকালকেও গ্রাস করেন । তাই তিনি করলবদনা । কালী ঘোরদ্রংস্ট্রাও । বলা হয়েছে , কালী ঘােরদ্রংস্ট্রা দন্তরা প্রকটিত রদনা । তাঁর জিহবা রক্তবর্ণ লেলিহান । মূর্তিতে দেখা যায় , লেলিহান জিহবা তিনি দন্ত দ্বারা দংশন করে আছেন । দেবীর শুভ্র দন্ত স্বপ্রকাশ সত্ত্বগুনসূচক । ঘাের বা বিশাল দন্ত সত্ত্বগুণের অধিকারসূচক।
রক্তবর্ণ লাল রসনা রজোগুনসূচক। দেবী প্রথমে রজােগুণ বৃদ্ধি করে তমোগুন নাশ করেন । দেবীর লেলিহান জিহবা এই তত্ত্বের সূচক । তারপর সত্ত্বগুণ বৃদ্ধি করে রজঃ ও তমঃ উভয় গুণকেই নাশ করেন । জিহ্বা দংশনের দ্বারা এই তত্বটিই প্রকটিত হয়েছে ।
কালি দেবী দুই ওষ্ঠ
প্রান্তে রক্তধারা বিগলিত হচ্ছে। রক্তধারা রজোগুনসূচক। রক্তধারা বহির্গত হচ্ছে, এই অর্থে দেবী রজোগুনরহিতা শুদ্ধ সত্ত্বাত্মিকা বিরজা।
শব কর্ণভূষণা অর্থ এই, দুটি কিশোর না বালকের শব দেবীর কর্নভূষন। মহেশ্বরের মতে নির্বিকার , নিষ্কাম বালকস্বভাব সাধক ব্রহ্মরূপিণী কালীর অতীব প্রিয় । এই তত্ত্বটিই দেবীর কর্ণভূষণ দ্বারা সূচিত হয়েছে ।
কালী দিগম্বরী । এর শাস্ত্রগত ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে এইরকম ; বস্ত্র আবরণ । সবচেয়ে সূক্ষ্ম আবরণ মায়া । কালী পূর্ণ ব্রক্ষ্মী বলে মায়াতীতা । তাই তিনি আবরণশূন্য দিগম্বরী । কালী চতুর্ভুজা । এর শাস্ত্রগত ব্যাখ্যা এই ধরনের : বিশ্বব্রক্ষ্মাণ্ড একটি বৃও স্বরূপ । প্রত্যেক বৃত্তে ৩৬ ° অংশ ( ডিগ্রি ) আছে । বৃত্তটিকে ৯০ ° ধরে চার ভাগ করা হয় । এই চার ভাগ বৃত্তের চতুর্ভুজ । এর অর্থ পূর্ণবৃত্ত চতুর্ভুক্ত । মহাকালী পূর্ণরূপা । তিনি মহাকাশরূপিণী । কেননা আকাশ ব্রক্ষ্ম। কালীও ব্রক্ষ্ম । মহাকালকে পূর্ণবৃত্ত কল্পনা করা হয় । এই কারণেই কালীকে চতুর্ভুজা করা হয়েছে ।
কালীর যে আলীঢ়পদ , শাস্ত্রে তার ব্যাখ্যা করা এইরকম : দক্ষিণাকালীর মূর্তি
আলীঢ়পাদা ও প্রত্যালীঢ়পাদা- এই উভয় রুপেই বর্নিত হয়েছে। দেবী বাঁ পা বাড়িয়ে দাঁড়ালে তাকে বলা হয় আলীঢ়পাদা । আর ডান পা বাড়িয়ে দাঁড়ালে তাকে বলা হয়
প্রত্যালীঢ়পাদা।
দুই পায়ের এক পা আছে অতীতে আর এক পা ভবিষ্যতে । এইভাবে দুই পা রেখে কালের অধিষ্ঠাত্রী দেবী দাঁড়িয়ে আছেন।
দু’পা এমন থাকার অর্থ- অগ্রগতি বা পশ্চৎ গতি কোনােটাই নেই । মহাশূন্যতারই এই অবস্থা । মহাশুন্যতা শ্মশানের প্রতীক । এই শ্মশান , যেখানে কামনা - বাসনা কিছুই নেই , তাই পরব্রহ্মণ , মহামুক্তির স্থান । তাই শ্মশানকালী মােক্ষদাত্রী । দক্ষিণাকালী সৃষ্টির শক্তি । তার কাছে প্রার্থনা করা হয় সৃষ্টিরক্ষার কারণে , সৃষ্টিতে স্বতন্ত্র অস্তিত্ব রক্ষার কারণে । তাই দক্ষিণাকালীর স্তব বীজমন্ত্র এইরকম : ওঁ ক্রীং ক্রীং ক্রীং হুং হুং হ্রীং হ্রীং
দক্ষিণে কালিকে ক্রীং ক্রীং ক্রীং হুং হুং হ্রীং
হ্রীং স্বাহা ।
ক্রীং অর্থ রক্ষা কর । এর দ্বারা এই বােঝায় যে , একাক্ষরা বীজরুপিনী কালিকা আমার মস্তক রক্ষা করুন । ক্রীং ক্রীং ক্রী এই ত্রিবীজরুপিণী খড়্গধারিনী কালিকা আমার ললাট , হুং হুং বীজদ্বয়রুপিনী নেত্রযুগল, হ্রীং হ্রীং বীজদ্বয়রুপিণী আমার কর্ণযুগল রক্ষা করুন। এই প্রার্থনা করার পর সর্বশেষে বলা হয় , স্বাহা বা ফট স্বাহা । স্বাহা অর্থ প্রণিপাত করি । ফট অর্থ সর্বাঙ্গে । অর্থাৎ দক্ষিণা কালীর কাছে এই অনিত্য জগতে রক্ষা পাবার জুন্যই প্রার্থনা জানানাে হয় । এইজন্য গৃহীরা দক্ষিণাকালীরই পূজা করেন । সংসারত্যাগী মােক্ষকামী সন্ন্যাসীরা করেন শ্মশানকালী পূজা ।
কালী শবহস্তকৃত কাঞ্চীধারিণী । কালীর কটিদেশে শবহস্তনির্মিত কাঞ্চী রয়েছে । হাত মানুষের প্রধান কর্মসাধন বা কাজ করার যন্ত্র। সুতরাং হাতকে কর্মের প্রতীক বলা হয় । কল্পাবসানে সকল জীব তাদের স্থূল দেহ ত্যাগ করে স্ব - স্ব কর্ম - সহ সূক্ষ্ম দেহ আশ্রয় করে এবং স্বগুনব্রক্ষ্মরুপিনী কালীর কারণ দেহের অবিদ্যাময় অংশে পুনরায় কল্পারম্ভ পর্যন্ত অবস্থান করে এবং মােক্ষলাভ না হওয়া পর্যন্ত জীবকে বারবার এইভাবে অবস্থান করাতে হয় । এইজন্যই মৃত জীবদের প্রধান কর্মসাধনভূত হস্তসমূহের দ্বারা নির্মিত কাঞ্চী বিরাটরূপিণী দেবীর গর্ভধারনযোগ্য নিম্নোদর উর্ধ্বস্থিত কটিদেশে কল্পিত হয়েছে ।
কালী শবরূপী শিবের বক্ষোপরি অবস্থিতা। শব নির্গুণ ব্রহ্মের প্রতীক । এই মূর্তি দ্বারা এটাই বােঝাবার চেষ্টা করা হয়েছে যে , কালী নির্গুণ ব্রহ্ম থেকেই উদ্ভুতা ।
কালীর শিবারও অর্থ আছে । ধ্যানে আছে কালীকে চারধারে শিবাদল ঘিরে রয়েছে। এখানে শিবা অর্থ শিবপ্রকৃতি , অর্থাৎ মঙ্গলস্বভাব অপঞ্চীকৃত মহাভূত , আর অস্থিকঙ্কাল শেতবর্ণ বলে সত্ত্বগুণের সূচক । মহাপ্রলয়ের সময় শ্মশান অপঞ্চীকৃত
মহাভূত এবং মৃত জীবদের সত্ত্বাদি গুণমূহের দ্বারা সমাকীর্ণ থাকে । দেবী দক্ষিনাকলী এইজন্যই শ্মশানবাসিনী ।
কালী কথা-১৬
পাশবদ্ধ জীবের কাছে কালীমূর্তি ভয়ংকরী। মূর্তিরহস্যজ্ঞ সাধকের কাছে এই মূর্তি করুণাময়ী , আনন্দময়ী জননীর মূর্তি । কালিকার ধ্যানে রাই তাঁকে বর্ণনা করা হয়েছে এই বলে , সর্বানন্দকারিনী , সুপ্রসন্নবদনা , স্মেরানন সরোরুহা।
কালী কৃষ্ণবর্ণা হবার কারণ , শ্বেত পীতবর্ন যেমন কৃষ্ণবর্ণে বিলীন হয়ে যায় , তেমনই সর্বভূত কালীর মধ্যে প্রবেশ করে অর্থাৎ বিলীন হয় । এইজন্য যারা মোক্ষর উপায় ব্রহ্মজ্ঞান লাভ করেছেন , তাঁরা নির্গুনা নিরাকার কল্যাণমযয়ী কালশক্তির কৃষ্ণবর্ণ নিরূপণ করছেন ।
অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন যে , মহাবিশ্বের একান্নটি তা বােঝাবার জন্যই যদি মায়ের গলায় মালা দেয়া হয়েছে , তবে সে - মালা নরমুণ্ড কেন , ফুলও তো দেওয়া যেতে পারত ? তার জবাব এই যে , নরমুণ্ড হল চেতনশক্তির আধার । বিশ্বব্রহ্মাণ্ড যে তরঙ্গসমূহ দ্বারা সৃষ্ট সেই তরঙ্গগুলি সবই সচেতন তরঙ্গ — চিৎশক্তি পূর্ণ । সেইজনই নরমুণ্ড দ্বারা তা বােঝাবার চেষ্টা করা হয়েছে । সেই একান্নটি তরঙ্গকে ভারতবর্ষে যে বর্ণ দ্বারা বােঝাবার চেষ্টা করা হয়েছে সেগুলো যথার্থই বিভিন্ন চেতনার প্রতীক। সুতরাং মায়ের গলায় ফুলের মালা অপেক্ষা মুণ্ডমালা বেশি মানায়। প্রত্যেকটি মুন্ডই ভিন্ন ভিন্ন বর্ণের । যেহেতু এক - একটি মুণ্ড এক -একটি ফ্রিকোয়েন্সির প্রতীক , সেই জন্যই বর্ণের এই তারতম্য। মুণ্ডের সংখ্যা উনপঞ্চাশটি । পঞ্চাশটি হওয়ার কথা কিন্তু সেটি ঘাড়ের পেছনে অদৃশ্য রয়েছে । এই অদৃশ্য মুন্ডটি যে বর্নের প্রতীক সেই বর্নটি মহাশূন্যতায় শুন্যতার সংগে একাত্মীভূত হয়ে আছে। হাতের মুণ্ড নিয়ে মুন্ডের সংখ্যা একান্নটি । সর্বত্রই তাই । এর কোনাে ব্যতিক্রম নেই ।
দীর্ঘ প্রসারিত জিহ্বা লােলুপতার সূচক নয় । এ হল খেচরী মুদ্রার প্রতীক । যাদের ধ্যানে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা আছে , তারা জানেন যে , খেচরী মুদ্রায় জিহ্বা বিলম্বিত হয়ে নাসারন্ধ্রে ঢুকে যায় । এর ফলে জিহ্বা বিলম্বিত হয় । ভেতরের এই বিলম্বিত জিহ্বাকে বােঝাবার জন্যই বাইরে তাকে প্রসারিত করে দেখানাে হয়েছে । অনেক সময় সত্যি সত্যিই তা বাইরে বিলম্বিত হয়ে বেরিয়ে পড়ে । এর ফলে সত্যিই জিহা লম্বা হয় । যাঁরা যথার্থ যােগী , তাঁদের প্রত্যেকেরই জিহ্বা লম্বা । যােগী যথার্থ যােগী কিনা প্রমাণ পাওয়া যায় এই
জিহ্বা দেখে । যােগীদের জিহ্বা মুখগহর থেকে বেরিয়ে এসে নাসাগ্র স্পর্শ করতে পারে । যারা যথার্থ যােগী নন , তারা এটা পারবেন না ।
যােগের চূড়ান্ত সাফল্যের ক্ষেত্রে খেচরী মুদ্রার একটি বিরাট ভূমিকা আছে । যােগী যখন ভূমি ত্যাগ করেন , তখন এই খেচরী মুদ্রাই তাঁর ভাসমান দেহে ভারসাম্য রক্ষা করে, নইলে তার পতন অনিবার্য । সুতরাং মায়ের প্রসারিত জিহা এটাই প্রমাণ করে যে , সৃষ্টিতে তিনিই ভারসাম্য রক্ষা করছেন।
মায়ের আলুলায়িত কেশ হল তার প্রচণ্ড তেজের প্রতীক , শক্তির প্রতীক । প্রাচীনকালে মানুষ কেশকে শক্তির প্রতীক বলে মনে করতো । কারণ , তারা লক্ষ্য করেছিল যে , শিশুকালে শিশু যখন দুর্বল থাকে , তখন তার কেশ থাকে অল্প । তরুণ বয়সে যখন সে সুস্থ ও সবল তখন তার কেশ হয় ঘন ও উদ্দাম । বার্ধক্যে আবার যখন দুর্বলতা প্রকাশ পেতে থাকে , তখন কেশ আবার কমতে আরম্ভ করে । এ - দেখেই তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছিল যে , কেশ শক্তির প্রতীক । এইজন্যই ঘনকৃষ্ণ এলােকেশ দ্বারা তারা মায়ের প্রচণ্ড শক্তিকে বুঝিয়েছে । ঠিক এই কারণেই হিন্দুরা বাবা-মা , কেউ মারা গেলে মাথা ন্যাড়া করে । শ্রাদ্ধের পূর্বে এই মাথা ন্যাড়া করা হয় । আসলে মৃতের সূক্ষ্মদেহকে পরপারে যাবার জন্য পর্যাপ্ত শক্তি যােগন দিতেই তারা এই মস্তকমুন্ডন করে । মুন্ডিত মস্তকের কেশ কিন্তু মৃতের উদ্দেশেই অর্পণ করা হয় ।
মায়ের পায়ের নীচে যে শবের মতো শিবকে দেখা যাচ্ছে , তার অর্থ এই যে , মহাশূন্যতার যে অংশ থেকে শক্তি নির্গত হয় , সেই অংশ নির্বিকারই থাকে । শিবের বা মহাশূনাতারূপী পুরুষের বর্ণ সাদা করার কারণ — মহাশূন্যতার মধ্যে 'দ্বিতীয় বিহীন আমি' বােধ জন্মালে তবেই সৃষ্টির বেগ বা কামের উদ্ভব হয়েছে ।
কালী কথা-১৭
সৃষ্টির ক্ষেত্রে এটা হল চিৎ পর্যায় । সৃষ্টির তিনটি পর্যায় বা বােধ আছে-- ( মহাশূন্যতা ) , চিৎ (স্পূটনের আবেগ, শূন্যতার কাম ) ও আনন্দ ( বিস্ফোরণের ফলে দ্বিতীয় সাত্তা জন্ম , যাকে বলে প্রকৃতি )। দ্বিতীয় পর্যায়ে অর্থাৎ চিৎ পর্যায়ে স্পূটনের যে আবেগ , অর্থাৎ মহাশূন্যতার বুকে বােধরুপী চিত্তের যে উদ্ভব , তাকে বলে জ্ঞান । এই জ্ঞানের শৈল্পিক প্রতীক বর্ণ হল সাদা । এই জন্য শিবকে অর্থাৎ পুরুষের চিৎ- পর্যায়কে শ্বেতশিবরপে কল্পনা করা হয়েছে । এই পর্যায়েও শিবের মধ্যে কোনো গতি নেই । কারণ এখানেও দ্বিতীয় কোনাে সত্তার উদয় হয়নি । দুই ছাড়া গতি হয় না । সেই কারণেই শিব শববৎ হয়ে আছেন । বস্তুত শিবের তিনটি পর্যায় আছে । যেমন- কৃষ্ণশিব। পুরুষের মহাশূন্যতার অবস্থা হল কৃষ্ণশিবের অবস্থা । এরপর শ্বেতশিব । চিৎ - পর্যায়ে শিবের বৰ্ণ শ্বেত। এখান থেকেই ঘনীভূত কাম - এর বিস্ফোরণের ফলে কালীরুপ কর্মচঞ্চলা মহাশক্তির সৃষ্টি হয়েছে। এখানে শিব দেখা দিয়েছেন শিবলিঙ্গ হিসেবে । শিবলিঙ্গে পুরুষ-প্রকৃতি একত্রে যুক্ত হয়ে আছেন । এ হল দ্বৈতের মধ্যে অদ্বৈত অবস্থা । একেই শব্দ ব্রক্ষ্মনের অর্থ ওঁ - এর — পর্যায় বলা হয় । তৃতীয় পর্যায়ে বিস্ফোরণ থেকে যে আলাে বেরােয় তাকে বলে জ্যোতি। এই জ্যোতিকেই বলে বিন্দু। বিন্দুই হল জগতের আদি প্লাজমা। শিবের তিনটি পর্যায় এই ধরনেরঃ
সৎঃ কৃষ্ণশিব
চিৎঃ শ্বেতশিব
আনন্দঃ শিব লিঙ্গ
(পুরুষ + প্রকৃতি =বিন্দু)
শিবকে কালীর স্বামীরূপে কল্পনা করা হয় । কারণ তার থেকেই মহাশক্তির উদ্ভব হয়েছে । যার থেকে উদ্ভব বা যিনি সৃষ্টি করেন , তাঁর সেই সৃষ্টির অধীশ্বর তিনিই । এই অধীশ্বরকেই বলা হয় — স্বামী । তাই শিব হলেন কালীর স্বামী । এই শিবের সঙ্গে আদিশক্তির সম্পর্ক সরাসরি । তাই তন্ত্রে কালীকে এই কারণেই রমণী বলা হয় ।
এই আদ্যাশক্তির নাম কালী করা হয়েছে এই কারণে যে , তার উদ্ভবের সঙ্গে সঙ্গেই কাল বা সময়ের উদ্ভব হয়েছে । সুতরাং এই আদ্যাশক্তিই কালের জননী । কালের জননী হিসেবে তাঁর নাম কালী । তাঁর বর্ণ কালো বলে তিনি কালী নন ।
এই যে মহাশক্তি , তার সৃষ্টিরূপে প্রকাশকালে একান্নটি ধাপ আছে । এই একান্নটি ভিন্ন ভিন্ন তরঙ্গের ভিন্ন ভিন্ন বর্ন আছে । এই একান্নটি বর্ণক্তিরূপে কালীরও একান্নটি রূপ আছে । যেমন — আদ্যাশক্তিরূপে কৃষ্ণবর্ণা , তারারুপে নীলবর্ণা , শ্বেতকালীরুপে শ্বেতবর্না, শ্যামল বৰ্ণরূপে শ্যামাকালী ইত্যাদি।
দশমহাবিদ্যারও এই শক্তির নানা রূপ । দশমহাবিদ্যারুপে শক্তির যে নানা রুপ আছে , তার অর্থ এই ধরনের ; আদ্যাশক্তি হিসেবে কালী কৃষ্ণবর্ণা
। দেশশক্তি হিসেবে তার নাম তারা । তারা হিসেবে তিনি নীলবর্ণা। এঁরা নিত্য, অব্যয়া ও কল্যাণময়ী । অকৃততত্ত্ব শ্রীযুক্ত বলে এঁদের ললাট চন্দ্রকলা । দেশ ও বাঙ্গ অনন্ত এই ধারনায় এঁরা আবরনশূন্য। কালী, তারা মহাবিদ্যা থেকেই ষোড়শীর উৎপত্তি।
চতুর্থ শক্তি ভুবনেশ্বরী । শক্তির দুই রুপ কোমল ও প্রচণ্ড । ভুবনেশ্বরী শক্তির মনােহারিণী রূপ । পঞ্চম শক্তি ভৈরবী । ভৈরবী চন্ডশক্তি । অষ্টবিধ প্রচণ্ডতায় বিভক্ত হয়ে তন্ত্রের অষ্টনায়িকা । তিনিই আবার ছিন্নমস্তারূপে
ষষ্ঠবিদ্যা । ভগবতী সকল মূর্তিতেই বিশ্বপালিকা । কারণ তিনি যেমন সৃষ্টির কারণ , তেমনই স্থিতিরও মূল । ছিন্নমস্তারূপে পালিকাশক্তি প্রবল হলে তিনি ভৈরবী থেকে ভিন্ন হন ।
ছিন্নমস্তার ত্রিরুধির ধারাতে আছে অন্নপূর্ণার ত্রিধা শক্তি । ভােক্তা , ভােগ্য ও ভােগরূপে জগতের অন্নস্বরূপ হলেন অন্নপূর্ণা। তাই তার রুধির হল ত্রিধারা । জগৎ ভােক্তা রূপে জগতের থেকে ভােগ্য সংগ্রহ করছেন প্রকৃতি । আবার ভােগ্য অন্নকে আপনিই ভোগ করে পরিপুষ্টা ও পালিতা হচ্ছেন । ভােক্তা , ভােগা ও ভোগ — এই তিনই পৃথক শক্তিরূপে বিরাজমান এই মহামায়া । ছিন্নমস্তায় আছে অন্নপূর্ণার জগৎ পালন রীতি । কিন্তু ভোগই তাে শেষ কথা নয় । ভাগ শেষ হলেই আসে প্রলয় । তাই ছিন্নমস্তার পর সপ্তম মূর্তি হল ধূমাবতীর । জগতের ভোগ শেষ হলে জরাজীর্ণ ভগবতী আসেন বৃদ্ধা বেশে কাকধব্জ যমের প্রলয় রথে চড়ে ক্ষুধাতুরা ও বিস্তৃতবদনা হয়ে । সকল সৃষ্টিকে কুলায় সংগ্রহ করে নিজের উদর পূর্ণ করেন তিনি । ধূমাবতী তাই প্রলয়রূপিণী ভৈরবীর ভয়ঙ্করী মূর্তি । অষ্টম মূর্তি রক্তবর্ণা , রজোরুপিণী বগলা । এই মূর্তিতে দেবী ঘােরতর বেদবিরােধী অসুরকে বিনাশ করেন । সেই অসুরনাশে যে জ্ঞানের উদয় , সেই নির্মল জ্ঞানরূপিণী ভগবৎশক্তিই নবম মূর্তি মাতঙ্গী ।
কালী কথা-১৮
মাতঙ্গীরূপে বিশ্বরূপিণী শক্তি অজ্ঞানরূপ অবিদ্যানাশিনী কৃষ্ণাঙী তমােরুপিণী শক্তি । এই শক্তি সকল শক্তিধারিণী হয়ে অষ্ট ঐশ্বর্যশালিনী কমলারূপে জগংবাপিনী । দশম মূর্তিতে হলেন কমলা । যে ব্রহ্মাণ্ড ব্রহ্মার কমল আসনরূপ কারবারি থেকে সঞ্জাত , সেই কমলেই কমলার ব্রাহ্মীশক্তি ও অপর বিদ্যারও আসন । শিবের বুকের উপর কালী দাঁড়িয়ে থাকা অর্থ মহাশূন্যের বুকে বিশ্বপ্রকৃতির উদয় । শিব কালীর বুকের ওপর দাঁড়িয়ে থাকলে বােঝায় বিশ্বপ্রকৃতির লয়।
সাধক যেমন ভাবেন মানস জগতে তেমনভাবেই দেখতে পান । তার দেখা চিত্র চিন্তাতরঙ্গের সূত্র ধরে পরমাত্মায় ছাপ ফেলে যায় । কারাে সমচিন্তাতরঙ্গ হলে তিনিও সেই ছবি দেখতে পান । দেবদেবী রহস্যের গােপন সূত্র রয়েছে এখানেই । তাছাড়া মহাবিশ্বে বহুমাত্রিক জীবও আছে । আমাদের ত্রিমাত্রা থেকে তাদের পূর্ণরূপ আমরা দেখতে পাই না । দেখি বিকৃতভাবে । দ্বিমাত্রার জীব যেমন আমাদের যথার্থ রূপ দেখতে পারে না , আমরাও তেমন তাদের দেখতে পাবো না। যতটুকু দেখব তা যথার্থ নয় । কিন্তু দেহের অভ্যন্তরে শক্তিতরঙ্গ জাগ্রত করে ( কুলকুণ্ডলিনী জাগরণের ফলে ) যদি আমরা সেই বহুমাত্রিক প্রাণীর সমতরঙ্গ হতে পারি , তখন তাদের ছবি আমাদের কাছে স্পষ্ট হবে । যতক্ষণ পর্যন্ত উচ্চ যােগীসাধকদের মতাে নিজেদের মধ্যে আমরা বহুমাত্রিক তরঙ্গ সৃষ্টি করতে না পারি , ততক্ষণ দেবদেবী রহস্যের যথার্থ চরিত্র আমাদের কাছে স্পষ্ট হবে না । জগতের সমস্তু সৃষ্ট এককের আদি উৎসে রয়েছে শূন্য । কোনাে কোনাে স্তরে দর্পণ - সদৃশ স্বচ্ছতা । কোথাও অপরিচ্ছিন্ন তীব্র আলাে , যাকে বলে জ্যোতি ! যিনি তার মানসতরঙ্গকে যে স্তরে নিতে পারেন , তিনি সেই অনুসারে সৃষ্টির উৎসের সেই সেই অবস্থা বা স্তর দেখতে পারেন । শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংস মায়ের জীবন্ত রূপ না দেখতে পেয়ে যখন হতাশায় আত্মহত্যা করতে চলেছিলেন , সেই সময় মায়ের জ্যোতিরূপ তার দর্শন হয় । কারাে কারাে বােধ হয় , রূপের আদি উৎস শূন্যতা। রূপ আসলে অরুপ মাত্র । আমরা সেই অরূপের রূপের ছায়া , পুতুল মাত্র । পুতুল হয়েও নড়ি , চড়ি , কথা বলি । দেবদেবীর কল্পিত রূপও তেমনই কথা বলতে পারে । শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসের সঙ্গেও তেমনই প্রতিমারূপা মাও নাকি কথা বলতেন । এ - রহস্য রহস্যই , সাধারণ মানুষের কাছে স্পষ্ট হবার নয় । তাই যাঁদের কাছে দেবদেবীর অস্তিত্ব আছে , তাদের কাছে আছে , যাদের কাছে নেই , তাদের কাছে নেই।
বঙ্গদেশের অধিষ্ঠাত্রী দেবী কালী আদি শক্তি রূপে যোগীদের মন্ত্র ও তন্ত্র উদঘাটনে তত্পর। কালী দশমহাবিদ্যার প্রথমা দেবী ও বিশ্বসৃষ্টির আদি কারণ। পরমানন্দা সত্ত্ববিদ্যাধারিণী জগন্ময়ী রূপ তাঁর। বীজ থেকে যেমন অঙ্কুরের নির্গমন হয় এবং জীবের ক্রমবিকাশ হয় তেমনই সেই সব সৃজনই তাঁর সৃষ্টিশক্তি।
Continue-48
কালী কথা-১৯
তান্ত্রিক মতে কালী 'অষ্টধা' বা 'অষ্টবিধ'। এই 'অষ্টধা' হলেন -- দক্ষিণাকালী, সিদ্ধকালী, গুহ্যকালী, শ্রীকালী, ভদ্রকালী, চামুন্ডাকালী, শ্মশানকালী ও মহাকালী।
১) দক্ষিণাকালী --
অষ্টধা কালী প্রথম কালী রূপটি হলো দক্ষিণাকালী। দক্ষিণাকালী কালীর সর্বাপেক্ষা প্রসিদ্ধ মূর্তি। দেবীর প্রচলিত ভাষায় নাম শ্যামাকালী। দক্ষিণাকালী করালবদনা, ঘোরা, মুক্তকেশী, চতুর্ভূজা এবং মুণ্ডমালাবিভূষিতা। দেবীর বামকরযুগলে সদ্যছিন্ন নরমুণ্ড ও খড়্গ; দক্ষিণকরযুলে বর ও অভয় মুদ্রা। দেবীর গাত্রবর্ণ মহামেঘের ন্যায়; তিনি দিগম্বরী। দেবীর গলায় মুণ্ডমালার হার; কর্ণে দুই ভয়ানক শবরূপী কর্ণাবতংস; কটিদেশে নরহস্তের কটিবাস। দেবীর দন্ত ভয়ানক; তাঁর স্তনযুগল উন্নত; তিনি ত্রিনয়নী এবং মহাদেব শিবের বুকে দণ্ডায়মান। তাঁর দক্ষিণপদ শিবের বক্ষে স্থাপিত। তিনি মহাভীমা, হাস্যযুক্তা ও মুহুর্মুহু রক্তপানকারিনী। দেবীর চতুর্দিকে শ্মশানে শিবাবাহিনী ঘোর রবে দেবীর জয়ধ্বনি করছেন। দক্ষিণ দিকের অধিপতি যম এই দেবীর নাম শুনে পলায়ন করেন, তাই ইঁনি দক্ষিণা কালী। এই দেবীর উপাসক দের যম ভয় থাকে না। দক্ষিণাকালীর পূজা করলে ত্রিবর্ণা তো বটেই সর্বোপরি সর্বশ্রেষ্ঠ ফলও দক্ষিণাস্বরূপ পাওয়া যায়।
২) সিদ্ধকালী --
সিদ্ধকালী দ্বিভুজা। সিদ্ধকালী তার দক্ষিণের হস্তের খড়গ দ্বারা চন্দ্রমণ্ডল ভেদন করছেন। সেই চন্দ্র মণ্ডলের গলিত রস দেবীর সর্বাঙ্গ প্লাবিত করছে। তিনি বাম হস্তের কপাল পাত্রে ঐ অমৃত ধারন করে পান করছেন। দেবী ত্রিনয়নী, মুক্তকেশী, দিগম্বরা। দেবীর কটিদেশ কাঞ্চী দ্বারা বদ্ধ। শিরে মনি মুক্ত খচিত মুকুট। দেবী দীপ্তজীহবা, দেবীর তনু কান্তি নীলোৎপল সদৃশ। কর্ণে তার রবি শশী তুল্য সমুজ্জ্বল কুন্ডল দ্বয়। দেবী মহাদেবের বুকে বাম চরণ স্থাপন করে আছেন, দক্ষিণ চরণ পেছনে। সিদ্ধকালী কেবল সাধক দের দ্বারাই পূজিতা। গৃহস্থ ব্যাক্তিরা দেবীর পূজো করেন না।
৩) গুহ্যকালী --
গুহ্যকালী মহামেঘপ্রভা, কৃষ্ণ বস্ত্র পরিধান করেন, লোলজিহ্বা, ঘোর দ্রংষ্ট্রা, কোটাক্ষী, হসন্মুখী। দেবীর কন্ঠে নাগ হার। ত্রিনেত্রা দেবীর মস্তকের গগনচুম্বী জটাজালে অর্ধচন্দ্র। দেবী শব আস্বাদনে আসক্তা। গুহ্যকালী নাগ যজ্ঞপবীত ধারন করেন, নাগশয্যেপরি বিরাজিতা। দেবীর কন্ঠদেশে পঞ্চাশৎ মুন্ড সংযুক্ত বনমালা, দেবী মহোদরী। সহস্র ফনা যুক্ত অনন্ত নাগ দেবীর শিরোপরি দেবীর চতুর্দিকে নাগ গণ ফণা তুলে বেষ্টন করে থাকেন। সর্পরাজ তক্ষক দেবীর বাম হস্তের কঙ্কণ এবং অনন্ত নাগ দক্ষিণ হস্তের কঙ্কণ। দেবী নাগ নির্মিত কাঞ্চী ও রত্ন নূপুর ধারন করেন। দেবীর বাম দিকে শিব সব্রুপ কল্পিত বৎস্য থাকে। দেবী দ্বিভুজা, দুইহাতে বরাভয় মুদ্রা। দেবীর শ্রুতি দ্বয় নরদেহসমাবদ্ধ কুন্ডল দ্বারা শোভিত থাকে। দেবী প্রসন্ন বদনা, সৌম্যা, নারদাদি মুনি গণ সেবিতা। অট্টহাস্যকারিনী এই দেবী সাধক দের অভিষ্ট দায়িনী। গুহ্যকালীর পূজো গৃহস্থ বাড়িতে হয় না। দেবী কেবল সাধক দের দ্বারাই পূজিতা। তবে কিছু পণ্ডিত এর মতে গ্রহ দোষ কাটানোর জন্য গৃহস্থ বাড়ীতে এই মায়ের পূজো করা যেতে পারে।
৪) শ্রীকালী --
শ্রীকালী মহাদেবের শরীরে প্রবেশ পূর্বক মহাদবের কন্ঠে স্থিত গরলে নিজ তনু কৃষ্ণ বর্ণ করেছেন। মহাদেবের ন্যায় শ্রীকালী ত্রিশূল ধারিনী, শ্রীকরে সর্প বলয় যুক্তা। লিঙ্গ পুরান মতে শ্রীকালী দারুক নামক এক অসুরকে বধ করেছিলেন । একারণে দেবীকে দারুকাসুর মর্দিনী কালীও বলা হয়।
কালী কথা-২০
৫) ভদ্রকালী --
তন্ত্র মতে ভদ্রকালী ক্ষুধায় ক্ষীণা। কোটোরাক্ষী, মসিমলিনমুখী, মুক্তকেশী। ভদ্রকালীর কর দ্বয়ে জ্বলন্ত অনল শিখার ন্যায় দীপ্ত পাশ যুগ্ম থাকে। দেবী পুরাণ বলেন – দেবী অন্তিমে মৃত্যুকালে ভদ্র বা মঙ্গল বিধান করেন, তাই তিনি ভদ্রকালী। কালিকাপুরাণ মতে ভদ্রকালী অতীব সুন্দর। অতসীপুস্পের ন্যায় গাত্র বর্ণ, মস্তকে জটায় উজ্জ্বল মুকুট, ললাটে অর্ধ চন্দ্র, কন্ঠে উজ্জ্বল নানা হার- নাগহার। অস্ত্রাদি দ্বারা সজ্জিত এই দেবীর পদতলে বাহন পশুরাজ থাকেন, দেবী বাম চরণে মহিষকে চেপে তাহাকে বধ করেন। দেবী এমন ভয়ঙ্করী রূপ হলেও অমঙ্গল ও ভয়-ভীতি হরণ করেন। ভদ্রকালীর পূজো গৃহস্থ ও সাধক উভয়েই করতে পারেন।
৬) চামুন্ডাকালী --
শ্রী শ্রী চন্ডী গ্রন্থানুসারে চন্ড ও মুন্ড নামক দুই দানব দেবী কৌষিকীর সাথে যুদ্ধ করতে আসলে দেবী তার ভ্রুকুটি কুঞ্চিত করেন। সেখানে থেকেই দেবী চামুন্ডার আবির্ভাব হয়। ভয়ঙ্করী এই চামুন্ডাকালীর মূর্তি। চন্ড ও মুন্ড নামক দুই দানব কে বধ করার জন্য তিনি চামুন্ডা নামে খ্যাত হন। কালিকাপুরাণে এই চামুন্ডাকালী দেবীকে নীল পদ্মের ন্যায়, চতুর্ভুজা বলা হয়েছে। তিনি বিচিত্র নর কঙ্কাল ধারিনী, নরমুণ্ড মালিনী, ব্যাঘ্রচর্ম পরিহিতা, অস্থি চর্মসার দেহ স্বরূপা। অতি ভীষনা, বিশাল বদনা, লোলজিহ্বা, ভয়ঙ্করী, কোটর গতা, আরক্ত চক্ষু বিশিষ্টা এবং সিংহ নাদে দিক মণ্ডল পূর্ণ কারিনী। চামুন্ডাকালী মাতা শব বাহনা। দুর্গাপূজার সময় সন্ধিক্ষণে এই দেবীর পূজা করা হয়। চামুন্ডাকালীর পূজো কেবল সাধক দের জন্যই। গৃহস্থ বাড়ীতে বা গৃহস্থ লোকেরা এই দেবীর পূজো করেন না।
৭) শ্মশানকালী --
শ্মশানকালী ঘন কৃষ্ণবর্ণা, শ্মশান বাসিনী, রক্তবর্ণ নেত্র, মুক্তকেশী, শুস্কমাংসা, অতি ভৈরবা, পিঙ্গল নয়না, কারণ- মাংস পূর্ণ পাত্র ধারিনী ও ভক্ষণকারিণী, ডান হস্তে নর মুণ্ড, বাম হস্তে পান পাত্র। দেবী স্মিতবক্ত্রা, সর্বদা আমমাংস চর্বণ তৎপরা, নগ্না, সদা মদ্যপানে প্রমত্তা। দেবী অতি উজ্জ্বল অলঙ্কার ধারিনী। পূর্বে ডাকাতেরা এই দেবীর কাছে পূজা দিয়ে ডাকাতি করতে যেতো। তন্ত্র সাধকেরা বীরাচারে এই দেবীর আরাধনা করেন। শ্মশানে এই দেবীর পূজা হয়। গৃহস্থ বাড়ীতে এই দেবীর পূজা বা ছবি রাখা হয় না।
৮) মহাকালী --
তন্ত্রসার গ্রন্থ অনুসারে মহাকালী পঞ্চদশ নয়না, মহারৌদ্রী। দেবীর হাতে শক্তি, শূল, ধনু, বাণ, খড়গ, খেটক, বর ও অভয় থাকে। মার্কণ্ড পুরাণে এই দেবীর বর্ণনা আছে। সৃষ্টির আদিতে ভগবান বিষ্ণুর কর্ণমলজাত মধু ও কৈটভ নামক দুই দানব প্রজাপতি ব্রহ্মাকে গ্রাস করতে উদ্যত হলে, ব্রহ্মা তখন যোগনিদ্রায় মগ্ন হরিকে স্তব করেন। কিন্তু ভগবান বিষ্ণু তখন যোগনিদ্রার প্রভাবে আচ্ছন্ন হয়ে আছেন দেখে ব্রহ্মা তখন হরিনেত্রনিবাসিনী সেই দেবীর স্তব করলেন। ব্রহ্মার স্তবে তুষ্ট হয়ে দেবী , মহাকালী রূপে প্রকট হলেন। যোগনিদ্রা থেকে মুক্ত হয়ে ভগবান বিষ্ণু ঐ দুই দানবকে বধ করেন। এই দেবীর দশ মুখ, দশ হাত, দশ চরণ। তনু নীলকান্ত মণির মতো উজ্জ্বল। ত্রিনয়না দেবী খড়্গ, বাণ, ধনুক, শঙ্খ, চক্র, ত্রিশূল, গদা, পরিঘ- ভূষ্ণণ্ডী, নরমুণ্ড ধারন করে আছেন। কেবল সাধক রাই মহাকালীর পূজো করতে পারেন। কথিত আছে দেবী প্রথমে সাধককে নানা ভাবে ভয় দেখান। সাধক ভয় তুচ্ছ করে সাধনার পরীক্ষায় সফল হলে দেবী নানা রকম সিদ্ধি দান করেন।
কালী কথা-২১
অদ্বৈত নিশ্চল ব্রহ্মে মিশে যাওয়ার পূর্বে এই যে বিভিন্ন কালী দেখা, এই কালী কে? কাকে কালী বলে, কালীর মালা, কালীর খড়্গ, কালীর চরণ, কালীর জিহ্বা, কালী কত প্রকার ইত্যাদি বিষয়ে যোগিরাজের যে সব প্রত্যক্ষ দর্শন, উপলব্ধি ও জ্ঞান হয়েছিল তা তিনি তাঁর গোপন দিনলিপিতে লিখে রেখে গেছেন। এই কালী কে, যোগিরাজ বলেছেন—‘‘সূর্য্যহি কালীকা রূপ। সূর্য্য ওহি কালী-সূর্য্যকা রূপ আউর হমারা রূপ এক হয়’’ আত্মসূর্যই কালীর রূপ। এই যে আত্মসূর্য দেখছি তিনিই কালী। এই আত্মসূর্যের রূপ এবং আমার রূপ একই অর্থাৎ যা কালীর রূপ তা আমার রূপ; কালী এবং আমি একই অভিন্ন। এই কালীর জিহ্বা কি? যোগিরাজ বলেছেন—‘‘লোল জিহ্বা মালুম হুয়া কালীকা। ইহ জিহ্বা জব তালুমুল্মে লপট জাতা হ্যায়। জিভ আউর উঠা আউর ইহ মালুম হোতা হায় কি নিদ ছোড় দেনা। আউর বড়া মজা মালুম হুয়া আউর বাসুলিকা আওয়াজ আউর সাফ বজনে লগা’’—জিহ্বা হোল লালসার প্রতীক। জিহ্বার দ্বারা সকল স্বাদ বোঝা যায়। কালীর ওই লকলকে লালসাযুক্ত জিহ্বা কি, যার দ্বারা সকল জীবের লালসা উৎপন্ন হয় তা এখন বুঝতে পারলাম। বুঝতে পারলাম যে এই লালসার জন্যই জীব আবদ্ধ হয়। কিন্তু কখন বুঝলাম? যখন আমার এই বর্তমান জিহ্বা উপরে উঠে তালুমুলে আটকে গেলো তখনই। লোভ চরিতার্থ না হলে ক্রোধ উৎপন্ন হয়। এগুলো সবই সাধনার অন্তরায় অতএব লোভ ক্রোধ ইত্যাদি এগুলোকে সর্বাগ্রে সংযত করা একান্ত প্রয়োজন। এগুলোকে সংযত করতে না পারলে কখনই আত্মরাজ্যে প্রবেশ করা যায় না। এরই প্রতীক স্বরূপ মা কালীর জিহ্বা বর্হিমুখী। কিন্তু এই লালসা লোভ ইত্যাদি সংযত হয় কি উপায়ে? যেমন কোন বস্তু লাভের জন্য লোভ হল। সেই লোভ কি বাইরের থেকে আমার মধ্যে প্রবেশ করল? তা নয়। লোভ আমার ভেতরেই আছে। কেবল সেই বস্তু লাভের ইচ্ছা মনে জাগ্রত হওয়ার দেহাভ্যন্তরস্থ লোভরূপী অবস্থায় প্রকাশ হোলো। অতএব লোভ আমারই ভেতর বর্তমান। তাই যোগিরাজ বলছেন এই লোভ কে সংযত করতে হলে বাহ্য উপায়ে বা বাহ্য ত্যাগে সম্ভব নয়। যেমন যে বস্তুর প্রাপ্তির জন্য লোভ হল, সেই বস্তুকে যদি গ্রহণ না করা হয় তবে বাহ্য ত্যাগ হল বটে কিন্তু মনে মনে সেই বস্তু লাভের লোভ রয়ে গেল। অতএব এইভাবে লালসা বা লোভ চরিতার্থতা হল না ঠিকই, তাই এই উপায়ে সঠিক ত্যাগ সম্ভব নয়। এই লালসা বা লোভ ত্যাগের যৌগিক উপায়স্বরূপ যোগিরাজ বলছেন যদি স্বীয় জিহ্বাকে ওপরে উঠিয়ে তালুকুহরে দুই নাসিকা ছিদ্রের ওপরে রাখা যায় তাহলে লালসা লোভ ইত্যাদি আপনা হতেই জয় হয়। শুধু তাই নয় কাম ক্রোধ লোভ মোহ মদ মাৎসর্য এই ষড়বর্গো আপনা হতেই জয় হয়। মা কালীর জিহ্বা যে বহুর্মুখী, এর দ্বারা বোঝানো হচ্ছে যে যোগীকে জিহ্বার কিছু কর্ম করতে হবে, যাতে করে জিহ্বা তালুকুহরে প্রবেশ করে। এই প্রবেশ করানোকেই খেচরী অবস্থা বলে। এই অবস্থা লাভ হলে সকল ইন্দ্রিয় ও রিপু আপনা হতেই দমিত হয়, এমনকি নিদ্রাও চলে যায়। এই অবস্থা লাভ হলে নিদ্রা জয় হবে অথচ শরীরের কোনো ক্ষতি হবে না এবং যোগী সারারাত ব্যাপী প্রাণ কর্মরূপ আত্মসাধনে নিরত থাকতে পারবে। এই অবস্থায় উত্তম প্রাণায়াম হয় এবং সেই প্রাণায়ামে শ্রীকৃষ্ণের বংশীধ্বনি স্বরূপ বাঁশির মতো আওয়াজ পরিষ্কার নির্গত হয়।
কালীচরণ কাকে বলে—‘‘কালিকা চরণ দেখা। কালীর নাম অর্থাৎ সূর্যের ধ্যান ও প্রাণায়াম কালীর পা এক ঐ পা দুই হইয়াছে বাঁ পা ও ডান পা অর্থাৎ চন্দ্র ও সূর্য অর্থাৎ ইড়া ও পিঙ্গলা। চরণ য়ানে দোনো শ্বাসা যয়সা চরণ এ স্থান ছোড়কে জাতা হয় ওএসাহি শক্তি শ্বাসাক।’’সেই চরণ কি? চরণ শব্দে যার দ্বারা বিচরণ করা যায়। মানুষ দুই পায়ের দ্বারা বিচরণ করে। পা হাড় মাংস দ্বারা গঠিত। প্রকৃতপক্ষে পায়ের কি নিজস্ব ক্ষমতা আছে? যদি থাকত মৃত মানুষের পাও চলত। তা যখন চলে না, তখন এই দুই পায়ের নিজস্ব কোনো ক্ষমতা নেই অতএব প্রকৃতপক্ষে এই দুই পা সহ সারা শরীরটাকে যিনি চালাচ্ছেন তিনি হলেন ইড়া ও পিঙ্গলা। এই ইড়া ও পিঙ্গলায় শ্বাসের গতি থাকায় জীব জীবিত থাকে এবং এই দুইতে যতক্ষণ জীব অবস্থিত ততক্ষণ জীব দ্বৈতে থাকতে বাধ্য হয় এবং এই দ্বৈতে থাকার দরুন যতকিছু জানাজানি, দেখাদেখি সবই বর্তমান থাকে। এই দুইতে গতি আছে বলেই পা দুটি চলে। তাই প্রকৃত পক্ষে দুই চরণ হোলো এই ইড়া ও পিঙ্গলা। ইড়াকে বলা হয় চন্দ্র নাড়ী এবং পিঙ্গলাকে বলা হয় সূর্যনাড়ী। এই ইড়া নাড়ী বাঁ পা এবং পিঙ্গলা নাড়ী ডান পা। এই ইড়া ও পিঙ্গলায় যতক্ষণ গতি আছে ততক্ষণ জীবের পক্ষে অদ্বৈতকে জানা অসম্ভব। ইড়া তমগুণ, পিঙ্গলা রজগুণ। তাই বেশির ভাগ জীবই এই দুই গুণের অন্তর্গত থাকতে বাধ্য হয়।
বৈদিক সাহিত্যে শিব
(১ম পর্ব)
বৈদিক যুগের প্রথম স্তরে অর্থাৎ বৈদিক সাহিত্যের প্রধান ও প্রাচীনতম সাহিত্য ঋগ্বেদে বস্তুত শিবকে পাওয়া যায় না। তাঁর প্রতিরূপ রুদ্রকে ঋগ্বেদের কয়েকটি সূক্তে স্তূয়মান হিসেবে পাওয়া যায়। অধ্যাপক জিতেন্দ্রনাথের মতে–
‘শিব’ শব্দ এই সময়ে কতিপয় বৈদিক দেবতার বিশেষণ রূপে ‘মঙ্গলদায়ক’ অর্থে ব্যবহৃত হইত। উত্তর বৈদিক সাহিত্যে যে ‘সত্যম্ শিবম্ সুন্দরম্’ পদ পাওয়া যায়, সেখানেও ইহা পরম ব্রহ্মের বিশেষণ রূপে একই অর্থে ব্যবহার করা হইয়াছে। বৈদিক সাহিত্যের শেষের দিক হইতে ইহা এক বিশেষ দেবসত্তাকে বুঝাইতে আরম্ভ করে।… কিন্তু রুদ্রই যে পৌরাণিক শিবের আদি বৈদিক প্রতিরূপ সে বিষয়ে নিঃসন্দেহ হওয়া যায়।’– (পঞ্চোপাসনা, পৃষ্ঠা-১২৫)
আর দীনেশ চন্দ্র সেন-এর ভাষায় বৈদিক রুদ্রের রূপ হলো– ‘বেদের রুদ্রদেব বিনাশের দেবতা, তাঁর জটাজুট অগ্নিশলাকার মতো। তাঁর নৃত্যের নাম– তাণ্ডব; তাতে বিশ্ব বিকম্পিত হয় ও গ্রহরা কক্ষচ্যুত হয়ে ব্যোমপথে বিক্ষিপ্তভাবে ছোটাছুটি করে। রুদ্রের নিঃশ্বাসের জ্বালা– জগতের শ্মশান। তাঁর শূলাগ্রে বিদ্ধ হয়ে দিগ্হস্তীরা আর্তনাদ করে ওঠে। তাঁর নেত্রশাসনে চিত্ত-শ্মশানে কামদেব পুড়ে ছাই হয়। তাঁর মুখোচ্চারিত প্রণব প্রলয়ের গান– বিনাশের ঝঞ্ঝা। তা জগতকে পুঞ্জীভূত ধুলোয় পরিণত করে। তাঁর বিষাণ-বাদনের তালে তালে চতুর্দশ মৃত্যু নৃত্য করতে থাকে।’ –(বৃহৎ বঙ্গ)
ড. উদয়চন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাষ্যে, ‘পণ্ডিতদের অনুমান– আদিম মানব গোষ্ঠীর মধ্যে গাছ, পাথর, বিভিন্ন জন্তু পূজার ব্যাপক প্রচলন ছিল। এরূপ কোন ‘জন্’ বা গোষ্ঠী হয়তো লম্বাটে পাথরকে শিব হিসাবে পূজা করতেন, যা পরবর্তী কালে বেদের রুদ্র দেবতার সঙ্গে এক হয়ে গেছেন। ডক্টর জিতেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় লিঙ্গপূজাকে ‘ট্রাইবাল’দের থেকে আসা বলেই মনে করেন। পরবর্তীকালে প্রত্ন-নিদর্শন হিসেবে প্রাপ্ত কয়েকটি শিবলিঙ্গের গায়ে শিবমূর্তি অঙ্কিত করে বা শিবের প্রতীক ত্রিশূল, পরশু ইত্যাদি অঙ্কিত করে উভয়ের ঐক্য বোঝানো হয়েছে। মূর্তি অঙ্কিত লিঙ্গকে বলে মুখলিঙ্গ। এধরনের মুখলিঙ্গ অতি প্রাচীন কালের প্রত্ন-নিদর্শনে তত বেশি পাওয়া যায় না। কাজেই লিঙ্গ-শিব-রুদ্রের মিশ্রণ অপেক্ষাকৃত আধুনিক।’– (ভূমিকা, লিঙ্গ পুরাণ, পৃষ্ঠা-৯)
তার মানে, লিঙ্গের সাথে শিবের সম্বন্ধ যেভাবেই ঘটুক, দেবতা হিসেবে শিবের চরিত্র ও রূপ-কল্পনায় বৈদিক রুদ্রের বৈশিষ্ট্য এক হয়ে মিশে গেছে বলেই পণ্ডিতদের ধারণা। এভাবে ঋগ্বেদের রুদ্র পরবর্তীকালের শিবের সঙ্গে অভিন্ন বলে ঘোষিত হলেও তিনি একটি পৃথক ধারার প্রতিনিধিত্ব করেন। আমরা দেখতে পাই, ঋগ্বেদে রুদ্র হলেন অন্তরীক্ষের দেবতা। রুদ্রকে উদ্দেশ্য করে ঋগ্বেদে মাত্র তিনটি স্বতন্ত্র সূক্ত রয়েছে। তবে দেবতা হিসেবে ঋগ্বেদে তাঁর বিশেষ প্রাধান্য না থাকলেও রুদ্রের পরিকল্পনায় বিবিধ বৈচিত্র্যের পরিচয় পাওয়া যায়। কোথাও তিনি উগ্র, ক্রোধপরায়ণ ও পশুর ন্যায় ভয়ঙ্কর, এবং এই রূপেই বিস্তীর্ণ জগতের রক্ষাকর্তা। যেমন–
হবীমভি র্র্হভতে যো হবির্ভিরব স্তোমেভী রুদ্রং দিষীয়।
ঋদূদরঃ সুহবো মা নো অস্যৈ বভ্রুঃ সুশিপ্রো রীরধন্মনায়ৈ।। (ঋগ্বেদ-২/৩৩/৫)।
স্থিরেভিরঙ্গৈঃ পুরুরূপ উগ্রো বভ্রুঃ শুক্রেভিঃ পিপিশে হিরণ্যৈঃ।
ঈশানাদস্য ভুবনস্য ভুরে র্ন বা উ যোষদ্রুদ্রাদসূর্যম্ ।। (ঋগ্বেদ-২/৩৩/৯)।
অর্হন্ বিভর্ষি সায়কানি ধন্বার্হন্নিষ্কং যজতং বিশ্বরূপম্ ।
অর্হন্নিদং দয়সে বিশ্বমভ্বং ন বা ওজীয়ো রুদ্রত্বদস্তি।। (ঋগ্বেদ-২/৩৩/১০)।
স্তুহি শ্রতং গর্তসদং যুবানং মৃগং ন ভীমমুপহত্নুমুগ্রম্ ।
মৃলা জরিত্রে রুদ্র স্তবানোহন্যং তে অস্মন্নি বপন্তু সেনাঃ।। (ঋগ্বেদ-২/৩৩/১১)।
অর্থাৎ :
যে রুদ্র হব্য সম্বলিত আহ্বানদ্বারা আহুত হন, আমি স্তোত্রদ্বারা তাঁকে অপগত-ক্রোধ করব। কোমলোদর, শোভন আহ্বানবিশিষ্ট বভ্রুবর্ণ ও সুনাসিক রুদ্র আমাদের যেন তাঁর জিঘাংসাবৃত্তির বিষয়ীভূত না করেন। (ঋক-২/৩৩/৫)।। দৃঢ়াঙ্গ, বহুরূপ, উগ্র ও বভ্রুবর্ণ রুদ্র দীপ্ত হিরণ্ময় অলঙ্কারে শোভিত হচ্ছেন। রুদ্র সমস্ত ভুবনের অধিপতি এবং ভর্তা, তাঁর বল পৃথককৃত হয় না। (ঋক-২/৩৩/৯)।। হে অর্চনার্হ ! তুমি ধনুর্বাণধারী; হে অর্চনার্হ ! তুমি নানারূপবিশিষ্ট ও পূজনীয় নিষ্ক ধারণ করেছ; হে অর্চনার্হ ! তুমি সমস্ত বিস্তীর্ণ জগৎকে রক্ষা করছ, তোমা অপেক্ষা অধিক বলবান আর কেউ নেই। (ঋক-২/৩৩/১০)।। হে স্তোতা ! প্রখ্যাত রথস্থিত, যুবা, পশুর ন্যায় ভয়ঙ্কর ও শত্রুদের বিনাশক, উগ্র রুদ্রকে স্তব কর। হে রুদ্র ! আমরা স্তব করলে তুমি আমাদের সুখী কর, তোমার সেনা শত্রুকে বিনাশ করুক। (ঋক-২/৩৩/১১)।।
আবার কোন কোন দৃষ্টান্তে রুদ্রের স্তুতি সুস্পষ্ট আতঙ্কজনিত বলেই প্রতীয়মান হয়। তাই ঋগ্বেদে বারবার এরকম প্রার্থনা উচ্চারিত হতে দেখা যায়–
মা নো মহান্তমুত মা নো অর্ভকং মা ন উক্ষন্তমুত মা না উক্ষিতম্ ।
মা নো বধীঃ পিতরং মোত মাতরং মা নঃ প্রিয়াস্তন্বো রুদ্র রীরিষঃ।। (ঋগ্বেদ-১/১১৪/৭)।
মা নস্তোকে তনয়ে মা ন আয়ৌ মা নো গোষু মা নো অন্বেষু রীরিষঃ।
বীরাদ্মা নো রুদ্রং ভামিতো বধী র্হবিষ্মন্তঃ সর্দামত্ত্বা হবামহে।। (ঋগ্বেদ-১/১১৪/৮)।
আরে তে গোঘ্নমুত পুরুষঘ্নং ক্ষয়দ্বীর সুম্নমস্মে তে অস্তু।
মৃলা চ নো অধি চ ব্রুহি দেবাধা চ নঃ শর্ম যচ্ছ দ্বিবর্হাঃ।। (ঋগ্বেদ-১/১১৪/১০)।
অর্থাৎ :
হে রুদ্র ! আমাদের মধ্যে বৃদ্ধকে বধ করো না, বালককে বধ করো না, সন্তান জনয়িতাকে বধ করো না, গর্ভস্থ সন্তানকে বধ করো না, আমাদের পিতাকে বধ করো না, মাতাকে বধ করো না, আমাদের শরীরে আঘাত করো না। (ঋক-১/১১৪/৭)।। হে রুদ্র ! আমাদের পুত্রকে হিংসা করো না; তার পুত্রকে হিংসা করো না, আমাদের অন্য মানুষকে হিংসা করো না, আমাদের গো ও অশ্ব হিংসা করো না। হে রুদ্র ! ক্রুদ্ধ হয়ে আমাদের বীরদের হিংসা করো না, কেননা আমরা হব্য নিয়ে সর্বদাই তোমাকে আহ্বান করি। (ঋক-১/১১৪/৮)।। হে বীরগণের ক্ষয়কারক ! তোমার কৃত গোহত্যা ও মানুষহত্যা দূরে থাকুক, আমরা যেন তোমার দত্ত সুখ পাই। আমাদের সুখী কর, হে দীপ্তিমান রুদ্র ! আমাদের পক্ষ হয়ে কথা বলো, তুমি উভয় পৃথিবীর স্বামী, আমাদের সুখ দাও। (ঋক-১/১১৪/১০)
চলবে........
সংযোগেঃ
রতন কর্মকার
বৈদিক সাহিত্য শিব
(২য় পর্ব)
এ-প্রেক্ষিতে ড. উদয়চন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রণিধানযোগ্য বক্তব্যটি হলো,– ‘লৌকিক শিবের মধ্যে বৈদিক রুদ্র ভাবনা এক সময় মিশে গিয়েছিল। অন্যভাবে বলা যায় যে বৈদিক রুদ্রই শিবেতে মিশেছেন। প্রকৃতির ধ্বংসাত্মক মূর্তিকে ঋগ্বেদে রুদ্র বলা হয়েছে। আকাশের বিদ্যুৎ তাঁর হাতের বাণ, ধ্বংসাত্মক মরুতেরা তাঁর পুত্র (মরুৎদের তাই ঋক্ সংহিতায় ‘রুদ্রিয়াসঃ’ বলা হয়েছে। ঋ.সং. ১/৩৮/৭; ১/৬৪/২; ১/১১৪/৬; ২/৩৪/১০ ইত্যাদি মন্ত্র দ্রষ্টব্য।) শুধু তাই নয়– মহামারী, রোগ, বিষ ইত্যাদি অনিষ্টকারক সব কিছুর সঙ্গেই রুদ্রকে যুক্ত করা হয়েছে। এই দেবতাকে আর্যরা এত ভয় পেতেন যে এনার নাম পর্য্যন্ত উচ্চারণ করতে নিষেধ করা হয়েছে, এবং সেজন্য বেদ মন্ত্রকে বিকৃত ভাবে উচ্চারণের বিধানও দেওয়া হয়েছে। লৌকিক ধর্মে গণেশ এবং শনিদেবতা সম্পর্কে এরূপ বিধান পাওয়া যায়। বিঘ্নের দেবতা গণেশকে পুরাণে ভিন্ন নামে অভিহিত করা হয়েছে (যাজ্ঞবল্ক্য সংহিতা দ্রষ্টব্য)। শনিকেও একই কারণে ‘বারের ঠাকুর’ বলা হয়। এই সব লৌকিক দেবতাকে লোকে যেমন ভয়ে পূজা করে, তেমনি রুদ্রকেও ভয়ে স্তুতি করা হত। এই কারণেই হয়তো ঋগ্বেদে রুদ্রের স্তুতি অত্যন্ত কম। রুদ্র দেবতা বৈদিক সাহিত্যের মধ্যে যজুর্বেদে একটা বিরাট স্থান অধিকার করেছেন।’– (ভূমিকা/ লিঙ্গ পুরাণ, পৃষ্ঠা-১৩)
তবে রুদ্রের একটি কল্যাণের দিকও আছে। ঋগ্বেদে তিনি সর্বশ্রেষ্ঠ ভিষক রূপে খ্যাত। তাই তিনি শুধুই আতঙ্ক-নিরসনের আশায় নয়, পার্থিব কল্যাণ-কামনায়, বিশেষ করে রোগ-নিরাময়কারক ওষধি প্রভৃতির কামনায়ও স্তুত হয়েছেন। যেমন–
মূলা নো রুদ্রোত নো ময়ষ্কৃধি ক্ষয়দ্বীরায় নমসা বিধেম তে।
যচ্ছং চ যোশ্চ মনুরায়েজে পিতা তদশ্যাম তব রুদ্র প্রণীতিষু।। (ঋগ্বেদ-১/১১৪/২)।
কুমারশ্চিৎ পিতরং বন্দমানং প্রতি নানাম রুদ্রোপয়ন্তম্ ।
ভূরে র্দাতারং সৎপতি গৃণীষে স্তুভস্ত্বং ভেষজা রাস্যস্মে।। (ঋগ্বেদ-২/৩৩/১২)।
যা বো ভেষজা মরুতঃ শুচীনি যা শন্তমা বৃষণো যা ময়োভু।
যানি মনুরবৃণীতা পিতা নস্তা শঞ্চ যোশ্চ রুদ্রস্য রশ্মি।। (ঋগ্বেদ-২/৩৩/১৩)।
ত্বাদত্তেভি রুদ্র শন্তমেভিঃ শতং হিমা অশীয় ভেষজেভিঃ।
ব্যস্মদ্দ্বেষো বিতরং ব্যংহো ব্যমীবাশ্চাতয়স্বা বিষূচীঃ।। (ঋগ্বেদ-২/৩৩/২)।
অর্থাৎ :
হে রুদ্র ! তুমি সুখী হও, আমাদের সুখী কর; তুমি বীরদের ক্ষয়কারী, আমরা নমস্কারের সাথে তোমার পরিচর্যা করি। পিতা মনু যে রোগসমূহ হতে উপশম ও ভয়সমূহ হতে উদ্ধার পেয়েছিলেন, হে রুদ্র ! তোমার উপদেশ হতে যেন আমরা তা পাই। (ঋক-১/১১৪/২)।। পিতা আশির্বাদ করবার সময় পুত্র যেরূপ তাঁকে নমস্কার করে, সেরূপ হে রুদ্র ! তুমি আসবার সময় আমরা তোমাকে নমস্কার করছি। হে রুদ্র ! তুমি বহুধনদাতা এবং সাধুলোকের পালক, আমরা স্তব করলে আমাদের ঔষধ প্রদান কর। (ঋক-২/৩৩/১২)।। হে মরুৎগণ ! তোমাদের যে নির্মল ঔষধ আছে, হে অভীষ্টবর্ষিগণ, তোমাদের যে ঔষধ অত্যন্ত সুখকর ও সুখপ্রদ, যে ঔষধ আমাদের পিতা মনু মনোনীত করেছিলেন, রুদ্রের সে সুখকর ভয়হারী ঔষধ আমরা কামনা করছি। (ঋক-২/৩৩/১৩)।। হে রুদ্র ! আমরা যেন তোমার দত্ত সুখকর ওষধিদ্বারা শতবর্ষ জীবিত থাকতে পারি। তুমি আমাদের শত্রুগণকে বিনাশ কর, আমার পাপ একেবারে বিদূরিত কর এবং সর্বশরীরব্যাপী ব্যাধিপুঞ্জকে বিদূরিত কর। (ঋক-২/৩৩/২)।।
ঋগ্বেদের নানা জায়গায় রুদ্রের সঙ্গে মরুৎগণের উল্লেখ থেকে বোঝা যায় রুদ্রের সঙ্গে মরুৎগণের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। মরুৎগণও অন্তরীক্ষের দেবতা, তবে একটি দেবতা নন– একদল দেবতা, এবং সর্বত্রই দল হিসেবে তাঁদের উল্লেখ। এই কারণে তাঁদের নামের সঙ্গে ‘গণ’ শব্দ সংযুক্ত। বিভিন্ন সূক্তে রুদ্রকে মরুৎগণের পিতা হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন–
উপ তে স্তোমান্ পশুপা ইবাকরং রাস্বা পিতর্মরুতাং সুম্মমস্মে।
ভদ্রা হি তে সুমতি র্মৃলয়ত্তমাথা বয়মব ইত্তে বৃণীমহে।। (ঋগ্বেদ-১/১১৪/৯)।
আ তে পিতর্মরুতাং সুম্নমেতু মা নঃ সূর্যস্য সন্দৃশো যুযোথাঃ।
অভি নো বীরো অর্বতি ক্ষমেত প্র জায়েমহি রুদ্র প্রজাভিঃ।। (ঋগ্বেদ-২/৩৩/১)।
ইদং পিত্রে মরূতামুচ্যতে বচঃ স্বাদোঃ স্বাদীয়ো রুদ্রায় বর্ধনম্ ।
রাস্বা নো অমৃত মর্তভোজনং ত্বনে তোকায় তনয়ায় মৃল।। (ঋগ্বেদ-১/১১৪/৬)।
অর্থাৎ :
পশুপালক যেরূপ সায়ংকালে পশুস্বামীদের তাদের পশু ফিরিয়ে দেয়, হে রুদ্র ! আমি সেরূপ তোমার স্তোত্র তোমাকে অর্পণ করছি। হে মরুৎগণের পিতা ! আমাদের সুখ দান কর, তোমার অনুগ্রহ অতিশয় সুখকর এবং কল্যাণকর, আমরা তোমার ক্ষণ প্রার্থনা করি। (ঋক-১/১১৪/৯)।। হে মরুৎগণের পিতা (রুদ্র) ! তোমার প্রদত্ত সুখ আমাদের নিকট আসুক, তুমি সূর্য দর্শন হতে আমাদের পৃথক করো না, আমাদের বীর পুত্রগণ শত্রুদের অভিভূত করুক। হে রুদ্র ! আমরা যেন পুত্র পৌত্রাদিতে অনেক হয়ে উঠি। (ঋক-২/৩৩/১)।। মধু হতেও অধিক মধুর এ স্তুতি বাক্য মরুৎগণের পিতা রুদ্রের উদ্দেশে উচ্চারিত হচ্ছে, এতে (স্তোতার) বৃদ্ধি সাধন হয়। হে মরণরহিত রুদ্র ! মনুষ্যদের ভোজনরূপ অন্ন আমাদের প্রদান কর এবং আমাকে আমার পুত্রকে ও তার তনয়কে সুখ দান কর। (ঋক-১/১১৪/৬)
চলবে......
সংযোগেঃ
রতন কর্মকার
বৈদিক সাহিত্যে শিব
(৩য় পর্ব)
ঋগ্বেদের অন্যত্র রুদ্র-পুত্র অর্থে মরুৎগণকে ‘রুদ্রাসঃ’ বলা হয়েছে এবং কোথাও আবার ‘রুদ্রিয়গণ’ হিসেবে স্তুত হয়েছে। যেমন–
নহি বঃ শত্রু র্বিবিদে অধি দ্যবি ন ভূম্যাং রিশাদসঃ।
যুষ্মাকমস্তু তবিষী তনা যুজা রুদ্রাশো নু চিদাধৃষে।। (ঋগ্বেদ-১/৩৯/৪)।
সত্যং ত্বেষা অমবস্তো ধন্বঞ্চিদা রুদ্রিয়াসঃ। মিহং কৃণ¦স্ত্যবাতাম্ ।। (ঋগ্বেদ-১/৩৮/৭)।
চিত্রং তদ্বো মরুতো ষাম চেকিতে পৃশ্ন্যা যদুধরপ্যাপয়ো দুহুঃ।
যদ্বা নিদে নবমানস্য রুদ্রিয়াস্ত্রিতং জরায় জুরতামদাভ্যাঃ।। (ঋগ্বেদ-২/৩৪/১০)।
অর্থাৎ :
হে শত্রুহিংসক মরুৎগণ ! দ্যুলোকে তোমাদের শত্রু নেই, পৃথিবীতেও নেই। হে রুদ্রপুত্রগণ ! তোমরা একত্রিত হও, (শত্রুদের) ধর্ষণার্থে তোমাদের বল শীঘ্র বিস্তৃত হোক। (ঋক-১/৩৯/৪)।। দীপ্তিমান ও বলবান রুদ্রীয়গণ সত্যই মরুভূমিতেও বায়ুরহিত বৃষ্টি দান করেন। (ঋক-১/৩৮/৭)।। হে মরুৎগণ; তোমরা যখন পৃশ্নির উধঃ দোহন করেছিলে, যখন স্তুতিকারীর নিন্দুককে হিংসা করেছিলে এবং ত্রিতের শত্রুদের বধ করেছিলে, হে অহিংসনীয় রুদ্রপুত্রগণ ! সে সময়ে তোমাদের বিচিত্র ক্ষমতা সকলেই জেনেছিল। (ঋক-২/৩৪/১০)।।
আবার ঋগ্বেদের অন্যত্র এই মরুৎগণকে ‘পৃশ্নিমাতরঃ’ অর্থাৎ পৃশ্নি মাতার সন্তান হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এবং কোথাও কোথাও মরুৎগণের মাতা পৃশ্নি উল্লেখও রয়েছে। যেমন–
বিশ্বান্দেবান্ হবামহে মরুতঃ সোমপীতয়ে। উগ্রা হি পৃশ্নিমাতরঃ।। (ঋগ্বেদ-১/২৩/১০)।
দ্যাবো ন স্তৃভিশ্চিতয়ন্ত খাদিনো ব্যভ্রিয়া ন দ্যূতয়ন্ত বৃষ্টয়ঃ।
রুদ্রো যদ্বো মরুতো রু´বক্ষসো বৃষাজনি পৃশ্ন্যাঃ শক্র ঊধনি।। (ঋগ্বেদ-২/৩৪/২)।
প্র যে মে বংধ্বেষে গাং বোচন্ত সূরয়ঃ পৃশ্নিং বোচন্তে মাতরম্ ।
অধা পিতরমিষ্মিণং রুদ্রং বোচন্ত শিক্বসঃ।। (ঋগ্বেদ-৫/৫২/১৬)।
অজ্যেষ্ঠাসো অকনিষ্ঠাস এতে সংভ্রাতরো বাবৃধূঃ সৌভগায়।
যুবা পিতা স্বপা রুদ্র এষাং সুদুঘা পৃশ্নিঃ সুদিনা মরুদ্ভ্যঃ।। (ঋগ্বেদ-৫/৬০/৫)।
অর্থাৎ :
সমস্ত মরুৎ দেবগণকে সোমপানার্থে আহ্বান করি, তাঁরা উগ্র ও পৃশ্নির সন্তান। (ঋক-১/২৩/১০)।। হে সুবর্ণবক্ষ মরুৎগণ ! যেহেতু সেচন সমর্থ রুদ্র পৃশ্নির নির্মল উদরে তোমাদের উৎপন্ন করেছেন; অতএব আকাশ যেরূপ নক্ষত্রে শোভিত হয়, তোমরা সেরূপ স্বীয় আভরণে শোভিত হও। তোমরা শত্রভক্ষক ও জলপ্রেরক, তোমরা মেঘস্থ বিদ্যুতের ন্যায় শোভিত হও। (ঋক-২/৩৪/২)।। আমি তাদের উৎপত্তিক্রম অনুসন্ধান করায়, জ্ঞানী মরুৎগণ আমাকে এ উত্তর দিয়েছেন; তাঁরা বলেছেন পৃশ্নি তাদের জননী, বলশালী মরুৎগণ বলেছেন অন্নদাতা রুদ্র তাঁদের জনক। (ঋক-৫/৫২/১৬)।। এ সমস্ত মরুৎ এক সময়ে উৎপন্ন, সুতরাং পরস্পর জ্যেষ্ঠ-কনিষ্ঠভাব বর্জিত হয়ে ভ্রাতৃভাবে ও সমৃদ্ধি সহকারে বর্ধিত হয়েছেন। নিত্যতরুণ, সৎকর্মের অনুষ্ঠানকারী মরুৎগণের পিতা রুদ্র ও জননী দোহনযোগ্যা পৃশ্নি মরুৎগণের নিমিত্ত দিন সকল অনুকুল করুন। (ঋক-৫/৬০/৫)।।
ঋগ্বেদ অনুসারে পৃশ্নি একটি গরুর নাম। ফলে মরুৎগণকে ‘গোমাতরঃ’ বলেও বর্ণনা করা হয়েছে। যেমন–
স বহ্নিঃ পুত্রঃ পিত্রোঃ পবিত্রবান্ পুনাতি ধীরো ভুবনানি মায়য়া।
ধেনুঞ্চ পৃশ্নিং বৃষভঃ সুরেতসং বিশ্বাহা শুক্রং পয়ো অস্য দুক্ষত।। (ঋগ্বেদ-১/১৬০/৩)।
গোভির্বাণো অজ্যতে সোভরীণাং রথে কোশে হিরণ্যয়ে।
গোবন্ধবঃ সুজাতাস ইষে ভুজে মহান্তো নঃ স্পরসে নু।। (ঋগ্বেদ-৮/২০/৮)।
অর্থাৎ :
আদিত্য পিতা মাতা স্বরূপ দ্যাবাপৃথিবীর পুত্র। তিনি ধীর এবং ফলপ্রদায়ী তিনি স্বীয় প্রজ্ঞাদ্বারা সমস্ত ভূতগণকে প্রকাশ করছেন। তিনি পৃশ্নি ধেনু ও সেচন সমর্থ বৃষকে প্রকাশ করছেন ও দ্যুলোক হতে নির্মল জল দোহন করছেন। (ঋক-১/১৬০/৩)।। সোভরি ঋষিগণের শব্দদ্বারা হিরণ্ময় রথের মধ্যদেশে মরুৎগণের বাণ ব্যক্ত হচ্ছে। গোমাতৃক সুজন্মা, মহানুভব মরুৎগণ আমাদের অন্ন ভোগ ও প্রীতিপ্রদ হোন। (ঋক-৮/২০/৮)।।
কিন্তু মরুৎগণকে গোমাতৃক জাতীয় পৌরাণিক কল্পনার কারণ কী হতে পারে? ‘পৃশ্নি’ অর্থ হলো নানা বর্ণযুক্ত। তাহলে নানা বর্ণযুক্তা মরুৎগণের এই মাতা কে? বেদ-টীকাকার সায়ণের ভাষ্যে পৃশ্নি অর্থ পৃথিবী। আবার কোথাও তিনি ‘পৃশ্নি’ শব্দের অর্থ শুক্লবর্ণ করেছেন। কিন্তু প্রাচীন সংস্কৃত অভিধান ‘নিঘণ্টু’ অনুযায়ী পৃশ্নি অর্থে আকাশ। তবে আধুনিক পণ্ডিত গবেষকরা অনুমান করতে চেয়েছেন, বৈদিক কবিরা এখানে আকাশের বৃষ্টিদায়িনী মেঘকে দুগ্ধদায়িনী গরুর সঙ্গে তুলনা করেছেন, অতএব গোমাতৃক অর্থে মরুৎগণ প্রকৃতপক্ষে মেঘতনয় বলেই কল্পিত। কিন্তু মনে রাখা দরকার যে, সুবিশাল ঋগ্বেদ সাহিত্যে বহু কবি বহুভাবে এই দেবতাদের নিয়ে বহু কল্পনা করেছেন; তাই মরুৎগণের উৎপত্তি-প্রসঙ্গে কোন এক অদ্বিতীয় সিদ্ধান্তের সাহায্যে সমস্ত নজিরের পর্যাপ্ত ব্যাখ্যা পাওয়া সুকঠিন। কেননা, এই মরুৎগণই কোথাও ‘সিন্ধু-মাতরঃ’ বলে কল্পিত, আবার বর্ণনা-বিশেষে তাঁরা কোথাও ‘স্বয়ং-উৎপন্ন’ কিংবা কোথাও ‘স্বর্গ-তনয়’ হিসেবেও কল্পিত হয়েছেন।
চলবে......
সংযোগেঃ
রতন কর্মকার
বৈদিক সাহিত্য শিব
(৪র্থ পর্ব)
গ্রাবাণো ন সূরয়ঃ সিন্ধুমাতর আদর্দিরাসো অদ্রয়ো ন বিশ্বহা।
শিশুলা ন ক্রীলয়ঃ সুমাতরো মহাগ্রামো ন যামন্নুত ত্বিষা।। (ঋগ্বেদ-১০/৭৮/৬)।
বব্রাসো ন যে স্বজাঃ স্বতবস ইষং স্বরভিজায়ন্ত ধূতয়ঃ।
সহস্রিয়াসো অপাং নোর্ময় আসা গাবো বন্দ্যাসো নোক্ষশঃ।। (ঋগ্বেদ-১/১৬৮/২)।
শ্রিয়ে মর্যাসো অঞ্জীরকৃণ্বত সুমারুতং ন পূর্বীরতি ক্ষপঃ।
দিবস্পুত্রাস এতা ন যেতির আদিত্যাসস্তে অক্রা ন বাবৃধুঃ।। (ঋগ্বেদ-১০/৭৭/২)।
অর্থাৎ :
জল প্রেরণকারী মেঘের ন্যায় সিন্ধুমাতার সন্তানেরা (মরুৎগণ) নদী নির্মাণ করেন। বিদীর্ণকারী অস্ত্রশস্ত্রের ন্যায় সকলি তাঁরা ধ্বংস করেন। বৎসল মাতার শিশুদের ন্যায় তাঁরা ক্রীড়া করেন। বহুলোকসমূহের ন্যায় তাঁরা দীপ্তিসহকারে গমন করেন। (ঋক-১০/৭৮/৬)।। স্বয়ং-উৎপন্ন, স্বাধীনবল, কম্পনশীল মরুৎগণ যে মূর্তিমান হয়ে অন্ন ও স্বর্গের জন্য প্রাদুর্ভূত হচ্ছেন। অসংখ্য এবং প্রশংসনীয় ধেনু যেরূপ দুগ্ধদান করে, জলোর্মির ন্যায় তাঁরা সেরূপ হয়ে জলদান করেন। (ঋক-১/১৬৮/২)।। এ মরুৎগণ পূর্বে মনুষ্য ছিলেন, পুণ্যদ্বারা দেবতা হয়েছেন, এরা শরীর শোভার্থে অলঙ্কার ধারণ করেন। বিস্তর সৈন্য একত্র হয়েও মরুৎগণকে অতিক্রম করতে পারে না। আমরা এখনও স্তব করি নি বলে এ সকল দ্যুলোকের পুত্রগণ অর্থাৎ মরুৎগণ এখনও দেখা দেন নি, মহাবল পরাক্রান্ত এ সকল অদিতি সন্তানগণ এখনও বৃদ্ধিযুক্ত হন নি। (ঋক-১০/৭৭/২)।।
তবে বৈদিক কবিদের এই কল্পনা যত বিচিত্রই হোক না কেন, রুদ্রের সাথে গরু বা গো-মাতার সম্পর্ক এবং পরবর্তীকালের শিব-কল্পনায় শিবের বাহন বা লাঞ্ছন হিসেবে যে গরু তথা বৃষ বা বলীবর্দের উপস্থিতি রয়েছে, কিংবা শিবের অন্যতম প্রধান অনুচর নন্দী যে মূলত বৃষ-কল্পনা সেটিও বিবেচনায় রাখা আবশ্যক। কেননা, বৃষের সঙ্গে শিবের সম্পর্ক অত্যন্ত প্রাচীন। এক্ষেত্রে স্মরণীয় যে, প্রাগৈতিহাসিক সিন্ধু সভ্যতার ধ্বংসাবশেষের মধ্যে যোগী শিবের মূর্তির সঙ্গে বৃষমূর্তিও আবিষ্কৃত হয়েছে। তাছাড়া ঋগ্বেদের একাধিক মন্ত্রেও বৃষের সঙ্গে রুদ্রের যে সম্পর্কের কথা পাওয়া যায়, কয়েকটি ক্ষেত্রে রুদ্রকেই বলা হয়েছে বৃষভ। যেমন–
উন্মা মমন্দ বৃষভো মরুত্বান্ত্বক্ষীয়সা বয়সা নাধমানম্ ।
ঘৃণীব ছায়ামরপা অশীয়া বিবাসেয়ং রুদ্রস্য সুম্নম্ ।। (ঋগ্বেদ-সংহিতা-২/৩৩/৬)
অর্থাৎ : আমি প্রার্থনা করছি, অভীষ্টবর্ষী (বৃষভ) মরুৎবিশিষ্ট রুদ্র আমাকে দীপ্ত অন্নদ্বারা তৃপ্ত করুন। রৌদ্রতপ্ত ব্যক্তি যেরূপ ছায়া লাভ করে, আমি সেরূপ পাপশূন্য হয়ে রুদ্রদত্ত সুখ লাভ করব এবং রুদ্রের পরিচর্যা করব।
এখানে বৃষভ-এর বেদার্থে অভীষ্টবর্ষী বলা হয়েছে। এ-প্রেক্ষিতে ড. উদয়চন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন,– ‘কাম্যবস্তুর বর্ষক হিসাবে বৃষভ শব্দটিকে টীকাকারেরা ব্যাখ্যা করেছেন। অনেকে মনে করেন যে রুদ্রের বৃষভ বা ষাঁড় রূপের কথাই এখানে বলতে চাওয়া হয়েছে। দেবতাদের পশুরূপ কল্পনার ইতিহাস অতি প্রাচীন। হয়তো এর মধ্যে টোটেম বিশ্বাস বা অন্য কোন প্রকার বিশ্বাসের কথাও লুকিয়ে আছে। পরবর্তী কালের ইতিহাসে পূজিত পশুরা বিভিন্ন দেবতার সঙ্গে সংযুক্ত হয়েছেন এবং তাঁদের বাহনে পর্য্যবসিত হয়েছেন। বৃষভও এভাবেই শিবের বাহনে পরিণত হয়েছেন অনেক পরে।’
এছাড়া দেবতার বাহনদের বিবর্তন প্রসঙ্গে তিনি বলেন,– ‘প্রসঙ্গত বলা চলতে পারে যে শতপথ ব্রাহ্মণ ইত্যাদি গ্রন্থে রুদ্রের পশু হিসাবে আখু বা ইঁদুরের উল্লেখ আছে। এই পশুটি ছেদনের প্রতীক বা ধ্বংসের প্রতীক। শিবের পুত্র হিসাবে পরবর্তী পুরাণাদি সাহিত্যে গণেশ এই বাহনকে লাভ করেছিলেন।’– (ভূমিকা/ লিঙ্গ পুরাণ, পৃষ্ঠা-৯)
ঋগ্বেদের পর যজুর্বেদের শতরুদ্রীয় নামক অংশে (যেখানে রুদ্রের শতনাম কীর্তিত আছে) তাঁর চরিত্রের প্রভূত বিকাশ দেখতে পাওয়া যায়। এই নামগুলির মধ্যে কয়েকটি তাঁর উগ্র রূপ ব্যঞ্জনা করে, কয়েকটি আবার তাঁর মঙ্গলময় সত্তার দ্যোতক। এই দুই রূপ তাঁর ঘোর ও শিব বা শান্ত তনু। যেমন, কৃষ্ণযজুর্বেদ বা তৈত্তিরীয়-সংহিতার চতুর্থ কাণ্ডের পঞ্চম প্রপাঠকের প্রথম মন্ত্রে বলা হয়েছে–
নমস্তে রুদ্র মন্যব উতো ত ইষবে নমঃ। নমস্তে অস্তু ধন্বনে বাহুভ্যামুত তে নমঃ। যা ত ইষুঃ শিবতমা শিবং বভূব তে ধনুঃ। শিবা শরব্যা যা তব তয়া নো রুদ্র মৃড়য়। যা তে রুদ্র শিবা তনূরঘোরাহপাপকাশিনী তয়া নস্তনুবা শন্তময়া গিরিশন্তাভি চাকশীহি। যামিষুম্ গিরিশন্ত হস্তে বিভর্ষ্যস্তবে। শিবাং গিরিত্র তাং কুরু মা হিংসীঃ পুরুষং জগৎ। শিবেন বচসা ত্বা গিরিশাচ্ছা বদামসি। যথা নঃ সর্ব্বমিজ্জগদযক্ষ্মং সুমনা অসৎ। অধ্যবোচদধিবক্তা প্রথমো দৈব্যো ভিষক্ । অহীংশ্চ সর্ব্বান্ জম্ভয়ন্ৎ সর্ব্বাশ্চ যাতুধান্যঃ। অসৌ যস্তাম্রো অরুণ উত বভ্রুঃ সুমঙ্গলঃ। যে চেমাং রুদ্রা অভিতো দিক্ষু শ্রিতাঃ সহস্রশোহবৈষাং হেড় ঈমহে। অসৌ যোহবসর্পতি নীলগ্রীবো বিলোহিতঃ। উতৈনং গোপা অদৃশন্নদৃশন্নুদহার্য্যঃ উতৈনং বিশ্বা ভূতানি স দৃষ্টো মৃড়য়াতি নঃ। নমো অস্তু নীলগ্রীবায় সহস্রাক্ষায় মীঢুষে। অথো যে অস্য সত্বানোহহং তেভ্যোহকরং নমঃ। প্র মুঞ্চ ধন্বনস্ত্বমুভয়োরার্ত্নিয়োর্জ্জ্যাম্ । যাশ্চ তে হস্ত ইষবঃ পরা তা ভগবো বপ। অবতত্য ধনুস্ত্বং সহস্রাক্ষ শতেষুধে। নিশীর্ষ্য শল্যানাং মুখা শিবো নঃ সুমনা ভব। বিজ্যং ধনুঃ কপর্দ্দিনো বিশল্যো বাণবাম্ উত। অনেশন্নস্যেষব আভুরস্য নিষঙ্গথিঃ। যা তে হেতির্মীঢুষ্টম হস্তে বভূব তে ধনুঃ। তয়াহস্মান্বিশ্বতস্ত্বমযক্ষ্ময়া পরি বূভুজ। নমস্তে অস্ত্বায়ুধায়ানাততায় ধৃষ্ণবে। উভাভ্যামুত তে নমো বাহুভ্যাং তব ধন্বনে। পরি তে ধন্বনো হেতিরস্মান্বৃণক্তু বিশ্বতঃ। অথো য ইষুধিস্তবারে অস্মন্নি ধেহি তম্ ।। (তৈত্তিরীয়-সংহিতা-৪/৫/১)
অর্থাৎ :
চলবে........
সংযোগেঃ
রতন কর্মকার
বৈদিক সাহিত্য শিব
(৫ম পর্ব)
অর্থাৎ :
হে রুদ্র, তোমার কোপকে নমস্কার করি, তোমার বাণকে নমস্কার করি এবং তোমার ধনুর্বাণ যুক্ত বাহুযুগলকে নমস্কার করি। এগুলি শত্রুর প্রতি প্রবৃত্ত হোক, আমার প্রতি নয়। হে রুদ্র, তোমার যে মঙ্গলময় ইষু আছে, তোমার যে কল্যাণপ্রদ ধনু আছে, এবং যে শান্ত ইষুধি আছে, তাদের দ্বারা আমাদের সুখী কর। হে রুদ্র, তোমার অনুগ্রহকারিণী তনু, আমাদের প্রতি যেন ঘোর রূপ না হয়। হে গিরিশ, তোমার সুখকর রূপ আমাদের কাছে প্রকাশ কর। হে গিরিশ, যে বাণ শত্রুর প্রতি নিক্ষেপের জন্য হস্তে ধারণ করেছ, হে কৈলাস-গিরির পালক রুদ্র, তোমার সে বাণ আমাদের প্রতি শান্ত কর, তোমার বাণ আমাদের পুত্রাদি ও পশুদের যেন হিংসা না করে। হে গিরিশ, তোমাকে পাবার জন্য আমরা মঙ্গলকর স্তূতিরূপ বাক্যের দ্বারা প্রার্থনা করছি, যাতে সকল মানুষ ও গব্যাদি পশু রোগরহিত হয়ে শোভন মন লাভ করে। হে রুদ্র, সকলের ভেতর আমাকে অধিক বল। তুমি দেবতাদের মধ্যে মুখ্য ও তাদের পালনে সক্ষম। ধ্যান মাত্রে সকলের রোগের উপশম কর জন্য তুমি চিকিৎসক। তুমি সর্প, ব্যাঘ্র ও রাক্ষস জাতিদের বিনাশক। আদিত্যরূপ রুদ্র উদয়কালে অত্যন্ত রক্তবর্ণ, উদয়ের পরে নানা বর্ণে অন্ধকারাদির নিবর্তক রূপে অত্যন্ত মঙ্গলরূপ রুদ্রের সহস্র সংখ্যক রশ্মি পূর্বাদি দিকে বিস্তৃত হয়েছে, সে রশ্মিরূপ রুদ্রগণের ক্রোধ-সদৃশ তীক্ষ্ণত্ব ভক্তি ও নমস্কারের দ্বারা আমরা নিবারণ করব। যে রুদ্র কালকূট বিষ ধারণে নীলগ্রীব; সে রুদ্র লোহিত বর্ণরূপে মণ্ডলবর্তী হয়ে উদয় ও অস্ত সম্পন্ন করছেন, সে রুদ্রকে গোপগণ, জল আহরণকারিণী গ্রাম্য রমণীগণ এবং গো-মহিষাদি সকল প্রাণী দর্শন করে। সকলের দর্শন দেবার জন্য রুদ্রদেব আদিত্য মূর্তি ধারণ করেছেন, তার কৈলাসবর্তী রুদ্ররূপ বেদশাস্ত্রে অভিজ্ঞজন দেখে থাকে। সে রুদ্র আমাদের দর্শন দানে সুখী করুন। সে নীলগ্রীব, সহস্রাক্ষ, বৃষ্টিকর্তা রুদ্রকে নমস্কার করছি। এ রুদ্রের দ্বারা ভৃত্য তাদের সকলকে নমস্কার করছি। হে ভগবান রুদ্র, ধনুর্ধারী তোমার ধনুর জ্যা খুলে ফেলে ও তীক্ষ্ণ বাণের ফলাগুলি ইষুধির মধ্যে রেখে আমাদের প্রতি অনুগ্রহপূর্বক শান্ত হও। (তৈত্তিরীয়-সংহিতা-৪/৫/১)
অন্যদিকে রুদ্রের শতনাম কীর্তিত শুক্লযজুর্বেদ বা বাজসনেয়ী-সংহিতার রুদ্রাধ্যায় নামক ষোড়শ অধ্যায়ে নিম্নোক্ত (১৬/১-৫) মন্ত্রে বলা হয়েছে–
নমস্তে রুদ্র মন্যব উতো ত ইষবে নমঃ। বাহুভ্যামুত তে নমঃ।। ১।। যা তে রুদ্র শিবা তনূরঘোরাহপাপকাশিনী তয়া নস্তনুবা শন্তময়া গিরিশন্তাভি চাকশীহি।। ২।। যামিষুম্ গিরিশন্ত হস্তে বিভর্ষ্যস্তবে। শিবাং গিরিত্র তাং কুরু মা হিংসীঃ পুরুষং জগৎ।। ৩।। শিবেন বচসা ত্বা গিরিশাচ্ছা বদামসি। যথা নঃ সর্ব্বমিজ্জগদযক্ষ্মং সুমনা অসৎ।। ৪।। অধ্যবোচদধিবক্তা প্রথমো দৈব্যো ভিষক্ । অহীংশ্চ সর্ব্বান্ জম্ভয়ন্ৎ সর্ব্বাশ্চ যাতুধান্যো হধরাচীঃ পরা সুব।। ৫।। (বাজসনেয়ী-সংহিতা-১৬/১-৫)
অর্থাৎ :
হে দুঃখনাশক জ্ঞানপ্রদ রুদ্র, তোমার ক্রোধের উদ্দেশে নমস্কার, তোমার বাণ ও বাহুযুগলকে নমস্কার করি। ১।। হে রুদ্র, তোমার যে মঙ্গলময়, সৌম্য, পুণ্যপ্রদ শরীর আছে, হে গিরিশ, সে সুখতম শরীরের দ্বারা আমাদের দিকে তাকাও। ২।। হে গিরিশ, শত্রুর প্রতি নিক্ষেপের জন্য তুমি হস্তে যে বাণ ধারণ করেছ, হে প্রাণিগণের ত্রাতা, তা কল্যাণকর কর, পুরুষ ও জগতের হিংসা করো না। ৩।। হে গিরিশ, মঙ্গলময় স্তুতি বাক্যে তোমায় পাবার জন্য প্রার্থনা জানাই যাতে জগতের সকলে নীরোগ ও শোভনমনস্ক হয়। ৪।। হে অধিকবদনশীল, আমায় সর্বাধিক বল, তুমি সকলের পূজ্য ও স্মরণমাত্র দেবগণের হিতকারী ভিষক। হে রুদ্র, সকল সর্প ব্যাঘ্রাদি বিনাশ করে অধোগমনশীল রাক্ষসীদের দূর করে দাও। ৫।।
বাজসনেয়ী সংহিতার শতরুদ্রীয় ১৬ অধ্যায়ের অন্য মন্ত্রগুলি বাহুল্য বিবেচনায় উদ্ধৃত করা হয়নি। তবে এই শতরুদ্রীয় অধ্যায় বর্তমান আলোচনায় গুরুত্বপূর্ণ। কেননা, পরবর্তীকালের পৌরাণিক যুগের দেহী শিবের কল্পনায় যেসব বিচিত্র পৌরাণিক কাহিনীর পরস্পর সমন্বয় ঘটেছে সেগুলির কল্পবীজ যে যজুর্বেদের এসব মন্ত্রের মধ্যে উপ্ত ছিলো তা বোধকরি বলা বাহুল্য হবে না। বেদের রুদ্র যেমন ব্যাধি, মৃত্যু ও অমঙ্গলের কারক, তাঁকে তুষ্ট করলে তিনি সেগুলির প্রতিকারও করেন। ড. উদয়চন্দ্রের ভাষ্যে–
‘রুদ্র দেবতার নামকরণ প্রসঙ্গে বেদ ও বেদাঙ্গে নানা প্রকার কল্পনা করা হয়েছে। বাজসনেয় সংহিতায় তাঁর সম্বন্ধে– ‘উচ্চৈঃ ঘোষঃ’ (১৬/১৯) শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। যাস্ক এখানে থেকেই অনুমান করেন যে গর্জনকারী হলেন রুদ্র– ‘রুদ্রো রৌরীতি সতঃ’ (নিরুক্ত ১০/৫)। বেদ ব্যাখ্যাকার সায়ণাচার্য্য অন্যভাবে রুদ্রকে ব্যাখ্যা করেছেন। তাঁর মতে যিনি অনন্তকাল সকলকে কাঁদান তিনিই রুদ্র– ‘রোদয়তি সর্বমন্তকালে ইতি রুদ্রঃ’ (১/৪৩/১ ঋক্ভাষ্য)। যিনি শত্রুদের কাঁদান তিনি রুদ্র– ‘রুৎ সংসারাখ্যং দুঃখং তং দ্রাবয়তি অপগময়তি বিনাশয়তি ইতি রুদ্রঃ’ (১/১১৪/১ ঋক্ভাষ্য)।
চলবে........
সংযোগেঃ
রতন কর্মকার
বৈদিক সাহিত্য শিব
(পর্বঃ ০৬)
দার্শনিক তত্ত্বের দিক থেকে রুদ্র শব্দকে নির্বাচন করার চেষ্টা সায়ণভাষ্যে পরিলক্ষিত হয়– ‘রুৎ শব্দাত্মিকা বাণী তৎপ্রতিপাদ্যা আত্মবিদ্যা বা তমুপাসকেভ্যো রাতি দদাতি ইতি রুদ্রঃ’ (১/১১৪/১ ঋক্ভাষ্য।) অর্থাৎ রুৎ শব্দের অর্থ শব্দাত্মিকা বাণী বা আত্মবিদ্যা; যিনি উপাসকদের সেই আত্মবিদ্যা দেন তিনিই রুদ্র। ঐ মন্ত্রেরই ভাষ্যে রুদ্র শব্দের আর একটি নির্বচনে বলা হয়েছে– যা আবৃত করে, সেই অন্ধকার হল রুৎ; সেই রুৎ বা অন্ধকারকে বিজারণকারী হলেন রুদ্র (রুণদ্ধি আবৃনোতি ইতি রুৎ অন্ধকারাদি। তৎ দৃণাতি বিদারয়তি ইতি রুদ্রঃ)। এই মতটি তান্ত্রিক বেদভাষ্যকার মহীধরের ভাষ্যের প্রতিধ্বনি। বাজসনেয়ী সংহিতার ১৬/১ মন্ত্রের ভাষ্যে মহীধর রুদ্র সম্পর্কে বলেছেন– ‘বরণৎ রুৎ জ্ঞানং রাতি দদাতি রুদ্রঃ। অথবা পাপিনো নরান্ দুঃখভোগেন রোদয়তি রুদ্রঃ’। রুদ্র নিজে রোদন করেন বলেই তাঁর এরূপ নামকরণ হয়েছিল বলে সায়ণ ১/১১৪/১ ঋক্-মন্ত্রের ভাষ্যে উল্লেখ করেছেন এবং সেই সংক্রান্ত একটি আখ্যায়িকার কথাও বলেছেন।’– (ভূমিকা/ লিঙ্গ পুরাণ, পৃষ্ঠা-১৪)
অথর্ববেদে রুদ্রের কয়েকটি নাম পাওয়া যায় যথা– রুদ্র, শর্ব, উগ্র, ভব, পশুপতি, মহাদেব ও ঈশান। অধ্যাপক জিতেন্দ্রনাথের বর্ণনায়–
‘প্রসঙ্গতঃ উল্লেখযোগ্য যে মহাভারতেও রুদ্র-শিব দেবতার দুই তনুর কথা একটি শ্লোকে বলা হইয়াছে– দ্বে তনূ তস্য দেবস্য ব্রাহ্মণাঃ বেদজ্ঞাঃ বিদুঃ। ঘোরামন্যাং শিবামন্যাং…। অথর্ববেদে রুদ্র দেবতার সাত মুখ্য নাম যথা– রুদ্র, শর্ব, উগ্র, ভব, পশুপতি, মহাদেব এবং ঈশান; দেবতা এই সাতটি নামে বিভিন্ন দিকের প্রাণিগণের সংরক্ষক। এখানে উল্লেখযোগ্য যে ভব নামধারী দেবতা পূর্বদিকের মধ্যভাগে স্থিত আর্যগোষ্ঠী হইতে বহিষ্কৃত ব্রাত্যদিগকে রক্ষা করিয়া থাকেন। শতপথ ব্রাহ্মণে রুদ্র ঊষাদেবীর পুত্র বলিয়া বর্ণিত হইয়াছেন এবং প্রজাপতি এক এক করিয়া তাঁহাকে আটটি নাম প্রদান করেন। অথর্ববেদোক্ত সাতটি নামের সহিত অশনি (বজ্র) নাম যোগ করিয়া তালিকার সংখ্যা পূরণ করা হইয়াছে। ইহাদিগের মধ্যে রুদ্র, শর্ব, উগ্র ও অশনি দেবতার ঘোর রূপ এবং বাকী কয়টি যথা ভব, পশুপতি, মহাদেব এবং ঈশান তাঁহার মঙ্গলময় রূপ ব্যঞ্জনা করে। শতপথ ব্রাহ্মণের কয়েকটি অংশে রুদ্রকে অগ্নির আর এক রূপ বলিয়া বর্ণনা করা হইয়াছে। পূর্বোক্ত আট নাম অগ্নির এবং এই বিভিন্ন নামে দেবতা ভিন্ন ভিন্ন দেশে পরিচিত ছিলেন। পূর্বদেশের লোকেরা তাঁহাকে শর্ব নামে এবং বাহীকেরা তাঁহাকে ভব নামে অভিহিত করিত। রুদ্র সম্বন্ধে এই সকল এবং অন্যান্য শাস্ত্রীয় প্রমাণ আলোচনা করিয়া ইহা অনুমান করা যায় যে এই দেবতার পূর্ণ রূপায়ণে বিভিন্ন সমগোষ্ঠীয় দেবসত্তার সহিত ইঁহার সংমিশ্রণ বিশেষ কার্যকরী হইয়াছিল।’– (পঞ্চোপাসনা, পৃষ্ঠা-১২৬)
‘ঐতরেয়, শতপথ, তাণ্ড্য এবং গোপথ ব্রাহ্মণে প্রজাপতির অগম্যাগমনের জন্য রুদ্রকে তাঁর শাস্তিদাতা-রূপে উল্লেখ করা হয়েছে। শাংখ্যায়ন, কৌষীতকি প্রভৃতি ব্রাহ্মণেও রুদ্রের বিভিন্ন নামের উল্লেখ আছে।’– (নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য/ ভারতীয় ধর্মের ইতিহাস, পৃষ্ঠা-১৯৯)
এক্ষেত্রে ড. উদয়চন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় লিঙ্গ পুরাণের ভূমিকায় (পৃষ্ঠা-১৪-৫) বলছেন,– ‘ঋগ্বেদে বিশেষতঃ যজুর্বেদের বাজসনেয়ী সংহিতায় রুদ্রের একটি প্রসন্ন মূর্তির পরিচয়ও পাওয়া যায়। ঋক্-সংহিতার ১/৪৩/১, ১/১১৪/৫, ২/৩৩/২, ৫/৪২/১১ ইত্যাদি মন্ত্রের বিভিন্ন বিশেষণ এক্ষেত্রে স্মরণীয়। বেদের বিভিন্ন বিশেষণ পর্য্যালোচনা করলে রুদ্রের একটি শরীরী সত্ত্বার পরিচয়ও পাওয়া যায়। ইন্দ্র, অগ্নি ইত্যাদি দেবতার সঙ্গে কোথাও কোথাও রুদ্রকে এক করে দেখাবার চেষ্টা থেকে এবং পরবর্তী পুরাণগুলিতে উল্লিখিত শিবের শতনাম, সহস্র নাম ইত্যাদি পর্যালোচনা করলে বোঝা যায় যে এই দেবতার আড়ালে অনেক লৌকিক ও বৈদিক দেবতা একাত্ম হয়ে গেছেন। এই প্রসঙ্গে স্মরণীয় যে বেদেই সহস্র সহস্র রুদ্রের কথা আমরা পাই।’
‘ঐতরেয় ব্রাহ্মণ ৩/৩/৯, শতপথ ব্রাহ্মণ ১/৭/৪/১-৪ প্রভৃতি অংশে কথিত রুদ্রোৎপত্তির কাহিনী এক্ষেত্রে স্বাভাবিক ভাবেই আমাদের স্মৃতিতে আসে। প্রজাপতি পশুরূপে নিজের কন্যাকে ধর্ষণ করলে দেবতারা রেগে গেলেন এবং তাদের সম্মিলিত ক্রোধ থেকেই রুদ্রের আবির্ভাব হল। রুদ্র বাণাঘাতে প্রজাপতিকে বধ করলেন। (পরবর্তী পুরাণগুলিতে এই কাহিনীকে একটু ভিন্ন ভাবে স্থাপন করা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে যে শিবের ক্রোধ থেকে উৎপন্ন হয়ে বীরভদ্র দক্ষ প্রজাপতিকে বধ করেছেন)। সমস্ত দেবতার তেজ থেকে সম্মিলিত ভাবেই যে কাত্যায়নী দেবীর এভাবেই উৎপত্তি ঘটেছিল তা মার্কণ্ডেয় চণ্ডীতে প্রথম অধ্যায়ে বলা আছে। গীতার একাদশ অধ্যায়ের বিশ্বরূপও সমস্ত দেবতার সম্মিলিত রূপ। এভাবেই সমস্ত দেবতাকে মিলিয়ে দিয়ে একটা বিশ্বদেব কল্পনার প্রক্রিয়া বৈদিক যুগ থেকে শুরু হয়ে পৌরাণিক যুগ হয়ে আধুনিক যুগ পর্য্যন্ত যে সক্রিয় ছিল তাতে সন্দেহ নেই।’
চলবে.........
সংযোগেঃ
রতন কর্মকার
বৈদিক সাহিত্য শিব
(৭ম পর্ব)
বিভিন্ন দেবতাকে একের মধ্যে মিশিয়ে দেবার প্রক্রিয়া যে কেবল মাত্র শৈব কাল্টেই ঘটেছিল এমন নয়, বৈষ্ণব ও শাক্ত কাল্টেও একই প্রকার প্রক্রিয়া আমরা প্রত্যক্ষ করি। ভয়ংকর রুদ্রের প্রসন্ন মূর্তির কথা এবং অঘোর সৌম্য তনুর কথা বাজসনেয়ী সংহিতায় আছে (১৬/২)। এখানেই রুদ্রের শিবতর রূপের কথা আছে এবং দক্ষিণ মুখের কথা আছে। রুদ্রাধ্যায়ে রুদ্রকে ‘ক্ষেম্য’ (১৬/৩৩) বা সমস্ত কুশলের মধ্যে বিদ্যমান বলা হয়েছে। রুদ্রাধ্যায়ে উক্ত ১৬/৪০ মন্ত্রের ‘তার’ নামটি সম্পর্কে ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে উবট এবং মহীধর প্রায় একই প্রকার কথা বলেছেন– সংসার থেকে তরিয়ে দেন বলেই তিনি ‘তার’। এই প্রসঙ্গেই পাঠকের তারক বা তারকেশ্বর নামটি স্মরণে আসতে পারে। রুদ্রের শিবময় তনুর অনেকগুলি রূপের কথাই বাজসনেয়ী সংহিতার নিম্নোক্ত মন্ত্রে পাওয়া যায়– ‘নমঃ শংভবায় চ ময়োভবায় চ নমঃ শংকরায় চ ময়স্করায় চ নমঃ শিবায় চ শিবতরায় চ।’ (বাজসনেয়ী-সংহিতা-১৬/৪১)
ঐতরেয় ব্রাহ্মণে– রুদ্র অত্যন্ত উগ্রস্বভাব এবং দুর্ধর্ষ, তাঁর নাম উচ্চারণ করাও বিপজ্জনক। রুদ্র কথাটা রুদ্ ধাতু থেকে নিষ্পন্ন যার অর্থ রোদন। রোদন করেন বা অন্তিমকালে রোদন করান, ভগিনী অম্বিকা তাঁর ধ্বংসকার্যের সহায়িকা। তিনি রীবগণকে ধ্বংস করেন বলে– ক্ষয়দ্বীয়। হাতে বজ্র তাই– বজ্রবাহু। এহেন মহাশক্তিমান দেবতার কোপানল থেকে বাঁচার তাগিদে মানুষ কাতর মিনতি জানাতো– তবে ভক্তিতে নয়, ভয়ে। কিন্তু মানুষের মন বুঝি এতে ভরে না। সে এই অমিত শক্তিধরকে চায়– কল্যাণসুন্দর রূপে পেতে। ফলে রুদ্র ধীরে ধীরে জনমানসে বিবর্তিত হন– মঙ্গলময় শিবে। আর পরিশেষে আশুতোষ রূপ পরিগ্রহ করেন যজুর্বেদে এসে।
রুদ্রাধ্যায়ের এ মন্ত্রে রুদ্রকে– ‘নমঃ উগ্রায় চ ভীমায় চ’, অর্থাৎ উগ্র ও ভীম এই দুই ভীষণত্ববোধক যেমন বলা হয়েছে, তেমনি আবার মঙ্গলবাচক বিশেষণে প্রণতি জানিয়ে বলা হয়েছে–
নমঃ শম্ভবায় চ ময়োভবায় চ।
নমঃ শঙ্করায় চ ময়ষ্করায় চ।
নমঃ শিবায় চ শিবতরায় চ।।
অর্থাৎ : শম্ভুকে নমস্কার, সুখভবকে নমস্কার। শঙ্করকে নমস্কার, সুখকরকে নমস্কার। শিবকে নমস্কার, শিবতরকে নমস্কার।
এখানে শম্ভব, ময়োভব, শঙ্কর, ময়ষ্কর ও শিব– প্রতিটা শব্দের একই অর্থ– কল্যাণ সুন্দর মঙ্গলময় রূপ। এ শুধু শিবই নয়। ‘শিবতর’ অর্থাৎ অধিকতার মঙ্গলদায়ক ও কল্যাণজনক।
এবং পরবর্তীতে শ্বেতাশ্বতরোপনিষদেও ঋষি প্রার্থনা করেছেন যে– রুদ্রের যে মঙ্গলময় দক্ষিণ মুখ আছে তা যেন তাঁকে নিত্য পালন করেন– ‘রুদ্র যত্তে দক্ষিণং মুখং তেন মাং পাহি নিত্যম্’ (৪/২১)।
রুদ্র শব্দটির মধ্যে যেমন ধ্বংসাত্মক তনুটির পরিচয় আছে তেমনি শিব শব্দের মধ্যে মঙ্গলময় সত্তার পরিচয় আছে। রুদ্রের বিভিন্ন রঙ ও রূপের কথা বেদ থেকেই আমরা পাই।–
‘বাজসনেয়ী সংহিতায় (১৬/৬,৭) আদিত্য রূপে রুদ্রের স্তুতি আছে। রুদ্রাধ্যায়ের মতে তিনি সহস্রাক্ষ, আদিত্য, শিপিবিষ্ট, সোম ও সূর্য। তিনি রক্তবর্ণ (১৬/৩৯), পীতবর্ণ (১৬/১৭), কপিলবর্ণ (১৬/৬)। এই স্তবেই তাঁকে নীললোহিত ও নীলগ্রীব (১৬/৭,৮) বলা হয়েছে। এই বিশেষণটিই পরবর্তী কালে সমুদ্রমন্থনে বিষ পানের ফলে শিবের নীলকণ্ঠ হবার আখ্যানের ভিত্তিভূমি হিসাবে কাজ করেছে। অনুরূপ ভাবে পশুপতি, ত্রিপুরারি (পৌরাণিক ত্রিপুর দহন বৃত্তান্ত দ্রষ্টব্য), ক্ষেত্রপতি (মঙ্গলকাব্যে চাষী শিবের বৃত্তান্ত দ্রষ্টব্য) ইত্যাদি বৈদিক বিশেষণগুলিও পুরাণের গল্পে পল্লবিত হয়ে শৈব পুরাণগুলিতে নতুন মাত্রা এনেছে। এইসব কারণের জন্যই প্রাচীন পুরাণ পরম্পরা বলেছে– ‘ইতিহাস-পুরাণাভ্যাম্ বেদম্ সমুপবৃংহয়েত্’। রুদ্রাধ্যায়ে উক্ত (১৬/১৮) ‘অন্নানাং পতি’ বিশেষণ থেকেই অন্নপূর্ণাপতি শিবের উৎপত্তি বলে অনেকে মনে করেছেন।’– (ড. উদয়চন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়/ ভূমিকা, লিঙ্গ পুরাণ, পৃষ্ঠা-১৬)
এখানে উল্লেখ্য,– ‘যজুর্বেদের কালে রুদ্র কেবল দ্বিজাতির বা আর্যদেরই দেবতা ছিলেন তা নয়; এই সময় তিনি অনার্য জাতির অন্ত্যজ জাতিরও দেবতা ছিলেন। তাই এই (রুদ্রাধ্যায়) সূক্তে অনেক অনার্য জাতি, অন্ত্যজ ও নীচ বর্ণের উল্লেখ পাওয়া যায়। তাই ঐতিহাসিক তথ্যের দিক দিয়ে এই অধ্যায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
চলবে........
সংযোগেঃ
রতন কর্মকার
Continue-49
বৈদিক সাহিত্য শিব
(৮ম পর্ব)
অনার্য জাতি, দস্যু, পার্বত্য জাতি ও অন্ত্যজ জাতির উপাস্য ও পালক বলে উল্লেখ থাকায় অধিকাংশ পণ্ডিতজন মনে করেন– রুদ্র প্রথমে অনার্য আদিবাসীদের উপাস্য দেবতা ছিলেন; পরবর্তীকালে আর্যরা তাদের থেকে এই দেবতাকে উপাস্যরূপে গ্রহণ করতে দ্বিধান্বিত ছিলেন বলেই ঋগ্বেদ সংহিতায় রুদ্র ছিলেন অন্ত্যজ দেবতা। এরপর আর্য-অনার্য সংস্কৃতির সংমিশ্রণ ও সংশ্লেষণের ফলে অনার্য প্রভাবে প্রভাবিত হয়ে এই দেবতাকে তাঁরা সম্পূর্ণরূপে গ্রহণ করেন– সর্বপূজ্য কল্যাণসুন্দর রূপে। আর এই যজুর্বেদের কালেই তিনি পরমাত্মায় পর্যবসিত হন। কারণ এই সময়ে তিনি শুধুমাত্র সাধু-সজ্জনদেরই আরাধ্য দেবতা ছিলেন তা নয়। তিনি একই সাথে অসাধু, চোর, দস্যু, গাঁটকাটা সিধেল চোর, সশস্ত্র চোর, নিশাচর দস্যু, মানুষ মারা দস্যু, উষ্ণীষধারী দস্যু (পাগড়ি পরা ডাকাত), পার্বত্য দস্যু, ধনুর্বাণধারী দস্যু ও শস্য অপহরণকারী দস্যুদেরও উপাস্য দেবতা ছিলেন। এ ছাড়াও তিনি ছুতোর, কামার, কুমোর, নিষাদ, যাযাবর, বেদে, ব্যাধ ইত্যাদিদেরও দেবতা ও পালক রূপে পূজিত ছিলেন। এমনকী তিনি গো, অশ্ব, কুকুর ইত্যাদি সমস্ত গৃহপালিত পশুদেরও পতি বা পালকরূপে পরিচিত– পশুপতি।’– (অশোক রায়, বিবর্তনের ধারায় শিব ও শিবলিঙ্গ, পৃষ্ঠা-১৩৯)
এভাবেই যজুর্বেদ সংহিতায় রুদ্র সগুণ দেবতার লক্ষণ অতিক্রম করে সর্বপূজ্য নির্গুণ পরমেশ্বরে পর্যবসিত হয়েছেন, যেখানে সমস্ত বিরোধের অবসান, সমস্ত দ্বন্দ্বের ঐক্যসমাবেশ, সমস্ত বৈপরীত্যের সমন্বয়। এই রুদ্রাধ্যায়েই তিনি যাবতীয় দার্শনিক রুপ-লক্ষণ, লাঞ্ছন চিহ্ন ও বিবিধ নামরূপে স্তুত হয়ে পরমেশ্বরে পর্যবসিত হলেন।
‘শুক্ল যজুর্বেদ সংহিতা কাব্য হিসাবেও অপূর্ব। রুদ্রাধ্যায় থেকে বহু দৃষ্টান্তই দেওয়া যায়। এই অধ্যায়ে রুদ্র দেব পশুপতি, শম্ভু, শিব, শংকর, কৃত্তিবাস, গিরিশ, ক্ষিতিকণ্ঠ, নীলগ্রীব, কপর্দী ইত্যাদি নামে স্তুত হয়েছেন। ঋগ্বেদের রুদ্র কেবল বজ্রের দেবতা, কিন্তু যজুর্বেদে তিনি কেবলমাত্র বজ্রই নন সূর্যের সাথেও তাঁর অভিন্নতা দেখানো হয়েছে। তাই সূর্যের উদয় থেকে অস্তকালীন অবস্থার মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন রূপ অনুযায়ী রুদ্রের এক একটা নাম হয়েছে। উদয় ও অস্তের সময় সূর্যের সহস্র সহস্র রশ্মি বা কিরণ সুস্পষ্টভাবে দেখা যায়; তাই ঋষি কল্পনায় সূর্যের বিম্বটি মস্তকসদৃশ। আর তার চতুর্দিকে প্রসারিত কিরণমালা– দীর্ঘ জটাজুট সদৃশ। তাই জটার প্রতিশব্দ (কপর্দ) অনুযায়ী রুদ্র হলেন– কপর্দী (রুদ্রাধ্যায় ষষ্ঠ মন্ত্র)। সপ্তম মন্ত্রে তিনি নীলকণ্ঠ। যা অস্তগামী সূর্যের রূপ থেকে এসেছে। ঋষি কবি বলছেন– ‘আদিত্যদেব যখন অস্তাচলে গমন করেন তখন গগনমণ্ডল রঙের মহোৎসবে মাতিয়া ওঠে। স্বর্ণবর্ণ সূর্যবিম্বের চতুর্দিকে বিচ্ছুরিত গাঢ় সিন্দুরবর্ণে পশ্চিমগগন রক্তিম রাগে রঞ্জিত হয়, কেবল সূর্যবিম্বের মধ্যস্থলে নীল বর্ণ রেখা দৃষ্ট হয়।’ এই মধ্যস্থলই কবি কল্পনায় কণ্ঠদেশ, আর সেই কণ্ঠদেশে নীল রং দেখায় বলেই ওই অবস্থায় সূর্যের নাম– নীলকণ্ঠ বা নীলগ্রীব। তাই ঋষি কবি বন্দনাগীত গাইছেন– ‘ওই যে নীলকণ্ঠ রক্তিমবর্ণ সূর্যরূপী রুদ্রদেব গগনপটে ধীরে ধীরে গমন করিতেছেন, তাঁহার অপরূপ রূপে আকৃষ্ট হইয়া গোধূলি লগ্নে মাঠ হইতে গোরুর পাল লইয়া গোষ্ঠে প্রত্যাবর্তন কালে মুগ্ধ হইয়া গোপালেরা তাঁহাকে দর্শন করে। গ্রামের ললনাবৃন্দ সায়ংকালে সরোবরের জল লইতে আসিয়া মুগ্ধ হইয়া রুদ্রের এই অতুলনীয় রূপ দেখিতে থাকে।’– (অশোক রায়, বিবর্তনের ধারায় শিব ও শিবলিঙ্গ)
যজুর্বেদের দুই শাখা– কৃষ্ণ যজুর্বেদ বা তৈত্তিরীয় সংহিতা এবং শুক্ল যজুর্বেদ বা বাজসনেয়ী সংহিতা। কৃষ্ণ যজুর্বেদের পঠন-পাঠন প্রচলন ও চর্চা সাধারণভাবে দেখা যায় দাক্ষিণাত্যে, আর শুক্ল যজুর্বেদের চর্চা সমগ্র আর্যাবর্ত জুড়েই (উত্তর, পূর্ব ও পশ্চিম ভারতে)। বাংলাদেশের অধিকাংশ যজুর্বেদীয় ব্রাহ্মণই শুক্ল যজুর্বেদীয় গোষ্ঠীর।
অথর্ববেদের যুগ বা তার আগে থেকেই রুদ্র শিবের সঙ্গে মহাকাল সংক্রান্ত একটা ধারা মিশতে থাকে বলে বেদজ্ঞ পণ্ডিতেরা মনে করেন। রুদ্রকে সৃষ্টি ও সংহারের দেবতা বলা হয়েছে। অথর্ববেদের কালসূক্তে (উনবিংশ কাণ্ডের ষষ্ঠ অনুবাকের অষ্টম ও নবম সূক্ত) আমরা কালের স্রষ্টা রূপের পরিচয় পাই। কালেই সব কিছু উৎপন্ন হয়, আবার কালেই সব বিলীন হয়। যেমন–
স এব সং ভুবনান্যাভরৎ স এব সং ভুবনানি পর্যৈৎ। পিতা সন্নভবৎ পুত্র এষাং তস্মাৎ বৈ নান্যৎ পরমস্তি তেজঃ।। ৪।। কালোহমূং দিবমজনয়ৎ কাল ইমাঃ পৃথিবীরুত। কালে হ ভূতং ভব্যং চেষিতং হ বি তিষ্ঠতে।। ৫।। কালো ভূতিমসৃজত কালে তপতি সূর্যঃ। কালে হ বিশ্বা ভূতানি কালে চক্ষুর্বি পশ্যতি।। ৬।। কালে মনঃ কালে প্রাণঃ কালে নাম সমাহিতম্ । কালেন সর্বা নন্দন্ত্যাগতেন প্রজা ইমাঃ।। ৭।। তেনেষিতং তেন জাতং তদু তস্মিন্ প্রতিষ্ঠিতম্ । কালো হ ব্রহ্ম ভূত্বা বিভর্তি পরমেষ্ঠিনম্ ।। ৯।। কালঃ প্রজা অসৃজত কালো অগ্রে প্রজাপতিম্ । স্বয়ম্ভুঃ কশ্যপঃ কালাৎ তপঃ কালাদজায়ত।। ১০।। (অথর্ববেদ-১৯/৬/৮/৪,৫,৬,৭,৯,১০)
অর্থাৎ :
চলবে.......
সংযোগেঃ
রতন কর্মকার
বৈদিক সাহিত্য শিব
(৯ম পর্ব)
অর্থাৎ :
সে কালই এ চরাচর সর্ববস্তু উৎপন্ন করেছে (অথবা নিজের উৎপাদিত সকল প্রাণীকে তিনিই সর্বতোভাবে পোষণ করেন)। সে কালই সমস্ত ভুবন ব্যাপ্ত করেছে। সে কালই এ ভুবনের জনক হয়ে পুত্ররূপে অবস্থান করছে। সে সকলের উৎপাদক সর্বগত কাল ছাড়া অন্য উৎকৃষ্ট তেজ আর নেই। ৪।। কালরূপ পরমাত্মা ঐ দ্যুলোক সৃষ্টি করেছেন এবং তিনিই এ পরিদৃশ্যমান পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন। কালই ভূত, ভবিষ্যৎ ও বর্তমান কালাবচ্ছিন্ন জগৎ আশ্রয় করে আছে। ৫।। কালরূপ পরমাত্মা এ জগৎ সৃষ্টি করেছেন। কালের প্রেরণায় সূর্য তাপ দেয় অর্থাৎ জগৎ প্রকাশ করে। কালের আশ্রয়ে সকল বিশ্ব অবস্থান করছে। কালে চক্ষুরাদি ইন্দ্রিয় দর্শন করে (অথবা কালেই চক্ষুষ্মান সর্বেন্দ্রিয়ের অধিষ্ঠাতা স্ব স্ব ইন্দ্রিয়ের ব্যাপার করে থাকে)। ৬।। সে কালরূপ পরমাত্মায় জগৎ সৃষ্টির কারণ-রূপ মন অবস্থান করছে। তাতেই সকল জগতের অন্তর্যামী সূত্রাত্মা প্রাণ অবস্থান করছে। অথবা সকল প্রাণীর মন, প্রাণ, নাম সেই কাল-স্বরূপে অবস্থান করছে। বসন্তাদি রূপে আগত সে কালের দ্বারা সকল প্রজাগণ (সৃষ্টি পদার্থ) নিজ নিজ কার্যসিদ্ধির জন্য তুষ্ট হচ্ছে। ৭।। সে কালরূপ পরমাত্মা সমস্ত স্রষ্টব্য জগতের কামনা করেছিলেন। তাঁর সৃষ্ট এ জগৎ সে কালেই প্রতিষ্ঠিত। সে কালই দেশকালাবচ্ছিন্ন সচ্চিৎ সুখাত্মক পরমার্থতত্ত্ব ব্রহ্মরূপে পরমেষ্ঠীকে (পরম স্থান সত্যলোকে স্থিত চতুর্মুখ ব্রহ্মাকে) পালন করেন। ৯।। কালরূপ পরমাত্মাই সৃষ্টির আদিতে প্রজাপতি ব্রহ্মাকে উৎপন্ন করেছিলেন। সে কালই প্রজা সৃষ্টি করেন। স্বয়ম্ভূ কশ্যপ সকলের দ্রষ্টা অষ্টম সূর্য এবং তার সন্তাপক তেজ সে কাল থেকে উৎপন্ন হয়েছে। ১০।।
এবং–
কালাদাপঃ সমভবন্ কালাৎ ব্রহ্ম তপো দিশঃ। কালেনোদেতি সূর্যঃ কালে নি বিশতে পুনঃ।। ১।। কালেন বাতঃ পবতে কালেন পৃথিবী মহী। দৌর্মহী কাল আহিতা।। ২।। কালো হ ভূতং ভব্যং চ পুত্রো অজনয়ৎ পুরা। কালাদৃচঃ সমভবন্ যজুঃ কালদজায়ত।। ৩।। কালো যজ্ঞং সমৈরয়দ্দেবেভ্যো ভাগমক্ষিতম্ । কালে গন্ধর্বাপ্সরসঃ কালে লোকাঃ প্রতিষ্ঠিতঃ।। ৪।। কালেহয়মঙ্গিরা দেবোহথর্বা চাধি তিষ্ঠতঃ। ইমং চ লোকং পরমং চ লোকং পুণ্যাংশ্চ লোকান্ বিধৃতীশ্চ পুণ্যাঃ। সর্বাংল্লোকানভিজিত্য ব্রহ্মণা কালঃ স ঈয়তে পরমো নু দেবঃ।। ৫।। –(অথর্ববেদ-১৯/৬/৯/১-৫)
অর্থাৎ :
সর্বজগৎকারণ পরমাত্মা থেকে ব্রহ্মাণ্ডের আধাররূপ জল উৎপন্ন হয়েছিল। সেরূপ সে কাল থেকে যজ্ঞাদি কর্ম, কৃচ্ছ্র চান্দ্রায়ণাদি তপস্যা ও পূর্বাদি দিকসকল উৎপন্ন হয়েছিল। প্রেরক কালের দ্বারা সূর্য উদয় লাভ করে এবং আবার কালে বিলীন হয় অর্থাৎ অস্তাগমন করে। ১।। কালরূপ পরমাত্মার প্রেরণায় বায়ু প্রবাহিত হয়, তার দ্বারাই মহতী পৃথিবী দৃঢ়রূপে স্থাপিত হয়েছে এবং মহান দ্যুলোক কালরূপ আধারে নিহত আছে। কালরূপ পরমাত্মা থেকে ঋক্, যজুঃ ও সামমন্ত্রগুলি উৎপন্ন হয়েছে। ২-৩।। কালই ইন্দ্রাদি দেবগণের জন্য অক্ষয় ভাগরূপে যজ্ঞ (প্রকৃতি-বিকৃতিরূপ সোমযাগ) উৎপন্ন করিয়েছিলেন। বাক্যের ধারক (গায়ক) গন্ধর্বগণ ও অন্তরিক্ষচারিণী অপ্সরাগণ কালাধারে অবস্থান করছে। সমস্ত লোকই (সর্বজগৎ ও তদধিবাসী প্রাণিগণ) কালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ৪।। অথর্ববেদ-স্রষ্টা দীপ্যমান পরমাত্মার অঙ্গোদ্ভূত অঙ্গিরা দেব এবং অথর্বা দেব স্বজনক কালেই অবস্থান করছে। ভূলোক, স্বর্গলোক, পুণ্যলোক ও দুঃখরহিত অন্য সকল লোক, স্বকারণ, দেশকালাদির দ্বারা অপরিচ্ছিন্ন সত্যজ্ঞানানন্তাদিরূপ পরমাত্মার দ্বারা ব্যাপ্ত করে, (এ সূক্তদ্বয় প্রতিপাদ্য) পরম কাল-দেব সকল স্থাবর জঙ্গমাত্মক জগৎ ব্যেপে অবস্থান করছেন। ৫।।
এ-প্রেক্ষিতে ড. উদয়চন্দ্র বলেন,– ‘বেদের এই মহাকাল তত্ত্বের দ্বারা প্রভাবিত হয়েই মহাভারতকার শিব সম্পর্কে বললেন– ‘সকালঃ সোহন্তকঃ মৃত্যুঃ স যমঃ’ (৭/২০১/২০৪)। মহানির্বাণ তন্ত্রেও আদ্যাকালীকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে মহাকাল শব্দের এই প্রকার ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে–
‘কলনাৎ সর্বভূতানাং মহাকালঃ প্রকীর্ত্তিতঃ।
মহাকালস্য কলনাৎ তমাদ্যা কালিকা পরা।।’
বেদ ও মহাভারতের সঙ্গে তন্ত্র বা শৈবাগমের মহাকালের হয়তো রূপগত পার্থক্য আছে, হয়তো আর্যেতর কোনো জনের দেবভাবনা থেকে শৈবাগমের কালচিন্তা আসতে পারে, তবে তার ওপর বৈদিক চিন্তার অভিষেক ঘটেনি এমত মনে হয় না।’
বেদ-সংহিতার যুগ অর্থাৎ ঋগ্বেদ-যজুর্বেদ-অথর্ববেদ হয়ে রুদ্রের এই ক্রমবিবর্তিত ধারায় ব্রাহ্মণ-আরণ্যক-উপনিষদের যুগে এসে রুদ্রের অন্যতম নাম মহাদেব হিসেবে বৈদিক দেবগণের মধ্যে হয়তো তাঁর প্রধানতম স্থান সম্বন্ধে ইঙ্গিত প্রদান করে।
চলবে.......
সংযোগেঃ
রতন কর্মকার
বৈদিক সাহিত্য শিব
(১০ম পর্ব)
শ্বেতাশ্বতর উপনিষদের চতুর্থ অধ্যায়ের দশম শ্লোকে তাঁকে মহেশ্বর নামে অভিহিত করে বলা হয়েছে– তিনি প্রকৃতি রূপ মায়ার অধীশ্বর এবং এই বিশ্বভুবন তাঁরই বিভিন্ন রূপ বা অবয়বের দ্বারা পরিব্যাপ্ত–
মায়াং তু প্রকৃতিং বিদ্যান্মায়িনং চ মহেশ্বরম্ ।
তস্যাবয়বভূতৈস্তু ব্যাপ্তং সর্বমিদং জগৎ।। (শ্বেতাশ্বতর-৪/১০)
অর্থাৎ : প্রকৃতিকে মায়া বলে এবং মহেশ্বরকে মায়াধীশ বলে জানবে। এই বিশ্বচরাচর মহেশ্বরের দেহ।
বস্তুত, ইতোমধ্যে আমরা যা লক্ষ্য করেছি, রুদ্র ভাবনা ক্রমে একটা বিশাল ব্রহ্ম ভাবনার দিকে অগ্রসর হচ্ছিলো। অথর্বের ব্রাত্য ধারার মধ্যে দিয়ে উপনিষদে এসে এই ভাবনা পরিপূর্ণভাবে ব্রহ্মবাদে বিলীন হয়। শৈব বেদপন্থী টীকাকারেরা এই ধারার দ্বারা বহুল পরিমাণে প্রভাবিত হয়েছিলেন। তবে– আরেকটি ধারা– বেদবিরোধী শৈব ধারার চলার পথ আবার ভিন্ন।
বস্তুত শ্বেতাশ্বতর উপনিষদে দেবতা রুদ্র ক্রমশ সর্বপ্রধান দেবতা, এবং একেশ্বর হিসেবে কীর্তিত হতে দেখা যায়। আমরা দেখতে পাই, শ্বেতাশ্বতরোপনিষদে রুদ্রশিব ও ব্রহ্ম এক পর্যায়ে চলে গেছেন। ঋষি বলছেন–
অজাত ইত্যেবং কশ্চিদ্ভীরুঃ প্রপদ্যতে।
রুদ্র যত্তে দক্ষিণং মুখং তেন মাং পাহি নিত্যম্ ।। (শ্বেতশ্বতর-৪/২১)
অর্থাৎ : হে রুদ্র, তুমি মৃত্যুঞ্জয়। যে জন্মাদি মৃত্যুভয়ে ভীত সেই তোমার শরণ নেয়। তোমার প্রসন্ন মুখ আমার দিকে ফেরাও এবং নিয়ত আমাকে রক্ষা কর।
উপনিষদকারের মতে একমাত্র ঈশ্বর ভগবান রুদ্র ব্যতীত আর কেউ নন। যজুর্বেদের বাজসনেয়ী সংহিতার ১৬/২,৩ ইত্যাদি মন্ত্রকে এখানে শ্বেতাশ্বতরে ৩/৫,৬ মন্ত্ররূপে ব্রহ্মপরত্বে ব্যবহৃত হতে দেখা যায়। বেদান্ত মতে ব্রহ্মই যেমন এক এবং সত্য, তেমনি শ্বেতাশ্বতরের মতে রুদ্রই হলেন একতম। এক ও অদ্বিতীয় রুদ্র স্ব-শক্তির সাহায্যে বিশ্ব চরাচর নিয়ন্ত্রিত করেন, তিনি স্রষ্টা, পালনকর্তা এবং সংহারকর্তা,– প্রলয়কালে তাঁর মধ্যেই সমস্ত ভুবন আশ্রয় গ্রহণ করে। যেমন–
একো হি রুদ্রো ন দ্বিতীয়ায় তস্থূঃ য ইমান্ লোকান্ ঈশত ঈশনীভিঃ।
প্রত্যক্ জনান্ তিষ্ঠতে সঞ্চুকোপান্তকালে সংসৃজ্য বিশ্বাঃ ভুবনানি গোপাঃ।। (শ্বেতাশ্বতর-৩/২)
অর্থাৎ : এক সেই পরমেশ্বর কে, যাঁর দ্বিতীয় কেউ নেই ? তিনি হলেন রুদ্র। প্রতি জীব-হৃদয়ে তাঁর অবস্থান– তাই পরমাত্মা। তিনিই তাঁর সেই ঐশ্বরিক শক্তি-বুদ্ধি দিয়ে জগৎকে শাসন করছেন। সেই শক্তির কোন ব্যাখ্যা চলে না। ব্রহ্মাণ্ডকে সৃষ্টি করে প্রতিটি মানুষের অন্তরে তিনি অবস্থান করছেন, আবার গোপা অর্থাৎ রক্ষাও করছেন। আবার অন্তিমকালে এলে সংহার-মূর্তিতে তিনিই সব সংহার করছেন।
এখানে উল্লেখ্য, যোগী সম্প্রদায়ের শ্বেতাশ্বতর ঋষির দ্বারা রচিত এই উপনিষদটি উপনিষদ্ ভাগের শেষ পর্বের রচনা। পুরাণবর্ণিত কল্প ও কল্পযুগের কথা যেমন এখানে আছে, তেমনি যোগাচারের ও যোগসিদ্ধির প্রথমাবস্থার কথাও এখানে বলা হয়েছে। লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো, ব্রহ্মের রূপ হিসেবে রুদ্রকে এখানে দেখানো হলেও ‘শিব’ শব্দটি তখনো (শ্বেতাশ্বতর রচনাকালে) রুদ্রের নামে পর্যবসিত হয়নি, তা বরাবরই বিশেষণ রূপে ব্যবহৃত হয়েছে। শ্বেতাশ্বতরে রুদ্রকে নানা নামে অভিহিত করা হয়েছে, যেমন মহাদেব, মহর্ষি, ভগবান, ঈশ, ঈশান এবং শিব। তবে শেষোক্ত নামটি (শিব) রুদ্রের উপাধি বা বিশেষণ হিসেবেই মাত্র কয়েকটি স্থলে উল্লিখিত হয়েছে বলে মনে হয়। যেমন–
সর্বাননশিরোগ্রীবঃ সর্বভূতগুহাশয়ঃ।
সর্বব্যাপী স ভগবান্ তস্মাৎ সর্বগতঃ শিবঃ।। (শ্বেতাশ্বতর-৩/১১)
অর্থাৎ : তিনি সর্বানন– জগতের সব মুখই তাঁর মুখ। জগতের প্রাণীমাত্রেরই মাথা, গলা– তাঁরই শির-গ্রীবা। প্রাণীর ভেতরে সেই গুহা, যার নাম বুদ্ধি, তিনি আছেন সেই গুহায়। সর্বব্যাপী এবং সর্বগত শিবস্বরূপ মঙ্গলময় তিনি ভগবান।
.
ঘৃতাৎ পরং মন্ডমিবাতিসূক্ষ্মং জ্ঞাত্বা শিবং সর্বভূতেষু গূঢ়ম্ ।
বিশ্বস্যৈকং পরিবেষ্টিতারং জ্ঞাত্বা দেবং মুচ্যতে সর্বপাশৈঃ।। (শ্বেতাশ্বতর-৪/১৬)
অর্থাৎ : ঘিয়ের উপর হালকা সরের মতো একটা সারবস্তু ভেসে থাকে। ঈশ্বর সেই অতি সূক্ষ্ম সারবস্তুর মতো, যিনি বিশ্বের একমাত্র কর্তা, যিনি প্রতিটি জীবকে তার কর্ম অনুসারে প্রাপ্য ফল দান করেন। অন্তরাত্মা হয়ে এই পরমেশ্বর সকলের মধ্যেই লুকিয়ে আছেন। তিনিই করুণাঘন পরমেশ্বর শিব। সেই পরমেশ্বরকে জানতে পারলে সমস্ত বন্ধন থেকে মুক্ত হওয়া যায়।
.
ভাবগ্রাহ্যমনীড়াখ্যং ভাবাভাবকরং শিবম্ ।
কলাসর্গকরং দেবং যে বিদুস্তে জহুস্তনুম্ ।। (শ্বেতাশ্বতর-৫/১৪)
অর্থাৎ : ভাব-গ্রাহ্য তিনি, খ্যাত তিনি অশরীরী বলে; সৃষ্টি-লয়ের কারণ যিনি পঞ্চপ্রাণ দশ-ইন্দ্রিয় এবং মন নিয়ে ষোড়শ কলার স্রষ্টা, সেই মঙ্গলময় (শিব) দেবকে যাঁরা জানেন, তাদের আর দেহাভিমান থাকে না– দেহত্যাগের পর আর দেহও ধারণ করতে হয় না।
চলবে........
সংযোগেঃ
রতন কর্মকার
বৈদিক সাহিত্য শিব
(১১তম পর্ব)
শ্বেতাশ্বতর উপনিষদে রুদ্র এমন ভাবে বর্ণিত হয়েছে যাতে তিনি যে উপনিষদকারের ভক্তি ও পূজার পাত্র ছিলেন তা অনুমান করা যায়। এতে ব্যক্তিত্বব্যঞ্জক একেশ্বরবাদ এবং প্রাচীনতর গদ্য উপনিষদগুলির নৈর্ব্যক্তিক ব্রহ্মবাদ একত্র মিলিত হলেও, ঈশ্বরবাদেরই প্রাধান্য সূচিত হয়েছে। ড. উদয়চন্দ্রের বক্তব্য অনুযায়ী, পাতঞ্জল যোগের সঙ্গে কয়েকটি ক্ষেত্রে মিল থাকায় আধুনিক পণ্ডিতেরা শৈব মতাবলম্বী এই শ্বেতাশ্বতর উপনিষদকে যোগোপনিষদ্গুলির আদি গ্রন্থ বলে অনুমান করেন। তিনি আরও বলেন, রুদ্রকে নিয়ে ব্রহ্মভাবনা শ্বেতাশ্বতরেতে ব্যাপক রূপ নিলেও তৈত্তিরীয় আরণ্যক থেকেই এর একটা সূত্র পাওয়া যায় (তৈ. আ. ১০/১৬)। সেখানে রুদ্রকে সর্বভূতাত্মা, বিশ্বাত্মক ও বিশ্বোত্তীর্ণ বলা হয়েছে। বায়বীয় সংহিতার (৪/৭০-১৪১) বিভিন্ন অংশের সঙ্গে শ্বেতাশ্বতরের প্রচণ্ড মিল। শ্বেতাশ্বতরকে সামান্য উল্টেপাল্টে এগুলি লেখা।
অধ্যাপক জিতেন্দ্রনাথের ভাষ্যে, এভাবেই ক্রমশ শিব নামের গুরুত্ব বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং আর্যেতর জাতির দ্বারা পূজিত অনুরূপ দেবতার যখন বৈদিক রুদ্রের সাথে মিলন ঘটে তখন মিশ্র দেবতা শিব নামেই পরিচিত হন।
শ্বেতাশ্বতর উপনিষদে রুদ্র শিবকে কেন্দ্র করে যে একেশ্বরবাদী প্রবণতা দেখা যায়, তার চূড়ান্ত বিকাশ ঘটেছে অনেক পরবর্তীকালে রচিত অথর্বাশিরস্ উপনিষদে।–
‘ইহাতেই সাম্প্রদায়িকতাপূর্ণ রুদ্র-শিব উপাসনার অন্যতম প্রথম পরিচয় পাওয়া যায়। এখানে রুদ্র বিভিন্ন বৈদিক দেবতা, যথা ব্রহ্মা প্রজাপতি, অগ্নি, ইন্দ্র, সোম, বরুণ প্রভৃতির সহিত একাত্মীভূত হইয়াছেন ত বটেই, সঙ্গে সঙ্গে কয়েকটি পৌরাণিক দেবতা, যথা স্কন্দ, বিনায়ক, উমা (কেনোপনিষদে উমার নাম প্রথম পাওয়া গেলেও প্রকৃতপক্ষে তিনি মহাকাব্য ও পুরাণের যুগেই প্রতিষ্ঠা লাভ করিয়াছিলেন) প্রভৃতিও তাঁহার ভিন্ন ভিন্ন প্রকাশ বলিয়া গৃহীত হইয়াছেন। গ্রন্থকারের মতে সপ্ত লোক, পঞ্চ মহাভূত, অষ্ট গ্রহ (তথাকথিত গ্রহের সংখ্যা আদিতে আট, পরে কেতু এই সংখ্যায় যুক্ত হইলে নব গ্রহ পূরণ হয়), কাল, অমৃত প্রভৃতি সবই ইঁহার বিভিন্ন রূপ। তিনি বিশ্বস্রষ্টা ও জগৎপিতা এবং সংহারকর্তা। তাঁহার এই রূপ কল্পনায় সুস্পষ্টভাবে সাম্প্রদায়িকতার প্রকাশ দেখা না যাইলেও রুদ্রোপাসকদিগের এক বিশেষ ব্রতের কথা এখানে বলা হইয়াছে। ইহার নাম পাশুপত ব্রত, এবং এই ব্রতের অনুষ্ঠানে ‘অগ্নিরিতি ভস্য বায়ুরিতিভস্ম জলমিতি ভস্ম স্থলমিতি ভস্ম ব্যোম ইতি ভস্ম সর্বংহ বৈ ইদং ভস্ম মনঃ এতানি চক্ষুংষি ভস্মানি’ মন্ত্র পাঠ করিয়া উপাসক তাঁহার সর্বাঙ্গে ভস্ম স্পর্শ করাইতেন। এই ব্রত পালনের ফলে উপাসক পশুপাশ হইতে মুক্ত হইতেন (পশুপাশবিমোক্ষণ) এবং ঐশী শক্তির অধিকারী হইতেন।’– (জিতেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়/ পঞ্চোপাসনা, পৃষ্ঠা-১২৯)
চলবে.......
সংযোগেঃ
রতন কর্মকার
বৈদিক সাহিত্য শিব
(১২ তম ও অন্তিম পর্ব)
বলা বাহুল্য, শৈব ধর্ম-সম্প্রদায়গুলির প্রধান দেবতা শিবের আদিম রূপ সম্বন্ধে অনুসন্ধান করলে বুঝা যায় যে তা মূলত এক কাল্পনিক দেবসত্তাকে অবলম্বন করেই বিকশিত হয়েছিল। কিন্তু কিভাবে লিঙ্গ ও যোনি প্রতীক পূজা শিবের সঙ্গে সম্পর্কিত ছিলো তার ইঙ্গিত শ্বেতাশ্বতর উপনিষদে পাওয়া যায় বলে কেউ কেউ (রামকৃষ্ণ গোপাল ভান্ডারকর মহাশয়) মনে করেন। যেমন শ্বেতাশ্বতরে বলা হয়েছে–
যো যোনিং যোনিমধিতিষ্ঠত্যেকো যস্মিন্নিদং সং চ বি চৈতি সর্বম্ ।
তমীশানং বরদং দেবমীড্যং নিচায্যেমাং শান্তিমত্যন্তমেতি।। (শ্বেতাশ্বতর-৪/১১)
অর্থাৎ : প্রকৃতি, আকাশ ইত্যাদি সবকিছু যে কারণ (যোনি) থেকে উৎপন্ন হয়েছে, আবার প্রলয়ের সময় যে কারণে বিলীন হয়ে যাচ্ছে, সেই কারণেরও কারণ হলেন মায়ার অতীত পরমানন্দময় এক অদ্বিতীয় পরমেশ্বর। সেই নিয়ন্তা, বরদা, পূজ্য দেবতাকে নিশ্চিতভাবে যে সাধক উপলব্ধি করেছেন, মনের চোখ দিয়ে হৃদয়-আকাশে দেখেছেন তিনি চিরশান্তি লাভ করেছেন।
.
যো যোনিং যোনিমধিতিষ্ঠ্যত্যেকো বিশ্বানি রূপাণি যোনীশ্চ সর্বাঃ।
ঋষিং প্রসূতং কপিলং যস্তমগ্রে জ্ঞানৈর্বিভর্তি জায়মানং চ পশ্যেৎ।। (শ্বেতাশ্বতর-৫/২)
অর্থাৎ : যিনি এক হয়েও বিশ্বের যোনিতে-যোনিতে অর্থাৎ প্রতিটি বস্তুতে, সমস্ত রূপে, সমস্ত উপাদানে বা উৎপত্তির কারণে কারণ হয়ে আছে, যিনি সৃষ্টির বা কল্পের শুরুতে সর্বজ্ঞ ঋষি কপিলকে উৎপন্ন করে ধর্ম, জ্ঞান, ঐশ্বর্য দিয়ে পরিপূর্ণ করেছিলেন এবং তাঁর জন্ম-মুহূর্তটিকেও দেখেছিলেন, তিনি জীব বা জীবাত্মা নন– পরমাত্মা, পরমেশ্বর।
এখানে কৌতুহলের বিষয় হলো, উপনিষদ ঋষি বলছেন, সৃষ্টির প্রাক্কালে তিনি জ্ঞানগর্ভ কপিলকে উৎপন্ন করলেন। শ্রীমদ্ভগবদ্গীতায়ও ভগবান বলেছেন, ঋষিদের মধ্যে কপিল এবং দর্শনের মধ্যে আমি সাংখ্য। তাহলে কি বুঝতে হবে যে, জগৎস্রষ্টা পরমেশ্বরের প্রথম সৃষ্টি সাংখ্যদর্শনের দ্রষ্টা ভগবান কপিল মুনি? আবার এই শ্বেতাশ্বতর উপনিষদেই অন্যত্র বলা হয়েছে– তাঁর প্রথম সৃষ্টি হিরণ্যগর্ভ। তাহলে কি কপিল বলতে হিরণ্যগর্ভকেই বোঝানো হয়েছে? পণ্ডিতদের মতে এখানে কপিল মুনি নন, স্বয়ং কনকবর্ণ হিরণ্যগর্ভ ব্রহ্মাকেই বোঝানো হয়েছে। সে যাক, তবে অধ্যাপক জিতেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে–
‘এই দুটি শ্লোকেরই প্রথম চরণে ঈশান (শিব) দেবতাকে প্রতি যোনিতে অধিষ্ঠিত থাকিবার বর্ণনা দেখিয়া ভান্ডারকরের মনে এইরূপ সংশয় জাগিয়াছিল। কিন্তু এখানে যোনি যে স্ত্রীচিহ্ন অর্থে ব্যবহৃত না হইয়া মূল কারণ বীজ অর্থেই ব্যবহৃত হইয়াছে সে বিষয়ে নিঃসন্দেহ হওয়া যায়। প্রত্নতত্ত্বমূলক প্রমাণও আমাদের এই উক্তি সমর্থন করে। লিঙ্গপ্রতীকের আদিমতম ও কিঞ্চিৎ পরবর্তী কালের যে সব নিদর্শন অদ্যাবধি আবিষ্কৃত হইয়াছে, এগুলির কোনওটিতেই লিঙ্গ ও যোনি একত্র করিয়া দেখানো হয় নাই। এই দুইটি পূজা প্রতীকের একত্র সমাবেশ আমরা গুপ্ত ও তৎপরবর্তী যুগের নিদর্শনগুলিতেই পাই,– তখন ইহার শিশ্নাকৃতি অনেকাংশে প্রচ্ছন্ন হইয়া গিয়াছিল এবং ইহা ক্রমশঃ সম্পূর্ণ রূপান্তরিত হইয়াছিল। গুপ্তপূর্ব কালের এবং খৃষ্টপূর্ব যুগের যে সব শিবলিঙ্গ বা তাহার চিত্র মুদ্রায় বা শিলমোহরে দেখা যায়, সেগুলিতে পরবর্তী কালের যোনিপট্ট দেখিতে পাওয়া যায় না, এবং ইহাদিগকে ঊর্ধ্বোত্থিত মুক্তমুখচর্ম পুংলিঙ্গের আকারে রূপায়িত দেখা যায়। গোপীনাথ রাও মহাশয় খৃষ্টপূর্ব যুগের এইরূপ একটি পরশু ও মৃগধারী দ্বিভুজ শিবের আকৃতি সংযুক্ত সুদীর্ঘ শিবলিঙ্গ অন্ধ্র প্রদেশের গুডিমল্লম গ্রামে আবিষ্কার করিয়াছিলেন। উহা অদ্যাবধি পূজা পাইয়া আসিতেছে। ইহাতে কোনও যোনিপীঠ বা যোনিপট্ট নাই।’– (পঞ্চোপাসনা, পৃষ্ঠা-১৩৬)
বিদ্বানেরা বলেন, সাধনার দার্শনিক উপলব্ধিতে লিঙ্গ মানে সূক্ষ্ম শরীরের প্রতীকী রূপ। কেননা শ্বেতাশ্বতর উপনিষদেরই নিম্নোক্ত শ্লোকে সূক্ষ্ম শরীরকে লিঙ্গ শরীর বলা হয়েছে–
বহ্নের্যথা যোনিগতস্য মূর্তির্ন দৃশ্যতে নৈব চ লিঙ্গনাশঃ।
স ভূয় এবেন্ধনযোনিগৃহ্যস্তদ্বোভয়ং বৈ প্রণবেন দেহে।। (শ্বেতাশ্বতর-১/১৩)
অর্থাৎ : আগুনের উৎস কাঠ। অর্থাৎ কাঠের ভিতরেই আগুন আছে। কিন্তু সেই আগুন তখনি দেখা যায় যখন একটি কাঠকে আরেকটি কাঠের সঙ্গে ঘষা হয়। না ঘষলে কি সেই শক্তি কাঠের মধ্যে থাকে না? অবশ্যই থাকে। সেইরকম প্রণবের মধ্যেই আত্মা আছেন। তাই প্রণবের দ্বারা আত্মাকে মনন করলেই তার উপলব্ধি হয়।
তার মানে, পরমেশ্বর মহেশ্বর সর্বব্যাপ্ত হয়েও সূক্ষ্ম লিঙ্গশরীরে অবস্থান করেন বলে তাঁকে দেখা যায় না, উপলব্ধির মাধ্যমে তাঁকে অনুভব করতে হয়। অর্থাৎ লিঙ্গশরীর মানে সূক্ষ্ম শরীর, যা বাস্তবে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য নয়। কিন্তু এই উপলব্ধির জন্য যে উচ্চমার্গের ধ্যান ও গভীর সাধনার প্রয়োজন হয় তার জন্যেও প্রাথমিকভাবে দরকার হয় কোনো বাহ্যিক প্রতীকী মাধ্যম। এই মাধ্যমই কি লিঙ্গপ্রতীক? এ প্রেক্ষিতে ড. উদয়চন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন–
‘শিবের সূক্ষ্মমূর্তি হলেও তার বাহ্য প্রতীক হিসাবে শিবলিঙ্গকে পূজা করা হত। এক্ষেত্রে লিঙ্গ শব্দের অর্থ চিহ্ন। শিবপূজকরা তাঁদের দেহে বিশেষ প্রকার তিলকাদি ব্যবহার করতেন। একেও লিঙ্গ বলা হত। পৌরাণিক যুগে ত্রিপুণ্ডক, ত্রিশূল বা লিঙ্গায়েৎ-দের শিবলিঙ্গ ধারণের মতই তখনও শৈবরা বিশেষ চিহ্ন বা লিঙ্গ ধারণ করতেন। পাশুপতসূত্রের– ‘লিঙ্গধারী’ (১/৬) অংশের ব্যাখ্যা কালে কৌণ্ডিন্য বলেন– বর্ণাশ্রমীদের যেমন স্ব স্ব আশ্রমের চিহ্ন থাকে, অর্থাৎ ব্রহ্মচারীর যেমন দণ্ড, কমণ্ডুল, যজ্ঞোপবীত ইত্যাদি থাকে, তেমনি পশুপতেরাও ভষ্মালেপন, নির্মাল্যধারণ ইত্যাদি লিঙ্গ ব্যবহার করবেন। শিবের চিহ্ন বা লিঙ্গ হিসাবেই তাই শিবলিঙ্গ ধারণ করা হত, কারণ শিবের প্রতীক লিঙ্গ এবং শিব প্রকৃতপক্ষে একই।
( সমাপ্ত )
সংযোগেঃ
রতন কর্মকার
তন্ত্রে দীক্ষা ও অভিষেক
(১ম পর্ব)
আচার্য অভিনবগুপ্ত দীক্ষা সম্বন্ধে তাঁর তন্ত্রালোকে গুটিকয় অভিনব সিদ্ধান্ত সিদ্ধান্ত করে বলেছেন যে,– ‘মুক্তির হেতুভূত বুদ্ধিনিষ্ঠ জ্ঞানও শাস্ত্রজ্ঞান ব্যতীত জন্মিতে পারে না। যে-সকল শাস্ত্র এই তত্ত্বের প্রদর্শক নহে, সেই সকল শাস্ত্র হইতে আগম-শাস্ত্র শ্রেষ্ঠ। শাস্ত্র বলিতেছেন, দীক্ষা গ্রহণ করিলেই পৌরুষ (আত্মনিষ্ঠ) অজ্ঞান নিবৃত্ত হইয়া যায়। দীক্ষার এইরূপ অনির্বচনীয় শক্তি। পৌরুষ অজ্ঞান বিনষ্ট হইলেও বুদ্ধিনিষ্ঠ অজ্ঞান নিবৃত্ত হয় না। বুদ্ধিগত অজ্ঞান নিবৃত্ত না হওয়া পর্যন্ত আত্মা সম্পূর্ণ মুক্ত হইতে পারেন না। দীক্ষা গ্রহণমাত্রই পৌরুষ অজ্ঞান নিবৃত্ত হয় বলিয়া দেহ-নাশের পর মুক্তির পথে আর কোন প্রতিবন্ধক থাকে না। অর্থাৎ প্রত্যেক দীক্ষিত ব্যক্তিরই মুক্ত অবধারিত। শ্রীমন্নিশাটন-শাস্ত্রে ধাতা এই কথা বলিয়াছেন। (তন্ত্রালোক-১/৫০-৫১) (সূত্র: তন্ত্রপরিচয়, পৃষ্ঠা-৩৩)
শক্তিমন্ত্রের উপাসকগণের দীক্ষার সঙ্গে শাক্তাভিষেক হওয়াও কর্তব্য মনে করা হয়। এখানে উল্লেখ্য, মন্ত্রসিদ্ধির নিমিত্ত তন্ত্রোপদিষ্ট বিশেষ বিশেষ মন্ত্রে গুরু শিষ্যের মস্তকে মন্ত্রপূত জলের দ্বারা অভিষেক করেন। কারো কারো মতে, শুধু শক্তি-সাধকের পক্ষেই অভিষেক কর্তব্য। বামকেশ্বর-তন্ত্রে অভিষেকের বিস্তৃত বিধান পাওয়া যায়। অভিষেকের দ্বারা সাধকের শরীর শোধিত হয় এবং সর্ববিধ আপদ-বিপদ কেটে যায়। বামকেশ্বরতন্ত্র অনুযায়ী অভিষেক দুই প্রকার– শাক্তাভিষেক ও পূর্ণাভিষেক। সাধারণত দীক্ষা দানের অব্যবহিত পরেই শাক্তাভিষেক অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু পূর্ণাভিষেকের প্রচলন খুব ব্যাপক নয়। তবে পূর্ণাভিষেক ব্যতীত কুলকর্মের অধিকার হয় না। যাঁর পূর্ণাভিষেক হয়েছে তিনিই কৌলকুলার্চক। তাই বামকেশ্বরতন্ত্রে বলা হয়েছে–
অভিষেকং বিনা দেবি কুলকর্ম করোতি যঃ।
তস্য পূজাদিকং কর্ম অভিচারায় কল্প্যতে।।
অভিষেকং বিনা দেবি সিদ্ধবিদ্যাং দদাতি যঃ।
তাবৎ কালং বসেদ্ ঘোরে যাবচ্চন্দ্রদিবাকরৌ।।- (বামাকেশ্বরতন্ত্র)
অর্থাৎ : অভিষিক্ত (পূর্ণাভিষিক্ত) না হয়ে যে-ব্যক্তি কুলকর্মের অনুষ্ঠান অর্থাৎ তান্ত্রিক মতে উপাসনা করে, তার জপ-পূজাদি অভিচারস্বরূপ হয়। আর যে ব্যক্তি অভিষেক ব্যতীত দশবিদ্যার কোন মন্ত্রদীক্ষা দেয়, সে ব্যক্তি যাবৎ চন্দ্রসূর্য থাকিবে, তাবৎ কাল নরকে বাস করিবে।
অতএব তান্ত্রিক সাধকমাত্রেই উপযুক্ত গুরুর নিকট পূর্ণাভিষিক্ত হতে হবে। আর পূর্ণাভিষেকের উপযুক্ত গুরু হলেন–
পরমহংসো গুরুণাং পূর্ণাভিষেকং সমাচরেৎ।- (কৌলার্চনচন্দ্রিকা)
অর্থাৎ : যে সাধক সাধনায় পরমহংসত্ব প্রাপ্ত হয়ে প্রকৃত সৎকৌলপদবাচ্য হয়েছেন, তিনি পূর্ণাভিষেক করবার উপযুক্ত গুরু।
তন্ত্র-সাধনায় এই অভিষেককাল একটি উল্লেখযোগ্য গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা বটে। কেননা এ-সময়ে যথাবিধি পঞ্চতত্ত্ব সহ তন্ত্র-সাধনার বিভিন্ন উপচার ও সাধনাচারের গুহ্য-প্রণালী অনুসরণ ও চর্চিত হয়ে থাকে। এবং এই পূর্ণাভিষেককালে কোন কোন গুপ্ত বিষয় বিজ্ঞাপনার্থ তন্ত্রে কতকগুলি সাঙ্কেতিক শব্দ ব্যবহৃত হয়ে থাকে– স্বয়ম্ভু কুসুম তারই একটি। শ্রদ্ধেয় অক্ষয় কুমার দত্ত মহাশয় এই সাঙ্কেতিক শব্দের কয়েকটি গুপ্তার্থ নির্দেশ করেছেন এভাবে–
(শব্দ) খপুষ্প– (অর্থ) রজস্বলা স্ত্রীলোকের রজ।
স্বয়ম্ভু পুষ্প বা স্বয়ম্ভু কুসুম– (অর্থ) রজস্বলা স্ত্রীলোকের প্রথম রজ।
কুণ্ড পুষ্প– (অর্থ) সধবা স্ত্রীলোকের রজ।
গোলক পুষ্প– (অর্থ) বিধবা স্ত্রীলোকের রজ।
বজ্র পুষ্প– (অর্থ) চণ্ডালীর রজ।
তন্ত্রশাস্ত্রে গুপ্তার্থবোধক এরকম বহু শব্দ রয়েছে। প্রকৃতপক্ষে সাধারণ-দৃষ্টিতে যেসব নিরীহ শব্দ তন্ত্রচর্চায় উল্লেখ করা হয়ে থাকে তার প্রতিটিরই ভিন্ন কোন গুপ্তার্থ থাকা বিচিত্র নয়, এবং বাস্তবে তা-ই হয়েছে বলে বিজ্ঞ গবেষকদের অভিমত।
বলা হয়ে থাকে, পূর্ণাভিষিক্ত গুরু দীক্ষা ও শাক্তাভিষেকের অধিকারী। অতএব সিদ্ধিকামী তান্ত্রিক-সাধক সাক্ষাৎ শিবতুল্য কৌলের নিকট পূর্ণাভিষিক্ত হবেন। শাক্তগণের প্রথমে দীক্ষার সাথে শাক্তাভিষেক, তারপর পূর্ণাভিষেক এবং তারপর ক্রমদীক্ষা হওয়া কর্তব্য। তাই কামাখ্যাতন্ত্রে মহাদেব বলছেন–
ক্রমদীক্ষাবিহীনস্য কলৌ ন স্যাৎ কদাচন।- (কামাখ্যাতন্ত্র)
অর্থাৎ : কলিযুগে ক্রমদীক্ষা ব্যতীত কখনোই সিদ্ধি হবে না।
এবং কামাখ্যাতন্ত্রে মহাদেবের উক্তিতে আরো বলা হচ্ছে–
যদি ভাগ্যবশাদ্দেবি ক্রমদীক্ষা চ জায়তে।
তদা সিদ্ধির্ভবেত্তস্য নাত্র কার্যা বিচারণা।।
ক্রমদীক্ষাবিহীনস্য কথং সিদ্ধিঃ কলৌ ভবেৎ।
ক্রমং বিনা মহেশানি সর্বং তেষাং বৃথা ভবেৎ।।- (কামাখ্যাতন্ত্র)
অর্থাৎ : কাহারও ভাগ্যবশে যদি ক্রমদীক্ষা হয়, তবে নিশ্চয়ই সিদ্ধিলাভ হইবে, সন্দেহ নাই। ক্রমদীক্ষা বিনা কলিযুগে কোন মন্ত্রই সিদ্ধি হইবে না এবং জপ-পূজাদি সমস্তই বৃথা হইবে।
তন্ত্র-সাধকদের নিজ নিজ কল্প অনুযায়ী পূর্ণাভিষেকেরও নির্ধারিত ক্রমপ্রণালী রয়েছে। এরকম একজন তন্ত্রগুরু শ্রীমৎ স্বামী নিগমানন্দ সরস্বতী পরমহংসদেব তাঁর ‘তান্ত্রিকগুরু’ গ্রন্থে পূর্ণাভিষেকের একটি ক্রম বিবৃত করেছেন এভাবে–
‘অভিষেকের পূর্বদিন গুরু সর্ববিঘ্ন শান্তির জন্য যথাবিধি পঞ্চতত্ত্ব দ্বারা বিঘ্নরাজের পূজা করিয়া অধিবাস করিবেন এবং ব্রহ্মজ্ঞ কুলসাধকদিগকে ভোজন করাইবেন।
পরদিবস শিষ্য প্রাতঃকৃত্য সমাপনপূর্বক স্নান ও নিত্যক্রিয়াদি শেষ করিয়া জন্মাবধিকৃত পাপরাশি ক্ষয়ের জন্য তিল-কাঞ্চন উৎসর্গ করিবে। তৎপরে কৌলদিগের তৃপ্তির জন্য একটি ভোজ্য উৎসর্গ করা আবশ্যক। পরে সূর্যার্ঘ্য প্রদান করতঃ ব্রহ্মা, বিষ্ণু, শিব, নবগ্রহ ও মাতৃগণের পূজা করিয়া বসুধারা দিবে। তৎপরে কর্মের অভ্যুদয় কামনায় বৃদ্ধিশ্রাদ্ধ করিবে।
তদনন্তর গুরুর নিকট গমনপূর্বক প্রণাম ও অনুমতি গ্রহণান্তে সকল উপদ্রব শান্তির নিমিত্ত এবং আয়ুঃ লক্ষ্মী, বল ও আরোগ্যপ্রাপ্তির জন্য যথাবিহিত সঙ্কল্প করিয়া বস্ত্র, অলঙ্কার, ভূষণ ও শুদ্ধির সহিত কারণদ্বারা গুরুর অর্চনা করিয়া বরণ করিবে।
চলবে......
তন্ত্রে দীক্ষা ও অভিষেক
(২য় পর্ব)
অনন্তর গুরু ধূপ, দীপ প্রভৃতি নানাবিধ দ্রব্যদ্বারা সুসজ্জিত মনোহর গৃহে চার অঙ্গুলী উচ্চ, অর্ধ হস্তা করিয়া দীর্ঘ-প্রস্থ পরিমিত মৃত্তিকার বেদী রচনা করিবেন। তৎপরে ঐ গৃহে পীত, রক্ত, কৃষ্ণ, শ্বেত ও শ্যামলবর্ণ অক্ষতচূর্ণ দ্বারা সুমনোহর সর্বতোভদ্রমণ্ডল রচনা করিবেন। পরে স্ব স্ব কল্পোক্ত বিধি-অনুসারে মানস-পূজা অবধি কার্যকলাপ সমাপন করিয়া যথারীতি পঞ্চতত্ত্ব শোধন করিবে।
পঞ্চতত্ত্ব শোধন করিয়া ‘ফট্’ এই মন্ত্রে প্রক্ষালন ও দধি এবং অক্ষত দ্বারা লিপ্ত সুবর্ণ, রজত, তাম্র কিংবা মৃত্তিকানির্মিত ঘট “ওঁ” এই পাঠপূর্বক সর্বতোভদ্রমণ্ডলের উপর স্থাপন করিবেন। তৎপরে “স্ত্রীং” এই বীজমন্ত্র পাঠ করিয়া সিন্দুর দ্বারা ঐ ঘট অঙ্কিত করিবেন। অনন্তর অনুস্বার পুটিত করিয়া “ক্ষ” অবধি অকারান্ত পঞ্চাশৎ বর্ণের সহিত মূলমন্ত্র তিনবার জপ করিয়া মদিরা, তীর্থজল কিংবা বিশুদ্ধ সলিলদ্বারা ঘট পূর্ণ করিবেন। তৎপরে নবরত্ন (অভাবে সুবর্ণ) ঐ ঘটমধ্যে নিক্ষেপ করিতে হইবে। অনন্তর গুরু “ঐঁ” এই বীজমন্ত্র পাঠপূর্বক ঘটমুখে কাঁঠাল, যজ্ঞডুমুর, অশ্বত্থ, বকুল ও আম্রবৃক্ষের পল্লব স্থাপন করিবেন। পরে “শ্রীঁ হ্রীঁ” এই মন্ত্র উচ্চারণ করিয়া ফল ও আতপতণ্ডুল-সমন্বিত সুবর্ণময়, রজতময়, তাম্রময় ও মৃন্ময় শরাব পল্লবোপরি রাখিবেন। তৎপরে বস্ত্রযুগ্মদ্বারা ঐ ঘটে গ্রীবা বন্ধন করিবেন। শক্তিমন্ত্রে রক্তবস্ত্র এবং শিব ও বিষ্ণুমন্ত্রে শ্বেতবস্ত্র ব্যবহার্য। পরে “স্থাং স্থীং হ্রীঁ শ্রীঁ স্থিরীভব” এই মন্ত্র পাঠ করিয়া ঘট স্থাপন করিবেন।
তদনন্তর অন্য একটি ঘটে পঞ্চতন্ত্র স্থাপনপূর্বক নয়টি পাত্রে বিন্যাস করিবেন। রজত দ্বারা শক্তিপাত্র, স্বর্ণ দ্বারা গুরুপাত্র, মহাশঙ্খ (নরকপাল) দ্বারা শ্রীপাত্র এবং তাম্র দ্বারা অন্য পাত্র সকল নির্মাণ করিবে। মহাদেবীর পূজাতে পাষাণ, কাষ্ঠ ও লৌহনির্মিত পাত্র ব্যবহার করিতে নাই। উপরিলিখিত পাত্র প্রস্তুত করিতে অসমর্থ হইলে নিষিদ্ধ পাত্র ব্যতীত অন্য পদার্থদ্বারা পাত্র নির্মাণ করিয়া লইবে। পরে পাত্র সংস্থাপন করিয়া গুরুগণের, ভগবতীর ও আনন্দভৈরবাদির তর্পণান্তর অমৃতপূর্ণ ঘটের অর্চনা করিবে। পরে ধূপ দীপ প্রদর্শন করিয়া সর্বভূতকে বলি প্রদান করিবে। তাহার পর পীঠদেবতাদিগের পূজাপূর্বক ষড়ঙ্গন্যাস করিবে। তদনন্তর প্রাণায়াম করিয়া মহেশ্বরীর ধ্যান ও আবাহনপূর্বক যথাসাধ্য উপচারে ইষ্টদেবতার পূজা করিবে। পূজাকালীন অবস্থানুসারে আয়োজন করিতে কদাচ কৃপণতা করিতে নাই। সদ্গুরু হোম পর্যন্ত কর্ম সমাপনান্তে পুষ্প, চন্দন ও বস্ত্রদ্বারা কুমারী, কৌল ও কুলরমণীর অর্চনা করিয়া তাঁহাদিগের নিকট শিষ্যের অভিষেকজন্য অনুজ্ঞা লইবেন। অনন্তর গুরু শিষ্যদ্বারা দেবীর পূজা করাইবেন। তৎপরে পূর্বস্থাপিত ঘটোপরি “হ্রীং স্ত্রীং শ্রীং”– এই মন্ত্র জপ করিয়া–
…ঘট চালনা করিবেন। অতঃপর শিষ্য উত্তরাভিমুখে উপবিষ্ট হইলে পূর্বোক্ত ঘটমুখে সংস্থাপিত পঞ্চ-পল্লবদ্বারা কলস হইতে জল লইয়া… (নির্ধারিত) মন্ত্রে শিষ্যের মস্তকে ও অঙ্গে সিঞ্চন করিবেন।…
…এই মন্ত্রে অভিষেক করিয়া, সাধক যদি পূর্বে পশ্বাচারীর কাছে দীক্ষিত হইয়া থাকেন, তবে কৌলগুরু পুনর্বার তাঁহাকে সেই দীক্ষিত মন্ত্র এই সময় একবার শুনাইয়া দিবেন। অনন্তর গুরু, শিষ্যকে আনন্দনাথান্ত (নিজ নিজ কল্প অনুযায়ী নামান্তর ভিন্নতা থাকতে পারে) নাম প্রদান করিয়া একবার সেই নামে ডাকিবেন এবং উপস্থিত কৌলগণকে শুনাইয়া দিবেন। যথা– একজনের পূর্বে নাম ছিল দ্বারকাচরণ; পূর্ণাভিষেকের পর গুরু নাম রাখিলেন “দুর্গানন্দ নাথ”।
অতঃপর শিষ্য মন্ত্রে নিজ দেবতার পূজা করিয়া, পঞ্চতত্ত্বোপচারে গুরুর পূজা করিবে। উপস্থিত কৌলগণকেও পূজা করা কর্তব্য। পরে গুরুদেবকে যথাশক্তি রত্নাদি দ্বারা দক্ষিণান্ত করিয়া চরণ স্পর্শপূর্বক প্রণাম করিবে।…
অনন্তর গুরু কৌলদিগের অনুমতি লইয়া শুদ্ধিসম্পন্ন পরামৃতপূর্ণ পানপাত্র শিষ্যের হস্তে সমর্পণ করিবেন। তৎপরে দেবীকে স্বহৃদয়ে ধ্যান করিয়া স্রুক্-সংলগ্ন ভস্মদ্বারা শিষ্যের ভ্রূমধ্যে তিলক প্রদান করিবেন। তদনন্তর চক্রানুষ্ঠানের বিধানানুসারে পান ও ভোজন করিবেন।
এতৎসংক্রান্ত সমস্ত কার্যই অর্থাৎ সংকল্প, পূজা, হোমাদি আপন আপন কল্পোক্ত বিধানানুসারে সম্পাদন করিবে। পূর্ণাভিষিক্ত ব্যক্তি তন্ত্রোক্ত সমস্ত সাধনারই অধিকারী হইয়া থাকে। পূর্ণাভিষেক না হইলে কোনরূপ কাম্যকর্মের ফলভাগী হওয়া যায় না। বিশেষতঃ কলিকালেই এই অনুশাসন সবিশেষ কার্যকরী।…
ব্রাহ্মণেতর যে কোন জাতি যথাবিধি পূর্ণাভিষিক্ত হইলে প্রণব ও সমস্ত বৈদিক কার্যে ব্রাহ্মণের ন্যায় অধিকার প্রাপ্ত হয়।’- (নিগমানন্দ সরস্বতী / তান্ত্রিকগুরু)
উপরে তন্ত্রগুরু নিগমানন্দ কর্তৃক পূর্ণাভিষেকের বর্ণনা দেয়া হলেও তন্ত্রশাস্ত্রে এই ক্রমদীক্ষার সাতটি পর্যায় রয়েছে বলে ‘তান্ত্রিকগুরু’ গ্রন্থটি থেকে জানা যায়। পর্যায়ক্রমিক এই দীক্ষাগুলো হচ্ছে– মন্ত্রদীক্ষা, শাক্তাভিষেক, পূর্ণাভিষেক, ক্রমদীক্ষা, সাম্রাজ্যদীক্ষা, মহাসাম্রাজ্যদীক্ষা ও পূর্ণদীক্ষা। এ-প্রেক্ষিতে স্বামী নিগমানন্দ বলছেন–
‘প্রথমতঃ গৃহস্থাশ্রমে অবস্থিতিপূর্বক সদ্গুরুর নিকট মন্ত্রদীক্ষায় দীক্ষিত হইয়া পশুভাবানুসারে বেদাচারদ্বারা বৈদিক কর্ম, বৈষ্ণবাচারদ্বারা পৌরাণিক কর্ম এবং শৈবাচারদ্বারা স্মার্ত কর্ম করিবে। পরে শাক্তাভিষিক্ত হইয়া দক্ষিণাচারদ্বারা সাধনা করিবে। তৎপরে পূর্ণাভিষেকান্তে গৃহাবধূত হইয়া বীরভাবানুসারে বামাচারদ্বারা যথাবিধি সাধনার উন্নতি করিবে। তৎপরে সাম্রাজ্যদীক্ষায় দীক্ষিত হইয়া বীরভাবানুসারে সিদ্ধান্তাচারে সাধনার কার্য সম্পন্ন করিবে। মহাসাম্রাজ্য-দীক্ষায় দীক্ষিত হইয়া দিব্যভাবানুসারে কুলাচারদ্বারা সাধন করিবে। তৎপরে পূর্ণ দীক্ষায় দীক্ষিত হইয়া দিব্যভাবানুসারে সাধনার চরমোন্নতি সম্পন্ন করিবে।
এইরূপ সাধনকার্যদ্বারা দিব্যভাব পরিপক্ক হইলে নিষ্ক্রিয় হইয়া কাল যাপন করিবে।’- (তান্ত্রিকগুরু)
এই উদ্ধৃতির মর্ম বুঝতে হলে তন্ত্রশাস্ত্রোক্ত ভাবত্রয় ও সপ্ত-আচার সম্পর্কে অবগত হওয়া আবশ্যক। কেননা এখানে কিরকম পদ্ধতি অনুসারে ত্রিবিধ ভাব ও সপ্ত আচারের ক্রিয়া সম্পন্ন করতে হবে তারই আলোচনা করা হয়েছে।
(সমাপ্ত)
সংযোগেঃ
রতন কর্মকার
*#গুরু_ভগবান_হতে_পারেন ?
*#প্রশ্নঃ গুরু কে কি ভগবান বলা যায়?
উত্তরঃ অবশ্যই বলা যায়।সাধারণের মধ্যে একটি অনাদি মুর্খামি রয়েছে কেউ যদি তার গুরু কে ভগবান বলে সম্বোধন করে তাহলে অনেকেই বলে না গুরু কে ভগবান বলা যায় না।
তাহলে কয়েকটা উদাহরন দেখে আসি। পূর্ব যুগের শিষ্যেরা গুরু কে ভগবান বলেই সম্বধন করতেন!
১)*#প্রশ্ন উপনিষদে ভরদ্বাজ নন্দন সুদেশা, শিবি পুত্র সত্যকাম, কৌশল্য ঋষি, পিপ্পলাদ কে ভগবান বলে উল্লেখ করেছেন ১.১.১।
২)*#ছান্দোগ্য উপনিষদে স্বয়ং নারদ, সনতকুমার কে বহুস্থানে ভগবান বলে সম্বোধন করেছেন 7.1. (1,2,3).
৩)*#ছান্দোগ্য উপনিষদে ১.১১.১ ঋষি উসস্তি কেও যজ্ঞকর্তা রাজা ভগবান বলে সম্বোধন করেছেন।
৪)*#মুণ্ডক উপনিষদে ১.১.৩ ঋষি শৌনক ঋষি অঙ্গীরা কে ভগবান বলে উল্লেখ করেছেন।
*#ভাগবতে বলা হয়েছে ১.২.১১
"তত্ববেত্তাগণ জ্ঞাতা ও জ্ঞেয়র অভেদ অখণ্ড অদ্বিতীয় সচ্চিদানন্দ স্বরূপ জ্ঞানকেই তত্ব বলে থাকেন।
সেই তত্বকেইকেই ব্রহ্ম, কেউ পরমাত্মা বা কেউ ভগবান বলে থাকেন।"
*#গীতা ৪.৩৫ শ্লোকেও এই তত্ব জ্ঞানের কথাই শ্রীকৃষ্ণ অর্জুন কে বলেছেন যে জ্ঞানের দ্বারা সর্বভূতে ঈশ্বর দর্শন করতে পারবে।
*#বিষ্ণু পুরাণ ৬.৫.৭৮
“ যিনি সৃষ্টি ও প্রলয় কে জানেন, জীবের গতি ও বিদ্যা ও অবিদ্যা সম্পর্কে জ্ঞাত তিনিই ভগবান।"
সুতরাং দেখাযাচ্ছে যে কেউ তার গুরু কে ভগবান বলতে পারে। অবশ্যই প্রতিটি গুরু তার শিষ্যের ভগবানই বটে।
*#ক্রিয়াযোগী_রবীন্দ্রনাথ
*#বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সারাজীবন ধরে বহু সাধুসন্তের সান্নিধ্যে এলেও ক্রিয়াযোগ এবং ক্রিয়াযোগীগণের সাথে আজীবন তাঁর নিবিড় সম্পর্ক ছিল। আর সেই সকলস্তরের সাক্ষাতের অমূল্য তথ্য তেমনভাবে উন্মোচিত না হওয়ায় অনেকেই জানেন না যে কবিগুরু কেবলমাত্র একজন কবিই নন বিখ্যাত যোগীও ছিলেন।
*#বিভিন্ন লেখনিতে সেই সব কথাই মূর্ত হয়ে উঠে। তার মাঝে কিছু কিছু তুলে ধরলাম- বাল্যকাল হতেই তিনি তাঁর পিতৃদেব মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের নির্দেশ মতো গায়ত্রী মন্ত্র জপ ও ধ্যান করিতেন।১
জীবন সায়হ্নে তিনি যোগীরাজ শ্যামাচরণ লাহিড়ী মহাশয়ের অন্যতম শিষ্য পরম পূজ্যপাদ শ্রীশ্রী ভূপেন্দ্রনাথ সান্যাল মহাশয়ের নিকট ক্রিয়াযোগে দীক্ষা লাভ করেছিলেন। ১৯০০ সালের কোনও এক সময় একটি বিশেষ ঘটনার মধ্যদিয়ে বোলপুরে প্রথম সান্যাল মহাশয়ের সাথে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাক্ষাৎ হয়।২
*#তখন সান্যাল মহাশয়ের বয়স মাত্র ২৬ বৎসর। সেই সময় তাঁদের মধ্যে দীর্ঘক্ষণ বিভিন্ন বিষয়ের উপর আলোচনা হয়। তারপর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাথে শ্রীশ্রী ভূপেন্দ্রনাথ সান্যাল মহাশয়ের এক নিবিড় আত্মিক সম্পর্ক তৈরি হয় ও সান্যাল মহাশয় ঠাকুর পরিবারে গৃহশিক্ষক হিসাবে নিযুক্ত হন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দাদা এবং পরিবারের সকলেই শ্রীশ্রী ভূপেন্দ্রনাথ সান্যাল মহাশয়কে গুরুজ্ঞানে শ্রদ্ধা ও ভক্তি করতেন।৩
আবার দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর সম্বন্ধে বলতে গিয়ে সান্যাল মহাশয় ঋষিকল্প মহাত্মা বলে উল্লেখ করেছেন।৪
*#প্রসঙ্গত উল্লেখ্য দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের জ্যেষ্ঠ্য পুত্রবধূ শ্রীযুক্তা হেমলতা ঠাকুর আজীবন শ্রী ভূপেন্দ্রনাথ সান্যাল মহাশয়কে গুরুজ্ঞানে শ্রদ্ধা ও ভক্তি করতেন এবং নিয়মিত বিভিন্ন বিষয়ে পত্রালাভের মাধ্যমে তাদের দুইজনের মধ্যে যোগাযোগ ছিল।৫
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পিতৃদেব মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের মৃত্যুকালে সান্যাল মহাশয় ভগবৎ কথা শুনিয়েছিলেন।৬
পরবর্তীকালে ১৯০২ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একান্ত অনুরোধে সান্যাল মহাশয় শান্তিনিকেতনের ব্রহ্মচর্যাশ্রমের প্রথম অধ্যক্ষ পদে অধিষ্ঠিত হন।৭
*#পরবর্তীকালে ১৯০৩ হতে ১৯১০ সাল পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যোগাচার্য্য ভূপেন্দ্রনাথ সান্যাল মহাশয়ের নিবিড় সান্নিধ্যে আসেন।৮ (সেই সময়কার বিবরণ শ্রী প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় মহাশয়ের রচিত ‘রবীন্দ্র জীবনী’ গ্রন্থে প্রকাশিত হয়েছে।)
পরবর্তী সময়ে একান্ত ব্যক্তিগত কারণ সান্যাল মহাশয় শান্তিনিকেতনের ব্রহ্মচর্য্যাশ্রমের দায়িত্ব ভার ছেড়ে দেন। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে আজীবন তাঁর নিবিড় অন্তরঙ্গতা অক্ষুন্ন ছিল। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বহুবার সান্যাল মহাশয়ের গৃহে এসেছেন ও সময়ে বহুক্ষেত্রে অর্থ সাহায্য ও করেছেন। পরবর্তীকালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও সান্যাল মহাশয়ের বহু চিঠিতে তা প্রকাশ পায়।৯
*#পরবর্তী সময়ে তাঁরা দুইজনে গোপনে ভারতের বহু তীর্থস্থান ভ্রমণ করেন ও বহু সাধুসঙ্গ করেন। ১৯১২ সালে একবার কাশীর রাণামহল ঘাটে যোগীরাজ শ্যামাচরণ লাহিড়ী মহাশয়ের অপর এক শিষ্য কৃষ্ণরামজীর আধ্যাত্মিক অনুভূতি ও নির্লোভ অবস্থা দেখে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অভিভূত হয়েছিলেন।১০
এই সময় পরমপূজ্যপাদ শ্রীশ্রী ভূপেন্দ্রনাথ সান্যাল মহাশয় সাতটি পুস্তক রচনা করেন। প্রত্যেকটি পুস্তক বঙ্গীয় ধার্ম্মিক সাহিত্যে এক অনবদ্য অবদান। তাঁর রচিত শ্রীমদ্ভগবদগীতার (তিন খণ্ড) ভূমিকা রচনা করেন তৎকালীন কাশীর সংস্কৃত কলেজের অধ্যাপক শ্রীযুক্ত মহামহোপাধ্যায় গোপীনাথ কবিরাজ মহাশয় স্বয়ং। সেই ভূমিকাতে স্বয়ং গোপিনাথ কবিরাজ মহাশয় শ্রীযুক্ত সান্যাল মহাশয়ের ভূয়সী প্রশংসা করেন।
তাঁর রচিত ‘অভ্যাসযোগ’ নামক পুস্তকের প্রাপ্তি স্বীকার করে প্রবাসী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যে চিঠি দেন সেখানে তিনি উল্লেখ করেন-
*#এবারকার মেলে আমি দুইখানি বই একসঙ্গে পেলাম একখানি আপনার ‘অভ্যাসযোগ’। দুইখানিই আমার প্রবাসের বন্ধুরূপে দর্শন দিয়াছে। একটিতে আমাদের দেশের সৌন্দর্য আর একটিতে আমাদের দেশের সাধনা আমার সঙ্গ লইয়াছে। উভেয়েতেই আমার প্রয়োজন এবং অনুরাগ।১১
‘দিনচর্য্যা’ পাঠ করে কবিগুরু লেখেন- ‘আপনার দিনচর্য্যা পড়ে উৎসাহ এবং উপকার পেয়েছি। এ বইটি কাজের হয়েছে। এবং এর মধ্যে ভাবের ও অভাব নেই।’১২
*#যোগীরাজ শ্যামাচরণ লাহিড়ী মহাশয়ের অন্যতম শিষ্য স্বামী যুক্তেশ্বর গিরি মহারাজের দুই শিষ্য পরমহংস যোগানন্দ এবং স্বামী সত্যানন্দ গিরি মহারাজ, নোবেলজয় লাভের কিছুদিন পর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। সেই সময় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ক্রিয়াযোগের কিছু প্রাথমিক পদ্ধতি সম্বন্ধে অবগত হন।১৩
স্বামী সত্যানন্দ গিরি মহারাজের (পূর্বেনাম মনোমোহন মজুমদার) কলেজের বন্ধু ছিলেন প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জোড়াসাঁকোস্থ বাড়িতে বিচিত্রা ক্লাবে প্রভাত বাবুর সহযোগীতায় স্বামী সত্যানন্দ গিরি বহুবার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাথে দেখা করেন এবং অত্যন্ত অন্তরঙ্গভাবে তাঁর সহিত বহু বিষয়ে পরামর্শ করেন। পরবর্তীকালে ১৯২১ সালে স্বামী সত্যানন্দ গিরি মহারাজ কবিগুরুর আমন্ত্রণে শান্তিনিকেতনে এসেছিলেন। সেই সময় স্বামী সত্যানন্দ গিরি একজন উন্নত ক্রিয়াযোগী জেনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর নিকট হতে কিছু প্রাথমিক ক্রিয়া পদ্ধতি শিক্ষা লাভ করেন এবং স্বামী সত্যানন্দ গিরি মহারাজকে অনুরোধ করেন শান্তিনিকেতনের শিক্ষক হিসাবে যুক্ত হতে। কিন্তু কিছু ব্যক্তিগত কারণ স্বামী সত্যানন্দ গিরি মহারাজ কবিগুরুর সেই অনুরোধ সবিনয়ে প্রত্যাখ্যান করেন।১৪
*#পরমহংস যোগানন্দের ভ্রাতা শ্রীযুক্ত শ্রী সনন্দলাল ঘোষ মহাশয় কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি দণ্ডায়মান অবস্থার চিত্র অঙ্কন করেছিলেন। কবিগুরু স্বয়ং সেই চিত্র দেখে বিস্ময়ে অভিভূত ও এতটাই সন্তুষ্ট হয়েছিলেন যে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে একখানি প্রশংসাপত্র পাঠিয়েছিলেন শ্রীযুক্ত সনন্দলাল ঘোষ মহাশয়কে। সেখানে তিনি তাঁর দাঁড়ানো ভঙ্গিতে ভালো ছবিগুলির মধ্যে শ্রেষ্ঠ বলে উল্লেখ করেন। পরবর্তীকালে দিল্লির অ্যাসেমব্লিতে শ্রীযুক্ত সনন্দলাল ঘোষ মহাশয়ের আঁকা ছবিটির অনুকরণে কবিগুরুর একটি মর্মর মূর্তি স্থাপিত হয়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য শ্রীযুক্ত সনন্দলাল ঘোষ মহাশয় পূজ্যপাদ যুক্তেশ্বর গিরি মহারাজের নিকট ক্রিয়াযোগ প্রাপ্ত হলেও পরবর্তীকালে ক্রিয়াযোগের উচ্চতর সাধন পদ্ধতি লাভ করেন শ্রীশ্রী ভূপেন্দ্রনাথ সান্যাল মহাশয়ের নিকট হতে।১৫
অবশেষে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জীবন সায়হ্নে এসে ৭৮ বছর বয়সে পরমপূজ্যপাদ শ্রীশ্রী ভূপেন্দ্রনাথ সান্যাল মহাশয়ের নিকট ক্রিয়াযোগে দীক্ষা লাভ করেন। সান্যাল মহাশয় কবিগুরুকে আত্মসাক্ষাৎ করিয়ে দেন ও ক্রিয়াযোগের অপরাপর সকল কর্মের (দেহের পবিত্রীকরণ, অঙ্গশোধন ইত্যাদি) মধ্যদিয়ে দীক্ষাদান সম্পন্ন করেন। দীক্ষা গ্রহণকালে কবিগুরু এবং সান্যাল মহাশয়কে সাহায্য করেন পরমহংস যোগানন্দজীর কনিষ্ঠ ভ্রাতা শ্রীযুক্ত বিষ্ণুচরণ ঘোষ মহাশয়ের শিষ্য ও জামাতা বিশিষ্ট ক্রিয়াযোগী বুদ্ধদেব বসু মহাশয়।
*#ক্রিয়াযোগে দীক্ষিত হবার পরই শ্রদ্ধেয় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও ক্রিয়াযোগী বুদ্ধদেব বসু মহাশয়ের একত্রে একটি ছবি তোলা হয়েছিল তা সংযুক্ত করলাম। সেই সঙ্গে কবিগুরু স্বহস্তে একটি প্রশস্তি পত্রও দিয়েছিলেন বুদ্ধদেব বসু মহাশয়কে।১৬
ক্রিয়াযোগে দীক্ষিত হবার পর আর মাত্র দুই বৎসর তিনি জীবিত ছিলেন। সেই সময় তিনি ভীষণ অসুস্থ ও পীড়াগ্রস্ত থাকলেও নিয়মিত রাত্রির শেষভাগে যোগাভ্যাস করতেন এবং অতি অল্প সময়ে আধ্যাত্ম জগতের অতি উচ্চাবস্থা প্রাপ্ত হন। এই বিষয়ে যোগীবর শ্রী ভূপেন্দ্রনাথ সান্যাল মহাশয় স্বয়ং বলেছেন, ‘সেই সময় কবিগুরু ধ্যানের মধ্যে এতোটাই মগ্ন হয়ে পড়িতেন যে বাহ্য চেতনা পর্যন্ত লুপ্ত হইতো।’১৭
*#বয়সে ছোট হলেও কবিগুরু সান্যাল মহাশয়কে গুরবৎ শ্রদ্ধা ভক্তি করতেন।১৮
Continue-50
***#রাধাভাব
*#রাধা উল্টো ধারা (আনন্দ ধারা ) সাধক নিজের মনের ভেতর বুঝতে পারছে যে, কৃষ্ণকে না পেয়ে আমার অস্তিত্ব নিরর্থক হয়ে যাচ্ছে, কৃষ্ণকে না পেলে আমি আর এক তিলও বাঁচতে পারব না, এই মানসিকতাটার নাম হলো রাধা (মনের) মানসিকতা।
*#অর্থাৎ আরাধনা ছাড়া সে আর কিছুই জানেনা। এই রাধা মানসিকতার চরম বিকাশ পাচ্ছি ব্রজের কৃষ্ণে- আর কোথাও নয়।
*#মানুষের মন (রাধা ) যখন পরমপুরুষকে পাবার জন্য অত্যন্ত ব্যাকুল হয়, যখন সে সব কাজে পরমপুরুষকে দেখবার চেষ্টা করছে ও শেষ পর্যন্ত দেখছে, এই যে পাবার আকুতি, এটাকে সংস্কৃতে বলে “আরাধনা”(আ+রাধ্+অনট্+আ = আরাধনা)
আর যে আরাধনা করে সেই হলো রাধা। রাধা হচ্ছে ভক্তের মন l
*#এই যে রাধাভাব/মনভাব , এটা হচ্ছে মধুর ভাব। কারণ, জীবনের যা কিছু মধুর অভিব্যক্তি, যা কিছু মাধুর্য্যময় কর্মচর্চা ও কর্ম অনবয়, সেগুলো কৃষ্ণের মধ্যে (৬৪গুণ) পাই এই মধুর রাধাভাব/মনভাব।
*#মধুর_ভাবঃ
আমি আমার সর্ব সত্তা- শারীরিক, মানসিক, সামাজিক, আধ্যাত্মিক; আমার সর্বসত্তাকে কেন্দ্রীভূত করে তাকে এক বিন্দুতে পর্যবসিত করে আমার সকল আনন্দ ঐ কৃষ্ণের ভিতর দিয়ে পাব- এই যে মধুর ভাব, এই হলো রাধা ভাব/মনের ভাব ।
*#অর্থাৎ কৃষ্ণরূপী (কষ) মহাবিশ্বের প্রাণকেন্দ্র বা মধ্যমনির মধ্যে আমার অর্থাৎ সকল সাধক বা সাধিকার মন যখন এক বিন্দুতে পর্যবসিত হয়ে আনন্দ (ধারা /রাধা ) লাভ করবে। সাধক সাধিকাদের সেই অবস্থার আনন্দময় সুমধুর ভাবটাই হলো রাধাভাব।
*#বিশ্বের সকল মানুষ, জাতি, বর্ণ, ধর্ম, দেশ, ভাষা নির্বিশেষে, সকলেই এক একজন সম্ভাবনাময় রাধা (আনন্দ ধারা )। ব্যাপকার্থে সকল নারী সকল পুরুষই রাধা, যদি তার মন, তার সর্বসত্তা উপরোক্ত মানস অবস্থাপ্রাপ্ত হয়।
তাই সকল সম্প্রদায়ের নর-নারীকে সেই মধুর রাধাভাবকে অর্জনের জন্যে পরমপুরুষকে স্মরণ-মনন নিধি ধ্যানাসনের মধ্যে দিয়েই এগোতে হবে। তবেই মানস আধ্যাত্মিক রাধাভাবকে/মনোভাবকে অর্জন করা যাবে।
*#স্মরণ-মনন নিধিধ্যানাসনের মধ্য দিয়ে পরমপুরুষের দিকে এগিয়ে যাওয়াটাকেই বলে মানস আধ্যাত্মিক সাধনা বিজ্ঞান।
এই মানস আধ্যাত্মিক বিজ্ঞানের পথে অর্জিত রাগাত্মিকা (অনুরাগী) ভক্তি’র দ্বারা বিন্দুতে পর্যবসিত মনের যে মধুর ভাবাবস্থা সেই ভাবাবস্থাই হলো মানস আধ্যাত্মিক রাধা ভাব/মনের ভাব। শ্রীকৃষ্ণকে স্বচ্চিদানন্দ বলা হয় কারন তার মনে কোন বিষাদ নেই, সুখ দুঃখের অবকাশ নেই। তিনি এক অবস্থায়
আনন্দের (রাধা /ধারার) মধ্যে স্থির থাকেন। তিনি কেবল আনন্দেই বিহার করেন তাই তার
নাম "সশ্চিদানন্দ"। সে আনন্দটাই (রাধা) হচ্ছে শ্রীকৃষ্ণের প্রিয় স্থান। যারা মনে আনন্দকে (রাধাকে) ধারন করেছেন সেখানেই শ্রীকৃষ্ণ বিরাজ করেন। সে আনন্দই হচ্ছে শ্রীকৃষ্ণ পরমাত্মার নিবাস স্থান। "মানুষের দেহে ৫ টি স্তর আছে"। এই ৫ টি স্তরের মধ্যে কোন স্তরে শ্রীকৃষ্ণ পরমাত্মার অংশ স্বরূপ আত্মার নিবাস স্থান সেটা দেখে নিই।
১) অন্নময় কোষ --- যাহা অন্ন দ্বারা গঠিত হয়েছে। অর্থাৎ এই স্থুল শরীর।
২) প্রানময় কোষ --- এই স্থুল শরীরের ভেতর সূক্ষ্মশরীর অবস্থিত।
৩) মনময় কোষ --- এটা প্রানময় কোষের ভেতর আরো সূক্ষ্মভাবে অবস্থিত।
৪) বিজ্ঞানময় কোষ --- এটা মনময় কোষের ভেতর আরো সূক্ষ্মভাবে অবস্থিত।
৫) আনন্দময় কোষ --- এটা বিজ্ঞানময় কোষের ভেতর আরো সূক্ষ্মভাবে অবস্থিত।
*#এই আনন্দময় (রাধাময় /মনময় /ধারা /নাড়ি ) কোষের মধ্যে শ্রীকৃষ্ণ পরমাত্মার অংশ স্বরূপ আত্মার অবস্থান।
অর্থাৎ যেখানে আনন্দ সেখানে সশ্চিদানন্দ। যেখানে রাধা (আনন্দ ধারা ) সেখানে শ্রীকৃষ্ণ। আর যেখানে রাধা নেই সেখানে শ্রীকৃষ্ণ (আত্মা নেই /রাধা নেই /দেহে আত্মা কোথায় মনের জানা নেই ) ও নেই। তাই নারী খুঁজে চলেছে/আসবে অপেক্ষায় আছে।
*#রাধা_কোন_নারী_নয়, আনন্দের যেহেতু কোন রূপরেখা নাই। এখানে মানুষকে সহজে বুঝানোর জন্য নারী রূপ দেওয়া হয়েছে।(তিন লক্ষ্য বাহাত্তর হাজার সাড়ে তিনটে নারীর মধ্যে শেষ্ঠ নারী )l নাড়ি শোধন করুন সৎ গুরুর বীজ মন্ত্র দিয়ে।
***#অমরত্ব
*#আলেকজান্ডার চেয়েছিলেন অমর হতে। তাই তিনি ভারতে এসেছিলেন অমরত্বের সন্ধানে। অনেক খোঁজাখুঁজির পর এক যোগীর সন্ধান পান তিনি। সম্রাটের আদেশে তাঁর সৈন্যরা সেই যোগীকে গিয়ে বলল, "আমাদের সাথে এক্ষুনি যেতে হবে"। "আমি কোথাও যাই না, সম্রাটের ইচ্ছে হলে এখানে আসতে পারে", যোগী জানায়।
*#এই কথা শুনে সৈন্যরা মূহুর্তে তরবারি বের করে বলে চল নাহলে তোমার মুন্ডু নিয়ে যাব। যোগী নির্বিকার, হাসল, বলে তাহলে তাই কর। সৈন্যরা এরকম আশ্চর্য জিনিস দেখে নি যার মৃত্যুভয় নেই। কিছুক্ষণ অবাক হয়ে থেকে তারা ফিরে গেল এবং সম্রাটকে সমস্ত জানাল।
*#আলেকজান্ডার অগত্যা নিজেই এলেন কারণ অমরত্ব বড় বালাই। যোগীকে জিজ্ঞেস করলেন, "তুমি কি আমায় অমরত্বের সন্ধান দিতে পারো?" যোগী তাকে এক স্বচ্ছ জলের সরোবরের সন্ধান দিলেন এবং সেই জল পান করতে বললেন।
*#আলেকজান্ডার যোগীর নির্দেশিত পথে যাত্রা শুরু করলেন এবং যেমন যেমন বলেছিল যোগী, তেমন তেমন মিলে গেল। তিনি সেই স্বচ্ছ জলের সরোবরের সন্ধান পেলেন।
*#কিন্তু যেইমাত্র তিনি হাতে আঁজলা করে জল নিয়ে পান করতে যাবেন, আওয়াজ এল, "খেয়ো না, খেয়ো না"! অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখলেন একটা কাক, তাকে সতর্ক করছে। কাকটা বলল জানো আমার কি কষ্ট! আমি অমর। আমার মৃত্যু নেই কারণ আমি এই জল পান করেছিলাম কত হাজার বছর আগে। আমার একটুও বেঁচে থাকতে ইচ্ছে করে না। কিন্তু কি করব! আমার সাধ, আহ্লাদ কিছু নেই! এইভাবে বেঁচে থাকা যে কি কষ্ট তা কল্পনাও করতে পারবে না! আমি আত্মহত্যাও করতে পারি না!
*#আলেকজান্ডার কিঞ্চিত থমকে গেলেন। জীবনে এই প্রথম দোর্দন্ডপ্রতাপ সম্রাট ঘাবড়ে গেলেন, হাতের জল গলে পড়ে গেল। কি একটা ভেবে প্রচন্ড ভয় পেলেন। উঠে দাঁড়ালেন এবং ধীরে ধীরে পিছন ফিরে চলে গেলেন।
*#মৃত্যু সুন্দর, খুব সুন্দর। একটা পূর্ণ জীবন কাটিয়ে নির্দিষ্ট সময়ে পৃথিবী ছেড়ে চলে যাওয়াটা যে কত সুন্দর ও বাঞ্ছনীয়, তা যারা সেই সুযোগ দেরীতে পায় তারাই একমাত্র অনুভব করতে পারে। সবথেকে আনন্দের জিনিস হলো আমরা জানি যে আমাদের একদিন মৃত্যু হবে। তাই যতদিন আছি আনন্দ করে বাঁচি, এটাই আশা করা উচিত। জীবন দীর্ঘ নয়, আনন্দের হোক।
*#অমরত্ব লাভ হোক ভাবনায়, কর্মে, অনুভবে, চেতনায় ....শরীরে নয়। যোগীদেরও মৃত্যু হয়। যোগ মানে অমরত্ব নয়, যোগ মানে সংবেদনশীল জীবনযাপন।
"শিবতত্ত্ব কি?"
শাস্ত্র বলেন-
"যতঃ সর্ব্বং সমুৎপন্নং নির্গুনাৎ পরমাত্মনঃ।
তদেব শিব সংজ্ঞং হি বেদ বেদান্তিনো বিদুঃ।।"
অর্থাৎ, " যে নির্গুন পরমাত্মা হতে এই সমস্ত জগত উৎপন্ন হয়েছে তাই শিবতত্ত্ব। বেদ বেদান্ত বিদগণ একথা বলেন।"
"ন যস্মাদধিকং কিঞ্চিৎ তত্তত্ত্বং বিদ্ধি শাঙ্করম্।।"
অর্থাৎ, " যা অপেক্ষা অধিক আর কিছু নাই, তাই শিবতত্ত্ব।"
শিব কেবল দেবতামাত্র নন, বরং বেদান্ত প্রতিপাদিত ব্রহ্ম। সুতরাং তিনি সবার প্রভু। বেদান্ত বলেন-
"সর্বস্য প্রভুমীশানং সর্বস্য শরণং বৃহৎ।।"
- শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ।
# বৈদিক আলোচনার প্রথমে জানতে হবে- বেদ শব্দের ধাতুগত অর্থ জ্ঞান বা বিদ্যা। বিদ্যা দুই রকম। পরমতত্ত্ব বিষয়ক জ্ঞান হচ্ছে- পরা বিদ্যা। আর জাগতিক লৌকিক জ্ঞান হচ্ছে- অপরা বিদ্যা। বেদে কিন্তু দুই বিদ্যাই স্থান পেয়েছে। কিন্তু পরা বিদ্যা হল শ্রেষ্ঠ বিদ্যা।
" দ্বৈ বিদ্যে বেদিতব্যে ইতি হ স্ম
যদ্ব্রহ্মবিদো বদন্তি পরা চৈবাপরা চ।।"
- মুণ্ডক উপনিষদ।
বেদ নিষ্ঠা আবার দুই ভাগে বিভক্ত। যথা- ১. কর্ম কাণ্ড ২. জ্ঞান কাণ্ড।
কর্ম কাণ্ড হল জাগতিক তথা প্রবৃত্তি মার্গ আর জ্ঞান কাণ্ড পারমার্থিক তথা নিবৃত্তি মার্গ। এই জ্ঞান কাণ্ডের অন্তর্ভুক্ত হল উপনিষদ। উপনিষদ শিরোভাগ। সমস্ত বেদজ্ঞানের সার। বেদের সর্বোচ্চ এবং সর্বশেষ জ্ঞান। তাই উপনিষদের আরেক নাম বেদান্ত। আর উপনিষদ বেদের সংহিতা এবং ব্রাহ্মণ দুই ভাগ থেকেই এসেছে। উপনিষদের সংখ্যা অনেক। তবে মৌলিক উপনিষদ হিসেবে ১২ খানাকে গ্রহণ করা হয়। যথা-
১। ঈশ - শুক্ল যজুর্বেদ।
২। বৃহদারণ্যক - " ।
৩। তৈত্তিরীয় - কৃষ্ণ যজুর্বেদ।
৪। কঠ - " ।
৫। শ্বেতাশ্বতর - " ।
৬। ঐতরেয় - ঋক্বেদ।
৭। কৌষিতকী - " ।
৮। কেন - সামবেদ ।
৯। ছান্দোগ্য - " ।
১০। প্রশ্ন - অথর্ববেদ।
১১। মুণ্ডক - " ।
১২। মাণ্ডুক্য - " ।
# সত্য তথা প্রভু এক, জ্ঞানীরা তাকে বিভিন্ন নামে ডাকেন। তাঁর অনেক নামের মধ্যে প্রসিদ্ধ অষ্টনাম হল-
" শিবো মহেশ্বরশ্চৈব রুদ্রো বিষ্ণুঃ পিতামহঃ।
সংসার বৈদ্যঃ সর্বজ্ঞঃ পরমাত্মেতি মুখ্যতঃ।।
নামাষ্টকমিদং নিত্যং শিবস্য প্রতিপাদকম্।।"
" সর্বদা পরমশিবের প্রতিপাদক আটটি নাম হল - শিব, মহেশ্বর, রুদ্র, বিষ্ণু, ব্রহ্মা, সংসার বৈদ্য (তারকব্রহ্ম), সর্বজ্ঞ (ব্রহ্ম) এবং পরমাত্মা। "
সুতরাং একই পরম সত্ত্বা বহুরূপে বিরাজমান।
"সোহকাময়ত অহং বহুস্যাং প্রজায়েয়।"
তাহলে বিশ্বজগৎ সৃষ্টির পূর্বে কী ছিল? উত্তরে বেদান্ত বলেন-
" যদাহতমস্তন্ন দিবা ন রাত্রিঃ ন সন্ন চাসঞ্ছিব এব কেবলঃ।
তদক্ষরং তৎসবিতুর্বরেণ্যং প্রজ্ঞা চ তস্মাৎ প্রসৃতা পুরাণী।।"
- শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ।
" যখন জ্ঞানের প্রকাশ হয় তখন - দিনও ছিল না, রাত্রিও ছিল না, সৎও ছিল না, অসৎও ছিল না। তখন শুধুমাত্র শিবই ছিলেন। তিনি আদিত্য মণ্ডলেরও বরণীয়। তাঁর থেকেই অনাদি জ্ঞান বিস্তারিত হয়েছে।"
শিব পরমেশ্বর। এই অনন্ত বিশ্বজগতের যিনি স্রষ্টা, অধীশ্বর, তিনি নির্বিকার, নিরঞ্জন। কিন্তু সর্বশক্তিমান তিনি অবলীলায় নাম রূপ ধারন করেন। শিব নাম দিয়ে সেই পরমসত্বাকে বুঝানো হয়। কিন্তু অজ্ঞ ও সঙ্কীর্ণচিত্ত বৈষ্ণবরা(যারা বিশুদ্ধ বৈষ্ণব নয়) শিব নামের তাৎপর্য অনুধাবন করতে না পেরে শিব ও শৈবদের অবজ্ঞা করেন।
আজকাল বিশুদ্ধ বৈষ্ণব খুব একটা দেখা যায় না। তবে আছেন। তাদের শ্রদ্ধা জানাই। কিন্তু অজ্ঞরা শিবকে শ্রীকৃষ্ণের দাসে পরিনত করেছে। আর শৈবরা নাকি দাসের দাস! তামসিক! শিবকে পরমেশ্বর বললে তাদের নাকি অসহ্য লাগে! কত বড় অজ্ঞতা!!!
শৈবদের তো তাদের চোখেই লাগে না। হিংসার, প্রতিশোধের বীজ হৃদয়ে নিয়েও নিজেকে বৈষ্ণব ভাবে। কি আশ্চর্য!!! তারা ৩য় শিক্ষাষ্টকে শ্রীচৈতন্যদেব কি বলেছেন সেটা ধারণ করেন না। বৈষ্ণব তথা কৃষ্ণভক্ত হতে হলে শিক্ষাষ্টক মানলে আর কিছুই লাগে না। সেখানে আছে প্রেমের কথা। কোনো বিদ্বেষ মনোভাব নেই। আর এটা চৈতন্যদেবের মতবাদ হিসেবে সবচেয়ে বিশুদ্ধ বলা যায়। শিবকে বৈষ্ণব বলে মানতে হলে, এখানে তিনি তা বলে দিতেন। কিন্তু এগুলো বাহ্যিক বিষয়। তাই তিনি যা পালনীয়, সেটাই আটটি শ্লোকে বলেছেন।
আবার আমি দেখেছি অনেক অজ্ঞ ব্যক্তি প্রভু বিষ্ণু ও শ্রীকৃষ্ণকে নিয়েও ঝগড়া করে। যেমন কেউ বলে শ্রীকৃষ্ণ হলেন বিষ্ণুর অবতার, আবার কেউ বলেন বিষ্ণু হলেন শ্রীকৃষ্ণের অবতার। আবার কেউ বলেন বিষ্ণু শ্রীকৃষ্ণের অংশ প্রকাশ। যদিও বেদ-বেদান্তে ভাগবতের বাসুদেব, প্রদ্যুম্ন, সংকর্ষণ, অনিরুদ্ধ এমন চতুর্ব্যূহের বিশেষ কিছু উল্লেখ নেই। চতুর্ব্যূহের প্রধান বাসুদেবই ব্রহ্ম। যথা-
"পরম কারণাত্ পরব্রহ্মভূতাত্ বাসুদেবাত্ সংকর্ষণী নাম জীব জায়তে, সংকর্ষণাত্ প্রদ্যুম্নসংজ্ঞা মনো জায়তে তস্মাদ্ অনিরুদ্ধ সংজ্ঞাতোহংকারা জায়তে।।"
অর্থাৎ- বাসুদেব, সংকর্ষণ, প্রদ্যুম্ন, অনিরুদ্ধ হচ্ছে ব্রহ্ম, জীব, মন ও অহংকারেরই নামান্তর। ব্রহ্ম থেকে জীব(সংকর্ষণ) উৎপন্ন হয়, তা থেকে মন ও মন থেকে অহংকার।
অবশ্য এটার আরও অনেক ব্যাখ্যা আছে।
সুতরাং বাসুদেব পরব্রহ্মের একটি নাম হতে পারে। উপনিষদে বলা হয়েছে -
সর্বভূতাধিবাসং যদ্ ভুতেষু চ বসত্যপি।
সর্বানুগ্রাহকত্বেন তদস্ম্যহং বাসুদেবঃ ইতি।।
- অমৃতবিন্দু উপনিষদ।
অতএব বুঝা যাচ্ছে- পরমাত্মা সর্বভূতের মধ্যে বাস করেন তাই তিনি বাসুদেব। কিন্তু লক্ষণীয় বিষয় হলো- শ্রীকৃষ্ণ কিন্তু ভগবদ গীতায় ভক্তির কথা বললেও চতুর্ব্যূহের উল্লেখ করেন নি।
সুতরাং স্পষ্টভাবে বলা যায়- ভগবদ গীতা একটি ভাগবতীয় ভক্তি শাস্ত্র নয়। বরং যোগশাস্ত্র। এবং ভগবদ গীতার প্রতিপাদ্য বিষয় হল ব্রহ্মবিদ্যা। ভগবদ গীতার প্রতিটি অধ্যায়ের নামের সাথেই যোগ শব্দ যুক্ত রয়েছে। আর প্রতিটি অধ্যায়ের শেষে রয়েছে-
"ইতি মহাভারতে শ্রীমদ্ভগদগীতাসুপনিষদসু ব্রহ্মবিদ্যায়াং যোগশাস্ত্রে শ্রীকৃষ্ণার্জুন সংবাদে--------যোগ নাম------ অধ্যায়ঃ।।"
সুতরাং শ্রীকৃষ্ণ যোগযুক্ত চিত্তে ব্রহ্মভূমিতে গিয়েই ব্রহ্মবিদ্যা আলোচনা করেছেন। কারন বেদান্ত বলেন-
"ব্রহ্মবেদ ব্রহ্মৈব ভবতি"।
কিন্তু এগুলো নিয়ে আমার কোনো আপত্তি নাই । তবে শ্রীকৃষ্ণকে ব্রহ্ম প্রতিপাদন করতে গিয়ে শিবকে সামান্য দেবতামাত্র বলে উল্লেখ করলে, তাতে আমার তথা শৈব যোগী সংঘের ঘোর আপত্তি আছে।
নিজের আরাধ্যকে পরমেশ্বর সাজাতে গিয়ে অন্য মতের অথবা ধর্মের আরাধ্যকে ছোট করতে যাওয়া হিংসা পরায়ন মন অথবা অজ্ঞানতার পরিচায়ক।
কেউ কেউ শ্রীবিষ্ণুকে পরমেশ্বর রূপে উপস্থাপন করতে গিয়ে বলেন শিব শব্দটি বেদবেদান্তে এসেছে একটি গুন হিসাবে। অর্থাৎ শিব অর্থ মঙ্গল। তাই দেবদেবীকে মঙ্গল না বলে শিব বলা হয়েছে, অথবা তাঁদের নামের সাথে শিব শব্দটি জুড়ে দেওয়া হয়েছে। সুতরাং বেদান্তে যত জায়গায় শিব শব্দটি আছে, তত জায়গায় কৌশলে এরা প্রমাণ করতে চান শিব অর্থে মঙ্গল বুঝানো হয়েছে। আর শৈবদের হুংকার দিয়ে প্রশ্ন ছুড়ে বলেন, প্রমাণ করো- "শিব একজন পৃথক দেবতা।"
কিন্তু শিবকে আমি কখনই পৃথক দেবতা বলব না। তিনি একমাত্র সত্বা পরম ব্রহ্ম, নির্বিকার, নিরঞ্জন। তিনি কখনই পৃথক নন। কিন্তু তাঁর ভিন্ন ভিন্ন নাম রূপ রয়েছে। কারন তিনি সর্বশক্তিমান। রুদ্র তাঁর বৈদিক আদি দেব রূপ। আবার পরম শিবকে ঈশ, ঈশান, মহেশ্বর, ভূতেশ্বর, নীলকণ্ঠ, শূলপাণি, গিরিশন্ত,সোম, হর প্রভৃতি নামেও আখ্যায়িত করা হয়। এগুলো শিবের নাম নয়- এটা বলা হাস্যকর।
আর যারা বলেন শিব একটি গুণ মাত্র- কোনো সত্বার নাম নয়, তখন অবাক হই। কারন তারা যুক্তি দেখান বেদ বেদান্তে শিব হল বিশেষণ। আবার প্রশ্ন রাখেন- "শৈবদের কি বিশেষ্য বিশেষণ জ্ঞান আছে??
এমন অজ্ঞোচিত প্রশ্ন শুনে পিলে চমকে যেতে হয়। কারন বেদ জানতে হলে আগে বেদাঙ্গ জানতে হয়। আর ষড়ঙ্গ বেদের একটি হল ব্যাকরণ। তাহলে প্রশ্নেরই কোনো প্রাসঙ্গিকতা থাকে না। অতএব প্রশ্ন কর্তাই বিশেষ্য বিশেষণ এর প্রকার ভেদ জানেন না। বিশেষ্য এর প্রকার ভেদ এর মধ্যে যে একটা - গুণবাচক বিশেষ্য; আর বিশেষণের প্রকারভেদের মধ্যে একটা- নাম বিশেষণ আছে, সেটা হয়ত তিনি জানেন না। যদিও শিব ব্রহ্ম এবং এই শব্দ কোন ব্যাকরণ গত ব্যাখ্যার জন্য নয়। তারপরও যদি ব্যাকরণ করা হয় তবে তা অস্তিত্বই প্রকাশ করে, শুধু গুণ নয়। আর শ্রেষ্ঠকে অনেক ক্ষেত্রে উপমা হিসেবে প্রয়োগ করা হয়। যেমন "চাঁদবদন"। এখানে চাঁদ শুধু গুণ নয়, বরং নাম। চাঁদের অস্তিত্ব আছে। তিনি সুন্দর। তাই "চাঁদবদন'' মানে হল চাঁদের মত বদন যার। অর্থাৎ সুন্দর মুখমণ্ডল। এখানে চাঁদের সাথে তুলনা করা হয়েছে। সুতরাং শিব শব্দ শুধু গুণ বুঝায় বললে তা ঠিক নয়। যেমন বেদান্তে বলা হয়েছে --
যদাহতমস্তন্ন দিবা ন রাত্রিঃ ন সন্ন চাসঞ্ছিব এব কেবলঃ।
তদক্ষরং তৎসবিতুর্বরেণ্যং প্রজ্ঞা চ তস্মাৎ প্রসৃতা পুরাণী।।"
- শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ।
এই যে এখানে বলা হলো "শিব এব কেবলঃ"। অর্থাৎ শুধু শিব ছিলেন। এটা অবশ্যই নাম। এবং পরম সত্বাকেই নির্দেশ করছে, তার গুণকে নয়। কারন যদি "শিব" শুধু বিশেষণ হয় অর্থাৎ শিব অর্থ "মঙ্গল" হয়, তাহলে অর্থ দাঁড়ায়- শুধু মঙ্গল ছিলেন অথবা কল্যান ছিলেন। এই অর্থটা রীতিমত হাস্যকর। এর অর্থ শুধু মঙ্গল ছিলেন তো নয়ই বরং মঙ্গলময় শিব ছিলেন বলা উচিৎ।
যেহেতু শিব পরম ব্রহ্ম। আর পরম ব্রহ্মকে লাভ করার অনেক উপায় থাকতে পারে। তাই শৈবরা কোন আধ্যাত্মিক পন্থাকেই অস্বীকার করেন না। তাছাড়া সত্য লাভের জন্য যারা বিভিন্ন মার্গের অনুসারী, তাদেরও অপমান করেন না। বরং শ্রদ্ধা এবং সম্মান করেন।
যথা-
ত্রয়ী সাংখ্যং যোগঃ পশুপতিমতং বৈষ্ণবমমিতি
প্রভিন্নে প্রস্থানে পরমিদমদঃ পথ্যমিতি চ।
রুচিনাং বৈচিত্র্যাদৃজু কুটিল নানা পথ জুষাং
নৃনামেক গম্যস্ত্বমসি পয়সামর্ণব ইব।।
- শিবমহিম্নঃ স্তোত্র।
অর্থাৎ বেদত্রয়, সাংখ্য, যোগ, পশুপতিমত ও বৈষ্ণব প্রভৃতি বিভিন্ন শাস্ত্র বিষয়ে "ইহাই শ্রেষ্ঠ এবং উহাই শ্রেষ্ঠ" এরূপ বুদ্ধি আছে বলেই লোকে নিজ নিজ রুচি বৈচিত্র্য হেতু সরল কিংবা বক্র নানাপথ অবলম্বন করে। তথাপি হে শিব, নদীসমূহের যেমন সমুদ্রই একমাত্র গতি, তেমনি তুমিই সকলের একমাত্র গম্যস্থান।
# সচ্চিদানন্দঘন সদাশিব পরম নিয়ন্তা। তিনি অদ্বিতীয় পরম সত্বা। কিন্তু অজ্ঞ ব্যক্তিরা তা মানতে চায় না। বিশেষ করে কিছু অল্প বুদ্ধি সম্পন্ন বৈষ্ণব নামধারী ব্যক্তিই এমন করেন। মনে রাখতে হবে, বিশুদ্ধ বৈষ্ণব বিষ্ণুর আরাধনায় নিযুক্ত থাকেন। তিনি সমস্ত কামনা - বাসনাহীন। তাই শিবকে ছোট করার জন্য তাঁকে কোনো কৌশল অবলম্বন করতে হয় না। তিনি জানেন হরি-হর এক এবং অভিন্ন।
কিন্তু বৈষ্ণব নামধারী অবৈষ্ণবের কান্ড দেখে রীতিমত গোলক ধাঁধায় পড়তে হয়। আবার এদের দেখে আসল নকল চেনা যায় না। শুধু কার্য দেখলেই পার্থক্য বুঝা যায়। তবে এটি সত্য যে বিশুদ্ধ বৈষ্ণব খুবই অল্প সংখ্যক আছেন। তাই ভক্তদের ভক্তির বন্যায় এদের আর চোখে পড়ে না। তারা প্রভুর আরাধনায়ই সর্বদা নিমগ্ন থাকেন। তাই এদের অনেক সময় চেনাও যায় না।
আমার লেখায় শুধু শিব বিদ্বেষী বহুরূপী বৈষ্ণবের কার্য তুলে ধরেছি। লক্ষ্য একটাই - শৈব সংস্কৃতির মহিমা এবং শিব ভক্তের শ্রদ্ধা-বিশ্বাস রক্ষা করা। শিব বিদ্বেষীরা শাস্ত্র বাক্যের মর্মার্থ বুঝতে না পেরে, কিছু মাত্র শ্লোকের অবতারণা করে শিব ও শৈব সংস্কৃতির অপমান করে। এমন কি প্রভু বিষ্ণুর মহিমা সূচক শ্লোকের উল্লেখ করেও শিবকে ছোট করতে চেষ্টা করে। সুতরাং এদের মুক্তি কিভাবে সম্ভব?
"চন্ডাচন্ড বিচন্ড জল্পক মহাভেদা সদা বৈষ্ণবাঃ।
সর্বে বৈ প্রপতান্তি দুঃসহ তরে সত্যং ন মোক্ষঃ পর।।"
অর্থাৎ "বৈষ্ণবরা সর্বদা বাদ- বিসম্বাদ প্রিয় এবং স্বমত স্থাপন করতে গিয়ে সর্বদা পরমত খন্ডন করার ইচ্ছা করেন এবং ভেদবুদ্ধি ধারী। এরা সকলে দুঃসহ নিরয়ে নিপতিত হয়ে নানা দুঃখ ভোগ করেন। এতএব এদের মোক্ষ কোথায় ? "
# অজ্ঞরা শিবকে ছোট করার জন্য, নানা ধরনের কৌশল অবলম্বন করেছে। এরা এই কৌশলের আশ্রয় করে শিবকে বিষ্ণুর দাস বলে পরিচয় দেয়। এদের কিছু সংখ্যক শ্লোক আছে। যে গুলোর তাৎপর্য এরা জানে না। আর এগুলোর মাধ্যমে মোহজাল বিস্তার করে শৈবদের হেয় করার চেষ্টা করে। যাদের সাথে এরা কথায় পারে না, তাদেরকেই মায়াবাদী আখ্যা দিয়ে নিজের পরাজয় ঢেকে রাখতে চেষ্টা করে। আবার অনেক সময় অযৌক্তিক ও অপ্রাসঙ্গিক কথা বলতে শুরু করে। আর কৌশলে কেটে পড়ে।
এদের আক্রমণাত্মক সব গুলো কৌশল এখানে ব্যাখ্যা করার সুযোগ নাই। তবুও দু’একটি উদাহরণ দিতে হবে। কারণ প্রথম ও দ্বিতীয় পর্বের লেখায় সে রকম কিছু কৌশল প্রয়োগ করা হয়েছে,,,,,,,,,,,,,
এদের একটি কৌশল হল-
★ এরা তাদের অনুসারীদের শাস্ত্র অধ্যয়ন করতে নিষেধ করে। কারণ এরা জানে শাস্ত্র অধ্যয়ন করলে শিব তত্ত্ব স্পষ্ট হয়ে যাবে। আবার শাস্ত্র অধ্যয়ন করলেও - তাদের নিজস্ব ব্যাখ্যাযুক্ত কয়েকটি গ্রন্থ ছাড়া বাকি সবগুলো শাস্ত্র অধ্যয়ন করতে নিষেধ করে।
সুতরাং এদের বিদ্যার দৌড় কতটুকু, তা সহজেই অনুমান করা যায়। এমনকি তারা নিজের স্বার্থে তাদের নিজস্ব মনোনীত শাস্ত্র ছাড়া বাকি সবগুলোকে অস্বীকার করতে পর্যন্ত দ্বিধাবোধ করে না। এর কারণ জিজ্ঞাসা করলে তারা বলে, শাস্ত্র অধ্যয়নে নাকি ভক্তির ব্যাঘাত ঘটে। কি আশ্চর্য! কাউকে সত্য থেকে বঞ্চিত রাখলে কি ভক্তির বিকাশ ঘটে? কাউকে অজ্ঞ রাখলে ভক্তির বিকাশ নয়, বরং অন্ধভক্তির বিকাশ ঘটে। হচ্ছেও তাই।"
★ আরেকটি কৌশল হল- তাদের দ্বারা প্রচারিত ব্রহ্ম সংহিতার কয়েকটি শ্লোক। এর মধ্যে দুগ্ধ দধির উপমাটি তাদের বড়ই প্রিয়। শৈবদের আক্রমণ করতে তারা এটাকে ব্রহ্মাস্ত্র হিসেবে প্রয়োগ করে। শ্লোকটি হল-
"ক্ষীরং যথা দধি বিকার বিশেষ যোগাৎ
সঞ্জায়তে ন হি ততঃ পৃথগস্তি হেতোঃ।
যঃ শম্ভুতামপি তথা সমুপৈতি কার্যাদ
গোবিন্দমাদিপুরুষং তমহং ভজামি।।"
অর্থাৎ, "দুগ্ধ যেমন বিকার- বিশেষ যোগে দধিতে পরিনত হয়, যা কারণরূপ দুগ্ধ হতে পৃথক নয়। সেরূপ যিনি কার্যবশত "শম্ভুতা" প্রাপ্ত হন, সেই আদিপুরুষ গোবিন্দকে আমি ভজনা করি।"
লক্ষনীয় বিষয় হল এই শ্লোকে কিন্তু "শিব" শব্দটি বলা হয়নি। তাছাড়া বিষ্ণু "শম্ভু" হন- তাও বলা হয় নি। এখানে বলা হয়েছে - গোবিন্দ "শম্ভুতা" প্রাপ্ত হন। শম্ভুতা প্রাপ্ত হওয়া মানে হল - "শম্ভুর" মত অবস্থা লাভ করা। ভগবান শিব আনন্দদায়ক, তাই তিনি শম্ভু। তিনি এই রূপে শ্রীবিষ্ণুর মাহাত্ম্য এবং কৃষি বিদ্যা ব্যাখ্যা করেন। তথা ক্ষেত্র কিভাবে জয় করতে হয় সেই শিক্ষা দেন। যেহেতু প্রভু শিব সমস্ত বিদ্যার অধীশ্বর।
ঋগবেদ -৭ম মণ্ডলে স্পষ্ট উচ্চারন করেন ---
"ক্ষেত্রস্য পতিরস্তু শম্ভুঃ।"
আরো লক্ষণীয় বিষয় হল -- আলোচ্য শ্লোকে উল্লেখিত "কারণ" দুগ্ধ যদি "কার্য" দধিতে রূপান্তরিত হয়ে যায়, তাহলে কারণরূপ দুগ্ধ আর থাকে না। যেহেতু তা দধিতে পরিনত হয়ে গেছে। আবার দধি যেহেতু দুগ্ধে পরিণত হতে পারেনা, তাহলে বিষ্ণু কিভাবে "শম্ভুতা" স্বরূপ থেকে বিষ্ণু স্বরূপে ফিরে আসেন? আর যদি কেউ বলে বিষ্ণু ফিরে আসতে পারেন তাহলে প্রমাণিত হয়ে যাবে উপমাটি যথার্থ হল না।
আবার বিষ্ণু যদি নির্বিকার হন তবে দুগ্ধ দধির বিকারের মত, তিনিও কিভাবে বিকারগ্রস্ত হলেন?
কিন্তু আমরা জানি শিব নির্বিকার। প্রভু শিবের ভিন্ন রূপ হলেন শ্রী বিষ্ণু। তারপরও যদি কেউ প্রসঙ্গটি তুলে অর্থাৎ উপমাটি প্রয়োগ করে তাহলে বলব, দুগ্ধের মধ্যে বিরাজিত সার পদার্থ মাখন যেমন সবাই দেখতে পায় না, তেমনি বিষ্ণু তত্ত্বের গভীরে বিরাজিত পরমাত্মা শিবকে কেউ উপলব্ধি করতে পারে না। শিবই বিষ্ণুর অস্তিত্ব। কিন্তু সাধন সিদ্ধ যোগী ছাড়া, পন্ডিতমন্য অন্য কেউ এই তত্ত্ব বুঝতে পারে না। শাস্ত্র বলেন-
"মথিত্বা চতুরোবেদান্ সর্ব্ব শাস্ত্রানি চৈব হি।
সারস্তু যোগিভিঃ পীতস্তক্রং পিবন্তি পন্ডিতাঃ।।"
-জ্ঞান সংকলনী তন্ত্র ।
অর্থাৎ, "বেদ চতুষ্ঠয় ও সমস্ত শাস্ত্র মন্থন করে, তার মাখন স্বরূপ সারভাগ যোগীগন পান করেছেন আর অসার ভাগ ঘোলই পন্ডিতগণ পান করেছেন। "
গোরক্ষ পদাবলীতে বলা হয়েছে-
আকাশ মন্ডল মধ্যে গাভী বিয়াইল।
তার দুগ্ধ দধি করি কাগজে লিখিল।।
পন্ডিতে ছানিয়া ছাঁচ করিল ভক্ষন।
সিদ্ধারা খাইল যাহা আসল মাখন।।"
আমরা শৈব যোগী। সর্ব তত্ত্বের সার শিবতত্ত্ব রূপ মাখন পান করে আমরা পরিতৃপ্ত হই।
যাই হোক, দুটি মাত্র কৌশলের উল্লেখ করে উত্তর দিলাম। এদের সমস্ত কৌশলের জাল আমি ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন
করে দিতে পারি এখানেই। কিন্তু কারনবশত এখন না।
আমরা বেদান্তের গভীরে প্রবেশ করব। চলুন!
# প্রত্যেক বস্তুতে উপস্থিত তার সার হলেন শিব। কারণ সর্ব জগৎ শিবময়। তিনি বিশ্বরূপ এবং সর্বভূতে আত্মারূপে উপস্থিত। ভগবান শিব তাই শ্রীরামচন্দ্রকে বলেছেন -
"রাম বিশ্বরূপশ্চাহং পুরানশ্চ সনাতনঃ।
আত্মরূপেণ ভূতেষু তিষ্ঠামি রঘুনন্দন।।"
- শিবগীতা।
অর্থাৎ, "হে রঘুনন্দন রামচন্দ্র! আমি বিশ্বরূপ, পুরাতন পুরুষ এবং সনাতন। আমি আত্মারূপে সর্বভূতে অবস্থান করি।"
শিব নিত্য,শাশ্বত। তিনি সবকিছুর প্রতিষ্ঠা তথা অস্তিত্ব। তিনি ব্যক্ত ও অব্যক্তেরও কারণ। সাকার তথা নিরাকারের উৎস। শিবের উপস্থিতিতেই- সর্বভূত অস্তিত্বশীল হয়। তাই তিনি মঙ্গল স্বরূপ। আর সেজন্যই সমস্ত বেদ বিভিন্ন দেবদেবীর নাম- রূপের গভীরে একই পরম সত্বার মাহাত্ম্য প্রকাশ করেছেন। সে কারনেই বেদে প্রায় প্রত্যেক দেব-দেবীকে সর্বশক্তি সম্পন্ন রূপে উপস্থাপন করা হয়েছে। সমস্ত জগৎ ব্রহ্মময়।
"সর্বং খল্বিদং ব্রহ্ম। "
# এই যে শ্রুতি বাক্য- "সোহকাময়ত অহং বহু স্যাং প্রজায়েয়"- এর মানে হল, এক পরমসত্বা যখন মায়াকে আশ্রয় করে বহু হলেন তখন মূলতঃ তিনি বহু "নাম-রূপে" প্রতিভাত হলেন। বহু নাম, বহু রূপে, বহু মহিমা প্রকাশ করলেন। অর্থাৎ এক একটি রূপে, এক একটি বিশেষ মহিমা প্রকাশ করলেন। যদিও তিনি নির্গুণ, নির্বিকার, অদ্বিতীয় পরম সত্বা।
তাই প্রত্যেক বেদ বিভিন্ন দেবদেবীর মাধ্যমে সেই পরম সত্বারই মহিমা প্রকাশ করেন। আর দেবদেবীর প্রার্থনা স্তবের মাধ্যমে পরমাত্মা সদাশিবের উদ্দেশ্যেই আমাদের যাত্রা শুরু হয়। কারন সর্ব দেবদেবীর নাম-রূপের গভীরে পরম শিবই বিরাজিত। তাই আমাদের গন্তব্য হলেন মঙ্গলময় পরম শিব। আর এই আধ্যাত্মিক অমৃত লোকের যাত্রা সমাপ্ত হয় শিব প্রাপ্তির মধ্য দিয়েই। যেহেতু শিব প্রাপ্তিতেই যাত্রার পরিসমাপ্তি ঘটে, তাই শিব হলেন মঙ্গলময়। আর শিব শব্দটিও তাই মঙ্গল সূচক।
যেহেতু শিব প্রাপ্তির উদ্দেশ্যেই যাত্রা শুরু হয় এবং শিব প্রাপ্তিতেই যাত্রার সমাপ্তি ঘটে, সেহেতু সবার ভাবনা তথা সংকল্প শিবযুক্ত হওয়া উচিত।
যজুর্বেদ বলেন-
* যজ্জাগ্রতো দূরমুদৈতি দৈবং তদু সুপ্তস্য তথৈবৈতি।
দূরঙ্গমং জ্যোতিষাং জ্যোতিরেকং তন্মে মনঃ শিব-সংকল্পমস্তু।। -যজুর্বেদ ৩৪/১
অর্থাৎ দিব্য শক্তি সম্পন্ন যে মন জাগ্রত ও নিদ্রিত উভয় অবস্থায়ই দূর দূর ধাবিত হয়, এবং যা জ্যোতি সমূহের মধ্যে অন্যতম জ্যোতি, আমার সেই মন সঙ্কল্পে শিবযুক্ত হোক।
* যেন কর্মাণ্যপসো মনীষিণো যজ্ঞে কৃণ্বন্তি বিদথেষু ধীরাঃ।
যদপূর্বং যক্ষমন্তঃ প্রজানাং তন্মে মনঃ শিব-সঙ্কল্পমস্তু।।
- যজুর্বেদ ৩৪/২
কর্মনিষ্ঠ ধীর ও বিদ্বানেরা শুভ কর্মে এবং জীবন যুদ্ধে যার মাধ্যমে সমস্ত কর্ম সম্পাদন করে থাকেন এবং যা প্রজাদের সমস্ত শক্তি, আমার সেই মনের সমস্ত সংকল্প শিব যুক্ত হোক।
* যৎ প্রজ্ঞানমুত চেতো ধৃতিশ্চ যজ্জ্যোতি-রন্তরমৃতং প্রজাসু।
যস্মান্ন ঋতে কিঞ্চন কর্ম ক্রিয়তে তন্মে মনঃ শিব-সংকল্পমস্তু।। - যজুর্বেদ ৩৪/৩
যা প্রজাগনের মধ্যে প্রজ্ঞা, চেতনা, ধৈর্য্য ও অমৃত জ্যোতি দান করে এবং যাকে ছাড়া কোন কার্য চলতে পারেনা, আমার সেই মন শিব-সঙ্কল্প যুক্ত হোক।
* যেনেদং ভূতং ভূবনং ভবিষ্যৎ পরিগৃহীতমমৃতেন সর্বম্।
যেন যজ্ঞস্তায়তে সপ্তহোতা তন্মে মনঃ শিব সঙ্কল্পমস্তু।।
- যজুর্বেদ ৩৪/৪
যে মন দিয়ে ভূত, ভবিষ্যৎ, বর্তমান সকল বস্তু গ্রহন করা যায়, অবিনশ্বর যে মন দিয়ে সপ্তহোতা যজ্ঞ বিস্তৃত হয়, আমার সেই মন সঙ্কল্পে শিবযুক্ত হোক।
* যস্মিন্ ঋচঃ সাম যজুৎসি যস্মিন্ প্রতিষ্ঠিতা রথনাভাবিবারাঃ।
যস্মিংশ্চিত্তং সর্বমোতং প্রজানাং তন্মে মনঃ শিব-সঙ্কল্পমস্তু।। --যজুর্বেদ ৩৪/৫
রথনাভিতে অরার ন্যায় যাতে জ্ঞান, কর্ম ও ভক্তি স্থিত আছে এবং সমস্ত প্রজার চিত্ত যাতে যুক্ত থাকে, আমার সেই মন সঙ্কল্পে শিবযুক্ত হোক।
# আজকাল এই কলি যুগে বেদ বিবর্জিত বহুরূপী কল্পিত বৈষ্ণব মতবাদের প্রচারের জোয়ারে বিশুদ্ধ বৈষ্ণব পন্থা প্রায় নিশ্চিহ্ন হতে শুরু করেছে। এটা আশ্চর্য নয়। কারন এটা কলিরাজের মায়াজাল। বিশুদ্ধ বেদান্ত জ্ঞান ছাড়া এই জাল ছিন্ন করার নয়।
কলিযুগের এক বিশেষত্ব হল- এই যুগে মানুষ শিবতত্ত্ব ভুলে যাবে। আর কল্পিত বৈষ্ণব দুরাত্মারা ভ্রান্ত মতবাদ প্রচার করবে। এরা বেদ বিরোধী মনগড়া ভক্তিবাদ প্রচার করবে।
★ "ঘোরে কলি যুগে প্রাপ্তে শ্রীশঙ্করপরাঙ্মুখাঃ।
ভবিষ্যন্তি নরাস্তথ্যমিতি দ্বৈপায়নোহব্রবীৎ।।"
অর্থাৎ, "ঘোর কলিযুগ উপস্থিত হলে মানব শিব বিমুখ হবে, এই সত্য কথা দ্বৈপায়ন বলেছেন।"
# প্রশ্ন হল- কল্পিত বৈষ্ণব কারা?
হ্যা! কল্পিত বৈষ্ণব হল তারা, যারা বৈষ্ণব নাম ধারন করেও শিব তথা শৈব বিদ্বেষী হয়। এদের প্রাথমিক ভাবে দেখে বুঝার সাধ্য নাই যে এরা শিব বিরোধী। কারন এরা কৌশলে বলে থাকে, শিব বিষ্ণু থেকে অভিন্ন। কিন্তু যখনই এদের সামনে শিবকে পরমেশ্বর বলা হবে, তখনই তাদের ভিতরের সমস্ত কলুষতা প্রকাশিত হবে। এমনকি তখন ক্রোধে তারা অগ্নিশর্মা হয়ে যায়। শৈব যোগী সংঘ শাস্ত্রীয় আলোকে শিবতত্ত্ব প্রচার করে। শিব পরমেশ্বর। তিনি এক এবং অভিন্ন। তাঁর বহু নাম বহু রূপ। শ্রীবিষ্ণু প্রভু শিব থেকে অভিন্ন, তাই তাঁকেও পরমেশ্বর বলা যায়। কিন্তু ভেদদর্শীরা শিবকে সামান্য দেবতামাত্র বলে তৃপ্তি পায়। এমনকি শিব ও শৈবদের প্রতিনিয়ত অপমান করে। প্রচন্ড ক্রোধে ভাষাজ্ঞান পর্যন্ত হারায়। প্রিয় পাঠকগণ, আপনারা জানেন, বিশুদ্ধ বৈষ্ণবরা নম্র-ভদ্র হয়। শুদ্ধ বৈষ্ণব শিরোমণি শ্রী চৈতন্যদেব তার শিক্ষাষ্টকের ৩য় শিক্ষায় বৈষ্ণবের একটা সুন্দর ব্যাখ্যা দিয়েছেন।
★ "তৃনাৎ-অপি সুনীচেন তরোঃ অপি সহিষ্ণু্ণা।
অমানিনা মানদেন কীর্তনীয় সদা হরিঃ।।"
অর্থাৎ "তৃণ হতে নীচ হয়ে, বৃক্ষের মত সহিষ্ণু হয়ে, নিজের সম্মানের কথা চিন্তা না করে, অন্যকে সম্মান দিয়ে সর্বদা শ্রীহরির কীর্তন করবে।"
মজার ব্যাপার হল, শিবকে পরমেশ্বর বলার সাথে সাথেই বহুরূপী কল্পিত ক্রোধী বৈষ্ণবরা উত্তেজিত হয়ে অপকথা বলতে শুরু করে দেয়। কিন্তু কেন? কারন তারা প্রকৃত বৈষ্ণব নয়। কেননা উপরে উল্লেখিত বৈশিষ্ট্য যার আছে তিনি প্রকৃত বৈষ্ণব। সুতরাং অল্পে উন্মত্ত হয়ে যাওয়া ব্যক্তি কখনোই বিশুদ্ধ বৈষ্ণব নয়। কল্পিত বৈষ্ণবরা কৌশলে বলে শিব-বিষ্ণু অভিন্ন। কিন্তু তারা এটা কখনোই মানে না। কারন তারা প্রচার করে প্রভু শিব বিষ্ণুর দাসানুদাস।
প্রশ্ন হল, শিব-বিষ্ণু যদি এক হন এবং এটা যদি তারা মানে। তবে কেনো তারা শিবের প্রসাদ খাবে না? কেননা যদি, "শিব = বিষ্ণু" হন
তবে, "শিব প্রসাদ = বিষ্ণু প্রসাদ"।
যারা অভিন্ন জ্ঞানে শিব প্রসাদ গ্রহন করতে পারে না, তারা কখনোই বিশুদ্ধ বৈষ্ণব নয়। এটা অবশ্যই মনে রাখতে হবে, এবং বুঝতে হবে - শিব এবং শিব প্রসাদ অবজ্ঞাকারী এরা সাক্ষাৎ কলিচর। কেননা কলিযুগে মিথ্যা অভিমান গ্রস্থ বৈষ্ণবরা শিব নিন্দা পরায়ন ও নরকগামী হবে।
★ "তৎ পক্ষপাতিনো মূঢ়া গৃহস্থাঃ শিব নিন্দকাঃ।
মিথ্যা বৈষ্ণবমানেন গ্রস্তা নিরয় গামিনঃ।।"
-- কলিযুগে মূঢ় গৃহস্থগন শিবনিন্দা পরায়ন হবে। মিথ্যা বৈষ্ণবাভিমানগ্রস্থ হয়ে তারা নরকগামী হবে।
তাছাড়াও শাস্ত্রে বলা হয়েছে- কলিযুগে ধর্ম হবে অর্থের বিনিময়ে। আর বহুরূপী বৈষ্ণবেরা ব্রহ্মবিদ-বিদ্বেষী হবে এবং দেবতাদেরও বিদ্বেষ করবে।
"অর্থলোভাদ্ সদ্ভ্যশ্চ মন্ত্রান্ দাস্যন্তি বেশিনঃ।
অন্তঃশঠা মহাক্রূরা পরদ্রব্যাভিলিপ্সবঃ।।
ভ্রমন্তে বৈষ্ণবৈবেশৈর্ঘাজয়িষ্যন্ত্যসজ্জনান্।।
পুরাণার্থবিদাং সাধুশীলানাঞ্চ দ্বিজন্মনাম।
দেবতাদ্বেষকাস্তে বৈ দ্বেষয়িষ্যন্তি সর্ব্বদা।।"
------বৃহদ্ধর্ম পুরাণ।
-- গুরু বেশধারী লোকেরা অর্থলোভে অসৎ ব্যক্তিদের মন্ত্র প্রদান করবে। তারা ভিতরে ভিতরে শঠ, মহাক্রূর এবং অন্যের দ্রব্যের অভিলাষী। তারা বৈষ্ণব-বেশে ভ্রমণ করে অসজ্জাতিদের যাজন করবে। সেইসব ব্যক্তিরা দেবতাদের বিদ্বেষ করবে। তারা বৈষ্ণব বেশ ধারন করে পুরানার্থ-বেত্তা সাধুশীল বিদ্বানদের প্রতি বিদ্বেষ করবে।
কল্পিত বৈষ্ণব তারা, যারা মোক্ষদাতা শিবের ঈশ্বরত্ব নিয়ে সন্দেহ পোষন করে। তারা বলে, শিব মোক্ষ দাতা নন। কিন্তু শাস্ত্র অন্য কথা বলে -
★ "ক্রমেন লভ্যতেহন্যেষাং মুক্তিরারাধনে দ্বিজাঃ।
আরাধয়ন মহেশং তং তস্মিন জন্মনি মুচ্যতে।।"
--অন্য দেবতার আরাধনায় ক্রমে মুক্তিলাভ হয়, কিন্তু মহেশ্বরের আরাধনায় সেই জন্মেই মুক্তি লাভ হয়।
★ "ক্ষনং মুহূর্ত্তমথবা ধ্যাতঃ সম্পূজিতঃ স্মৃতঃ।
প্রদদাত্যাশু কৈবল্যং যস্তং ভজ মহেশ্বরম্।। "
-- ক্ষনকাল বা মুহূর্তকাল ধ্যান, পুজা কিংবা স্মরণ করলে যিনি শীঘ্র মুক্তি প্রদান করেন, সেই মহেশ্বরের ভজনা কর।
# আবার কিছু কিছু বহুরূপী বৈষ্ণব শিবকে পরমেশ্বর বললে রেগে যায়। তারা কারন হিসাবে বলে থাকে, শিব নাকি তামসিক! এইসব বাল্যমনা বিদ্বানদের বলতে চাই,শিব হলেন গুনাতীত। তিনি পরমেশ্বর, তাই গুণের অধীন নন।
★ "দুরাচারাশ্চ পাপাশ্চ বেদেভ্যস্তে বহিস্কৃতাঃ।
তত্ত্বং নৈতে বিজানন্তি শিবস্যাগুণরূপিনঃ।।"
অর্থাৎ, দুরাচারী,পাপী, এবং বেদ হতে বহিস্কৃত ব্যক্তিরা সেই গুণের অতীত শিবের তত্ত্ব জানতে সক্ষম হয় না।
শিব পরমেশ্বর। তাই জগৎ লীলায় তিনি বিভিন্ন গুণে বিভিন্ন লীলা করেন। কালাগ্নি রূদ্ররূপে তমগুন নিয়ন্ত্রন করেন। বিষ্ণু রূপে সত্বগুণ নিয়ন্ত্রন করেন আর ব্রহ্মারূপে রজগুণ। রুদ্রকে তামসিক যারা বলে তাদের জানা উচিৎ - কালাগ্নি রূদ্র তমোগুন নিয়ন্ত্রন করেন; তাই তিনি মহিমান্বিত। কেননা সত্বগুণ নিয়ন্ত্রন করা সহজ ব্যাপার। তাছাড়া বিভিন্ন লীলায় তিনি তার বিভিন্ন রূপের বন্দনা স্তুতি করেন। তাতে পরম প্রভুর মহিমা কভু কমে যায় না।
ভগবান শিব নির্গুণ আবার ত্রিগুণের অধীশ্বর। যথা : -
★ "তস্মৈ নমো ভগবতে ত্রিগুনায়গুনাত্মনে।
কেবলায়াদ্বিতীয়ায় গুরবে ব্রহ্ম মূর্তয়ে।। "
----ভাগবত পুরাণ।
-- হে ভগবান! তুমি ত্রিগুণ স্বরূপ হলেও তার উর্ধ্বে। তুমি সমস্ত জ্ঞানের মূল, অদ্বিতীয় ব্রহ্ম। আমি তোমাকে নমস্কার করি।
ভগবান শিব মূলতঃ নির্গুণ। কিন্তু বিশ্বজগৎ পালনার্থে সগুণ স্বরূপ ধারন করেন। শ্রী বিষ্ণু তাই বলেছেন -
★ "নির্গুণায় নমস্তুভ্যং পুনশ্চ সগুণায় চ।
পুনঃ প্রকৃতিরূপায় পুনশ্চ পুরুষায় চ।।
পশ্চাদ্ গুণস্বরূপায় ততো বিশ্বাত্মনে নমঃ।
ভক্তি প্রিয়ায় শান্তায় শিবায় পরমাত্মনে।। "
অর্থাৎ, হে প্রভু শিব, নির্গুণ হয়েও তুমি সগুণ। তোমাকে নমস্কার। প্রকৃতি ও পুরুষ স্বরূপ তোমাকে নমস্কার। তারপর গুনরূপী তোমাকে বার বার নমস্কার। হে পরমাত্মা, তুমি ভক্তি প্রিয়, শান্ত। তোমাকে নমস্কার।
সুতরাং প্রভু শিব নির্গুণ পরমাত্মা। তিনি সমস্ত ঈশ্বরের ঈশ্বর - মহেশ্বর, পরমেশ্বর। কিন্তু, বেদ বিরোধী নাস্তিক নাবালক বহুরূপী কল্পিত বৈষ্ণব তা কিভাবে বুঝতে পারবে?
# শিব পরম নিয়ন্তা। তিনি পরম শাসক, মহাদেব তথা মহারুদ্র। আমি আগেই বলেছি - রুদ্র মূলত শিব তথা শিবের বৈদিক দেবরূপ। তাই বলা হয়েছে -
"যা তে রুদ্র শিবা।"
Continue-51
চলুন বেদের গভীরে -
★ " নমস্তে রুদ্র মন্যব উতো ত ইষ্যবে নমঃ।
বাহুভ্যামুত তে নমঃ।।"
-হে দুঃখ বিনাশক জ্ঞান দাতা রুদ্র, তোমার ক্রোধের উদ্দেশ্যে নমস্কার। তোমার বাণ ও বাহু যুগলকে নমস্কার করি।
★ "যা তে রুদ্র শিবা তনূরঘোরাহপাপকাশিনী।
তয়া নস্তন্বা শন্তময়া গিরিশন্তাভিচাকশীহি।। "
- হে প্রভু রুদ্র! তোমার পরম অঘোর পূণ্যময় যে শিব তনু আছে, হে গিরিশ! সে সুখতম স্বরূপে আমাদের দিকে তাকাও।
★ "যামিষুং গিরিশন্ত হস্তে বিভর্ষ্যস্তবে।
শিবাং গিরিত্র তাং কুরু মা হিংসীঃ পুরুষং জগৎ।।"
-- হে গিরীশ! শত্রু বিনাশক বান তুমি হস্তে ধারন করেছো, হে প্রানীগণের ত্রাতা! তুমি তা কল্যানময় তথা শিবযুক্ত কর, পুরুষ ও জগতের হিংসা কর না।
★ "শিবেন বচসা ত্বা গিরিশাচ্ছা বদামসি।
যথা নঃ সর্বমিজ্জগদযক্ষ্মং সুমনা অসৎ।।
--হে গিরীশ! শিব স্তুতির মাধ্যমে তোমার প্রার্থনা করি যাতে সমস্ত জগৎ নিরোগ এবং শুভ মনস্ক হয়।
★ "অধ্যবোচদধিবক্তা প্রথমো দৈব্যো ভিষক্।
অহিশ্চ সর্বাঞ্জম্ভয়ন্ত সর্বাশ্চ যাতুধান্যোহধরাচীঃ পরাসুব।।"
অর্থাৎ, হে অধিক বদনশীল; আমাকে সবচেয়ে অধিক বলো। তুমি সকলের পূজ্য এবং দেবগনের উদ্ধারকর্তা ভিষক। হে প্রভু! সকল সর্প ব্যাঘ্র প্রভৃতি বিনাশ করে অধোগামী রাক্ষসীদের দূর কর।
★ "অসৌ যস্তাম্রো অরুণ উত বভ্রুঃ সুমঙ্গলঃ।
যে চৈনং রুদ্রা অভিতো দিক্ষূ শ্রিতাঃ সহস্রশোহবৈষাং হেড ইমহে।।
- যিনি রবি রূপ রুদ্র, উদয়ে ও অস্ত-কালে অরুনবর্ণ, অন্য সময় পিঙ্গলবর্ণ ও মঙ্গলময়, যিনি সহস্র কিরণে পূর্বাদি দিক আশ্রয় করেছেন, তাঁর ক্রোধ-আমরা ভক্তিতে দূর করব।
★ "অসৌ যোহবসর্পতি নীলগ্রীবো বিলোহিতঃ।
উতৈনং গোপা অদৃশ্রন্নুদৃশ্রন্নুদহার্যঃ স দৃষ্টো মৃডয়াতি নঃ।। "
-যিনি আদিত্যরূপে নিরন্তর গমন করেন, যিনি শাসক এবং যাকে কল্যানকামীরা দেখে থাকে, তিনি দৃশ্য হয়ে আমাদের সুখ প্রদান করুন।
★ ''নমোহস্তু নীলগ্রীবায় সহস্রাক্ষায় মীঢুষে।
অথো যো অস্য সত্বানোহহং তেভ্যোহকরং নমঃ।।
-- চির তরুন সহস্রাক্ষ নীলকণ্ঠের প্রতি আমার নমস্কার। তার ভক্তকেও নমস্কার করি।
-------------------- যজুর্বেদ!!!!!!!!!!!!!
# বেদ-বেদান্ত শিবতত্ত্বে ভরপুর। কিন্তু কলি কলুষিত চিত্তে পবিত্র শিবভাবনা জাগরিত হয় না। এমন কি শিবতত্ত্ব নিয়ে তাদের মন-মস্তিষ্কে সন্দেহ জাগরিত হয়। শুধু তাই নয়, তারা বেদ ও শিব নিন্দাও করে থাকে। কিন্তু তারা জানে না পরমাত্মা শিব সর্বভূতে বিরাজমান।
★ "যো অগ্নৌ রুদ্রো যো অপস্বন্তর্য ওষধীর্বীরুধ অবিবেশ।
য ইমা বিশ্বা ভুবনানি চাকলৃপে তস্মৈ রুদ্রায় নমো অস্ত্বগ্নয়ে।। "
-------অথর্ব্ব বেদ!!!!!!!!
- যে পরমাত্মা রুদ্র অগ্নিতে, জলে, ঔষধীতে ও বনস্পতিতে ব্যাপক রয়েছেন,যিনি এই নিখিল ভুবনকে রচনা করেছেন সেই সর্বব্যাপক পরমাত্মাকে নমস্কার।
চ্চিদানন্দঘন লীলাময় পরমেশ্বর শিব। তিনিই মোক্ষদাতা,পুরুষোত্তম পরমাত্মা ও পরমানন্দ। তার শ্রীচরনে আত্মসমর্পণেই শাশ্বত শান্তি। তিনি সমস্ত অবতার তথা দেবদেবীর উৎস। কিন্তু আমি আগেই বলেছি যে, কল্পিত বৈষ্ণব তা মানতে চায় না বা মানতে পারে না। তারা শিবকে বৈষ্ণব তথা বিষ্ণুর আজ্ঞাবহ দাসানুদাস বলে প্রচার করে বিকৃত সুখ তথা তামসিক তৃপ্তি অনুভব করে।
আমি আগেই শাস্ত্রবাক্য দ্বারা প্রমাণ করেছি যে, যারাই এমন অপব্যাখ্যা করছে তারাই সাক্ষাৎ কলিচর। আমি আবারো বলে রাখি- শিব ও বিষ্ণুতে অভেদ জ্ঞানী বিশুদ্ধ বৈষ্ণবেরা অবশ্যই শ্রদ্ধেয় এবং বরণীয়। তাই আমি পথভ্রষ্ট বৈষ্ণবদের কল্পিত বৈষ্ণব বললাম। শাস্ত্রে এমনটাই ব্যক্ত হয়েছে।
যাই হোক শিবতত্ত্ব বোঝা সহজ কথা নয়। ভগবান শিবের মায়ায় মোহিত এই বিশ্ব-জগৎ। অতএব মায়ায় মোহিত মানব শিবতত্ত্ব বুঝবে কিরূপে? তাই মহামুনি অগস্ত্য শিষ্য রামচন্দ্রকে বলেন -
"দুর্জ্ঞেয়া শাম্ভবী মায়া তয়া সংমোহ্যতে জগৎ ।"
অর্থাৎ, শাম্ভবী মায়া অতীব দুর্জ্ঞেয়া। এই মায়া দ্বারাই এ জগৎ মোহিত রয়েছে।
# কিছু কিছু কপট ব্যক্তি অজ্ঞানতার কারনে শিবতত্ত্বের বিরোধিতা করে। মায়ায় মোহিত শিব বিদ্বেষী এরা প্রচ্ছন্ন কলিচর।
আমি বার বার বলেছি যে শিব এবং বিষ্ণু অভেদ। পরমেশ্বর শিবেরই ভিন্ন রূপ হলেন প্রভু বিষ্ণু। কিন্তু কলুষিত কল্পিত বৈষ্ণবরা শাস্ত্র প্রমাণ পাওয়ার পরও শিবকে বিষ্ণুর অংশ, কলা, দাস, ভৃত্য প্রভৃতি বলতে অভ্যস্ত। তবে এটাও সত্য যে, কিছু সাধারণ মানুষ শাস্ত্র জ্ঞানের অভাবে ওই সব কলিচরের দ্বারা আক্রান্ত। তারা না জেনেই শিবতত্ত্বের বিপক্ষে কথা বলছে।
কল্পিত বৈষ্ণবরা এতই উগ্র যে শাস্ত্রবাক্য পর্যন্ত অস্বীকার করতে তারা দ্বিধাবোধ করে না। আবার কখনো কখনো দুই-একটা শ্লোক উচ্চারণ করে বলে শাস্ত্রে নাকি কোথাও শিবকে পরমেশ্বর বলা হয় নি! সমস্ত বৈদিক শাস্ত্রে নাকি শিবকে কৃষ্ণের ভৃত্যরূপে ব্যাখ্যা করা হয়েছে!
তাদের সম্যক অবগতির জন্য আবারো জানাচ্ছি- প্রভু শিব হলেন মহেশ্বর,মহাদেব,পরমেশ্বর। তিনিই সবার প্রেরক। তিনিই একমাত্র পরমসত্তা। ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও কালাগ্নিরুদ্রকে তিনিই প্রেরণ করেন। তিনি তাঁর এই অভিন্ন রূপের মাধ্যমেই সৃষ্টি-স্থিতি-লয়রূপ দিব্যলীলা পরিচালনা করেন।
ওঁ কার তথা প্রনব শিবেরই বৈদিক মূলমন্ত্র।
যথা-
" শিরশ্চোত্তরতো যস্য পাদৌ দক্ষিণতস্তথা।
যস্য সর্বোত্তরঃ সাক্ষাদোঙ্কারোহহং ত্রিমাত্রকঃ।।
--শিবগীতা।
--উত্তর ভাগ যার শির, দক্ষিন ভাগ যার চরণ এবং সমস্তই যার মধ্যভাগ স্বরূপ, আমিই সেই ত্রিমাত্রাত্মক ওঁ কার ।"
সেই প্রণব ব্রহ্মা ও বিষ্ণুকে বলেছেন--
"সর্বাত্মা সর্ব্বকর্ত্তাসৌ স্বতন্ত্রঃ সর্ব্ব ভাবনঃ।
ব্রহ্মান্নয়ং সৃষ্টিকালে ত্বাং নিযুক্তে রজো গুণৈঃ ।।
সত্ত্বেন রক্ষণে শম্ভুস্ত্বাং প্রেষয়তি কেশব।
তমসা কালরুদ্রাখ্যং সম্প্রেরয়তি সংহৃতৌ ।।
--স্কন্দ পুরাণম।
অর্থাৎ, তিনি (শিব) সর্বাত্মা ও সর্বকর্তা, স্বতন্ত্র ও সর্বভাবন। হে ব্রহ্মা! সেই শম্ভু সৃষ্টিকালে তোমায় রজোগুণে নিযুক্ত করেন। হে কশব! তিনিই সত্ত্ব গুণে তোমাকে সৃষ্টি রক্ষার্থে প্রেরণ করে থাকেন আর সংহার কালে তমোগুণে কাল রুদ্রকে প্রেরণ করেন।
আবার বলা হয়েছে --
ব্রহ্মবিষ্ণ্বাদয়ো দেবা মুনয়ো মনবস্তথা।
সর্ব্বে ক্রীড়নকাস্তস্য দেবদেবস্য শূলিনঃ।।
----ব্রহ্মা, বিষ্ণু প্রভৃতি দেবগন, মুনিগন এবং মনুগন সকলেই সেই দেবদেব শূলপাণির ক্রীড়নক মাত্র।
ভগবান সদাশিব বলেছেন-
ব্রহ্মবিষ্ণুহরাখ্যানাং যঃ পরঃ পরমেশ্বরঃ।
ত্বং মাং মহাদেব ইতি ব্রহ্মন্ জানন্তি সুরয়ঃ।।
---- ব্রহ্মা-বিষ্ণু-হরের শ্রেষ্ঠ যে পরমেশ্বর, জ্ঞানিগন আমাকেই সেই মহাদেব বলে জানেন।
ভগবান শিব শ্রী ব্রহ্মাকে বলেছেন-
ত্রিধা ভিন্নোহস্ম্যহং ব্রহ্মন্ ব্রহ্ম-বিষ্ণু-হরাখ্যয়া।
সর্গরক্ষালয়গুণৈর্নিষ্কলঃ পরমেশ্বর।।
--কুর্ম পুরানম্
--হে ব্রহ্মন! আমি নিষ্কল পরমেশ্বর, কিন্তু সৃজন, পালন ও সংহার গুণ দ্বারা ব্রহ্মা, বিষ্ণু, হর নামে তিন প্রকার ভিন্ন রূপ ধারন করেছি।
এ রকম শতশত উদাহরণ দিতে পারি। কিন্তু শম্ভু মায়ায় মোহিত ব্যক্তির তাতে বোধজ্ঞান হবে না জানি। যারা শিবকে দেবতা মাত্র বলেন, তাদের জানা উচিত শাস্ত্রে বিষ্ণুকেই দেবতামাত্র বলে শিবকেই পরমেশ্বর বলা হয়েছে।
বারাণস্যাঃ পরং স্থানং ন ভূতং ন ভবিষ্যতি।
যথা নারায়নাদ্দেবো মহাদেবাদিবেশ্বরঃ।।
--যেমন নারায়ন অপেক্ষা পরম দেবতা নাই এবং মহাদেব অপেক্ষা পরম ঈশ্বর (পরমেশ্বর) নাই,সেরূপ বারাণসী অপেক্ষা শ্রেষ্ঠস্থান আর নাই।
সে জন্যই ভগবান শ্রীকৃষ্ণ শিবমন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে শিবের শরণাগত হয়েছিলেন। তিনি প্রতিনিয়ত শিবকে আশ্রয় করেন। শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন-------
স্থানং প্রাহু অনাদিমধ্যনিধনং যস্মাদিদং জায়তে।
নিত্যং ত্বাহমুপৈমি সত্য বিভবং বিশ্বেশ্বরং তং শিবম্।।
---কুর্ম পুরানম্
---- অনাদি, মধ্য, নিধন স্থানরূপ এই সমস্ত জগৎ যা হতে উৎপন্ন হয়েছে, আমি সেই সত্য বিভব বিশ্বেশ্বর শিবকে প্রতিনিয়ত আশ্রয় করি।
তথাপি আমি বারবার বলেছি শিব ও বিষ্ণু অভিন্ন। কিন্তু পথভ্রষ্টরা তা মানে নি। তাদের সেই কৃষ্ণ প্রীতি কিন্তু কৃষ্ণ ভক্তি নয়। কারন শুদ্ধ ভক্ত হরি-হরে কোন ভেদ জ্ঞান করেন না কখনো। অতএব তাদের এই ভক্তি যে প্রেম-ভক্তি নয় বরং অন্ধ-ভক্তি, তাতে কোন সন্দেহ নাই। এই বিকট অন্ধ ভক্তের ধর্মান্ধ হিংসাত্মক প্রবচনের জোয়ারেই আজ সনাতন ধর্মের অনুসারীদের নাজেহাল অবস্থা।"শৈব যোগী সংঘ" বারবার বলতে চাচ্ছে জ্ঞাননিষ্ঠা কিংবা কর্মনিষ্ঠা থাকলে অবশ্যই মোক্ষলাভ তথা পরম প্রাপ্তি হবে। নিজ নিজ আরাধ্যকে ভক্তি করতে গিয়ে অন্য মতের আরাধ্যকে ছোট করা যাবে না। কারন পরমেশ্বর এক। তার বহু নাম,বহু রূপ। পঞ্চ উপাসনা সনাতন ধর্মে প্রসিদ্ধ। শুধু জ্ঞান তথা ভক্তি নিষ্ঠার দরকার। তাই বৃহন্নারদীয় পুরানে শ্রীবিষ্ণু বলেছেন---
"শিবে চ পরেমেশানে বিষ্ণৌ চ পরমাত্মনি।
সমবুদ্ধ্যা প্রবর্ত্তন্তে তে বৈ ভাগবতোত্তমাঃ।।
----যারা পরমেশ্বর শিব এবং পরমাত্মা বিষ্ণুকে অভিন্ন ভাবেন, তারাই উত্তম ভক্ত।
সুতরাং ধর্মান্ধ ব্যক্তির অন্ধ ভক্তি হতে সাবধান!
# অনন্ত ব্রহ্মস্বরূপ মহারুদ্র শিব বেদ-বেদান্তের গোপনীয় তত্ত্ব। পরমেশ্বর শিবের নিঃশ্বসিত তথা শিব হতে উৎপন্ন বেদের সর্বত্র বহুরূপে বহুনামে শিবতত্ত্বেরই মহিমা গীত হয়েছে। ভগবান শিব বলেছেন ----
"ঋগ্বেদোহহং যজুর্ব্বেদঃ সামবেদোহহমাত্মনঃ।
অথর্ব্বণশ্চ মন্ত্রোহহং তথা চাঙ্গিরসো বরঃ।।"
-----শিব গীতা।
---আমি ঋগবেদ, যজুর্বেদ, সামবেদ এবং ব্রহ্মস্বরূপ। আমি শ্রেষ্ঠ অথর্বন ও আঙ্গিরস মন্ত্র স্বরূপ।
সুতরাং বেদ-বেদান্তে শিবময় ব্রহ্মতত্ত্বই প্রকটিত।
চলুন বেদ-বেদান্ত ভাবনায়---------
★ নমো হিরণ্য বাহবে সেনান্যে। দিশাং চ পতয়ে নমো।
নমো বৃক্ষেভ্যো হরিকেশেভ্যঃ। পশুনাং পতয়ে নমো।
নমঃ শষ্পিঞ্জরায় ত্বিষীমতে। পথীনাং পতয়ো নমো।
নমো হরিকেশায়োপবীতিনে। পুষ্টানাং পতয়ে নমঃ।।
--যজুর্বেদ।
অর্থাৎ, হিরণ্যবাহু সেনানী রুদ্রকে নমস্কার, দিকসমূহের পালক রুদ্রকে নমস্কার। হরিতবর্ণ পত্রযুক্ত বৃক্ষরূপ রুদ্রকে নমস্কার, পশুপতি তথা জীব পালক রুদ্রকে নমস্কার। পীতরক্তবর্ণ কান্তিযুক্ত রুদ্রকে নমস্কার, পথের পালক রুদ্রকে নমস্কার। নীলবর্ণকেশযুক্ত যজ্ঞোপবীতধারী রুদ্রকে নমস্কার, মানবগণের পালক রুদ্রকে নমস্কার করি।
★নমো রোহিতায় স্তপতয়ে। বৃক্ষানাং পতয়ে নমো। ভুবন্তয়ে বারিবস্কৃতায়ৌধধীনাং পতয়ে নমো। নমো মন্ত্রিণে বানিজায়। কক্ষানাং পতয়ে নমো। নমো উচ্চের্ঘোষায়াক্রন্দয়তে। পত্তীনাং পতয়ে নমঃ।।
--যজুর্বেদ।
--রোহিত স্থপতিরূপ রুদ্রকে নমস্কার, বৃক্ষসমূহেরপতি রুদ্রকে নমস্কার। বিশ্বজগতের বিস্তারক ধনদাতা ও ঔষধী সমূহের পতি রূদ্রকে নমস্কার। মন্ত্রণা বিশারদ রুদ্রকে নমস্কার, বণিকরূপ রুদ্রকে নমস্কার, লতা-গুল্ম জাতীয় বৃক্ষসমূহের পালক রুদ্রকে নমস্কার। যুদ্ধে মহাশব্দকারী রুদ্রকে নমস্কার, পত্তীদের পতি রুদ্রকে নমস্কার।
★নমো ভবায় চ রুদ্রায় চ।
নমঃ শর্বায় চ পশুপতয়ে চ।
নমো নীলগ্রীবায় চ শিতিকন্ঠায় চ ।।"
-- যজুর্বেদ।
-- প্রাণীগণের উৎপাদক ভব ও দারিদ্র্যনাশক রুদ্রকে নমস্কার। পাপনাশক শর্ব ও জীবগণের পালক পশুপতিকে নমস্কার। নীলগ্রীব ও শিতিকন্ঠকেশ প্রভুকে নমস্কার করি।
★ নমঃ কপর্দিনে চ ব্যুপ্তকেশায় চ।
নমঃ শহস্রাক্ষায় চ শতধন্বনে চ।
নমো গিরিশয়ায় চ শিপিবিষ্টায় চ।
নমো মীঢ়ুষ্টমায় চেষুমতে চ।।
--যজুর্বেদ।
- জটা নামক উর্ধ্ব বিন্যস্ত কেশধারী ও মুন্ডিত কেশ রুদ্রকে নমস্কার। সহস্রাক্ষ ও শতশত ধনুর্ধর রুদ্রকে নমস্কার। গিরীশায়ী ও অন্তর্যামী রুদ্রকে নমস্কার। বর্ষণকারী ও বানধারী প্রভুকে নমস্কার করি।
★"নমো হ্রস্বায় চ বামনায় চ।
নমো বৃহতে চ বর্ষীয়সে চ।
নমো বৃদ্ধায় চ সবৃধে চ।
নমোহগ্ন্যায় চ প্রথমায় চ।।
-- যজুর্বেদ।
--হ্রস্ব ও বামনরূপী রুদ্রকে নমস্কার; বৃহৎ ও বর্ষীয়ানরূপী রুদ্রকে নমস্কার ; বয়োবৃদ্ধ ও জ্ঞানবৃদ্ধ রূপী রুদ্রকে নমস্কার, জগতের মোক্ষ ও আদি রুদ্রকে নমস্কার।
★"নমঃ শম্ভবায় চ ময়োভবায় চ।
নমঃ শঙ্করায় চ ময়স্করায় চ।
নমঃ শিবায় চ শিবতরায় চ।।
--যজুর্বেদ।
-- মুক্তিসুখ ও সংসারসুখ দাতাকে নমস্কার, লৌকিক ও মোক্ষ সুখ দাতা প্রভুকে নমস্কার। শিবজ্ঞান দাতা প্রভু শিবকে নমস্কার করি।
Continue-52
বৈদিক সাহিত্যে শিব ও তাঁর বিকাশ
বৈদিক যুগের প্রথম স্তরে অর্থাৎ বৈদিক সাহিত্যের প্রধান ও প্রাচীনতম সাহিত্য ঋগ্বেদে বস্তুত শিবকে পাওয়া যায় না। তাঁর প্রতিরূপ রুদ্রকে ঋগ্বেদের কয়েকটি সূক্তে স্তূয়মান হিসেবে পাওয়া যায়। অধ্যাপক জিতেন্দ্রনাথের মতে–
‘শিব’ শব্দ এই সময়ে কতিপয় বৈদিক দেবতার বিশেষণ রূপে ‘মঙ্গলদায়ক’ অর্থে ব্যবহৃত হইত। উত্তর বৈদিক সাহিত্যে যে ‘সত্যম্ শিবম্ সুন্দরম্’ পদ পাওয়া যায়, সেখানেও ইহা পরম ব্রহ্মের বিশেষণ রূপে একই অর্থে ব্যবহার করা হইয়াছে। বৈদিক সাহিত্যের শেষের দিক হইতে ইহা এক বিশেষ দেবসত্তাকে বুঝাইতে আরম্ভ করে।… কিন্তু রুদ্রই যে পৌরাণিক শিবের আদি বৈদিক প্রতিরূপ সে বিষয়ে নিঃসন্দেহ হওয়া যায়।’– (পঞ্চোপাসনা, পৃষ্ঠা-১২৫)
আর দীনেশ চন্দ্র সেন-এর ভাষায় বৈদিক রুদ্রের রূপ হলো– ‘বেদের রুদ্রদেব বিনাশের দেবতা, তাঁর জটাজুট অগ্নিশলাকার মতো। তাঁর নৃত্যের নাম– তাণ্ডব; তাতে বিশ্ব বিকম্পিত হয় ও গ্রহরা কক্ষচ্যুত হয়ে ব্যোমপথে বিক্ষিপ্তভাবে ছোটাছুটি করে। রুদ্রের নিঃশ্বাসের জ্বালা– জগতের শ্মশান। তাঁর শূলাগ্রে বিদ্ধ হয়ে দিগ্হস্তীরা আর্তনাদ করে ওঠে। তাঁর নেত্রশাসনে চিত্ত-শ্মশানে কামদেব পুড়ে ছাই হয়। তাঁর মুখোচ্চারিত প্রণব প্রলয়ের গান– বিনাশের ঝঞ্ঝা। তা জগতকে পুঞ্জীভূত ধুলোয় পরিণত করে। তাঁর বিষাণ-বাদনের তালে তালে চতুর্দশ মৃত্যু নৃত্য করতে থাকে।’ –(বৃহৎ বঙ্গ)
ড. উদয়চন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাষ্যে, ‘পণ্ডিতদের অনুমান– আদিম মানব গোষ্ঠীর মধ্যে গাছ, পাথর, বিভিন্ন জন্তু পূজার ব্যাপক প্রচলন ছিল। এরূপ কোন ‘জন্’ বা গোষ্ঠী হয়তো লম্বাটে পাথরকে শিব হিসাবে পূজা করতেন, যা পরবর্তী কালে বেদের রুদ্র দেবতার সঙ্গে এক হয়ে গেছেন। ডক্টর জিতেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় লিঙ্গপূজাকে ‘ট্রাইবাল’দের থেকে আসা বলেই মনে করেন। পরবর্তীকালে প্রত্ন-নিদর্শন হিসেবে প্রাপ্ত কয়েকটি শিবলিঙ্গের গায়ে শিবমূর্তি অঙ্কিত করে বা শিবের প্রতীক ত্রিশূল, পরশু ইত্যাদি অঙ্কিত করে উভয়ের ঐক্য বোঝানো হয়েছে। মূর্তি অঙ্কিত লিঙ্গকে বলে মুখলিঙ্গ। এধরনের মুখলিঙ্গ অতি প্রাচীন কালের প্রত্ন-নিদর্শনে তত বেশি পাওয়া যায় না। কাজেই লিঙ্গ-শিব-রুদ্রের মিশ্রণ অপেক্ষাকৃত আধুনিক।’– (ভূমিকা, লিঙ্গ পুরাণ, পৃষ্ঠা-৯)
তার মানে, লিঙ্গের সাথে শিবের সম্বন্ধ যেভাবেই ঘটুক, দেবতা হিসেবে শিবের চরিত্র ও রূপ-কল্পনায় বৈদিক রুদ্রের বৈশিষ্ট্য এক হয়ে মিশে গেছে বলেই পণ্ডিতদের ধারণা। এভাবে ঋগ্বেদের রুদ্র পরবর্তীকালের শিবের সঙ্গে অভিন্ন বলে ঘোষিত হলেও তিনি একটি পৃথক ধারার প্রতিনিধিত্ব করেন। আমরা দেখতে পাই, ঋগ্বেদে রুদ্র হলেন অন্তরীক্ষের দেবতা। রুদ্রকে উদ্দেশ্য করে ঋগ্বেদে মাত্র তিনটি স্বতন্ত্র সূক্ত রয়েছে। তবে দেবতা হিসেবে ঋগ্বেদে তাঁর বিশেষ প্রাধান্য না থাকলেও রুদ্রের পরিকল্পনায় বিবিধ বৈচিত্র্যের পরিচয় পাওয়া যায়। কোথাও তিনি উগ্র, ক্রোধপরায়ণ ও পশুর ন্যায় ভয়ঙ্কর, এবং এই রূপেই বিস্তীর্ণ জগতের রক্ষাকর্তা। যেমন–
হবীমভি র্র্হভতে যো হবির্ভিরব স্তোমেভী রুদ্রং দিষীয়।
ঋদূদরঃ সুহবো মা নো অস্যৈ বভ্রুঃ সুশিপ্রো রীরধন্মনায়ৈ।। (ঋগ্বেদ-২/৩৩/৫)।
স্থিরেভিরঙ্গৈঃ পুরুরূপ উগ্রো বভ্রুঃ শুক্রেভিঃ পিপিশে হিরণ্যৈঃ।
ঈশানাদস্য ভুবনস্য ভুরে র্ন বা উ যোষদ্রুদ্রাদসূর্যম্ ।। (ঋগ্বেদ-২/৩৩/৯)।
অর্হন্ বিভর্ষি সায়কানি ধন্বার্হন্নিষ্কং যজতং বিশ্বরূপম্ ।
অর্হন্নিদং দয়সে বিশ্বমভ্বং ন বা ওজীয়ো রুদ্রত্বদস্তি।। (ঋগ্বেদ-২/৩৩/১০)।
স্তুহি শ্রতং গর্তসদং যুবানং মৃগং ন ভীমমুপহত্নুমুগ্রম্ ।
মৃলা জরিত্রে রুদ্র স্তবানোহন্যং তে অস্মন্নি বপন্তু সেনাঃ।। (ঋগ্বেদ-২/৩৩/১১)।
অর্থাৎ :
যে রুদ্র হব্য সম্বলিত আহ্বানদ্বারা আহুত হন, আমি স্তোত্রদ্বারা তাঁকে অপগত-ক্রোধ করব। কোমলোদর, শোভন আহ্বানবিশিষ্ট বভ্রুবর্ণ ও সুনাসিক রুদ্র আমাদের যেন তাঁর জিঘাংসাবৃত্তির বিষয়ীভূত না করেন। (ঋক-২/৩৩/৫)।। দৃঢ়াঙ্গ, বহুরূপ, উগ্র ও বভ্রুবর্ণ রুদ্র দীপ্ত হিরণ্ময় অলঙ্কারে শোভিত হচ্ছেন। রুদ্র সমস্ত ভুবনের অধিপতি এবং ভর্তা, তাঁর বল পৃথককৃত হয় না। (ঋক-২/৩৩/৯)।। হে অর্চনার্হ ! তুমি ধনুর্বাণধারী; হে অর্চনার্হ ! তুমি নানারূপবিশিষ্ট ও পূজনীয় নিষ্ক ধারণ করেছ; হে অর্চনার্হ ! তুমি সমস্ত বিস্তীর্ণ জগৎকে রক্ষা করছ, তোমা অপেক্ষা অধিক বলবান আর কেউ নেই। (ঋক-২/৩৩/১০)।। হে স্তোতা ! প্রখ্যাত রথস্থিত, যুবা, পশুর ন্যায় ভয়ঙ্কর ও শত্রুদের বিনাশক, উগ্র রুদ্রকে স্তব কর। হে রুদ্র ! আমরা স্তব করলে তুমি আমাদের সুখী কর, তোমার সেনা শত্রুকে বিনাশ করুক। (ঋক-২/৩৩/১১)।।
আবার কোন কোন দৃষ্টান্তে রুদ্রের স্তুতি সুস্পষ্ট আতঙ্কজনিত বলেই প্রতীয়মান হয়। তাই ঋগ্বেদে বারবার এরকম প্রার্থনা উচ্চারিত হতে দেখা যায়–
মা নো মহান্তমুত মা নো অর্ভকং মা ন উক্ষন্তমুত মা না উক্ষিতম্ ।
মা নো বধীঃ পিতরং মোত মাতরং মা নঃ প্রিয়াস্তন্বো রুদ্র রীরিষঃ।। (ঋগ্বেদ-১/১১৪/৭)।
মা নস্তোকে তনয়ে মা ন আয়ৌ মা নো গোষু মা নো অন্বেষু রীরিষঃ।
বীরাদ্মা নো রুদ্রং ভামিতো বধী র্হবিষ্মন্তঃ সর্দামত্ত্বা হবামহে।। (ঋগ্বেদ-১/১১৪/৮)।
আরে তে গোঘ্নমুত পুরুষঘ্নং ক্ষয়দ্বীর সুম্নমস্মে তে অস্তু।
মৃলা চ নো অধি চ ব্রুহি দেবাধা চ নঃ শর্ম যচ্ছ দ্বিবর্হাঃ।। (ঋগ্বেদ-১/১১৪/১০)।
অর্থাৎ :
হে রুদ্র ! আমাদের মধ্যে বৃদ্ধকে বধ করো না, বালককে বধ করো না, সন্তান জনয়িতাকে বধ করো না, গর্ভস্থ সন্তানকে বধ করো না, আমাদের পিতাকে বধ করো না, মাতাকে বধ করো না, আমাদের শরীরে আঘাত করো না। (ঋক-১/১১৪/৭)।। হে রুদ্র ! আমাদের পুত্রকে হিংসা করো না; তার পুত্রকে হিংসা করো না, আমাদের অন্য মানুষকে হিংসা করো না, আমাদের গো ও অশ্ব হিংসা করো না। হে রুদ্র ! ক্রুদ্ধ হয়ে আমাদের বীরদের হিংসা করো না, কেননা আমরা হব্য নিয়ে সর্বদাই তোমাকে আহ্বান করি। (ঋক-১/১১৪/৮)।। হে বীরগণের ক্ষয়কারক ! তোমার কৃত গোহত্যা ও মানুষহত্যা দূরে থাকুক, আমরা যেন তোমার দত্ত সুখ পাই। আমাদের সুখী কর, হে দীপ্তিমান রুদ্র ! আমাদের পক্ষ হয়ে কথা বলো, তুমি উভয় পৃথিবীর স্বামী, আমাদের সুখ দাও। (ঋক-১/১১৪/১০)।।
এ-প্রেক্ষিতে ড. উদয়চন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রণিধানযোগ্য বক্তব্যটি হলো,– ‘লৌকিক শিবের মধ্যে বৈদিক রুদ্র ভাবনা এক সময় মিশে গিয়েছিল। অন্যভাবে বলা যায় যে বৈদিক রুদ্রই শিবেতে মিশেছেন। প্রকৃতির ধ্বংসাত্মক মূর্তিকে ঋগ্বেদে রুদ্র বলা হয়েছে। আকাশের বিদ্যুৎ তাঁর হাতের বাণ, ধ্বংসাত্মক মরুতেরা তাঁর পুত্র (মরুৎদের তাই ঋক্ সংহিতায় ‘রুদ্রিয়াসঃ’ বলা হয়েছে। ঋ.সং. ১/৩৮/৭; ১/৬৪/২; ১/১১৪/৬; ২/৩৪/১০ ইত্যাদি মন্ত্র দ্রষ্টব্য।) শুধু তাই নয়– মহামারী, রোগ, বিষ ইত্যাদি অনিষ্টকারক সব কিছুর সঙ্গেই রুদ্রকে যুক্ত করা হয়েছে। এই দেবতাকে আর্যরা এত ভয় পেতেন যে এনার নাম পর্য্যন্ত উচ্চারণ করতে নিষেধ করা হয়েছে, এবং সেজন্য বেদ মন্ত্রকে বিকৃত ভাবে উচ্চারণের বিধানও দেওয়া হয়েছে। লৌকিক ধর্মে গণেশ এবং শনিদেবতা সম্পর্কে এরূপ বিধান পাওয়া যায়। বিঘ্নের দেবতা গণেশকে পুরাণে ভিন্ন নামে অভিহিত করা হয়েছে (যাজ্ঞবল্ক্য সংহিতা দ্রষ্টব্য)। শনিকেও একই কারণে ‘বারের ঠাকুর’ বলা হয়। এই সব লৌকিক দেবতাকে লোকে যেমন ভয়ে পূজা করে, তেমনি রুদ্রকেও ভয়ে স্তুতি করা হত। এই কারণেই হয়তো ঋগ্বেদে রুদ্রের স্তুতি অত্যন্ত কম। রুদ্র দেবতা বৈদিক সাহিত্যের মধ্যে যজুর্বেদে একটা বিরাট স্থান অধিকার করেছেন।’– (ভূমিকা/ লিঙ্গ পুরাণ, পৃষ্ঠা-১৩)
তবে রুদ্রের একটি কল্যাণের দিকও আছে। ঋগ্বেদে তিনি সর্বশ্রেষ্ঠ ভিষক রূপে খ্যাত। তাই তিনি শুধুই আতঙ্ক-নিরসনের আশায় নয়, পার্থিব কল্যাণ-কামনায়, বিশেষ করে রোগ-নিরাময়কারক ওষধি প্রভৃতির কামনায়ও স্তুত হয়েছেন। যেমন–
মূলা নো রুদ্রোত নো ময়ষ্কৃধি ক্ষয়দ্বীরায় নমসা বিধেম তে।
যচ্ছং চ যোশ্চ মনুরায়েজে পিতা তদশ্যাম তব রুদ্র প্রণীতিষু।। (ঋগ্বেদ-১/১১৪/২)।
কুমারশ্চিৎ পিতরং বন্দমানং প্রতি নানাম রুদ্রোপয়ন্তম্ ।
ভূরে র্দাতারং সৎপতি গৃণীষে স্তুভস্ত্বং ভেষজা রাস্যস্মে।। (ঋগ্বেদ-২/৩৩/১২)।
যা বো ভেষজা মরুতঃ শুচীনি যা শন্তমা বৃষণো যা ময়োভু।
যানি মনুরবৃণীতা পিতা নস্তা শঞ্চ যোশ্চ রুদ্রস্য রশ্মি।। (ঋগ্বেদ-২/৩৩/১৩)।
ত্বাদত্তেভি রুদ্র শন্তমেভিঃ শতং হিমা অশীয় ভেষজেভিঃ।
ব্যস্মদ্দ্বেষো বিতরং ব্যংহো ব্যমীবাশ্চাতয়স্বা বিষূচীঃ।। (ঋগ্বেদ-২/৩৩/২)।
অর্থাৎ :
হে রুদ্র ! তুমি সুখী হও, আমাদের সুখী কর; তুমি বীরদের ক্ষয়কারী, আমরা নমস্কারের সাথে তোমার পরিচর্যা করি। পিতা মনু যে রোগসমূহ হতে উপশম ও ভয়সমূহ হতে উদ্ধার পেয়েছিলেন, হে রুদ্র ! তোমার উপদেশ হতে যেন আমরা তা পাই। (ঋক-১/১১৪/২)।। পিতা আশির্বাদ করবার সময় পুত্র যেরূপ তাঁকে নমস্কার করে, সেরূপ হে রুদ্র ! তুমি আসবার সময় আমরা তোমাকে নমস্কার করছি। হে রুদ্র ! তুমি বহুধনদাতা এবং সাধুলোকের পালক, আমরা স্তব করলে আমাদের ঔষধ প্রদান কর। (ঋক-২/৩৩/১২)।। হে মরুৎগণ ! তোমাদের যে নির্মল ঔষধ আছে, হে অভীষ্টবর্ষিগণ, তোমাদের যে ঔষধ অত্যন্ত সুখকর ও সুখপ্রদ, যে ঔষধ আমাদের পিতা মনু মনোনীত করেছিলেন, রুদ্রের সে সুখকর ভয়হারী ঔষধ আমরা কামনা করছি। (ঋক-২/৩৩/১৩)।। হে রুদ্র ! আমরা যেন তোমার দত্ত সুখকর ওষধিদ্বারা শতবর্ষ জীবিত থাকতে পারি। তুমি আমাদের শত্রুগণকে বিনাশ কর, আমার পাপ একেবারে বিদূরিত কর এবং সর্বশরীরব্যাপী ব্যাধিপুঞ্জকে বিদূরিত কর। (ঋক-২/৩৩/২)।।
ঋগ্বেদের নানা জায়গায় রুদ্রের সঙ্গে মরুৎগণের উল্লেখ থেকে বোঝা যায় রুদ্রের সঙ্গে মরুৎগণের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। মরুৎগণও অন্তরীক্ষের দেবতা, তবে একটি দেবতা নন– একদল দেবতা, এবং সর্বত্রই দল হিসেবে তাঁদের উল্লেখ। এই কারণে তাঁদের নামের সঙ্গে ‘গণ’ শব্দ সংযুক্ত। বিভিন্ন সূক্তে রুদ্রকে মরুৎগণের পিতা হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন–
উপ তে স্তোমান্ পশুপা ইবাকরং রাস্বা পিতর্মরুতাং সুম্মমস্মে।
ভদ্রা হি তে সুমতি র্মৃলয়ত্তমাথা বয়মব ইত্তে বৃণীমহে।। (ঋগ্বেদ-১/১১৪/৯)।
আ তে পিতর্মরুতাং সুম্নমেতু মা নঃ সূর্যস্য সন্দৃশো যুযোথাঃ।
অভি নো বীরো অর্বতি ক্ষমেত প্র জায়েমহি রুদ্র প্রজাভিঃ।। (ঋগ্বেদ-২/৩৩/১)।
ইদং পিত্রে মরূতামুচ্যতে বচঃ স্বাদোঃ স্বাদীয়ো রুদ্রায় বর্ধনম্ ।
রাস্বা নো অমৃত মর্তভোজনং ত্বনে তোকায় তনয়ায় মৃল।। (ঋগ্বেদ-১/১১৪/৬)।
অর্থাৎ :
পশুপালক যেরূপ সায়ংকালে পশুস্বামীদের তাদের পশু ফিরিয়ে দেয়, হে রুদ্র ! আমি সেরূপ তোমার স্তোত্র তোমাকে অর্পণ করছি। হে মরুৎগণের পিতা ! আমাদের সুখ দান কর, তোমার অনুগ্রহ অতিশয় সুখকর এবং কল্যাণকর, আমরা তোমার ক্ষণ প্রার্থনা করি। (ঋক-১/১১৪/৯)।। হে মরুৎগণের পিতা (রুদ্র) ! তোমার প্রদত্ত সুখ আমাদের নিকট আসুক, তুমি সূর্য দর্শন হতে আমাদের পৃথক করো না, আমাদের বীর পুত্রগণ শত্রুদের অভিভূত করুক। হে রুদ্র ! আমরা যেন পুত্র পৌত্রাদিতে অনেক হয়ে উঠি। (ঋক-২/৩৩/১)।। মধু হতেও অধিক মধুর এ স্তুতি বাক্য মরুৎগণের পিতা রুদ্রের উদ্দেশে উচ্চারিত হচ্ছে, এতে (স্তোতার) বৃদ্ধি সাধন হয়। হে মরণরহিত রুদ্র ! মনুষ্যদের ভোজনরূপ অন্ন আমাদের প্রদান কর এবং আমাকে আমার পুত্রকে ও তার তনয়কে সুখ দান কর। (ঋক-১/১১৪/৬)।।
ঋগ্বেদের অন্যত্র রুদ্র-পুত্র অর্থে মরুৎগণকে ‘রুদ্রাসঃ’ বলা হয়েছে এবং কোথাও আবার ‘রুদ্রিয়গণ’ হিসেবে স্তুত হয়েছে। যেমন–
নহি বঃ শত্রু র্বিবিদে অধি দ্যবি ন ভূম্যাং রিশাদসঃ।
যুষ্মাকমস্তু তবিষী তনা যুজা রুদ্রাশো নু চিদাধৃষে।। (ঋগ্বেদ-১/৩৯/৪)।
সত্যং ত্বেষা অমবস্তো ধন্বঞ্চিদা রুদ্রিয়াসঃ। মিহং কৃণ¦স্ত্যবাতাম্ ।। (ঋগ্বেদ-১/৩৮/৭)।
চিত্রং তদ্বো মরুতো ষাম চেকিতে পৃশ্ন্যা যদুধরপ্যাপয়ো দুহুঃ।
যদ্বা নিদে নবমানস্য রুদ্রিয়াস্ত্রিতং জরায় জুরতামদাভ্যাঃ।। (ঋগ্বেদ-২/৩৪/১০)।
অর্থাৎ :
হে শত্রুহিংসক মরুৎগণ ! দ্যুলোকে তোমাদের শত্রু নেই, পৃথিবীতেও নেই। হে রুদ্রপুত্রগণ ! তোমরা একত্রিত হও, (শত্রুদের) ধর্ষণার্থে তোমাদের বল শীঘ্র বিস্তৃত হোক। (ঋক-১/৩৯/৪)।। দীপ্তিমান ও বলবান রুদ্রীয়গণ সত্যই মরুভূমিতেও বায়ুরহিত বৃষ্টি দান করেন। (ঋক-১/৩৮/৭)।। হে মরুৎগণ; তোমরা যখন পৃশ্নির উধঃ দোহন করেছিলে, যখন স্তুতিকারীর নিন্দুককে হিংসা করেছিলে এবং ত্রিতের শত্রুদের বধ করেছিলে, হে অহিংসনীয় রুদ্রপুত্রগণ ! সে সময়ে তোমাদের বিচিত্র ক্ষমতা সকলেই জেনেছিল। (ঋক-২/৩৪/১০)।।
আবার ঋগ্বেদের অন্যত্র এই মরুৎগণকে ‘পৃশ্নিমাতরঃ’ অর্থাৎ পৃশ্নি মাতার সন্তান হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এবং কোথাও কোথাও মরুৎগণের মাতা পৃশ্নি উল্লেখও রয়েছে। যেমন–
বিশ্বান্দেবান্ হবামহে মরুতঃ সোমপীতয়ে। উগ্রা হি পৃশ্নিমাতরঃ।। (ঋগ্বেদ-১/২৩/১০)।
দ্যাবো ন স্তৃভিশ্চিতয়ন্ত খাদিনো ব্যভ্রিয়া ন দ্যূতয়ন্ত বৃষ্টয়ঃ।
রুদ্রো যদ্বো মরুতো রু´বক্ষসো বৃষাজনি পৃশ্ন্যাঃ শক্র ঊধনি।। (ঋগ্বেদ-২/৩৪/২)।
প্র যে মে বংধ্বেষে গাং বোচন্ত সূরয়ঃ পৃশ্নিং বোচন্তে মাতরম্ ।
অধা পিতরমিষ্মিণং রুদ্রং বোচন্ত শিক্বসঃ।। (ঋগ্বেদ-৫/৫২/১৬)।
অজ্যেষ্ঠাসো অকনিষ্ঠাস এতে সংভ্রাতরো বাবৃধূঃ সৌভগায়।
যুবা পিতা স্বপা রুদ্র এষাং সুদুঘা পৃশ্নিঃ সুদিনা মরুদ্ভ্যঃ।। (ঋগ্বেদ-৫/৬০/৫)।
অর্থাৎ :
সমস্ত মরুৎ দেবগণকে সোমপানার্থে আহ্বান করি, তাঁরা উগ্র ও পৃশ্নির সন্তান। (ঋক-১/২৩/১০)।। হে সুবর্ণবক্ষ মরুৎগণ ! যেহেতু সেচন সমর্থ রুদ্র পৃশ্নির নির্মল উদরে তোমাদের উৎপন্ন করেছেন; অতএব আকাশ যেরূপ নক্ষত্রে শোভিত হয়, তোমরা সেরূপ স্বীয় আভরণে শোভিত হও। তোমরা শত্রভক্ষক ও জলপ্রেরক, তোমরা মেঘস্থ বিদ্যুতের ন্যায় শোভিত হও। (ঋক-২/৩৪/২)।। আমি তাদের উৎপত্তিক্রম অনুসন্ধান করায়, জ্ঞানী মরুৎগণ আমাকে এ উত্তর দিয়েছেন; তাঁরা বলেছেন পৃশ্নি তাদের জননী, বলশালী মরুৎগণ বলেছেন অন্নদাতা রুদ্র তাঁদের জনক। (ঋক-৫/৫২/১৬)।। এ সমস্ত মরুৎ এক সময়ে উৎপন্ন, সুতরাং পরস্পর জ্যেষ্ঠ-কনিষ্ঠভাব বর্জিত হয়ে ভ্রাতৃভাবে ও সমৃদ্ধি সহকারে বর্ধিত হয়েছেন। নিত্যতরুণ, সৎকর্মের অনুষ্ঠানকারী মরুৎগণের পিতা রুদ্র ও জননী দোহনযোগ্যা পৃশ্নি মরুৎগণের নিমিত্ত দিন সকল অনুকুল করুন। (ঋক-৫/৬০/৫)।।
ঋগ্বেদ অনুসারে পৃশ্নি একটি গরুর নাম। ফলে মরুৎগণকে ‘গোমাতরঃ’ বলেও বর্ণনা করা হয়েছে। যেমন–
স বহ্নিঃ পুত্রঃ পিত্রোঃ পবিত্রবান্ পুনাতি ধীরো ভুবনানি মায়য়া।
ধেনুঞ্চ পৃশ্নিং বৃষভঃ সুরেতসং বিশ্বাহা শুক্রং পয়ো অস্য দুক্ষত।। (ঋগ্বেদ-১/১৬০/৩)।
গোভির্বাণো অজ্যতে সোভরীণাং রথে কোশে হিরণ্যয়ে।
গোবন্ধবঃ সুজাতাস ইষে ভুজে মহান্তো নঃ স্পরসে নু।। (ঋগ্বেদ-৮/২০/৮)।
অর্থাৎ :
আদিত্য পিতা মাতা স্বরূপ দ্যাবাপৃথিবীর পুত্র। তিনি ধীর এবং ফলপ্রদায়ী তিনি স্বীয় প্রজ্ঞাদ্বারা সমস্ত ভূতগণকে প্রকাশ করছেন। তিনি পৃশ্নি ধেনু ও সেচন সমর্থ বৃষকে প্রকাশ করছেন ও দ্যুলোক হতে নির্মল জল দোহন করছেন। (ঋক-১/১৬০/৩)।। সোভরি ঋষিগণের শব্দদ্বারা হিরণ্ময় রথের মধ্যদেশে মরুৎগণের বাণ ব্যক্ত হচ্ছে। গোমাতৃক সুজন্মা, মহানুভব মরুৎগণ আমাদের অন্ন ভোগ ও প্রীতিপ্রদ হোন। (ঋক-৮/২০/৮)।।
কিন্তু মরুৎগণকে গোমাতৃক জাতীয় পৌরাণিক কল্পনার কারণ কী হতে পারে? ‘পৃশ্নি’ অর্থ হলো নানা বর্ণযুক্ত। তাহলে নানা বর্ণযুক্তা মরুৎগণের এই মাতা কে? বেদ-টীকাকার সায়ণের ভাষ্যে পৃশ্নি অর্থ পৃথিবী। আবার কোথাও তিনি ‘পৃশ্নি’ শব্দের অর্থ শুক্লবর্ণ করেছেন। কিন্তু প্রাচীন সংস্কৃত অভিধান ‘নিঘণ্টু’ অনুযায়ী পৃশ্নি অর্থে আকাশ। তবে আধুনিক পণ্ডিত গবেষকরা অনুমান করতে চেয়েছেন, বৈদিক কবিরা এখানে আকাশের বৃষ্টিদায়িনী মেঘকে দুগ্ধদায়িনী গরুর সঙ্গে তুলনা করেছেন, অতএব গোমাতৃক অর্থে মরুৎগণ প্রকৃতপক্ষে মেঘতনয় বলেই কল্পিত। কিন্তু মনে রাখা দরকার যে, সুবিশাল ঋগ্বেদ সাহিত্যে বহু কবি বহুভাবে এই দেবতাদের নিয়ে বহু কল্পনা করেছেন; তাই মরুৎগণের উৎপত্তি-প্রসঙ্গে কোন এক অদ্বিতীয় সিদ্ধান্তের সাহায্যে সমস্ত নজিরের পর্যাপ্ত ব্যাখ্যা পাওয়া সুকঠিন। কেননা, এই মরুৎগণই কোথাও ‘সিন্ধু-মাতরঃ’ বলে কল্পিত, আবার বর্ণনা-বিশেষে তাঁরা কোথাও ‘স্বয়ং-উৎপন্ন’ কিংবা কোথাও ‘স্বর্গ-তনয়’ হিসেবেও কল্পিত হয়েছেন। যেমন–
গ্রাবাণো ন সূরয়ঃ সিন্ধুমাতর আদর্দিরাসো অদ্রয়ো ন বিশ্বহা।
শিশুলা ন ক্রীলয়ঃ সুমাতরো মহাগ্রামো ন যামন্নুত ত্বিষা।। (ঋগ্বেদ-১০/৭৮/৬)।
বব্রাসো ন যে স্বজাঃ স্বতবস ইষং স্বরভিজায়ন্ত ধূতয়ঃ।
সহস্রিয়াসো অপাং নোর্ময় আসা গাবো বন্দ্যাসো নোক্ষশঃ।। (ঋগ্বেদ-১/১৬৮/২)।
শ্রিয়ে মর্যাসো অঞ্জীরকৃণ্বত সুমারুতং ন পূর্বীরতি ক্ষপঃ।
দিবস্পুত্রাস এতা ন যেতির আদিত্যাসস্তে অক্রা ন বাবৃধুঃ।। (ঋগ্বেদ-১০/৭৭/২)।
অর্থাৎ :
জল প্রেরণকারী মেঘের ন্যায় সিন্ধুমাতার সন্তানেরা (মরুৎগণ) নদী নির্মাণ করেন। বিদীর্ণকারী অস্ত্রশস্ত্রের ন্যায় সকলি তাঁরা ধ্বংস করেন। বৎসল মাতার শিশুদের ন্যায় তাঁরা ক্রীড়া করেন। বহুলোকসমূহের ন্যায় তাঁরা দীপ্তিসহকারে গমন করেন। (ঋক-১০/৭৮/৬)।। স্বয়ং-উৎপন্ন, স্বাধীনবল, কম্পনশীল মরুৎগণ যে মূর্তিমান হয়ে অন্ন ও স্বর্গের জন্য প্রাদুর্ভূত হচ্ছেন। অসংখ্য এবং প্রশংসনীয় ধেনু যেরূপ দুগ্ধদান করে, জলোর্মির ন্যায় তাঁরা সেরূপ হয়ে জলদান করেন। (ঋক-১/১৬৮/২)।। এ মরুৎগণ পূর্বে মনুষ্য ছিলেন, পুণ্যদ্বারা দেবতা হয়েছেন, এরা শরীর শোভার্থে অলঙ্কার ধারণ করেন। বিস্তর সৈন্য একত্র হয়েও মরুৎগণকে অতিক্রম করতে পারে না। আমরা এখনও স্তব করি নি বলে এ সকল দ্যুলোকের পুত্রগণ অর্থাৎ মরুৎগণ এখনও দেখা দেন নি, মহাবল পরাক্রান্ত এ সকল অদিতি সন্তানগণ এখনও বৃদ্ধিযুক্ত হন নি। (ঋক-১০/৭৭/২)।।
তবে বৈদিক কবিদের এই কল্পনা যত বিচিত্রই হোক না কেন, রুদ্রের সাথে গরু বা গো-মাতার সম্পর্ক এবং পরবর্তীকালের শিব-কল্পনায় শিবের বাহন বা লাঞ্ছন হিসেবে যে গরু তথা বৃষ বা বলীবর্দের উপস্থিতি রয়েছে, কিংবা শিবের অন্যতম প্রধান অনুচর নন্দী যে মূলত বৃষ-কল্পনা সেটিও বিবেচনায় রাখা আবশ্যক। কেননা, বৃষের সঙ্গে শিবের সম্পর্ক অত্যন্ত প্রাচীন। এক্ষেত্রে স্মরণীয় যে, প্রাগৈতিহাসিক সিন্ধু সভ্যতার ধ্বংসাবশেষের মধ্যে যোগী শিবের মূর্তির সঙ্গে বৃষমূর্তিও আবিষ্কৃত হয়েছে। তাছাড়া ঋগ্বেদের একাধিক মন্ত্রেও বৃষের সঙ্গে রুদ্রের যে সম্পর্কের কথা পাওয়া যায়, কয়েকটি ক্ষেত্রে রুদ্রকেই বলা হয়েছে বৃষভ। যেমন–
উন্মা মমন্দ বৃষভো মরুত্বান্ত্বক্ষীয়সা বয়সা নাধমানম্ ।
ঘৃণীব ছায়ামরপা অশীয়া বিবাসেয়ং রুদ্রস্য সুম্নম্ ।। (ঋগ্বেদ-সংহিতা-২/৩৩/৬)
অর্থাৎ : আমি প্রার্থনা করছি, অভীষ্টবর্ষী (বৃষভ) মরুৎবিশিষ্ট রুদ্র আমাকে দীপ্ত অন্নদ্বারা তৃপ্ত করুন। রৌদ্রতপ্ত ব্যক্তি যেরূপ ছায়া লাভ করে, আমি সেরূপ পাপশূন্য হয়ে রুদ্রদত্ত সুখ লাভ করব এবং রুদ্রের পরিচর্যা করব।
এখানে বৃষভ-এর বেদার্থে অভীষ্টবর্ষী বলা হয়েছে। এ-প্রেক্ষিতে ড. উদয়চন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন,– ‘কাম্যবস্তুর বর্ষক হিসাবে বৃষভ শব্দটিকে টীকাকারেরা ব্যাখ্যা করেছেন। অনেকে মনে করেন যে রুদ্রের বৃষভ বা ষাঁড় রূপের কথাই এখানে বলতে চাওয়া হয়েছে। দেবতাদের পশুরূপ কল্পনার ইতিহাস অতি প্রাচীন। হয়তো এর মধ্যে টোটেম বিশ্বাস বা অন্য কোন প্রকার বিশ্বাসের কথাও লুকিয়ে আছে। পরবর্তী কালের ইতিহাসে পূজিত পশুরা বিভিন্ন দেবতার সঙ্গে সংযুক্ত হয়েছেন এবং তাঁদের বাহনে পর্য্যবসিত হয়েছেন। বৃষভও এভাবেই শিবের বাহনে পরিণত হয়েছেন অনেক পরে।’
এছাড়া দেবতার বাহনদের বিবর্তন প্রসঙ্গে তিনি বলেন,– ‘প্রসঙ্গত বলা চলতে পারে যে শতপথ ব্রাহ্মণ ইত্যাদি গ্রন্থে রুদ্রের পশু হিসাবে আখু বা ইঁদুরের উল্লেখ আছে। এই পশুটি ছেদনের প্রতীক বা ধ্বংসের প্রতীক। শিবের পুত্র হিসাবে পরবর্তী পুরাণাদি সাহিত্যে গণেশ এই বাহনকে লাভ করেছিলেন।’– (ভূমিকা/ লিঙ্গ পুরাণ, পৃষ্ঠা-৯)
ঋগ্বেদের পর যজুর্বেদের শতরুদ্রীয় নামক অংশে (যেখানে রুদ্রের শতনাম কীর্তিত আছে) তাঁর চরিত্রের প্রভূত বিকাশ দেখতে পাওয়া যায়। এই নামগুলির মধ্যে কয়েকটি তাঁর উগ্র রূপ ব্যঞ্জনা করে, কয়েকটি আবার তাঁর মঙ্গলময় সত্তার দ্যোতক। এই দুই রূপ তাঁর ঘোর ও শিব বা শান্ত তনু। যেমন, কৃষ্ণযজুর্বেদ বা তৈত্তিরীয়-সংহিতার চতুর্থ কাণ্ডের পঞ্চম প্রপাঠকের প্রথম মন্ত্রে বলা হয়েছে–
নমস্তে রুদ্র মন্যব উতো ত ইষবে নমঃ। নমস্তে অস্তু ধন্বনে বাহুভ্যামুত তে নমঃ। যা ত ইষুঃ শিবতমা শিবং বভূব তে ধনুঃ। শিবা শরব্যা যা তব তয়া নো রুদ্র মৃড়য়। যা তে রুদ্র শিবা তনূরঘোরাহপাপকাশিনী তয়া নস্তনুবা শন্তময়া গিরিশন্তাভি চাকশীহি। যামিষুম্ গিরিশন্ত হস্তে বিভর্ষ্যস্তবে। শিবাং গিরিত্র তাং কুরু মা হিংসীঃ পুরুষং জগৎ। শিবেন বচসা ত্বা গিরিশাচ্ছা বদামসি। যথা নঃ সর্ব্বমিজ্জগদযক্ষ্মং সুমনা অসৎ। অধ্যবোচদধিবক্তা প্রথমো দৈব্যো ভিষক্ । অহীংশ্চ সর্ব্বান্ জম্ভয়ন্ৎ সর্ব্বাশ্চ যাতুধান্যঃ। অসৌ যস্তাম্রো অরুণ উত বভ্রুঃ সুমঙ্গলঃ। যে চেমাং রুদ্রা অভিতো দিক্ষু শ্রিতাঃ সহস্রশোহবৈষাং হেড় ঈমহে। অসৌ যোহবসর্পতি নীলগ্রীবো বিলোহিতঃ। উতৈনং গোপা অদৃশন্নদৃশন্নুদহার্য্যঃ উতৈনং বিশ্বা ভূতানি স দৃষ্টো মৃড়য়াতি নঃ। নমো অস্তু নীলগ্রীবায় সহস্রাক্ষায় মীঢুষে। অথো যে অস্য সত্বানোহহং তেভ্যোহকরং নমঃ। প্র মুঞ্চ ধন্বনস্ত্বমুভয়োরার্ত্নিয়োর্জ্জ্যাম্ । যাশ্চ তে হস্ত ইষবঃ পরা তা ভগবো বপ। অবতত্য ধনুস্ত্বং সহস্রাক্ষ শতেষুধে। নিশীর্ষ্য শল্যানাং মুখা শিবো নঃ সুমনা ভব। বিজ্যং ধনুঃ কপর্দ্দিনো বিশল্যো বাণবাম্ উত। অনেশন্নস্যেষব আভুরস্য নিষঙ্গথিঃ। যা তে হেতির্মীঢুষ্টম হস্তে বভূব তে ধনুঃ। তয়াহস্মান্বিশ্বতস্ত্বমযক্ষ্ময়া পরি বূভুজ। নমস্তে অস্ত্বায়ুধায়ানাততায় ধৃষ্ণবে। উভাভ্যামুত তে নমো বাহুভ্যাং তব ধন্বনে। পরি তে ধন্বনো হেতিরস্মান্বৃণক্তু বিশ্বতঃ। অথো য ইষুধিস্তবারে অস্মন্নি ধেহি তম্ ।। (তৈত্তিরীয়-সংহিতা-৪/৫/১)
অর্থাৎ :
হে রুদ্র, তোমার কোপকে নমস্কার করি, তোমার বাণকে নমস্কার করি এবং তোমার ধনুর্বাণ যুক্ত বাহুযুগলকে নমস্কার করি। এগুলি শত্রুর প্রতি প্রবৃত্ত হোক, আমার প্রতি নয়। হে রুদ্র, তোমার যে মঙ্গলময় ইষু আছে, তোমার যে কল্যাণপ্রদ ধনু আছে, এবং যে শান্ত ইষুধি আছে, তাদের দ্বারা আমাদের সুখী কর। হে রুদ্র, তোমার অনুগ্রহকারিণী তনু, আমাদের প্রতি যেন ঘোর রূপ না হয়। হে গিরিশ, তোমার সুখকর রূপ আমাদের কাছে প্রকাশ কর। হে গিরিশ, যে বাণ শত্রুর প্রতি নিক্ষেপের জন্য হস্তে ধারণ করেছ, হে কৈলাস-গিরির পালক রুদ্র, তোমার সে বাণ আমাদের প্রতি শান্ত কর, তোমার বাণ আমাদের পুত্রাদি ও পশুদের যেন হিংসা না করে। হে গিরিশ, তোমাকে পাবার জন্য আমরা মঙ্গলকর স্তূতিরূপ বাক্যের দ্বারা প্রার্থনা করছি, যাতে সকল মানুষ ও গব্যাদি পশু রোগরহিত হয়ে শোভন মন লাভ করে। হে রুদ্র, সকলের ভেতর আমাকে অধিক বল। তুমি দেবতাদের মধ্যে মুখ্য ও তাদের পালনে সক্ষম। ধ্যান মাত্রে সকলের রোগের উপশম কর জন্য তুমি চিকিৎসক। তুমি সর্প, ব্যাঘ্র ও রাক্ষস জাতিদের বিনাশক। আদিত্যরূপ রুদ্র উদয়কালে অত্যন্ত রক্তবর্ণ, উদয়ের পরে নানা বর্ণে অন্ধকারাদির নিবর্তক রূপে অত্যন্ত মঙ্গলরূপ রুদ্রের সহস্র সংখ্যক রশ্মি পূর্বাদি দিকে বিস্তৃত হয়েছে, সে রশ্মিরূপ রুদ্রগণের ক্রোধ-সদৃশ তীক্ষ্ণত্ব ভক্তি ও নমস্কারের দ্বারা আমরা নিবারণ করব। যে রুদ্র কালকূট বিষ ধারণে নীলগ্রীব; সে রুদ্র লোহিত বর্ণরূপে মণ্ডলবর্তী হয়ে উদয় ও অস্ত সম্পন্ন করছেন, সে রুদ্রকে গোপগণ, জল আহরণকারিণী গ্রাম্য রমণীগণ এবং গো-মহিষাদি সকল প্রাণী দর্শন করে। সকলের দর্শন দেবার জন্য রুদ্রদেব আদিত্য মূর্তি ধারণ করেছেন, তার কৈলাসবর্তী রুদ্ররূপ বেদশাস্ত্রে অভিজ্ঞজন দেখে থাকে। সে রুদ্র আমাদের দর্শন দানে সুখী করুন। সে নীলগ্রীব, সহস্রাক্ষ, বৃষ্টিকর্তা রুদ্রকে নমস্কার করছি। এ রুদ্রের দ্বারা ভৃত্য তাদের সকলকে নমস্কার করছি। হে ভগবান রুদ্র, ধনুর্ধারী তোমার ধনুর জ্যা খুলে ফেলে ও তীক্ষ্ণ বাণের ফলাগুলি ইষুধির মধ্যে রেখে আমাদের প্রতি অনুগ্রহপূর্বক শান্ত হও। (তৈত্তিরীয়-সংহিতা-৪/৫/১)
অন্যদিকে রুদ্রের শতনাম কীর্তিত শুক্লযজুর্বেদ বা বাজসনেয়ী-সংহিতার রুদ্রাধ্যায় নামক ষোড়শ অধ্যায়ে নিম্নোক্ত (১৬/১-৫) মন্ত্রে বলা হয়েছে–
নমস্তে রুদ্র মন্যব উতো ত ইষবে নমঃ। বাহুভ্যামুত তে নমঃ।। ১।। যা তে রুদ্র শিবা তনূরঘোরাহপাপকাশিনী তয়া নস্তনুবা শন্তময়া গিরিশন্তাভি চাকশীহি।। ২।। যামিষুম্ গিরিশন্ত হস্তে বিভর্ষ্যস্তবে। শিবাং গিরিত্র তাং কুরু মা হিংসীঃ পুরুষং জগৎ।। ৩।। শিবেন বচসা ত্বা গিরিশাচ্ছা বদামসি। যথা নঃ সর্ব্বমিজ্জগদযক্ষ্মং সুমনা অসৎ।। ৪।। অধ্যবোচদধিবক্তা প্রথমো দৈব্যো ভিষক্ । অহীংশ্চ সর্ব্বান্ জম্ভয়ন্ৎ সর্ব্বাশ্চ যাতুধান্যো হধরাচীঃ পরা সুব।। ৫।। (বাজসনেয়ী-সংহিতা-১৬/১-৫)
অর্থাৎ :
হে দুঃখনাশক জ্ঞানপ্রদ রুদ্র, তোমার ক্রোধের উদ্দেশে নমস্কার, তোমার বাণ ও বাহুযুগলকে নমস্কার করি। ১।। হে রুদ্র, তোমার যে মঙ্গলময়, সৌম্য, পুণ্যপ্রদ শরীর আছে, হে গিরিশ, সে সুখতম শরীরের দ্বারা আমাদের দিকে তাকাও। ২।। হে গিরিশ, শত্রুর প্রতি নিক্ষেপের জন্য তুমি হস্তে যে বাণ ধারণ করেছ, হে প্রাণিগণের ত্রাতা, তা কল্যাণকর কর, পুরুষ ও জগতের হিংসা করো না। ৩।। হে গিরিশ, মঙ্গলময় স্তুতি বাক্যে তোমায় পাবার জন্য প্রার্থনা জানাই যাতে জগতের সকলে নীরোগ ও শোভনমনস্ক হয়। ৪।। হে অধিকবদনশীল, আমায় সর্বাধিক বল, তুমি সকলের পূজ্য ও স্মরণমাত্র দেবগণের হিতকারী ভিষক। হে রুদ্র, সকল সর্প ব্যাঘ্রাদি বিনাশ করে অধোগমনশীল রাক্ষসীদের দূর করে দাও। ৫।।
বাজসনেয়ী সংহিতার শতরুদ্রীয় ১৬ অধ্যায়ের অন্য মন্ত্রগুলি বাহুল্য বিবেচনায় উদ্ধৃত করা হয়নি। তবে এই শতরুদ্রীয় অধ্যায় বর্তমান আলোচনায় গুরুত্বপূর্ণ। কেননা, পরবর্তীকালের পৌরাণিক যুগের দেহী শিবের কল্পনায় যেসব বিচিত্র পৌরাণিক কাহিনীর পরস্পর সমন্বয় ঘটেছে সেগুলির কল্পবীজ যে যজুর্বেদের এসব মন্ত্রের মধ্যে উপ্ত ছিলো তা বোধকরি বলা বাহুল্য হবে না। বেদের রুদ্র যেমন ব্যাধি, মৃত্যু ও অমঙ্গলের কারক, তাঁকে তুষ্ট করলে তিনি সেগুলির প্রতিকারও করেন। ড. উদয়চন্দ্রের ভাষ্যে–
‘রুদ্র দেবতার নামকরণ প্রসঙ্গে বেদ ও বেদাঙ্গে নানা প্রকার কল্পনা করা হয়েছে। বাজসনেয় সংহিতায় তাঁর সম্বন্ধে– ‘উচ্চৈঃ ঘোষঃ’ (১৬/১৯) শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। যাস্ক এখানে থেকেই অনুমান করেন যে গর্জনকারী হলেন রুদ্র– ‘রুদ্রো রৌরীতি সতঃ’ (নিরুক্ত ১০/৫)। বেদ ব্যাখ্যাকার সায়ণাচার্য্য অন্যভাবে রুদ্রকে ব্যাখ্যা করেছেন। তাঁর মতে যিনি অনন্তকাল সকলকে কাঁদান তিনিই রুদ্র– ‘রোদয়তি সর্বমন্তকালে ইতি রুদ্রঃ’ (১/৪৩/১ ঋক্ভাষ্য)। যিনি শত্রুদের কাঁদান তিনি রুদ্র– ‘রুৎ সংসারাখ্যং দুঃখং তং দ্রাবয়তি অপগময়তি বিনাশয়তি ইতি রুদ্রঃ’ (১/১১৪/১ ঋক্ভাষ্য)। দার্শনিক তত্ত্বের দিক থেকে রুদ্র শব্দকে নির্বাচন করার চেষ্টা সায়ণভাষ্যে পরিলক্ষিত হয়– ‘রুৎ শব্দাত্মিকা বাণী তৎপ্রতিপাদ্যা আত্মবিদ্যা বা তমুপাসকেভ্যো রাতি দদাতি ইতি রুদ্রঃ’ (১/১১৪/১ ঋক্ভাষ্য।) অর্থাৎ রুৎ শব্দের অর্থ শব্দাত্মিকা বাণী বা আত্মবিদ্যা; যিনি উপাসকদের সেই আত্মবিদ্যা দেন তিনিই রুদ্র। ঐ মন্ত্রেরই ভাষ্যে রুদ্র শব্দের আর একটি নির্বচনে বলা হয়েছে– যা আবৃত করে, সেই অন্ধকার হল রুৎ; সেই রুৎ বা অন্ধকারকে বিজারণকারী হলেন রুদ্র (রুণদ্ধি আবৃনোতি ইতি রুৎ অন্ধকারাদি। তৎ দৃণাতি বিদারয়তি ইতি রুদ্রঃ)। এই মতটি তান্ত্রিক বেদভাষ্যকার মহীধরের ভাষ্যের প্রতিধ্বনি। বাজসনেয়ী সংহিতার ১৬/১ মন্ত্রের ভাষ্যে মহীধর রুদ্র সম্পর্কে বলেছেন– ‘বরণৎ রুৎ জ্ঞানং রাতি দদাতি রুদ্রঃ। অথবা পাপিনো নরান্ দুঃখভোগেন রোদয়তি রুদ্রঃ’। রুদ্র নিজে রোদন করেন বলেই তাঁর এরূপ নামকরণ হয়েছিল বলে সায়ণ ১/১১৪/১ ঋক্-মন্ত্রের ভাষ্যে উল্লেখ করেছেন এবং সেই সংক্রান্ত একটি আখ্যায়িকার কথাও বলেছেন।’– (ভূমিকা/ লিঙ্গ পুরাণ, পৃষ্ঠা-১৪)
অথর্ববেদে রুদ্রের কয়েকটি নাম পাওয়া যায় যথা– রুদ্র, শর্ব, উগ্র, ভব, পশুপতি, মহাদেব ও ঈশান। অধ্যাপক জিতেন্দ্রনাথের বর্ণনায়–
‘প্রসঙ্গতঃ উল্লেখযোগ্য যে মহাভারতেও রুদ্র-শিব দেবতার দুই তনুর কথা একটি শ্লোকে বলা হইয়াছে– দ্বে তনূ তস্য দেবস্য ব্রাহ্মণাঃ বেদজ্ঞাঃ বিদুঃ। ঘোরামন্যাং শিবামন্যাং…। অথর্ববেদে রুদ্র দেবতার সাত মুখ্য নাম যথা– রুদ্র, শর্ব, উগ্র, ভব, পশুপতি, মহাদেব এবং ঈশান; দেবতা এই সাতটি নামে বিভিন্ন দিকের প্রাণিগণের সংরক্ষক। এখানে উল্লেখযোগ্য যে ভব নামধারী দেবতা পূর্বদিকের মধ্যভাগে স্থিত আর্যগোষ্ঠী হইতে বহিষ্কৃত ব্রাত্যদিগকে রক্ষা করিয়া থাকেন। শতপথ ব্রাহ্মণে রুদ্র ঊষাদেবীর পুত্র বলিয়া বর্ণিত হইয়াছেন এবং প্রজাপতি এক এক করিয়া তাঁহাকে আটটি নাম প্রদান করেন। অথর্ববেদোক্ত সাতটি নামের সহিত অশনি (বজ্র) নাম যোগ করিয়া তালিকার সংখ্যা পূরণ করা হইয়াছে। ইহাদিগের মধ্যে রুদ্র, শর্ব, উগ্র ও অশনি দেবতার ঘোর রূপ এবং বাকী কয়টি যথা ভব, পশুপতি, মহাদেব এবং ঈশান তাঁহার মঙ্গলময় রূপ ব্যঞ্জনা করে। শতপথ ব্রাহ্মণের কয়েকটি অংশে রুদ্রকে অগ্নির আর এক রূপ বলিয়া বর্ণনা করা হইয়াছে। পূর্বোক্ত আট নাম অগ্নির এবং এই বিভিন্ন নামে দেবতা ভিন্ন ভিন্ন দেশে পরিচিত ছিলেন। পূর্বদেশের লোকেরা তাঁহাকে শর্ব নামে এবং বাহীকেরা তাঁহাকে ভব নামে অভিহিত করিত। রুদ্র সম্বন্ধে এই সকল এবং অন্যান্য শাস্ত্রীয় প্রমাণ আলোচনা করিয়া ইহা অনুমান করা যায় যে এই দেবতার পূর্ণ রূপায়ণে বিভিন্ন সমগোষ্ঠীয় দেবসত্তার সহিত ইঁহার সংমিশ্রণ বিশেষ কার্যকরী হইয়াছিল।’– (পঞ্চোপাসনা, পৃষ্ঠা-১২৬)
‘ঐতরেয়, শতপথ, তাণ্ড্য এবং গোপথ ব্রাহ্মণে প্রজাপতির অগম্যাগমনের জন্য রুদ্রকে তাঁর শাস্তিদাতা-রূপে উল্লেখ করা হয়েছে। শাংখ্যায়ন, কৌষীতকি প্রভৃতি ব্রাহ্মণেও রুদ্রের বিভিন্ন নামের উল্লেখ আছে।’– (নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য/ ভারতীয় ধর্মের ইতিহাস, পৃষ্ঠা-১৯৯)
এক্ষেত্রে ড. উদয়চন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় লিঙ্গ পুরাণের ভূমিকায় (পৃষ্ঠা-১৪-৫) বলছেন,– ‘ঋগ্বেদে বিশেষতঃ যজুর্বেদের বাজসনেয়ী সংহিতায় রুদ্রের একটি প্রসন্ন মূর্তির পরিচয়ও পাওয়া যায়। ঋক্-সংহিতার ১/৪৩/১, ১/১১৪/৫, ২/৩৩/২, ৫/৪২/১১ ইত্যাদি মন্ত্রের বিভিন্ন বিশেষণ এক্ষেত্রে স্মরণীয়। বেদের বিভিন্ন বিশেষণ পর্য্যালোচনা করলে রুদ্রের একটি শরীরী সত্ত্বার পরিচয়ও পাওয়া যায়। ইন্দ্র, অগ্নি ইত্যাদি দেবতার সঙ্গে কোথাও কোথাও রুদ্রকে এক করে দেখাবার চেষ্টা থেকে এবং পরবর্তী পুরাণগুলিতে উল্লিখিত শিবের শতনাম, সহস্র নাম ইত্যাদি পর্যালোচনা করলে বোঝা যায় যে এই দেবতার আড়ালে অনেক লৌকিক ও বৈদিক দেবতা একাত্ম হয়ে গেছেন। এই প্রসঙ্গে স্মরণীয় যে বেদেই সহস্র সহস্র রুদ্রের কথা আমরা পাই।’
‘ঐতরেয় ব্রাহ্মণ ৩/৩/৯, শতপথ ব্রাহ্মণ ১/৭/৪/১-৪ প্রভৃতি অংশে কথিত রুদ্রোৎপত্তির কাহিনী এক্ষেত্রে স্বাভাবিক ভাবেই আমাদের স্মৃতিতে আসে। প্রজাপতি পশুরূপে নিজের কন্যাকে ধর্ষণ করলে দেবতারা রেগে গেলেন এবং তাদের সম্মিলিত ক্রোধ থেকেই রুদ্রের আবির্ভাব হল। রুদ্র বাণাঘাতে প্রজাপতিকে বধ করলেন। (পরবর্তী পুরাণগুলিতে এই কাহিনীকে একটু ভিন্ন ভাবে স্থাপন করা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে যে শিবের ক্রোধ থেকে উৎপন্ন হয়ে বীরভদ্র দক্ষ প্রজাপতিকে বধ করেছেন)। সমস্ত দেবতার তেজ থেকে সম্মিলিত ভাবেই যে কাত্যায়নী দেবীর এভাবেই উৎপত্তি ঘটেছিল তা মার্কণ্ডেয় চণ্ডীতে প্রথম অধ্যায়ে বলা আছে। গীতার একাদশ অধ্যায়ের বিশ্বরূপও সমস্ত দেবতার সম্মিলিত রূপ। এভাবেই সমস্ত দেবতাকে মিলিয়ে দিয়ে একটা বিশ্বদেব কল্পনার প্রক্রিয়া বৈদিক যুগ থেকে শুরু হয়ে পৌরাণিক যুগ হয়ে আধুনিক যুগ পর্য্যন্ত যে সক্রিয় ছিল তাতে সন্দেহ নেই।’
‘বিভিন্ন দেবতাকে একের মধ্যে মিশিয়ে দেবার প্রক্রিয়া যে কেবল মাত্র শৈব কাল্টেই ঘটেছিল এমন নয়, বৈষ্ণব ও শাক্ত কাল্টেও একই প্রকার প্রক্রিয়া আমরা প্রত্যক্ষ করি। ভয়ংকর রুদ্রের প্রসন্ন মূর্তির কথা এবং অঘোর সৌম্য তনুর কথা বাজসনেয়ী সংহিতায় আছে (১৬/২)। এখানেই রুদ্রের শিবতর রূপের কথা আছে এবং দক্ষিণ মুখের কথা আছে। রুদ্রাধ্যায়ে রুদ্রকে ‘ক্ষেম্য’ (১৬/৩৩) বা সমস্ত কুশলের মধ্যে বিদ্যমান বলা হয়েছে। রুদ্রাধ্যায়ে উক্ত ১৬/৪০ মন্ত্রের ‘তার’ নামটি সম্পর্কে ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে উবট এবং মহীধর প্রায় একই প্রকার কথা বলেছেন– সংসার থেকে তরিয়ে দেন বলেই তিনি ‘তার’। এই প্রসঙ্গেই পাঠকের তারক বা তারকেশ্বর নামটি স্মরণে আসতে পারে। রুদ্রের শিবময় তনুর অনেকগুলি রূপের কথাই বাজসনেয়ী সংহিতার নিম্নোক্ত মন্ত্রে পাওয়া যায়– ‘নমঃ শংভবায় চ ময়োভবায় চ নমঃ শংকরায় চ ময়স্করায় চ নমঃ শিবায় চ শিবতরায় চ।’ (বাজসনেয়ী-সংহিতা-১৬/৪১)
ঐতরেয় ব্রাহ্মণে– রুদ্র অত্যন্ত উগ্রস্বভাব এবং দুর্ধর্ষ, তাঁর নাম উচ্চারণ করাও বিপজ্জনক। রুদ্র কথাটা রুদ্ ধাতু থেকে নিষ্পন্ন যার অর্থ রোদন। রোদন করেন বা অন্তিমকালে রোদন করান, ভগিনী অম্বিকা তাঁর ধ্বংসকার্যের সহায়িকা। তিনি রীবগণকে ধ্বংস করেন বলে– ক্ষয়দ্বীয়। হাতে বজ্র তাই– বজ্রবাহু। এহেন মহাশক্তিমান দেবতার কোপানল থেকে বাঁচার তাগিদে মানুষ কাতর মিনতি জানাতো– তবে ভক্তিতে নয়, ভয়ে। কিন্তু মানুষের মন বুঝি এতে ভরে না। সে এই অমিত শক্তিধরকে চায়– কল্যাণসুন্দর রূপে পেতে। ফলে রুদ্র ধীরে ধীরে জনমানসে বিবর্তিত হন– মঙ্গলময় শিবে। আর পরিশেষে আশুতোষ রূপ পরিগ্রহ করেন যজুর্বেদে এসে।
রুদ্রাধ্যায়ের এ মন্ত্রে রুদ্রকে– ‘নমঃ উগ্রায় চ ভীমায় চ’, অর্থাৎ উগ্র ও ভীম এই দুই ভীষণত্ববোধক যেমন বলা হয়েছে, তেমনি আবার মঙ্গলবাচক বিশেষণে প্রণতি জানিয়ে বলা হয়েছে–
নমঃ শম্ভবায় চ ময়োভবায় চ।
নমঃ শঙ্করায় চ ময়ষ্করায় চ।
নমঃ শিবায় চ শিবতরায় চ।।
অর্থাৎ : শম্ভুকে নমস্কার, সুখভবকে নমস্কার। শঙ্করকে নমস্কার, সুখকরকে নমস্কার। শিবকে নমস্কার, শিবতরকে নমস্কার।
এখানে শম্ভব, ময়োভব, শঙ্কর, ময়ষ্কর ও শিব– প্রতিটা শব্দের একই অর্থ– কল্যাণ সুন্দর মঙ্গলময় রূপ। এ শুধু শিবই নয়। ‘শিবতর’ অর্থাৎ অধিকতার মঙ্গলদায়ক ও কল্যাণজনক।
এবং পরবর্তীতে শ্বেতাশ্বতরোপনিষদেও ঋষি প্রার্থনা করেছেন যে– রুদ্রের যে মঙ্গলময় দক্ষিণ মুখ আছে তা যেন তাঁকে নিত্য পালন করেন– ‘রুদ্র যত্তে দক্ষিণং মুখং তেন মাং পাহি নিত্যম্’ (৪/২১)।
রুদ্র শব্দটির মধ্যে যেমন ধ্বংসাত্মক তনুটির পরিচয় আছে তেমনি শিব শব্দের মধ্যে মঙ্গলময় সত্তার পরিচয় আছে। রুদ্রের বিভিন্ন রঙ ও রূপের কথা বেদ থেকেই আমরা পাই।–
‘বাজসনেয়ী সংহিতায় (১৬/৬,৭) আদিত্য রূপে রুদ্রের স্তুতি আছে। রুদ্রাধ্যায়ের মতে তিনি সহস্রাক্ষ, আদিত্য, শিপিবিষ্ট, সোম ও সূর্য। তিনি রক্তবর্ণ (১৬/৩৯), পীতবর্ণ (১৬/১৭), কপিলবর্ণ (১৬/৬)। এই স্তবেই তাঁকে নীললোহিত ও নীলগ্রীব (১৬/৭,৮) বলা হয়েছে। এই বিশেষণটিই পরবর্তী কালে সমুদ্রমন্থনে বিষ পানের ফলে শিবের নীলকণ্ঠ হবার আখ্যানের ভিত্তিভূমি হিসাবে কাজ করেছে। অনুরূপ ভাবে পশুপতি, ত্রিপুরারি (পৌরাণিক ত্রিপুর দহন বৃত্তান্ত দ্রষ্টব্য), ক্ষেত্রপতি (মঙ্গলকাব্যে চাষী শিবের বৃত্তান্ত দ্রষ্টব্য) ইত্যাদি বৈদিক বিশেষণগুলিও পুরাণের গল্পে পল্লবিত হয়ে শৈব পুরাণগুলিতে নতুন মাত্রা এনেছে। এইসব কারণের জন্যই প্রাচীন পুরাণ পরম্পরা বলেছে– ‘ইতিহাস-পুরাণাভ্যাম্ বেদম্ সমুপবৃংহয়েত্’। রুদ্রাধ্যায়ে উক্ত (১৬/১৮) ‘অন্নানাং পতি’ বিশেষণ থেকেই অন্নপূর্ণাপতি শিবের উৎপত্তি বলে অনেকে মনে করেছেন।’– (ড. উদয়চন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়/ ভূমিকা, লিঙ্গ পুরাণ, পৃষ্ঠা-১৬)
এখানে উল্লেখ্য,– ‘যজুর্বেদের কালে রুদ্র কেবল দ্বিজাতির বা আর্যদেরই দেবতা ছিলেন তা নয়; এই সময় তিনি অনার্য জাতির অন্ত্যজ জাতিরও দেবতা ছিলেন। তাই এই (রুদ্রাধ্যায়) সূক্তে অনেক অনার্য জাতি, অন্ত্যজ ও নীচ বর্ণের উল্লেখ পাওয়া যায়। তাই ঐতিহাসিক তথ্যের দিক দিয়ে এই অধ্যায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অনার্য জাতি, দস্যু, পার্বত্য জাতি ও অন্ত্যজ জাতির উপাস্য ও পালক বলে উল্লেখ থাকায় অধিকাংশ পণ্ডিতজন মনে করেন– রুদ্র প্রথমে অনার্য আদিবাসীদের উপাস্য দেবতা ছিলেন; পরবর্তীকালে আর্যরা তাদের থেকে এই দেবতাকে উপাস্যরূপে গ্রহণ করতে দ্বিধান্বিত ছিলেন বলেই ঋগ্বেদ সংহিতায় রুদ্র ছিলেন অন্ত্যজ দেবতা। এরপর আর্য-অনার্য সংস্কৃতির সংমিশ্রণ ও সংশ্লেষণের ফলে অনার্য প্রভাবে প্রভাবিত হয়ে এই দেবতাকে তাঁরা সম্পূর্ণরূপে গ্রহণ করেন– সর্বপূজ্য কল্যাণসুন্দর রূপে। আর এই যজুর্বেদের কালেই তিনি পরমাত্মায় পর্যবসিত হন। কারণ এই সময়ে তিনি শুধুমাত্র সাধু-সজ্জনদেরই আরাধ্য দেবতা ছিলেন তা নয়। তিনি একই সাথে অসাধু, চোর, দস্যু, গাঁটকাটা সিধেল চোর, সশস্ত্র চোর, নিশাচর দস্যু, মানুষ মারা দস্যু, উষ্ণীষধারী দস্যু (পাগড়ি পরা ডাকাত), পার্বত্য দস্যু, ধনুর্বাণধারী দস্যু ও শস্য অপহরণকারী দস্যুদেরও উপাস্য দেবতা ছিলেন। এ ছাড়াও তিনি ছুতোর, কামার, কুমোর, নিষাদ, যাযাবর, বেদে, ব্যাধ ইত্যাদিদেরও দেবতা ও পালক রূপে পূজিত ছিলেন। এমনকী তিনি গো, অশ্ব, কুকুর ইত্যাদি সমস্ত গৃহপালিত পশুদেরও পতি বা পালকরূপে পরিচিত– পশুপতি।’– (অশোক রায়, বিবর্তনের ধারায় শিব ও শিবলিঙ্গ, পৃষ্ঠা-১৩৯)
এভাবেই যজুর্বেদ সংহিতায় রুদ্র সগুণ দেবতার লক্ষণ অতিক্রম করে সর্বপূজ্য নির্গুণ পরমেশ্বরে পর্যবসিত হয়েছেন, যেখানে সমস্ত বিরোধের অবসান, সমস্ত দ্বন্দ্বের ঐক্যসমাবেশ, সমস্ত বৈপরীত্যের সমন্বয়। এই রুদ্রাধ্যায়েই তিনি যাবতীয় দার্শনিক রুপ-লক্ষণ, লাঞ্ছন চিহ্ন ও বিবিধ নামরূপে স্তুত হয়ে পরমেশ্বরে পর্যবসিত হলেন।
‘শুক্ল যজুর্বেদ সংহিতা কাব্য হিসাবেও অপূর্ব। রুদ্রাধ্যায় থেকে বহু দৃষ্টান্তই দেওয়া যায়। এই অধ্যায়ে রুদ্র দেব পশুপতি, শম্ভু, শিব, শংকর, কৃত্তিবাস, গিরিশ, ক্ষিতিকণ্ঠ, নীলগ্রীব, কপর্দী ইত্যাদি নামে স্তুত হয়েছেন। ঋগ্বেদের রুদ্র কেবল বজ্রের দেবতা, কিন্তু যজুর্বেদে তিনি কেবলমাত্র বজ্রই নন সূর্যের সাথেও তাঁর অভিন্নতা দেখানো হয়েছে। তাই সূর্যের উদয় থেকে অস্তকালীন অবস্থার মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন রূপ অনুযায়ী রুদ্রের এক একটা নাম হয়েছে। উদয় ও অস্তের সময় সূর্যের সহস্র সহস্র রশ্মি বা কিরণ সুস্পষ্টভাবে দেখা যায়; তাই ঋষি কল্পনায় সূর্যের বিম্বটি মস্তকসদৃশ। আর তার চতুর্দিকে প্রসারিত কিরণমালা– দীর্ঘ জটাজুট সদৃশ। তাই জটার প্রতিশব্দ (কপর্দ) অনুযায়ী রুদ্র হলেন– কপর্দী (রুদ্রাধ্যায় ষষ্ঠ মন্ত্র)। সপ্তম মন্ত্রে তিনি নীলকণ্ঠ। যা অস্তগামী সূর্যের রূপ থেকে এসেছে। ঋষি কবি বলছেন– ‘আদিত্যদেব যখন অস্তাচলে গমন করেন তখন গগনমণ্ডল রঙের মহোৎসবে মাতিয়া ওঠে। স্বর্ণবর্ণ সূর্যবিম্বের চতুর্দিকে বিচ্ছুরিত গাঢ় সিন্দুরবর্ণে পশ্চিমগগন রক্তিম রাগে রঞ্জিত হয়, কেবল সূর্যবিম্বের মধ্যস্থলে নীল বর্ণ রেখা দৃষ্ট হয়।’ এই মধ্যস্থলই কবি কল্পনায় কণ্ঠদেশ, আর সেই কণ্ঠদেশে নীল রং দেখায় বলেই ওই অবস্থায় সূর্যের নাম– নীলকণ্ঠ বা নীলগ্রীব। তাই ঋষি কবি বন্দনাগীত গাইছেন– ‘ওই যে নীলকণ্ঠ রক্তিমবর্ণ সূর্যরূপী রুদ্রদেব গগনপটে ধীরে ধীরে গমন করিতেছেন, তাঁহার অপরূপ রূপে আকৃষ্ট হইয়া গোধূলি লগ্নে মাঠ হইতে গোরুর পাল লইয়া গোষ্ঠে প্রত্যাবর্তন কালে মুগ্ধ হইয়া গোপালেরা তাঁহাকে দর্শন করে। গ্রামের ললনাবৃন্দ সায়ংকালে সরোবরের জল লইতে আসিয়া মুগ্ধ হইয়া রুদ্রের এই অতুলনীয় রূপ দেখিতে থাকে।’– (অশোক রায়, বিবর্তনের ধারায় শিব ও শিবলিঙ্গ)
যজুর্বেদের দুই শাখা– কৃষ্ণ যজুর্বেদ বা তৈত্তিরীয় সংহিতা এবং শুক্ল যজুর্বেদ বা বাজসনেয়ী সংহিতা। কৃষ্ণ যজুর্বেদের পঠন-পাঠন প্রচলন ও চর্চা সাধারণভাবে দেখা যায় দাক্ষিণাত্যে, আর শুক্ল যজুর্বেদের চর্চা সমগ্র আর্যাবর্ত জুড়েই (উত্তর, পূর্ব ও পশ্চিম ভারতে)। বাংলাদেশের অধিকাংশ যজুর্বেদীয় ব্রাহ্মণই শুক্ল যজুর্বেদীয় গোষ্ঠীর।
অথর্ববেদের যুগ বা তার আগে থেকেই রুদ্র শিবের সঙ্গে মহাকাল সংক্রান্ত একটা ধারা মিশতে থাকে বলে বেদজ্ঞ পণ্ডিতেরা মনে করেন। রুদ্রকে সৃষ্টি ও সংহারের দেবতা বলা হয়েছে। অথর্ববেদের কালসূক্তে (উনবিংশ কাণ্ডের ষষ্ঠ অনুবাকের অষ্টম ও নবম সূক্ত) আমরা কালের স্রষ্টা রূপের পরিচয় পাই। কালেই সব কিছু উৎপন্ন হয়, আবার কালেই সব বিলীন হয়। যেমন–
স এব সং ভুবনান্যাভরৎ স এব সং ভুবনানি পর্যৈৎ। পিতা সন্নভবৎ পুত্র এষাং তস্মাৎ বৈ নান্যৎ পরমস্তি তেজঃ।। ৪।। কালোহমূং দিবমজনয়ৎ কাল ইমাঃ পৃথিবীরুত। কালে হ ভূতং ভব্যং চেষিতং হ বি তিষ্ঠতে।। ৫।। কালো ভূতিমসৃজত কালে তপতি সূর্যঃ। কালে হ বিশ্বা ভূতানি কালে চক্ষুর্বি পশ্যতি।। ৬।। কালে মনঃ কালে প্রাণঃ কালে নাম সমাহিতম্ । কালেন সর্বা নন্দন্ত্যাগতেন প্রজা ইমাঃ।। ৭।। তেনেষিতং তেন জাতং তদু তস্মিন্ প্রতিষ্ঠিতম্ । কালো হ ব্রহ্ম ভূত্বা বিভর্তি পরমেষ্ঠিনম্ ।। ৯।। কালঃ প্রজা অসৃজত কালো অগ্রে প্রজাপতিম্ । স্বয়ম্ভুঃ কশ্যপঃ কালাৎ তপঃ কালাদজায়ত।। ১০।। (অথর্ববেদ-১৯/৬/৮/৪,৫,৬,৭,৯,১০)
অর্থাৎ :
সে কালই এ চরাচর সর্ববস্তু উৎপন্ন করেছে (অথবা নিজের উৎপাদিত সকল প্রাণীকে তিনিই সর্বতোভাবে পোষণ করেন)। সে কালই সমস্ত ভুবন ব্যাপ্ত করেছে। সে কালই এ ভুবনের জনক হয়ে পুত্ররূপে অবস্থান করছে। সে সকলের উৎপাদক সর্বগত কাল ছাড়া অন্য উৎকৃষ্ট তেজ আর নেই। ৪।। কালরূপ পরমাত্মা ঐ দ্যুলোক সৃষ্টি করেছেন এবং তিনিই এ পরিদৃশ্যমান পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন। কালই ভূত, ভবিষ্যৎ ও বর্তমান কালাবচ্ছিন্ন জগৎ আশ্রয় করে আছে। ৫।। কালরূপ পরমাত্মা এ জগৎ সৃষ্টি করেছেন। কালের প্রেরণায় সূর্য তাপ দেয় অর্থাৎ জগৎ প্রকাশ করে। কালের আশ্রয়ে সকল বিশ্ব অবস্থান করছে। কালে চক্ষুরাদি ইন্দ্রিয় দর্শন করে (অথবা কালেই চক্ষুষ্মান সর্বেন্দ্রিয়ের অধিষ্ঠাতা স্ব স্ব ইন্দ্রিয়ের ব্যাপার করে থাকে)। ৬।। সে কালরূপ পরমাত্মায় জগৎ সৃষ্টির কারণ-রূপ মন অবস্থান করছে। তাতেই সকল জগতের অন্তর্যামী সূত্রাত্মা প্রাণ অবস্থান করছে। অথবা সকল প্রাণীর মন, প্রাণ, নাম সেই কাল-স্বরূপে অবস্থান করছে। বসন্তাদি রূপে আগত সে কালের দ্বারা সকল প্রজাগণ (সৃষ্টি পদার্থ) নিজ নিজ কার্যসিদ্ধির জন্য তুষ্ট হচ্ছে। ৭।। সে কালরূপ পরমাত্মা সমস্ত স্রষ্টব্য জগতের কামনা করেছিলেন। তাঁর সৃষ্ট এ জগৎ সে কালেই প্রতিষ্ঠিত। সে কালই দেশকালাবচ্ছিন্ন সচ্চিৎ সুখাত্মক পরমার্থতত্ত্ব ব্রহ্মরূপে পরমেষ্ঠীকে (পরম স্থান সত্যলোকে স্থিত চতুর্মুখ ব্রহ্মাকে) পালন করেন। ৯।। কালরূপ পরমাত্মাই সৃষ্টির আদিতে প্রজাপতি ব্রহ্মাকে উৎপন্ন করেছিলেন। সে কালই প্রজা সৃষ্টি করেন। স্বয়ম্ভূ কশ্যপ সকলের দ্রষ্টা অষ্টম সূর্য এবং তার সন্তাপক তেজ সে কাল থেকে উৎপন্ন হয়েছে। ১০।।
এবং–
কালাদাপঃ সমভবন্ কালাৎ ব্রহ্ম তপো দিশঃ। কালেনোদেতি সূর্যঃ কালে নি বিশতে পুনঃ।। ১।। কালেন বাতঃ পবতে কালেন পৃথিবী মহী। দৌর্মহী কাল আহিতা।। ২।। কালো হ ভূতং ভব্যং চ পুত্রো অজনয়ৎ পুরা। কালাদৃচঃ সমভবন্ যজুঃ কালদজায়ত।। ৩।। কালো যজ্ঞং সমৈরয়দ্দেবেভ্যো ভাগমক্ষিতম্ । কালে গন্ধর্বাপ্সরসঃ কালে লোকাঃ প্রতিষ্ঠিতঃ।। ৪।। কালেহয়মঙ্গিরা দেবোহথর্বা চাধি তিষ্ঠতঃ। ইমং চ লোকং পরমং চ লোকং পুণ্যাংশ্চ লোকান্ বিধৃতীশ্চ পুণ্যাঃ। সর্বাংল্লোকানভিজিত্য ব্রহ্মণা কালঃ স ঈয়তে পরমো নু দেবঃ।। ৫।। –(অথর্ববেদ-১৯/৬/৯/১-৫)
অর্থাৎ :
সর্বজগৎকারণ পরমাত্মা থেকে ব্রহ্মাণ্ডের আধাররূপ জল উৎপন্ন হয়েছিল। সেরূপ সে কাল থেকে যজ্ঞাদি কর্ম, কৃচ্ছ্র চান্দ্রায়ণাদি তপস্যা ও পূর্বাদি দিকসকল উৎপন্ন হয়েছিল। প্রেরক কালের দ্বারা সূর্য উদয় লাভ করে এবং আবার কালে বিলীন হয় অর্থাৎ অস্তাগমন করে। ১।। কালরূপ পরমাত্মার প্রেরণায় বায়ু প্রবাহিত হয়, তার দ্বারাই মহতী পৃথিবী দৃঢ়রূপে স্থাপিত হয়েছে এবং মহান দ্যুলোক কালরূপ আধারে নিহত আছে। কালরূপ পরমাত্মা থেকে ঋক্, যজুঃ ও সামমন্ত্রগুলি উৎপন্ন হয়েছে। ২-৩।। কালই ইন্দ্রাদি দেবগণের জন্য অক্ষয় ভাগরূপে যজ্ঞ (প্রকৃতি-বিকৃতিরূপ সোমযাগ) উৎপন্ন করিয়েছিলেন। বাক্যের ধারক (গায়ক) গন্ধর্বগণ ও অন্তরিক্ষচারিণী অপ্সরাগণ কালাধারে অবস্থান করছে। সমস্ত লোকই (সর্বজগৎ ও তদধিবাসী প্রাণিগণ) কালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ৪।। অথর্ববেদ-স্রষ্টা দীপ্যমান পরমাত্মার অঙ্গোদ্ভূত অঙ্গিরা দেব এবং অথর্বা দেব স্বজনক কালেই অবস্থান করছে। ভূলোক, স্বর্গলোক, পুণ্যলোক ও দুঃখরহিত অন্য সকল লোক, স্বকারণ, দেশকালাদির দ্বারা অপরিচ্ছিন্ন সত্যজ্ঞানানন্তাদিরূপ পরমাত্মার দ্বারা ব্যাপ্ত করে, (এ সূক্তদ্বয় প্রতিপাদ্য) পরম কাল-দেব সকল স্থাবর জঙ্গমাত্মক জগৎ ব্যেপে অবস্থান করছেন। ৫।।
এ-প্রেক্ষিতে ড. উদয়চন্দ্র বলেন,– ‘বেদের এই মহাকাল তত্ত্বের দ্বারা প্রভাবিত হয়েই মহাভারতকার শিব সম্পর্কে বললেন– ‘সকালঃ সোহন্তকঃ মৃত্যুঃ স যমঃ’ (৭/২০১/২০৪)। মহানির্বাণ তন্ত্রেও আদ্যাকালীকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে মহাকাল শব্দের এই প্রকার ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে–
‘কলনাৎ সর্বভূতানাং মহাকালঃ প্রকীর্ত্তিতঃ।
মহাকালস্য কলনাৎ তমাদ্যা কালিকা পরা।।’
বেদ ও মহাভারতের সঙ্গে তন্ত্র বা শৈবাগমের মহাকালের হয়তো রূপগত পার্থক্য আছে, হয়তো আর্যেতর কোনো জনের দেবভাবনা থেকে শৈবাগমের কালচিন্তা আসতে পারে, তবে তার ওপর বৈদিক চিন্তার অভিষেক ঘটেনি এমত মনে হয় না।’
বেদ-সংহিতার যুগ অর্থাৎ ঋগ্বেদ-যজুর্বেদ-অথর্ববেদ হয়ে রুদ্রের এই ক্রমবিবর্তিত ধারায় ব্রাহ্মণ-আরণ্যক-উপনিষদের যুগে এসে রুদ্রের অন্যতম নাম মহাদেব হিসেবে বৈদিক দেবগণের মধ্যে হয়তো তাঁর প্রধানতম স্থান সম্বন্ধে ইঙ্গিত প্রদান করে। যেমন, শ্বেতাশ্বতর উপনিষদের চতুর্থ অধ্যায়ের দশম শ্লোকে তাঁকে মহেশ্বর নামে অভিহিত করে বলা হয়েছে– তিনি প্রকৃতি রূপ মায়ার অধীশ্বর এবং এই বিশ্বভুবন তাঁরই বিভিন্ন রূপ বা অবয়বের দ্বারা পরিব্যাপ্ত–
মায়াং তু প্রকৃতিং বিদ্যান্মায়িনং চ মহেশ্বরম্ ।
তস্যাবয়বভূতৈস্তু ব্যাপ্তং সর্বমিদং জগৎ।। (শ্বেতাশ্বতর-৪/১০)
অর্থাৎ : প্রকৃতিকে মায়া বলে এবং মহেশ্বরকে মায়াধীশ বলে জানবে। এই বিশ্বচরাচর মহেশ্বরের দেহ।
বস্তুত, ইতোমধ্যে আমরা যা লক্ষ্য করেছি, রুদ্র ভাবনা ক্রমে একটা বিশাল ব্রহ্ম ভাবনার দিকে অগ্রসর হচ্ছিলো। অথর্বের ব্রাত্য ধারার মধ্যে দিয়ে উপনিষদে এসে এই ভাবনা পরিপূর্ণভাবে ব্রহ্মবাদে বিলীন হয়। শৈব বেদপন্থী টীকাকারেরা এই ধারার দ্বারা বহুল পরিমাণে প্রভাবিত হয়েছিলেন। তবে– আরেকটি ধারা– বেদবিরোধী শৈব ধারার চলার পথ আবার ভিন্ন।
বস্তুত শ্বেতাশ্বতর উপনিষদে দেবতা রুদ্র ক্রমশ সর্বপ্রধান দেবতা, এবং একেশ্বর হিসেবে কীর্তিত হতে দেখা যায়। আমরা দেখতে পাই, শ্বেতাশ্বতরোপনিষদে রুদ্রশিব ও ব্রহ্ম এক পর্যায়ে চলে গেছেন। ঋষি বলছেন–
অজাত ইত্যেবং কশ্চিদ্ভীরুঃ প্রপদ্যতে।
রুদ্র যত্তে দক্ষিণং মুখং তেন মাং পাহি নিত্যম্ ।। (শ্বেতশ্বতর-৪/২১)
অর্থাৎ : হে রুদ্র, তুমি মৃত্যুঞ্জয়। যে জন্মাদি মৃত্যুভয়ে ভীত সেই তোমার শরণ নেয়। তোমার প্রসন্ন মুখ আমার দিকে ফেরাও এবং নিয়ত আমাকে রক্ষা কর।
উপনিষদকারের মতে একমাত্র ঈশ্বর ভগবান রুদ্র ব্যতীত আর কেউ নন। যজুর্বেদের বাজসনেয়ী সংহিতার ১৬/২,৩ ইত্যাদি মন্ত্রকে এখানে শ্বেতাশ্বতরে ৩/৫,৬ মন্ত্ররূপে ব্রহ্মপরত্বে ব্যবহৃত হতে দেখা যায়। বেদান্ত মতে ব্রহ্মই যেমন এক এবং সত্য, তেমনি শ্বেতাশ্বতরের মতে রুদ্রই হলেন একতম। এক ও অদ্বিতীয় রুদ্র স্ব-শক্তির সাহায্যে বিশ্ব চরাচর নিয়ন্ত্রিত করেন, তিনি স্রষ্টা, পালনকর্তা এবং সংহারকর্তা,– প্রলয়কালে তাঁর মধ্যেই সমস্ত ভুবন আশ্রয় গ্রহণ করে। যেমন–
একো হি রুদ্রো ন দ্বিতীয়ায় তস্থূঃ য ইমান্ লোকান্ ঈশত ঈশনীভিঃ।
প্রত্যক্ জনান্ তিষ্ঠতে সঞ্চুকোপান্তকালে সংসৃজ্য বিশ্বাঃ ভুবনানি গোপাঃ।। (শ্বেতাশ্বতর-৩/২)
অর্থাৎ : এক সেই পরমেশ্বর কে, যাঁর দ্বিতীয় কেউ নেই ? তিনি হলেন রুদ্র। প্রতি জীব-হৃদয়ে তাঁর অবস্থান– তাই পরমাত্মা। তিনিই তাঁর সেই ঐশ্বরিক শক্তি-বুদ্ধি দিয়ে জগৎকে শাসন করছেন। সেই শক্তির কোন ব্যাখ্যা চলে না। ব্রহ্মাণ্ডকে সৃষ্টি করে প্রতিটি মানুষের অন্তরে তিনি অবস্থান করছেন, আবার গোপা অর্থাৎ রক্ষাও করছেন। আবার অন্তিমকালে এলে সংহার-মূর্তিতে তিনিই সব সংহার করছেন।
এখানে উল্লেখ্য, যোগী সম্প্রদায়ের শ্বেতাশ্বতর ঋষির দ্বারা রচিত এই উপনিষদটি উপনিষদ্ ভাগের শেষ পর্বের রচনা। পুরাণবর্ণিত কল্প ও কল্পযুগের কথা যেমন এখানে আছে, তেমনি যোগাচারের ও যোগসিদ্ধির প্রথমাবস্থার কথাও এখানে বলা হয়েছে। লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো, ব্রহ্মের রূপ হিসেবে রুদ্রকে এখানে দেখানো হলেও ‘শিব’ শব্দটি তখনো (শ্বেতাশ্বতর রচনাকালে) রুদ্রের নামে পর্যবসিত হয়নি, তা বরাবরই বিশেষণ রূপে ব্যবহৃত হয়েছে। শ্বেতাশ্বতরে রুদ্রকে নানা নামে অভিহিত করা হয়েছে, যেমন মহাদেব, মহর্ষি, ভগবান, ঈশ, ঈশান এবং শিব। তবে শেষোক্ত নামটি (শিব) রুদ্রের উপাধি বা বিশেষণ হিসেবেই মাত্র কয়েকটি স্থলে উল্লিখিত হয়েছে বলে মনে হয়। যেমন–
সর্বাননশিরোগ্রীবঃ সর্বভূতগুহাশয়ঃ।
সর্বব্যাপী স ভগবান্ তস্মাৎ সর্বগতঃ শিবঃ।। (শ্বেতাশ্বতর-৩/১১)
অর্থাৎ : তিনি সর্বানন– জগতের সব মুখই তাঁর মুখ। জগতের প্রাণীমাত্রেরই মাথা, গলা– তাঁরই শির-গ্রীবা। প্রাণীর ভেতরে সেই গুহা, যার নাম বুদ্ধি, তিনি আছেন সেই গুহায়। সর্বব্যাপী এবং সর্বগত শিবস্বরূপ মঙ্গলময় তিনি ভগবান।
.
ঘৃতাৎ পরং মন্ডমিবাতিসূক্ষ্মং জ্ঞাত্বা শিবং সর্বভূতেষু গূঢ়ম্ ।
বিশ্বস্যৈকং পরিবেষ্টিতারং জ্ঞাত্বা দেবং মুচ্যতে সর্বপাশৈঃ।। (শ্বেতাশ্বতর-৪/১৬)
অর্থাৎ : ঘিয়ের উপর হালকা সরের মতো একটা সারবস্তু ভেসে থাকে। ঈশ্বর সেই অতি সূক্ষ্ম সারবস্তুর মতো, যিনি বিশ্বের একমাত্র কর্তা, যিনি প্রতিটি জীবকে তার কর্ম অনুসারে প্রাপ্য ফল দান করেন। অন্তরাত্মা হয়ে এই পরমেশ্বর সকলের মধ্যেই লুকিয়ে আছেন। তিনিই করুণাঘন পরমেশ্বর শিব। সেই পরমেশ্বরকে জানতে পারলে সমস্ত বন্ধন থেকে মুক্ত হওয়া যায়।
.
ভাবগ্রাহ্যমনীড়াখ্যং ভাবাভাবকরং শিবম্ ।
কলাসর্গকরং দেবং যে বিদুস্তে জহুস্তনুম্ ।। (শ্বেতাশ্বতর-৫/১৪)
অর্থাৎ : ভাব-গ্রাহ্য তিনি, খ্যাত তিনি অশরীরী বলে; সৃষ্টি-লয়ের কারণ যিনি পঞ্চপ্রাণ দশ-ইন্দ্রিয় এবং মন নিয়ে ষোড়শ কলার স্রষ্টা, সেই মঙ্গলময় (শিব) দেবকে যাঁরা জানেন, তাদের আর দেহাভিমান থাকে না– দেহত্যাগের পর আর দেহও ধারণ করতে হয় না।
শ্বেতাশ্বতর উপনিষদে রুদ্র এমন ভাবে বর্ণিত হয়েছে যাতে তিনি যে উপনিষদকারের ভক্তি ও পূজার পাত্র ছিলেন তা অনুমান করা যায়। এতে ব্যক্তিত্বব্যঞ্জক একেশ্বরবাদ এবং প্রাচীনতর গদ্য উপনিষদগুলির নৈর্ব্যক্তিক ব্রহ্মবাদ একত্র মিলিত হলেও, ঈশ্বরবাদেরই প্রাধান্য সূচিত হয়েছে। ড. উদয়চন্দ্রের বক্তব্য অনুযায়ী, পাতঞ্জল যোগের সঙ্গে কয়েকটি ক্ষেত্রে মিল থাকায় আধুনিক পণ্ডিতেরা শৈব মতাবলম্বী এই শ্বেতাশ্বতর উপনিষদকে যোগোপনিষদ্গুলির আদি গ্রন্থ বলে অনুমান করেন। তিনি আরও বলেন, রুদ্রকে নিয়ে ব্রহ্মভাবনা শ্বেতাশ্বতরেতে ব্যাপক রূপ নিলেও তৈত্তিরীয় আরণ্যক থেকেই এর একটা সূত্র পাওয়া যায় (তৈ. আ. ১০/১৬)। সেখানে রুদ্রকে সর্বভূতাত্মা, বিশ্বাত্মক ও বিশ্বোত্তীর্ণ বলা হয়েছে। বায়বীয় সংহিতার (৪/৭০-১৪১) বিভিন্ন অংশের সঙ্গে শ্বেতাশ্বতরের প্রচণ্ড মিল। শ্বেতাশ্বতরকে সামান্য উল্টেপাল্টে এগুলি লেখা।
অধ্যাপক জিতেন্দ্রনাথের ভাষ্যে, এভাবেই ক্রমশ শিব নামের গুরুত্ব বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং আর্যেতর জাতির দ্বারা পূজিত অনুরূপ দেবতার যখন বৈদিক রুদ্রের সাথে মিলন ঘটে তখন মিশ্র দেবতা শিব নামেই পরিচিত হন।
শ্বেতাশ্বতর উপনিষদে রুদ্র শিবকে কেন্দ্র করে যে একেশ্বরবাদী প্রবণতা দেখা যায়, তার চূড়ান্ত বিকাশ ঘটেছে অনেক পরবর্তীকালে রচিত অথর্বাশিরস্ উপনিষদে।–
‘ইহাতেই সাম্প্রদায়িকতাপূর্ণ রুদ্র-শিব উপাসনার অন্যতম প্রথম পরিচয় পাওয়া যায়। এখানে রুদ্র বিভিন্ন বৈদিক দেবতা, যথা ব্রহ্মা প্রজাপতি, অগ্নি, ইন্দ্র, সোম, বরুণ প্রভৃতির সহিত একাত্মীভূত হইয়াছেন ত বটেই, সঙ্গে সঙ্গে কয়েকটি পৌরাণিক দেবতা, যথা স্কন্দ, বিনায়ক, উমা (কেনোপনিষদে উমার নাম প্রথম পাওয়া গেলেও প্রকৃতপক্ষে তিনি মহাকাব্য ও পুরাণের যুগেই প্রতিষ্ঠা লাভ করিয়াছিলেন) প্রভৃতিও তাঁহার ভিন্ন ভিন্ন প্রকাশ বলিয়া গৃহীত হইয়াছেন। গ্রন্থকারের মতে সপ্ত লোক, পঞ্চ মহাভূত, অষ্ট গ্রহ (তথাকথিত গ্রহের সংখ্যা আদিতে আট, পরে কেতু এই সংখ্যায় যুক্ত হইলে নব গ্রহ পূরণ হয়), কাল, অমৃত প্রভৃতি সবই ইঁহার বিভিন্ন রূপ। তিনি বিশ্বস্রষ্টা ও জগৎপিতা এবং সংহারকর্তা। তাঁহার এই রূপ কল্পনায় সুস্পষ্টভাবে সাম্প্রদায়িকতার প্রকাশ দেখা না যাইলেও রুদ্রোপাসকদিগের এক বিশেষ ব্রতের কথা এখানে বলা হইয়াছে। ইহার নাম পাশুপত ব্রত, এবং এই ব্রতের অনুষ্ঠানে ‘অগ্নিরিতি ভস্য বায়ুরিতিভস্ম জলমিতি ভস্ম স্থলমিতি ভস্ম ব্যোম ইতি ভস্ম সর্বংহ বৈ ইদং ভস্ম মনঃ এতানি চক্ষুংষি ভস্মানি’ মন্ত্র পাঠ করিয়া উপাসক তাঁহার সর্বাঙ্গে ভস্ম স্পর্শ করাইতেন। এই ব্রত পালনের ফলে উপাসক পশুপাশ হইতে মুক্ত হইতেন (পশুপাশবিমোক্ষণ) এবং ঐশী শক্তির অধিকারী হইতেন।’– (জিতেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়/ পঞ্চোপাসনা, পৃষ্ঠা-১২৯)
বলা বাহুল্য, শৈব ধর্ম-সম্প্রদায়গুলির প্রধান দেবতা শিবের আদিম রূপ সম্বন্ধে অনুসন্ধান করলে বুঝা যায় যে তা মূলত এক কাল্পনিক দেবসত্তাকে অবলম্বন করেই বিকশিত হয়েছিল। কিন্তু কিভাবে লিঙ্গ ও যোনি প্রতীক পূজা শিবের সঙ্গে সম্পর্কিত ছিলো তার ইঙ্গিত শ্বেতাশ্বতর উপনিষদে পাওয়া যায় বলে কেউ কেউ (রামকৃষ্ণ গোপাল ভান্ডারকর মহাশয়) মনে করেন। যেমন শ্বেতাশ্বতরে বলা হয়েছে–
যো যোনিং যোনিমধিতিষ্ঠত্যেকো যস্মিন্নিদং সং চ বি চৈতি সর্বম্ ।
তমীশানং বরদং দেবমীড্যং নিচায্যেমাং শান্তিমত্যন্তমেতি।। (শ্বেতাশ্বতর-৪/১১)
অর্থাৎ : প্রকৃতি, আকাশ ইত্যাদি সবকিছু যে কারণ (যোনি) থেকে উৎপন্ন হয়েছে, আবার প্রলয়ের সময় যে কারণে বিলীন হয়ে যাচ্ছে, সেই কারণেরও কারণ হলেন মায়ার অতীত পরমানন্দময় এক অদ্বিতীয় পরমেশ্বর। সেই নিয়ন্তা, বরদা, পূজ্য দেবতাকে নিশ্চিতভাবে যে সাধক উপলব্ধি করেছেন, মনের চোখ দিয়ে হৃদয়-আকাশে দেখেছেন তিনি চিরশান্তি লাভ করেছেন।
.
যো যোনিং যোনিমধিতিষ্ঠ্যত্যেকো বিশ্বানি রূপাণি যোনীশ্চ সর্বাঃ।
ঋষিং প্রসূতং কপিলং যস্তমগ্রে জ্ঞানৈর্বিভর্তি জায়মানং চ পশ্যেৎ।। (শ্বেতাশ্বতর-৫/২)
অর্থাৎ : যিনি এক হয়েও বিশ্বের যোনিতে-যোনিতে অর্থাৎ প্রতিটি বস্তুতে, সমস্ত রূপে, সমস্ত উপাদানে বা উৎপত্তির কারণে কারণ হয়ে আছে, যিনি সৃষ্টির বা কল্পের শুরুতে সর্বজ্ঞ ঋষি কপিলকে উৎপন্ন করে ধর্ম, জ্ঞান, ঐশ্বর্য দিয়ে পরিপূর্ণ করেছিলেন এবং তাঁর জন্ম-মুহূর্তটিকেও দেখেছিলেন, তিনি জীব বা জীবাত্মা নন– পরমাত্মা, পরমেশ্বর।
এখানে কৌতুহলের বিষয় হলো, উপনিষদ ঋষি বলছেন, সৃষ্টির প্রাক্কালে তিনি জ্ঞানগর্ভ কপিলকে উৎপন্ন করলেন। শ্রীমদ্ভগবদ্গীতায়ও ভগবান বলেছেন, ঋষিদের মধ্যে কপিল এবং দর্শনের মধ্যে আমি সাংখ্য। তাহলে কি বুঝতে হবে যে, জগৎস্রষ্টা পরমেশ্বরের প্রথম সৃষ্টি সাংখ্যদর্শনের দ্রষ্টা ভগবান কপিল মুনি? আবার এই শ্বেতাশ্বতর উপনিষদেই অন্যত্র বলা হয়েছে– তাঁর প্রথম সৃষ্টি হিরণ্যগর্ভ। তাহলে কি কপিল বলতে হিরণ্যগর্ভকেই বোঝানো হয়েছে? পণ্ডিতদের মতে এখানে কপিল মুনি নন, স্বয়ং কনকবর্ণ হিরণ্যগর্ভ ব্রহ্মাকেই বোঝানো হয়েছে। সে যাক, তবে অধ্যাপক জিতেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে–
‘এই দুটি শ্লোকেরই প্রথম চরণে ঈশান (শিব) দেবতাকে প্রতি যোনিতে অধিষ্ঠিত থাকিবার বর্ণনা দেখিয়া ভান্ডারকরের মনে এইরূপ সংশয় জাগিয়াছিল। কিন্তু এখানে যোনি যে স্ত্রীচিহ্ন অর্থে ব্যবহৃত না হইয়া মূল কারণ বীজ অর্থেই ব্যবহৃত হইয়াছে সে বিষয়ে নিঃসন্দেহ হওয়া যায়। প্রত্নতত্ত্বমূলক প্রমাণও আমাদের এই উক্তি সমর্থন করে। লিঙ্গপ্রতীকের আদিমতম ও কিঞ্চিৎ পরবর্তী কালের যে সব নিদর্শন অদ্যাবধি আবিষ্কৃত হইয়াছে, এগুলির কোনওটিতেই লিঙ্গ ও যোনি একত্র করিয়া দেখানো হয় নাই। এই দুইটি পূজা প্রতীকের একত্র সমাবেশ আমরা গুপ্ত ও তৎপরবর্তী যুগের নিদর্শনগুলিতেই পাই,– তখন ইহার শিশ্নাকৃতি অনেকাংশে প্রচ্ছন্ন হইয়া গিয়াছিল এবং ইহা ক্রমশঃ সম্পূর্ণ রূপান্তরিত হইয়াছিল। গুপ্তপূর্ব কালের এবং খৃষ্টপূর্ব যুগের যে সব শিবলিঙ্গ বা তাহার চিত্র মুদ্রায় বা শিলমোহরে দেখা যায়, সেগুলিতে পরবর্তী কালের যোনিপট্ট দেখিতে পাওয়া যায় না, এবং ইহাদিগকে ঊর্ধ্বোত্থিত মুক্তমুখচর্ম পুংলিঙ্গের আকারে রূপায়িত দেখা যায়। গোপীনাথ রাও মহাশয় খৃষ্টপূর্ব যুগের এইরূপ একটি পরশু ও মৃগধারী দ্বিভুজ শিবের আকৃতি সংযুক্ত সুদীর্ঘ শিবলিঙ্গ অন্ধ্র প্রদেশের গুডিমল্লম গ্রামে আবিষ্কার করিয়াছিলেন। উহা অদ্যাবধি পূজা পাইয়া আসিতেছে। ইহাতে কোনও যোনিপীঠ বা যোনিপট্ট নাই।’– (পঞ্চোপাসনা, পৃষ্ঠা-১৩৬)
বিদ্বানেরা বলেন, সাধনার দার্শনিক উপলব্ধিতে লিঙ্গ মানে সূক্ষ্ম শরীরের প্রতীকী রূপ। কেননা শ্বেতাশ্বতর উপনিষদেরই নিম্নোক্ত শ্লোকে সূক্ষ্ম শরীরকে লিঙ্গ শরীর বলা হয়েছে–
বহ্নের্যথা যোনিগতস্য মূর্তির্ন দৃশ্যতে নৈব চ লিঙ্গনাশঃ।
স ভূয় এবেন্ধনযোনিগৃহ্যস্তদ্বোভয়ং বৈ প্রণবেন দেহে।। (শ্বেতাশ্বতর-১/১৩)
অর্থাৎ : আগুনের উৎস কাঠ। অর্থাৎ কাঠের ভিতরেই আগুন আছে। কিন্তু সেই আগুন তখনি দেখা যায় যখন একটি কাঠকে আরেকটি কাঠের সঙ্গে ঘষা হয়। না ঘষলে কি সেই শক্তি কাঠের মধ্যে থাকে না? অবশ্যই থাকে। সেইরকম প্রণবের মধ্যেই আত্মা আছেন। তাই প্রণবের দ্বারা আত্মাকে মনন করলেই তার উপলব্ধি হয়।
তার মানে, পরমেশ্বর মহেশ্বর সর্বব্যাপ্ত হয়েও সূক্ষ্ম লিঙ্গশরীরে অবস্থান করেন বলে তাঁকে দেখা যায় না, উপলব্ধির মাধ্যমে তাঁকে অনুভব করতে হয়। অর্থাৎ লিঙ্গশরীর মানে সূক্ষ্ম শরীর, যা বাস্তবে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য নয়। কিন্তু এই উপলব্ধির জন্য যে উচ্চমার্গের ধ্যান ও গভীর সাধনার প্রয়োজন হয় তার জন্যেও প্রাথমিকভাবে দরকার হয় কোনো বাহ্যিক প্রতীকী মাধ্যম। এই মাধ্যমই কি লিঙ্গপ্রতীক? এ প্রেক্ষিতে ড. উদয়চন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন–
‘শিবের সূক্ষ্মমূর্তি হলেও তার বাহ্য প্রতীক হিসাবে শিবলিঙ্গকে পূজা করা হত। এক্ষেত্রে লিঙ্গ শব্দের অর্থ চিহ্ন। শিবপূজকরা তাঁদের দেহে বিশেষ প্রকার তিলকাদি ব্যবহার করতেন। একেও লিঙ্গ বলা হত। পৌরাণিক যুগে ত্রিপুণ্ডক, ত্রিশূল বা লিঙ্গায়েৎ-দের শিবলিঙ্গ ধারণের মতই তখনও শৈবরা বিশেষ চিহ্ন বা লিঙ্গ ধারণ করতেন। পাশুপতসূত্রের– ‘লিঙ্গধারী’ (১/৬) অংশের ব্যাখ্যা কালে কৌণ্ডিন্য বলেন– বর্ণাশ্রমীদের যেমন স্ব স্ব আশ্রমের চিহ্ন থাকে, অর্থাৎ ব্রহ্মচারীর যেমন দণ্ড, কমণ্ডুল, যজ্ঞোপবীত ইত্যাদি থাকে, তেমনি পশুপতেরাও ভষ্মালেপন, নির্মাল্যধারণ ইত্যাদি লিঙ্গ ব্যবহার করবেন। শিবের চিহ্ন বা লিঙ্গ হিসাবেই তাই শিবলিঙ্গ ধারণ করা হত, কারণ শিবের প্রতীক লিঙ্গ এবং শিব প্রকৃতপক্ষে একই।
Continue-53
সমাজে তন্ত্রের প্রভাব
হিন্দুর ধর্মানুষ্ঠানের বিপুলতা প্রকাশ করতে যে প্রবাদ-বাক্যটি আমাদের কাছে অত্যন্ত পরিচিত, তা হলো– ‘বারো মাসে তেরো পার্বণ’। অথচ স্ত্রী-আচার ব্যতীত এই অনুষ্ঠানগুলির মধ্যে যা কিছু করা হয়, তাতে বৈদিক পদ্ধতির সংস্রব অত্যন্ত কম। তান্ত্রিক ও পৌরাণিক পূজাপদ্ধতির প্রচলনই হিন্দুসমাজে সমধিক। নিত্য উপাসনার ক্ষেত্রেও ভারতবর্ষের সর্বত্র তন্ত্রেরই আদর বেশি পরিলক্ষিত হয়। এ প্রসঙ্গে শ্রী সুখময় শাস্ত্রী’র ভাষ্যে–
‘ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় এবং বৈশ্যগণ বৈদিক পদ্ধতিতে উপনীত হইয়াও পরে তান্ত্রিক দীক্ষা গ্রহণ করিয়া থাকেন। গায়ত্রীর উপাসনা অপেক্ষা তান্ত্রিক দীক্ষায় ইষ্টদেবতার উপাসনাতেই হিন্দুগণ বেশী সময় দিয়া থাকেন। ভয়-ভীতিতে গায়ত্রীর শরণ না লইয়া ইষ্টমন্ত্রকেই বেশী স্মরণ করেন।’
‘বিষ্ণুচক্রচ্ছিন্ন সতীদেহ একান্ন খণ্ডে বিভক্ত হইয়া বেলুচীস্থানের হিঙ্গুলাক্ষেত্র হইতে আসামের কামরূপ পর্যন্ত তান্ত্রিক পীঠস্থানে পরিণত হইয়াছে। একই দেবতা সমগ্র ভারতে পরিব্যাপ্ত হইয়া ভারতীয় হিন্দুর তান্ত্রিক উপাসনার প্রবৃত্তি জাগাইতেছেন।’- (তন্ত্রপরিচয়, পৃষ্ঠা-২০)
বৈদিক কিংবা তান্ত্রিক এই উভয় মতে মুক্তিই চরম উপায় বলে নির্দেশিত হয়। এ প্রেক্ষিতে রুদ্রযামলে বলা হয়েছে–
যদ্ বেদৈর্গম্যতে স্থানং তৎ তন্ত্রৈরপি গম্যতে।
অর্থাৎ : বৈদিক সাধনার শেষ লক্ষ্য এবং তান্ত্রিক সাধনার শেষ লক্ষ্য একই।
তার মানে, পথ বিভিন্ন হলেও উভয়েরই গন্তব্য স্থল অভিন্ন। যেহেতু কলিকালে মানব স্বল্পায়ু এবং ভোগপ্রবণ, তাই কলিকালে তান্ত্রিক অনুষ্ঠানই প্রশস্ত বলে নির্দেশিত হয়েছে। কারণ শাস্ত্রে উপদিষ্ট হয়েছে–
কলৌ তন্ত্রোদিতা মন্ত্রাঃ সিদ্ধাস্তূর্ণফলপ্রদাঃ।- (মহানির্বাণ-তন্ত্র)
অর্থাৎ : তান্ত্রিক উপাসনায় শীঘ্র শীঘ্র ফল পাওয়া যায়।
তবে কি উপাসনায় শীঘ্র শীঘ্র ফল পাওয়ার আকাঙ্ক্ষাই তন্ত্রকে অধিক আদরণীয় করেছে? প্রাচীন ভারতীয় সমাজ ও সভ্যতার ক্রমবিকাশ বিবেচনায় নিলে বিষয়টার ব্যাখ্যা এতোটা সরলীকরণ করে দেখার উপায় নেই বলেই মনে হয়। কেননা শাক্ত-সাধনার ক্রমবিকাশ পর্যালোচনা করলে এমন সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া অসম্ভব নয় যে, কোন স্থানীয় আদিবাসী জনগোষ্ঠীর প্রাচীন অনার্য ধ্যান-ধারণা ও উপাসনা-পদ্ধতির সাথে কালে কালে বিভিন্ন বিশ্বাস ও সংস্কৃতির মিলন ও মিথষ্ক্রিয়ার মাধ্যমে গড়ে ওঠা এক রহস্যময় গূঢ় সাধন-পদ্ধতির পরিবর্তিত রূপ এই তন্ত্র-সাধনা। ফলে আদিম সংস্কৃতির নিজস্ব ফল্গু ধারা কোন জনগোষ্ঠীর অন্তপ্রবাহে সতত বহমান থেকে তাকে নিজস্ব মহিমায় উজ্জীবিত রাখবে এটাই স্বাভাবিক। একইভাবে শুরু থেকে দীর্ঘকাল আর্যাবর্তের বাইরে থাকা অবাধ্য বাঙালি জাতির লোকায়তিক জীবনধারায় এই তান্ত্রিক প্রভাব যে তার সংস্কৃতিতে ছাপ রেখে যাবে এটা অস্বীকার করার উপায় নেই। তাই অনেকেই যে ধারণা করেন, তান্ত্রিক উপাসনা বঙ্গদেশেই প্রথম প্রচলিত হয়েছিলো, তা যৌক্তিক বিশ্লেষণ ছাড়া একবাক্যে উড়িয়ে দেয়ার উপায় নেই। এ বিষয়ে একটি প্রাচীন বচনের কথা জানা যায়,–
গৌড়ে প্রকাশিত বিদ্যা মৈথিলে প্রকটীকৃতা।
ক্বচিৎ ক্বচিন্মহারাষ্ট্রে গুর্জরে প্রলয়ং গতা।।
অর্থাৎ : গৌড়ে বা বঙ্গে প্রথম প্রকাশিত বিদ্যা পরে মিথিলায় প্রকটিত হয়েছে এবং কালক্রমে মহারাষ্ট্রের কোন কোন স্থানে প্রচারিত হয়ে গুজরাটে বিলয়প্রাপ্ত হয়েছে।
যে-কোনো প্রাচীন প্রবাদেরর সাথেই একটি ঐতিহাসিক মূল্য জড়িয়ে আছে। তাই এই প্রবাদ-বাক্যটিরও বিশেষ মূল্য রয়ে গেছে নিশ্চয়ই। কারণ, ভারতের সর্বত্রই তান্ত্রিক উপাসনার সমান সমাদর দেখতে পাওয়া যায়। সম্ভবত জৈন-প্রভাবের ফলে ভক্তিশাস্ত্র ও তন্ত্রশাস্ত্র গুজরাটে প্রসার লাভ করেনি– এবং এ কারণেই গুজরাটের উপর এসব শাস্ত্রজ্ঞদের কিঞ্চিৎ বিরক্তির ভাব এই প্রবাদে প্রকাশ পাচ্ছে বলে শ্রী সুখময় শাস্ত্রীর ধারণা। তাঁর ভাষ্যে–
–‘দাক্ষিণাত্যেও কৌল সাধক অনেক প্রখ্যাত ব্যক্তির আবির্ভাব হইয়াছে। বঙ্গদেশ ও কাশ্মীরে হয়তো এই বিদ্যার সমাদর একটু বেশী হইয়াছিল। বিশেষতঃ বঙ্গদেশে তান্ত্রিক গ্রন্থাদিও কিছু বেশী পাওয়া যায়। তন্ত্র-গ্রন্থ অনেকগুলি লুপ্ত এবং অমুদ্রিত থাকিলেও সারা ভারতেই এই শাস্ত্র এবং শাস্ত্রোপদিষ্ট উপাসনা-পদ্ধতি আদৃত হইতেছে। বৈদিক আচার অপেক্ষা বঙ্গ দেশে চিরকালই তান্ত্রিক আচারের প্রাধান্য। বাঙ্গালার প্রসিদ্ধ বংশগুলি এখনও তান্ত্রিক কোন সিদ্ধ পুরুষ বা আচার্যকেই পূর্বপুরুষ-রূপে পরিচয় দিয়া কৃতার্থতা বোধ করে। কুলবধূ তান্ত্রিক দীক্ষা গ্রহণ না করা পর্যন্ত পরিবারস্থ গুরুজন সেই বধূর পক্কান্ন গ্রহণ করেন না এবং দেবগৃহের কোনও কাজে সেই বধূ সহায়তা করিতে পারেন না– এরূপ উদাহরণ কামরূপ হইতে রাঢ়দেশ পর্যন্ত বহু সম্ভ্রান্ত পরিবারে দেখিতে পাওয়া যায়। পারিবারিক ধর্মকৃত্যে এবং উপাসনাদিতে অধিকার লাভের নিমিত্ত গুরু হইতে তান্ত্রিক দীক্ষা গ্রহণ করা অবশ্য-কর্তব্য বলিয়া তন্ত্রশাস্ত্রের আদেশ। আস্তিক-সম্প্রদায় এই আদেশকে মান্য করিয়া থাকেন। এইভাবে যে ধারাটি এখনও প্রবাহিত, তাহাকে অস্বীকার বা অবজ্ঞা করিবার অবকাশ কোথায়।’- (তন্ত্রপরিচয়, পৃষ্ঠা-২০)
তান্ত্রিক ক্রিয়াকাণ্ডের ফল প্রত্যক্ষসিদ্ধ বলে উপাসকগণ মনে-প্রাণে বিশ্বাস করে বলে থাকেন–
চিকিৎসিত-জ্যোতিষ-তন্ত্রবাদাঃ,
পদে পদে প্রত্যয়মাবহন্তি।
অর্থাৎ : চিকিৎসাশাস্ত্র, জ্যোতিষ এবং তন্ত্রের বচন প্রতি পদে প্রত্যক্ষ সত্য।
আমাদের সাধারণ লৌকিক জনগোষ্ঠীতেও এই বিশ্বাস কতোটা প্রবল তার নমুনাও আমাদের অগোচর নয় এখনও। ঝাড়-ফুক, তাগা-তাবিজ, বান-বদ্যি, জ্যোতিষ-বিচারের সাথে প্রাত্যহিক জীবন-যাপনের অংশ হয়ে থাকা এই বিশাল জনগোষ্ঠীর প্রবল বিশ্বাস-নির্ভরতা থেকেই তা প্রত্যক্ষ করা যায়। বৌদ্ধ-তন্ত্রের সাথে হিন্দু-তন্ত্রের তাত্ত্বিক ধারণায় মৌলিক কোন তফাৎ না থাকলেও বৌদ্ধ-তন্ত্র প্রসঙ্গ ভিন্ন আলোচনার অবকাশ রাখে বিধায় বর্তমান আলোচনা হিন্দু তন্ত্র বিষয়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখা হয়েছে। ইতঃপূর্বেও উল্লেখ করা হয়েছে যে, সাধন-প্রণালীতে তেমন মৌলিক কোন পার্থক্য না থাকলেও হিন্দু তন্ত্রের মধ্যেও শাক্ত, শৈব, বৈষ্ণব ইত্যাদি বিভাগ রয়েছে। তবে সংখ্যায় শাক্ত তন্ত্রই বেশি পাওয়া যায়। এই তন্ত্রসমূহের মধ্যে পরস্পর দ্বেষপূর্ণ উক্তি থাকলেও তার তাৎপর্য ভিন্ন। অর্থাৎ স্ব-সম্প্রদায়ের আচারে সবিশেষ শ্রদ্ধা আকর্ষণই সেসব অশ্রদ্ধামূলক উক্তির তাৎপর্য। শাস্ত্রে এই নিন্দা বলতে আসলে কী বোঝায় তার স্বরূপ প্রকাশ করতে গিয়ে বিখ্যাত মীমাংসক আচার্য শবরস্বামী সিদ্ধান্ত করেছেন–
ন হি নিন্দা নিন্দ্যং নিন্দিতুং প্রযুজ্যতে।
কিং তর্হি। নিন্দিতাদিতরৎ প্রশংসিতুম্ ।
তত্র ন নিন্দিতস্য প্রতিষেধো গম্যতে।
কিং তু ইতরস্য বিধিঃ।
অর্থাৎ : নিন্দ্য বিষয়কে নিন্দা করিবার নিমিত্ত নিন্দার প্রয়োগ করা হয় না, পরন্তু নিন্দিতাতিরিক্ত বিষয়কে অর্থাৎ বিধেয়কে প্রশংসা করিবার নিমিত্তই নিন্দার প্রয়োগ।
দেশভেদে তান্ত্রিক আচার ও সাধনায় কিছু কিছু পার্থক্য দেখা যায়। এ প্রেক্ষিতে শ্রী সুখময় শাস্ত্রী’র ভাষ্য অনুযায়ী–
–‘সমগ্র ভারতের হিন্দুসমাজেই এখন তান্ত্রিক সাধনা চলিতেছে– এইকথা একাধিকবার বলা হইয়াছে। দাক্ষিণাত্য ও মহারাষ্ট্রে বৈদিক যাগ-যজ্ঞ এখনও লুপ্ত হয় নাই এবং অনেক অগ্নিহোত্রী ব্রাহ্মণও আছেন, কিন্তু সেইসকল দেশেও তান্ত্রিক উপাসনারই প্রাধান্য। মহারাষ্ট্রে গণপতি ও সূর্যের উপাসকের সংখ্যা কম নহে। দক্ষিণ-ভারতের শাক্তদের মধ্যে অধিকাংশই শ্রীবিদ্যার উপাসক। সেখানে বৈষ্ণবের সংখ্যাধিক্য। শৈবও আছেন, কিন্তু বৈষ্ণবের তুলনায় সংখ্যায় কম।’
–‘উত্তর-ভারত ও পূর্ব-ভারতে শক্তি-উপাসনার বাহুল্য। উত্তর ভারতে কিছু কিছু শৈবও আছেন। বঙ্গদেশ ও আসামের হিন্দুসমাজে শাক্তের সংখ্যাই বেশী, বাকি প্রায় সকলই বৈষ্ণব। শ্রীমন্মহাপ্রভুর কৃপাতেই বৈষ্ণবের সংখ্যা বৃদ্ধি প্রাপ্ত হইয়াছিল। পরবর্তী কালে প্রভুপাদ বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীর প্রভাবেও বৈষ্ণবের সংখ্যা বৃদ্ধি পাইয়াছে। বঙ্গীয় শাক্ত সম্প্রদায় কালী, তারা প্রমুখ দেবতাদের উপাসকই বেশী, শ্রীবিদ্যার উপাসক খুব কম। এই কারণে একমাত্র শ্রীতত্ত্ব-চিন্তামণি ব্যতীত বঙ্গদেশীয় তন্ত্রনিবন্ধেও মুখ্য কৌলাচারের বিধান বেশী পাওয়া যায় না। দাক্ষিণাত্য শাক্ত সম্প্রদায়ে শ্রীবিদ্যার পদ্ধতিই বেশী চলে। এই কারণে সেই অঞ্চলের নিবন্ধসমূহে মুখ্য কৌলাচারের উপদেশই বেশী। দাক্ষিণাত্যের কেরল-সম্প্রদায় এবং বাঙ্গালার গৌড়ীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে সম্প্রদায়গত ভেদও কিছু কিছু রহিয়াছে।’
–‘উভয় আচারে যদিও পঞ্চ-মকারের বিধান আছে, তথাপি বামাচার আর কৌলাচার এক নহে। বেদাচার-পরায়ণ দ্বিজাতির পক্ষে বামাচারের সাধন চলিতে পারে না, কিন্তু কৌলাচারে তাঁহাদেরও অধিকার আছে। বেদাচারভ্রষ্ট দ্বিজাতি বামাচারের দ্বারা কৌলাচারকে গ্রহণ করিতে পারিবেন। বামাচার শূদ্রাদির পক্ষেও বিহিত। দাক্ষিণাত্যে এখনও বৈদিক-মার্গাবলম্বী ব্রাহ্মণাদির সংখ্যা কম নহে। এইহেতু দাক্ষিণাত্যের বেদাচারনিষ্ঠ ব্রাহ্মণগণ বামাচারের পথে না গিয়াও দক্ষিণাচার হইতেই কৌলাচারকে অবলম্বন করিতেন। বঙ্গদেশের শাক্ত সাধকগণ বামাচারের দ্বারা কৌলমার্গ গ্রহণ করিতেন। সম্ভবতঃ এই কারণে দাক্ষিণাত্যের নিবন্ধগুলিতে অবিমিশ্র কৌলাচারের পদ্ধতি দেখিতে পাওয়া যায়। আর বঙ্গদেশের তন্ত্র-নিবন্ধগুলি বামাচার ও কৌলাচারের পদ্ধতিতে মিশ্রিত। বামাচারের ভিতর দিয়াই বাঙ্গালী তান্ত্রিক সাধকগণ কৌলাচারে প্রবেশ করিতেন বলিয়া তাঁহাদের নিবন্ধে বামাচার ও কৌলাচারের সীমারেখা নির্ণয় করা সুকঠিন। সকল দেশেই সাধকগণ নিজেদের আচার গোপন করিয়া থাকেন। এইহেতু বিশেষ জিজ্ঞাসু ভক্ত ব্যতীত অপর ব্যক্তি তাঁহাদের সন্ধান জানিতে পারে না। মন্ত্রে সিদ্ধি লাভ করার পর সাধক প্রকাশ্যেও অনেক কিছু অনুষ্ঠান করেন। সেই অবস্থায় আচার প্রকাশ করাও দোষের নহে। তিনি তখন নিন্দা-স্তুতির অনেক উর্ধ্বে অবস্থিত।’- (তন্ত্রপরিচয়, পৃষ্ঠা-৬৭)
এখানে উল্লেখ্য, পুরশ্চর্যার্ণবের নবম তরঙ্গে সিদ্ধান্তসংগ্রহ-তন্ত্রের কতকগুলি বচন উদ্ধৃত হয়েছে। তা থেকে জানা যায়, প্রদেশ-ভেদে ভারতে তিনটি তান্ত্রিক সম্প্রদায় ছিল– গৌড়-সম্প্রদায়, কাশ্মীর-সম্প্রদায় ও কেরল-সম্প্রদায়। এদের মধ্যকার তান্ত্রিক আচার ও সাধন-প্রক্রিয়ার পার্থক্যগুলো শ্রী সুখময় শাস্ত্রী’র ভাষ্যে–
–‘গৌড়-সম্প্রদায়ে বামমার্গ সবিশেষ আদৃত। এই সম্প্রদায়ে পূজাদিতে পঞ্চ মকারের মুখ্য দ্রব্যই গৃহীত হইয়া থাকে। এই মতে পূজাতে নৈবেদ্য নিবেদনের পরে হোম এবং তাম্বুল নিবেদনের পরে বলি-দানের বিধান। এই সম্প্রদায় বাম হস্তে পূজা এবং দক্ষিণ হস্তে তর্পণ করেন। ইঁহারা স্বীয় হৃদয়ে দেবতার বিসর্জন করিয়া থাকেন।’
–‘কাশ্মীর-সম্প্রদায়ে পীঠার্চনের পরেই বলিদান এবং পঞ্চোপচার পূজার পরেই হোম করা হয়। এই সম্প্রদায় দক্ষিণ হস্তেই পূজা ও তর্পণ করেন। ইহাতে পঞ্চ মকারের অনুকল্প অর্থাৎ প্রতিনিহিত দ্রব্য গৃহীত হইয়া থাকে। ইঁহারা স্বকীয় সহস্রারে দেবতাকে বিসর্জন করেন।’
–‘কেরল-সম্প্রদায়ে পঞ্চ মকারের ভাবনা-মাত্র; কোন দ্রব্যের অপেক্ষা নাই। পূজার অন্তে বলিদান, দক্ষিণ হস্ত দ্বারা পূজন এবং বাম হস্ত দ্বারা তর্পণ। এই মতে সকল কর্মের সমাপ্তিতে হোম, আর স্ব-হৃদয়ে দেবতার বিসর্জন।’
‘উল্লিখিত বর্ণনা অনুসারে দেখা যাইতেছে, আজকাল বঙ্গদেশেও কেরল সম্প্রদায়ের রীতিই সমধিক অনুসৃত হইতেছে।’- (তন্ত্রপরিচয়, পৃষ্ঠা-৬৮)
পরিশেষে এটা বলা বাহুল্য হবে না যে, হিন্দুধর্মে তন্ত্রের যে তাৎপর্যময় সুস্পষ্ট প্রভাব আনুষ্ঠানিকভাবে বহমান তার জ্বলন্ত প্রমাণ হলো হিন্দুধর্মের প্রচলিত মাতৃপূজা অনুষ্ঠান ও তার বিধি-প্রক্রিয়া। বৈদিক সংস্কৃতিতে পূজা অনুপস্থিত। দুর্গা কালী সরস্বতি লক্ষ্মী এইসব অনার্য ঐতিহ্যবাহী মাতৃপূজার বহিরঙ্গের ভেতরগত মন্ত্র-বিধি-প্রণালীর গোটা প্রক্রিয়া জুড়েই রয়েছে তন্ত্র ও তান্ত্রিক বিধি-ব্যবস্থার বিপুল প্রভাব। এছাড়া আউল-বাউল ফকির-সাধু-সন্ন্যাসী ধারা তথা বাঙালির পরবর্তীকালে সাধন-পরম্পরার মধ্যেও মিশে আছে তন্ত্রের বিপুল প্রভাব।
তন্ত্র নিয়ে অজানা কিছু তথ্য
তন্ত্র- ছোট্ট একটি শব্দ। কিন্তু গভীর তার অন্তর্নিহিত অর্থ। তন্ত্র হল এক বৃহৎ ও অতিপ্রাচীন গুপ্ত বা লুপ্তপ্রায় বিষয়। মুক্ত বিশ্বকোষে বলা আছে, তন্ত্র হিন্দুসমাজে প্রচলিত ঈশ্বর উপাসনার একটি পথবিশেষ। শিব ও মহাশক্তির উপাসনা সংক্রান্ত শাস্ত্রগুলিকেও তন্ত্র সাধনা নামে অভিহিত করা হয়। তন্ত্রশাস্ত্র অনুযায়ী, এই মহাবিশ্ব হল শিব ও মহাশক্তির দিব্যলীলা। তন্ত্রে যেসব ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান ও রীতি-নীতির বর্ণনা রয়েছে তার উদ্দেশ্যই হল মানুষকে অজ্ঞানতা ও পুনর্জন্মের হাত থেকে মুক্তি দেওয়া।
খ্রিস্ট্রীয় প্রথম সহস্রাব্দের প্রথম দিকে তন্ত্র সাধনার বিকাশ লাভ করে। গুপ্তযুগের শেষভাগে এই প্রথার পূর্ণ বিকাশ ঘটে। মূলত বৌদ্ধধর্মের হাত ধরেই পূর্ব এশিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় বিস্তার লাভ করে এই তন্ত্রশাস্ত্রটি। তন্ত্র ভারতের অতিপ্রাচীন এবং গুরু পরম্পরার একটি গুপ্ত বিদ্যা। প্রাচীন ভারত থেকে বহু মূল্যবান পুঁথি চীনা পরিব্রাজকরা তাঁদের দেশে নিয়ে চলে গেছেন। এটি গুরু পরম্পরা বিদ্যা বলে প্রকৃত গুরুর খোঁজ করতে হয়। দীক্ষা ছাড়া এ শাস্ত্র সম্পর্কে সহজে কেউ কাউকে কিছু ব্যক্ত করেন না।
ভারতের আদি ও অকৃত্রিম তন্ত্র সাধনার জায়গা হল নীলাচল পর্বত। যা 'কামাখ্যাধাম' নামে পরিচিত। তন্ত্র এমনই একটি শাস্ত্র যার মাধ্যমে নিজেকে অনুসন্ধান করা যায়। নিজের অন্তরের ঈশ্বরকে খুঁজে পাওয়া যায়।
তন্ত্র শব্দটির অর্থ ব্যাপক । সংক্ষেপে তন্ত্র হচ্ছে "সৃষ্টির পরিচালনার নিয়ম " । মহাদেব বা শিবের ডমরু থেকে তন্ত্রের উৎপত্তি । সতী বা দেবি দূর্গার দশ হাতে আছেন দশ মহাবিদ্যা । এই দশমহাবিদ্যার উপর ভিত্তি করেই অনেকটা তন্তশাস্ত্র গড়ে উঠেছে । তন্ত্রের বিষয়টা অনেক ব্যাপক ও বিস্তৃত । সাধারনভাবে, তন্ত্র অসীম জ্ঞানের আধার । সাধক শ্রীরামকৃষ্ণের তন্ত্রসাধনা রিসার্চ করলে দেখা যায়, যা অবিদ্যাকে গ্রাস করে তাই জ্ঞান । তন্ত্র জ্ঞানচক্ষু উম্মোচন করে ।সৃষ্টির কারন বুঝতে সাহায্য করে তন্ত্র । তন্ত্র সৃষ্টি , স্থিতি ও বিনাশের পরিচালনা শক্তি । ব্রহ্মা বিষ্ণু মহেশ্বর এই তিন শক্তির পরিচালনা নিয়ম ব্যাক্ত করে তন্ত্র ।
তন্ত্রের সাথে সম্পর্কিত আছে মন্ত্র ,যন্ত্র । তন্ত্র সাধনায় সাধক সৃষ্টির রহস্য জেনে পরমানন্দ অনুভব করে ।
চৈতন্যময়ী প্রকৃতিকে তুষ্ঠ করতেই পূজা করা হয়; যাতে পূজারী / ভক্তের জীবন আনন্দময়, কল্যাণময় হয়ে ওঠে। তন্ত্র হচ্ছে দর্শন বা তত্ত্ব। আর পূজা হচ্ছে পদ্ধতি। পূজার উপচার বা উপকরণ নিষাদরা তাদের নিজস্ব পরিবেশ থেকেই সংগ্রহ করেছিল। পরবর্তীকালে বাংলায় তাদের এই ধারণার (প্রকৃতি কে 'চৈতন্যময়ী' বলে মনে করে দেবীরূপে ভজনা করা) বিবর্তিত হয়েছিল। এবং এই নারীকেন্দ্রিক তান্ত্রিক ধারণাটি পল্লবিত হয়েছিল। তন্ত্র সর্ম্পকে একটি ইউরোপিয় সূত্র লিখেছে,
" The word "tantra" is derived from the combination of two words "tattva" and "mantra". "Tattva" means the science of cosmic principles, while "mantra" refers to the science of mystic sound and vibrations. Tantra therefore is the application of cosmic sciences with a view to attain spiritual ascendancy. In another sense, tantra also means the scripture by which the light of knowledge is spread ."
তন্ত্রের প্রধান একটি সিদ্ধান্তই হল এই যে প্রাকৃতিক শক্তিকে চৈতন্যময়ী মনে করা। কিন্তু, শক্তি কি? বিশ্বজগতে সবই তো শক্তির সমাহার। যে শক্তিকে বিজ্ঞান নিয়ন্ত্রণে আনতে চায়। আধুনিক সভ্যতা এই মূলতত্ত্বের ওপরই প্রতিষ্ঠিত। প্রকৃতির সূত্র আবিস্কার করে এই শক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করা কতটা যৌক্তিক এই প্রশ্নও তো আজকাল উঠছে । এই দৃষ্টিভঙ্গি হটকারী কিনা, পরিবেশ বিপর্যয়ের মূলে এই দর্শন সক্রিয় কিনা- এসব প্রশ্নও নিয়েও তো আমরা আজ উদ্বিগ্ন।
তো, প্রাকৃতিক শক্তির নিয়ন্ত্রণ প্রসঙ্গে তন্ত্রের সিদ্ধান্ত কি ?
তন্ত্র প্রাকৃতিক শক্তির নিয়ন্ত্রণ করতে চায় না। তার কারণ, তন্ত্র প্রাকৃতিক শক্তিকে চৈতন্যময়ী জেনেছে, মা বলে জেনেছে, মায়ের দেবীপ্রতিমা কল্পনা করেছে; দেবী মা (প্রাকৃতি কে) কে একজন তান্ত্রিক নিষ্ঠাভরে ভজনা করতে চায়, আরাধনা করতে চায়, পূজা করতে চায়। পাশাপাশি একজন তান্ত্রিক মনে করেন, একজন ভক্ত চৈতন্যময়ী শক্তির অনুগত থাকলে চৈতন্যময়ী শক্তির কৃপায় তার অশেষ কল্যাণ সাধিত হতে পারে।
এই হল বিজ্ঞান এবং তন্ত্রের মধ্যে পার্থক্য।
চৈতন্যময়ী প্রকৃতিরূপী নারীবাদী তন্ত্রের দেবী দূর্গা- কালী- বাসুলী - তারা- শিবানী। কিন্তু তন্ত্রের কেন্দ্রে রয়েছেন (আমি আগেই একবার ইঙ্গিত দিয়েছি) অনার্য দেবতা শিব। তন্ত্রমতে শিব তাঁর শক্তি পেয়েছে কালীর কাছ থেকে। আবার শিব- এর রয়েছে পৃথক নিজস্ব শক্তি। তন্ত্রমতে পুরুষ শক্তিলাভ করে নারীশক্তি থেকে। শিব শক্তি লাভ করেছেন তাঁর নারীশক্তির প্রকাশ- গৌড়ীর শক্তি থেকে। তবে শিবের নিজস্ব শক্তিও স্বীকৃত। তন্ত্রসাধনার মূল উদ্দেশ্যই হল- (প্রাকৃতিক) শক্তি দেবীর সাধনা করে "শিবত্ব" লাভ তথা শক্তিমান হওয়া।
এখানেই বলে রাখি যে- প্রাচীন ও মধ্যযুগের বঙ্গবাসী পরবর্তীকালে নগর গড়ে তুললেও সে তার আদিম পূর্বপুরুষের ঐতিহ্য কখনও পরিত্যাগ করেনি কিংবা বিস্মৃত হয়নি। এই বাঙালি মননের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। নগরেও পূজা হয়েছে। উপচার হল পূজার উপকরণ। এমন কী, পূজার উপচারেও দেখা যায় নিষাদ উপকরণ। আপত চাল, তিল, জল, দুধ, কুশাগ্র, দই, যব, শ্বেতসরিষা, চন্দন, বিল্বপত্র বা বেলপাতা, কচু, হরিদ্রা, জয়ন্তী, ডালিম, বেল, অশোক, মানকচু, ধান, কলাগাছ, গম, মাষকলাই, তিসি। এ সবই প্রাচীন বাংলার লোকজসমাজের কৃষিপণ্য।
এখানেই বলে রাখি যে প্রাচীন বাংলার নিষাদসমাজের তান্ত্রিক বিশ্বাস ও বাহিরাগত (আর্যরা প্রাচীন বাংলার বাইরে থেকে এসেছিল বলে) আর্যবৈদিক মতের কিছু পার্থক্য রয়েছে। বহিরাগত আর্যদের বৈদিক ধর্মবিশ্বাসটি মূলত পুরুষতান্ত্রিক; পক্ষান্তরে বাংলার অনার্যদের তান্ত্রিক মত মাতৃতান্ত্রিক। তা ছাড়া আর্যদের বৈদিক মত হল ঋষিজ: তার মানে দার্শনিক বা ফিলোফফিক্যাল। এ কারণে মানবকল্যাণে এর ভূমিকা প্রত্যক্ষ নয়, পরোক্ষ। অন্যদিকে তান্ত্রিকমত মুণিজ বা বিজ্ঞান ভিত্তিক হওয়ায় জগৎসংসারে জীবজগতে এর প্রভাব প্রত্যক্ষ। সনাতনধর্মের একটি গুরুত্বপূর্ণ সিধান্ত হল- দর্শনের সামগ্রিক দৃষ্টি এবং তন্ত্রমতের খন্ডিত বা বৈজ্ঞানিক দৃষ্টি একত্রিত হলেই জ্ঞান সম্পূর্ণ হয়। এ কারণেই বেদের যজ্ঞ এবং তন্ত্রের পূজা সম্মিলিত ভাবে সনাতনধর্মকে একটি দৃঢ় ভিত্তি দিয়েছে।
তন্ত্র থেকে তত্ত্ব। তন্ত্রের বৈশিষ্ট্য বা উদ্দেশ্য হল তত্ত্বের সিদ্ধান্তকে জীবনের কর্মক্ষেত্রে রূপদান করা। কাজেই তন্ত্রের প্রচারের মাধ্যম আচরণ বা থিউরি নয়, প্র্যাকটিস। তন্ত্রমতে নারী জগতের আদি কারণ। তন্ত্রের উদ্ভব প্রাচীন বাংলার মাতৃতান্ত্রিক নিষাদসমাজে হয়েছিল বলেই এমনটাই ভাবা অত্যন্ত স্বাভাবিক ছিল।
কিন্তু, তন্ত্রমতে কেন নারী জগতের আদি কারণ ?
ঈশ্বর নিরাকার। রূপহীন। যে কারণে প্রাচীন বৈদিক আর্যরা ঈশ্বরের রূপ বর্ণনা করেছেন এভাবে-
'রূপংরূপ বিবর্জিতস্য ভবতো ধ্যানেন যদবর্ণিতং।'
এর মানে হল-'হে রূপহীন ঈশ্বর! ধ্যানে তোমার রূপ বর্ণনা করেছি।'
তন্ত্রমতে নারী জগতের আদি কারণ এই জন্য যে এই নিরাকার রূপহীন ইশ্বরকে যখন নারী ভাবা হয় তখন ঈশ্বরের মাহাত্ম ক্ষুন্ন হয় না। কাজেই ভক্তের মানসিক প্রবনার ওপরই মাতৃমূর্তির কল্পনা।
যে কারণে বলা হয়েছে -'সাধকানাং হিতার্থায়ৈ ব্রহ্মণে রূপকল্পনা '
এর মানে হল- 'সাধকের হিতের জন্য ঈশ্বরের রূপ কল্পনা করা হয়েছে।'
তন্ত্র একটি জটিল বিষয়। ভারতবর্ষের আর্যকেন্দ্রিক অধ্যাত্ম ঐতিহ্যে এর স্থানটি নিয়ে নানা পরস্পরবিরোধী ধ্যানধারণা রয়েছে। বস্তুতঃ এর উৎস ছিল অনার্য উপাসনা পদ্ধতি ও ব্যাপকভাবে বিকেন্দ্রিত লোকাচারের মধ্যে। এর উদ্ভব প্রাক বৈদিক যুগেরও আগে এবং আর্যদের পরবর্তীকালের বৈদিক আচারবিচারে, বিশেষতঃ অথর্ববেদের সময়ে, আগম ও তন্ত্রের প্রভাব চোখে পড়ে। তন্ত্রের উদ্ভব ও বিবর্তনে সমাজতত্ত্ব ও রাজনীতির ভূমিকা নিয়ে দীর্ঘকাল ধরে আগ্রহ পোষণ করার সূত্রে বহু ধরনের প্রবণতা লক্ষ্য করেছি। ভারতবর্ষের আবহমান নিম্নবর্গীয় সমাজতত্ত্ব, আর্য-অনার্য সংস্কৃতির দ্বন্দ্ব ও বৌদ্ধধর্মের সম্পূর্ণ কায়াপলটের পরিপ্রেক্ষিতে তন্ত্রশাস্ত্র একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অনুঘটক।
সত্যি কথা বলতে কি, তন্ত্র সম্বন্ধে 'সংক্ষেপে' কিছু লিখে ফেলা আমার মতো অনধিকারীর পক্ষে অসম্ভব। বিপুল এর ইতিহাস, বিশাল এর বিস্তৃতি। সচরাচর গুহ্যশাস্ত্র হিসেবে গণ্য হওয়ার কারণে সাধারণ মানুষ আগ্রহী হলেও এ বিষয়ে কৌতূহল নিবৃত্ত করার মতো আকরগ্রন্থ বিশেষ পাওয়া যায় না। কারণ অসংখ্য সাধক ও বিদ্বানের বহুধাবিভক্ত চর্চা ও অভ্যাসের দৌলতে সাধারণ পাঠকের উপযুক্ত সহজ আলোচনা আমাদের ভাষায় বিরল।
এখানে মনে রাখতে হবে, এই গুহ্যতন্ত্রসাধনা ষোড়শ শতক পর্যন্ত এক বিশেষ গোষ্ঠীর মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। পরবর্তীকালে বিদেশী মুসলমান রাজশক্তির নিষ্পেষণে যখন মূলস্রোতের ব্রাহ্মণ্য পূজা-আরাধনা প্রকাশ্যে, সমারোহ সহকারে উদযাপন করার পথে অন্তরায় দেখা দিল তখন উচ্চকোটীর বিপর্যস্ত ব্রাহ্মণ্যধর্ম শরণ নিয়েছিল অনার্য কৌম সমাজের দীর্ঘদিন ধরে গড়ে তোলা দেবী প্যান্থিয়নের আশ্রয়ে। এই সময় থেকেই তন্ত্রশাস্ত্র পূর্বতন অসংগঠিত রূপ থেকে ব্রাহ্মণ্যমনীষার যোগদানের ফলে এক বিস্তৃত স্ট্রাকচার্ড মাত্রা পেয়ে ছিল।
বৌদ্ধতন্ত্র ও সনাতনধর্মীয় তন্ত্রের মধ্যে বস্তুত কোনও উল্লেখযোগ্য প্রভেদ নেই। আসলে সেভাবে দেখলে তন্ত্র কোনও ধর্মীয় মতবাদ নয়, তন্ত্র এক সাধনপদ্ধতি মাত্র। মনুষ্যদেহকে এক যন্ত্রস্বরূপ বিচার করে সেই সূত্রে এক গুহ্যসাধনপদ্ধতিকেই তন্ত্র বলে। এই সাধনপদ্ধতিতে অনুগামীদের বিভিন্ন দেবীর নামে দীক্ষা নিতে হয়। বেছে নেবার মতো অসংখ্য দেবী থাকলেও আমাদের দেশে (বাংলায়) শাক্তরা জগদ্ধাত্রী মন্ত্রেই অধিক দীক্ষিত হন। তারা, অন্নপূর্ণা, ত্রিপুরা ও ভুবনেশ্বরী মন্ত্রে দীক্ষিত শাক্তদের সংখ্যা অপেক্ষাকৃত কম।
তন্ত্রসাধনার মূল স্রোতটি যে আচারপদ্ধতিকে আশ্রয় করে গড়ে ওঠে, তা হলো পঞ্চ ম-কার ক্রিয়া। এই পদ্ধতিটি নিয়ে আবহমানকাল ধরে নানা ধরনের পরস্পর বিপ্রতীপ মতামত প্রচলিত রয়েছে। প্রায় সোয়াশো বছর আগে এ বিষয়ে ব্যাখ্যা দেবার উপক্রমনিকা হিসেবে একটি কৈফিয়ৎ যেমন ভাবে প্রকাশিত হয়েছিল, "...ভারত-প্রচলিত তান্ত্রিক উপাসনার প্রকৃত মর্ম ও পঞ্চ ম-কারের মূল উদ্দেশ্য আমাদের জ্ঞানে যতদূর উদ্বোধ হইয়াছে এবং ইহার আধ্যাত্মিক-তত্ত্ব যতদূর জানিতে পারা গিয়াছে..." ইত্যাদি। অর্থাৎ এই ব্যাখ্যাটির প্রামাণ্যতা নির্ভর করছে দু'টি বিষয়ের উপর, 'আমাদের জ্ঞান' ও 'যতদূর জানিতে পারা গিয়াছে'। এ বিষয়ে সাক্ষী মানা হয়েছে 'আগমসার' নামের একটি প্রাচীন গ্রন্থের। এই গ্রন্থে প্রথম-ম, অর্থাৎ 'মদ্য' সাধন বিষয়ে বলা হয়েছে,
"সোমধারা ক্ষরেদ যা তু ব্রহ্মরন্ধ্রাদ বরাননে।
পীত্বানন্দময়ীং তাং য স এব মদ্যসাধকঃ"।।
তাৎপর্যঃ- "হে পার্বতি! ব্রহ্মরন্ধ্র হইতে যে অমৃতধারা ক্ষরিত হয়, তাহা পান করিলে, লোকে আনন্দময় হয়, ইহারই নাম মদ্যসাধক"।
মাংসসাধনা সম্বন্ধে বলা হচ্ছে, "মা, রসনা শব্দের নামান্তর, বাক্য তদংশভূত; যে ব্যক্তি সতত উহা ভক্ষণ করে, তাহাকেই মাংসসাধক বলা যায়। মাংসসাধক ব্যক্তি প্রকৃত প্রস্তাবে বাক্যসংযমী মৌনাবলম্বী যোগী"
মৎসসাধনার তাৎপর্য আরও গূঢ় ও প্রতীকী। "গঙ্গা-যমুনার মধ্যে দুইটি মৎস্য সতত চরিতেছে, যে ব্যক্তি এই দুইটি মৎস্য ভোজন করে, তাহার নাম মৎস্যসাধক। আধ্যাত্মিক মর্ম গঙ্গা ও যমুনা, ইড়া ও পিঙ্গলা; এই উভয়ের মধ্যে যে শ্বাস-প্রশ্বাস, তাহারাই দুইটি মৎস্য, যে ব্যক্তি এই মৎস্য ভক্ষণ করেন, অর্থাৎ প্রাণারামসাধক শ্বাস-প্রশ্বাস, রোধ করিয়া কুম্ভকের পুষ্টিসাধন করেন, তাঁহাকেই মৎস্যসাধক বলা যায়"।
মুদ্রাসাধনা এরকম, "...শিরঃস্থিত সহস্রদল মহাপদ্মে মুদ্রিত কর্ণিকাভ্যন্তরে শুদ্ধ পারদতুল্য আত্মার অবস্থিতি, যদিও ইহার তেজঃ কোটিসূর্য্যসদৃশ, কিন্তু স্নিগ্ধতায় ইনি কোটি চন্দ্রতুল্য। এই পরম পদার্থ অতিশয় মনোহর এবং কুন্ডলিনী শক্তি সমন্বিত, যাঁহার এরূপ জ্ঞানের উদয় হয়, তিনিই প্রকৃত মুদ্রাসাধক হইতে পারেন"।
মৈথুনতত্ত্ব সম্বন্ধে 'অতি জটিল' বিশেষণ আরোপ করা হয়েছে আগমসার গ্রন্থে। সেখানে বলা হয়েছে, মৈথুনসাধক পরমযোগী। কারণ তাঁরা "বায়ুরূপ লিঙ্গকে শূন্যরূপ যোনিতে প্রবেশ করাইয়া কুম্ভকরূপ রমণে প্রবৃত্ত হইয়া থাকেন"। আবার অন্য ঘরানার তন্ত্রে বলা হচ্ছে, "মৈথুনব্যাপার সৃষ্টি-স্থিতি-লয়ের কারণ, ইহা পরমতত্ত্ব বলিয়া শাস্ত্রে উক্ত হইয়াছে। মৈথুন ক্রিয়াতে সিদ্ধিলাভ ঘটে এবং তাহা হইলে সুদুর্লভ ব্রহ্মজ্ঞান হইয়া থাকে"।
যে 'সাধারণ' লোকেরা তন্ত্রের প্রথম উদ্গাতা ছিল এবং ম-কার যাদের দৈনন্দিন জীবনের ছন্দ, তাদের প্রতি পুরোহিতশ্রেণীর আশংকা, "...সাধারণ লোকে উদ্দেশ্য ও প্রকৃত মর্ম বুঝিতে না পারিয়া তন্ত্রশাস্ত্র ও তন্ত্রোক্ত পঞ্চ-মকারের প্রতি ঘোরতর ঘৃণা ও অশ্রদ্ধা প্রদর্শন করেন"। উল্লেখ্য, বৌদ্ধ বা ব্রাহ্মণ্য, উভয় ঘরানার তন্ত্রেরই আকর উৎস বিভিন্ন আগমশাস্ত্র। আগমশাস্ত্র বস্তুতঃ আদি প্রযুক্তি প্রকৌশলের গ্রন্থিত সংগ্রহ। খেটেখাওয়া শ্রমজীবী সাধারণ মানুষই আদিতে যাবতীয় আগমশাস্ত্র প্রণয়ন করেছিল। কালক্রমে এইসব ভৌতশাস্ত্র আধিদৈবিক অতীন্দ্রিয় কর্মকান্ডের রূপ পরিগ্রহ করে ইতরজনের নাগালের বাইরে চলে যায়। 'সাধারণ' জনগোষ্ঠীর নৈতিকতায় 'মৈথুন' কখনই 'কদর্য, কুৎসিত' বোধ হয়নি। এই বোধটি আর্যায়নের সঙ্গে এসেছিল। শাস্ত্রকার এভাবে ব্যাখ্যা করছেন, "...আপাততঃ মৈথুন ব্যাপারটি অশ্লীলরূপে প্রতীয়মান হইতেছে, কিন্তু নিবিষ্টচিত্তে অনুধাবন করিলে, তন্ত্রশাস্ত্রে ইহার কতদূর গূঢ়ভাব সন্নিবেশিত আছে তাহা বুঝা যাইতে পারে। যেরূপ পুরুষজাতি পুংঅঙ্গের সহকারিতায় স্ত্রীযোনিতে প্রচলিত মৈথুন কার্য করিয়া থাকে, সেইরূপ 'র' এই বর্ণে আকারের সাহায্যে 'ম' এই বর্ণ মিলিত হইয়া তারকব্রহ্ম রাম নামোচ্চারণ রূপে তান্ত্রিক অধ্যাত্ম-মৈথুন ক্রিয়া নিষ্পাদিত হইয়া থাকে"।
শারীরিক মৈথুনের বিভিন্ন অঙ্গ, যেমন আলিঙ্গন, চুম্বন, শীৎকার, অনুলেপ, রমণ ও রেতোৎসর্গ - তেমনই আধ্যাত্মিক মৈথুন ও যোগক্রিয়ায় তার সমান্তরাল কৃত্য, সেখানে 'তত্ত্বাদিন্যাসের' নাম আলিঙ্গন, ধ্যানের নাম চুম্বন, আবাহনের নাম শীৎকার, নৈবেদ্যের নাম অনুলেপন, জপের নাম রমণ আর দক্ষিণান্তের নাম রেতঃপাতন। এই সাধনাটির নাম 'ষড়ঙ্গসাধন' এবং শিবের ইচ্ছায় একে 'অতীব গোপন' মোহর দেওয়া হয়েছিল। তাছাড়া "কলির জীব পঞ্চ ম-কারের মর্ম বুঝিতে পারিবে না বলিয়া কলিতে ইহা নিষিদ্ধ হইয়াছে"। অতএব ইতরজনের জন্য এইসব দর্শন 'নিষিদ্ধ' হয়ে গেল এবং উচ্চবর্গ তাদের হাতে শেষ পর্যন্ত পেন্সিল ছাড়া আর কিছু থাকতে দিল না ।
ইতরজন ও নারীজাতি এই সব শাস্ত্র প্রণয়নের সময় একই ধরনের সম্মান(?) লাভ করত। সাধনসঙ্গিনী নির্বাচনের যে প্রথাপ্রকরণ এ প্রসঙ্গে বর্ণিত হয়েছে, সেখানে নারীকে এক ধরনের বাণিজ্যিক পণ্য হিসেবে বোধ হতে পারে। নামে নারীই 'শক্তি', কিন্তু শক্তি সাধনের ষটকর্মে সাধনসঙ্গিনীর যে সব লক্ষণ নির্দেশ করা হয়েছে, তার থেকে সম্মাননা বা অবমাননার ব্যাপারটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। কিছু উল্লেখ করা যায়। যেমন, সাধনসঙ্গিনী হিসেবে পদ্মিনী নারী শান্তিদায়িনী। সে হবে গৌরাঙ্গী, দীর্ঘকেশী, সর্বদা অমৃতভাষিণী ও রক্তনেত্রা। শঙ্খিণী নারী হয় মন্ত্রসিদ্ধকারী। সে হবে দীর্ঘাঙ্গী এবং নিখিল জনরঞ্জনকারিণী। যে নারী নাগিনী গোত্রের, তার লক্ষণ হলো শূদ্রতুল্যদেহধারিণী, নাতিখর্বা, নাতিদীর্ঘ, দীর্ঘকেশী, মধ্যপুষ্টা ও মৃদুভাষিণী। এরপর কৃষ্ণাঙ্গী, কৃশাঙ্গী, দন্তুরা, মদতাপিতা, হ্রস্বকেশী, দীর্ঘঘোণা, নিরন্তর নিষ্ঠুরবাদিনী, সদাক্রুদ্ধা, দীর্ঘদেহা, মহাবাবিনী, নির্লজ্জা, হাস্যহীনা, নিদ্রালু ও বহুভক্ষিণী নারীকে ডাকিনী বলা হয়(যোগিনীতন্ত্রম)।
শাক্তদের মধ্যে দুটি প্রধান সম্প্রদায়ের নাম পশ্বাচারী ও বীরাচারী। দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে মূল প্রভেদ হচ্ছে বীরাচারে পঞ্চ-ম কারের প্রচলন আছে, পশ্বাচারে তা নেই। কুলার্ণবতন্ত্রে এই দু' প্রকার আচারকে আবার সাত ভাগ করা হয়েছে। সেখানে বলা হচ্ছে, বেদাচার উত্তম (এই বেদাচারের সঙ্গে বৈদিক আচারের কোনও সম্পর্ক নেই), বেদাচারের থেকে বৈষ্ণবাচার উত্তম, বৈষ্ণবাচার থেকে শৈবাচার উত্তম, শৈবাচার থেকে দক্ষিণাচার উত্তম, দক্ষিণাচার থেকে বামাচার উত্তম, বামাচার থেকে সিদ্ধান্তাচার উত্তম, সিদ্ধান্তাচারের চেয়ে কৌলাচার উত্তম। কৌলাচারের চেয়ে উত্তম আর কিছু নেই ("...রামপ্রসাদ বলে নিদানকালে পতিত হবি কুল ছাড়িলে / মন ভুলো না কথার ছলে...", এখানে 'কুল' শব্দ দ্ব্যর্থবোধক। তা বংশসম্প্রদায় ও কৌলাচারের প্রতি আনুগত্য দুইই বোঝায়)।
বিভিন্ন দেবতার যেমন নিজস্ব বিশেষ বীজমন্ত্র আছে, বিভিন্ন তান্ত্রিক ক্রিয়ারও বিশেষ বীজ আছে। কালিকার বীজ একাক্ষর, তারার বীজ ত্র্যক্ষর এবং বজ্রবৈরেচনীর বীজ একাদশাক্ষর। যোগিনীতন্ত্রে এই কথা শিবের উক্তিতে দেওয়া হয়েছে। দেবীর এই তিন রূপের মধ্যে তারা ও বজ্রবৈরেচনী বৌদ্ধ তন্ত্রের দেবী। পূর্ণাভিষেকের সময় স্বয়ম্ভূ-কুসুমাদির প্রতি যে শুদ্ধিমন্ত্র উচ্চারিত হয় তা এরকম, "প্লূং ম্লূং স্লূং শ্লূং স্বাহা"। আবার ব্রহ্মশাপ বিমোচন মন্ত্র, শুক্রশাপ বিমোচন মন্ত্র বা কৃষ্ণশাপ বিমোচন মন্ত্র মদ্যের প্রতি উৎসর্গিত হয়। এই সব শুদ্ধি মন্ত্র বা উৎসর্গ মন্ত্রে যেসব প্রতীক ব্যবহার করা হয়, তা এরকম। 'খপুষ্প' মানে রজস্বলা স্ত্রীলোকের রজ, স্বয়ম্ভূ পুষ্প বা স্বয়ম্ভূ কুসুম মানে স্ত্রীলোকের প্রথম রজ ("...যত বিষয় মধু তুচ্ছ হল, কামাদিকুসুম সকলে... কমলাকান্ত), কুন্ডপুষ্প মানে সধবা স্ত্রীলোকের রজ, গোলকপুষ্প মানে বিধবা স্ত্রীলোকের রজ এবং বজ্রপুষ্প মানে চন্ডালীর রজ (তন্ত্রসাধনায় এই 'চন্ডালী' নারীর বিশেষ কদর আছে)। এই লক্ষণটি তন্ত্রচর্চায় ইতরযানী স্বীকৃতির নিদর্শন। এই সব 'পুষ্প' বামাচারী তন্ত্র সাধনার জরুরি উপকরণ। বাউলচর্যাতেও আমরা এজাতীয় পদ্ধতির প্রচলন দেখতে পাই।
তন্ত্র শাস্ত্রে বিভিন্ন ইষ্ট দেবতা আছেন। ব্যক্তি বিশেষে কেউ কালী, কেউ তারা কেউ বা জগদ্ধাত্রীকে ইষ্ট করেন। এছাড়া অন্যান্য দেবীরাও আরাধ্যা হয়ে থাকেন। উক্ত সব শক্তি দেবীর দীর্ঘ তালিকা নথিবদ্ধ আছে। এই সাধন প্রণালীতে গুরু-শিষ্য পরম্পরা অতি জরুরি বিষয়। বিভিন্ন তন্ত্রে, যেমন পিচ্ছিলা তন্ত্র, বিশ্বসার তন্ত্র, কামাখ্যাতন্ত্র প্রভৃতিতে গুরুর লক্ষণ বিবৃত হয়েছে। গুরুকে সর্বশাস্ত্র পরায়ণ, নিপুণ, সর্ব শাস্ত্রজ্ঞ, মিষ্টভাষী, সুন্দর, সর্বাবয়ব সম্পন্ন, কুলাচার বিশিষ্ট, সুদৃশ্য, জিতেন্দ্রিয়, সত্যবাদী ইত্যাদি গুণশীল হতে হবে। শিষ্যের জন্যও নানা লক্ষণবিচার রয়েছে।
শিষ্যের দীক্ষাকালে গুরু বীজমন্ত্র উপদেশ দেন। এই বীজমন্ত্র বিভিন্ন ইষ্ট দেবীর জন্য পৃথক হয়। এই বীজমন্ত্রগুলি অতীব গুহ্য তাই তন্ত্রকারেরা তাদের গোপন রাখার প্রচেষ্টায় বিভিন্ন সাংকেতিক শব্দ ও তার নতুন অর্থ সৃষ্টি করেছেন। এই সব শব্দের যে সব অর্থ করা হয় তা শুধুমাত্র তন্ত্রশাস্ত্রে অধিকারী ব্যক্তিরাই উদ্ধার করতে পারেন। একে আদিম ক্ল্যাসিফায়েড কোডিং প্রসেসও বলা যায়।
এক আধটা উদাহরণ দিই। 'কালীবীজ' মন্ত্র, 'বর্গাদ্যং বর্ণহিসংযুক্তং রতিবিন্দুসমন্বিতম'। এখানে 'বর্গাদ্য' শব্দের প্রতীক হচ্ছে 'ক', 'বর্ণহি' শব্দের 'র', 'রতি' শব্দে 'ঈ' এবং তাতে বিন্দু যুক্ত। সব মিলিয়ে যে প্রতীকী শব্দটি তৈরি হলো তা হচ্ছে 'ক্রীং'। এইভাবে 'ভুবনেশ্বরী বীজ' 'হ্রীং', 'লক্ষ্মীবীজ' 'শ্রীং'। যৌগিক বীজও আছে, যেমন 'তারাবীজ' 'হ্রীং স্ত্রীং হূ ফট' বা 'দুর্গাবীজ' 'ওঁ হ্রীং দূং দুর্গয়ৈ নমঃ'। এই তালিকাটি অতি দীর্ঘ ও এখানে আলোচনা নিষ্প্রয়োজন। এছাড়া এমন কিছু বীজ আছে যেগুলি বিশেষ বিশেষ ক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত।
তন্ত্রসাধনে 'গ্রহণ'-এও সিদ্ধিলাভ সম্ভব :-
হিন্দু শাস্ত্রে 'গ্রহণ' নিয়ে অনেক বিধি-নিষেধ প্রচলিত থাকলেও তান্ত্রিক মতে, তান্ত্রিক সাধনার যাবতীয় সিদ্ধিলাভের উপযুক্ত সময় চন্দ্র বা সূর্যগ্রহণ। সমস্ত তান্ত্রিক তাঁদের মন্ত্র সাধনা এবং গুপ্ত সাধনায় সিদ্ধিলাভের জন্য বছর ভর গ্রহণের অপেক্ষায় থাকেন। তন্ত্র শাস্ত্রে এমন কিছু সাধনার উল্লেখ আছে, যাতে সিদ্ধি লাভ করতে গেলে প্রচুর পরিশ্রম আর কঠোর সাধনা করতে হয়। গ্রহণের সময় সেই সাধনায় বসলে অতি সহজে এবং অল্প সময়ে সাফল্য আসে। এবার জেনে নিন, কী কী সাফল্য পাওয়া যেতে পারে গ্রহণকাল থেকে---
চাকরি বা ব্যবসায় উন্নতি: চাইলে গ্রহণের আগে স্নান সেরে পুজোর ঘরে শ্রীযন্ত্র প্রতিষ্ঠা করুন। যন্ত্রের সামনে ঘিয়ের প্রদীপ জ্বালিয়ে দিন। গ্রহণ শুরু হওয়ার পর পঞ্চোপচারে শ্রীযন্ত্রের পুজো করুন। গ্রহণ শেষ না হওয়া পর্যন্ত এই মন্ত্র জপ করতে থাকুন: 'ওঁ শ্রীং হ্রীং শ্রীং কমলে কমলালয়ে প্রসীদ প্রসীদ শ্রীং হ্রীং শ্রীং কমলভ্যে নমঃ'। বাড়িতে আলাদা করে কোনও ঠাকুরঘর না থাকলে যে কোনও শান্ত, পবিত্র স্থানে যন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে পুজো করতে পারেন।
মামলায় জয় লাভ: সম্ভব যদি গ্রহণ শুরুর সময় বগলামুখী যন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে গোটা হলুদ, হলুদ ফুল আর কেশর দিয়ে পুজো করার পর ঘিয়ের প্রদীপ জ্বালিয়ে দেন। একই সঙ্গে পুজোর পর একটি তিনমুখী রুদ্রাক্ষও যন্ত্রের সামনে রাখতে হবে। গ্রহণ যতক্ষণ চলবে ততক্ষণ গোটা হলুদের মালা হাতে নিয়ে এই মন্ত্র জপ করতে হবে: 'ওঁ হ্রীং বগলামুখী সর্বদুষ্টানাং বাচং মুখং পদং স্তংভয় জিহ্বা কীলয় বুদ্ধি বিনাশায় হ্রীং ওঁ স্বাহা'।
তন্ত্রের ভুল ব্যবহার থেকে মুক্তি পেতে চাইলে গ্রহণের সময় একটি হলুদ, বড়ো, দাগহীন পাতিলেবু নিয়ে নিজের শরীরের ওপর সাতবার বুলিয়ে বা ঘুরিয়ে লেবুটিকে চার টুকরোয় কেটে ফেলুন। এবার সেই চারটি টুকরো চৌরাস্তার চার দিকে ফেলে দিয়ে আসুন।
দুর্গামন্ত্র :-
ভূ-লোকে রিদ্ধি-সিদ্ধি লাভের জন্য একটি মহাকুঞ্জিকা রচনা করেন মহাগৌরী পার্বতী। তিনি বলেন, তাঁর যে ভক্ত তাঁকে স্মরণ করে এই মন্ত্র উচ্চারণ করবে, সে এই সংসারে জীবন সুখ-শান্তিতে জীবন অতিবাহিত করবে। ধন-ধান্য এবং সমৃদ্ধির অভাব হবে না। এটি একটি গুপ্তমন্ত্র। এই মন্ত্র পাঠ করলে মারণ, মোহন, বশীকরণ এবং উচ্চাটন ইত্যাদি উদ্দেশের সিদ্ধি হয়।
এই মন্ত্রটি হল-- ওম এং হ্লীং ক্লীং চামুণ্ডায়ৈ ভিচ্চে। ওম গ্লৌং হুং ক্লীং জুং সঃ জ্বালয় জ্বালয় জ্বল জ্বল প্রজ্বল প্রজ্বল এং হ্লীং ক্লীং চামুণ্ডায়ৈ ভিচ্চে জ্বল হং সং লং ক্ষং ফট্ স্বাহা।
নমস্তে রুদ্ররুপিণ্যৈ নমস্তে মধুমর্দিনী। নমঃ কৈটভহারিণ্যৈ নমস্তে মহিষার্দিনী।। নমস্তে শুম্ভহন্ত্রয়ৈ চ নিশুম্ভাসুরঘাতিনী।। জাগতং হি মহাদেবী জপং সিদ্ধং কুরুষ্ব মে। এংকারী সৃষ্টিরুপায়ৈ, হ্রীংকারী প্রতিপালিকা।। ক্লীংকারী কামরুপিণ্যৈ বীজরুপে নমোস্তু তে। চামুণ্ডা চণ্ডঘাতী চ য়ৈকারী বরদায়িনী। ভিচ্চে চাভ্যদা নিত্যং নমস্তে মন্ত্ররুপিণি।। ধাং ধীং ধূং ধূর্জটেঃ পত্নী বাং বীং বুং বাগদীশ্বরী। ক্রাং ক্রীং ক্রুং কালিকা দেবী শাং শীং শুং মে শুভং কুরু।। হুং হুং হুংকাররুপিণ্যৈ জং জং জং জম্ভনাদিনী। ভ্রাং ভ্রীং ভ্রুং ভৈরবী ভদ্রে ভবান্যৈ তে নমো নমঃ।। অং কং চং টং তং পং য়ং শং বীং দুং এং বীং হং ক্ষং ধিজাগ্রং ধিজাগং ত্রোটয় ত্রোটয় দীপ্তং কুরু কুরু স্বাহা।। পাং পীং পূং পার্বতী পূর্ণা খাং খীং খূং খেচরি তথা।। সাং সীং সুং সপ্তশতী দেব্যা মন্ত্রসিদ্ধিং কুরুষ্ব মেব।। ইদং তু কুংজিকায় দেবী হীনাং সপ্তশতীং পেঠত্। ন তস্য জায়তে সিদ্ধিররণ্যে রোদং যথা।।
Continue-54
দুর্গা-মন্ত্রে দূর হবে সব বিপত্তি :-
দুঃখ-দারিদ্র্যে জর্জরিত ?
বা পারিবারিক কলহ রাতের ঘুম কেড়েছে ?
তা হলে এই দুর্গা মন্ত্রীগুলি জপ করলে সমস্ত বিপত্তি দূর হবে।
পরিবারে সুখের বাস হবে।
দারিদ্রতা এবং দুঃখ ইত্যাদি দূর করতে :-
দুর্গে স্মৃতা হরসি ভীতিমশেষজন্তোঃ স্বস্থৈঃ স্মৃতা মতিমতীব শুভাং দদাসি। দারিদ্র্যদুঃখভয়হারিণি কা ত্বদন্যা সর্বোপকারকরণায় সদার্দ্রচিত্তা।।
কলহ, অশান্তি দূর করে ভালোবাসা বৃদ্ধির জন্য :-
ধাং ধীং ধূং ধূর্জটে পত্নী ।
বাং বীং বূং বাগধীশ্বরী।।
ক্রাং ক্রীং ক্রূং কালিকা দেবী। শাং শীং শূং মেং শুভং কুরু।।
সুশীল এবং বিচার-বুদ্ধি সম্পন্ন স্ত্রীর প্রাপ্তির জন্য :-
ভার্য্যাং মনোরমাং দেহি মনোবৃত্ত্যনুসারিণীম্।
রূপং দেহি জয়ং দেহি যশো দেহি দ্বিষো জহি ।।
তারিণি দুর্গসংসার-সাগরস্যাচলোদ্ভবে।
রূপং দেহি জয়ং দেহি যশো দেহি দ্বিষো জহি ।।
কোনও বিপত্তির হাত থেকে বাঁচতে :-
শূলেন পাহি নো দেবী পাহি খড়গেন চাম্বিকো।
ঘণ্টাস্বনেন নঃ পাহি চাপজ্যানিঃস্বনেন চ।।
প্রসন্নতা প্রাপ্তির জন্য :-
প্রণতানাং প্রসীদ ত্বং দেবী বিশ্ববার্তিহারিণি।
ত্রৈলোক্যবাসিনামীড্যে লোকানাং বরদা ভব।।
মন্ত্র-গুণে সমস্যা সমাধান :-
কে না জানে, জীবন ইক্যুয়ালটু রকমারি সমস্যা! তা বলে লাগাতার সমস্যায় ভুগতে কার ভালো লাগে! অনেকেই জানেন না, যেমন হরেক কিসিমের সমস্যা আছে তেমনি তার নানা সমাধানও রয়েছে। আর সে সবই হয় মন্ত্রগুণে। তবে মন্ত্রে বিশ্বাস রাখতে হবে। শান্ত মনে জপ করতে হবে। সঙ্গে ধূপ জ্বালাতে পারলে আরও ভালো। তবেই ফল মিলবে। এবং মন শুদ্ধ করতে প্রথমে আরাধ্য দেবতা, গণেশ, গুরুদেব বা মহাদেব-কে স্মরণ করতে হবে।
এমনও হয়, দোষ না করেও আপনি দোষের ভাগীদার হয়ে যান। আর অকারণে লাঞ্ছিত হওয়ায় মন অস্থির হয়ে ওঠে। এই অসুবিধে দূর করতে জপ করুন 'ওঁ হ্রিং ঘৃণীঃ সূর্যায় আদিত্য শ্রী/ ওঁ হ্রিং জূং সঃ ক্লীং ক্লীং ক্লীং'।
কোনও গ্রহের প্রভাবে সব সময় ভয় বা ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কায় মন ভারাক্রান্ত হয়ে থাকে। এমন আশঙ্কাও হয় যে, ঘর থেকে বের হলেই ভয়ানক ক্ষতি হবে। তখন ঈশ্বরকে স্মরণ করে জপ করবেন 'ওঁ জূং সঃ (নিজের পুরো নাম) পালয় পালয় সঃ জূং ওঁ ওঁ ওঁ'
কর্মক্ষেত্রে উন্নতি চাইলে জপ করুন, 'ওঁ ভূর্ভুবঃ স্বঃ/ তত্সবিতুর বরেণ্যং/ ভর্গো দেবস্য ধীমহি/ ধিয়ো যোনঃ প্রচোদয়াত্ ক্লীং ক্লীং ক্লীং'
কোনও অঘটনের সম্মুখীন হয়ে যদি মৃত্যুভয় মনে আসে প্রথমে বলুন, 'ওঁ হ্রিং জূং সঃ'। তারপর বলুন, ওঁ ত্রম্বকং যজামহে/ সুগন্ধিং পুষ্টিবর্ধনম্/ উর্বারুকমিব বন্ধনান্/ মৃত্যোর্মুক্ষীয় মামৃতাত্'।।
মন যখন প্রচণ্ড চঞ্চল হয়ে ওঠে. কিছুতেই বশে থাকে না, তখন শান্ত করতে এই মন্ত্র জপ করুন, 'ওঁ দ্বৌঃ শান্তিরন্তরিক্ষক্ষং শান্তি/ পৃথ্বী শান্তিরাপঃ শান্তিরোষধয়ঃ শান্তি/ বনস্পতয়ঃ শান্তির্বিশ্বেদেবাঃ শান্তির্ব্রহ্ম শান্তিঃ/ সর্ব শান্তিঃ শান্তিরেব শান্তিঃ সা মা শান্তিরেধি/ ওঁ শান্তি শান্তি শান্তি'
হতে হতে কোনও হওয়া কাজ মাঝপথে আটকে গেলে জপ করুন, 'দেহি সৌভাগ্যমারোগ্যং দেহি দেবি পরং সুখম/ রূপং দেহি জয়ং দেহি যশো দেহি দ্বিষো জহি'।
পরীক্ষায় ভালো ফল করতে চাইলে এই মন্ত্র বলুন, 'এং হ্রিং এং/ বিদ্যাবন্তং যশস্বন্তং লক্ষীবন্তঞ্চ মাং কুরু/ রূপং দেহি জয়ং দেহি যশো দেহি দ্বিষো জহি এং এং এং'।
তন্ত্রশাস্ত্রের সঙ্গে সম্পৃক্ত কয়েকটি বিষয়সূত্র নিয়ে যে আলোচনা এখানে করলুম, সঙ্গতভাবেই তা অসম্পূর্ণ ও অগভীর। কিন্তু আমার চর্চার সূত্রে তন্ত্র-আগম-পুরাণ বিষয়ে বাংলায় যেসব চর্চা-ব্যাখ্যান দেখেছি, সেগুলি হয় ভক্তের উদ্গার নয়তো নিন্দুকের প্রচার। অথবা বাজারি গালগল্পের নিকৃষ্ট ভোজন। ইতিহাস ও সমাজতত্ত্বের নিরিখে আমাদের দেশের তন্ত্র ও শক্তিসাধনার ইতিবৃত্ত এখনও প্রকৃত অধিকারীর মনোযোগ পায়নি। আশা করি বিষয়টি কখনও ধীমান আলোচনার উপজীব্য হয়ে উঠবে। ততদিন পর্যন্ত আমরা রামপ্রসাদেই আশ্রয় নিয়ে রয়ে যাই না হয়,
"...আমায় মনমাতালে মাতাল করে,
আর মদমাতালে মাতাল বলে,
মন ভুলো না কথার ছলে..."
যোগ সাধনা ও প্রাণায়াম
(১ম পর্ব)
পূর্ণতা লাভ করে আত্মার মুক্তির উপায়কে যোগ বলে। যোগ শব্দটি ব্যাপকভাবে পরিচিত। সনাতন ধর্মের অন্যতম দুটি প্রধান স্তম্ভ সাংখ্য দর্শন এবং বেদান্ত উভয় মতই যোগকে সমর্থন করে। চার হাজার বছরেরও বেশি আগে ঋষি পতঞ্জলি এ যোগ আবিষ্কার করেন। পাতঞ্জল দর্শন সাংখ্যমতের ওপর প্রতিষ্ঠিত। সাংখ্যমতের প্রণেতা মহর্ষী কপিল এবং পাতঞ্জল দর্শনের প্রণেতা ঋষি পতঞ্জলি। পাতঞ্জল দর্শনকে পাতঞ্জল-সূত্র নামে অভিহিত করা হয়।
আত্মা মাত্রই অব্যক্ত ব্রহ্ম। বাহ্য ও আন্তঃপ্রকৃতি বশীভূত করে আত্মার এ ব্রহ্মভাব ব্যক্ত করাই জীবনের চরম লক্ষ্য। কর্ম, উপাসনা, মনঃসংযোগ অথবা জ্ঞান- এদের মধ্যে এক, একাধিক বা সব উপায়ের দ্বারা নিজের ব্রহ্মভাব ব্যক্ত করো ও মুক্ত হও- এটিই ধর্মের পূর্ণাঙ্গ সত্য। মতবাদ, অনুষ্ঠান পদ্ধতি, শাস্ত্র, মন্দির বা অন্য বাহ্য ক্রিয়াকলাপ এর গৌণ অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ মাত্র।
যোগ সাধনা ও প্রাণায়াম
(২য় পর্ব)
ধর্ম প্রত্যক্ষানুভূতির ওপর প্রতিষ্ঠিত। সব ধর্মাচার্যই ঈশ্বরকে দর্শন করেছেন। তারা প্রত্যেকেই আত্মদর্শন করেছেন। সবাই নিজ নিজ ভবিষ্যৎ দেখেছেন এবং অনন্ত স্বরূপ অবগত হয়েছেন। প্রত্যক্ষানুভূতি ছাড়া কেউই ধার্মিক হতে পারে না। যে বিজ্ঞানের দ্বারা এসব অনুভূতি হয় তার নাম যোগ।
যোগাগ্নি মানবের পাপ পিঞ্জরকে দগ্ধ করে, তখন চিত্তশুদ্ধি হয় এবং সাক্ষাৎ নির্বাণ লাভ হয়। প্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রণ করার কার্যকে যোগী নিজ কর্তব্য বলে মনে করেন। যোগী অধিক বিলাসিতা ও কঠোরতা দুই-ই পরিত্যাগ করবেন। অতিভোজনকারী, একান্ত উপবাসী, অধিক জাগরণকারী, অধিক নিদ্রালু, অতিরিক্ত কর্মপরায়ণ অথবা একেবারে নিষ্কর্মা- এদের কেউই যোগী হতে পারেন না।
(সংগৃহীত) যোগ সাধনা ও প্রাণায়াম
(৩য় পর্ব)
আমরা জানি শরীর হাজার বছর বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব হলেও চরমে সেই একই গতি। যেসব শক্তিতে দেহ বিধৃত রয়েছে, সেগুলো অপসৃত হলে দেহ থাকবে না। একমুহূর্তের জন্যও শরীরের পরিবর্তন নিবারণ করতে কেউই সমর্থ হয় না। শরীর আসলে কতগুলো পরিবর্তনের পরম্পরামাত্র। নদীর জলরাশি প্রতিমুহূর্তে পরিবর্তিত হচ্ছে, নতুন জলরাশি আসছে; কিন্তু দেখতে ঠিক আগের মতো। এ শরীরও তদ্রূপ। তথাপি শরীরকে সুস্থ ও বলিষ্ঠ রাখা আবশ্যক। কারণ শরীরের সাহায্যেই আমরা জ্ঞান লাভ করতে হবে। শরীরই আমাদের শ্রেষ্ঠ যন্ত্র। বিশ্বজগতে এ মানবদেহই শ্রেষ্ঠ দেহ এবং মানুষই শ্রেষ্ঠ জীব।
যোগ প্রধানত দুই প্রকার। একটিকে বলে অভাব যোগ এবং অন্যটিকে বলে মহাযোগ। যখন নিজেকে শূন্য ও সর্বপ্রকার গুণবিরহিতরূপে চিন্তা করা যায় তখন তাকে অভাব যোগ বলে। যে জোগে আত্মাকে আনন্দপূর্ণ, পবিত্র ও ব্রহ্মার সঙ্গে অভিন্নরূপে চিন্তা করা হয় তাকে মহাযোগ বলে। যোগী প্রতিটির সাহায্যেই আত্মসাক্ষাৎকার লাভ করেন। এই মহাযোগে যোগী নিজেকে ও সমূদয় জগৎকে ঈশ্বররূপে অনুভবন করেন। এটিই সব যোগের মধ্যে শ্রেষ্ঠ। এটিই রাজযোগ। এ ছাড়াও হঠযোগ, জ্ঞানযোগ, কর্মযোগ, ধ্যানযোগ, ভক্তিযোগ ইত্যাদি যোগ আছে।
(সংগৃহীত)
যোগ সাধনা ও প্রাণায়াম
(৪র্থ পর্ব)
হঠযোগ মূলত কতগুলো আসনের সমষ্টি। আসন সংখ্যা অসংখ্য হলেও যোগীরা ৭০টি আসনকে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বর্ণনা করেন। আসনগুলো আবার দু’ভাগে বিভক্ত। ধ্যানাসন ও স্বাস্থ্যাসন। যোগীকে নিয়মিতভাবে কতগুলো শারীরিক ও মানসিক প্রক্রিয়া পরপর অভ্যাস করতে হয়। দীর্ঘসময় একভাবে বসে থাকতে পারা যায় এমন একটি আসন অভ্যাস করা যোগীদের জন্য প্রয়োজন। ধ্যানাসনগুলোর মধ্যে পদ্মাসন, গোমুখাসন ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ। হঠযোগ কেবল স্থূল দেহ নিয়ে ব্যস্ত। এর উদ্দেশ্য কেবল স্থূল দেহকে সবল রাখা। মানুষকে দীর্ঘজীবী করাই হঠযোগের উদ্দেশ্য। স্বাস্থ্যই মুখ্য ভাব, এটিই হঠযোগীদের একমাত্র লক্ষ্য। আমার যেন পীড়া না হয় এটিই হঠযোগীর দৃঢ় সংকল্প। তার পীড়া হয় না, তিনি দীর্ঘজীবী হন। শতবর্ষ জীবিত থাকা তার পক্ষে কিছুই নয়। দেড়শ’ বছর বয়সে তিনি পূর্ণ যুবা ও সতেজ থাকেন। কিন্তু এ পর্যন্তই। বটবৃক্ষও কখনও কখনও পাঁচ হাজার বছর জীবিত থাকে, কিন্তু তা বটবৃক্ষই থেকে যায়, এর বেশি কিছু নয়।
রাজযোগের সঙ্গে দেহতত্ত্বের একটি গুরুত্বপূর্ণ সর্ম্পক আছে। মানুষের দেহ অস্থিরূপ স্তম্ভের ওপর বিধৃত, স্বায়ুরূপ রজ্জুর দ্বারা বদ্ধ, রক্ত ও মাংসের দ্বারা প্রলিপ্ত, চামড়ার দ্বারা আচ্ছাদিত, মূত্র ও বিষ্ঠার দ্বারা পূর্ণ ও দুর্গন্ধযুক্ত। দেহটি আবার জরা ও শোকে আক্রান্ত, নানারকম ব্যাধির আধার, ক্ষুধা-পিপাসায় কাতর, রজোগুণাসক্ত, অনিত্য এবং ভূতের বাড়ির মতো। এসব জেনে ভূতের বাড়ির মায়া পরিত্যাগ করা উচিত। যাতে পুনরায় এই দেহরূপ ভূতাগারে প্রবেশ করতে না হয় এজন্য মানুষকে চেষ্টা করা উচিত। আমাদের দেহে বাহাত্তর হাজার নাড়ি রয়েছে। এর মধ্যে ইড়া, পিঙ্গলা ও সুষুর্মা প্রধান। যোগসাধনকালে নানারকম কাজ শরীরের ভেতর চলতে থাকে। এর অধিকাংশই মেরুদণ্ডের ভেতর এবং সুষুর্মা নাড়ির মধ্যে হয়ে থাকে। ইড়া (চন্দ্র নাড়ি) মেরুদণ্ডের বামে এবং পিঙ্গলা (সূর্য নাড়ি) মেরুদণ্ডের ডানে অবস্থিত এবং সুষুর্মা নাড়ি মেরুদণ্ডের মাঝখানে অবস্থিত। ইড়া ও পিঙ্গলা আজ্ঞাবাহী নাড়ি এবং সব মেরুদণ্ড প্রাণীতেই এর কার্যকারিতা রয়েছে এবং মস্তিষ্কের আদেশে দেহ এর মাধ্যমেই কাজ করে।
(সংগৃহীত)
যোগ সাধনা ও প্রাণায়াম
(৫ম পর্ব)
মেরুদণ্ডের মাঝখানে সুষুর্মা নাড়ির অবস্থান এবং মেরুদণ্ডী প্রাণীর দেহেই এর অস্তিত্ব রয়েছে। মেরুদণ্ডের নিুাংশের সামান্য নিচে কুলকুণ্ডলিনী বা মূলাধারের অবস্থান এবং দেহের শক্তির কেন্দ্র এ মূলাধার। সাধারণ মানুষের এ সুষুর্মা নাড়ির কোনো কার্যকারিতা নেই এবং এর নিুাংশ বদ্ধ থাকে। যোগীরা যোগ সাধনের দ্বারা সুষুর্মার নিুাংশ খুল ফেলেন এবং শক্তি-ঊর্ধ্বমুখে চালিত করেন। মূলাধার থেকে মস্তিষ্ক পর্যন্ত ৭টি চক্র রয়েছে। সর্বনিম্ন ১. মূলাধার চক্র, ২. স্বাধিষ্ঠান চক্র, ৩. মনিপুর চক্র, ৪. অনাহত চক্র, ৫. বিশুদ্ধ চক্র, ৬. আজ্ঞা চক্র এবং ৭. মস্তিষ্কে সহস দল চক্র। নিুভূমি মূলাধার চক্র থেকে মস্তিষ্কে সহস দলে পৌঁছলে পাশবিক শক্তি ওজঃশক্তিতে পরিণত হয়। এ ওজঃশক্তিই মানুষের আধ্যাত্মিক শক্তির পরিচায়ক। মানুষের জ্যোতির্ময় দেহের কারণও এ ওজঃশক্তি। কুণ্ডলিনী জাগ্রত করাই দিব্যজ্ঞান, জ্ঞানাতীত অনুভূতি বা আত্মানুভূতি লাভের একমাত্র উপায়। কারও ভগবৎপ্রেমে, কারও সিদ্ধ মহাপুরুষের কৃপায় আবার কারও সূক্ষ্ম জ্ঞান বিচার দ্বারা কুণ্ডলিনী জাগরিত হয়।
আমাদের জীবনের চরম লক্ষ্য আত্মার সাক্ষাৎ উপলদ্ধি করা। আমাদের বিভিন্ন সংস্কার আত্মার স্বরূপকে আবৃত করার ফলে আমরা আত্মার প্রকৃত স্বরূপ অনুভব করতে পারি না। চিত্তহৃদে যতক্ষণ একটি তরঙ্গও থাকবে, ততক্ষণ আত্মার প্রকৃত স্বরূপ অনুভব হবে না। একটি তরঙ্গ এমনভাবে প্রবল করতে হবে যাতে অপর তরঙ্গগুলো একবারে তাতে লুপ্ত হয়ে যায়। যখন একটি মাত্র তরঙ্গ অবশিষ্ট থাকে তখন তাকে দমন করা সহজ হবে। যখন তাও চলে যাবে, তখন সে সমাধিকে নির্জীব সমাধি বলে। তখন আত্মা নিজ স্বরূপে নিজ মহিমায় অবস্থান করবে। আমরা তখনই জানতে পারব আত্মা মিশ্র বা যৌগিক পদার্থ নয়, আত্মাই জগতে একমাত্র নিত্য অমিশ্র মৌলিক পদার্থ। সুতরাং আত্মার জন্ম নেই, মৃত্যু নেই, আত্মা অমর, অবিনশ্বর, নিত্য, চৈতন্যময় সত্যস্বরূপ।
(সংগৃহীত) যোগ সাধনা ও প্রাণায়াম
(পর্বঃ০৬)
ভারতীয় দার্শনিকরা মনে করেন সমগ্র জগৎ দুটি উপাদানে গঠিত। এর একটির নাম আকাশ এবং অপরটির নাম প্রাণ। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের যাবতীয় বস্তু এ আকাশ থেকে উৎপন্ন এবং যাবতীয় শক্তি প্রাণ থেকে উৎপন্ন হয়। কল্পান্তে সব বস্তু এ আকাশে এবং সমস্ত শক্তি প্রাণে লয় হয়। সৃষ্টির শুরুতে আকাশের ওপর প্রাণের আঘাতে জগতের সব বস্তু ও শক্তির উৎপন্ন হয়। এ প্রাণকে নিয়ন্ত্রণ করাই প্রাণায়ামের একমাত্র উদ্দেশ্য। যে শক্তিটি শ্বাস-প্রশ্বাসের প্রাণস্বরূপ তাকে প্রাণ বলে।
মহাসমুদ্রের একটি বুঁদবুঁদও মহাসমুদ্রের সঙ্গে সংযুক্ত। সংসারের সামান্য ব্যক্তিও সেই অনন্ত শক্তির সঙ্গে সংযুক্ত। এ মহাসমুদ্রে জীবমাত্রই জন্মগত অধিকার। যেখানেই জীবনীশক্তির প্রকাশ, সেখানেই পশ্চাতে অনন্ত শক্তির ভাণ্ডার রয়েছে।
যে কেন্দ্রে সংবেদনগুলোর সংস্কারসমষ্টি অবশিষ্ট থাকে তাকে মূলাধার বলে বলে এবং ওই কুণ্ডলীকৃত ক্রিয়াশক্তিকে কুণ্ডলিনী বলে। যখন এ কুণ্ডলিনী শক্তিকে জ্ঞাতসারে সুষুর্মা নাড়ির ভেতর দিয়ে নেয়া যায় তখন তা এক কেন্দ্রের পর আরেক কেন্দ্রের ওপর ক্রিয়া করবে, অমনি প্রবল প্রতিক্রিয়া উৎপত্তি হবে। যখন দীর্ঘকাল সঞ্চিত বিপুল শক্তিপুঞ্জ তীব্র ধ্যানের শক্তিতে সুষুর্মামার্গ অতিক্রম করে তখন যে প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয় তা অতীন্দ্রিয় অনুভূতি। এ অবস্থায় মন জ্ঞানাতীত ভূমিতে আরোহণ করেছে বলা যায়। শক্তিপুঞ্জ যখন সমুদয় অনুভূতির কেন্দ্রস্বরূপ মস্তিষ্কে গিয়ে উপস্থিত হয় তখন সমুদয় মস্তিষ্ক এবং এর অনুভবসম্পন্ন প্রত্যেক পরমাণু থেকেই যেন প্রতিক্রিয়া হতে থাকে। ফলে মনের একেকটি স্তর উন্মুক্ত হয়ে যায় এবং তখন যোগী জগতের সূক্ষ্ম বা কারণাবস্থাটি উপলব্ধি করতে পারেন। এভাবেই জগতের সর্ববিষয়ে পূর্ণজ্ঞান হবে।
(সংগৃহীত)
যোগ সাধনা ও প্রাণায়াম
(৭ম পর্ব)
রাজযোগ অষ্ঠাঙ্গ : ১. যম : যম অর্থাৎ অহিংসা, সত্য, অস্তেয় (অচৌর্য), ব্রহ্মচর্য, অপরিগ্রহ; ২. নিয়ম : শৌচ, সন্তোষ, তপস্যা, স্বাধ্যায় (আধ্যাত্মশাস্ত্র পাঠ) এবং ঈশ্বরে আত্মসমর্পণ; ৩. আসন : দীর্ঘসময় একভাবে বসে থাকার জন্য নির্ধারিত ধ্যানাসন যেমন- পদ্মাসন, গোমুখাসন ইত্যাদি; ৪. প্রাণায়াম : শ্বাস-প্রশ্বাসের গতি নিয়ন্ত্রণ করার প্রচেষ্টা করাই প্রাণায়াম। শ্বাস-প্রশ্বাস আমাদের শরীরের শক্তির মূল জোগানদাতা এবং শক্তিকে নিয়মিত করে। প্রাণায়ামের ক্রিয়া তিন প্রকার, যেমন- ক. রেচক : শ্বাস দেহের বাইরে নেয়া অর্থাৎ নিঃশ্বাসকে রেচক বলে। খ. শ্বাস গ্রহণের মাধ্যমে বাইরের বাতাস দ্বারা দেহকে পূর্ণ করাকে পূরক বলে। গ. কুম্ভক : শ্বাস দেহের মধ্যে বা বাইরে আবদ্ধ করাকে কুম্ভক বলে। উপযুক্ত গুরু না থাকলে এবং গৃহীদের জন্য কুম্ভক নিষিদ্ধ। অনেকে মনে করেন প্রাণায়াম শ্বাস-প্রশ্বাসের ক্রিয়া, কিন্তু বাস্তবে তা নয়। প্রাণায়াম মূলত প্রাণের সংযম। প্রাণায়াম ফুসফুসের ক্রিয়ার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। শ্বাস-প্রশ্বাস দেহযন্ত্রের গতি নিয়ামক মূলচক্র। প্রাণ আমাদের শরীরযন্ত্রকে চালায় এবং শ্বাস-প্রশ্বাসই প্রাণশক্তির প্রত্যক্ষ প্রকাশ।
(সংগৃহীত)
0 Comments