Recent Posts

6/recent/ticker-posts

প্রারব্ধ সূত্রে যাহা উপস্থিত হয়, তার তাহাই ভোগ হয়; ইহার জন্য অনুতাপ করিতে নাই




 প্রারব্ধ সূত্রে যাহা উপস্থিত হয়, তার তাহাই ভোগ হয়; ইহার জন্য অনুতাপ করিতে নাই

জীবনের চলমান পরিপ্রেক্ষিতে আমরা প্রায়শই এমন ঘটনার সম্মুখীন হই, যা আমাদের কাম্য নয়—হঠাৎ ক্ষতি, প্রিয়জনের বিচ্ছেদ, প্রত্যাশার ব্যর্থতা কিংবা অকারণে কষ্ট। তখন মনে প্রশ্ন জাগে: "এ সব কিসের ফল?", কিংবা “আমি তো এমন কিছু করিনি, তবে কেন এমন হলো?” এইসব প্রশ্নের গভীরে প্রবেশ করলে দেখা যায়, আমরা অনেক কিছুই বুঝি না, যা আমাদের জীবনে ঘটে। শ্রীশ্রী রামঠাকুর তাই এক গভীর বাণী দিয়েছেন, যা একদিকে যেমন আত্মজীবনের সূত্র উন্মোচন করে, তেমনই অন্যদিকে শান্তি ও মমত্বের দ্বার খুলে দেয়।

তিনি বলেন:

"প্রারব্ধ সূত্রে যাহা যখন যার উপস্থিত করে, তার তাহাই ভোগ হয়; ইহার জন্য অনুতাপ এবং প্রয়াস করিতে নাই।"

এই বাণীর মূল কথা—জীবনে যা ঘটছে, তা কেবল আমাদের এই জন্মের কর্মফলের প্রতিফলন নয়; বহু জন্মের সঞ্চিত কর্মফল, যা পূর্বজন্মে আমরা নিজেরাই তৈরি করেছি। সেই কর্মই এখন ‘প্রারব্ধ’ হয়ে বর্তমান জীবনে ফল দিচ্ছে। এই সূত্রে কে কার সঙ্গে মিলবে, কবে কাকে হারাবে, কোন দুঃখ আসবে আর কোন আনন্দ—সবই পূর্বনির্ধারিত। একে এড়ানো যায় না, বদলানো যায় না।

প্রারব্ধ এমন এক অদৃশ্য বিধান, যা আমাদের জীবনের ছায়ারূপে চলে—আমরা চাই না, তবু ঘটে; আমরা চেষ্টাও করি, কিন্তু ফল অন্যরকম হয়। সেই কারণে ঠাকুর বলেন, এর জন্য অনুতাপ করে কোনো লাভ নেই। যা ঘটেছে, তা ঘটবারই ছিল। তার জন্য নিজেকে দোষারোপ করা, কিংবা অনবরত অতীত নিয়ে ভাবা আত্মার শান্তিকে নষ্ট করে। আবার ভবিষ্যতের ফল বদলাতে উদগ্র প্রয়াস করাও বৃথা—এতে জীবনে ক্লান্তি বাড়ে, অথচ ফল হয় না।

এই দৃষ্টিভঙ্গি মানবজীবনের ভেতরে এক নতুন আলো দেয়। যেখানে আর আমরা “কেন?”, “কিভাবে?”, “আমারই বা কী দোষ?”—এই আত্মকেন্দ্রিক প্রশ্নে আবদ্ধ থাকি না। বরং বুঝতে শুরু করি, এই জগত ঈশ্বরের এক বিশাল ন্যায়ের পরিক্রমা, যেখানে প্রতিটি ঘটনা কোনো না কোনো কর্মের ফল। সে কর্ম হয়তো এই জন্মে নয়, কিন্তু সে ফল অনিবার্য। অতএব, জীবনে যা কিছু আসছে, তা গ্রহণ করার শক্তিই প্রকৃত সাধনা।

এই মনোভাব তৈরি করে সাক্ষীভাব—যেখানে আমি নিজেকে কেবল দেহ-মন-ইন্দ্রিয়ের খেলায় এক ‘পর্যবেক্ষক’ হিসেবে অনুভব করি। আমি জানি, সুখ এলে তাকে আসতে দিই, দুঃখ এলে তাকেও স্বাগত জানাই—কারণ উভয়ই প্রারব্ধের ফল। এই উপলব্ধি থেকে জন্ম নেয় নিরাসক্তি, আর নিরাসক্তি থেকেই আসে আত্মিক শান্তি। তখন জীবনের অনিবার্য দুঃখও কাঁটার মতো বেদনাদায়ক হয় না, বরং হয়ে ওঠে আত্মার জাগরণের মাধ্যম।

আধ্যাত্মিকভাবে এ এক মহান তপস্যা—দেহের কষ্ট থাকলেও মনে অমল শান্তি। কারণ, জানি এ দুঃখও চিরস্থায়ী নয়, জানি এ আমারই কর্মের ফল, আর জানি আমি কেবল আত্মা—যা ভোগ করে না, কেবল প্রত্যক্ষ করে।

এই উপলব্ধিই আমাদের নিয়ে যায় ঈশ্বরচিন্তার দিকে। কারণ যখন নিজের চেষ্টা, অনুতাপ, বা নিয়ন্ত্রণ সব বিফল হয়, তখন একমাত্র ভরসা হয় ঈশ্বর। তখন আত্মা বলে—"আমি কেবল তোমার ইচ্ছার মধ্যেই চলছি।" এভাবে ‘ভোগ’ পরিণত হয় ‘ভগবানের স্মরণে’।

তাই শ্রীশ্রী রামঠাকুরের এই বাণী আমাদের মনে করিয়ে দেয়—জীবনের গভীর রহস্য বোঝার আগে আত্মাকে স্থির করতে হয়, মনের প্রবল প্রতিক্রিয়া থামাতে হয়। সুখ বা দুঃখ, লাভ বা ক্ষতি—সবই প্রারব্ধের প্রতিফলন। আমাদের কর্তব্য কেবল—জাগ্রত থাকা, প্রত্যক্ষ করা, এবং ঈশ্বরচিন্তায় স্থিত থাকা।

সত্যিকারের শান্তি তখনই আসে, যখন আমরা বলি: "যা ঘটছে, তা ঘটবারই ছিল। আমি কেবল দর্শক—আর তুমি কর্তা।"

✍️ তাৎপর্য ব্যাখ্যা: রতন কর্মকার

Post a Comment

0 Comments