পরশুরামের অবতারত্ব
*#পৌরানিক কাহিনীতে দেখা যায়, পরশুরাম মাতৃহত্যা করেছিলেন । হিংসার বশবর্তী হয়ে একুশবার পৃথিবীকে নিঃক্ষত্ৰীয় করেছিলেন । একটা মানুষ যে গুণে দৈবীসত্তা প্রাপ্ত হয় সেগুণও তাঁর ছিল না । তাহলে, হিংসায় উন্মত্ত পরশুরাম কি করে ঈশ্বরের গুণাবলী নিয়ে অবতার হিসেবে চিহ্নিত হতে পারেন?
*#আসলে এই গল্পটির একটি প্রতীকাৰ্থ আছে, প্রতীকাৰ্থ এই রকমঃ মাতা মানে শক্তি , জগৎ । শুন্যতার বুকে সুপ্ত এই শক্তি স্বভাবগুণে ফুটে উঠে গোলাকার জগৎ তৈরী করে । এই জগৎকে
হনন করে অর্থাৎ জয় করে অর্থাৎ নিষ্ক্রিয় করে সেই শূন্যতায় ফিরে যিনি যেতে পারেন তিনিই ঈশ্বররপে গ্রাহ্য হন । পরশুরাম এই জগৎকে জয় করে নির্গুন শূন্যতায় স্থিত হতে পারতেন । সুতরাং তিনি ছিলেন ঈশ্বরতুল্য । জগৎ অর্থাৎ শক্তিজয়ী হিসেবে তিনি মাতৃঘাতী । কারণ শক্তিকে স্ত্রীলিঙ্গ বা মাতারপে কল্পনা করা হয়।
*#ক্ষত্রীয় হলেন তিনিই যার মধ্যে সত্ত , রজঃ ও তমঃ গুণের মধ্যে রজঃ ও তমঃ গুণের প্রাধান্য বেশী। কোন সাধক একুশদিন সমাধিস্থ থাকলে এই রজঃ ও তমঃ গুণ সম্পূর্ণ নাশ হয় । তখন তিনি ঈশ্বরের নির্ভেজাল সত্ত্ব গুণের অধিকারী হন । পরশুরাম একুশ দিন সমাধিস্থ থেকে এই জড়প্রধান দুই গুণ অর্থাৎ রজঃ ও তমঃকে জয় করতে পেরেছিলেন বলেই একুশবার ক্ষত্রীয়নিধনকারী রুপে বর্ণিত হয়েছেন ।
*#পরশুরাম কুঠারধারী । এই কুঠার নরহত্যার প্রয়ােজনে ব্যবহৃত কুঠার নয় । এ হল জ্ঞানকুঠার যার দ্বারা অজ্ঞান রপ অন্ধকারকে ছেদন করে সত্যের সন্ধান পাওয়া যায় । সেইজন্য অদ্যাবধি শৈব সাধকেরা কুঠার প্রতীক ধারণ করে থাকেন ।
*#গল্পের এই প্রতীকাৰ্থ খুঁজে পেলে পরশুরামের অবতারত্বের যুক্তিযুক্ততা প্রমাণিত হয় । কিন্তু এই প্রতীকাৰ্থ ধরা না গেলে তা কুসংস্কার ও অজ্ঞানতাতুল্য হয় ।
(রতন কর্মকার)
*****ক্রিয়া*****
******
***#ক্রিয়া করলে মানবদেহ অধ্যাত্মজ্ঞানে আলোকিত হয়ে যায়। ক্রিয়া সাধনায় শরীর হয়ে ওঠে ভাগবত শরীর।
***#প্রথম ক্রিয়া মানুষের শরীরের বিভিন্ন গ্ল্যান্ড-কে মজবুত করে যা সমাধীলাভে সাহায্য করে।
***#দ্বিতীয় ক্রিয়ায় মনের উপর দখল আসে এবং
সাধকের ভিতরে জ্ঞানের আলো জ্বলে ওঠে।
***#তৃতীয় ক্রিয়া দূর করে দেয় মনের চাঞ্চল্য ।
***#চতুর্থ ক্রিয়া লিভার ও অগ্ন্যাশয় -কে সুস্থ করে এবং দেহের যৌন শক্তিকে পরিণত করে ভগবত শক্তিকে। অনেকে ভাবে কামকে বা যৌনতাকে নির্মূল করতে হয় । কিন্তু যৌনতাকে নির্মূল করলে সাধনায় অগ্রসর হওয়ার পথ বন্ধ হয়ে যায়। যৌনশক্তিকে ক্রিয়ার মাধ্যমে দমন করে তাকে কুলকুন্ডলিনী শক্তিতে রূপান্তরিত করতে হয় ।
***#এরপরও আরো উচ্চ ক্রিয়া আছে। এই যোগের জন্যে চাই নির্দিষ্ট আধার এবং সুস্থ সবল শরীর। আর সেইসাথে গুরুর প্রতি ভক্তি,নিবেদন ও অধ্যবসায়। তাহলেই ক্রিয়ায় এগিয়ে যাওয়া সম্ভব।
***#ক্রিয়াযোগের মাধ্যমেই প্রাণের অনন্ত গতিকে থামিয়ে স্থির ব্রহ্মের সাথে যুক্ত করে দেয়া যায়। সেই লক্ষেই চলে ক্রিয়াযোগীদের সাধনা।
Continue-1
প্রাণায়াম (Pranayama)
যে প্রক্রিয়া দেহের প্রাণশক্তি বৃদ্ধি করে এবং জরা, ব্যাধি ও অকালমৃত্যুর হাত থেকে দেহকে রক্ষা করে, তাই প্রাণায়াম।
***#প্রাণায়ামের কাজ হলো বায়ুকে অর্থাৎ নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসকে নিয়ন্ত্রিত করে দেহের প্রাণশক্তিকে বৃদ্ধি করা।
যোগ-শাস্ত্র অনুযায়ী বায়ুই দেহের প্রাণশক্তি এবং তা রস-রক্তকে প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে পরিচালিত করে। বায়ু প্রধানতঃ ‘প্রাণ’, ‘উদান’, ‘সমান’, ‘অপান’ ও ‘ব্যাণ’- এই পাঁচ ভাগে ভাগ হয়ে দেহের বিভিন্ন অঞ্চলে নিয়ত কাজ করে যাচ্ছে। গলদেশে ‘উদান’, হৃদয়ে ‘প্রাণ’, নাভিদেশে ‘সমান’, গুহ্যদেশে ‘অপান’ এবং দেহের সর্বত্র ‘ব্যাণ’ কার্যরত।
***#এই পাঁচ প্রকার বায়ুর মধ্যে সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো ‘প্রাণ’ বায়ুর। শ্বাসগ্রহণ ও ত্যাগ, হৃদযন্ত্র পরিচালনা করা, খাদ্যবস্তুকে পাকস্থলীতে পাঠানো, ধমনী-শিরা-উপশিরা দিয়ে রক্তরস আনা-নেয়া করা, ধমনী, শিরা, উপশিরা, স্নায়ুজালকে কাজে প্রবৃত্ত ও সাহায্য করা প্রভৃতি অতি প্রয়োজনীয় কাজগুলো নিয়ত এই প্রাণবায়ু করে যাচ্ছে। কাজেই দেহে প্রাণবায়ুর ভূমিকা প্রধান।
***#উদান বায়ুর কাজ হচ্ছে শব্দ করা। এই বায়ুর সূক্ষ্মাংশ বুদ্ধি ও স্মৃতিশক্তিকে পুষ্ট করে। ‘উদান’ বায়ুর সাহায্যে আমরা হাসি, কাঁদি, গান করি, শব্দ করি ইত্যাদি। ‘সমান’ বায়ু আমাদের জঠরাগ্নিকে উদ্দীপ্ত করে, পাকস্থলী থেকে জরাজীর্ণ খাদ্যবস্তুকে গ্রহণী নাড়ীতে পাঠিয়ে দেয়। তারপর সার ও অসার অংশে ভাগ করে অসার অংশকে মলনাড়ীতে পাঠিয়ে দেয়। ‘অপান’ বায়ুর কাজ হচ্ছে প্রাণবায়ুকে সাহায্য করা এবং মেয়েদের রজঃনিঃসরণ, সন্তানধারণ ও সন্তান প্রসবে সাহায্য করা ইত্যাদি। আর ‘ব্যাণ’ বায়ুর কাজ হচ্ছে প্রাণবায়ুকে রক্ত পরিচালনায় সাহায্য করা, পেশী সঙ্কোচন ও প্রসারণে সাহায্য করা এবং দেহ থেকে ঘাম বের করে দেয়া।
যোগ-শাস্ত্রে বলা হয়, এই পাঁচটি বায়ুর একটি কূপিত হলে দেহে রোগাক্রমণ ঘটে, আসে মৃত্যুর হাতছানি।
***#যোগ-শাস্ত্র মতে বায়ু গ্রহণকে ‘পূরক’, ধারণকে ‘কুম্ভক’ এবং ত্যাগকে ‘রেচক’ বলা হয়। এই তিন প্রকার কাজকে একসঙ্গে বলা যেতে পারে প্রাণায়াম। অন্যদিকে প্রাণ ও অপান-বায়ুর পরস্পর সংযোগকেও প্রাণায়াম বলা হয়ে থাকে। প্রাণায়াম প্রক্রিয়ায় শ্বাস গ্রহণ করতে সাধারণত যে সময় নেয়া হয়, শ্বাস ত্যাগ করতে প্রায় তার দ্বিগুণ সময় নিতে হয়। এ বিষয়ে নানা জনের নানা মত। অনেকে বলেন পূরক, কুম্ভক ও রেচকের অনুপাত ২ঃ ১ঃ ২ হওয়া উচিৎ। এক্ষেত্রে কুম্ভকের সময়কালকে অতীব গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা করা হয়। তা হতে হবে আয়াসহীন ও সুখকর। তবেই শরীরের কোন ক্ষতি হয় না। অর্থাৎ পূরক, কুম্ভক, রেচক যত সময় নিয়েই করা যাক না কেন, আয়াসহীন হওয়া চাই। শরীরের ক্ষতি তখনই হয়, যখন জোর করে ফুসফুসের শক্তির বিচার না করে শ্বাস-ব্যায়াম করা হয়। তাই প্রাণায়াম অভ্যাসের সময়কাল আপেক্ষিক এবং ব্যক্তি ভেদে ভিন্ন ভিন্ন হয়। প্রাণায়াম ততক্ষণ করা যেতে পারে, যতক্ষণ ফুসফুস ক্লান্ত না হয়। যখন দেখা যাবে, সে আর অতিরিক্ত পরিশ্রম করতে পারছে না, তখন তার প্রাণায়াম করা উচিৎ নয়।
***#বায়ুর প্রধান উপাদান চারটি। অক্সিজেন, হাইড্রোজেন, নাইট্রোজেন ও কার্বন। ফসফরাস, সালফার প্রভৃতি আরও কয়েকটি উপাদান আছে। সেগুলোও মূলত বায়ুরই পরিণতি। শ্বাসের সঙ্গে আমরা যে পরিমাণ বায়ু দেহে গ্রহণ করি, তা ঠিকমত কাজে লাগাতে বা দেহ উপাদানে পরিণত করতে পারলে আমাদের খাদ্য-সমস্যা অনেকটাই মিটে যেতো। অনেক যোগী দিনের পর দিন কোন খাবার না খেয়ে বেঁচে থাকতে পারেন। অথচ আমরা সাধারণ মানুষ একদিন না খেলেই আমাদের অবস্থা কাহিল হয়ে পড়ে। দেহ-বিজ্ঞানীদের মতে, আমাদের দেহের শতকরা বাষট্টি ভাগ অক্সিজেন দ্বারা গঠিত। শ্বাসের সঙ্গে আমরা যে বায়ু গ্রহণ করি এবং এতে যে শতকরা একুশ ভাগ অক্সিজেন থাকে, তার মাত্র চার ভাগ আমরা দেহের কাজে লাগাতে পারি। বাকি প্রায় সতের ভাগ আবার নিঃশ্বাসের সাথে দেহ থেকে বের হয়ে যায়। এই অভাব আমাদেরকে খাদ্যবস্তু দ্বারা পূরণ করতে হয়।
***#আমরা যদি এমন কিছু প্রক্রিয়া অভ্যাস করতে পারি, যার দ্বারা প্রচুর পরিমাণে বায়ু শরীরের ভেতরে নিতে পারি এবং তা দেহোপযোগী উপাদানে পরিণত করতে পারি তবে দেহের খাদ্য বা পুষ্টি-সমস্যা অনেকটা মিটে যায়। আবার যদি গভীরভাবে রেচক করতে পারি অর্থাৎ নিঃশ্বাস ছাড়তে পারি, তবে দেহের অপ্রয়োজনীয় কার্বন-ডাই-অক্সাইড বের হয়ে যেতে পারে এবং দেহও বিষমুক্ত হয়। কেবল প্রাণায়াম দ্বারাই এই কাজগুলো যথাযথ করা যেতে পারে। তাই প্রাণায়ামকে উত্তম শ্বাস-ব্যায়াম বলা হয়। এতে ফুসফুস ও হৃৎপিণ্ডের কর্মক্ষমতা ও সহনশীলতা বৃদ্ধি পায়। সুতরাং প্রাণায়াম অভ্যাস দীর্ঘ ও কর্মক্ষম জীবন লাভের একটি উৎকৃষ্ট উপায়।
আমাদের শরীরটা একটা দেহ-কারখানা। এখানে যেসব যন্ত্র আছে যেমন হৃদযন্ত্র, স্নায়ু, গ্রন্থি, ধমনী, শিরা, উপশিরা প্রভৃতি, সেগুলো সঠিকভাবে কাজ করলেই কেবল সুস্বাস্থ্য লাভ সম্ভব। স্বাস্থ্য রক্ষায় স্নায়ুজালের বিরাট ভূমিকা। শ্বাস-প্রশ্বাস, পরিপাক, রক্ত-রস সঞ্চালন প্রভৃতি কাজ স্নায়ুজালের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। আবার নালীহীন গ্রন্থিগুলোর ভূমিকাও দেহে কোন অংশে কম নয়। এইসব গ্রন্থিনিঃসৃত রস দেহকে রোগাক্রান্ত হওয়া থেকে রক্ষা করে, দেহযন্ত্রগুলোকে সুস্থ ও সক্রিয় রাখে এবং শক্তি যোগায়। এই গ্রন্থিগুলো যদি প্রয়োজনমতো রস নিঃসরণ না করে, তবে অন্যান্য দেহযন্ত্রের মতো স্নায়ুতন্ত্রও দুর্বল হয়ে পড়ে এবং তা একদিন অকেজো হয়ে যায়। তাই নালীহীন গ্রন্থির সক্রিয়তার উপর স্নায়ুতন্ত্রের কর্মক্ষমতা নির্ভর করে।
***#অন্যদিকে অক্সিজেনযুক্ত বিশুদ্ধ বায়ু ও রক্ত সংবহন ছাড়া নালীহীন গ্রন্থি ও স্নায়ুমণ্ডলী সতেজ ও সক্রিয় থাকতে পারে না। শ্বাসযন্ত্র যদি ঠিকমতো কাজ না করে, আবশ্যকীয় অক্সিজেন ফুসফুসে যেতে পারে না এবং দেহের কার্বন-ডাই-অক্সাইড, ইউরিয়া প্রভৃতি বিষও বের হয়ে যেতে পারে না। শ্বাসযন্ত্র ও পরিপাকযন্ত্র কর্মক্ষম না থাকলে দেহে এইসব বিষ জমতে শুরু করে। ফলে এক এক করে দেহযন্ত্রগুলো বিকল হয়ে আসতে থাকে। রক্তবাহী শিরা-উপশিরা এই বিষ ফুসফুসে টেনে আনে এবং নিঃশ্বাসের সঙ্গে তা বের হয়ে যায়। তেমনি মূত্রাশয় ও মলনাড়ী দেহের বিষ ও অসার পদার্থ বের করে দেয়।
মূত্রাশয় ও মলনাড়ী তলপেটে এবং ফুসফুস ও হৃৎপিণ্ড আমাদের বুকে অবস্থিত। এর মাঝে রয়েছে শক্ত পেশীর দেয়াল ‘ডায়াফ্রাম’। নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে সঙ্গে এই ডায়াফ্রামের যে উত্থান-পতন হয় এবং তলপেটের পেশীসমূহের যে সঙ্কোচন ও প্রসারণ হয়, তা দ্বারা প্লীহা, যকৃৎ, মূত্রাশয়, ক্ষুদ্রান্ত্র প্রভৃতিতে মৃদু কম্পন ও ঘর্ষণ লাগে। এতে করে এইসব যন্ত্রগুলোর ভালো ব্যায়াম হয়। অতএব, দেখা যাচ্ছে যে প্রাণায়াম শ্বাসযন্ত্র থেকে শুরু করে দেহের প্রধান প্রধান যন্ত্রগুলো সবল ও সক্রিয় রাখে। এছাড়া আমাদের নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসে এতো অনিয়ম যে ফুসফুস ঠিকমতো সবখানি উঠানামা করে না। সাধারণভাবে আমরা যখন দম নেই ও ছাড়ি তখন ফুসফুস অক্সিজেন গ্রহণের দ্বারা ২/৩ অংশ প্রসারিত হয়। ফলে ফুসফুসের ঠিক প্রয়োজনমতো ব্যায়াম হয় না। এতে ফুসফুস আস্তে আস্তে দুর্বল হয়ে আসতে থাকে। শ্বাসগ্রহণের সময় রোগ-জীবাণু ঐ দুর্বল ফুসফুসে গিয়ে বাসা বাঁধার সুযোগ পায়। ফলে দেহে নানা দূরারোগ্য রোগ দেখা দেয়। প্রণায়াম অভ্যাসের দ্বারা ফুসফুস ও হৃৎপিণ্ডের খুব ভালো ব্যায়াম হয় এবং আমরা ফুসফুসকে সম্পূর্ণভাবে প্রসারিত করতে পারি। ফলে শ্বাসযন্ত্র সবল ও সুস্থ থাকে আর তাদের কর্মক্ষমতাও বৃদ্ধি পায়।
***#একজন সুস্থ মানুষের সাধারণ শ্বাস-প্রশ্বাসের গতি মিনিটে ১৭/১৮ বার। প্রাণায়াম অভ্যাসের মাধ্যমে এই সাধারণ গতিবিধিকে ইচ্ছামতো কমিয়ে আনতে পারা যায়। এতে ফুসফুস ও হৃৎপিণ্ড বিশ্রাম পায়। এবং আমরা আমাদের চঞ্চল মনকে শান্ত করে নিজের কাছে বশীভূত করতে পারি।
প্রাণায়াম অভ্যাস করতে যে চারটি বস্তুর আয়ত্ত একান্ত প্রয়োজন তা হলো- (১) উপযুক্ত স্থান, (২) বিহিত কাল, (৩) পরিমিত আহার এবং (৪) নাড়ীশুদ্ধি।
এই নাড়ীশুদ্ধি বা নাড়ী শোধন প্রাণায়াম কোন প্রাণায়ামের অন্তর্ভূক্ত না হলেও যে কোন প্রাণায়াম অভ্যাসের আগে তা অভ্যাস করা বিশেষ প্রয়োজন। নাড়ী শোধন প্রাণায়াম বা অনুলোম বিলোম প্রাণায়াম অভ্যাসের ফলে প্রাণায়াম অভ্যাসকারী খুব সহজেই যে কোন প্রাণায়াম অভ্যাসের পদ্ধতি সহজেই আয়ত্ত করতে পারবে।
***#প্রাণায়াম অভ্যাসকারীদের যতদূর সম্ভব কিছু বিধিনিষেধ মেনে চলা উচিত-
১) সকালে বা সন্ধ্যায় নির্মল বায়ুতে প্রাণায়াম অভ্যাস করা বাঞ্ছনীয়। যেখানে বিশুদ্ধ বায়ু পাওয়া সম্ভব নয়, সেখানে সকালে সুর্যোদয়ের পূর্বে প্রাণায়াম অভ্যাস করা উত্তম।
২) প্রাতঃক্রিয়াদির পূর্বে, স্নানের পরে অথবা কোন শ্রমসাধ্য কাজের বা ব্যায়ামের ঠিক পরে প্রাণায়াম অভ্যাস করা উচিৎ নয়। কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে তবেই তা করা যেতে পারে।
৩) ঠাণ্ডা আবহাওয়ায় প্রাণায়াম করা আবশ্যক নয়। এরূপ ক্ষেত্রে কফ্-প্রবণ ব্যক্তির রোগ নিরাময় না হওয়া পর্যন্ত প্রাণায়াম করা নিষেধ। তবে, রোদ উঠলে করা যেতে পারে।
৪) ভরপেটে আসন, মুদ্রা, প্রাণায়াম কোনটাই করা উচিৎ নয়।
৫) শীর্ষাসনের পরে যেমন আর কোন আসন করা ঠিক নয়, তেমনি প্রাণায়ামের পর তখনকার মতো আর কোন ব্যায়াম করা উচিৎ নয়।
৬) প্রাণায়াম আট-নয় বছর বয়স থেকে আজীবন করা যেতে পারে। তবে অধিক বয়সে অভিজ্ঞদের পরামর্শ নেয়া বাঞ্ছনীয়।
৭) তাড়াহুড়ো করে, চিন্তাযুক্ত মন নিয়ে প্রাণায়াম, আসন, মুদ্রা কোনটাই করা ঠিক নয়। মন শান্ত, ধীর ও চিন্তাশূন্য রাখার চেষ্টা করতে হবে। আসন ও মুদ্রার মতো প্রাণায়াম অভ্যাসের সময়ও একাগ্রতা থাকা আবশ্যক।
***#প্রাণায়াম চার প্রকার- (১) সহজ প্রাণায়াম, (২) লঘু প্রাণায়াম, (৩) বৈদিক প্রাণায়াম ও (৪) রাজযোগ প্রাণায়াম। কোন গৃহীর পক্ষে এই চার ধরনের প্রাণায়াম আয়ত্ত করা সহজসাধ্য নয়। সদগুরু বা প্রাণায়াম সিদ্ধ যোগীর সাহায্য ব্যতীত কেবল বই পড়ে কোন শিক্ষার্থীর পক্ষে বৈদিক ও রাজযোগ প্রাণায়াম অভ্যাস করা উচিত নয়। এতে বিপদের যথেষ্ট সম্ভাবনা আছে। রাজযোগ প্রাণায়াম সাধারণতঃ গৃহীদের পক্ষে নিষিদ্ধ। কেবল যোগী ও সাধকই এই প্রাণায়াম অভ্যাসের অধিকারী। প্রথমোক্ত দু’ধরনের অর্থাৎ সহজ ও লঘু প্রাণায়ামই কেবল গৃহীরা দিনে দুইবার সকাল ও সন্ধ্যায় অভ্যাস করতে পারে।
***#সহজ প্রাণায়ামঃ
কুম্ভক ছাড়া পূরক ও রেচকসহ যে প্রাণায়াম অভ্যাস করতে হয় তাকেই সহজ প্রাণায়াম (Sahaja Pranayama) বলে। সহজ প্রাণায়াম অভ্যাসে একটু ভুলত্রুটি হলেও কোন প্রকার ক্ষতি হবার সম্ভাবনা থাকে না। তাই বালক, বৃদ্ধ এমন কি দুর্বল রোগীরা পর্যন্ত নির্দ্বিধায় এই প্রাণায়াম অভ্যাস করতে পারে। সহজ প্রাণায়াম অনেক ধরনের হয়ে থাকে। এ ধরনের কয়েকটি সহজ প্রাণায়ামের অভ্যাসবিধি দেয়া হলো-
***#সহজ প্রাণায়াম |০১|
পদ্ধতি:
পদ্মাসনে বা যে কোন ধ্যানাসনে সোজা হয়ে বসুন। এবার উভয় নাক দিয়ে শ্বাসগ্রহণ বা পুরক করুন। পুরকান্তে অর্থাৎ শ্বাসগ্রহণ শেষ হলে মুখ দিয়ে ধীরে ধীরে কিন্তু গভীরভাবে শ্বাসত্যাগ বা রেচক করুন। এইভাবে নিজ নিজ সামর্থমতো ২ থেকে ৫ মিনিট ধরে নাক দিয়ে বায়ু গ্রহণ বা পুরক করুন এবং মুখ দিয়ে ত্যাগ বা রেচক অভ্যাস করুন।
***#উপকারিতা:
এই প্রাণায়াম অভ্যাসে ফুসফুস, পাকস্থলী ও যকৃত সুস্থ সবল হয়ে ওঠে, এরা সহজে রোগাক্রান্ত হয় না। প্রাণায়ামটি অভ্যাসে রাখলে খোস, পাঁচড়া, ফোঁড়া প্রভৃতি রোগ হতে পারে না, আর এ সব রোগ থাকলেও অল্পদিনেই তা ভালো হয়ে যায়।
***#সহজ প্রাণায়াম |০২|
পদ্ধতি:
পদ্মাসনে বা যে কোন সহজ আসনে মেরুদণ্ড সরল ও সোজা রেখে বসুন। এবার চিবুক উর্ধ্বে তুলে উভয় নাক দিয়ে সশব্দে বুক ভরে শ্বাস গ্রহণ বা পুরক করুন। শ্বাসগ্রহণ শেষ হলে চিবুক কণ্ঠকূপে রাখুন এবং উভয় নাক দিয়ে সশব্দে শ্বাস ত্যাগ বা রেচক করুন। এখন আবার চিবুক উঁচু করুন এবং একইভাবে শ্বাস গ্রহণ করে চিবুক কণ্ঠকূপে রেখে শ্বাস ত্যাগ করুন। এভাবে সহজভাবে নিজ নিজ সামর্থ অনুযায়ী দুই থেকে চার মিনিট বা যতটুক পারুন অভ্যাস করুন।
প্রাণায়ামটি ভালোভাবে অভ্যাস হয়ে গেলে শ্বাসগ্রহণ বা পুরকের সময়ের চেয়ে শ্বাসত্যাগ বা রেচকের সময় একটু বেশি নেবে।
***#উপকারিতা:
এই প্রাণায়াম অভ্যাসে ফুসফুসের ভালো কাজ হয়, সর্দি-কাশি নিরাময় হয় এবং ইনফ্লুয়েঞ্জা, নিউমোনিয়া, ব্রঙ্কাইটিস, টাইফয়েড প্রভৃতি রোগ সহজে হতে পারে না, প্রতিরোধক শক্তি বৃদ্ধি পায়।
***#সহজ প্রাণায়াম |০৩|
পদ্ধতি:
পদ্মাসন, বজ্রাসন বা যে কোন সহজ ধ্যানাসনে বসুন। এবার উভয় নাক দিয়ে বুক ভরে শ্বাস গ্রহণ বা পুরক করুন। শ্বাসগ্রহণ শেষ হলে মুখ ও ঠোঁট পাখির চঞ্চু বা ঠোঁটের মতো ছোট করে সজোরে এবং থেমে থেমে শ্বাস ত্যাগ বা রেচক করুন। অর্থাৎ অল্প বায়ু ত্যাগ করে একটু থামুন, আবার অল্প বায়ু ত্যাগ করুন। এভাবে শ্বাস গ্রহণ ও ত্যাগ করে দুই থেকে তিন মিনিট বা ৬/৭ বার প্রাণায়ামটি অভ্যাস করুন।
***#উপকারিতা:
যোগশাস্ত্রীদের মতে এই সহজ প্রাণায়ামে অভ্যাসে বিভিন্ন রকমের কাশি, সর্দি, ব্রঙ্কাইটিস, হাঁপানি, প্লুরিসি, যক্ষ্মা, নিউমোনিয়া, টাইফয়েড, ইনফ্লুয়েঞ্জা প্রভৃতি বিশ রকমের কফরোগ নিরাময় হয়। শ্বাসনালী সতেজ ও সুস্থ থাকে, মুখের সৌন্দর্য্য বৃদ্ধি করে এবং মুখের যাবতীয় ব্যাধি এমনকি মুখের পক্ষাঘাত জাতীয় রোগ পর্যন্ত নিরাময় হয়।
***#সহজ প্রাণায়াম |০৪|
পদ্ধতি:
পদ্মাসন বা যে কোন সহজ ধ্যানাসনে বসুন। এবার অনেকক্ষণ সময় নিয়ে ধীরে ধীরে উভয় নাক দিয়ে সাধ্যমতো বুক ভরে শ্বাস গ্রহণ বা পুরক করুন। শ্বাসগ্রহণ শেষে মুখের পেশী ও স্নায়ুর উপর জোর দিয়ে হাঁ করে মুখ দিয়ে সজোরে শ্বাস ত্যাগ বা রেচক করুন। এভাবে নিজ নিজ সামর্থমতো ২ থেকে ৫ মিনিট প্রাণায়ামটি অভ্যাস করুন।
***#উপকারিতা:
এই প্রাণায়াম অভ্যাস কণ্ঠস্বরে মাধুর্য্যতা বাড়ায়। বিশেষ করে সঙ্গীত শিক্ষার্থীদের কণ্ঠস্বরের মিষ্টতা বজায় রাখতে এবং কণ্ঠের কম্পন আয়ত্ত করতে সাহায্য করে।
***#সহজ প্রাণায়াম |০৫|
পদ্ধতি:
পদ্মাসনে বা যে কোন ধ্যানাসনে সোজা হয়ে বসুন। এবার রেচক প্রক্রিয়ায় বা শ্বাস ত্যাগ করতে করতে পেট বা উদর বায়ুশূন্য করুন। শ্বাসত্যাগ শেষ হলে এখন উদর ও তলপেট বা নাভিপ্রদেশ সাধ্যমতো মেরুদণ্ডের সাথে লাগাতে আকুঞ্চন করতে করতে উভয় নাক দিয়ে শ্বাসগ্রহণ বা পুরক করতে থাকুন। খেয়াল রাখতে হবে আকুঞ্চনের সময় যেন উদরের পেশীতে টান না পড়ে। শ্বাসগ্রহণ শেষ হলে ধীরে ধীরে শ্বাসত্যাগ বা রেচকের সঙ্গে সঙ্গে উদর ও নাভিপ্রদেশের আকুঞ্চন শিথিল করে দিন। এভাবে প্রাণায়ামটি ২ থেকে ৫ মিনিট অভ্যাস করুন।
***#উপকারিতা:
এ প্রাণায়াম নিয়মিত অভ্যাস করলে হজম শক্তি বৃদ্ধি করে যাবতীয় অজীর্ণতা দূর করে এবং উদর ও নাভিপ্রদেশের স্নায়ু ও পেশীগুলোকে সতেজ ও সবল করে অপ্রয়োজনীয় চর্বি জমতে দেয় না। প্লীহা, যকৃৎ, মূত্রাশয়, অগ্ন্যাশয়, যৌনগ্রন্থি প্রভৃতি সুস্থ ও সক্রিয় রাখে। হাঁপানী রোগীদের জন্যেও তা বিশেষ উপকারী।
***#সহজ প্রাণায়াম |০৬|
পদ্ধতি:
পদ্মাসনে বা যে কোন সহজ ধ্যানাসনে সোজা হয়ে বসুন। এবার দমভরে পুরক বা শ্বাস নিতে থাকুন এবং একইসাথে তলপেট বা নাভিপ্রদেশ আকুঞ্চন করে ভেতরের দিকে টেনে নিন। শ্বাস নেয়া শেষ হলে নাক বন্ধ করে মুখে ফু দিয়ে রেচক বা শ্বাসত্যাগ করুন এবং নাভিপ্রদেশ শিথিল করে দিন। এভাবে ২ থেকে ৫ মিনিট প্রাণায়ামটি অভ্যাস করুন।
***#উপকারিতা:
এ প্রাণায়াম অভ্যাসে হজমশক্তি বৃদ্ধি পায় এবং যাবতীয় পেটের পীড়া নিরাময় করে। পেট ও তলপেটের মাংসপেশী দৃঢ করে এবং এ অঞ্চলের স্নায়ুজাল সক্রিয় রাখে। প্লীহা, যকৃৎ, অগ্ন্যাশয়, মূত্রাশয় ও যৌনগ্রন্থি সুস্থ ও সক্রিয় রাখে। এ প্রাণায়াম দেহের কুপিত বায়ু সহজে বের করে দেয। রাত্রে যাদের ভালো ঘুম হয় না, নাক-মুখ দিয়ে গরম হাওয়া বের হয়, তাদের জন্য এই প্রাণায়ামটি অত্যন্ত উপকারী।
***#সহজ প্রাণায়াম |০৭|
পদ্ধতি:
সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বাঁ হাত বাঁ বুকের উপর এবং ডান হাত ডান বুকের উপর রাখুন। কনুই দুটোকে পেছনদিকে যথাসাধ্য ভেঙে রাখুন। এখন উভয় নাক দিয়ে ধীরে ধীরে ও গভীরভাবে পুরক বা শ্বাস নিতে থাকুন। যতক্ষণ শ্বাস নেয়া অব্যাহত থাকবে ততক্ষণ বুক ও হাতের পেশী ও স্নায়ু সটান থাকবে। এবার ধীরে ধীরে রেচক বা শ্বাসত্যাগের সঙ্গে সঙ্গে ওগুলো শিথিল করে দিন। এভাবে ২ থেকে ৪ মিনিট প্রাণায়ামটি অভ্যাস করুন।
***#উপকারিতা:
এ প্রাণায়াম অভ্যাসে ফুসফুস ও শ্বাসক্রিয়া সতেজ ও সক্রিয় হওয়ার সাথে সাথে বুকের গড়ন সুঠাম ও সুন্দর করে। বয়েস অনুযায়ী যাদের বুক সরু বা অপরিণত, তাদের জন্য প্রাণায়ামটি খুবই উপকারী।
***#সহজ প্রাণায়াম |০৮|
পদ্ধতি:
পা দুটো জোড়া করে সোজা হয়ে দাঁড়ান। এখন হাত দুটো কাঁধ বরাবর সামনে উপরে তুলুন। এবার রেচক বা শ্বাস ছাড়তে ছাড়তে কিছুটা নত হয়ে দু’হাত দিয়ে দু’ হাঁটু স্পর্শ করুন। প্রক্রিয়াটা এমনভাবে হবে যেন শ্বাসত্যাগও শেষ হবে আর হাতও হাঁটু স্পর্শ করবে। এখন পুরক বা শ্বাস নিতে নিতে সোজা হয়ে দাঁড়ান যেন শ্বাস নেয়াও শেষ হয় এবং সেই সঙ্গে দেহটাও সোজা হয়। এভাবে ২ থেকে ৫ মিনিট প্রাণায়ামটি অভ্যাস করুন।
***#উপকারিতা:
প্রাণায়ামটি অভ্যাসে বিশেষ করে ফুসফুসের বায়ুধারণ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায় এবং যক্ষ্মারোগ প্রতিরোধ করে।
***#সহজ প্রাণায়াম |০৯|
পদ্ধতি:
পা দুটো জোড়া রেখে সটান চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ুন। হাত দুটো পাঁজরের দু’পাশে লম্বা করে রাখুন। এখন ধীরে ধীরে ও গভীরভাবে পুরক বা শ্বাস নিতে নিতে হাত দুটো উপরদিকে তুলুন এবং মাথার পেছনদিকে নিয়ে লম্বা করে মাটিতে রাখুন। প্রক্রিয়াটি এমনভাবে হবে যেন শ্বাস নেয়াও শেষ হবে আর হাত দুটোও মাথার পেছনে মাটিতে লাগবে। এরপর রেচক বা শ্বাস ছাড়তে ছাড়তে হাত দুটো পূর্বাবস্থায় পাঁজরের দু’পাশে মাটিতে রাখুন যেন শ্বাসত্যাগও শেষ হয় এবং হাত দুটোও পূর্বাবস্থায় মাটিতে আসে। এভাবে ২ থেকে ৫ মিনিট প্রাণায়ামটি অভ্যাস করুন।
এবার হাত দুটোকে বিশ্রাম দিয়ে পা দুটো দিয়ে অভ্যাস করুন। প্রথমে পুরক বা শ্বাস নিতে নিতে ডান পায়ের হাঁটু না ভেঙে সোজা অবস্থায় রেখে যতদুর সম্ভব উপরে তুলুন। এরপর রেচক বা শ্বাস ছাড়তে ছাড়তে পা’টিকে পূর্বাবস্থায় নিয়ে আসুন। এখন বাঁ পা দিয়েও একইভাবে অভ্যাস করুন। এভাবে পা বদল করে করে করে ২ থেকে ৪ মিনিট প্রাণায়ামটি অভ্যাস করুন।
তারপর দু’ পা একসঙ্গে করে একই ভাবে প্রাণায়ামটি ২/৩ মিনিট অভ্যাস করুন।
***#উপকারিতা:
এ প্রাণায়াম অভ্যাসে ফুসফুসের বায়ুধারণ ক্ষমতা বৃদ্ধির পাশাপাশি হাত, পা ও তলপেটের পেশী দৃঢ় ও সবল করে এবং এসব অঞ্চলের স্নায়ুজাল সতেজ ও সক্রিয় রাখে। সর্দি কাশি নিরাময় করতেও এ প্রাণায়াম উপকারী।
***#সহজ প্রাণায়াম |১০|
পদ্ধতি:
শবাসনে শুয়ে দেহটাকে শিথিল করে দিন। হাত দুটো পরস্পর অঙ্গুলিবদ্ধ করে নাভির উপর রাখুন। এবার উভয় নাক দিয়ে ধীরে ধীরে দমভরে পুরক বা শ্বাস গ্রহণ করুন। শ্বাসগ্রহণ শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে ধীরে ধীরে রেচক বা শ্বাসত্যাগ করুন। পুরক বা শ্বাসগ্রহণকালে চিন্তা করতে হবে- বায়ুস্থ প্রাণশক্তি আমার দেহের মধ্যে প্রবেশ করে নাভিদেশে অবস্থিত সূর্যগ্রন্থি বা প্যাংক্রিয়াস গ্ল্যান্ডে জমা হচ্ছে এবং শ্বাস ত্যাগ বা রেচককালে মনে করতে হবে- সূর্যগ্রন্থিতে সঞ্চিত প্রাণ-শক্তি দেহের প্রতিটা রন্ধ্র, গ্রন্থি, স্নায়ু ও শিরা-উপশিরায় পরিব্যাপ্ত হয়ে গোটা দেহকে প্রাণবন্ত করে চলেছে এবং দেহে সঞ্চিত দূষিত পদার্থ ও রোগ জীবাণু বিষ বায়ুর সঙ্গে বের হয়ে যাচ্ছে।
এভাবে প্রাণায়ামটি নিজ সামার্থ্য মতো ৫ থেকে ১০ মিনিট অভ্যাস করুন।
***#উপকারিতা:
নিয়মিত এ প্রাণায়ামের অভ্যাস নীরোগ দেহ এবং প্রবল ইচ্ছাশক্তি-চিন্তাশক্তি সম্পন্ন বলিষ্ঠ মন গঠনে বিশেষভাবে সহায়তা করে। দেহ ও মনকে প্রশান্তিময় করে তোলে।
***#ভ্রমণ-প্রাণায়াম (Bhramana-Pranayama)
কুম্ভক ছাড়া পূরক ও রেচকসহ যে প্রাণায়াম অভ্যাস করতে হয় তাকেই সহজ প্রাণায়াম (Sahaja Pranayama) বলে। তাই কুম্ভকের ব্যবহার নেই বলে ভ্রমণ-প্রাণায়াম এই সহজ-প্রাণায়ামেরই অন্তর্ভূক্ত।
***#পদ্ধতি:
মেরুদণ্ড সরল ও টানটান রেখে সোজা হয়ে সমান তালে হাঁটুন। হাঁটার সময় প্রতি ৪ (চার) পদক্ষেপের সাথে সাথে মনে মনে ১, ২, ৩, ৪ গুনতে হবে এবং একই সাথে উভয় নাক দিয়ে পুরক বা শ্বাস গ্রহণ করুন। পুরক বা শ্বাসগ্রহণ শেষ হওয়া মাত্রই আবার ৪ (চার) পদক্ষেপের সঙ্গে আগের মতো মনে মনে ১, ২, ৩, ৪ গুনার সাথে সাথে উভয় নাক দিয়ে রেচক বা শ্বাস ত্যাগ করুন। ৩/৪ সপ্তাহ এভাবে অভ্যাসের পর এবার ১ থেকে ৪ পর্যন্ত গুনতে গুনতে পুরক বা শ্বাস নিতে হবে, কিন্তু রেচক বা শ্বাস ছাড়ার সময় ১, ২, ৩, করে ৬ পর্যন্ত গুনতে হবে এবং সময় নিতে হবে। আবার কিছুদিন অভ্যাসের পর এভাবে ৬ পর্যন্ত গুনে শ্বাস নিতে হবে এবং শ্বাস ছাড়তে হবে ৮ পর্যন্ত গুনে। এভাবে আরো কিছুদিন অভ্যাসের পর ৮ পদক্ষেপ পর্যন্ত পুরক বা শ্বাস নেয়া এবং ১২ পদক্ষেপ পর্যন্ত রেচক বা শ্বাস ছাড়ার অভ্যাস রপ্ত হয়ে গেলে সাধ্যে কুলালে একইভাবে ১২ পদক্ষেপ পর্যন্ত পুরক বা শ্বাস গ্রহণ এবং ১৮ পদক্ষেপ পর্যন্ত রেচক বা শ্বাস ছাড়ার অভ্যাস করা যেতে পারে। এরপর আর মাত্রা বাড়াবার দরকার হয় না। শ্বাস-প্রশ্বাস নিয়ন্ত্রণ অভ্যাসের মাধ্যমে এভাবে হাঁটাকে ভ্রমণ-প্রাণায়াম বলে। এই ভ্রমণ-প্রাণায়াম নিজ নিজ সামর্থানুযায়ী ১০/১৫ মিনিট থেকে এক ঘণ্টাও করা যেতে পারে। কিংবা অভ্যাসের সময়কাল আরো বাড়ালেও কোন ক্ষতি হয় না।
***#ক্ষতি তখনই হবে যদি প্রাণায়ামটি অভ্যাসের সময় হাঁপ ধরে যায়। কেননা প্রাণায়াম অভ্যাস সব সময়ই আয়াসহীন হওয়া চাই। হাঁপ ধরে গেলে স্বাভাবিক নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস রেখে বিশ্রাম নিতে হবে। প্রাণায়ামটি অভ্যাসের সময় যদি বাঁ বুকে একটু চিনচিনে ব্যথা অনুভূত হয়, বুঝতে হবে, ফুসফুসের ক্ষমতা অনুযায়ী মাত্রা বেশি হয়ে যাচ্ছে। সেক্ষেত্রে ওইদিন ওইখানেই অভ্যাস বন্ধ রাখতে হবে। একদিন সম্পূর্ণ বিশ্রাম নিয়ে এক মাত্রা কমিয়ে পুনরায় শুরু করতে হবে।
এ প্রাণায়াম প্রাতে ও সন্ধ্যায় খোলা বা মুক্ত স্থানে, মাঠে বা ধূলাবিহীন রাস্তায় নির্মল বায়ুতে অভ্যাস করা বাঞ্ছনীয়।
***#উপকারিতাঃ
এই ভ্রমণ-প্রাণায়াম সবার পক্ষে বিশেষ উপকারী। বয়স্ক বা বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের জন্য তা মৃতসঞ্জীবনীর কাজ করে থাকে। তবে তার মাত্রা স্বাস্থ্যানুযায়ী হতে হবে। অন্যান্য প্রাণায়ামে যত রকমের উপকার রয়েছে তার প্রায় সবই এই ভ্রমণ-প্রাণায়ামে রয়েছে। নিয়মিত ও নিয়মানুযায়ী প্রাণায়ামটি অভ্যাস রাখলে যক্ষ্মা, হাঁপানি, ইনফ্লুয়েঞ্জা প্রভৃতি রোগ কখনোই হতে পারে না এবং ফুসফুস ও হৃদযন্ত্রাদি অধিক কর্মক্ষম থাকে। রক্ত অধিকতর পরিশোধিত হয়।
অন্য ব্যায়াম না করেও কেবল ভ্রমণ-প্রাণায়াম অভ্যাস রাখলে দেহ চমৎকার রোগমুক্ত থাকে। যে কোন রোগ থেকে আরোগ্যের পরপরই এই প্রাণায়াম অভ্যাস করলে রোগীর শারীরিক দুর্বলতা কাটিয়ে স্বাস্থ্য পুনরুদ্ধার সহজ হয়।
***#নাড়ী শোধন প্রাণায়াম (Nadi Shodhana Pranayama)
পদ্ধতি:
পদ্মাসন বা যে কোন সহজ ধ্যানাসনে শিরদাঁড়া সোজা অথচ শিথিল রেখে (চোখ বন্ধ থাকা ভালো) স্বাভাবিক অবস্থায় বসুন। এবার ডান হাতের বৃদ্ধাঙ্গুলি ডান নাকে এবং কনিষ্ঠা ও অনামিকা আঙ্গুলদ্বয় একত্রে বাঁ নাকের কাছে নিয়ে যান। তর্জনি এবং মধ্যমা আঙুলদ্বয় একত্রে ভাঁজ হয়ে হাতের তালু স্পর্শ করে থাকবে।
এখন বৃদ্ধাঙ্গুলি দিয়ে ডান নাক চেপে ধরে ছিদ্র বন্ধ করে বাঁ নাক দিয়ে ধীরে ধীরে যতটা সম্ভব বুক ভরে পুরক বা দম নিতে থাকুন। শ্বাস নেয়া শেষ হলে এবার একত্রে কনিষ্ঠা ও অনামিকা আঙ্গুল দিয়ে বাঁ নাক চেপে ছিদ্র বন্ধ করে ডান নাক দিয়ে রেচক বা দম ছাড়তে থাকুন। রেচকের পরপরই বাঁ নাক চেপে রেখেই এখন ডান নাক দিয়ে পুরক বা দম নিন এবং পুরক শেষ হলে বুড়ো আঙুলে ডান নাক চেপে বাঁ নাক দিয়ে ধীরে ধীরে রেচক বা দম ছাড়ুন। এভাবে প্রতি নাকে ৩/৪ বার করে উভয় নাকে ৬ থেকে ৮ বার অভ্যাস করুন।
লক্ষ্য রাখতে হবে, দম নেয়া ও ছাড়ার সময় যাতে নাকে বা গলায় কোন আওয়াজ না হয়। একই সাথে এটাও খেয়াল রাখতে হবে, পুরক বা দম নেয়া এবং রেচক বা দম ছাড়ার সময় যেন ১ ঃ ২ অনুপাতে হয়। অর্থাৎ যতটুকু সময় ধরে দম নেয়া হবে তার দ্বিগুণ সময় নিয়ে দম ছাড়তে হবে। নতুন শিক্ষার্থীদের জন্য প্রথম প্রথম তা আয়ত্তে আনা সহজ না হলেও কিছুদিনের নিয়মিত চর্চায় তা আয়ত্তে চলে আসবে।
এই প্রক্রিয়ার মধ্যে যারা পুরক ও রেচকের মধ্যবর্তী কুম্ভক বা দম আটকে রাখার চর্চাও যুক্ত করতে চান সেক্ষেত্রে পুরক, কুম্ভক ও রেচক এই তিন প্রক্রিয়ার সময়ানুপাত যথাক্রমে ১ ঃ ২ ঃ ২ বা ২ ঃ ১ ঃ ৪ হিসাবে অভ্যাস করতে হবে। অর্থাৎ যতক্ষণ পুরক বা শ্বাসগ্রহণ হবে তার দ্বিগুণ সময় ধরে রেচক বা শ্বাসত্যাগ করতে হবে। কিন্তু কুম্ভক বা দম আটকে রাখার সময়কাল নিজের সামর্থ্যমতো ধীরে ধীরে বাড়াতে হবে। তবে গৃহীদের পক্ষে কুম্ভক অভ্যাস না করাই বাঞ্ছনীয়। বই পড়ে কুম্ভক অভ্যাস করা উচিত নয়। এতে হিতে বিপরীত হয়ে যাবার সম্ভাবনা প্রবল। একান্তই কেউ তা অভ্যাস করতে চাইলে অবশ্যই সদগুরুর কাছে হাতে কলমে এই প্রাণায়ামের সম্পূর্ণ পদ্ধতি শিখে তবে চর্চা করতে হবে।
***#উপকারিতাঃ
দেহ থেকে যাবতীয় রোগবিষ টেনে বের করে দেয় বলে এটির নাম নাড়ী শোধন প্রাণায়াম। এই প্রাণায়াম বিশেষভাবে দেহের প্রাণশক্তি বৃদ্ধি করে এবং সর্দি-কাশির দোষ নষ্ট করে।
.....…..........★...........…....
Continue-2
মা তারা
মা_তারা বা আর্যতারা হলেন মহাযান বৌদ্ধধর্মের একজন নারী বোধিসত্ত্ব, যিনি বজ্রযান বৌদ্ধধর্মে একজন নারী বুদ্ধের মর্যাদা পান। তিব্বতি বৌদ্ধধর্মে তাকে জেতসুন দোলমা বলা হয়। তিনি "নির্বাণ-জননী" হিসেবে পরিচিত।
তারা কাজ ও কীর্তির গুণাবলির সাফল্যের প্রতিনিধি। জাপানে তিনি "তারা বোসাতসু" নামে পরিচিত। চীনা বৌদ্ধধর্মে তিনি দৌলাও পূসা নামে স্বল্প-পরিচিত।
তারা একজন তান্ত্রিক ধ্যান দেবী।
*#বজ্রযান বৌদ্ধধর্মের তিব্বতি শাখাটি তার ধ্যান অনুশীলন করে আন্তরিক গুণাবলির বিকাশ এবং দয়া ও শূন্যতার বাইরের, অন্তরের এবং গোপন শিক্ষা অনুধাবনের জন্য। একই শ্রেণীর বুদ্ধ বা বোধিসত্ত্বগণের গোষ্ঠীনাম হিসেবেও তারা শব্দটি ব্যবহৃত হয়। বোধিসত্ত্বেরা প্রায়শই বৌদ্ধ গুণাবলির উপমা হিসেবে ব্যবহৃত হন। সেই দিক থেকে এই ধারণাটি আরও স্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করা যায়।
*#মা_তারার সুপরিচিত রূপগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য:
*#হরিত_তারা, (শ্যামাতারা) বোধিপ্রাপ্ত ক্রিয়াকর্মের বুদ্ধ হিসেবে পরিচিত।
*#শুক্লতারা, (সীতাতারা) দয়া, দীর্ঘজীবন, আরোগ্যদান ও শান্তি হিসেবে পরিচিত; এছাড়াও চিন্তাচক্র বা কল্পতরু চক্র হিসেবেও পরিচিত।
*#রক্ততারা, (কুরুকুল্লা) সকল ভাল জিনিস চুম্বকীকরণের সঙ্গে যুক্ত ভয়াবহ রূপ।
*#কৃষ্ণতারা, শক্তির সঙ্গে যুক্ত।
*#পীততারা, (ভৃকুটি) সম্পদ ও বিকাশের সঙ্গে যুক্ত।
*#নীলতারা, ক্রোধের পরিবর্তনের সঙ্গে যুক্ত।
*#চিত্তমণি_তারা, তারার একটি রূপ যা তিব্বতি বৌদ্ধধর্মেরগেলাগ শাখায় সর্বোচ্চ যোগ তন্ত্রে বহুলভাবে প্রচলিত। এঁর গাত্রবর্ণ সবুজ দেখানো হয় এবং প্রায়শই হরিত তারার সঙ্গে এক হিসেবে দেখানো হয়।
*#খদিরববনী_তারা, দক্ষিণ ভারতের খদিরবনী বনে ইনি নাগার্জুনের সামনে আবির্ভূতা হয়েছিলেন বলে কথিত আছে। এঁকে প্রায়শই "২২তম তারা" বলা হয়।
*#বৌদ্ধধর্মের কোনো কোনো সম্প্রদায়ে "একুশ তারা" স্বীকৃত। তিব্বতি বৌদ্ধধর্মের চারটি সম্প্রদায়ই সকালে একুশ তারা স্তোত্র আবৃত্তি করে।
*#কোনো কোনো বৌদ্ধ সম্প্রদায় ও হিন্দুধর্মে তারার মন্ত্র একই: ওঁ তারে তুত্তারে তুরে স্বাহা। তিব্বতি প্রথা অনুসারে তিব্বতি ও বৌদ্ধরা এটিকে উচ্চারণ করে “ওঁ তারে তু তারে তুরে সোহা”। ( সংগৃহীত)
Continue-3
*#যোগানন্দের_বিশ্বজয়
(১ম পর্ব)
১৯৫২ সালের ৭ই মার্চ এই যোগী আমেরিকায় যখন দেহত্যাগ করেন তখন ভারতবর্ষ থেকে প্রতিনিধি পাঠানো এবং আরও কিছু প্রশাসনিক কারণে তাঁর মরদেহ সমাধিস্থ করতে যথেষ্ট দেরি হয়ে যায়। ২০ দিন তাঁর মরদেহ কোন রাসায়নিকের ব্যবহার ছাড়াই শায়িত ছিল এবং অবশেষে ২৭শে মার্চ তাঁর দেহ যখন কফিন-বন্দী করা হয় তখনও সেটি ছিল সম্পূর্ণ সজীব ও অবিকৃত। এটা একটা অভূতপূর্ব এবং আশ্চর্য জনক ঘটনা। এর ফটোগ্রাফও রয়েছে। সেখানে যোগানন্দের মরদেহ যারা নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করেছেন সে চিকিৎসক বিশেষজ্ঞদের রিপোর্টের কিয়দংশ এখানে উধৃত করছি:
“…… The physical appearance of Paramhansa Yogananda on March 27th, just before the bronze cover of the casket was put in position, was the same as it had been on March 7th. He looked on March 27th as fresh and as unravaged by decay as he had looked on the night of his death. On March 27th there was no reason to say that his body had suffered any visible physical disintegration at all. For these reasons we state again that the case of Paramhansa Yogananda is unique in our experience.”
*#ফিরে যাওয়া যাক আরও পিছনে.....
মহাসমুদ্রের ঢেউ কেটে এগিয়ে চলেছে একটা জাহাজ। ‘সিটি অব স্পার্টা’। ভারতবর্ষ থেকে যাত্রা শুরু, গন্তব্য আমেরিকার বোস্টন বন্দর। ১৯২০ সালের অগস্ট, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ভারত থেকে আমেরিকার পথে সেটাই প্রথম যাত্রীবাহী জাহাজ।
*#জাহাজে দেশি-বিদেশি অসংখ্য যাত্রীর ভিড়ে আছেন এক সন্ন্যাসীও। বয়স সাতাশ, উজ্জ্বল মুখ। সহযাত্রীদের এক জন আবিষ্কার করলেন, তরুণ সন্ন্যাসীর গন্তব্য বস্টনের ‘ইন্টারন্যাশনাল কংগ্রেস অব রিলিজিয়াস লিবার্যালস ইন আমেরিকা’, সেখানে তিনি ভারতের প্রতিনিধিত্ব করবেন। এত বড় অনুষ্ঠানে তো খানকয়েক বক্তৃতা দিতেই হবে, এখনই, এই সুদীর্ঘ জলযাত্রায় একটু মকসো করে নিলে কেমন হয়? সহযাত্রীটি চেপে ধরলেন, রটিয়েও দিলেন জাহাজে, সন্ন্যাসী রাতে বক্তৃতা দেবেন, বিষয় ‘জীবনযুদ্ধ ও তা জয়ের উপায়’।
চলবে......
*#যোগানন্দের_বিশ্বজয়
(২য় পর্ব)
*#ইংরেজিতে বক্তৃতা, ভাব ও ভাষা দুটোই গুছিয়ে নিতে হবে বইকী। সন্ন্যাসী দেখলেন, ভাবনাগুলোই আসছে না, ভাষায় তাদের বাঁধবেন কী! বহু চেষ্টার পর হাল ছেড়ে দিয়ে, গুরুর আশ্বাসবাক্য স্মরণ করে দাঁড়ালেন শ্রোতাদের সামনে। কিন্তু মুখে কথা সরে না। এক মিনিট, দু’মিনিট করে পেরোল দশ মিনিট, শ্রোতামহলের উসখুস, ফিসফিস তখন হাসাহাসিতে ঠেকেছে। খুব রাগ হল, সঙ্গে দুঃখ, অভিমান। নীরবে প্রার্থনা করছেন, মনের মধ্যে কে যেন বলে উঠল, পারবে, তুমি পারবে। মুখ খুলতেই, ভাব-ভাষা দুই-ই অনায়াসে বেরিয়ে এল ভিতর থেকে। কোথা দিয়ে কেটে গেল পঁয়তাল্লিশ মিনিট! শ্রোতারা তখন উচ্ছ্বসিত, আরও শুনতে চান তাঁরা!
এই তরুণ সন্ন্যাসীই যোগানন্দ। *#পরমহংস_যোগানন্দ।
শ্রী নরেন্দ্রনাথ দত্ত বা স্বামী বিবেকানন্দের পরে বিশ্ব জয় করা আরেক বাঙালি, শ্রী মুকুন্দলাল ঘোষ।
*#ভারত ও পাশ্চাত্যে ‘যোগদা সৎসঙ্গ সোসাইটি অব ইন্ডিয়া’ ও ‘সেল্ফ রিয়্যালাইজেশন ফেলোশিপ’ সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা, পাশ্চাত্যে ‘ক্রিয়াযোগ’ প্রচার-প্রসারের প্রধান মুখ।
এই যুগে বিশ শতকের যোগগুরু আর তাঁর জীবনদর্শনের স্থান কোথায়?
*#যিনি বলেছিলেন, তাঁর কাজ নতুন কিছু নয়— ভারতজীবনেরই অন্তরসম্পদ যে যোগসাধনা, তাকেই ঘরে ঘরে পৌঁছে দেওয়া ছাড়া; যে জিনিস ঘরেই আছে অথচ খবর নাই, তাকেই একটু চিনিয়ে দেওয়া ছাড়া!
১৮৯৩-এ শিকাগোর ধর্মমহাসম্মেলনে হিন্দুধর্মের প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন স্বামী বিবেকানন্দ। বাকি ইতিহাস বেদান্তের বিশ্বজয়ের ইতিহাস। আর সেই বছরেই উত্তরপ্রদেশের গোরক্ষপুরে জন্মালেন মুকুন্দলাল ঘোষ। চার ভাই চার বোনের সংসারে দ্বিতীয় পুত্র। বাবা বেঙ্গল নাগপুর রেলওয়ের বড় পদে ছিলেন, চাকরিসূত্রে ভারতের নানান শহরে ঘুরতে হয়েছে পরিবারটিকে।
*#যে শহরেই বদলি হন, সেখানেই বাড়ির ঠাকুরঘরে ফ্রেমে বাঁধানো একখানা ছবি থাকত— ‘লাহিড়ীমশাই’, যোগীরাজ শ্যামাচরণ লাহিড়ীর ছবি। মুকুন্দের বাবা তাঁর মন্ত্রশিষ্য ছিলেন।
চলবে.......
*#যোগানন্দের_বিশ্বজয়
(৩য় পর্ব)
*#শৈশব থেকেই মায়ের সঙ্গে ঠাকুরঘরে বিভোর বসে থাকত শিশুটি, একা থাকলেই ডুবে যেত তন্ময় নীরবতায়। গোরক্ষপুরের বাড়ির উঠোনে এক দিন দিদি উমা তাঁর পায়ে একটা ফোড়া হয়েছে বলে মলম লাগাচ্ছেন, মুকুন্দও খানিকটা নিয়ে হাতে লাগাল, ‘‘দেখ দিদি, আমার মনে হচ্ছে কাল আমার হাতে একটা ফোড়া বের হবে। যে জায়গায় ফোড়াটা বেরোবে, সেইখানে তোমার মলমটা লাগিয়ে দেখছি।’’ দিদি তো হেসে কুটিপাটি, মিথ্যুক কোথাকার! মুকুন্দ রেগে বলল, ‘‘খবরদার আমায় মিথ্যুক বোলো না, আমার অন্তরের প্রবল ইচ্ছাশক্তি জোরেই আমি বলছি যে, কাল আমার হাতে ঠিক এই জায়গাটিতেই বেশ বড়গোছের একটি ফোড়া বেরোবে, আর তোমার ফোড়াটি এই সাইজের ঠিক ডবল হয়ে ফুলে উঠবে, দেখো।’’ পর দিন সকালে দেখা গেল, ঠিক তা-ই হয়েছে। দিদি ছুটে গিয়ে মা’কে সব জানাতে, তিনি গম্ভীর হয়ে মুকুন্দকে বলেছিলেন, আজ থেকে জীবনে কারও ক্ষতি করার জন্য কোনও বাক্যের শক্তির অপব্যবহার কোরো না।
*#অটোবায়োগ্রাফি_অব_আ_যোগী বা ‘যোগিকথামৃত’-বইয়ের পাতায় পাতায় আশ্চর্য এক জীবনকথা। রামকৃষ্ণকথামৃতের পাতায় মাস্টারমশাই ‘শ্রীম’ লিখে গিয়েছেন বিভূতি, সিদ্ধাইয়ের প্রতি দক্ষিণেশ্বরের ‘পাগলা বামুন’-এর বিরাগ-বিতৃষ্ণার কথা। মুকুন্দ— যাঁকে স্কটিশ চার্চ বা শ্রীরামপুর কলেজের সহপাঠীরা ‘পাগলা সন্ন্যাসী’ বলে ডাকত— সাধনমার্গের পথে চলতে চলতে সেও মুখোমুখি লোকচক্ষুতে ব্যাখ্যাতীত সব ঘটনার, দর্শনের। মৃত্যুর আগে তাঁর মা লিখে রেখে গিয়েছিলেন কাশীর লাহিড়ীমশাইয়ের কথা, দুধের শিশু মুকুন্দকে দেখে যিনি বলেছিলেন, তোমার ছেলে এক জন যোগী হবে, আধ্যাত্মিক ইঞ্জিনের মতো বহু লোককে টেনে নিয়ে যাবে। লাহিড়ীমশাইয়েরও গুরু বাবাজি মহারাজ বলে গিয়েছিলেন মুকুন্দের গুরু শ্রী যুক্তেশ্বর গিরিকে, উপযুক্ত এক শিষ্য আসছে তোমার, যে ক্রিয়াযোগ শিখে, কালে পশ্চিমে যাবে এই দর্শন প্রচার করতে। সেই শিষ্যই মুকুন্দ তথা যোগানন্দ! তাঁর জীবন ও কাজের ধারাও পূর্বনির্দিষ্ট!
*#ক্রিয়াযোগই গুরুপরম্পরায় বয়ে আসা সেই দর্শন, যার প্রচারে যোগানন্দ আমেরিকা জয় করলেন। এ এক শারীরমনস্তাত্ত্বিক প্রণালী, যার দ্বারা ‘‘শরীরের রক্ত অঙ্গারশূন্য হয়ে অম্লজান দ্বারা প্রতিপূরিত হয়। এই অতিরিক্ত অম্লজানের পরমাণু প্রাণধারায় রূপান্তরিত হয়ে মস্তিষ্ক আর মেরুদণ্ডের কেন্দ্রগুলিকে সঞ্জীবিত করে।’’ যোগী ক্রমশ শরীরের ক্ষয় হ্রাস বা নিবারণ করতে পারেন। ক্রিয়াযোগ চর্চায় আরও এগিয়েছেন যিনি, তিনি শরীরকোষগুলিকে রূপান্তর করতে পারেন শক্তিতে। অর্থাৎ, সাধক মহাপুরুষদের জীবনচরিত যেমন ইচ্ছেমতো আবির্ভাব বা অদৃশ্য হওয়ার ‘অলৌকিক’ কাহিনিতে ভরপুর, সেই জিনিস হতে পারে এই যোগসহায়েই!
*#ক্রিয়াযোগ সাধনে যোগী মুক্ত হতে পারেন কার্য-কারণের শেকল থেকে, অন্য যে কোনও মানুষের মন বা চিন্তার সঙ্গে মিলিয়ে দিতে পারেন নিজেকে। কিন্তু এহ বাহ্য, আসল ও শেষ কথা, ক্রিয়া-প্রক্রিয়া-অনুষ্ঠানাদির পারে পরমাত্মার সঙ্গে ‘যোগ’।
চলবে.......
*#যোগানন্দের_বিশ্বজয়
(৪র্থ পর্ব)
*#Please_join_this_group:
★ক্রিয়াযোগে ঈশ্বরলাভ★
https://www.facebook.com/groups/353473076140599/?ref=share
*#সংসারেই সন্ন্যাসী, যোগীরাজ শ্যামাচরণ ক্রিয়াযোগের শিক্ষা পেয়েছিলেন তাঁর গুরু বাবাজি মহারাজের থেকে। তখন তিনি দুই সন্তানের পিতা, ইংরেজ সরকারের সামরিক পূর্ত বিভাগের হিসাবরক্ষকের চাকরি করেন। হিমালয়ের অন্তরাল থেকে যোগ এল ঘরে ঘরে, লাহিড়ীমশাইয়ের হাত ধরে।
*#সেই যোগকেই বিদেশে, বিশ্বের দরবারে প্রতিষ্ঠা দিলেন মুকুন্দ তথা যোগানন্দ। মাঝখানে আর একটি সেতু, তিনি যোগানন্দের গুরু, লাহিড়ীমশাইয়ের শিষ্য শ্রী যুক্তেশ্বর গিরি। শ্যামাচরণ লাহিড়ির শিষ্য যুক্তেশ্বর গিরিজি খুবই উচ্চমার্গের ক্রিয়াযোগ সাধক ছিলেন। পুরীর স্বর্গদ্বারে রয়েছে তাঁর সমাধি মন্দির।
*#শ্রীরামপুর নিবাসী এই সন্ন্যাসীর সঙ্গে যোগাযোগও অদ্ভুত ঘটনা। স্কুলবেলা থেকেই মুকুন্দ জানেন, গুরুর সন্ধান পাবেন তিনি কোনও এক দিন। যেখানে সাধুসন্তের খোঁজ পান ধেয়ে যান। সবাই ফিরিয়ে দেন, আমরা নই, তোমার গুরু তোমার অপেক্ষায় আছেন, কালে দেখা হবে। শ্রীরামপুরে নয়, দেখা হল কাশীতেই। প্রথম সাক্ষাতে দুজনেই ভাবস্থ। স্বয়ং গুরু শিষ্যকে বলেছিলেন, আমি তোমাকে আমার নিঃস্বার্থ ভালবাসা দিলাম, আর তুমি যদি আমাকেও কখনও ভগবদ্বিচ্যুত হতে দেখো, তা হলে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করবে, প্রতিজ্ঞা করো!
*#শ্রীরামপুর আশ্রমে কঠোরে-কোমলে গুরু তাঁকে শেখান আশ্রমের কাজ, সঙ্গে ধ্যান, সাধনা। বুঝিয়ে দেন গীতার ‘সংপ্রেক্ষ্য নাসিকাগ্রং’-এর আসল অর্থ: নাসিকাগ্রং মানে মোটেই ‘নাকের ডগা’ নয়, সাধুকে ওখানে দৃষ্টি স্থির করে ট্যারা হওয়ার উপদেশ দেওয়া হচ্ছে না। ‘নাসিকাগ্রং’ অর্থ নাসামূল, দুই ভ্রুর মধ্যস্থল— আধ্যাত্মিক দৃষ্টির স্থান। এই সন্ন্যাসী বলেন, সাধু মানে বোবা, অকর্মণ্য হয়ে থাকা নয়, অন্যকেও উঠিয়ে আনতে হবে, দিতে হবে নিজের পাওয়া আনন্দের স্বাদ। মুকুন্দ সারা দিন আশ্রমে পড়ে থাকতেন, গুরুই তাঁকে বলেন পড়াশোনা করতে হবে, আই এ, বি এ পাশ করতে হবে। কেন? কারণ তাঁকে পশ্চিমে যেতে হবে, ওখানকার মানুষ সাধুকে শিক্ষিত না দেখলে তাঁর কথা শুনবে কেন?
চলবে........
*#যোগানন্দের_বিশ্বজয়
(৫ম পর্ব)
*#অটোবায়োগ্রাফি অব আ যোগী শুধুই এক আত্মকথন নয়। নিজে কী হলাম, কী পেলাম, তার খতিয়ান নয়। শুরুর দিকের অধ্যায়গুলি বিবিধ সাধু-সংবাদে পূর্ণ। ‘দুই দেহধারী সাধু’ প্রণবানন্দ, ইচ্ছেমতো যে কোনও সুগন্ধে চারপাশ ভরিয়ে দিতে পারা ‘গন্ধবাবা’, ভবানীপুরের সোহহং স্বামী, আপার সার্কুলার রোডের লঘিমাসিদ্ধ সাধু ‘ভাদুড়ীমশাই’— সবার সঙ্গে সাক্ষাৎ ও কথোপকথনের বিবরণ লিখে গিয়েছেন যোগানন্দ। তাঁর বর্ণনায় ভাল-মন্দ, আসল-গাঁজাখুরির ভ্যালু জাজমেন্ট নেই, এক আশ্চর্য নৈর্ব্যক্তিকতা আছে। সাধুদের কীর্তিবর্ণনায় তিনি অযথা তরল বা গম্ভীর, কোনওটাই হন না। বরং পাঠককে বলতে চান, মানো না মানো, এই সব কিছুই ভারতের বহু সাধকের বহু সাধনার ধারা। কেউ প্রায়-অলৌকিক শক্তি প্রদর্শন করবেন, আবার কেউ দৈনন্দিন সাংসারিকতার মধ্যে থেকেও লুকিয়ে রাখবেন বিপুল অধ্যাত্ম-ঐশ্বর্য।
*#রামকৃষ্ণকথামৃতের রচয়িতা ‘মাস্টারমশাই’ মুকুন্দকে নিয়ে দক্ষিণেশ্বর ঘুরিয়ে দেখান, আবার ইউনিভার্সিটি বিল্ডিংয়ের সামনে ফুটপাতে হঠাৎ-স্পর্শে দেখান ‘জীবন্ত বায়োস্কোপ’, সেখানে কলকাতার কর্মচঞ্চল পথচারী, মোটর, ট্রামগাড়ি মুহূর্তে নিঃশব্দ হয়ে পথ চলতে থাকে।
*#কলকাতায় মুকুন্দদের বাড়ির ঠিকানা ছিল ৪ নং গড়পার রোড, অনতিদূরে ছিল ১০০এ গড়পার রোডে উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর বাড়ি, যে বাড়িতে মৃত্যুশয্যায় শায়িত সুকুমার রায়কে এসে দেখে গিয়েছিলেন, গান শুনিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। আবার কাছেই আচার্য জগদীশচন্দ্র বসুর বাড়ি, সেখানেও বিজ্ঞানীকে দেখতে গিয়েছিলেন তরুণ মুকুন্দ। প্রবীণ বিজ্ঞানী তাঁকে ল্যাবরেটরিতে এসে তাঁর আবিষ্কৃত ক্রেস্কোগ্রাফ দেখে যেতে বলেছিলেন। প্রেসিডেন্সি কলেজ ছেড়ে জগদীশচন্দ্র স্থাপনা করলেন বসু বিজ্ঞান মন্দির, সেই উদ্বোধন-অনুষ্ঠানেও গিয়েছিলেন মুকুন্দ। বিশদে লিখে গিয়েছেন বিজ্ঞানীর সে দিনের ভাষণ, ‘অটোবায়োগ্রাফি অব আ যোগী’ বইয়েই। পরেও গিয়েছিলেন তাঁর কাছে, দেখেছিলেন ফার্নের গায়ে ক্রেস্কোগ্রাফ লাগিয়ে দেওয়ার পর পর্দায় তার ধীর অথচ সুস্পষ্ট বেড়ে ওঠা, ক্লোরোফর্ম প্রয়োগে তার থেমে যাওয়া, তীক্ষ্ণ অস্ত্রের আঘাতে তার যন্ত্রণায় স্পন্দিত হওয়া।
চলবে.......
*#যোগানন্দের_বিশ্বজয়
(পর্বঃ ০৬)
*#অনেক পরে যখন মুকুন্দ সন্ন্যাস নিয়ে যোগানন্দ হয়েছেন, রাঁচীতে তৈরি করেছেন যোগদা সৎসঙ্গ ব্রহ্মচর্য বিদ্যালয়, তখন এই কলকাতাতেই এক দিন রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর পরিচয় করিয়ে দেন সি এফ অ্যান্ড্রুজ। কবির আমন্ত্রণে শান্তিনিকেতনেও যান যোগানন্দ, যোগ অভ্যাসের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মনঃসংযোগের প্রক্রিয়া তাঁর কাছে শুনেছিলেন রবীন্দ্রনাথ।
*#আমেরিকা থেকে ভারতে ফেরার পর ১৯৩৫ সালে ওয়ার্ধাতে গান্ধীজির আশ্রমেও আমন্ত্রিত হয়েছিলেন যোগানন্দ। চমৎকার সেই অনুপুঙ্খ বর্ণনা। মহাত্মার মৌনব্রত, তাঁর খাওয়ার বর্ণনা, সরল আশ্রমিক জীবন, গো-পালন, সব কিছু লিখে গিয়েছেন যোগানন্দ। রাতে শোওয়ার আগে সাধুর হাতে এক শিশি লেবুর তেল দিয়ে হেসে বলেছিলেন গান্ধীজি, ‘‘ওয়ার্ধার মশারা অহিংসাটহিংসা মানে না, একটু সাবধান হয়ে শোবেন।’’ গান্ধীজি ও তাঁর কয়েক জন শিষ্য যোগানন্দের কাছে ক্রিয়াযোগে দীক্ষা গ্রহণ করেছিলেন, মহাত্মার কথায় টাউন হল-এ চারশো লোকের সামনে বক্তৃতাও দিয়েছিলেন যোগানন্দ।
১৯১৫ সালে সন্ন্যাস, তার দু’বছর পর গুরুর কথায় ‘সংগঠনের কাজ’ শুরু করেন যোগানন্দ। ছোট্ট এক গ্রামে সাতটি মাত্র ছেলেকে নিয়ে শুরু হয়েছিল বিদ্যালয়, ১৯১৮ সালে কাশিমবাজারের মহারাজার দাক্ষিণ্যে সেই বিদ্যালয় গেল রাঁচীতে। সেও একশো বছর পেরিয়েছে। ‘ইয়োগা’ থেকে ‘হট যোগা’ নিয়ে মাতামাতির এই যুগে মনে রাখলে ভাল, তিনিই প্রথম ভারতীয় যোগশিক্ষক যিনি জীবনের বহুলাংশ কাটিয়েছেন আমেরিকার মাটিতে। লব্ধপ্রতিষ্ঠ বহু বিদেশি নারীপুরুষ শিষ্যত্ব নিয়েছিলেন তাঁর। মার্ক টোয়েনের মেয়ে, সুগায়িকা ক্লারা ক্লেমেন্স গ্যাব্রিলোউইশ, অ্যালিস হেসি (‘যোগমাতা’, সেল্ফ রিয়্যালাইজেশন ফেলোশিপের প্রথম সন্ন্যাসিনী), লরি প্র্যাট (তারামাতা), ব্যবসায়ী জেমস লিন (জনকানন্দ)— তালিকা সুদীর্ঘ।
*#যোগানন্দ পাশ্চাত্যে ক্রিয়াযোগ প্রচারের জন্য ১৯২০ সালে আমেরিকা চলে যান এবং ১৯২৫ সালে ক্যালিফোর্ণিয়ার লস এ্যঞ্জেলসে Self-Realisation Fellowship (SRF)-এর আন্তর্জাতিক সদর দপ্তরের প্রশাসনিক ভবন স্থাপন করেন। দ্রোনগিরির কাছে অবস্থিত ‘লাহিড়ী মহাশয়ের গুহা’ এই SRF-এর উদ্যোগেই প্রচার লাভ করেছে।
চলবে........
*#যোগানন্দের_বিশ্বজয়
(৭ম ও আপাতত শেষ পর্ব)
*#যোগানন্দ পাশ্চাত্যে ক্রিয়াযোগ প্রচারের জন্য ১৯২০ সালে আমেরিকা চলে যান এবং ১৯২৫ সালে ক্যালিফোর্ণিয়ার লস এ্যঞ্জেলসে Self-Realisation Fellowship (SRF)-এর আন্তর্জাতিক সদর দপ্তরের প্রশাসনিক ভবন স্থাপন করেন। দ্রোনগিরির কাছে অবস্থিত ‘লাহিড়ী মহাশয়ের গুহা’ এই SRF-এর উদ্যোগেই প্রচার লাভ করেছে।
*#দক্ষিণেশ্বর মন্দিরের কাছে গঙ্গাতীরে এক প্রশান্ত পরিবেশে ১৯৩৯ সালে যোগানন্দ কর্তৃক স্থাপিত হয়েছিল যোগদা সৎসঙ্গ সোসাইটির (YSS) ভারতের রেজিস্টার্ড অফিস। সেখানে রয়েছে যোগদা মঠ। এটি সর্বসাধারণের জন্য মুক্ত। এখানে ধ্যানকক্ষের নিবিড় শান্ত পরিবেশে কিছুক্ষণ কাটালে মন বিক্ষেপ মুক্ত হয়ে আপনিই স্থির হয়ে আসে।
*#তাঁর মৃত্যুও অদ্ভুত সহজ। ১৯৫২ সালের ৭ই মার্চ লস অ্যাঞ্জেলেসে ভারতীয় রাষ্ট্রদূত বিনয়রঞ্জন সেনের আয়োজিত নৈশভোজে বক্তৃতা দিলেন ভারত-আমেরিকা মৈত্রী ও বিশ্বশান্তি নিয়ে, নিজের লেখা কবিতা থেকে পড়লেন, ‘যেখানে গঙ্গা, অরণ্য, হিমালয়ের গুহাকন্দর ও মানুষ ঈশ্বরকে খোঁজে, আমি ধন্য, ছুঁয়েছি সেই মাটি!’ ভ্রু-মধ্যে উত্থিত দৃষ্টি, তার পরেই ঢলে পড়ল প্রবাসে ভারতীয় যোগের অঘোষিত ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডরের শরীর।
*#শরীর গিয়েছে, রয়ে গিয়েছে তাঁর সাধন। ‘বিটলস’ ভারতে এলে জর্জ হ্যারিসনের হাতে রবিশংকর তুলে দিয়েছিলেন যোগানন্দেরই বই। স্টিভ জোবস নাকি ভারতবর্ষকে জেনেছিলেন ‘অটোবায়োগ্রাফি অব আ যোগী’ পড়েই। ২০১১-তে মৃত্যুর পর তাঁর স্মরণসভায় উপস্থিত সবার জন্য ‘শেষ উপহার’ ছিল এই বই, জোবসেরই ইচ্ছানুযায়ী! সংগঠনের বহতা ধারার সমান্তরালে এও তো এক প্রভাব-পরম্পরা।
++++++++++++±++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++
Continue-4
ক্রিয়াযোগী_রবীন্দ্রনাথ
*#বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সারাজীবন ধরে বহু সাধুসন্তের সান্নিধ্যে এলেও ক্রিয়াযোগ এবং ক্রিয়াযোগীগণের সাথে আজীবন তাঁর নিবিড় সম্পর্ক ছিল। আর সেই সকলস্তরের সাক্ষাতের অমূল্য তথ্য তেমনভাবে উন্মোচিত না হওয়ায় অনেকেই জানেন না যে কবিগুরু কেবলমাত্র একজন কবিই নন বিখ্যাত যোগীও ছিলেন।
*#বিভিন্ন লেখনিতে সেই সব কথাই মূর্ত হয়ে উঠে। তার মাঝে কিছু কিছু তুলে ধরলাম- বাল্যকাল হতেই তিনি তাঁর পিতৃদেব মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের নির্দেশ মতো গায়ত্রী মন্ত্র জপ ও ধ্যান করিতেন।১
জীবন সায়হ্নে তিনি যোগীরাজ শ্যামাচরণ লাহিড়ী মহাশয়ের অন্যতম শিষ্য পরম পূজ্যপাদ শ্রীশ্রী ভূপেন্দ্রনাথ সান্যাল মহাশয়ের নিকট ক্রিয়াযোগে দীক্ষা লাভ করেছিলেন। ১৯০০ সালের কোনও এক সময় একটি বিশেষ ঘটনার মধ্যদিয়ে বোলপুরে প্রথম সান্যাল মহাশয়ের সাথে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাক্ষাৎ হয়।২
*#তখন সান্যাল মহাশয়ের বয়স মাত্র ২৬ বৎসর। সেই সময় তাঁদের মধ্যে দীর্ঘক্ষণ বিভিন্ন বিষয়ের উপর আলোচনা হয়। তারপর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাথে শ্রীশ্রী ভূপেন্দ্রনাথ সান্যাল মহাশয়ের এক নিবিড় আত্মিক সম্পর্ক তৈরি হয় ও সান্যাল মহাশয় ঠাকুর পরিবারে গৃহশিক্ষক হিসাবে নিযুক্ত হন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দাদা এবং পরিবারের সকলেই শ্রীশ্রী ভূপেন্দ্রনাথ সান্যাল মহাশয়কে গুরুজ্ঞানে শ্রদ্ধা ও ভক্তি করতেন।৩
আবার দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর সম্বন্ধে বলতে গিয়ে সান্যাল মহাশয় ঋষিকল্প মহাত্মা বলে উল্লেখ করেছেন।৪
*#প্রসঙ্গত উল্লেখ্য দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের জ্যেষ্ঠ্য পুত্রবধূ শ্রীযুক্তা হেমলতা ঠাকুর আজীবন শ্রী ভূপেন্দ্রনাথ সান্যাল মহাশয়কে গুরুজ্ঞানে শ্রদ্ধা ও ভক্তি করতেন এবং নিয়মিত বিভিন্ন বিষয়ে পত্রালাভের মাধ্যমে তাদের দুইজনের মধ্যে যোগাযোগ ছিল।৫
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পিতৃদেব মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের মৃত্যুকালে সান্যাল মহাশয় ভগবৎ কথা শুনিয়েছিলেন।৬
পরবর্তীকালে ১৯০২ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একান্ত অনুরোধে সান্যাল মহাশয় শান্তিনিকেতনের ব্রহ্মচর্যাশ্রমের প্রথম অধ্যক্ষ পদে অধিষ্ঠিত হন।৭
*#পরবর্তীকালে ১৯০৩ হতে ১৯১০ সাল পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যোগাচার্য্য ভূপেন্দ্রনাথ সান্যাল মহাশয়ের নিবিড় সান্নিধ্যে আসেন।৮ (সেই সময়কার বিবরণ শ্রী প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় মহাশয়ের রচিত ‘রবীন্দ্র জীবনী’ গ্রন্থে প্রকাশিত হয়েছে।)
পরবর্তী সময়ে একান্ত ব্যক্তিগত কারণ সান্যাল মহাশয় শান্তিনিকেতনের ব্রহ্মচর্য্যাশ্রমের দায়িত্ব ভার ছেড়ে দেন। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে আজীবন তাঁর নিবিড় অন্তরঙ্গতা অক্ষুন্ন ছিল। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বহুবার সান্যাল মহাশয়ের গৃহে এসেছেন ও সময়ে বহুক্ষেত্রে অর্থ সাহায্য ও করেছেন। পরবর্তীকালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও সান্যাল মহাশয়ের বহু চিঠিতে তা প্রকাশ পায়।৯
*#পরবর্তী সময়ে তাঁরা দুইজনে গোপনে ভারতের বহু তীর্থস্থান ভ্রমণ করেন ও বহু সাধুসঙ্গ করেন। ১৯১২ সালে একবার কাশীর রাণামহল ঘাটে যোগীরাজ শ্যামাচরণ লাহিড়ী মহাশয়ের অপর এক শিষ্য কৃষ্ণরামজীর আধ্যাত্মিক অনুভূতি ও নির্লোভ অবস্থা দেখে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অভিভূত হয়েছিলেন।১০
এই সময় পরমপূজ্যপাদ শ্রীশ্রী ভূপেন্দ্রনাথ সান্যাল মহাশয় সাতটি পুস্তক রচনা করেন। প্রত্যেকটি পুস্তক বঙ্গীয় ধার্ম্মিক সাহিত্যে এক অনবদ্য অবদান। তাঁর রচিত শ্রীমদ্ভগবদগীতার (তিন খণ্ড) ভূমিকা রচনা করেন তৎকালীন কাশীর সংস্কৃত কলেজের অধ্যাপক শ্রীযুক্ত মহামহোপাধ্যায় গোপীনাথ কবিরাজ মহাশয় স্বয়ং। সেই ভূমিকাতে স্বয়ং গোপিনাথ কবিরাজ মহাশয় শ্রীযুক্ত সান্যাল মহাশয়ের ভূয়সী প্রশংসা করেন।
তাঁর রচিত ‘অভ্যাসযোগ’ নামক পুস্তকের প্রাপ্তি স্বীকার করে প্রবাসী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যে চিঠি দেন সেখানে তিনি উল্লেখ করেন-
*#এবারকার মেলে আমি দুইখানি বই একসঙ্গে পেলাম একখানি আপনার ‘অভ্যাসযোগ’। দুইখানিই আমার প্রবাসের বন্ধুরূপে দর্শন দিয়াছে। একটিতে আমাদের দেশের সৌন্দর্য আর একটিতে আমাদের দেশের সাধনা আমার সঙ্গ লইয়াছে। উভেয়েতেই আমার প্রয়োজন এবং অনুরাগ।১১
‘দিনচর্য্যা’ পাঠ করে কবিগুরু লেখেন- ‘আপনার দিনচর্য্যা পড়ে উৎসাহ এবং উপকার পেয়েছি। এ বইটি কাজের হয়েছে। এবং এর মধ্যে ভাবের ও অভাব নেই।’১২
*#যোগীরাজ শ্যামাচরণ লাহিড়ী মহাশয়ের অন্যতম শিষ্য স্বামী যুক্তেশ্বর গিরি মহারাজের দুই শিষ্য পরমহংস যোগানন্দ এবং স্বামী সত্যানন্দ গিরি মহারাজ, নোবেলজয় লাভের কিছুদিন পর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। সেই সময় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ক্রিয়াযোগের কিছু প্রাথমিক পদ্ধতি সম্বন্ধে অবগত হন।১৩
স্বামী সত্যানন্দ গিরি মহারাজের (পূর্বেনাম মনোমোহন মজুমদার) কলেজের বন্ধু ছিলেন প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জোড়াসাঁকোস্থ বাড়িতে বিচিত্রা ক্লাবে প্রভাত বাবুর সহযোগীতায় স্বামী সত্যানন্দ গিরি বহুবার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাথে দেখা করেন এবং অত্যন্ত অন্তরঙ্গভাবে তাঁর সহিত বহু বিষয়ে পরামর্শ করেন। পরবর্তীকালে ১৯২১ সালে স্বামী সত্যানন্দ গিরি মহারাজ কবিগুরুর আমন্ত্রণে শান্তিনিকেতনে এসেছিলেন। সেই সময় স্বামী সত্যানন্দ গিরি একজন উন্নত ক্রিয়াযোগী জেনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর নিকট হতে কিছু প্রাথমিক ক্রিয়া পদ্ধতি শিক্ষা লাভ করেন এবং স্বামী সত্যানন্দ গিরি মহারাজকে অনুরোধ করেন শান্তিনিকেতনের শিক্ষক হিসাবে যুক্ত হতে। কিন্তু কিছু ব্যক্তিগত কারণ স্বামী সত্যানন্দ গিরি মহারাজ কবিগুরুর সেই অনুরোধ সবিনয়ে প্রত্যাখ্যান করেন।১৪
*#পরমহংস যোগানন্দের ভ্রাতা শ্রীযুক্ত শ্রী সনন্দলাল ঘোষ মহাশয় কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি দণ্ডায়মান অবস্থার চিত্র অঙ্কন করেছিলেন। কবিগুরু স্বয়ং সেই চিত্র দেখে বিস্ময়ে অভিভূত ও এতটাই সন্তুষ্ট হয়েছিলেন যে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে একখানি প্রশংসাপত্র পাঠিয়েছিলেন শ্রীযুক্ত সনন্দলাল ঘোষ মহাশয়কে। সেখানে তিনি তাঁর দাঁড়ানো ভঙ্গিতে ভালো ছবিগুলির মধ্যে শ্রেষ্ঠ বলে উল্লেখ করেন। পরবর্তীকালে দিল্লির অ্যাসেমব্লিতে শ্রীযুক্ত সনন্দলাল ঘোষ মহাশয়ের আঁকা ছবিটির অনুকরণে কবিগুরুর একটি মর্মর মূর্তি স্থাপিত হয়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য শ্রীযুক্ত সনন্দলাল ঘোষ মহাশয় পূজ্যপাদ যুক্তেশ্বর গিরি মহারাজের নিকট ক্রিয়াযোগ প্রাপ্ত হলেও পরবর্তীকালে ক্রিয়াযোগের উচ্চতর সাধন পদ্ধতি লাভ করেন শ্রীশ্রী ভূপেন্দ্রনাথ সান্যাল মহাশয়ের নিকট হতে।১৫
অবশেষে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জীবন সায়হ্নে এসে ৭৮ বছর বয়সে পরমপূজ্যপাদ শ্রীশ্রী ভূপেন্দ্রনাথ সান্যাল মহাশয়ের নিকট ক্রিয়াযোগে দীক্ষা লাভ করেন। সান্যাল মহাশয় কবিগুরুকে আত্মসাক্ষাৎ করিয়ে দেন ও ক্রিয়াযোগের অপরাপর সকল কর্মের (দেহের পবিত্রীকরণ, অঙ্গশোধন ইত্যাদি) মধ্যদিয়ে দীক্ষাদান সম্পন্ন করেন। দীক্ষা গ্রহণকালে কবিগুরু এবং সান্যাল মহাশয়কে সাহায্য করেন পরমহংস যোগানন্দজীর কনিষ্ঠ ভ্রাতা শ্রীযুক্ত বিষ্ণুচরণ ঘোষ মহাশয়ের শিষ্য ও জামাতা বিশিষ্ট ক্রিয়াযোগী বুদ্ধদেব বসু মহাশয়।
*#ক্রিয়াযোগে দীক্ষিত হবার পরই শ্রদ্ধেয় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও ক্রিয়াযোগী বুদ্ধদেব বসু মহাশয়ের একত্রে একটি ছবি তোলা হয়েছিল তা সংযুক্ত করলাম। সেই সঙ্গে কবিগুরু স্বহস্তে একটি প্রশস্তি পত্রও দিয়েছিলেন বুদ্ধদেব বসু মহাশয়কে।১৬
ক্রিয়াযোগে দীক্ষিত হবার পর আর মাত্র দুই বৎসর তিনি জীবিত ছিলেন। সেই সময় তিনি ভীষণ অসুস্থ ও পীড়াগ্রস্ত থাকলেও নিয়মিত রাত্রির শেষভাগে যোগাভ্যাস করতেন এবং অতি অল্প সময়ে আধ্যাত্ম জগতের অতি উচ্চাবস্থা প্রাপ্ত হন। এই বিষয়ে যোগীবর শ্রী ভূপেন্দ্রনাথ সান্যাল মহাশয় স্বয়ং বলেছেন, ‘সেই সময় কবিগুরু ধ্যানের মধ্যে এতোটাই মগ্ন হয়ে পড়িতেন যে বাহ্য চেতনা পর্যন্ত লুপ্ত হইতো।’১৭
*#বয়সে ছোট হলেও কবিগুরু সান্যাল মহাশয়কে গুরবৎ শ্রদ্ধা ভক্তি করতেন।
Continue-5
রাধাভাব
*#রাধা উল্টো ধারা (আনন্দ ধারা ) সাধক নিজের মনের ভেতর বুঝতে পারছে যে, কৃষ্ণকে না পেয়ে আমার অস্তিত্ব নিরর্থক হয়ে যাচ্ছে, কৃষ্ণকে না পেলে আমি আর এক তিলও বাঁচতে পারব না, এই মানসিকতাটার নাম হলো রাধা (মনের) মানসিকতা।
*#অর্থাৎ আরাধনা ছাড়া সে আর কিছুই জানেনা। এই রাধা মানসিকতার চরম বিকাশ পাচ্ছি ব্রজের কৃষ্ণে- আর কোথাও নয়।
*#মানুষের মন (রাধা ) যখন পরমপুরুষকে পাবার জন্য অত্যন্ত ব্যাকুল হয়, যখন সে সব কাজে পরমপুরুষকে দেখবার চেষ্টা করছে ও শেষ পর্যন্ত দেখছে, এই যে পাবার আকুতি, এটাকে সংস্কৃতে বলে “আরাধনা”(আ+রাধ্+অনট্+আ = আরাধনা)
আর যে আরাধনা করে সেই হলো রাধা। রাধা হচ্ছে ভক্তের মন l
*#এই যে রাধাভাব/মনভাব , এটা হচ্ছে মধুর ভাব। কারণ, জীবনের যা কিছু মধুর অভিব্যক্তি, যা কিছু মাধুর্য্যময় কর্মচর্চা ও কর্ম অনবয়, সেগুলো কৃষ্ণের মধ্যে (৬৪গুণ) পাই এই মধুর রাধাভাব/মনভাব।
*#মধুর_ভাবঃ
আমি আমার সর্ব সত্তা- শারীরিক, মানসিক, সামাজিক, আধ্যাত্মিক; আমার সর্বসত্তাকে কেন্দ্রীভূত করে তাকে এক বিন্দুতে পর্যবসিত করে আমার সকল আনন্দ ঐ কৃষ্ণের ভিতর দিয়ে পাব- এই যে মধুর ভাব, এই হলো রাধা ভাব/মনের ভাব ।
*#অর্থাৎ কৃষ্ণরূপী (কষ) মহাবিশ্বের প্রাণকেন্দ্র বা মধ্যমনির মধ্যে আমার অর্থাৎ সকল সাধক বা সাধিকার মন যখন এক বিন্দুতে পর্যবসিত হয়ে আনন্দ (ধারা /রাধা ) লাভ করবে। সাধক সাধিকাদের সেই অবস্থার আনন্দময় সুমধুর ভাবটাই হলো রাধাভাব।
*#বিশ্বের সকল মানুষ, জাতি, বর্ণ, ধর্ম, দেশ, ভাষা নির্বিশেষে, সকলেই এক একজন সম্ভাবনাময় রাধা (আনন্দ ধারা )। ব্যাপকার্থে সকল নারী সকল পুরুষই রাধা, যদি তার মন, তার সর্বসত্তা উপরোক্ত মানস অবস্থাপ্রাপ্ত হয়।
তাই সকল সম্প্রদায়ের নর-নারীকে সেই মধুর রাধাভাবকে অর্জনের জন্যে পরমপুরুষকে স্মরণ-মনন নিধি ধ্যানাসনের মধ্যে দিয়েই এগোতে হবে। তবেই মানস আধ্যাত্মিক রাধাভাবকে/মনোভাবকে অর্জন করা যাবে।
*#স্মরণ-মনন নিধিধ্যানাসনের মধ্য দিয়ে পরমপুরুষের দিকে এগিয়ে যাওয়াটাকেই বলে মানস আধ্যাত্মিক সাধনা বিজ্ঞান।
এই মানস আধ্যাত্মিক বিজ্ঞানের পথে অর্জিত রাগাত্মিকা (অনুরাগী) ভক্তি’র দ্বারা বিন্দুতে পর্যবসিত মনের যে মধুর ভাবাবস্থা সেই ভাবাবস্থাই হলো মানস আধ্যাত্মিক রাধা ভাব/মনের ভাব। শ্রীকৃষ্ণকে স্বচ্চিদানন্দ বলা হয় কারন তার মনে কোন বিষাদ নেই, সুখ দুঃখের অবকাশ নেই। তিনি এক অবস্থায়
আনন্দের (রাধা /ধারার) মধ্যে স্থির থাকেন। তিনি কেবল আনন্দেই বিহার করেন তাই তার
নাম "সশ্চিদানন্দ"। সে আনন্দটাই (রাধা) হচ্ছে শ্রীকৃষ্ণের প্রিয় স্থান। যারা মনে আনন্দকে (রাধাকে) ধারন করেছেন সেখানেই শ্রীকৃষ্ণ বিরাজ করেন। সে আনন্দই হচ্ছে শ্রীকৃষ্ণ পরমাত্মার নিবাস স্থান। "মানুষের দেহে ৫ টি স্তর আছে"। এই ৫ টি স্তরের মধ্যে কোন স্তরে শ্রীকৃষ্ণ পরমাত্মার অংশ স্বরূপ আত্মার নিবাস স্থান সেটা দেখে নিই।
১) অন্নময় কোষ --- যাহা অন্ন দ্বারা গঠিত হয়েছে। অর্থাৎ এই স্থুল শরীর।
২) প্রানময় কোষ --- এই স্থুল শরীরের ভেতর সূক্ষ্মশরীর অবস্থিত।
৩) মনময় কোষ --- এটা প্রানময় কোষের ভেতর আরো সূক্ষ্মভাবে অবস্থিত।
৪) বিজ্ঞানময় কোষ --- এটা মনময় কোষের ভেতর আরো সূক্ষ্মভাবে অবস্থিত।
৫) আনন্দময় কোষ --- এটা বিজ্ঞানময় কোষের ভেতর আরো সূক্ষ্মভাবে অবস্থিত।
*#এই আনন্দময় (রাধাময় /মনময় /ধারা /নাড়ি ) কোষের মধ্যে শ্রীকৃষ্ণ পরমাত্মার অংশ স্বরূপ আত্মার অবস্থান।
অর্থাৎ যেখানে আনন্দ সেখানে সশ্চিদানন্দ। যেখানে রাধা (আনন্দ ধারা ) সেখানে শ্রীকৃষ্ণ। আর যেখানে রাধা নেই সেখানে শ্রীকৃষ্ণ (আত্মা নেই /রাধা নেই /দেহে আত্মা কোথায় মনের জানা নেই ) ও নেই। তাই নারী খুঁজে চলেছে/আসবে অপেক্ষায় আছে।
*#রাধা_কোন_নারী_নয়, আনন্দের যেহেতু কোন রূপরেখা নাই। এখানে মানুষকে সহজে বুঝানোর জন্য নারী রূপ দেওয়া হয়েছে।(তিন লক্ষ্য বাহাত্তর হাজার সাড়ে তিনটে নারীর মধ্যে শেষ্ঠ নারী )l নাড়ি শোধন করুন সৎ গুরুর বীজ মন্ত্র দিয়ে।
Continue-6
বাবা_লোকনাথ_সতীর্থ_বেণীমাধব_গঙ্গোপাধ্যায়_শ্রীশ্রীমাধবানন্দগিরি_মহারাজ
*#সাধক বেণীমাধব তার সাধনসতীর্থ লোকনাথ বাবার সঙ্গে চন্দ্রনাথ পাহাড় থেকে সুদীর্ঘ প্রায় ১৩০ বছর পর নেমে আসেন। বাবা লোকনাথ ঢাকার কাছে বারদি গ্রামে চলে আসেন। আর বেণীমাধব চলে যান কামাখ্যায়।
এরপর তাঁর বেণীমাধব থেকে মাধবানন্দে রূপান্তর ঘটে, বিভিন্ন তীর্থপীঠে তাঁর তপস্যা, সিদ্ধিলাভ, কায়াকল্প, পরিব্রাজন করেন।
*#ভারত বিখ্যাত মহাযোগী ও মহাজ্ঞানী শ্রীশ্রীমাধবানন্দ গিরি মহারাজ তারাপীঠে এলেন আনুমানিক বাংলা ১২৮৪ সালে। তারামন্দিরে তারামাকে প্রণাম করে এই প্রাচীন সিদ্ধ মহাপুরুষ এলেন তারাপীঠ মহাশ্মশানে।
ভারতবিখ্যাত পুরুষ ভগবান গাঙ্গুলীর অন্যতম মহানশিষ্য ও বারদীর লোকনাথ ব্রহ্মচারীর গুরুভাই দেড়শতাধিক বছর বয়স্ক মাধবানন্দ গিরি মহারাজ মহাশ্মশানে প্রবেশ করলেন। মহাশ্মশানে শ্রীশ্রীবামাক্ষ্যাপা বসে আছেন। উভয়ে উভয়কে সানন্দে আলিঙ্গন করলেন। দু’জনের সাধনার পথ ও মত ভিন্ন হতে পারে কিন্ত সিদ্ধি লাভের পর কোন ভেদাভেদ থাকেনা। এক ব্রহ্মানন্দ সাগরে সবাই ভাসেন। তাই দেড় শতাধিক বছর বয়স্ক মহাযোগী ও মহাজ্ঞানী ও মহাপ্রেমিক শ্রীশ্রীমাধবানন্দ গিরি মহারাজের সাথে মাত্র চল্লিশ বছর বয়স্ক মহাযোগী ও মহাতান্ত্রিক ও পরম প্রেমভক্তির মহান বিগ্রহ শ্রীশ্রীবামাক্ষ্যাপার কোন ব্যবধান নেই। এক ও অভিন্ন দিব্যানন্দে উভয়ে বিভোর হয়ে রইলেন। তারপর নিগূঢ় অধ্যাত্ম ভাব বিনিময়ে উভয়ে মগ্ন হলেন।
*#তারাপীঠে কয়েকদিন মহানন্দে অতিবাহিত করে মাধবানন্দ গিরি সশিষ্য বিদায় নিলেন শ্রীশ্রীবামাক্ষ্যাপার কাছ থেকে। শ্রীবামও তাঁকে যথাযথ মর্যাদা দিয়ে বিদায় জানালেন।
বেণীমাধব উত্তর ভারতে খ্যাত মৌনীবাবা নামে। তাঁর লোককল্যাণে অলৌকিক শক্তি প্রয়োগ অবাক করে। তিনি ভক্তদের বলতেন, ব্রহ্মজ্ঞানে অনর্থ হানি। ভগবান দীনের বন্ধু ভাই। আমার কাছে যারা এসেছে, তাদের সকলের মুক্তি হোক। আর যেন জগতে আসতে না হয় --- এই আমার ইচ্ছা। সাধুর বাক্যে বিশ্বাস করিস।
১৯৭৪ সালে ২৪৬ বছর বয়সে এই মহাসাধক লখনউতে সমাধিযোগে দেহত্যাগ করেন।
Continue-7
অতীন্দ্রিয়
*#ইন্দ্রিয়ের ক্ষমতা থেকে নিজেকে মুক্ত করতে হলে অতীন্দ্রিয় অবস্থা লাভ করতে হবে, ব্ৰহ্ম সাধনায় ডুবে গিয়ে। বাহ্যিক যে ভালােবাসা সবই ইন্দ্রিয়গত ভালােবাসা। যেমন- ' ও আমার প্রাণের বন্ধু', ওকে ছাড়া আমি বাঁচব না, যেই একটা দ্বন্দ্ব হ'ল, তখন বলে “ আমি তােকে দেখে নেবাে”।
*#এই ভালােবাসা কতদূর যেতে পারে, বড়জোর ইন্দ্রিয়ের যেখানে শেষ সেখানে। কিন্তু অতীন্দ্রিয়তে কখনই যেতে পারবে না '। যখন মাতৃ-পিতৃ-সন্তান বিয়ােগে আমরা শােক বিহুল-কাতর, তখন স্বজন হারানাে শােকে আমাদের বাঁচতে ইচ্ছা করে না। কিন্তু কিছু দিন অতিবাহিত হবার পর অন্য একজন নারী-পুরুষকে ভালােবেসে জীবনসঙ্গী হিসাবে না পেয়ে আত্মহননে উদ্যত হই
‘ এই তাে আমাদের ভালােবাসা ’! আবার কোনাে মাতা তার রােগগ্রস্ত সন্তানকে বাঁচাতে দেবতার মন্দিরে প্রার্থনা করেও নিজকোলে সন্তানের প্রাণবায়ু স্তব্ধ হতে দেখলেন। মন্দিরে দেবতা নীরব, কারণ তিনি অতীন্দ্রিয়, মানুষ ইন্দ্রিয়ের অধীনে থাকায় তার আবেদন অতীন্দ্রিয়ের কাছে পৌছাবে কেমন করে? কিন্তু অতীন্দ্রিয় অবস্থা লাভ করলে আমরা দেখতে পাব, মন্দিরের সকল দেবতা আমাদের বিপদ থেকে রক্ষা করার জন্য হাত বাড়িয়ে আছেন। আমরা যদি নিজেকে তার চরণে সঁপে দিতে পারি -তাহলে চিরশান্তি পাব। রামপ্রসাদ বলছেন, “ আমি যা করি মা সবই তােমার কাজ, আমার আমার বলতে লাগে লাজ।
*#সবই তাে ধার করা বিদ্যা। চোখ ধার করা বিদ্যায় দেখে, কান ধার করা বিদ্যায় শােনে, চঞ্চল মন বুদ্ধি-ইন্দ্রিয় ধার করা বিদ্যায় আমি আমি করে আর অর্থ
মান-যশ-প্রতিপত্তির মােহে ও অহংকারের বশবর্তী হয়ে ভাবে আমি একটা কেউকেটা ধার করা বিদ্যা নিয়ে এত লাফালাফি। আর যিনি ধার করেন না অর্থাৎ যার অস্তিত্বে আমার অস্তিত্ব, তিনি নিরাকার ব্রহ্ম। যিনি প্রাণকৃষ্ণ রূপে সকলের হৃদয়ে কূটস্থ রূপে বিদ্যমান এবং তিনিই কুমারশক্তি অর্থাৎ বীজপ্রদ পিতার আমরা সন্তান, যা কিনা নিজে কোনদিন স্বাভাবিক নিয়মে মিলিত না হয়ে আমাদের জন্ম হচ্ছে পৃথিবীতে আর আমরা একবারও ভাবছি না যেকোন মুহূর্তে আমার শ্বাস-প্রশ্বাস থেমে গিয়ে আমি
মৃতদেহ হয়ে যাব ’ এবং আমার ফেলে আসা অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ কর্মদোষের ফল ভােগ করতে হবে।
*#তাই যারা একটু সচেতন তারাই ভাবে, কে আমি? কোথা থেকে এসেছি! কি আমার পরিচয়, কি আমায় করতে হবে? আমাকে কি এই বিরাট অট্টালিকায় থাকতে হবে, আমি কি এই দেশটাকে শাসন করতে পারি? আমি কি দেশের রাজা, আমি কি এই দেশের প্রজা? আমি রাজাও নই,
প্রজাও নই, ভিখারী নই, তবে কে আমি? এইটাই হ’ল“ জীবনদর্শন ” – যা স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের
জীবন বিজ্ঞান ও দর্শন নয়। এই আসল সত্যটা যেদিন বােধগম্য হবে সেদিন থেকে সে অতীন্দ্রিয় অবস্থা লাভ করার যে উপায় সেই পথের সন্ধান পেয়ে ব্রহ্ম সাধন করে জন্ম-মৃত্যুর অতীতে পৌছে যাবে চিরতরে অর্থাৎ পুনর্জন্ম হবে না কোন দিন।
Continue-8
কুলকুন্ডলিনী_ও_গুরু_শিষ্য_সংবাদ
***#আধ্যাত্মিক সার্থকতার জন্য দৃঢ় সংকল্পযুক্ত ব্যক্তিত্ব খুবই জরুরী । এর জন্য প্রথম এবং প্রধান অস্ত্র হচ্ছে সংযম । যা কেবল কিছু জাগতিক প্রাপ্তি এবং পাণ্ডিত্যের জন্য নয় বরং যোগসাধনা সম্বন্ধে জানবার জন্য দরকার। যারা লোভের বশবর্তী হয়ে কিছু অলৌকিক ঘটনার সাক্ষী হওয়ার অনুসন্ধান করেন বা শাস্ত্রাদি পাঠ করেন তাঁদের চরিত্রের দৃঢ়তা থাকে না । তাঁদের বিশ্বাস আসে আবার চলে যায় ঠিক বুদবুদের মত । প্রকৃত অনুসন্ধানী ব্যক্তি লক্ষ্যের প্রতি আস্থা হারান না জাগতিক কোন বিষয়ে নিজেকে বন্ধনে ফেলেন না । এবং লক্ষ্যে পৌঁছানাের জন্য আমরন সংগ্রাম করে চলেন ।
***#সাময়িক সুখ দিয়ে পরিণামে দুঃখকেই লাভ করা হয় । সকলের সর্বপ্রকার সুখের পথ পরিত্যাগ করে মঙ্গলের পথ অনুসন্ধান করা উচিত। জ্ঞান কােন প্রকার আপেক্ষিক বস্তু নয় বরং তা আমাদের মধ্যেই আছে । এটি উদঘাটিত করতে হবে।
***#স্বামী অভেদানন্দ তাঁর বিশ্বখ্যাত মৃত্যুরহস্য ' ; গ্রন্থে এই গুরু - শিষ্য সম্বন্ধে সুনিপুণ ভাবে আলােকপাত করেছেন । তিনি বলেছেন , “ গুরু ও শিষ উভয়েই আশ্চর্যজনক অর্থাৎ আশ্চর্যের বিষয় হওয়া দরকার । আমাদের এই শাশ্বত জীবন মন্ত্র যিনি শিক্ষা দিতে পারেন সে অনন্য। সব শিক্ষকদের থেকে ভিন্ন । সাধারণ শিক্ষকরা এই মন্ত্র প্রদানে সক্ষম নন কেননা তারা সেই বিষয়ে অবগত নন । আমাদের মনে রাখতে হবে গুরু সময়ের ক্রমবিকাশের পথে বিভিন্ন স্তর বা অবস্থার মধ্য দিয়ে আসেন। সাধারনের মধ্যে শাশ্বত সেই মহাজ্ঞানের উপলব্ধি শুধু তিনিই দিতে পারেন।
***#কেবলই বই পড়ে কেউ এই জ্ঞান অর্জন করতে পারে না। তাই তাকে মনে প্রাণে উপলব্ধি করতে হয় , আর সেই উপলান্ধি আসবে দীর্ঘ অভ্যাসের ফলরুপে । এর জন্য নানান ধ্যান , ও সমাধি অভ্যাসের প্রয়োজন দীর্ঘকাল ধরে । যােগাভ্যাস যদি করা যায় তবে মুত্যুভয় থেকে চিরমুক্তি লাভ করা যায় । যখনই একবার নিজের দেহ , মন , ইন্দ্রিয় এবং জগতের উর্ধ্বে ও প্রাকৃতিক জড় নিয়ম থেকে মুক্ত ও স্বতন্ত্র অনুভব করতে পারা যায়, তখনই ব্যক্তি তার আত্মশক্তিকে উপলব্ধি করতে পারবেন । এই অনুভূতি বা আত্মােপলব্ধি দিবাকর নির্দেশ বা শিক্ষার সাহায্যেই লাভ করা যায় । সাধারণ শিক্ষক এই নির্দেশ দিতে পারেন না । শুধু পাঠে যে অভিজ্ঞতা লাভ হয় তা দিয়ে আত্মা বা ব্রহ্মতত্ত্ব সম্বন্ধে শিক্ষা নেয়া যায় না । যথার্থ শুরুরই একমাত্র শিষের দিব্যচক্ষু খুলে দেওয়ার শক্তি আছে । তবে সেই জ্ঞান লাভের জন্য শিষ্যেরও প্রস্তুতিস্বরূপ অন্তঃকরণ উন্মুক্ত অর্থাৎ পরিশুদ্ধ হওয়া প্রয়ােজন । কেননা একমাত্র পরিশুদ্ধ অধিকারীকেই শুরু আত্মজ্ঞান দান , করতে পারেন । শিষ্যের অন্তর বা মন , বুদ্ধি প্রভৃতি পরিশুদ্ধ অর্থাৎ চিত্ত শুদ্ধি না হলে গুরুর চেষ্টা বা উপদেশ যথাযথভাবে ফলন হয় না । তাই শিষ্যকে প্রস্তুতি ও অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের মাধ্যমে বিভিন্ন স্তরের মধ্যে দিয়ে আসতে হয় । একমাত্র আধ্যাত্মিক প্রবল ইচ্ছা ও দৃঢ় সংকল্পের ভিতর দিয়েই এই আত্মবিকাশের পথ , উমূক্ত হয় । অতএব আধ্যাত্মিক সাধনা মানবদেহেই করতে হবে । যোগ দ্বারাই এ সম্যক উপলব্ধি সম্ভব ।
***#যােগ কথাটা ব্যাপক । তবে আমরা আধ্যাত্মিক যোগ বলতে বুঝি জীবাত্মার সাথে পরমাত্মার যােগ , চঞ্চল প্রাণের সাথে স্থির প্রাণের যোগ , ভক্তের সাথে ভগবানের যোগ , দ্বৈতের সাথে অদ্বৈতের যোগ ইত্যাদি ।
***#মহামায়া প্রকৃতির তিন গুণকে আশ্রয় করে সবকিছু পরিচালিত করছেন । তাই মহামায়ার কৃপা ছাড়া অগ্রসর হওয়া সম্ভব নয় । তাকে জয় করতে সমর্থ চাই । নিয়মিত ক্রিয়া ও প্রাণায়ামের দ্বারা এটি অর্জন করতে হয় ।
***#মনকে স্থির করতে বা শূন্যভাবগত করতে সকল ইন্দ্রিয়ের নির্লিপ্ততা দরকার । বাইরের জগতের বিভিন্ন বিষয়ে মন সর্বদা লিপ্ত থাকে এবং সংসার প্রতিপালিত করতে হয় সবকিছু বুঝেও মন অনেক বিষয়ে বহির্মুখ প্রবণতার ফলে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারেনা । মনের কর্তৃত্ব মহাভারতের ধৃতরাষ্ট্রের মত । জ্ঞান আছে , শক্তি আছে , বুদ্ধি আছে অথচ জাগতিক ভােগ বাসনার মােহে অন্ধ । তাই ইন্দ্রিয় নিরপেক্ষতা খুবই জরুরী । আপনি স্থির মন নিয়ে জন্মালেন । তারপর রূপ , রস , গন্ধ , এবং শব্দ আপনাকে ধীরে ধীরে সংসারের রণাঙ্গনে মধ্যে প্রবেশ করালো আপনি মন ও বুদ্ধি এই সারথীর ব্যুহের মধ্যে পড়ে অভিমন্যু হয়ে গেলেন । বেরোবার কোন পথ নেই । যিনি বার করতে পারতেন সেই সদগুরু ( অর্জুন ) তখন অন্যত্র যুদ্ধ করছেন । মূলাধারে পঞ্চাতন্ত্রের একত্রে সহবস্থান । তাই প্রথম চক্র বা গাট মূলাধার দেহবোধের প্রধান জায়গা । এই গাট বা শৃঙ্খল না খুললে মুক্তির পথ আসেনা । কামনা - বাসনা , ভােগ প্রভৃতির লয় বা বিনাশ যােগের পথে যাওয়ার প্রথম এবং প্রধান ক্রিয়া । প্রাণায়াম বা ক্রিয়া করতে করতে এবং সাথে সাথে ভক্তিরসের ধারা অব্যাহত রাখলে এক তত্ত্ব পরবর্তী তত্ত্বে বিলীন হয় ।
***#একদিকে সংসারের আকর্ষণ , ঐশ্বৰ্য্য প্রাপ্তি ও ভোগ এবং অপরদিকে বৈরাগ্যের হাতছানিকে পরমানন্দের দিকে প্রবাহ। এটা মনে রাখা দরকায় সাংসারিক কর্মকান্ডে কামনা - বাসনা মধ্যে থেকেই বিবেক বৈরাগপ্ৰৰণ - আত্মজ্ঞান সম্পন্ন মনের আগুন জ্বালিয়ে রাখতে হয় । পদ্মফুল সর্বদা পাকে জন্মায় । আমাদের ধর্মে পথ ফুলের খুবই উচ্চস্থান ।
মনের সংসার অনন্দময় না হলে পরমানন্দ প্রাপ্তি হয় না
***#সেরকম শক্তি সম্পন্ন সাধু খুবই দুর্লভ যিনি শিষের মধ্যে সেই দুর্লভ বীজ রোপন করবেন যা একদিন মহীরুহে পরিনত হবে। তিনিই অজ্ঞানতারুপ অন্ধকার অপসারিত হয়ে পরমেশ্বরের সন্ধান দিতে পারেন।
***#বৃহদারণ্যক উপনিষদে অশ্বমেধ যজ্ঞের উপযােগী অগ্নিকে মনজ্যোতিরূপেই বর্ণনা করা হয়েছে এবং সূর্যকে অগ্নিই বিভিন্ন প্রকাশ বলে অভিহিত করা হয়েছে । আত্মতত্ত্ব উপলব্ধি নিজেকে করতে হবে । কেউ করে দিতে পারে না । স্বীয় স্বরূপ পরমাত্মা পরমেশ্বরকে মন্দিরের কোন প্রতীকে বা কোন মহাত্মার পদতলে উপলব্ধি করতে পারা যায় না । তাকে আপন হৃদয়ে আপন কর্মফলহীন কর্মধারায় সাক্ষাৎ করতে হয় ।
***#বড় বড় মঠ মিশনে ছুটাছুটি করে সময়ের অপব্যয় হয় মাত্র । সেই সময়টুকু নিজেকে আত্মস্থ করতে পারলে অধিক ফললাভ হয় । আমাদের শরীরই সবচেয়ে পবিত্র মন্দির । এই মন্দিরে সর্বদা বাস করেন সেইজন। নিজস্বতা বিসর্জন দিয়ে মহারাজ বলি হতে পারলে পরমেশ্বরের শ্রীচরণ পাওয়া যেতে পারে । আমাদের দেহ হচ্ছে সমস্ত তীর্থের সার । বায়ুকে ( প্রাণশক্তি কুন্ডলিনীকে ) নাভিমূলের মণিপুর চক্র হতে প্রেরণ করে মন্তকে সহস্রার চক্রে স্থাপনকে উদ্ঘাত বলে ।
***#উপনিষদ ঘােষণা করেছেন- " হে অমৃতের পুত্রগণ , হে দিব্যধাম নিবাসিগণ শ্রবণ কর । আমি এই অজ্ঞানান্ধকার হতে আলােকে যাবার পথ পেয়েছি । যিনি সকল জানার ওপারে , তাকে জানতে পারলেই লোক মৃত্যু অতিক্রম করতে পারে , মুক্তির আর কোন উপায় নাই কুলকুণ্ডলিনী তত্ত্ব অবগত হওয়া এবং দেহে সেই শক্তির জাগরণ আমাদের সাধনার মূল । আসুন আমরা সেই মহাশক্তি কুণ্ডলিনীকে প্রণাম করি ।
Continue-9
কাশীধাম
গঙ্গা , যমুনা ও সরস্বতী অর্থাৎ ইড়া , পিঙ্গলা ও সুষুম্না বা সত্ত্ব , রজঃ ও তমঃ এই তিনের উপরে কাশী অবস্থিত । এই কাশীধামে অন্নপূর্ণাসহ মৃত্যুঞ্জয় শিব বাস করেন ।
***#গুরূপদিষ্ট যৌগিক ক্রিয়াদ্বারা মূলাধারস্থিত কুলকুন্ডলিনী শক্তিকে জাগরিত করে কূটস্থে ( আজ্ঞাচক্রে ) স্থাপন করতঃ নিশ্চল ভাবে যিনি অবস্থান করতে পারেন , একমাত্র তিনিই কাশীবাসী হয়ে শিবত্ব প্রাপ্ত হয়ে থাকেন ।
১০৮ সংখ্যা এর মাহাত্ম্য
***#হিন্দুধর্মে 108 সংখ্যাকে পবিত্র মানা হয় সে জন্য দূর্গা পুজোতে 108 টা পদ্ম লাগে, দেবীর গলায় 108 বেলপাতার মালা পড়ানো হয়, নারায়ণ পুজোতে 108 তুলসীপাতা চড়ানো হয়, কিংবা জপের মালাতে 108 মনকা থাকে, বিভিন্ন আখড়ার সন্ত সমাজে মহামন্ডলেশ্বরের নামের আগে ' শ্রীশ্রী 108' দিয়ে শুরু হয়।
***#হিন্দুধর্মে সমস্ত অক্ষরের যে সংখ্যা আছে সেই গুলো দিয়ে যদি ব্রহ্মকে প্রকাশ করা যায় তবে সেই সংখ্যা হয় 108, সেজন্য 108 সংখ্যার এত মাহাত্ম্য আমাদের হিন্দু ধর্মে।
***#আর "ব্রহ্ম" শব্দের মত "সীতারাম" শব্দের প্রত্যেকটা অক্ষরের যে সংখ্যা সেই সংখ্যাকে যোগ করলেও যোগফল আসে 108। তাই "সীতারাম " নামটি ও হিন্দু ধর্মে সব থেকে পবিত্র নাম।
ব্রহ্ম= ব + র+ হ + ম= 23 + 27 + 33 + 25 = 108
সীতারাম = স + ঈ + ত +আ+ র +আ + ম = 32 + 4 + 16 + 2 + 27 + 2 + 25 = 108
***#প্রাচীন সংস্কৃতে ছিল ৫৪ টি অক্ষর
| ৫৪X২=১০৮ |
১০৮ কে সংস্কৃতে বলা হয় হর্ষদ সংখ্যা। কারণ এই সংখ্যাকে তার সংখ্যা সমষ্টি দিয়ে ভাগ করা যায় | ১+০+৮=৯ | আবার ১০৮ ভাগ ৯ = ১২
অদ্ভুত ভাবে প্রকৃতির অনেককিছু সঙ্গে জুড়ে আছে এই 108 সংখ্যা।
***#যেমনঃ
1. সূর্য্য আর পৃথিবীর মধ্যে দূরত্ব /সূর্যের ব্যাস 150,000,000 km/1,391,000 km = 108, অর্থাৎ পৃথিবী আর সূর্যের মধ্যে খানে 108 টা সূর্য বসানো যাবে।
2. সূর্যের ব্যাস পৃথিবীর ব্যাস 1,391,000 km/12,742 km = 108
অর্থাৎ সূর্যের মোট ব্যাসের ওপর 108 টা পৃথিবীর ব্যাস বসানো যাবে।
3. পৃথিবী আর চন্দ্রের মধ্যে দূরত্ব /চন্দ্রের ব্যাস 384403 km/3474.20 km = 108
অর্থাৎ পৃথিবী আর চন্দের মধ্যিখানে 108 চন্দ্র বসানো যাবে।
4. একজন সুস্থ মানুষের ক্ষেত্রে , 1মিনিটে হৃদয়ের কম্পন হয় = 72 বার
6 মিনিটে হয় = 72×6 = 432 = [ 108×4 ]
6 মিনিট = 1মুহূর্ত। সুতরাং 1 মুহূর্তে 108 × 4 বার হৃদকম্প হয়।
***#একজন সুস্থ মানুষের এক মিনিটে ১৫ বার প্রশ্বাস গ্রহণ ও নিঃশ্বাস ত্যাগ করার কথা। ১ ঘণ্টায় ৯০০ বার, ১২ ঘণ্টায় ১০, ৮০০ বার, সেই হিসেবে ১০৮ বার জপ করলে বা মন্ত্র উচ্চারণ করলে পুণ্যলাভ হয় বলে বিশ্বাস। জপমালায় মনকা থাকে ১০৮ টি।
***#হিন্দু বা সনাতন শাস্ত্রে ১০৮ টি পুরাণ ও উপনিষদ।
মানবদেহে মোট ১০৮ টি এনার্জি লাইন বা শক্তিরেখা আছে। দুই রেখার ছেদবিন্দুতে আছে চক্র।
***#নটরাজ এর তাণ্ডবের থেকে ভারত নাট্যাম এর সৃষ্টি, সেই নৃত্য শাস্ত্রে ১০৮ টি হস্ত ও পদমুদ্রা আছে।
***#আয়ুর্বেদে আছে ১০৮ টি মর্মবিন্দু। দেহের সেই বিন্দুগুলোয় স্পর্শ বা চিকিত্সায় সুস্থতা লাভ করে মানুষ।
১০৮-এর মধ্যে ১ হল সর্বোচ্চ সত্যর প্রতীক। ০ বোঝায় শূন্যতা এবং সম্পূর্ণতা। ৮ হল ইনফিনিটির প্রতীক।
Continue-10
*** যোগীর গীতা ***
' গী ' এবং ' তা ' এই দুই শব্দ যোগ করে হয় গীতা। ' গী ' অর্থে গান এবং ' তা ' অর্থে সমতা বা একতা। মহাভারতের ঘটনা অনুসারে শ্রীকৃষ্ণ কুরুক্ষেত্রে রথে
বসে কেবলমাত্র অর্জুনকে গীতাজ্ঞান দান করেন।
*#ধর্মযুদ্ধে তথা সাধনসমরে অবতীর্ণ হয়েও পরধর্মে ( আত্মীয় স্বজনদের মোহে তথা ইন্দ্রিয়াদির আকর্ষণে ) আসক্তি প্রকাশ করে অর্জুন বিষাদগ্রস্ত হয়ে পড়েন। তখন ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তাঁকে স্বধর্মে (অর্থাৎ প্রাণকর্মে
তথা শ্বাসপ্রশ্বাসের আরোহণ অবরোহণ স্বরূপ প্রানায়ামে ) অনুপ্রাণিত করে আত্ম উপলব্ধির জন্য পরামর্শ দেন (" তস্মাৎ যোগী ভবার্জুন "।
*#এই উদ্দেশ্যে ছন্দোবদ্ধ ভাষায় তাঁদের সাধন উপযোগী কর্ম ও পন্থার কথোপকথন গীতার মূল আলোচ্য বিষয়। তাই ভগবান শ্রীকৃষ্ণ এখানে গুরু এবং অর্জুন শিষ্যের ভূমিকায় অবতীর্ণ।
*#শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার মূল প্রণেতা মহাজ্ঞানী ব্যাসদেব প্রত্যেক অধ্যায়ের শেষে গীতাতত্ত্বের স্বরূপ বর্ণনা করে বলেছেন, গীতা ব্রহ্মবিদ্যা ও যোগশাস্ত্র। গীতার অন্তরালে মূলতঃ মানবদেহের যোগ চেতনার তাৎপর্য নিহত আছে।
*#গীতার তত্ত্বগুলো যেহেতু যোগলব্ধ প্রত্যক্ষ জ্ঞানের উপর প্রতিষ্ঠিত, তাই যে যোগীব্যক্তি দেহ, মন ও প্রাণকে আত্মময় করে তুলতে পারবেন তাঁর অন্তর্জগতের মানসলোকে গীতার নিত্য শাশ্বত জ্ঞান ও অনুভূতি উত্তরোত্তর প্রাণবন্ত হয়ে উঠবে। একইসঙ্গে গীতার নীতিগুলো দৈনন্দিন জীবনের চলার পথে দুঃখ- কষ্ট, হতাশা এমনকি আনন্দের মাঝেও নির্দেশিকা হয়ে ন্যায়নিষ্ঠ, নির্ভীক ও আত্মসচেতন হয়ে চলতে সাহায্য করবে।
*#আত্ম_উপলব্ধি সদ্ গুরুর উপদেশমত উদ্যোগী মানুষ যোগাভ্যাসের সঙ্গে অনুসন্ধিৎসু চিত্তে গীতা ব্যাখ্যায় মনোনিবেশ করতে পারলে মানবদেহের সঙ্গে গীতার যে নিগূঢ় সম্পর্ক নিহিত আছে সে সম্পর্কে সম্যক বোধশক্তিই কেবল বাড়বে না, সেই সঙ্গে অন্তরের গভীরে গীতা রহস্য-সূত্রের আবরণ ধীরে ধীরে উন্মোচিত হয়ে তাঁকে নিত্য দিব্য অনুভূতিতে অভিভূত করবে।
*#সিদ্ধপুরুষরা_শাস্ত্রের_সাথে_মেলে_না_এমন_কথা_বলেন_কেন ?
*#শ্রীশ্রীবিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীঃ সিদ্ধ তো কতরকম আছে - ভুতসিদ্ধ, প্রেতসিদ্ধ, কোন বিশেষ বিশেষ দেবদেবী সিদ্ধ, ঐশ্বর্যসিদ্ধ ইত্যাদি । যিনি যা সংকল্প করেন তাহা পূরণ হলেই তিনি সিদ্ধ । কিন্তু আমি যা চাই, সে বিষয়ে তিনি সিদ্ধ না হলে তিনি আমাকে কী সাহায্য করবেন ? কারণ তিনি যে বিষয়ে সিদ্ধ তিনি তো কেবলমাত্র সেই বিষয়েই আমাকে পথ দেখাতে পারেন ।
*#সিদ্ধ হলেই যে তিনি সর্বজ্ঞ হবেন তার কোন মানে নেই । আবার সিদ্ধ হলেই যা তিনি ধার্মিক হবেন তাও বলা যায় না । ধর্মের সঙ্গে কোন প্রকার সংস্রব না রেখেও কত লোক কত বিষয়ে সিদ্ধ । সিদ্ধ শুনলেই যে দীক্ষা নেবার জন্য তাঁর নিকট দলে দলে ছুটে যাওয়া, এটা বোকামি। সাত্ত্বিক প্রকৃতির একজন মানুষ, সিদ্ধ শুনতে পেয়ে যদি একজন কাপালিক বা পিশাচসিদ্ধ লোকের নিকট দীক্ষা নিয়ে মদ, মাংসাদি সহ তামস ভক্ষণ করে, তার কি কোন লাভ হবে ? না, যা লাভ করার জন্য সে দীক্ষা নিয়েছিল তা প্রাপ্ত হবে ? প্রকৃতি বিরুদ্ধ
সাধন করে এই প্রকার সিদ্ধ গুরুর সাহায্যেও কোন লাভ হয়
***#দক্ষিণাকালীর_ধ্যানমন্ত্র_ও_তাঁর_অনুবাদঃ
ওঁ করালবদনাং ঘোরাং মুক্তকেশীং চতুর্ভুজাম্ ।
কালিকাং দক্ষিণাং দিব্যাং মুন্ডমালাবিভূষি তাম্।।
সদ্যশ্চিন্নশিরঃ খড়গবামাধোর্দ্ধক রাম্বুজাম্ ।
অভয়ং বরদঞ্চৈব দক্ষিণোদ্ধার্ধপাণিকাম্।।
মহামেঘপ্রভাং শ্যামাং তথা চৈব দিগম্বরীম্ ।
কন্ঠাবসক্তমুন্ডালী-গলদ্রুধিরচর্চিতাম্ ।
কর্নাবতংসতানীতশ বযুগ্মভয়ানকাম্ ।।
ঘোরদ্রংষ্টাং করালস্যাং পীণোন্নতপয়োধরাং।
শবনাং করসংঘাতৈঃ কৃতকাঞ্চীং হসন্মখীম্ ।।
সৃক্কদ্বয়গলদ্রক্ত-ধারাবিস্ফুরিতাননাম্ ।।
ঘোররাবাং মহারৌদ্রীং শ্মশ্মানালয় বাসিনীম্ ।
বালার্কমণ্ডলাকা রলোচনত্রিয়ান্মি তাম্ ।।
দস্তুরাং দক্ষিণব্যপিমুক্ তালম্বিকচোচ্চয়া ম্ ।
শবরূপমহাদেবহৃদয়োপরি সংস্থিতাম্ ।।
শিবাভির্ঘোররাবা ভিশ্চতুর্দিক্ষু সমন্বিতাম্ ।
মহাকালেন চ সমং বিপরীতরতাতুরাম ।।
সুখপ্রসন্নবদনাং স্মেরানন সরোরুহাম্ ।
এবং সঞ্চিন্তেয়ৎ কালীং সর্বকাম- সমৃদ্ধিদাম্ ।।
*#অনুবাদঃ
-----------------------------------------
দক্ষিণা কালী করালবদনা ঘোরা, মুক্তকেশী ও চতুর্ভুজা, দিব্য জ্যোতি সম্পূর্ণা দেবী মুন্ডমালা ধারিণী । মায়ের বামদিকের নিচের হাতে সদ্যচ্ছিন্ন মুন্ড, উপরের বাম হাতে খড়গ । ডানদিকের উপরের হাতে অভয় এবং নিচের হাতে বরমুদ্রা ধারণ করে আছেন । মায়ের গায়ের রং কাল মেঘের প্রভার মত শ্যামা । তিনি দিগম্বরী মানে বস্ত্রহীণা । উনার গালার মুন্ডমালা গুলো থেকে বের হওয়া রক্ত উনার দেহ কে রন্জিত করছে, দুটি শবশিশু তার কর্ণভূষণ হওয়াতে দেবীকে ভয়ঙ্করী দেখাচ্ছে । তিনি তার করাল দন্ত দিয়ে নিজের জিহ্বা তে কামড় দিয়ে আছেন, হাতের মালা তিনি কোমড়ে বেঁধে রেখেছেন । তিনি মৃদুহাসি দিয়ে থাকেন এবং উনার মুখ থেকে রক্তের ধারা বের হচ্ছে আর উনার মুখে অনন্ত কোটি সূর্যের তেজ বিদ্যমান । তিনি অতিশয় ক্রোদ্ধা, ভয়ংকর নাদকারিণী, উনার তিনটি চোখ আর সেই সকালের সূর্যের মত লালপ্রভাময় । দেবী শবরুপ মহাদেবের হৃদয়ের মধ্যে দাড়িয়ে আছেন । উনার চারদিকে চিতকারী শিয়ালের দল । তিনি মহাকালের সাথে বিপরিতরাতুরা, তিনি সুখ প্রসন্ন মুখ তার । তিনি মোক্ষদায়িনী এবং সকল ইচ্ছাপূরণকারিণী।।
Continue-11
ক্রিয়াযােগ কি ?
"শাস্ত্ৰণ্যাধীত্যাপি ভবন্তি মূর্খাঃ যস্তুক্রিয়াবান্ পুরুষঃ স বিদ্বান্ । ”
শাস্ত্র অধ্যয়ণ করেও লােক মুর্খ থাকে কিন্তু যিনি ক্রিয়াবান তিনিই বিদ্বান। যােগ শব্দটি বহু প্রাচীন। ঋগ্বেদেই এই শব্দটির প্রথম ব্যবহার হয়। শাস্ত্রানুযায়ী “যােগ ” অর্থ যুক্ত হওয়া বা সংযােগ সাধন। বর্তমান কালে “যােগ ” শব্দটি বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিভিন্ন ভাবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। যেমন- অংকশাস্ত্রে “দুই বা ততােধিক সংখ্যার সংযুক্তি করণের প্রক্রিয়াকে যােগ বলা হয়।" আবার সমধর্মবিশিষ্ট একাধিক বস্তুর সংযােগকেও যােগ বলা হয়। সাংখ্যদর্শনের মতে, "অনাদি পুরুষের সঙ্গে প্রকৃতির মিলনকে যােগ বলা হয়।” হিন্দু দর্শনশাস্ত্রে, “পরমাত্মার সঙ্গে জীবাত্মার মিলনকে যােগ বলা হয়।” শৈবগণের মতে
“শিব এবং শক্তির মিলনকে যােগ বলা হয়।" বৈষবগণের মতে, “রাধা এবং কৃষ্ণের মিলনকে যােগ বলা হয়।” শ্রীমদ্ভগবদগীতায় যােগের সংজ্ঞা বলা হয়েছে ,
“সিল্কসিন্ধেদ্ধঃ সমম্বা সমত্ব যােগ উচ্যতে" ( ২/৪৮ )
অর্থাৎ,কর্মের সিদ্ধি এবং অসিদ্ধিতে সমভাব জ্ঞানই যােগ। আবার অন্যত্র বলেছেন, “যােগঃ কর্মসুকৌশল। ” অর্থাৎ কর্মের সুকৌশলই যােগ । যে অবস্থা লাভ করে সাধক অন্য লাভকে অধিক বলে মনে করেন না, যে অবস্থায় স্থিত হলে অতিরিক্ত দুঃখ দ্বারাও বিচলিত হন না, সেই দুঃখ সংযােগের বিয়ােগরুপ অবস্থাকেই যোগ বলা হয়। জ্ঞানসঙ্কলিনী তন্ত্রে বলা হয়েছে- “সর্বচিন্তা পরিত্যাগে নিশ্চিন্তে যােগ উচ্যতে।” অর্থাৎ সর্বচিন্তা পরিত্যাগকেই যােগ বলে।
*#পাতঞ্জল যােগ দর্শনের ভাষায় বলা যায়, "যােগশ্চিত্তবৃত্তি নিরােধঃ।” অর্থাৎ চিত্তের বৃত্তিগুলাের নিরােধকেই যোগ বলা হয়। শিব সংহিতার মতে,
“মন্ত্রযোগে হঠলৈ লয়যােগস্তৃতীয়তঃ । চতুর্থো রাজযােগঃ স্যাৎ স দ্বিধাভাব বর্জিতঃ।।”
অর্থাৎ যােগ প্রধানত চার প্রকারঃ
(১ ) মন্ত্রযোগ
(২ ) হঠযােগ
(৩ ) লয়যােগ
(৪ ) রাজযােগ
*#এছাড়াও ভারতবর্ষে সাধকসমাজে বহু প্রাচীনকাল থেকে আরও বহু প্রকার যােগ পথের নির্দেশ পাওয়া যায়। তার মধ্যে প্রায় সবই ছিলেন সাধু - সন্ন্যাসী মহলে অতি গুপ্ত। সে সব যােগের প্রক্রিয়া সাধারণ গৃহীদের যেমন নাগালের বাইরে ছিল তেমনি দুঃসাধ্যও ছিল। সাধারণ মানুষ যারা প্রাচীনকালের কঠিন যােগ ক্রিয়া করতে সমর্থ নয়, সেই সমস্ত সাধারণ গৃহীদের জন্য কাশীবাসী যােগিরাজ শ্ৰীশ্ৰীশ্যামাচরণ লাহিড়ী মহাশয় যে সহজ যােগক্রিয়া প্রচলন করেছিলেন তাই "ক্রিয়াযােগ” বা “ক্রিয়া" নামে পরিচিত। শাস্ত্রমতে এই সাধন পথকে আত্মবিদ্যা , অধ্যাত্মবিদ্যা বা ব্রহ্মবিদ্যা বলা হয় । অনেক সিদ্ধ মহাপুরুষের মতে আজ পর্যন্ত যে সব মুক্তির উপায় বের হয়েছে তার মধ্যে এই ক্রিয়াযােগই হচ্ছে সর্বাপেক্ষা সহজ। ক্রিয়াযােগ প্রকৃতপক্ষে যে এক প্রকার যােগ বা সাধন প্রণালী তা নয়। গীততাক্ত শ্রীকৃষ্ণ যে সুপ্রাচীন যােগমার্গ প্রিয় শিষ্য অর্জুনকে শিক্ষা দিয়েছিলেন যা আবালবৃদ্ধবনিতা এমন কি জরাবৃদ্ধ গৃহস্থ লােকেও সহজে এ কৌশল অবলম্বন করতে পারে। ত্রিকালজ্ঞ ঋষি শ্ৰীশ্ৰীবাবাজী মহারাজ বহু যুগের বিস্মৃতির অন্তরাল থেকে সেই সুকৌশল ১৮৬১ সালে কাশীবাসী যােগিরাজ শ্রীশ্রীশ্যামাচরণ লাহিড়ী মহাশয়কে রাণীক্ষেতের জঙ্গলে অলৌকিক কৌশলে ডেকে নিয়ে সেই যুগােপযােগী ক্রিয়াযােগের সহজতর কৌশল শিখিয়ে জনসমাজে লােকশিক্ষার জন্য পাঠিয়েছিলেন। সেই কৌশল আজও সারা বিশ্বে “ক্রিয়াযোগ” নামে পরিচিত । সত্যিকারের আত্মজ্ঞান পিপাসু লােকের কাছে এই ক্রিয়াযােগ সাধন গুরুমুখী বিদ্যারূপে প্রিয় জিনিসের মত সমাদর পেয়ে আসছে।
*#সেই শুভদিনে শ্রীশ্রীবাবাজী মহারাজ শ্রীশ্রী লাহিড়ীমহাশয়কে ক্ৰিয়াদীক্ষা দেবার
সময় গীতার অনুকরণে বলেছিলেনঃ "আজকে এই উনবিংশ শতাব্দীতে তোমার হাত দিয়ে আমি জগৎকে যে ক্রিয়াযােগ দান করছি তা হচ্ছে সেই একই বিজ্ঞানের পুনরুজ্জীবন, যা শ্রীকৃষ্ণ হাজার হাজার বছর আগে অর্জুনকে দিয়েছিলেন।” শ্রীভগবান গীতায়া বলেছেন -
ইমং বিবস্বতে যােগং প্রােক্তনহমবষম্ । বিবস্বান্মনবে প্রাহ মনুরিক্ষৰাকহেরবীৎ ।। এবং পরম্পরা প্রাপ্তমিমং রাজয়াে বিদুঃ । স কালেনেহ মহতা যােগাে নষ্টঃ পরন্তপ ।।
- গীতা ( ৪১-২ )
অর্থাৎ আমি সুৰ্য্যকে এই অক্ষয় এবং অব্যয় যোগ বলেছিলাম । সূৰ্য্য ( স্বপুত্র ) মনুকে এবং মনু ( স্বপুত্র ) ইক্ষাকুকে বলেছিল । নিমি, জুনকাদি, রাজর্ষিগণ এরূপে পুরুষ পরম্পরা প্রাপ্ত এ যােগ জেনেছিলেন । হে পরন্তপ, ইহলােকে সেই যােগ দীর্ঘকাল পরে নষ্ট হয়েছে। শ্রীভগবান তার এক প্রাচীনতম অবতার কালে এ অব্যয় এবং অক্ষয় যােগ সাধন প্রণালী প্রাচীন প্রনালী বিবস্বানকে দিয়েছিলেন ( বিবস্বান থেকে যে বংশের উৎপত্তি তাকেই সূৰ্য্য বংশ বলে। কেননা বিবস্বান শব্দে সূর্য্য বুঝায় ) বিবস্বান মনুকে দান করেন ( মানবধর্ম শাস্ত্র বা মনুসংহিতার রচয়িতা )। এ সকল মানবধর্ম শাস্ত্রানুমোদিত রীতিনীতি বা প্রথা আজও ভারতবর্ষের নানা জায়গায় প্রচলিত আছে। মনু আবার তার নাসাপুট থেকে উৎপন্ন পুত্র ইক্ষাকুকে এ জ্ঞান দান করেন। এভাবে জড়যুগ পর্যন্ত বংশ পরম্পরাক্রমে এ যোগ সাধন প্রণালী মুনিঋষিদের দ্বারা প্রচারিত হয়ে আসছে। বহু কাল ধরে এভাবে যােগ প্রচারিত থাকার পর কালক্রমে মুনি ঋষি এবং ব্রাহ্মণদের মন্ত্রগুপ্তি আর মানুষের ধর্ম পিপাসার অভাবের দরুন এই পরম পবিত্র যােগ ক্রমশঃ সাময়িকভাবে বিলুপ্ত হয় অর্থাৎ ভস্মাচ্ছাদিত আগুনের মত লুকিয়ে থাকে। চিরন্তন সত্য চিরদিনের মত কখনও বিলুপ্ত প্রাপ্ত হয় না। একেই গীতায় কালক্রমে যােগনষ্টের কথা উল্লেখ করেছেন। প্রাচীনকালে এ যােগক্রিয়াগুলাে মুনি ঋষির অভ্যাস করতেন। ভগবান শ্রীকৃষ্ণের মানব দেহে জন্মের আগেও এ যোগের প্রচলন ছিল। বর্তমানেও আছে , চিরকাল থাকবে ।
*#এ যােগের নাম অমর যােগ। কাল প্রভাবে মাঝে মাঝে যখনই মলিন হয় তখনই কোন মহাপুরুষের আর্বিভাব হয়ে এ যােগের পুনঃস্থাপন করেন। শ্ৰীশ্ৰীলাহিড়ী মহাশয় প্রচারিত ক্রিয়াযােগ প্রকৃতপক্ষে যে অন্য এক প্রকার যােগ বা শাস্ত্রে বহিভূত যােগ বা সাধন প্রণালী তা নয় । পাতঞ্জল যােগদর্শনে এই ক্রিয়াযােগের উল্লেখ আছে।
“তপঃ স্বাধ্যায়ের প্রাণিধানানি ক্রিয়াযােগঃ।”
( সাধন পাদ ১ সূত্র )
অর্থাৎ “তপস্যা, স্বাধ্যায় ও ঈশ্বর প্রাণিধানই হচ্ছে ত্রিয়াযােগ।”
*#যােগসিদ্ধির উদ্দেশ্যে প্রক্রিয়া সহকারে পরমাত্মার সহিত সংযােগ স্থাপনই ক্রিয়াযােগ। তার ভাষায় ক্রিয়াযােগ সম্বন্ধে আরও বলা যায় –“ক্রিয়াযােগ হচ্ছে অতি দ্রুত সকল দুঃখ ক্লেশমুক্ত সকল বাধা বন্ধনহীন অনাদি অনন্তু পরমাত্মার স্বরূপ দেখতে পাওয়ার চাবিকাঠি। যার দ্বারা দেহকারাগারের বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে পরমাত্মার সঙ্গে মিলিত হওয়া যায়। ” তান্ত্রিক এবং বৈদিক উভয় মতেই ক্রিয়াযােগ সাধন প্রণালী একই প্রকার। এবং ক্রিয়াযােগ পথৈঃ পুমান বৈদিক তান্ত্রিককৈঃ । অন্যভয়তঃ সিদ্ধিং মন্দ্রো বিন্দত্যভাপসিতাম্ ।। – শ্ৰীমদভাগবদ ১১ স্কন্ধ । ( ২৭-৪৯ ) অর্থাৎ, এই প্রকার ক্রিয়াযােগ পথে বৈদিক ও তান্ত্রিক সাধকগণ উভয়ে অর্চণা করে স্ব স্ব অভীষ্ট সিদ্ধিলাভ করেন। বলাবাহুল্য এই ক্রিয়াযােগ একটি অধ্যাত্ম কর্ম, যার দ্বারা আত্মজ্ঞান লাভ করা যায়। গীতায় শ্রীভগবান আবার বলেছেন-
“এষা তেহভিহিতা সাংখ্যে বুদ্ধিযোগেমিং শৃণু । বুদ্ধ্যা যুক্তো যয়া পার্থ কর্মবন্ধং প্রহাস্যসি ।।”
অর্থাৎ, জ্ঞানীদিগের এই মত যে জ্ঞান প্রাপ্তির জন্য চৈতন্য প্রকাশক ক্রিয়ায় নিযুক্ত হওয়া প্রয়ােজন। কারণ এর দ্বারা সমস্ত কর্মবন্ধন হতে মুক্ত হওয়া যায়। এই ক্রিয়াযােগই গীতােক্ত কর্মযােগ। প্রাণাপানয়ো কর্মোতি। – প্রাণ ও অপানের কৰ্ম্মই ক্রিয়া।
“যােগঃ কসু কৌশল।”
(গীতা ২/৫০ ) ক্রিয়াযােগ শাস্ত্রোক্ত পরমজ্ঞান লাভের এক বিজ্ঞান সম্মত সাধন প্রণালী।
"জানং বিজ্ঞান সহিতং যজ জ্ঞাত্বা মােক্ষ সেহশুভাৎ।"
- বিজ্ঞান সম্মত উপায়ে ব্রহ্মজ্ঞান লাভ করলে সংসার বন্ধন হতে মুক্তি প্রাপ্ত হওয়া যায়।
*#ক্রিয়াযােগ সাধনে অনুভবসিদ্ধ অজ্ঞান প্রাপ্তি হয়। এটিই বিজ্ঞান সম্মত উপায়। অর্থাৎ, প্রত্যক্ষ জ্ঞানানুভূতিমূলক আত্মবিজ্ঞান। ক্রিয়াযােগের মাধ্যমে প্রত্যক্ষ অনুভূতি লাভ করা যায় এবং ক্রমে পরমাত্মার সঙ্গে একীভূত হওয়া যায়। যা মনুষ্য জীবনের শ্রেষ্ঠ সম্পদ। তখন যে কী আনন্দ তা বলে বা লিখে প্রকাশ করা যায় না। কারণ বলার কোন উপায় থাকে না। সেই অপার শাশ্বত আনন্দ শুধু নিজ বােধগম্য। শ্রদ্ধেয় আনন্দ মােহন লাহিড়ীর মতে, "ক্রিয়াযােগ এবং ইহার বিজ্ঞান সম্মত বিস্ময়কর পরিণতির কথা ভারতীয় যেগিগণ সবিশেষ অবহিত আছেন কিন্তু অনেকেই ভুলে গেছেন যে এই ক্রিয়াযােগ মূলতঃ ঈশ্বরে পরানুরক্তিমূলক আধ্যাত্মিক অভিব্যক্তির স্বাভাবিক ফলস্বরূপ সাধন প্রয়াস। যদিও আত্মিক উন্নয়নের প্রচেষ্টার সঙ্গে সঙ্গে যুগপৎ দেহমনের পরিবর্তন স্বতঃই হয়ে থাকে, তবু ইহা পরীক্ষা - নিরীক্ষার দ্বারা জানবার চেষ্টা চলছে যে দৈহিক মানসিক পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে আমরা চৈতন্য রাজ্যে ফিরে যেতে পারি কিনা। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশতঃ অনেকেই অন্তর্মূখীন শেষ লক্ষ্যের কথা বিস্মৃত হয়েছেন এবং আত্মানুসন্ধানের লক্ষ্যপথে প্রযত্নশীল না হয়ে ঐন্দ্রজালিকরূপে রূপান্তরিত হয়ে পড়েছেন। বর্তমানে যােগসাধন বিষয়টিকে যেভাবে ব্যবহার করা হয়, তা যেন ভগবদ্ সম্পর্ক লেশহীন স্বতন্ত্র এক বিজ্ঞান চর্চা মাত্র।" পরমহংস যােগানন্দের মতে - "এই ক্রিয়াযােগের বিধি সনাতন। এ গণিতশাস্ত্রের মতাে একেবারে অভ্রান্ত যােগ বিয়ােগের সহজ প্রণালীর মত ক্রিয়াযােগের বিধিও কখন নষ্ট হতে পারে না। গণিত শাস্ত্রের সমস্ত পুস্তক অগ্নিতে আহুতি দিলেও যুক্তিবাদী মন যেমন এর সত্য সব ঠিক পুনরায় আবিষ্কার করে ফেলবে, তেমনি যােগশাস্ত্রের সমস্ত বই নষ্ট করে ফেললেও যদি একজন প্রকৃষ্ট যােগী আবির্ভূত হন - যার মধ্যে যদি শুদ্ধাভক্তি ও শুদ্ধাজ্ঞানের সমন্বয় ঘটে তাহলে তিনি মূলবিধি সবই পুনরায় আবিষ্কার করে ফেলতে পারবেন। ” যােগিরাজের শিষ্য শ্ৰীযুক্তেশ্বর গিরি মহারাজ বলেছেন - "ক্রিয়াযােগ হচ্ছে এমন একটি উপায় যার দ্বারা মানব জাতির বিবর্তন খুব দ্রুত সাধিত হতে পারে। প্রাচীন যােগীরা আবিষ্কার করেছিলেন যে, ব্রহ্মজ্ঞানলাভের রহস্য শ্বাস প্রশ্বাস নিয়ন্ত্রনের সঙ্গে খুব ঘনিষ্টভাবে বিজড়িত।"
*#বিশ্বের জ্ঞানভান্ডারে এ হচ্ছে ভারতবর্ষের অপূর্ব আর অমরদান । প্রাণশক্তি যা সাধারণতঃ হৃৎপিন্ড পরিচালনায় ব্যয়িত হয়, তা অবিরাম শাসপ্রশ্বাসের গতি স্থির করবার প্রণালী দ্বারা উচ্চতম সাধনের জন্য মুক্ত করা আবশ্যক। ক্রিয়াযােগই মনকে স্থির করবার অন্যতম প্রকৃষ্ট উপায় । প্রাণের চাঞ্চল্যেই মনের চাঞ্চল্য ঘটে থাকে। শ্বাস প্রশ্বাসের গতি বহির্মুখী বলেই মনও বহির্মুখী। ক্রিয়াযােগের দ্বারা শ্বাস প্রশ্বাসের গতি অন্তর্মুখী করলে মনও অন্তর্মুখী হয় এবং ধীরে ধীরে স্থির হয়। স্থিরত্বই মুক্তি এবং চঞ্চলতাই বন্ধন। শাস্ত্রে উক্ত হইয়াছে - "নিশ্চলং ব্রহ্ম উচ্যতে।" ”অর্থাৎ, নিশ্চল বা স্থির অবস্থানই ব্রহ্ম।"
স্বামী বিদ্যানন্দ গিরি মহারাজ তার "ক্রিয়াযােগ” গ্রন্থে লিখেছেন - "ক্রিয়াযােগ নীরব অনাড়ম্বর সাধন - যােগাসনে বসে মৌনব্রত মাত্র। তােমার দেহশিরে বসে আছেন তোমার আরাধ্য দেবাদিদেব সদাশিব। তােমার দেহাভ্যন্তরে আছেন তােমার বিশ্ব জননী, তােমার আরাধ্যা দেবী কুন্ডলিনী। তােমার মন্ত্ররূপে তােমারই মধ্যে - তােমার অন্তরে বাহিরে প্রবাহিত হচ্ছে তােমার শ্বাস- প্রশ্বাস। ঐ শ্বাস প্রশ্বাসেই ধ্বনিত হচ্ছে তােমার মন্ত্র ওঁকার। ঐ শ্বাস - প্রশ্বাসই তোমার জপমালা, তােমার সাধনার মূল উপকরণ।ফুল চন্দনের সুগন্ধ তােমারই সাধন প্রয়াসে অভিব্যক্ত হবে, - তােমাকে বাগিচায় গিয়ে ফুল তুলে আনতে হবে না। তােমার সাধন প্রচেষ্টায় তোমারই মধ্যে জ্বলে উঠবে অগ্নির প্রদীপ শিখা, তােমারই শিরােদেশে ভেসে উঠবে চন্দ্রমার দিব্যকান্তি , জ্যোতির্ময় সূর্যপ্রভা! সাধনার কুশলতায় তুমি যা যা দর্শন করছো, বােধ করছ একদিন দেখবে “তুমিই সেই। তােমার আর কিছু পৃথক সত্ত্বা নাই। ইহাই চিরমুক্তির আস্বাদন। ক্রিয়াযােগের ইহাই পরমাসিদ্ধি। ” এই সব শাস্ত্র দেখে মনে হয় যে, জগৎগুরু যােগিরাজ লাহিড়ী মহাশয় যে যােগের প্রবর্তন করেছেন, তা অতি উৎকৃষ্ট এবং যথাসম্ভব সরল। কারণ তিনি প্রাণায়ামের সঙ্গে সঙ্গে চক্রে চক্রে মনকে রাখতে বলেছেন। অতএব তার এই ক্রিয়াযােগে প্রাণবায়ু ও মন উভয়কেই এক সঙ্গে নিরুদ্ধ করার প্রক্রিয়া দেখা যাচ্ছে। আরও তিনি যে সব ক্রিয়াযােগান্তর্গত সাধন প্রণালী প্রবর্তিত করেছেন, সেইগুলির অনুষ্ঠানে মনকে কত অন্তর্মুখী করে দেয়, তা ভাবলে বিস্মিত হতে হয়।”
তাই পরিশেষে এই বলা যায়, "যােগই মুক্তির উপায়।"
(সমাপ্ত)
*#
সাধনা কি বিজ্ঞান সম্মত ?
মানুষের শরীরের মধ্য দিয়ে সাত হাজার দুশাে ( ৭২০০ ) নাড়ী বিদ্যমান জীববিজ্ঞানের তত্ত্ব অনুযায়ী । সাধন জগতের লােকেরা মনে করেন প্রায় তিন লক্ষের ওপর নাড়ী রয়েছে মানবদেহে । নাড়ীদের নাম ও সাধন জগতে পৃথক । কুলকুণ্ডলিনী শেষ অংশটি মূলাধার চক্রের সঙ্গে যুক্ত রয়েছে সুষুস্মাড়ীকে সাড়ে তিন পাক দিয়ে ঘুমন্ত অবস্থায়। এই কুলকুণ্ডলিনী জড়িয়ে ওপর দিয়ে উঠে গেছে । ঈড়া পিঙ্গলা সুষুম্ননাড়ী একেবারে সহস্রার ঠিক নীচ পর্যন্ত তার ওপরে একহাজার দলবিশিষ্ট সাদা মহাপদ্ম বা জ্ঞান ব্ৰহ্ম রয়েছেন । সাধকেরা ঈড়া ও পিঙ্গলাকে যথাক্রমে চন্দ্র ও সূর্য বলেন এবং গঙ্গা - যমুনার সঙ্গে তাদের তুলনা করেন । সুষুম্না নাড়ীকে বজ্রনাড়ী বা সরস্বতী বলেন । ঈড়া পিঙ্গলা সুষুম্না প্রত্যেকটি নাড়ীই কুলকুণ্ডলিনীকে স্পর্শ করে ওপর দিকে উঠেছে । সাধকেরা মনে করেন প্রত্যেকটি নাড়ীর ভেতর সুক্ষ্ম জ্বালিকা রয়েছে যার মধ্যে আবার ছােটছােট প্রদীপ জ্বলে । ঐ প্রদীপ শিখায় অনন্তবার ওঁ এই প্রণব অক্ষরটি কুলকুণ্ডলিনী জাগালে ধ্বনিক্রিয়া শুরু করে । অনবরত ওঁ এই - শব্দ ও ছবি সাধক নিজে অনুভব করেন স্পষ্টভাবে । ঈড়া পিঙ্গলা সুষুম্না নাড়ী যেখানে মিলিত হচ্ছে সেটি পবিত্র তীর্থস্থান ত্রিবেণী সঙ্গম । ভারতবর্ষে , উত্তরপ্রদেশে , এলাহাবাদে যেখানে গঙ্গা ও যমুনা স্পষ্টভাবে এবং সরস্বতী ( অন্তঃসলিলা ) নদী মিলেছে সেই স্থানটিকে পবিত্র ত্রিবেণী তীর্থ বলা হয় । ধর্মপ্রাণ ভারতবাসী এই স্থানটিতে স্নান করে পুণ্যলাভ করেন । মানুষের দেহে মাথায় সহস্রার বা শ্বেত শতদল রয়েছে । একহাজারটি দলবিশিষ্ট মহাপদ্ম । এই মহাপদ্মের নীচে ঈড়া , পিঙ্গলা , সুষুম্না এই তিন নাড়ীর মিলন স্থল বা সঙ্গম স্থল পবিত্র ত্রিবেণী - তীর্থ মানব দেহেই রয়েছে । নিঃশ্বাস - প্রশ্বাস চলাকালে ( বাম ও ডান নাক ) বায়ুর গতিপথে এই নাড়ী দুটি ( ঈড়া ও পিঙ্গলা ) । তান্ত্রিকদের পঞ্চমকারের সাধনায় যে মংস্যমূদ্রার কথা বলা হয় অর্থাৎ মাছের উল্লেখ দেখতে পাই তা সেই মুদ্রা এই নাড়ী দুইটির ( ঈড়া ও পিঙ্গলা ) ক্রিয়া বিশেষ । কুলকুণ্ডলিনী মানবদেহে ঘুমন্ত অবস্থায় থাকে এইটিই মানবের আসল শক্তি । এটি সকলের শরীরেই ( মানবের ) আছে - সাধক এটিকে জাগ্রত করেন মাত্র ।
কুলকুণ্ডলিনী জাগ্রত হলে সাধক চৈতন্য লাভ করেন । সাধনা না করলেও হঠাৎ হঠাৎ এই শক্তিটি প্রচণ্ড শােক দুঃখ আনন্দে আপনা থেকেই এক একবার জেগে ওঠে - তারপর আবার সে নিস্তেজ হয়ে যায় কারণ , ধারাবাহিক ভাবে একে জাগ্রত না করলে ( সাধনা দ্বারা ) এটি ক্রিয়াশীল হয় না সব সময়ের জন্য । কুলকুণ্ডলিনীকে জাগানােটিই হচ্ছে আসলে সাধকের সাধনা । সাধক এত কৃচ্ছ সাধন করেন এত কষ্ট করেন তার একটিই কারণ , কুলকুণ্ডলিনীকে জাগ্রত করতেই হবে যে কোন ভাবে । একবার কুলকুণ্ডলিনীকে জাগ্রত করে সহস্রা পর্যন্ত ( যেখানে হাজার দলবিশিষ্ট মহাপদ্ম রয়েছে ) ক্রিয়াশীল করতে পারলে সাধকের সব ভাবনা দূর হয় । সাধক তখন নিশ্চিত মনে অমৃত পান করেন এবং জগৎ ভুলে মহা আনন্দে - ব্রহ্মের স্পর্শলাভ করেন , সাধক ব্রহ্মজ্ঞানী পরমহংস হয়ে যান । শােক-তাপ, আশা আকাঙ্খর সমস্ত নিবৃত্তি ঘটিয়ে সাধক সচ্চিদানন্দের ( সং চিৎ আনন্দ ) সাগরে ডুব দিয়ে থাকেন । জন্মমৃত্যু তখন সাধকের পায়ের ভূত হয়ে যায় । মহামায়া আর সাধককে স্পর্শ করতে পারে না বা বেঁধে রাখতে পারে না । আনন্দ - আনন্দ - শুধু অফুরন্ত আনন্দ - সাধকের চোখে মুখে ফুটে ওঠে । সাধক তখন ত্রিকালদর্শী হয়ে যান । জীবদেহ, পরপার, ঈশ্বর, এবং পরজন্ম সবকিছুই স্পষ্টভাবে সাধকের কাছে ধরা পড়ে । অতীত বর্তমান ভবিষ্যত বলে কোন কালের সীমারেখা সাধককে বেঁধে রাখতে পারেনা । কুলকুণ্ডলিনীকে জাগ্রত করে সাধক তার দেহে ছয়টি চক্রকে জাগ্রত করে দেন । ছয়টি চক্রে ছয়টি পদ্ম রয়েছে । কুলকুণ্ডলিনীটির ওপর যে চক্রটি বসে রয়েছে তা মূলাধার চক্র । এই মূলাধার চক্রেই সাধক প্রথমে ধ্যান দেন । মূলাধার চক্রটি ধ্যানযােগে ক্রিয়াশীল হয় সর্বপ্রথম । মূলাধার উত্তেজিত হলে সাধন দ্বারা জাগ্রত হলে ঈড়া পিঙ্গলা ও সুষুম্না নাড়ী প্রতিক্রিয়া জানাতে থাকে তখন বীর্যশক্তি বা ওজঃ যার দ্বারা জীবের সৃষ্টি কাৰ্য্য চলে সেটি সংস্কার মুক্ত হয়ে ( ধারাবাহিক প্রক্রিয়ার বাইরে , নিম্নপথ ব্যতিরেকে ) এক গরম বাষ্প তৈরী করে । সাধক সাধনা করলে এই বীর্যশক্তি ওজঃ শক্তিতে রূপান্তরিত হয় এবং তা উৰ্দ্ধমুখে ক্রিয়াশীল হয় । ঐ শক্তি কুলকুণ্ডলিনীকে জাগ্রত রাখতে সাহায্য করে এবং বীর্যশক্তির পতন না হয়ে তা বাষ্প আকারে উর্ধ্বগামী হয় । এই বাষ্প শক্তি ‘ অসীম শক্তি ধারণ করে।
যে শক্তির সাহায্যে একে একে সুষুম্ন নাড়ীতে বিদ্যমান পদ্মগুলি পরপর নিজস্ব রং ও ক্রিয়ায় ক্রিয়াশীল হয় । মূলাধার চক্রের সঙ্গেই লেগে আছে কুলকুণ্ডলিনীর লেজের অংশটি তখন ঐ সাড়ে তিন পাক দেওয়া কুলকুণ্ডলিনী পাক খুলতে শুরু করে এবং আসতে আসতে সেটি ওপর দিয়ে উঠতে শুরু করে ।
এবার মূল প্রসঙ্গে যাওয়া যাক। সাধনা কি বিজ্ঞান সঙ্গত? সাধনা জপ তপ কি আদৌ বিজ্ঞান সঙ্গত ? এর কি কোনাে ভিত্তিভূমি আছে ( প্রক্রিয়া প্রকরণ ) ? না এটি নিছক কল্পনা গুটিকয়েক লােকের বুজরুকি বা চালাকি ? স্বভাবতঃই এই প্রশ্নগুলি বিজ্ঞান মনকে ( আধুনিক মানুষকে ) যে নাড়া দেয় তাতে কোন সন্দেহ নেই । তাহলে সাধক যে সাধনা করেন আসলে তা কি ? কতখানি লাভের বস্তু ? এ প্রশ্নগুলি এড়িয়ে যাবার কোনাে মানে হয় না , দেখি ব্যাপারটা কতদূর যুক্তিগ্রাহ্য অন্ততঃ বিজ্ঞান আলােকে । অণুপরমাণু দ্বারা জগৎ সৃষ্ট এটি বৈজ্ঞানিক সত্য । জীব সৃষ্টিতে জীবদেহে অণুপরমাণুর অবস্থান রয়েছে জীবের ধ্বংসকালে শরীর বিলীন হয় তখনও জীব অণুপরমাণুতে লয় হয় । আধ্যাত্মিক ভাষায় জীব দেহ পাঁচটি উপাদানে গঠিত ক্ষিতি অপ, তেজঃ মরুৎ ও ব্যোম । ক্ষিতি বলতে মাটি , অপ বলতে জল , তেজঃ বলতে আলাে , মরুৎ , বলতে বাতাস , ব্যোম বলতে আকাশ । এই পাঁচটির কোনাে নিজস্ব একক রং নেই যখন যেস্থানে যে অবস্থানে থাকে এই পাঁচটি কিন্তু সেই অবস্থানের রং ও আকার গ্রহণ করে । পৃথকভাবে এক একটিকে নির্দিষ্ট আকার বা রঙে বিশ্লেষিত করা যাবেনা সমস্তুগুলি যৌগ উপাদান। এই পাঁচটি উপাদানকে আমাদের চৌম্বকের মতাে আকর্ষণ করে চোখ কান নাক এই তিনটি । বহিঃ অঙ্গের ইন্দ্রিয়গুলির টানে দেশে ফিরি পুজোর সময় গ্রামে । আমরা যাই পাহাড়ে পর্বতে সমুদ্রে নিঝুম ঘনজঙ্গলে , একাকী ফুলের গন্ধ আমাদের তাড়া করে । ইন্দ্রিয়ের তিনটি অংশ আকর্ষণ করে । কিন্তু কাকে আকর্ষণ করে দেহকে ? দেহের ভিতর যে দেহাতীত হয়ে আছেন, তাকে ? চোখ কান দিয়ে সব কিছুকে দেখা যায় ? না , ছোঁয়া যায় ? না শুধু অনুভব করা যায় ? যিনি দেহে রাজার রাজা যার আকর্ষণ ক্ষমতায় আমরা পদানত হই , পরাজিত হয়ে যার কাছে আত্মসমর্পন করা ছাড়া মানুষের কোন উপায় নেই সেই রাজাধিরাজের নাম মন । মন আমাদের অলক্ষ্যে চালিত করে তার কোনাে আকার নেই ব্যাখ্যা নেই।
সঠিক অবস্থানটুকুও জানা নেই । তাই মন জীবদেহের ইন্দ্রের উদ্দেশ্যে সারা শরীরটুকু জুড়ে এর অবস্থান । ডাক্তারবাবু হাতে ইনজেকশন দিতে এলে মনটা হাতের জায়গা থেকে সরিয়ে উল্টোপাল্টা ভাবি যদি ব্যথা কম লাগে বলে তাই তো ? মন কিছু গ্রহণ করতে পারেনা । মন কিছু মনে রাখেনা আবার সবই মনে রাখে । এ যেন একে দ্বৈত সত্ত্বায় বিরাজ । বলা ভালাে ক্রিয়া ও প্রতিক্রিয়ার একই সঙ্গে সহাবস্থান । নিউটন কি তাই বলেছেন প্রতিটি ক্রিয়ার বিপরীত প্রতিক্রিয়ার কথা ? আমরা খালি চোখ দিয়ে কতদূর দেখতে পাই ? খুব সীমিত জায়গা । কিন্তু যদি মন দিয়ে আমরা অতীত বর্তমানকে ঠিক ঠিক ভাবে মনে সংযােগ ঘটাই , তাহলে ভবিষ্যতেও দেখবাে না কেন ?
এবার মনের কথা ছেড়ে একটু মরুং বা বাতাসের কথা ভাবি । আমরা জীবদেহ বাঁচাতে নিঃশ্বাস গ্রহণ করি ও ত্যাগ করি এক কথায় বায়ু গ্রহণ । এই বাতাস অসীম শক্তির প্রতীক । বাতাস ঠিক ঠিক ভাবে কাজ করলে জীবের শরীরে অসম্ভব প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। সাধনার ভাষায় মানুষ দেহে এই বায়ু পাঁচভাগে নেয়। নামগুলি হল প্রাণ , অপান , সমান , উদান ও ব্যান । এর মধ্যে অপানবায়ু অধােগমনশীল আর সমান বায়ু নাভি থেকে ওপরে গমন করে । গলায় বা কষ্ঠে থাকে উদান বায়ু । প্রাণ বায়ু হৃদয়ে এবং ব্যান বায়ু সারাশরীরে ঘুরে বেড়ায় ক্রিয়াশীল হয়ে । আমরা যাকে প্রাণায়াম বলি তা আসলে এই বায়ু চলাচলের গতিকে বন্ধ করে দেওয়া । আমরা সাধারণ ভাবে জানি নিঃশ্বাস না নিলে জীব বাঁচতে পারেনা কিন্তু নিঃশ্বাস গ্রহণ না করেও সঞ্চিত বায়ু দ্বারা জীব সক্রিয় ( সজীব ) থাকে এরকম মানুষ আমি দেখেছি তারাপীঠে নিজের চোখে । এটি অবিশ্বাস করার কোনাে কারণ নেই । সাধন জগতের লােকেরা একে কুম্ভক করা বলে । অবশ্য এঁরা যাকে তাকে দেহ স্পর্শ করতে দেয় না বা ভেলকী বার্জী দেখাতেও রাজী নয় । দীর্ঘদিন মেশা একজন সাধুকে আমি এরকম দেখেছিলাম তিনি অবশ্য বর্তমানে দেহ রেখেছেন ।
প্রাণায়ামের সময় পূরক রেচক দ্বারা কুম্ভক করেন সাধুরা বা যােগীরা । ডান নাক বন্ধ করে বাম নাক দিয়ে নিঃশ্বাস নিলে হয় পূরক , আর বাম নাক টিপে ধরে দক্ষিণ নাক দিয়ে নিঃশ্বাস ছেড়ে দেওয়াকে বলে রেচক , শ্বাসরােধ করা অবস্থাকে বলে কুম্ভক । কুম্ভক কঠিন কাজ নয় যাঁরাই দীর্ঘদিন প্রাণায়াম অভ্যাস করেছেন তারাই নিঃশ্বাস বন্ধ করতে পারেন কুম্ভক করে । যােগিরা এই কুম্ভককালে ধ্যানমন্ত্র জপ করেন কয়েক লক্ষবার । অনেক প্রাণীও কুম্ভক করে বেঁচে থাকে যেমন কচ্ছপ । আবার ম্যাজিশিয়েনরা কুম্ভক করে মাটির নিচে গর্তে নিজেকে চাপা দিয়ে থেকে যেতে পারে এদৃশ্য অনেকেরই চোখে পড়েছে । তাহলে কুম্ভক করা যায় ? যে সব যােগী যত বেশী দিন কুম্ভক করবেন তার মনঃসংযােগ তত বাড়বে এবং মনস্থির হবে । এই মনস্থির করাটাই তাে আসলে কঠিন কাজ । মন সব সময় বুদবুদ চিন্তায় ব্যস্ত । মন কখনও ঘুমােত জানেনা । সাধকেরা কুম্ভক করলে নিদ্রা জয় করেন অনন্ত কাল ধরে , এবং কুম্ভক করলে ক্ষিদে তৃষ্ণা লাগেনা এটি পরীক্ষিত সত্য । তাহলে সাধকেরা যে মনবিদ্যার অধিকারী তাতে কোনাে সন্দেহ নেই । মন একটি নিজেই বিজ্ঞান । তাকে একটা নিজস্ব বাংলায় নাম দেওয়া যেতে পারে তার নাম ‘ মনময় বিজ্ঞান ’ হতে পারে । মনবিজ্ঞান নয় এই কারণে যে মনবিজ্ঞান দ্বারা মনকে শুধু বিশ্লেষণ করা যায় আর ‘ মনময় বিজ্ঞান ' নিজে শরীরকে প্রভাবিত করতে পারে এর ফলে শরীরের প্রসারণ - সংকোচন ক্রিয়া সচল হয় । মনসংযােগে অসম্ভব কাজ সম্ভব করা যায় তাহলে সাধকেরা তাে সেই কাজটিই করেন মনের সাহায্যে তাহলে সাধনা বিজ্ঞান সঙ্গত হবে না কেন ? সাধকেরা মনের এই সব সময় বুদবুদ চিন্তাকে সাধন দ্বারা ( কুম্ভক করে ) একেবারে বসিয়ে দিতে সক্ষম । তখন আর মনের কোনাে ক্রিয়া ( স্বাভাবিক ক্রিয়া ) সাধককে বিরক্ত করতে পারেনা । যে কোনাে লােক বিশেষ সাধক না হলেও একটু চেষ্টা করলেই তা করতে পারেন এটি ‘ মনময় বিজ্ঞান ' ।
পরীক্ষিত সত্যকে সঙ্গ দেয় বলে সাধনা বিজ্ঞান সঙ্গত । সংসারী মানুষ ঘর বাঁধে কিন্তু মন বাঁধতে পারেনা তাই বীরভূমের বাউল বলছে- “ মন আমার উথল পাথাল গহীন জলে চলেগুরু মন আমি বাঁধি কেমন করে ” ? মহামায়ার খেলায় সদাব্যস্ত মন চঞ্চলা সাধক এই উথল পাথাল মনকে বেঁধে দিয়ে সাধনা করেন।
আমরা সাধারণভাবে কোন পদার্থ বলতে সাধারণতঃ বস্তু বুঝি তা দৃশ্যমান । বস্তুর আকার ওজন আছে । গুণগত বৈশিষ্ট্য , বস্তুর ভর এবং ধাতু , সজীব না নির্জীব এ সব বিজ্ঞানের ভাষা । আমাদের মৌলিক পদার্থগুলি চিহিত বা নির্বাচিত ( আমাদের দেওয়া সংখ্যা আছে ) । আমরা মৌলিক পদার্থগুলি মিশ্রিত করে সংখ্যাটাকে বাড়িয়ে দিই এবং বলি এটি যৌগিক পদার্থ । আমরা বল ভর বস্তুর প্রয়ােগ জানি । বাইরে থেকে বল প্রয়োগ করে জড় বস্তুকে আমরা ক্রিয়াশীল করি । প্রত্যেকটি ক্রিয়ার বিপরীত প্রতিক্রিয়া আছে , মাধ্যাকর্ষণ শক্তি আকর্ষিত বস্তুকে কেন্দ্রের দিকে টানে কথাগুলাে সবই বিজ্ঞান পরিভাষায় প্রমাণিত ও সিদ্ধ । বিজ্ঞান ছাড়া যুক্তিবাদী মন কোন কিছু গ্রহণ করতে চায় না এটা স্বাভাবিকও বটে । এবার প্রশ্ন কোনাে বস্তু কতখানি প্রতিক্রিয়া জানাবে প্রত্যক্ষ বা পরােক্ষভাবে , তার পরিমাণ কত ? একটি বস্তুকে ( যদি বস্তুটি জড় পদার্থ হয় তাহলে ) তার ওপর বাইরে থেকে বল প্রয়ােগ করলে সে কত পরিমাণ শক্তিতে প্রতিক্রিয়া জানাবে ? ধরে নিলাম আমি জড় পদার্থের ওপর এক ইউনিট শক্তি প্রয়ােগ করছি তাহলে ঐ জড়পদার্থটি কি এক ইউনিট শক্তি পেয়ে সমপরিমাণ ক্রিয়াশীল হবে বা প্রতিক্রিয়া জানাবে ? না আমি যে পরিমাণ শক্তি প্রয়ােগ করবাে সেটি তার চেয়ে বেশী শক্তিকে প্রতিক্রিয়া হিসাবে জানাবে ? এখন প্রশ্ন হতে পারে যদি কোনাে বস্তুকে অণু বা পরমাণু দ্বারা চার্জ করি তাহলে সে প্রয়ােগ করা শক্তির বহুগুণ প্রতিক্রিয়া জানাবে , কিন্তু কত গুণ ? বিজ্ঞানীরা গুণগত শক্তির মাপ জেনে তারও হিসাব জানিয়ে দেবেন । অর্থাৎ একটি এটোম বা নিউক্লিয়ার বােমের শক্তির ( ব্যবহার হওয়ার পর ) তার শক্তির পরিমাণ কত ব্যবহৃত শক্তি মাপা যায় । কিন্তু এটিও সীমিত গাণিতিক পরিসংখ্যানে প্রকাশ করা সম্ভব । সীমিত বলছি এই কারণে যে গাণিতিক সংখ্যা আমরা জানি তা ১ থেকে ৯ পর্যন্ত । আবার ঐ শূন্যের ছােট আকার পৌণপােণিক ব্যবহার করে অনন্ত শক্তির পরিমাপ করার চেষ্টা করি সংখ্যা দিয়ে । বর্তমান আধুনিক গাণিতিক পরিভাষা রেখার সাহায্য নিয়ে আধুনিক প্রচেষ্টায় গণিতজ্ঞরা অনেককিছু আলােকিত করার চেষ্টা অন্ততঃ করছেন বলা যায় । কিন্তু সাধারণের কাছে সংখ্যা বলতে এক থেকে নয়।
এবার ধাতু সম্পর্কে আমরা জানি বস্তুর অবস্থান আছে তাই তার আকার আছে আর আকার বা অবস্থান থাকার জন্য তার ওজন আছে । বস্তুটির ( যা দৃশ্যমান ) শক্তি কতখানি তা আমরা জেনে ফেলতে পারি । কিন্তু যে বস্তু দৃশ্যমান নয় তার পরিমাণ বা আকার কিভাবে চিহ্নিত হবে ? দৃশ্যমান নয় তাকে অদৃশ্য শক্তি বলা যাবে ? তার শক্তির পরিমাণ মাপা যাবে কি ? যেমন ধরা যাক বাতাস একটি অদৃশ্য শক্তি , এর শক্তি পরিমাপ সম্ভব কি ? কথাটি ব্যাখ্যা করা প্রয়ােজন । আমরা বাতাসকে বেলুনে ভরে তার ওজন করতে পারি । পৃথিবীর ব্যাস মেপে কত টন বাতাস আছে বলে দিতে পারি বাতাসকে বদ্ধ জিনিসে ভরে ব্যবহার করতে পারি তার শক্তিকে বিন্দু পরিমাণে । যেমন মটরের চাকায় টিউবে বাতাস ভরে আমরা বাস চালাই মটোর গাড়ি চালাই কিন্তু এই শক্তি বাতাসের বাইরের শক্তি বা ব্যবহৃত শক্তি । বাতাস সামান্য একটু নিয়ে বেলুনে ভরে তার সামান্য শক্তির সামান্য প্রয়ােগ চিহ্নিত হয়েছে কিন্তু প্রশ্ন বাতাস অনন্ত শক্তির অধিকারী কি না ? অর্থাৎ যে ক্রিয়া ও প্রতিক্রিয়া বাতাস জানায় জীবজগতে তার শক্তির পরিমাণ কত এটি কি আবিষ্কৃত হয়েছে ? তাহলে বাতাসের কার্যকরী শক্তির পরিমাণ কত ? এখানে কি কোনাে ভর বলের প্রমাণিত শক্তির ব্যবহার ঘটে ? না বাতাস নিজেই নিজের শক্তিকে বৃদ্ধি করে তার অন্তর নিহিত গুণগত কারণে ?
প্রয়ােজন নেই যাতায়াতের জন্য ট্রেন বাস এরােপ্লেনের । মানুষ ইচ্ছে করলে বাতাসকে ঠিক মতাে ব্যবহার করে নিমিষে ব্রহ্মাণ্ডে শতপাক দিতে পারে । শুধু পারে নয় পেরেছে । এই পৃথিবীর বিজ্ঞানীরা এ ব্ৰহ্মাণ্ড সম্পর্কে কতটুকু খবর রাখেন ? ব্রহ্মাণ্ডের আকার সম্পর্কে তাে বিজ্ঞানীদের ধারণাই নেই । এই পৃথিবী বলতে আমরা যা বুঝি তা হচ্ছে সপ্তদ্বীপা পৃথিবী তার একটা দ্বীপের খবরও আমরা ভালােভাবে জানিনা । সপ্তদ্বীপা পৃথিবীর এক একটা দ্বীপে সাতটা করে বর্ষ আছে তারও বিন্দুবিসর্গ কেউ বিশ্বাস করে জম্বুদ্বীপের যে সাতটা বর্য আছে তারমধ্যে এই ভারত - চীন বা পৃথিবীর সবদেশ । এরপর কিংপুরুষ বর্ষ । এই দেশে লােকের মুখ ঘােড়ার মতাে এবং এরা মানুষ হিসাবেও ভালাে । সপ্তদ্বীপা পৃথিবী এক একটি শঙ্খের মালার মতাে পরস্পর যুক্ত রয়েছে কেউ বিচ্ছিন্ন নয় । সমস্তু দ্বীপগুলােতেই যাতায়াত করা যায় তবে অবশ্য সব জায়গা একইভাবে যাওয়া যায় না কারণ মানুষ বেঁচে থাকার জন্য যে অক্সিজেন প্রয়ােজন হয় অনেক জায়গায় এর পরিমাণ খুবই কম যা গ্রহণ করে আমাদের মতাে স্বাভাবিক জীব বাঁচতে পারবে না। তাই সূক্ষ্ম শরীরে দ্বীপের উপযােগী শরীর গঠন করে অবশ্যই যাওয়া যায় । এ কথাগুলাে আমার লেখা নয় যারা গিয়েছিলেন তাদেরই কথা লেখা আছে ( কুদানন্দ ব্রহ্মচারীর সদ্গুরু সঙ্গ বইটিতে ) । তাহলে বই অনুযায়ী বলতে হয় আমাদের ক্ষমতা আপেক্ষিকভাবে সীমিত । তাহলে ? এই ধরার সাধারণ মানুষের জানার উপায় কি ? আর সবকিছু এই অল্প সময়ে সত্তোর আশি বছর বয়সে কিভাবে তা জানা যাবে ? এই সব প্রশ্নগুলাে বেশ জটিল বলেই মনে হয় । কিন্তু সাধন জগতের লােক সকলেই তার খবর রাখেন । যেমন স্বামী বিবেকানন্দকে প্রশ্ন করা হয়েছিলাে তিনি কিভাবে এত সুন্দর বক্তৃতা দিলেন আমেরিকার শিকাগাে শহরে ( ধর্ম সম্বন্ধে বক্তৃতা ) । তিনি অকপটে স্বীকার করেছেন । ঠাকুর রামকৃষ্ণ বললেন “ তুই মুখ নড়া , আমি পেছন থেকে বলে যাচ্ছি ” ঠাকুর তখন দেহ রেখেছেন । তাহলে এটি কিভাবে সম্ভব হলাে ? যোগীরাজ শ্যামাচরন লাহিড়ী জানাচ্ছেন যে , তিনি বিলেত গিয়ে ( সূক্ষ্ম শরীরে ) সাহেবের স্ত্রীর কথা হাসপাতাল থেকে জেনে এসে সাহেবকে বলেছিলেন । নিগমানন্দজীর স্ত্রীর ঘটনাও তাে তাই । মৃত স্ত্রী হাজির হয়েছিলেন সশরীরে ( সূক্ষ দেহে মৃত্যুর পর ) নিগমানন্দজীর কাছে তার অফিসে , তাহলে ? এর পরও ভাবতে হয় একথা গুলাে সবই কি মিথ্যা ? আর যদি মিথ্যাই হয় তাহলে তাদের এসব কথা লিখে লাভ কি হয়েছে ? আসলে আমাদের অভ্যাস কথায় কথায় তর্ক করা । যে তর্কের কোনাে মাথামুণ্ডু নেই । ভগবান টগবান নেই কারণ তিনি তা দেখতে পাচ্ছেন না । আবার ঐ একই যুক্তি দিয়ে যখন তাকে বলা হচ্ছে তােমার সাতপুরুষ আগের ব্যক্তিটি কে এবং কেমন ? তখন ঐ তার্কিক ব্যক্তি গা - জোয়ারী স্বভাবে যুক্তির অবতারণা করে , ঘটনাটি ঠিক তাই । চর্ম চক্ষু দিয়ে ( সীমিত জ্ঞান দিয়ে ) অসীমের বিচার বিশ্লেষণ কিভাবে সম্ভব ? তাহলে উপায় ? উপায় একটিই তা হচ্ছে প্রথমেই সর্বতােভাবে বিশ্বাস করা । তারপর বিশ্বাসগুলি যুক্তি দিয়ে ক্রমান্বয়ে বিচার করা এবং সর্বদা সত্য জানা । সত্য জানতে পারলে সন্দেহের কোনাে অবকাশ থাকবে না । সত্য জানাটাই তাে বিজ্ঞান । যিনি সাধন পদ্ধতি নিয়ে তর্ক করেন তিনি । কখনও এপথে পা দেননি বলে । আঙ্গুর না খেলে তাকে তাে টক বলে দেওয়াই স্বাভাবিক । আঙ্গুরের অম্লত্বের বিচার করতে গেলে আঙ্গুর বাগানে বসে আঙ্গুর পেড়ে যিনি খেয়েছেন একমাত্র তিনিই বলতে পারবেন আসল সত্যটা কি ? আমি আঙ্গুর বাগানে পৌছালাম না অথচ একটি চট জলদি সিদ্ধান্ত টেনে দিলাম । আমাদের প্রায় সকলেরই এই মহৎ গুণটি আছে । আমরা চোখের সামনে সবজিনিস থাকলেও দেখতে পাইনা বুঝতেও পারিনা । কারণ বিশ্বাস নামক বস্তুটি আমার কাছে অন্ততঃ নেই । যারা বিশ্বাস করেছেন তারা অবশ্যই দেখেন । বিবেকানন্দ , অভেদানন্দ , ঋষি অরবিন্দ এঁরা । আর যাই হােন একটু লেখাপড়া নিশ্চয় শিখেছিলেন বলেই মনে হয় ? আর আমরা ভাবি আমাদের মতাে পণ্ডিত বােধ হয় পৃথিবীতে জন্মায়নি । তাই ছিলােনা আর্যভট্ট , ছিলােনা চরক শুশ্রুত ? যত পণ্ডিত বর্তমানেই দেখতে পাওয়া যাচ্ছে । এরা এ জগতের সব বুঝে গেছেন এক লহমায় । বাতাস দিয়ে শুরু করেছিলাম বাতাস দিয়েই শেষ কথা বলি বাতাসই হচ্ছে সমস্ত শক্তির উৎসমূল সমস্ত শক্তির সংকেত বাহী । সাধকেরা বাতাসকে নিয়ন্ত্রিত করতে জানেন । বাতাস থেকেই শক্তি সংগ্রহ করে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতেই ( যা সাধারণের বাহ্যিক দৃষ্টি শক্তির বাইরে ) কাজে লাগিয়ে নিজের দেহের মধ্যেই কুলকুণ্ডলিনী শক্তিকে জাগ্রত করা যায় । এই কুলকুণ্ডলিনী শক্তি অসীম ক্ষমতার অধিকারী যখন তা জেগে ওঠে । এটি নিয়ন্ত্রিত বাতাসের সাহায্যেই ধ্যানযােগে মনঃসংযােগ করলে । নিয়ন্ত্রিত বাতাসে যা শক্তির সৃষ্টি হবে তার দ্বারা দেহস্থিত পদ্মগুলি ফুটে উঠবে এক একটি চক্রে । এই চক্রগুলি তখন নিজে থেকেই ক্রিয়াশীল হবে । পদ্মগুলি বিভিন্ন রং নিয়ে ফুটবে ও ধ্বনি প্রকাশ পাবে । তার দলও থাকবে এক একটার আলাদা । অন্তর দৃষ্টি দিয়েই সাধক তা স্পষ্টভাবেই উপলদ্ধি করতে পারবেন । এমনকি বহুকোটি যুগ আগের দৃশ্য প্রকাশমান হবে স্পষ্টভাবে । সত্য , ত্রেতা , দ্বাপর , কলি সমস্ত যুগের সমস্ত ধারাবাহিক ঘটনা। যা ঘটেছে অতীতে তা সহজেই দৃষ্টিগােচর হবে । কোথায় বাঁশি বেজেছিলাে ( কৃষ্ণের যমুনা তীরে ) আর কোথায় রাধা নৃত্য করেছিলাে ? সে সমস্ত ঘটনা জানা বা দেখা সাধকের কাছে কঠিন কাজ হবে না। এই জন্মেই এই পৃথিবীতে বসে , এই অতি অল্প জীবনেই । দেখা যায় যখন হেঁটে চলেন রাস্তায় তখন তারা ঘােলাটে চোখ নিয়ে নিম্নমুখে সাধকেরা ডাকলেও সাধক ভালাে করে শুনতে পাননা কারণ আমাদের শরীরের বাইরে থেকে যে ইন্দ্রিয়গুলি আছে চোখ , কান , নাক বা স্পর্শেন্দ্রিয় গুলি তা সাধক সব বন্ধ করে দেন । ঐ দুরাগত ধ্বনি সাধক ক্রমাগত শুনে তখন চলেছেন আপন মনে যার ফলে সাধক চট করে ডাকলেও সাড়া দেননা । পৃথিবীর কোনাে চলমান ছবি সাধককে টলাতে পারে না । সাধকতখন তন্ময় হয়ে যান অমৃতধারায় স্নান করেন। আমাদের প্রত্যেকে শরীরে এই অমৃতধারা প্রতিনিয়ত বয়ে চলেছে । একটা উদাহরণ দিলেই বােঝা যাবে । সৃষ্টি চক্রে রত জীৰ এই অমৃতধারা পান করেন । যে কোনাে নর বা নারী যখন সৃষ্টিকার্যে সাহায্য করেন ( রত হন ) তখন তিনি ঐ অমৃতধারা পান করেন । ঐ বিশেষ মুহুর্তে নর ও নারী উভয়েই জাগতিক ঘটনা কয়েক মুহুর্তের জন্য ভুলে যান ( ক্রিয়াশীল অবস্থায় ) তখন তারা বিশ্বভূবনের সমস্ত অমৃত আনন্দে পান করেন । কারণ হচ্ছে আমরা সকলেই অমৃতস্য পুত্ৰা , অমৃতেরই সন্তান পরমব্রহ্ম থেকেই আমাদের সৃষ্টি । ব্রহ্মা আমাদের সৃষ্টি করেছেন , নিজ আনন্দের জন্যই আমরা ( জীব নর বা নারী ) ধ্বনির সাহায্যে তা ( আনন্দ ) প্রকাশ করি । জীব যত ক্ষুদ্রই হােক ব্রহ্ম সংকেত পেতে তার ভুল হয় না । ব্ৰহ্ম সংকেতই সে সবকিছু করে ঐ বিশেষ মুহূর্তে । সন্তানের প্রকৃত উন্মমুহূর্তটি কোনাে বাবা মা - ই বলতে পারবেনা । কারণ জন্মমুহূৰ্ত্ত ঈশ্বর ইচ্ছা , মৃত্যুক্ষণও তাই । আমরা শুধু শারীরিক লক্ষণ দেখে একটা অনুমান করি মাত্র , সঠিক মিনিট সেকেণ্ড দণ্ড পল ( জন্মানাের ঠিক মুহুর্তে ) কখনাে বলা বা জানা সম্ভব নয় তাই আমাদের হিসাব মেলেনা সব কিছু প্রকাশ পায় । আনুমানিক পরিভাষায় । এরপর আবার স্বাভাবিক হয়ে পরমুহূর্তে আমরা আনন্দ থেকে বিচ্যুত হয়ে যাই ( মিলনের ঠিক পরমুহূর্তেই ) কিন্তু কেন ? কারণ হচ্ছে এক সরষে অমৃত যতক্ষণ উর্ধ্বগামী হয়ে সহস্রার সঙ্গে সংযােগ রাখে শরীরে তখন অসীম আনন্দ আমাদের শরীরকে আন্দোলিত করে কুলকুণ্ডলিনীকে জাগ্রত করে তারপর যেহেতু আমরা বীর্যশক্তি কে উর্ধ্বমুখী করতে জানিনা তাই সে সহজেই নিম্নমুখে পতনশীল হয়ে যায় । কিন্তু তান্ত্রিকেরা যে ভৈরবী সহযােগে ভৈরব বা ( সাধক ) সাধনা করেন তা কখনও শক্তি ( বীর্যশক্তি ) নিম্নমুখী হয়না । ' আমা ' থেকে আমিই সৃষ্ট হই । আমাতে আমি পূর্ণতা লাভ করি । তাই আমার সমস্ত ছবি সমন্ত চেতনা রূপে রঙ্গে ফুটে ওঠে আনন্দে , আমার সন্তানের মধ্যে দিয়ে । নর ও নারী এভাবেই ( পিতা ) বেঁচে থাকে পুত্রে । সবই সৃষ্টিকার্যে রত হয়ে আছে ব্রহ্মের ইচ্ছায় । প্রতিটি জীব ব্রহ্মময় , আনন্দময় । জগৎ তাই চিরকালের আনন্দের বাসভূমি এখানে দুঃখ বলে কোনাে কিছু নেই । এ পৃথিবীতে তাই হারাবার কিছু নেই । যা সৃষ্টি হয়েছে তা কারাে ইচ্ছায় হয়েছে , আপন মনের মাধুরী মিশায়ে । আর যা ধ্বংস হয়েছে বা হচ্ছে বা লােপ পাচ্ছে তাও অপরের ইচ্ছায় আমি শত চেষ্টা করেও কারাে ধ্বংস বা মৃত্যু আটকাতে পারিনা । আমি যদি অসীম ক্ষমতার অধিকারী হতাম তাহলে জগতের সুখ নামক বাস্তুটি আমার বাইরে চলে যেতনা । আর্থিক শারীরিক ক্ষমতা দিয়ে রাজ রাজারা তা কুক্ষিগত করে রাখতেন চিরকালের জন্য ? সুখ কোনাে বিশেষ বস্তু নয় তা মনের অনুভুতি , দুঃখও সেইরূপ মনেরই প্রতিক্রিয়া যা আমাকেই কেন্দ্র করে প্রতিনিয়ত আমাকেই বিব্রত করে । সুখ বা দুঃখ সৰ্বোতভাবেই আমার মনের সৃষ্টি অলীক কল্পনা বলা যেতে পারে । তবে হ্যা শান্তি আত্ম সৃষ্ট । আমাকে চেষ্টা করতে হবে শান্তি কি তা উপলব্ধি করার । অনেকে শুধু শাক ভাত খেয়ে পৃথিবীতে বেঁচে আছেন শান্তিতে । চরমতম শান্তি উপভােগ করেন ঐ দূরের সাঁওতাল পল্লীর পুরুষ নারী , কিন্তু কেন আমি পারবাে না শান্তি পেতে ? কারণ আমি লেখাপড়া শিখে একটু বেশী বুঝি । চলমান অর্থনীতিকে ভালােবেসে ভবিষাতের সুখের আশায় স্বপ্ন দেখি । তাই আমি অনন্ত পথে ছুটছি আগামী বংশধরকে ধনেমানে চির সুখে রাখার জন্য । যেখানে মৃত্যুর পর আমার সন্তান স্ত্রী বা আত্মীয় স্বজনের সঙ্গে আমার কোনাে যােগাযােগ হবেনা বা হতে পারে না এ সত্য জানার পরও আমার ছােটার বিরাম নেই । অর্থ - যশ মান বাড়ী গাড়ি টাকা পয়সা ধনদৌলত সব আমার মৃত্যুতে শেষ । চিরতরে আমি বিলীন হবাে এ ধরার বুক থেকে । তবুও আমি শান্তিতে দুমুঠো খেতে পেলাম না এ পৃথিবীতে এসে এরজন্য কে দায়ী ? এসব , সব বুঝে যাওয়া পাগলের কাণ্ডকারখানা ছাড়া আর কি ? যেখানে সৃষ্টির পেছনে ধ্বংস লুকিয়ে আছে সেখানে গগণ চুম্বি প্রাসাদোপম বাড়ীটা একটু দাঁড়িয়ে মুচকি হেসে চলেছে মাত্র কালের সাক্ষী ‘ কালাতীত ’ ? প্রতিটি বস্তু এ ধরায় আনন্দ বয়ে নিয়ে চলেছে । দুঃখ কষ্ট তা সম্পূর্ণ মনের ভুলে আরােপিত ক্রিয়া যা জীবের মনে অশান্তি ডেকে এনেছে । মন নামক তন্মত্রা আমাদের শরীরের কোনাে অংশে বিদ্যমান নয় । আমাদের ইন্দ্রিয়গুলি শিরা উপশিরাগুলি কেটে তন্ন তন্ন করে খুঁজলেও মন নামক বস্তুকে খুঁজে পাওয়া যাবে না শরীরে । কেউ বলতে পারবেনা মন আমাদের শরীরের মাথায় না বুকে , পেটে না পায়ে ? কিন্তু মন আমাদের শরীরকে যেমন নিয়ন্ত্রণ করতে আসে তখন প্রায়ই আমরা ভুল করি। তাই আমার কৃতকর্ম আমিই পুত্র হয়েই ভোগ করে চলেছি অহঃ রহঃ যতক্ষণ না কর্ম কান্ডণ্ডলি বিচার দ্বারা শুদ্ধ হয়ে ( অনুতাপে দগ্ধ হয়ে ) নিজেকে পূর্ব অবস্থায় ফিরিয়ে আনছি । একেই বলি ' অদৃষ্ট ' একেই বলি প্রারব্ধ ' । দৃষ্ট কথার অর্থ হচ্ছে দর্শন যােগ্য বা দৃশ্যমান বস্তু যা আমরা দেখতে পাচ্ছি দু চোখ দিয়ে বা যা দেখা সম্ভব সােজা কথায় । তাহলে দৃশ্যমান বস্তু সত্য , কারণ তার অস্তিত্ব আছে । আর অস্তিত্ব আছে বলেই আলাের সাহায্যে বস্তুর ছবি প্রতিফলিত হয় এটি বিজ্ঞান বা সত্য । যে বস্তু অস্তিত্বহীন তা ' অলীক কল্পনা বহিরভূত তাকে আমরা কোনাে অবস্থানেই কল্পনা করতে পারবােনা বা ভাবতেও পারবােনা এটি সত্য বা বিজ্ঞান । অর্থাৎ যা ঘটে তাই ঘটনা । ঘটনা কখনও মিথ্যা নয় , ঘটেছে বলেই সে ঘটনা সেজন্য A truth is always truth বড় জোড় বলা যেতে পারে He tried to conceal the fact . কিন্তু সত্য কি চেপে রাখা যায় ? যুক্তির খাতিরে তাই আমার কাছে বর্তমানে ' বর্তমানকালটি ' অতীতকালের প্রতিফলন , তা সেই ঘটনা না ঘটলেও আমার চোখের সামনে । আমি নিজে অতীতের সাক্ষীস্বরূপ বর্তমানে দাঁড়িয়ে আছি ( পিতৃ পরিচয় বহন করে ) । দৃষ্ট বস্তু অতীতের দৃশ্য বস্তু । দৃষ্ট ’ শব্দটির সঙ্গে ‘ অ এই অক্ষরের সাহায্যে আমরা বলি অদৃষ্ট । অদৃষ্টকে সঠিক ভাবেই বলি ভাগ্য । ভাগ্য আমরা নিজেরাই সৃষ্টি করি কর্মের দ্বারা এবং কৃতকর্মগুলি ( ভালাে বা মন্দ ) পরপর আমরাই ভােগ করি জীবদেহে এটি বিজ্ঞান তত্ত্ব । কারণ নিউটন বলেছেন প্রত্যেক ক্রিয়ার বিপরীত প্রতিক্রিয়া জানায় । দেওয়ালে ঢিল ছুঁড়লে তা সবেগে ফিরে আসে ( বলক্রিয়ার সামান্য পরিবর্তন ঘটিয়ে ) ভাগ্যও যেহেতু সৃষ্টি করা হয়েছে এবং তা আমিই সৃষ্টি করেছি তাই কর্ম দ্বারা ভাগ্যও ফিরতে বাধ্য আমার কাছেই বিজ্ঞানের তত্ত্ব অনুযায়ী । সাধকেরা এই ফেরার গতিকেই বলেন ' প্রারব্ধ ক্রিয়ার ফল , শুধু নামের হেরফের । নামের মধ্যে বিজ্ঞানকে ( সত্যকে ) অস্বীকার করা হয়নি , আমি আমার কৃতকর্ম সব ফল রূপে আমিই পেয়ে যাবাে আজ অথবা কাল । বল যদি দেয়ালে ধাক্কা লেগে ফিরতে পারে তাহলে আমার কর্ম গুলি আমার কাছেই ফিরে আসবে তাতে অবাক হবার কি আছে ? সে জন্য বলা হয় ' বুঝে চলাে পা ফেলে চলাে ' । যদি দেখে চলি ( সত্য মেনে ) , যদি পা ফেলে চলি ( সত্য বুঝে ) , তাহলে তাে হোঁচট খাবার কোনােই সম্ভবনা নেই । ' ঢিলটি ছুঁড়লে পাটকেলটি খেতে হবে, কথাগুলাে ছড়ার মধ্যে ছড়িয়ে আছে আজও শুধু সমাজে মানব মনে সত্য জানার সুবিধার্থে । এগুলি কাল্পনিক মনগড়া কথা নয় , সত্যের নিরিখে বিচার করা কোষ্টি পাথরে এক একটি বাক্য বা শব্দ এণ্ডলি । সত্য কখনাে বিকৃত হয় না বা অবলুপ্ত হয় না । সত্য চিরকালই সত্য , সত্যই হচ্ছে বিজ্ঞান । সূর্য ডােবেনা , পৃথিবীর ঘূর্ণায়ণ চক্রে পড়ে একদিক পৃথিবীর আলাে অপর দিক ক্ষণেকের জন্য অন্ধকার । অন্ধকারের সময় আমি ভাবি সূর্যটা ডুবে গেছে । আসলে সূর্য কি সত্যই ডুবেছে ? আমার মন ভুলিয়ে রেখেছে ছােট ছেলের মতাে । তাই আমি বলছি সূর্য ডুবেছে । বিজ্ঞান কথাটি আসলে কিছু নয় যা প্রমাণিত সত্য তাই বিজ্ঞান । বিজ্ঞানের সঙ্গে সাহিত্যের কোনাে ঝগড়া নেই কারণ সাহিত্য সমাজের দর্পণ , সাহিত্যিক কথার মালা গাঁথেন মাত্র । সাহিত্যিক কোথা থেকে অলীক কল্পনা করবেন ? কি ক্ষমতা রয়েছে তার ? যদি কোনাে সাহিত্যিক কল্পনায় গরুকে গাছে তুলিয়ে দেন অথবা আকাশে উড়িয়ে দেন তাহলেও জানতে হবে কোনদিন না কোনদিন গরু গাছে উঠেছে অথবা আকাশেই উড়েছে , তা নাহলে তার মাথায় এ কল্পনা আসতােনা । কল্পনা আসলে বস্তুর ফেলে রাখা ছবি । বস্তুটি ধ্বংস প্রাপ্ত হতে পারে কিন্তু ছবিটি বস্তু রেখে গেছে বা ফেলে গেছে । আমরা ধারাবাহিক বংশ গতিতে সেটিকেই বয়ে চলেছি মাত্র । যেমন আমি মৃত , আমার পুত্র জীবিত । বস্তুটি ‘ আমি ’ , ইন্দ্রিয় দ্বারা ( আমার চোখ কান নাক বর্তমানে ) মৃত্যুর পর খুঁজে পাচ্ছিনা , তাই বলে বস্তুটি ছিলােনা একথা বলা যায় । বস্তু ও আলাে ছাড়া ছবি উঠবেনা । বস্তুতে আলাে পড়ে বলেই ছবির সৃষ্টি হয়েছে । ছবি বস্তুর দিক চিহ্ন বা সংকেত ৰাহী । পুত্র , পিতার সংকেত বাহী । বস্তুটি অস্তিত্ব , পুত্র বস্তুর সংকেত বলা চলে । বড়ােজোড় সজীব বস্তু বলতে পারি । বস্তুর আয়তন ওজন ভর ( সজীব বস্তু ) গতিশীল এসব ভাবা যেতে পারে । ছবি নির্জীব বস্তু কিন্তু সজীব বস্তু থেকেই সে নিঙবে আজ পরিণত হয়েছে । বর্তমানে প্রাণহীন বস্তু অতীতের প্রাণ সংকেত । সাধকেরা তাই বলেছেন প্রতিটি বস্তু ব্রহ্মের অংশে সে জীবই হােক আর জড় পদার্থই হােক । কারণ আজ যে জীব কাল সেই জড় । জীবিত ব্যক্তি মৃত হলে জড়ে রূপান্তরিত হয় তখন জড় ( মড়া ) জীবিত ব্যক্তির ছায়া , বস্তু হলেও । ক্রিয়ার পার্থক্য আছে আবার অস্তিত্বের পার্থক্যও আছে । জীবও একদিন না একদিন ধ্বংস হবে । ধ্বংসের পর জীব অণুতে পরমাণুতে পঞ্চভূতে বিলীন হবে। জীব সৃষ্টি হবে পঞ্চভূত। জড় কোথায় যাবে ? জড়ও তাে ধ্বংস হওয়ার পর পঞ্চভূতেই রয়েছে ? সেও জীবের সৃষ্টি হওয়ার পর পঞ্চভূত নিয়েই গঠিত হবে এবং ক্রিয়াকাল হবে জীবের সঙ্গে । জড় নিজে কাজ করবে জীবের সহযোগী হয়েই তাই জীব জড় পদার্থের ওপর এসেই জন্মায় মাটি বা অন্য পদার্থের ওপর এসে পড়ে । মাটিকে তাই আমরা প্রণাম করি । কে বলেছে মাটি জড়পদার্থ ? আমি কি তার চেতনের অনুভব পাইনি ? তার গুণগত বৈশিষ্ট্য নেই ? সে কি মানবের সহযােগী নয় ? যদি কোনাে বন্ধুর কোনাে গুণ না থাকতাে তাহলে আমরা তাকে কি গ্রহণ করতাম ? কিছুদিন আগেও আমাদের ধারণা ছিলাে গাছ কথা বলতে পারে না । গাছের প্রাণ নেই ? পরে অবশ্য এ ভুল ভাঙ্গলাে এই তাে সেদিনের কথা যখন জগদীশ চন্দ্র বােস জানিয়ে দিলেন গাছেরও প্রাণ আছে যদিও সে আক্ষরিক অর্থে গমনশীল নয় কিন্তু তার ব্যাপ্তি রয়েছে বিস্তার রয়েছে , রয়েছে বংশগতির ধারা । মাটিও গ্রহণ বর্জন করতে পারে অতি সূক্ষ্মভাবে । মাটির গুণগত বৈশিষ্ট্য রয়েছে সে সৃষ্টিকার্যে সাহায্যকারীর ভূমিকা পালন করে সজীব বস্তুর বিশ্বস্ত বন্ধু হয়ে । মাটি ছাড়া জীবের অস্তিত্ব কল্পনা করা সম্ভব ? জীব কোনােদিন বেঁচে থাকতে পারবে মাটি ছাড়া ? মাটি আমাদের বেঁচে থাকার উপযােগী পরিবেশ তৈরী করে প্রয়ােজন অনুযায়ী । আমি সৃষ্টির সময় মাটিতে এসেছি ধ্বংসের সময় মাটিতেই বিলীন হবাে তাই মাটি মা । এই মাটিই আমাকে পঞ্চভূতের অস্তিত্ব গঠন করতে সর্বতােভাবেই সাহায্য করবে অলক্ষ্যে । মাটি থেকে রস নিয়ে চারা হবে উদ্ভিদ । সে আমার খাদ্যের যােগান দেবে । খাদ্য খেয়ে আমার শরীর ধারণ হবে শরীর থেকে বীর্যশক্তি উৎপাদন হবে আবার এই বীজ বা শক্তি নব শক্তির জন্মদেবে এতাে বৃত্তাকারে ঘূর্ণায়মান চক্র । মাটি আপাতত জড় পদার্থ বলে মনে হলেও তার জীবন যাত্রার ছন্দ রয়েছে , আমাদের মতােই সে তাপ গ্রহণ করে বর্জন করে । আসলে মাটি কে ? এ সত্য একমাত্র বলতে পারবে এ জগতে উদ্ভিদ । যদি কোনাে দিন গাছ প্রকাশ্যে এসে জানিয়ে দেয় যে মাটি কে ? তাহলে আমরা তখনই জানাতে পারবাে মাটির আসল পরিচয় কি ? কারণ গাছই একান্তে কথা বলে মাটির সঙ্গে । আমরা আজও গাছের হাসি কান্না সুখ দুঃখ কিছুই অনুভব করতে পারলাম না বাহ্যিকভাবে , তাই এ ধরার সব কিছুই আমাদের অজানা বয়ে গেল । গােটাকতক যন্ত্রপাতি নিয়ে আর কয়েকটা কলম নিয়ে সারা ব্রহ্মাণ্ডের সংবাদ জানা তাই আমাদের কাছে অজানা । যাঁরা এর বিন্দুমাত্র সংবাদ পেয়েছেন তারাই বলতে পেরেছেন ‘ বিপুলা এ পৃথিবীর কতটুকু জানি ।
সাধকের সাধনা তাই অলীক নয় , ভ্রান্ত নয় , তা একেবারে চরম সত্য । জাগ্রত কুলকুণ্ডলিনী সব পরিস্কার করে দিয়ে জানিয়ে দেবে ব্রহ্ম তত্ত্ব , যা পুরােপুরি বিজ্ঞান পুরােটাই সত্য । আসলে এ যুগের মানুষ দ্রুত গতিতে ছুটে চলেছে , কেন চলেছে ? তা সে নিজেই জানেনা আর কোথায় চলেছে তাও জানেনা ? সে শুধু চলতি পথে ট্রেন থেকে জানালা দিয়ে দেখার মতাে এ পৃথিবীর সবকিছুকেই অস্পষ্ট দেখছে প্রতিনিয়ত আর অঙ্ক করে জানতে চাইছে চটজদি সিদ্ধান্ত । যার ফলে মানুষ আজ হারিয়েছে ত্যাগ , ধৈর্য , আর তিতিক্ষা । চোখ থাকতেও সে অন্ধ । সে চায় এখুনি সবকিছুর সমাধান হােক চোখের সামনেই এক মিনিটে । কিন্তু একমিনিটে সবকিছু জানতে গেলে যে ষাট ( ৬০ সেকেণ্ড ) সেকেণ্ড পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে তা বােধহয় আমরা ভুলে গেছি । এই ভুলে যাওয়া অধৈর্য স্বভাবের জন্য সব জেনেও সৰ পেয়েও সবকিছুকেই মানুষ আজ হারাতে বসেছে এ আমাদের এক চরম দুর্ভাগ্য ছাড়া আর কি ? ক্রিয়ার প্রতিফলন ঘটছে আমার আপনার মধ্য দিয়ে তাই মনে এত হতাশা এত অন্ধকার আজ ।
Continue-12
গদ্যে শ্রী শ্রী চন্ডী
বহু আগে যখন দ্বিতীয় মনু ছিলেন তখন চৈত্রের বংশ জাত রাজা সুরথ পৃথিবীর এক মাত্র অধীশ্বর ছিলেন । তিনি তার প্রজাদের পুত্রসম স্নেহ ভালোবাসা দিয়ে রাজ্য শাসন করতেন । একদা যবন রাজারা তার রাজ্য আক্রমণ করেন । যুদ্ধে রাজা সুরথ এর পরাজয় হয় । তার রাজ্য , সিংহাসন , ধন, সম্পদ সব শত্রুর হাতে চলে যায় । তিনি সব হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়েন । মনের দুঃখে তিনি বনে চলে যান । সেখানে তিনি বিষন্ন মনে ঘুরতে থাকেন ।
বনে গিয়ে প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য দেখে রাজা খানিকটা এগিয়ে গেলেন । সেখানে তিনি এক মুনির আশ্রম দেখতে পেলেন । আশ্রমে ঢুকে জানতে পারলেন এটি মেধস্ মুনির আশ্রম । রাজা সেখানে চিন্তা করতে লাগলেন “ অতীতে আমার পূর্বপুরুষ গন যে রাজ্যকে সুন্দর ভাবে পালন করিয়াছেন , তাহা এখন দুষ্ট অমাত্য দের দখলে । তারা এখন সকল প্রজাদের রক্ষা করিতেছেন কিনা ? জানি না সেই মহাবলবান মদস্রাবী প্রধান হাতিটি শত্রুদের অধিকৃত হয়ে ঠিকঠাক খাবার পাচ্ছে কিনা ? যে সকল রাজ কর্মচারী আগে পারিতোষিক , বেতন , খাদ্যদ্রব্য পেয়ে আমার অনুগত থাকত , আজ তারা অন্যের দাসত্ব করছে । আমি এত কষ্ট করে , দুঃখ করে যে বিশাল ধনরাশি জমা করেছিলাম তা ঐ অমিতব্যয়ী গন অপচয় করে শেষ করবে” ।
অপর দিকে সমাধি নামক এক বৈশ্য সেই বনে বিষন্ন মনে চলে আসেন । সমাধি বৈশ্য এক বিত্তশালী ঘরের ছিলেন । তিনি ছিলেন ধনী । কিন্তু তার স্ত্রী ও পুত্রেরা সমস্ত সম্পত্তি হাতিয়ে তাকে পরিত্যাগ করেন । ঘটনাচক্রে সমাধি বৈশ্য বনে ভ্রমণ করতে করতে মেধস মুনির আশ্রমে পৌছালেন ।
সমাধি বৈশ্য কে সেখানে দেখে রাজা সুরথ তার পরিচয় জানতে চাইলে সমাধি বৈশ্য তার পরিচয় ও দুঃখের কারণ জানালেন । সমাধি বৈশ্য জানালেন “ আমার অসাধু স্ত্রী ও পুত্রেরা ধনের লোভে আমাকে পরিত্যাগ করেছে । আমি এখন ধনহীন দরিদ্র । আমার আত্মীয় কুটুম্ব , বন্ধু বান্ধব রা আমাকে পরিত্যাগ করায় আমি মনে অনেক দুঃখ নিয়ে বনে চলে এসেছি । কিন্তু এখানে এসেও আমি আমার স্ত্রী , পুত্র ও বন্ধু দের ভুলতে পারছি না । তারা কেমন আছে , তারা ভালো না খারাপ পথে চলছে তাও আমি জানি না।”
রাজা সুরথ বললেন “ যে আত্মীয় ও স্ত্রী পুত্রেরা ধন লোভে আপনাকে পরিত্যাগ করল তাদের জন্য আপনার মন এত স্নেহাসক্ত হচ্ছে কেন ?”
সমাধি বৈশ্য বললেন “ আপনি আমার সম্পর্কে ঠিক বলেছেন । কিন্তু আমি আমার মনকে নিষ্ঠুর করতে পারছি না । বরং তাদের প্রতি আমার মন আরো আসক্ত হচ্ছে । তাদের জন্য আমার দুশ্চিন্তা হচ্ছে । আমি আমার মনকে নিষ্ঠুর করতে পারছি না ।”
রাজা সুরথ ও সমাধি বৈশ্য এরপর মেধস্ মুনিকে প্রনাম জানিয়ে বললেন – “ হে ভগবন , আপনার কাছে একটি প্রশ্ন করি । আপনি কৃপা করে তার উত্তর দিন । আমার মন আমার নিজের বশীভূত নয় । সেজন্য আমার হারানো রাজ্যাদিতে এখনও আমার মমতা আছে । আমি এও জানি যে এই হারানো মমতা দুঃখের কারন । কিন্তু এমন জানা সত্ত্বেও আমার হারানো রাজ্য ও রাজ্যের অঙ্গ গুলির জন্য আমার যে আসক্তি বা মমতা থেকে গেছে এর কারণ কি ? এই সমাধি বৈশ্য কেও তার স্ত্রী ও পুত্রেরা তাঁর ধন থেকে বঞ্চিত করেছে । তাঁর অমাত্য কর্মচারীরা তাকে বর্জন করেছে , আত্মীয় স্বজন রাও তাকে ছেড়ে চলে গেছে । কিন্তু তবুও ইনি সেই তাদের প্রতি একান্তভাবেই আসক্ত । এই ভাবেই ইনি ও আমি উভয়েই খুব দুঃখিত হয়েছি । কারণ স্ত্রী- পুত্র – রাজ্যাদি বিষয়ে দোষ দেখেও তাদের প্রতি আমাদের মন মমতায় আকৃষ্ট হয়ে আছে । হে মহামতি , আমারও এরকম জ্ঞান থাকা সত্ত্বেও আমাদের এই মোহ কি জন্য ? এইরকম মূঢ়তা বিবেকহীন লোকেদেরই হয়ে থাকে ।”
মেধস্ ঋষি বললেন – “ হে মহাভাগ , সকল প্রাণীরই রূপ , রস , প্রভৃতি সম্পর্কিত ইন্দ্রিয় গ্রাহ্য বিষয়ে জ্ঞান আছে এবং সে সব বিষয় সমূহ কিভাবে তাদের জ্ঞান গোচর হয় তা আপনাদের বলছই
পেঁচা বা তার মত প্রানী দিনের বেলায় দেখতে পায় না । তারা অন্ধ হয়ে থাকে । আবার কাক বা তার মতো প্রানী রাতের বেলায় দেখতে পায় না । আবার অনেক প্রানী দিন রাত সর্বদা অন্ধ থাকে । আর বিড়ালের মতো প্রানী দিন রাত সব সময় দেখতে পায় । একথা সত্য যে মানুষের বিষয় জ্ঞান আছে । কিন্তু তাদেরই শুধু বিষয় জ্ঞান আছে – একথা ঠিক না । কারণ পশু পাখী হরিণ , মাছ সকল প্রাণীরই বিষয় জ্ঞান আছে , মানুষেরও তেমনি বিষয় জ্ঞান আছে । আবার মানুষের যে রকম বিষয়ে জ্ঞান আছে পশু পাখীদেরও সেরকমই আছে । আহার , নিদ্রা প্রভৃতি বিষয়ের জ্ঞান পশু- পাখী এবং মানুষ উভয়েই সমান ।
দেখুন পাখীরা যে খাবার সংগ্রহ করে তাই তাদের শাবকের মুখে তুলে দেয় । এর ফলে তারা খেলেও তাদের ক্ষুধার নিবৃত্তি হয় না । একথা আমরা যেমন জানি বুঝি তেমনি পাখীরাও বুঝে । অথচ সব জেনে বুঝেও তারা শস্যকণা তাদের শাবক দের মুখে তুলে দিতে কত আগ্রহ । হে নরশ্রেষ্ঠ , এই মানুষ দের ক্ষেত্রে আবার দেখছেন না , তারা ভাবে তাদের সন্তান ভবিষ্যতে তাদের প্রত্যুপকার করবে ; সেই লোভে তারা তাদের সন্তান দের প্রতি কতই না অনুরক্ত হয় ? তবুও সংসারের স্থিতি কারিনী মহামায়ার প্রভাবে জীব গণ মোহ রুপ গর্তে এবং মমতা রুপ আবর্তে নিক্ষিপ্ত হয়ে থাকে । এই মহামায়াই জগতের অধিপতি বিষ্ণুর যোগনিদ্রা স্বরুপিনী । তার দ্বারাই এই সারা জগত মোহিত হয়ে আছে । সুতরাং এ বিষয়ে আশ্চর্য হওয়া উচিত নয় । এমনকি সেই দেবী ভগবতী মহামায়ার প্রবল প্রতাপ থেকে জ্ঞানবান বা বিবেক সম্পন্ন মানুষেরও রেহাই নেই । সেই মহামায়া তাদের চিত্তকে জোর করে আকর্ষণ করে মোহের দ্বারা আবৃত করে রাখেন । অতএব যারা সাধারন মানুষ তারা যে তার মোহপাশে আবদ্ধ থাকবে তাতে আর আশ্চর্য কি ?
সেই মহামায়া এই সমস্ত চরাচর জগত কে সৃষ্টি করেছেন । তিনি প্রসন্না হলে তাঁরই কৃপায় মানুষ মুক্তিলাভ করে থাকে । সেই মহামায়াই সংসার থেকে মুক্তির একমাত্র উপায় । তিনিই পরমা ব্রহ্মবিদ্যারূপিণী ও সনাতনী । তিনি সংসার বন্ধনের কারন স্বরুপিনী অবিদ্যা এবং তিনি ব্রহ্মা , বিষ্ণু প্রভৃতি সকল ঈশ্বরের ঈশ্বরী ,অধিশ্বরী । ”
এই কথা শুনে রাজা সুরথ ও সমাধি বৈশ্য জিজ্ঞেস করলেন – “ হে ভগবন , আপনি যাঁকে মহামায়া বলছেন – সেই দেবী কে? তিনি কি রুপে উৎপন্না হন ?
সেই মহামায়ার স্বভাব কি রকম ? তাঁর স্বরূপ কি রকম ? এবং যে জন্য তেনার আবির্ভাব হয় তা আমি আপনার থেকে শুনতে ইচ্ছা করি ।”
মুনি বলিলেন – “ সেই মহামায়া নিত্যা । এর অর্থ তার জন্ম নেই । মৃত্যু নেই । আবার এই জগত প্রপঞ্চ তাঁরই বিরাট মূর্তি । তিনি সর্বত্রই বিরাজমানা । তিনি নিত্যা । তাও তাকে বহুবার আবির্ভূত হতে হয়েছে ও হতে হয় । আমি আপনাদের কাছে সেই কথা বলছি । আপনারা তা মনোযোগ দিয়ে শুনুন ।”
( মধু কৈটভ বধ )
পূর্বে প্রলয়কালীন সাগর জলে অখিল বিশ্ব পরিব্যাপ্ত এবং ত্রিভুবন বিলীন হলে যখন ভগবান বিষ্ণু অনন্ত নাগ শয্যায় শয়ন করছিলেন তখন তাঁর কর্ণমল থেকে মধু ও কৈটভ নামক দুই অসুর প্রকট হলেন । তারা জলে খেলা করে বেশ কিছুদিন কাটালো । একদা তাদের মনে প্রশ্ন জাগল যে, এই জলরাশি কোন বস্তুর ওপর অবস্থান করছে ? কে এর সৃষ্টি কর্তা ? কি ভাবে এটি সৃষ্টি হয়েছে ? আমাদের বাবা মা কে?
অসুর দ্বয় এই প্রশ্নের কথা ভাবতে লাগলো । এমন সময় কৈটভ বলল – “ ভাই আমার মনে হয় , আমাদের যে এই জলের মধ্যে থাকা অচলা শক্তি আছে , তাই সব কিছুর কারন হবে । এই জলরাশি সেই শক্তিতে পরিব্যাপ্ত হয়ে তাতেই অবস্থিত আছে । সেই পরমা দেবী আমাদের কারণ হবেন । ”
চিন্তায় ব্যাকুল তারা দুইজন তখন আকাশে একটি বাগবীজ শুনতে পেলো । তারা সেই বীজ উচ্চারন করতে থাকল । এভাবে তারা শুদ্ধচিত্তে হাজার বছর তপস্যা করল ।
একদা তারা নারী কণ্ঠ শুনতে পেলো । দেবী বলছেন “ হে দানব দ্বয় । আমি তোমাদের তপস্যায় সন্তুষ্ট হয়েছি । তোমরা বর প্রার্থনা কর । ”
দুই দানব ইচ্ছামৃত্যুর বর চাইলো । দেবী তাদের তাই বর দিলেন । তখন দুই দানব জলে খেলা করে বেড়াতে লাগলো । হটাত তারা একদিন ভগবান শ্রী হরির নাভি পদ্মে ধ্যানমগ্ন ব্রহ্মা কে দেখতে পেলেন । তারা তখন ব্রহ্মা কে আক্রমণ করলেন । ব্রহ্মা তখন আত্মরক্ষার জন্য ভগবান বিষ্ণুর শরণাপন্ন হলেন । তিনি ভগবান বিষ্ণুর স্তব করতে লাগলেন । কিন্তু ভগবান যোগ নিদ্রায় মগ্ন । তিনি জাগলেন না । ব্রহ্মা বুঝতে পারলেন ভগবান বিষ্ণু যোগমায়ার প্রভাবে যোপ নিদ্রায় আছন্ন । তাই যোগমায়া ভগবান বিষ্ণু কে প্রভাব মুক্ত না করলে তিনি জাগবেন না । তাই ব্রহ্মা সেই আদ্যাশক্তির স্তব করতে লাগলেন ।
ব্রহ্মার স্তব
“ হে নিত্যে , হে অক্ষরে , তুমি দেবতাদের উদ্দ্যেশে হবিঃ দানের ‘স্বাহা’ মন্ত্র । তুমি পিতৃলোকের উদ্দ্যেশে দ্রব্যদানের ‘ স্বধা ’ মন্ত্ররূপা । তুমি দেবতাদের আহ্বানের বষট্ মন্ত্র স্বরুপিনী । তুমিই অমৃত রূপা এবং তুমি অ-উ-ম এই মাত্রা রুপে অবস্থিতা প্রনব রুপা । যা বিশেষ রুপে উচ্চারনের যোগ্য নয় , সেই নির্গুণা বা তুরীয়া – তাও তুমি । হে দেবী তুমিই গায়ত্রী মন্ত্র স্বরুপিনী । তুমিই পরমা জননী । হে দেবী তুমিই এই সমগ্র জগত কে ধরে রেখেছো , এই জগত তোমারই দ্বারা সৃষ্ট ও প্রতিপালিত হয় এবং সব সময় প্রলয় কালে তুমি একে গ্রাস করে থাকো বা সংহার করে থাকো । হে জগতস্বরূপা , তুমিই এই জগতের সৃষ্টির সময় সৃষ্টিরূপা , পালন কালে তুমিই স্থিতি রুপা , এবং সবসময় প্রলয়কালে তুমি সংহার রুপা । হে দেবী তুমিই তত্ত্বমসি ইত্যাদি মহাবাক্য লক্ষণা ব্রহ্মবিদ্যা ও মহামায়া । তুমিই মহতী মেধা বা ধারনা । তুমিই মহতী স্মৃতি ও মহামোহরুপিনী । তুমিই সর্ব রপিনী । তুমি দেবশক্তি আবার তুমিই অসুর শক্তি । তুমি সর্বভূতের মূল কারণ রুপা প্রকৃতি এবং গুনত্রয়ের প্রসবকারিনী । তুমিই কালরাত্রি অর্থাৎ যাতে ব্রহ্মার লয় হয় ও মহারাত্রি যাতে জগতের লয় হয় এবং ভীষন মোহরাত্রিস্বরূপা । তুমি শ্রী অর্থাৎ লক্ষ্মী । তুমি ঈশ্বরী শক্তি । তুমিই হ্রী । তুমিই নিশ্চয়াত্মিকা বুদ্ধি । তুমিই লজ্জা । তুমিই পুষ্টি এবং তুমিই শান্তি ও ক্ষমারূপিণী । তুমিই খড়্গ ধারিনী । তুমিই ত্রিশূলধারিণী , তুমিই ভয়ঙ্করী , গদাধারিনী , চক্রধারিনী , শঙ্খধারিনী এবং ধনুর্ধারীনি । তুমিই বাণ , ভূশন্ডী ও পরিঘ নামে অস্ত্রধারিনী । তুমিই দেবতা গনের প্রতি প্রশান্তা বা সৌম্যা । তুমিই দৈত্য গনের প্রতি অসৌম্যতরা অর্থাৎ ততোধিক রুদ্রা। তুমিই সকল সুন্দর বস্তুসমূহ থেকেও সুন্দরী । তুমিই ব্রহ্মা প্রভৃতি দেবতাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ । তুমিই সর্ব প্রধানা দেবী ও তুমিই পরমেশ্বরী । হে সর্বস্ব রুপে যে কোন জায়গায় বা স্থানে যে কোন চেতনা বা জড় বস্তু অতীতে ছিল , বর্তমানে আছে , এবং ভব্যিষতে হবে সেই সকল যেই শক্তি তাও তুমি । অতএব কিভাবে তোমাকে স্তব করব? যিনি ব্রহ্মা রুপে জগতের সৃষ্টি করেন । বিষ্ণু রুপে জগতকে পালন করেন এবং শিব রুপে জগতকে ধ্বংস করেন , সেই পরমেশ্বরকেই তুমি নিদ্রায় অভিভূত করেছ । সুতরাং এই জগত সংসারে তোমার স্তব করার সাধ্য কার আছে ? তুমি আমাকে , বিষ্ণুকে এবং শিবকেও শরীর গ্রহণ করিয়েছ । সুতরাং কে তোমার স্তব করতে পারে ? হে দেবী , তুমিই এক রকম ভাবে নিজ অলৌকিক মহিমায় সংস্তুতা হয়ে মধু ও কৈটভ নামক এই দুর্জয় দুই অসুরকে মোহিত কর । হে দেবী তুমিই জগত স্বামী বিষ্ণুকে শীঘ্র যোগনিদ্রা থেকে জাগিয়ে এই দুই মহাসুরকে বধ করার জন্য প্রবৃত্তি দান কর । ”
এই ভাবে ব্রহ্মা দশমুখ ও দশ চরণ বিশিষ্টা পরমেশ্বরী মহাকালীর স্তব করলেন । দেবী স্তবে মুগ্ধ হয়ে ভগবান বিষ্ণুর যোগনিদ্রা ভঙ্গ করার জন্য তাঁর চোখ, মুখ, মুখ, নাসিকা , বাহু , হৃদয় এবং বক্ষস্থল থেকে নির্গত হয়ে ব্রহ্মার সম্মুখে প্রকট হলেন । ভগবান বিষ্ণু জেগে উঠলে ব্রহ্মা তাকে সব ঘটনা জানালেন । ততক্ষণে দুই অসুর ও সেখানে এসে গেছে । ভগবান বিষ্ণু সব শুনে যুদ্ধে নামলেন । ২ অসুরের সাথে ভগবান বিষ্ণুর যুদ্ধ বেধে গেলো । যুদ্ধ করতে করতে পাঁচ হাজার বছর কেটে গেল । তবুও দুই অসুর বধ হলেন না । শেষে ভগবান বিষ্ণু ও দুই অসুর ক্লান্ত হয়ে বিশ্রাম নিতে বসলেন , ভগবান বিষ্ণু ভাবলেন এই দুই অসুর দেবীর কাছে ইচ্ছামৃত্যুর বর পেয়েছেন । তাই এদের বধ করা অস্মভব ।
তখন ভগবান নারায়ন সেই মহামায়া কে স্তব করতে লাগলেন । দেবী প্রকট হয়ে জানালেন – “ আপনি যুদ্ধ করুন । আমি শীঘ্র মোহ বিস্তার করে ২ অসুরের বুদ্ধি ভ্রমিত করব ।”
ভগবান আবার যুদ্ধ শুরু করলে দেবী ২ অসুরকে ভ্রমিত করলেন । দুই অসুর গর্বে ভগবান বিষ্ণু কে বললেন – “ ওহে তোমার যুদ্ধ কলায় আমরা প্রসন্ন । তুমি আমাদের কাছে বর চাও ।”
ভগবান বিষ্ণু বললেন – “ তোমরা আমার হাতে বধ্য হও , এই আমার অভিলাষ ।”
দুই অসুর ও বেশ চতুর । তারা বললেল – “ তাই হবে । তবে আমরা স্থলে মরতে চাই ।”
কারন অসুর ২ জন দেখল চার পাশে খালি জল আর জল । তখন ভগবান বিষ্ণু বললেন – “ তোমরা আমার জঙহা তে আসো । আমি সেখানেই বধ করবো ।”
শুনে দুই অসুর নিজের দেহ কে সহস্র যোজন বড় করল । ভগবান বিষ্ণু তার শরীর কে তার দ্বিগুণ করলেন । তারপর ২ অসুরকে নিজ জঙ্ঘা তে রাখলেন । তারপর সুদর্শন চক্র দিয়ে মধু আর কৈটভ এর শিরোচ্ছেদ করলেন । এই ভাবে মধু আর কৈটভের অন্ত হল ।
(শুম্ভ ও নিশুম্ভ বধ )
শুম্ভ ও নিশুম্ভ নামক দুই দানব ছিল । তারা প্রজাপতি ব্রহ্মার কঠোর তপস্যা করলেন । খুশি হয়ে প্রজাপতি ব্রহ্মা বর দিতে আসলেন । ২ দানব বর চাইলো যে , কোন পুরুষ যেনো তাদের বধ করতে না পারে । ব্রহ্মা তাদের তাই বর দিলেন ।
এর পর সেই দুই অসুর মহা ভয়ানক অত্যাচার আরম্ভ করল । তার সাথে যোগ দিল চণ্ড ও মুণ্ড নামক ২ অসুর । রক্তবীজ নামক আর এক অসুর এসে যোগ দিল । রক্তবীজ ব্রহ্মার কাছে বর পেয়েছিলেন যে তার রক্ত মাটিতে যেখানেই পরবে সেখানেই দ্বিতীয় রক্তবীজ তৈরি হবে ।
অসুর দের অত্যাচারে ধর্ম কর্ম লোপ পেল । মুনি ঋষি দের কারাগারে বা তাদের বধ করা হল । অনেক কন্যা রা দানব দের হাতে লাঞ্ছিতা হলেন । অনেক রাজা তাদের কাছে পরাজয় স্বীকার করল । এভাবে পৃথিবী বিজয় হলে অসুর রা বিশাল সেনা নিয়ে স্বর্গ আক্রমণ করল । দেবতা আর অসুর দের মধ্যে ভয়ানক যুদ্ধ হল । দেবতারা পরাজিত হয়ে স্বর্গ থেকে পলায়ন করলেন । স্বর্গে অসুরদের অধিকার কায়েম হল । পরাজিত দেবগণের দুঃখের সীমা থাকল না। আর ব্রহ্মার বর এর জন্য বিষ্ণু বা মহেশ্বর কেঊ ওই অসুরদের বধ করতে পারবেন না । ভাবতে ভাবতে দেবতাদের মাথায় এল , ভগবতী বর দিয়েছিলেন যে , বিপদে তাকে স্মরণ করলেই তিনি আবির্ভূতা হবেন । ভাবামাত্র দেবতারা হিমালয় এ গিয়ে দেবীর স্তব করতে লাগলেন ।
দেবতাদের স্তব
“ দেবীকে , মহা দেবীকে প্রনাম । সতত কল্যাণময়ী দেবী শিবাকে সতত প্রনাম করি । সৃষ্টিশক্তিরুপিনী ভদ্রাকে প্রনাম । আমরা একাগ্র চিত্তে তাঁকে বার বার প্রনাম করি । রৌদ্রাদেবীকে , নিষ্ঠদেবীকে প্রনাম , গৌরী দেবীকে , জগদ্ধাত্রী দেবীকে প্রনাম করি । জ্যোৎস্নারুপিনী , চন্দ্ররুপিনী মুখস্বরূপাকে সতত প্রনাম করি । কল্যাণীকে প্রনাম করি । বুদ্ধিরুপা ও সিদ্ধিরুপাকে পুনঃ পুনঃ প্রনাম করি , অলক্ষ্মীরূপা , রাজগণের লক্ষ্মীরূপা এবং শিবশক্তিরুপিনী তোমাকে বার বার প্রনাম করি । দুস্তর ভবসাগর পারকারিনী দুর্গাদেবীকে প্রনাম করি । যিনি সারভূতা , সর্বজননী , খ্যাতিরুপিনী এবং যিনি কৃষ্ণাবর্না ও ধুম্রবর্ণা সেই দেবীকে সতত ভক্তি ভরে প্রনাম করি । যিনি বিদ্যা রুপে অতি সৌম্যা এবং আশ্রয়রুপিনী ও ক্রিয়ারুপিনী দেবীকে বারবার প্রনাম করি । যে দেবী সকল প্রানীতে বিষ্ণুমায়া নামে শব্দিতা বা অভিহিতা হন , তাঁকে প্রনাম , তাঁকে প্রনাম , প্রনাম , প্রনাম । যে দেবী সকল প্রানীতে বুদ্ধিরুপে অবস্থিতা তাঁকে প্রনাম , তাঁকে প্রনাম , প্রনাম , প্রনাম । যে দেবী সর্বভূতে নিদ্রারুপে অবস্থিতা তাঁকে প্রনাম , তাঁকে প্রনাম , প্রনাম , প্রনাম । যে দেবী সকলভূতে ক্ষুধারুপে অবস্থিতা তাঁকে প্রনাম , তাঁকে প্রনাম , প্রনাম , প্রনাম । যে দেবী সর্বভূতে ছায়ারুপে অবস্থিতা তাঁকে প্রনাম , তাঁকে প্রনাম , প্রনাম , প্রনাম । যে দেবী সকলভূতে শক্তিরুপে অধিষ্ঠিতা তাঁকে প্রনাম , তাঁকে প্রনাম , প্রনাম , প্রনাম । যে দেবী সকল প্রানীতে বিষয় বাসনা রুপে অবস্থিতা তাঁকে প্রনাম , তাঁকে প্রনাম , প্রনাম , প্রনাম । যে দেবী সকল প্রানীতে ক্ষমা রুপে অবস্থিতা তাঁকে প্রনাম , তাঁকে প্রনাম , প্রনাম , প্রনাম । যে দেবী সর্বভূতে জাতিরুপে অবস্থিতা তাঁকে প্রনাম , তাঁকে প্রনাম , প্রনাম , প্রনাম । যে দেবী সর্বভূতে লজ্জারুপে অবস্থিতা তাঁকে প্রনাম , তাঁকে প্রনাম , প্রনাম , প্রনাম । যে দেবী সর্বভূতে শান্তিরুপে অবস্থিতা তাঁকে প্রনাম , তাঁকে প্রনাম , প্রনাম , প্রনাম । যে দেবী সর্বভূতে শ্রদ্ধারুপে অবস্থিতা তাঁকে প্রনাম , তাঁকে প্রনাম , প্রনাম , প্রনাম । যে দেবী সর্বভূতে কান্তিরুপে অবস্থিতা তাঁকে প্রনাম , তাঁকে প্রনাম , প্রনাম , প্রনাম । যে দেবী সর্বভূতে লক্ষ্মী রুপে অবস্থিতা তাঁকে প্রনাম , তাঁকে প্রনাম , প্রনাম , প্রনাম । যে দেবী সর্বভূতে বৃত্তি বা জিবীকা রুপে অবস্থিতা তাঁকে প্রনাম , তাঁকে প্রনাম , প্রনাম , প্রনাম । যে দেবী সর্বভূতে স্মৃতিরুপে অবস্থিতা তাঁকে প্রনাম , তাঁকে প্রনাম , প্রনাম , প্রনাম । যে দেবী সর্বভূতে দয়ারুপে অবস্থিতা তাঁকে প্রনাম , তাঁকে প্রনাম , প্রনাম , প্রনাম । যে দেবী সর্বভূতে তুষ্টি রুপে অবস্থিতা তাঁকে প্রনাম , তাঁকে প্রনাম , প্রনাম , প্রনাম । যে দেবী সর্বভূতে মাতৃরুপে অবস্থিতা তাঁকে প্রনাম , তাঁকে প্রনাম , প্রনাম , প্রনাম । যে দেবী সর্বভূতে ভ্রান্তিরুপে অবস্থিতা তাঁকে প্রনাম , তাঁকে প্রনাম , প্রনাম , প্রনাম । যিনি সমস্ত প্রানীর মধ্যে ইন্দ্রিয়গনের অধিষ্ঠাত্রী দেবতারুপে বিরাজিতা এবং যিনি ক্ষিতি , অপ্ , তেজ , মরুৎ ও ব্যোম , পঞ্চভূতের প্রেরায়িত্রী , সেই বিশ্ব ব্যাপিকা দেবীকে পুনঃ পুনঃ প্রনাম করি । যিনি চিৎশক্তি রুপে এই সারা জগত জুড়ে অবস্থান করছেন তাকে প্রনাম প্রনাম প্রনাম । ”
এই ভাবে দেবতারা দেবী ভবানীর স্তব করতে লাগলেন । সে সময় সেখানে দেবাদিদেব মহেশ্বরের পত্নী ভগবতী পার্বতী তাদের সামনে দিয়ে গঙ্গা স্নানের জন্য যাচ্ছিলেন । দেবী তাদের স্তব শুনে বললেন – “ আপনারা এখানে কার স্তব করিতেছেন ? ”
সেই সময় ভগবতী পার্বতীর শরীর থেকে তার মতন দেখতে আর এক জন দেবী বের হয়ে আসলেন । সেই নব আবির্ভূতা দেবী জানালেন – “ ইহারা আমারাই স্তব করিতেছেন ।”
এই দেবীই আদ্যাশক্তি জগত মাতা অম্বিকা মহামায়া । তিনি দেবী পার্বতীর কোষ থেকে সৃষ্টি হয়েছেন বলে তার এক নাম কৌষিকী । কথিত আছে এর পর নাকি দেবী পার্বতী কৃষ্ণবর্ণা হয়ে যান । এবং তিনি কালিকা নামে প্রসিদ্ধা হলেন ।
দেবতারা দেবী মহামায়ার কাছে অসুর দের অত্যাচার এর কথা বিস্তারে জানালেন । দেবী অম্বিকা তাদের অভয় দিয়ে জানালেন , তিনি অসুর দের নাশ করবেন ।
দেবী হিমালয়ে সিংহ পৃষ্ঠে বসে মধু পান করতে লাগলেন । সে সময় চণ্ড আর মুণ্ড নামক দুই দানব দেবীকে দেখতে পেলেন । চন্ড মুন্ড একথা গিয়ে শুম্ভ নিশুম্ভ কে জানালেন । শুম্ভ , নিশুম্ভ সেই নারীর রুপ বর্ণনা শুনে সেই নারীকে পাবার জন্য আকুল হল । নারী লোলুপতা , কামান্ধতা আসুরিক প্রবৃত্তির আর একটি লক্ষণ । শুম্ভ নিশুম্ভ সেই নারীকে পাবার জন্য সুগ্রীব নামক এক অসুর কে পাঠালো । ঠিক হল সুগ্রীব সেই নারী কে বুঝিয়ে শুনিয়ে নিয়ে আসবে ।
সুগ্রীব হিমালয়ে সেই পর্বত চূড়ায় গিয়ে দেবীকে শুম্ভ নিশুম্ভের পরাক্রম , ঐশ্বর্য এর কথা বলে বিবাহের প্রস্তাব দিল । দেবী শুনে ঈষৎ হাস্য করে বললেন –
“ শুম্ভ ত্রিভুবনের অধিপতি এবং নিশুম্ভ তারই মতো বীর । কিন্তু এ বিষয়ে আগেই আমি আমার অল্প বুদ্ধিবশতঃ যে প্রতিজ্ঞা করেছি , তার অন্যথা করি কি করে ? আমার প্রতিজ্ঞাটি শোন – যিনি আমাকে যুদ্ধে জয় করবেন , যিনি আমার দর্পচূর্ণ করবেন – এবং যিনি জগতে আমার তুল্য বলশালী হবেন – তিনিই আমার স্বামী হবেন । অতএব মহাসুর শুম্ভ অথবা নিশুম্ভ এখানে এসে আমাকে যুদ্ধে হারিয়ে দিয়ে শীঘ্র আমাকে স্ত্রীরূপে গ্রহণ করুন এ বিষয়ে আর দেরীর কি দরকার ?”
দূত জানালেন এটি নিছক উপহাস মাত্র । শুম্ভ ও নিশুম্ভ এর মতো মহা পরাক্রমী ব্যাক্তি আপনার মতো দুর্বলা , অবলা নারীর সাথে কিভাবে যুদ্ধ করবেন ? আপনি চলুন নচেৎ পরে আপনাকে অপমান করে চুলের মুঠি ধরে নিয়ে যাবে ।
দেবী জানালেন – “ আমি বিচার বুদ্ধি করে প্রতিজ্ঞা করিনি । অতএব তুমি ফিরে গিয়ে তোমার রাজা শুম্ভাসুর কে সব জানাও । তারপর তিনি যা উচিত মনে করবেন – তাই করবেন ।”
( ধুম্রলোচন বধ )
শুম্ভ ও নিশুম্ভ তার দূত সুগ্রীব এর মুখে এসব কথা শুনে অতিশয় ক্রুদ্ধ হলেন । অসুররাজ শুম্ভ তখন তার সেনাপতি ধুম্রলোচন কে আদেশ দিলেন – “ তুমি নিজ সৈন্যে পরিবৃত হয়ে সেই গর্বিতা নারীকে চুলের মুঠি ধরে টানতে টানতে এখানে নিয়ে আসো । আর যদি তোমাকে কেউ এ কাজে বাধা দেয় , তাহলে সেই বাধা দানকারী কে তখুনি বধ করবে ।”
এখানে বলা প্রয়োজন নারী অপহরণ একটি আসুরিক প্রবৃতি । আর কোন নারীকে কেশ আকর্ষণ করে নিয়ে আসা আর একটি আসুরিক প্রবৃতি । দুঃশাসন একবস্ত্রা রজঃস্বলা দ্রৌপদী কে কেশ আকর্ষণ করে রাজসভায় নিয়ে এসেছিল । এই পাপেই গোটা কৌরব কূল ধ্বংস হয় । নারী নির্যাতন কারীকে ঈশ্বর ও ক্ষমা করেন না । যাই হোক , ধুম্রলোচন ষাট হাজার সৈন্য নিয়ে দেবীকে আনতে গেল ।
ধুম্রলোচন দেবীকে কাছে গিয়ে বললেন – “আজ যদি আপনি নিজের ইচ্ছায় আমার প্রভু শুম্ভের নিকট না যান তবে আমি আপনাকে কেশ আকর্ষণ করে বলপূর্বক নিয়ে যেতে বাধ্য হব ।”
দেবী বললেন – “ তুমি দৈত্যরাজ শুম্ভ দ্বারা প্রেরিত , বলবান ও সৈন্য পরিবৃত । তুমি যদি আমাকে এভাবে জোর করে নিয়ে যাও , তাহলে আমি আর তোমাকে কি করতে পারি ?”
দেবীর এই কথাই শুনে ধুম্রলোচন দেবীকে ধরতে গেলো । দেবী এই দেখে এক হুঙ্কার দিলেন । সেই হুঙ্কার এই ধুম্রলোচন ভস্ম হয়ে গেল । এর পর দেবীর বাহন পশুরাজ সিংহ প্রচন্ড গর্জন করে কেশর দুলিয়ে অসুর সেনা গনের মধ্যে প্রবেশ করল । তার পর আচরে কামড়ে অসুর দের রক্ত মাংস খেতে লাগল । কাউকে মাথা ছিন্ন করল , কারোর হাত পা বিচ্ছিন্ন করল , কারোর উদর ছিড়ে রক্ত মাংস ভক্ষণ করল , কারোর গোটা শরীর শত টুকরো করে দিল । এভাবে একা সিংহ সমস্ত অসুরদের বিনাশ করল ।
( চণ্ড ও মুন্ড বধ )
শুম্ভ ও নিশুম্ভ সব শুনে অতিশয় বিস্মিত হলেন । কারন এক নারীর পক্ষে ধুম্রলোচন এর মতো মহাবীর কে বধ করা সাধারন ব্যাপার নয় । তারা চণ্ড ও মুন্ড নামক ২ দানব কে পাঠালেন ।
চন্ড ও মুণ্ড বহু সেনা , অশ্ব , রথ , হাতী নিয়ে যুদ্ধে আসল । তারা হিমালয়ের চূড়ায় হাস্যরত দেবী অম্বিকা কে দেখতে পেলেন । দেবী চন্ডিকা তাদের দেখে ভীষণ ক্রুদ্ধা হলেন । ক্রোধে তার বদন মণ্ডল কৃষ্ণবর্ণা হল । দেবী ভ্রুকূটি কুঞ্চিত করলেন । তখন দেবীর ললাট থেকে এক বিকট দর্শনা দেবী প্রকট হলেন । সেই দেবী কালিকা । তিনি বিচিত্র নর কঙ্কাল ধারিনী , নরমুণ্ড মালিনী , ব্যাঘ্রচর্ম পরিহিতা , অস্থি চর্মসার দেহ স্বরূপা । অতি ভীষনা , বিশাল বদনা , লোলজিহ্বা , ভয়ঙ্করী , কোটর গতা , আরক্ত চক্ষু বিশিষ্টা এবং সিংহ নাদে দিক মণ্ডল পূর্ণ কারিনী ।
সেই ভয়ংকরা দেবী ভীষন হুঙ্কার দিয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে প্রবেশ করলেন । সেই দেবী প্রচুর অসুর সেনাকে মূঠে মূঠে তুলে চিবিয়ে খেতে লাগলেন । অসুরেরা যত অস্ত্র দেবীর পানে নিক্ষেপ করল , দেবীর শরীরে লাগতেই অস্ত্র গুলো ভেঙ্গে যেতে লাগল । দেবী হাজারে হাজারে অসুর সেনাদের ভক্ষণ করতে লাগলেন । রথ , অশ্ব , হাতী গুলোকে ধরে মুখে নিয়ে তা চিবিয়ে খেতে লাগলেন । রক্তে তার দন্ত গুলি লাল হয়ে গেল । কত গুলি অসুরকে দেবী তার চরণ ভারে পিষে বধ করলেন । কোন কোন অসুর দেবীর খড়গের আঘাতে মারা গেল । আবার কিছু অসুর দেবীর দাতে চর্বিত হয়ে মারা গেলো । যুদ্ধক্ষেত্রে এই ভাবে দেবী অসুর দের ধ্বংস করে ফেললেন ।
এ দেখে চণ্ড অসুর হাজার হাজার চক্রাস্ত্র নিক্ষেপ করে দেবীকে আচ্ছন্ন করে ফেললেন । বাণের প্রভাবে সূর্য ঢাকা পড়ল । দেবী তখন তার খড়গ তুলে ‘হং’ শব্দ করে চন্ডের দিকে ধেয়ে গেল । দেবী চন্ডের চুলের মুঠি ধরে এক কোপে চণ্ডের শিরোচ্ছেদ করে ফেললেন । চন্ড অসুর বধ হল ।
চন্ড নিহত হয়েছে দেখে ক্রোধে মুন্ড দেবীর দিকে ধেয়ে গেলো । দেবী তার রক্তাক্ত খড়গ দিয়ে আর এক কোপে মুন্ড এর শিরোচ্ছেদ করলেন । এভাবে মুণ্ড বধ হল । বাদবাকী জিবীত অসুর রা এ দেখে ভয়ে পালালো । দেবতারা আনন্দে দেবীর জয়ধ্বনি করলেন ।
দেবী চন্ড আর মুণ্ড এর ছিন্ন মস্তক নিয়ে দেবী মহামায়ার কাছে এসে বিকট অট্টহাসি হেসে বললেন – “ এই যুদ্ধরূপ যজ্ঞে আমি আপনাকে চন্ড ও মুন্ড নামে দুই মহাপশুর মস্তক উপহার দিলাম । এখন আপনি নিজেই শুম্ভ ও নিশুম্ভ কে বধ করবেন ।”
দেবী অম্বিকা মধুর স্মরে বললেন – “ হে দেবী , যেহেতু তুমি চন্ড ও মুণ্ডের বধ করে মাথা দুটি আমার নিকট নিয়ে এসেছো , সেজন্য আজ থেকে তুমি জগতে ‘চামুন্ডা’ নামে বিখ্যাত হবে ।”
( রক্তবীজ বধ )
ইতিমধ্যে দেবীর ইচ্ছায় মহেশ্বর দূত হয়ে অসুর দের বোঝাতে গেলেন । দেবী শিবশম্ভু কে দূত হিসাবে পাঠালেন বলে দেবীর এক নাম হল শিবদূতী । মহাদেব অসুর দের অনেক বোঝালেন কিন্তু অসুর রা শুনলো না । অসৎ ব্যাক্তি কখনো ধর্ম কথা শোনে না । চন্ড ও মুন্ডের নিধন সংবাদ পেয়ে শুম্ভ ও নিশুম্ভ ভীষণ ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল ।
শুম্ভাসুরের আদেশে ৮৬ জন প্রধান দৈত্য তাদের সেনা সহ , কম্বু বংশ জাত ৮৪ জন দৈত্য তাদের সেনা সহ , কোটিবীর্য নামে অসুর দের ৫০ টি বংশ , ধুম্র বংশের অসুর দের ১০০ বংশ সসৈন্যে যুদ্ধযাত্রা করল । কালক , দৌ্হৃরদ , মৌর্য , কালকেয় অসুর রা যুদ্ধে প্রস্থান করল ।
অসুর দের পদভরে পৃথিবী কাপতে লাগল । ধূলা বালি উড়িয়ে লক্ষ লক্ষ ঘোড়া রথ ছুটে চলল । হস্তীবাহিনীর পদ চাপে মেদিনী দুলতে লাগল । অসুর রা বিবিধ বাজনা , দুন্দভি , শিঙা বাজিয়ে নানা ভাবে গর্জন করে প্রানঘাতক অস্ত্র গুলি নাচাতে নাচাতে চলল । ঘন ঘন রনদামামা , রনভেরী বাজতে লাগল ।
অসুর দের আসতে দেখে দেবী মহামায়া শঙ্খধ্বনি , ঘণ্টাধ্বনি করতে লাগলেন । তার ধ্বনি দিক দিগন্তে ছড়িয়ে পড়ল । দেবীর ধনুষ্টঙ্কার এ চারপাশ কেপে উঠল । পশুরাজ সিংহ ঘন ঘন কেশর ও লেজ দুলিয়ে ভয়ানক গর্জন করতে লাগলেন ।
এসময় ব্রহ্মার থেকে হংসযুক্ত বিমানে জপমালা ও কমুন্ডল নিয়ে দেবী ব্রহ্মাণী আসলেন । মহেশ্বর এর থেকে ষাঁড় এর পীঠে চেপে ত্রিশূল নিয়ে আসলেন । তার পরনে ব্যাঘ্রচর্ম , কপালে অর্ধচন্দ্র , অঙ্গে সর্প । দেবীর নাম মহেশ্বরী । কার্তিক এর থেকে দেবী কৌমারী দেবী প্রকট হয়ে আসলেন , যিনি ময়ূরবাহনা ও হস্তে তির আর ধনুক । শ্রী নারায়নের থেকে প্রকট হয়ে আসলেন বৈষ্ণবী শক্তি , যার হাতে চক্র , শঙ্খ , গদা , পদ্ম , ধনুক-বান , খড়গ । ইনি গরুর পক্ষী বাহনা । বারাহী দেবী আসলেন । নারসিংহী দেবী আসলেন । তারপর ১০০ চক্ষু বিশিষ্টা হস্তী বাহনা ঐন্দ্রী দেবী বজ্র নিয়ে আসলেন । শিবদূতী ও কালিকা দেবী আসলেন ।
রক্তবীজ প্রচুর সৈন্য সামন্ত নিয়ে আসলে দেবী মহামায়া , কালিকা কে বললেন – “ আমার প্রীতির জন্য আপনি সত্বর অসুর দের বিনাশ করুন ।”
দেবী কালিকার থেকে অসংখ্য দেবীগণের সৃষ্টি হল । অসুর রা এসে দেবী কালিকা কে বাণ দ্বারা আছন্ন করলে দেবী ভীষণ তান্ডব শুরু করলেন । তিনি তার তীব্র খড়গ দ্বারা দানব দের শিরোচ্ছেদ করতে লাগলেন , চরণে পিষ্ট করে বধ করতে লাগলেন , কাউকে আবার গিলে খেয়ে ফেললেন । দেবী মহামায়া চক্র শূল , বাণ , খড়গ , গদা , কুঠার দ্বারা অসুর দের ধ্বংস করতে লাগলেন ।
ব্রহ্মাণী দেবী কমুন্ডল এর জল ছিটিয়ে অসুর দের ভস্ম করতে লাগলেন । বৈষ্ণবী দেবী চক্র দিয়ে অসুর দের টুকরো টুকরো করে দিলেন । তাঁর গদার আঘাতে অসুর রা রক্তবমি করতে করতে মারা গেল । রথ , অশ্ব , হস্তী গুলো ধ্বংস হল । কৌমারী দেবীর ভীষন বানবৃষ্টি তে অসুর দের দেহ গুলো টুকরো টুকরো হতে লাগল । ঐন্দ্রী দেবীর বজ্র প্রহারে অসুরেরা ভস্ম হতে লাগল । বারাহী দেবী তার তীক্ষ্ণ দন্তের দ্বারা অসুর দের ছিড়ে ফেলতে লাগলেন । নারসিংহী দেবী তার নখ দ্বারা অসুর দের ছিন্নবিচ্ছিন্ন করলেন । শিবদূতী দেবীর অট্টহাস্যে অসুর রা মূর্ছিত হলে দেবী সেই মূর্ছিত অসুর দের গিলে খেলেন । দেবীর বাহন সিংহ অসুর দের আঁচরে কামরে শেষ করতে লাগলেন ।
রক্তবীজ এ দেখে ক্রুদ্ধ হয়ে আসলেন । । রক্তবীজ ব্রহ্মার কাছে বর পেয়েছিলেন যে তার রক্ত মাটিতে যেখানেই পরবে সেখানেই দ্বিতীয় রক্তবীজ তৈরি হবে । রক্তবীজ প্রথমেই দেবী ঐন্দ্রীর সাথে যুদ্ধ করলেন । ঐন্দ্রী দেবীর ব্জ্রপ্রহারে ক্ষতবিক্ষত হলে তার শরীর থেকে অনেক বিন্দু রক্ত পড়ে আরো রক্তবীজ এর সৃষ্টি হল । এভাবে অনান্য দেবী দের অস্ত্রের আঘাতে রক্তবীজ রক্তাক্ত হলে অনেক রক্তবীজ এর সৃষ্টি হল । দেবতারা এ দেখে খুব ভয় পেলেন ।
দেবী অম্বিকা তখন কালিকাকে বললেন – “ হে চামুন্ডে , তুমি শীঘ্র তোমার বদন বিস্তৃত কর । এবং তোমার ওই বিস্তৃত মুখ দিয়ে আমার শস্ত্রের আঘাতে রক্তবীজের শরীর থেকে যে রক্তবিন্দু ঝরবে তা খেয়ে ফেলবে । সেই সঙ্গে ওই রক্তবিন্দু থেকে জন্মলাভ করা অসুর দের খেতে খেতে তুমি সারা যুদ্ধক্ষেত্র ঘুরে বেড়াও । তাহলেই এই রক্তবীজ দৈত্য ক্রমশঃ রক্তশূন্য হয়ে পড়বে । আর তাতেই তার ক্ষয় বা মৃত্যু হবে । পরন্তু তুমি দৈত্যদের খেয়ে ফেলতে থাকলে আর উগ্র দৈত্যদের জন্ম হবে না । ”
দেবী অম্বিকা এই বলে নিজের শাণিত ত্রিশূল দিয়ে রক্তবীজ কে আঘাত করলেন । দেবী কালিকা রক্তবীজের রক্ত খর্পর ( করোটি ) এ নিয়ে পান করলেন । এই ভাবে অম্বিকার ত্রিশুলে রক্তবীজ ভীষন ভাবে আহত হল । তার এক বিন্দু রক্ত মাটিতে পরল না । দেবী কালিকা তার সমস্ত রক্ত পান করলেন । এভাবে রক্তবীজ এর সমস্ত রক্ত দেবী কালিকা পান করলে রক্তবীজের মৃত্যু হল ।
এর পর দেবী কালিকা সমস্ত যুদ্ধখেত্র ঘুরে বেড়ালেন আর রক্তবীজ এর দেহ থেকে সৃষ্টি হওয়া অনান্য রক্তবীজ দের খড়গ দ্বারা শিরোচ্ছেদ করে তাদের রক্ত পান করতে লাগলেন । রক্তপান করতে করতে দেবী ভয়ানক হয়ে উঠলেন । তাহার জিহ্বা ও দন্ত রক্তবর্ণ হল । এভাবে সমস্ত রক্তবীজ দের নাশ হল । দেবী কালিকার অট্টহাস্যে চারিদিক পরিপূর্ণ হল । দেবীর হাতে অসুর , হস্তী , অশ্ব , রথ ধ্বংস হতে লাগল ।
শেষে এমন হল দেবী কালিকা পলায়মান অসুর দের বধ করে তাদের রক্ত পান করতে লাগলেন । দেবী মহামায়ার ডাকেও তিনি ফিরলেন না । দেবতাগন দেবীকে শান্ত করার জন্য অনেক স্তব স্তুতি করলেও দেবী শান্ত হলেন না । উপায় না দেখে দেবগণ মহাদেবের শরণাপন্ন হলেন । মহাদেব শব রুপ হয়ে দেবী কালিকার যাত্রাপথে শুয়ে থাকলেন । দেবী কালিকা মহাদেব কে দেখতে পেলেন না । তিনি তাঁর ডান চরণ মহাদেবের বুকে রাখলেন । যখন তিনি নীচে তাকিয়ে দেখলেন স্বয়ং স্বামী মহাদেব , তখন তিনি লজ্জায় তার জিহ্বা বের করলেন ।এর পর দেবী কালিকা শান্ত হলেন।
(দেবীর হাতে মহিষাসুরের সেনাদের বধ)
মহিষাসুরের অসুর বাহিনী রথ, পদাতিক , হাতী , অশ্ব বাহিনী নিয়ে যুদ্ধে ধাবমান হল । সেনাপতি চিক্ষুর , চামর রথ , গজ , পদাতিক , অশ্ব চতুরঙ্গ সেনা নিয়ে যুদ্ধে গেলো । ষাট হাজার রথ নিয়ে উদগ্র নামক অসুর এবং এক কোটি রথ নিয়ে মহাহনু নামক অসুর আসলো । বাস্কল নামক অসুর ষাট লক্ষ রথ , অসিলোমা ৫ কোটি রথ নিয়ে আসলো । বিড়ালাক্ষ নামক অসুর ৫০০ রথে পরিবেষ্টিত হয়ে যুদ্ধে আসল ।
অনান্য অসুর রা নানা অস্ত্র নিয়ে যুদ্ধে আসল । মহাযুদ্ধ শুরু হল । অসুরেরা নানা অস্ত্র শস্ত্র বর্ষণ করতে শুরু করল ।
ভগবতী মহামায়া নানা অস্ত্র প্রয়োগ করে অসুর দের অস্ত্র গুলি ধ্বংস করতে লাগলেন । দেবী তার প্রচণ্ড অস্ত্র দ্বারা দানব দের বধ করতে লাগলেন ।
দেবীর বাহন পশুরাজ সিংহ ভয়ানক গর্জন করে রন ক্ষেত্রে প্রবেশ করে অসুরদের ওপর আঘাত হানলো । সিংহ তার নখ দন্ত দিয়ে অসুরদের মেরে রক্ত মাংস খেতে লাগল । অসুর দের কারো মুন্ড কাটা গেলো, কারোর শরীর রক্তাক্ত ও অর্ধেক হয়ে গেলো ।
দেবী চক্র , বাণ , ত্রিশূল , গদা , কুঠার দিয়ে অসুরদের বধ করতে লাগলেন । দেবীর চক্রে অসুর রা খন্ড বিখন্ড হতে লাগল । শূল বিদ্ধ হল । গদার আঘাতে রক্তবমি করতে করতে দানব রা প্রান ত্যাগ করতে লাগলো । দেবীর খড়গে কিছু অসুরদের মাথা কাটা গেল । কারোর হাত কাটা পরল । কারোর দেহ আড়াআড়ি ভাবে অর্ধেক হল । দেবীর বানে অসুরেরা মরতে লাগল । কারোর মুণ্ড উড়ে গেলো । কারোর হাত পা কাটা পড়লো । যুদ্ধ ভূমি রক্তে ভেসে গেলো । সিংহ এর দাত নখ অসুরদের রক্তে লাল হয়ে গেল । দেহের স্তূপ জমে গেলো । দেবী র অস্ত্রে রথ , হস্তী , অশ্ব টুকরো টুকরো হতে লাগলো । এই ভাবে দেবী ভবানী অসুরদের নিধন করতে লাগলেন ।
চিক্ষুর কে দেবী ত্রিশূল দ্বারা বধ করলেন । চামর অসুর যুদ্ধ করতে আসলে দেবীর বাহন সিংহ তাকে কামড় বসিয়ে তার গলা থেকে মুন্ড টা আলাদা করে দিলো । এর পর দেবী উদগ্র ও করাল নামক অসুরকে বধ করলেন । গদার প্রহারে উদ্ধতাসুর কে বধ করলেন । তারপর বাণ এর আঘাতে তাম্র অসুর ও অন্ধক নামক অসুরকে বধ করলেন । ত্রিশুল দিয়ে উগ্রাস্য , উগ্র বীর্য , মহাহনু নামক অসুরকে বধ করলেন । এর পর দুর্ধর ও দুর্মুখ নামক ২ অসুরকে তরবারি দিয়ে বধ করলেন । নিজের সেনা দের ধ্বংস হতে দেখে মহিষাসুর যুদ্ধে আসলেন ।
( মহিষাসুর এর যুদ্ধে আগমন)
মহিষাসুর যুদ্ধে এসে ভীষণ সংগ্রাম আরম্ভ করলেন । দেবী নানা অস্ত্রে মহিষের অস্ত্র গুলিকে ধ্বংস করতে লাগলেন । মহিষাসুর তার শিং দিয়ে পাহার গুলিকে দেবীর দিকে ছুড়তে লাগলেন । তার লেজের আঘাতে সমুদ্র উথলে উঠতে লাগল । দেবী চন্ডীকা তখন পাশ নিক্ষেপ করে মহিষাসুর কে বেঁধে ফেললেন । মহিষাসুর তখন মহিষ রুপ ছেড়ে সিংহ রুপ ধরলেন । দেবী খড়গ দিয়ে সেই সিংহ এর মাথা কাটলেন । তখন মহিষাসুর একটি খড়গ ঢাল ধারী পুরুষ মূর্তি ধারন করলেন । দেবী বান বর্ষণ করে সেই পুরুষ ও তার ঢাল খড়গ কে ছিন্ন বিছিন্ন করলেন । এর পর মহিষাসুর হস্তী রুপ ধরলেন । শুঁড় দিয়ে দেবীর বাহন কে পেঁচিয়ে ধরে টানতে লাগলেন । দেবী খড়গ দিয়ে সেই শুঁড় কেটে ফেললেন । তখন মহিষাসুর পুনরায় মহিষ মূর্তি ধরে দেবীর সাথে যুদ্ধ করতে লাগলেন । দেবী মহামায়া তখন দিব্য সুরা পাত্র থেকে মধু খেতে লাগলেন । মহিষাসুর তখন গর্বে উদ্ধত হয়ে গর্জন করতে লাগলেন ।
দেবী মহামায়া তখন বললেন – “ ওরে মূঢ় , যতক্ষণ আমি মধু পান করি , ততক্ষণ তুই গর্জন কর । আমি তোকে বধ করলে ইন্দ্র প্রভৃতি দেবতা গন এখানেই এখুনি আনন্দধ্বনি করবেন । ”
এর পর দেবী এক লাফ দিয়ে মহিষাসুরের পীঠের ওপর তার গলাটি পায়ের দ্বারা চেপে ধরলেন । তারপর দেবী তার শূল দিয়ে মহিষাসুরের বুক বিদ্ধ করলেন । তার পর মহিষাসুরের মুখ দিয়ে আর একটি মহাসুর বের হতেই দেবী তার খড়গ দিয়ে সেই অসুরের মাথা কেটে ফেললেন । এই ভাবে মহিষাসুর এর বধ হল । দেবতারা আনন্দিত হলেন । অবশিষ্ট অসুর সেনাগন হায় হায় করতে করতে পালিয়ে গেলো ।
ত্রিলোকে মঙ্গল বাদ্য বেজে উঠলো । সকলে আদিশক্তির স্তব করতে লাগলেন । অপ্সরা , গন্ধর্ব , কিন্নর রা নৃত্যগীত করতে লাগলেন । স্বর্গ রাজ্য তে আবার দেবরাজ ইন্দ্র ও দেবতাগন পুনধিষ্ঠিত হলেন । পৃথিবী তে শান্তি নেমে আসলো । ঋষি মুনিরা আনন্দে ধর্মাচরণ করতে লাগলেন ।
(দেবতাগন এর স্তবস্তুতি)
দেবী মহামায়া কে সকল এ স্তব করতে লাগলেন
“ যে দেবী আপন শক্তির প্রভাবে এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে পরিব্যাপ্তা হয়ে আছেন , যিনি সমস্ত দেবতাগনের ঘনীভূতা মূর্তিস্বরূপা , যিনি দেবতা ও মহর্ষিগনের আরাধ্যা , সেই জগতের মাতা অম্বিকা দেবীকে আমরা ভক্তিপূর্বক প্রনাম করছি । তিনি আমাদের সকল রকম মঙ্গল বিধান করুন । বেদে ভগবান বিষ্ণুকে সহস্রবদন । সেই সহস্রবদন বিষ্ণু , ব্রহ্মা , শিব যাঁর অতুলনীয় প্রভাব ও শক্তি বর্ণনা করতে সমর্থ নন , সেই দেবী চন্ডীকা সমগ্র বিশ্ব প্রতিপালনের জন্য এবং আমাদের অমঙ্গলজনক ভয় বিনাশের জন্য ইচ্ছা করুন । যিনি স্বয়ং পুন্যবান ব্যাক্তিদের গৃহে লক্ষ্মীস্বরূপা এবং পাপাচারী লোকেদের গৃহে অলক্ষ্মীস্বরূপা , যিনি শুদ্ধচিত্ত ব্যাক্তিগনের হৃদয় এ সদ্ বুদ্ধি স্বরূপা ও সজ্জনগনের লজ্জারুপা , সেই তোমাকে আমরা ভক্তিভরে প্রনাম করি । হে দেবি , তুমি সমগ্র জগত প্রতিপালন কর । হে দেবী , দেবতা , দৈত্য , প্রমথ ও ব্রহ্মর্ষিগনের মধ্যে আপনার এই অনিবার্য ও অচিন্তনীয় স্বরূপ তোমার অসুর নাশকারী অসীম মহাবীর্য , সংগ্রামে তোমার এই অতি অদ্ভূত আচরণসমূহ আমরা কি প্রকারে বর্ণনা করব? তুমি সম্যক জগতের মূল কারণ । তুমি সত্ত্ব প্রভৃতি ত্রিগুণময়ী হলেও রাগ , দ্বেষ যুক্ত ব্যাক্তিগন তোমাকে জানতে পারে না । এমনকি তুমি বিষ্ণু ও শিব প্রভৃতি দেবতাদের অজ্ঞাত । তুমিই সকলের আশ্রয়স্বরূপা । ব্রহ্মা থেকে কীট পর্যন্ত এই অখিল বিশ্ব তোমার একাংশ মাত্র । কারণ তুমিই ত সকলের আশ্রয় স্বরূপা । তুমিই বিকার রহিতা পরমা আদ্যা প্রকৃতি । হে দেবী , যে মন্ত্রের সম্যক উচ্চারণে সকল দেবতাবৃন্দ তৃপ্তিলাভ করেন সেই স্বাহামন্ত্র তুমিই এবং পিতৃগনের তৃপ্তির স্বধামন্ত্র তো তুমিই । এজন্যই দেবযজ্ঞ ও পিতৃযজ্ঞ অনুষ্ঠানকারী সকল ব্যাক্তিগন স্বাহা ও স্বধা মন্ত্ররূপে উচ্চারন করে থাকেন । হে দেবী , যে পরাবিদ্যা মুক্তির কারণ , যোগশাস্ত্রে বর্ণিত দুঃসাধ্য যম নিয়ম প্রভৃতি মহাব্রত যার সাধন – তুমিই সেই ভগবতী পরমা ব্রহ্মবিদ্যা । সেজন্য যারা জিতেন্দ্রিয় তত্ত্বনিষ্ঠ , সমস্ত দোষবর্জিত , শুদ্ধচিত্ত ও মুমুক্ষু সেই মুনিগন তোমার সাধনা করে থাকেন । হে দেবী । তুমিই শব্দ ব্রহ্মস্বরূপিণী । তুমিই বিশুদ্ধ ঋক ও যজুঃ মন্ত্রসমূহের এবং উদাত্তদি স্বর ও মধুর পদোচ্চারন বিশিষ্ট সামমন্ত্র
সমূহের আশ্রয় । তুমি বেদত্রেয় রুপিনী ও সর্ব ঐশ্বর্যময়ী দেবী ভগবতী । তুমিই জগত সংসার পালনের জন্য কৃষি বাণিজ্য প্রভৃতি বৃত্তি স্বরূপা এবং সারা জগতের পরম দুঃখ বিনাশকারিনী । হে দেবী যাঁর কৃপায় সর্ব শাশ্ত্রের মর্ম অবগত হওয়া যায় – তুমিই সেই মেধারুপিনী সরস্বতী । দুস্তর সংসার সমুদ্রের অদ্বিতীয়া তরণী স্বরূপা দুর্গাও তুমি । তুমিই নারায়নের হৃদয় বিহারিনী লক্ষ্মীদেবী এবং তুমিই মহাদেবের হৃদয় বিলাসিনী দেবী গৌরী । হে দেবী , তোমার ঈষৎ হাস্যময় , নির্মল , পূর্ণচন্দ্রের মত এবং উত্তম স্বর্ণ প্রভাতুল্য বদন মণ্ডল দেখেও মহিষাসুর ক্রোধভরে হটাত প্রহার করল – এ ঘটনা অত্যন্ত আনন্দের । হে দেবী , তোমার কুপিত , ভ্রকুটি ভীষণ নব উদিত পূর্ণচন্দ্রের তুল্য প্রভা সমন্বিত বদন মণ্ডল দেখেও মহিষাসুর সাথে সাথে প্রান ত্যাগ করেনি এ বড়ই আশ্চর্যের বিষয় ! কারন কুপিত যমকে দেখে কেউ কি বাঁচতে পারে ? হে দেবী , তুমি প্রসন্না হও । কারন তুমিই জগতের কল্যাণকারিনী । তুমিই প্রসন্না হলেই জগতের কল্যাণ হয় । আর তুমি যদি তার বিপরীত হও । অর্থাৎ ক্রুদ্ধা হও তাহলে বংশ সমূহ নষ্ট হয় । ”
দেবতারা আরো বললেন
“ দেবী তোমার শূলের দ্বারা আমাদের রক্ষা কর । হে অম্বিকে তোমার খড়গ দ্বারাও আমাদের রক্ষা কর । হে চন্ডীকে , হে ঈশ্বরী , তোমার শূলকে সঞ্চালিত করে আমাদের পূর্বদিকে রক্ষা কর । পশ্চিম ও উত্তর এবং দক্ষিণ দিকেও রক্ষা কর । ত্রিভুবনে তোমার যে সকল সৃষ্টি – স্থিতি কারিনী সৌম্যমূর্তি এবং সংহার কারিনী রুদ্রমূর্তি বিরাজিত তাদের দ্বারা আমাদিগকে ও সমগ্র জগত বাসীকে রক্ষা কর । তোমার করপল্লবে বিরাজমান খড়গ , শূল , গদা প্রভৃতি যে সকল অস্ত্র আছে , সে সকল দ্বারা আমাদের সর্বপ্রকারে রক্ষা কর । ”
এই ভাবে দেবতারা স্তব করে ভক্তিভরে দেবীকে পূজো করলে দেবী সন্তুষ্ট হয়ে তাদের বর দিতে চাইলেন ।
দেবতারা বললেন – “ দেবী ভগবতী , আপনি আমাদের শত্রু মহিষাসুকে বধ করেছেন , এতেই আমাদের জন্য সব করা হয়েছে । বাকী আর কিছুই নেই । তবু যদি কৃপা করে আমাদের বর দিতেই চাও , তবে আমাদের প্রার্থনা – যখনই আমরা তোমাকে বার বার স্মরণ করব , তখনই তুমিই আবির্ভূতা হয়ে আমাদের ঘোর বিপদ গুলি দূর করে দেবে । হে দেবী যে মানুষ এই স্তব দ্বারা তোমার স্তুতি করবে , আমাদের প্রতি প্রসন্না হয়ে তুমি সব সময় তাদের জ্ঞান , সমৃদ্ধি ও ঐশ্বর্য সহ ধন , সম্পদ ও স্ত্রী পুত্রাদি বৃদ্ধি করবে ।”
দেবী মহামায়া “ তাই হোক ” বলে অদৃশ্য হলেন ।
( মহিষাসুর বধ )
পুরাকালে রম্ভ নামক এক অসুর মহাদেবের কাছে ( মতান্তরে অগ্নি দেব ) বর লাভ করে যে সে এমন একটি বলশালী পুত্র লাভ করবে যে দেবতাদের পরাজিত করতে পারবে ।
সেই রম্ভাসুরের পুত্র ছিল মহিষাসুর । সে কঠোর তপস্যা করে ব্রহ্মার কাছে বর লাভ করেন – সে পুরুষের অবধ্য কেবল নারীর হাতেই বধ্য হবে ।
ব্রহ্মার বর পেয়ে সেই অসুর ভয়ানক অত্যাচার আরম্ভ করল । অসুর রা ভগবানকে মানে না । মুনি ঋষি দের আশ্রম ধ্বংস করে । নিজেদের কেই ভগবান মানে । নারী অপহরণ ধর্ষণ করে । ধর্ষণ একটি আসুরিক প্রবৃত্তি । নরকাসুর প্রচুর নারীকে অপহরণ করে বিয়ে করেছিল । রাবন রম্ভা নামক অপ্সরা কে ধর্ষণ করেছিলেন । মহিষাসুর আর তার প্রবল দানব সেনাও তাই করে বেড়াতে লাগলো । পৃথিবী বিজয় হলে তারা স্বর্গ আক্রমণ করে দখল করল । দেবতাদের পরাজিত করে মহিষাসুর ইন্দ্রাসনে বসলেন । অসুর রা অপ্সরা দিগকে বন্দী করলেন । ইন্দ্র দেবের পত্নী শচী দেবী পর মা সুন্দরী । মহিষাসুর হাত থেকে বাচার জন্য তিনিও স্বর্গ ছেড়ে চলে গেলেন ।
লাঞ্ছিত ও পরাজিত দেবগণ প্রজাপ্রতি ব্রহ্মাকে নিয়ে হরি আর হর এর কাছে গেলেন । সেখানে মহিষাসুরের ও তার দানব সেনার অত্যাচারের কথা জানালে ত্রিদেব ভীষন ক্রোধ করলেন । ক্রোধে ত্রিদেবের বদন থেকে জ্যোতি বের হতে লাগলো । অনান্য সকল দেবতাদের শরীর থেকে জ্যোতি বের হয়ে তা পাহার প্রমান জ্যোতি হয়ে মহর্ষি কাত্যায়নের আশ্রমে প্রবেশ করল । সেখানে সেই জ্যোতি এর দিব্য নারী রুপ ধারন করল । মহাদেবের তেজে তার মুখ , ব্রহ্মার তেজে তাঁর পদ যুগল , শ্রী হরির তেজে তাঁর বাহু সমূহ , যমের তেজে কেশ রাশি , চন্দ্রের তেজে স্তন্য যুগল , ইন্দ্রের তেজে শরীরের মধ্য ভাগ , বরুণের তেজে জঙ্ঘা ও উরু দ্বয় , পৃথিবীর তেজে তার নিতম্ব , সূর্যের তেজে চরণের আঙ্গুল , অষ্টবসুর তেজে হাতের আঙ্গুল , কুবেরের তেজে নাসিকা , দক্ষ ও অনান্য প্রজাপতি গনের তেজে দাঁত , অগ্নির তেজে তার ৩ টি চোখ , প্রাতঃ এবং সায়ং এই ২ সন্ধ্যা দেবীর তেজে ২ কর্ণ তৈরি হল । এই ভাবে বিশ্বকর্মা ও অনান্য দেবতাদের তেজে মহামায়ার আবির্ভাব হল ।
দেবী যুদ্ধে যাবেন । তাই তার অস্ত্র দরকার । প্রত্যেক দেবতা ও ত্রিদেব তাদের অস্ত্র থেকে অনুরূপ আরো একটি অস্ত্র তৈরি করে দেবীকে দিলেন । মহাদেব ত্রিশূল , বিষ্ণু চক্র , বরুণ দেব শঙ্খ , অগ্নিদেব শক্তি অস্ত্র , পবন ধনুক ও বাণে পূর্ণ ২ টি তূন , ইন্দ্র বজ্র , ঐরাবত ঘণ্টা , মৃত্যুদেব কালদন্ড , জলদেবতা পাশ , ব্রহ্মা রুদ্রাক্ষ মালা ও কমুন্ডল , সূর্য দেব উজ্জ্বল কিরণ এবং নিমেষ দেবতা কালাভিমানী দেবতা খড়গ ও ঢাল , ক্ষীর সাগর বস্ত্র – দিব্য চূড়া – ২ টি কুণ্ডল – সকল হাতের বলয় – শুভ্র ললাট ভূষন – সকল বাহুতে কেয়ূর – নূপুর – কণ্ঠের ভূষণ – অঙ্গুরি , বিশ্বকর্মা অভেদ বর্ম , সমুদ্র দেবতা পদ্মের মালা ও হাতে পদ্ম , কুবের সুরা পূর্ণ পানপাত্র , নাগরাজ বাসুকী নাগ হার দিলেন । গিরিরাজ হিমালয় দিলেন একটি বলশালী সিংহ । অনান্য দেবতারা নানা অস্ত্র দিলেন ।
দেবী সিংহ পীঠে আরোহণ করে অট্টহাস ও গর্জন করতে লাগলেন । দেবীর গর্জনে সপ্তলোক কম্পিত হতে লাগলো । সিংহ এর গর্জনে চতুর্দিক ছেয়ে গেলো । দেবী অস্ত্রশস্ত্রে সুসজ্জিতা হয়ে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে লাগলেন ।
দেবতারা মহিষাসুরের অত্যাচারের কথা জানালো । দেবী তাদের অভয় দিলেন ।
অপরদিকে মহিষাসুর গুপ্তচর এর মাধ্যমে খবর পেলো যে দেবতারা তাকে বধ করার জন্য এক নারীকে যুদ্ধে পাঠিয়েছে । একথা যেনে অসুরেরা হাস্য করতে লাগল । অসুরেরা দেবীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করল ।
মেধস মুনি এভাবে রাজা সুরথ ও সমাধি বৈশ্য কে দেবীর লীলা শোনালেন । রাজা সুরথ ও সমাধি বৈশ্য দেবীর পূজা করতে মনস্থির করলে মেধস মুনি তাদের দেবীর রূপ সম্পর্কে বললেন । তিনি মহালক্ষী , মহাসরস্বতী ও মহাকালীর রূপ সম্পর্কে বললেন ।
রাজা সুরথ ও সমাধি বৈশ্য নদীতীরে গিয়ে দুর্গাদেবীর মাটির মূর্তি তৈরি করে পুস্প , ধূপ – দীপ , হোম , নৈবেদ্যাদি দিয়ে পূজো করতে লাগলেন । কথিত আছে তাঁরা নিজের দেহের রক্ত দিয়ে দেবীকে পূ
জো করেছিলেন । তার পর তারা তিন বছর দেবীর তপস্যা করেন । দেবী খুশী হয়ে তাঁদের দর্শন দিলেন । তাঁদের মনোবাঞ্ছা পূরন হওয়ার বর দিলেন । রাজা সুরথ এবার সৈন্য সামন্ত জুটিয়ে শত্রু রাজাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করলেন । দেবীর আশীর্বাদে রাজা সুরথ শত্রু দের ধ্বংস করে নিজের হারানো রাজ্য পুনঃ অধিকার করলেন । অপর দিকে সমাধি বৈশ্য মনে মনে ব্রহ্মজ্ঞান প্রাপ্তির ইচ্ছা করেছিলেন । দেবী চন্ডীকার আশীর্বাদে সমাধি বৈশ্য ব্রহ্মজ্ঞান পেলেন । রাজা সুরথ দেবীর কাছে বর পেয়েছিলেন যে – পরজন্মে সুরথ রাজা সূর্যদেবের ঔরসে তাঁর পত্নী সবর্নার গর্ভে জন্ম নিয়ে পৃথিবীতে সাবর্ণি নামে অষ্টম মণু হবেন ।
ক্ষমা প্রার্থনা
চন্ডী পাঠের পর অবশ্যই আমাদের ক্ষমা প্রার্থনা পাঠ করতে হয় । এতে দেবী প্রসন্না হন ।
“ হে দেবী মহেশ্বরী । এই শ্রী শ্রী চন্ডীপাঠ করার সময় ( মন্ত্রে ) আমার যে সকল অক্ষর পরিভ্রষ্ট ও মাত্রাহীন হয়েছে , তোমার কৃপায় সে সকল সম্পূর্ণ হোক ।
হে জগদম্বিকে , এই পাঠে আমি যে বিসর্গ , চন্দ্রবিন্দু বা অক্ষরবিহীন ( মন্ত্রে ) উচ্চারন করেছি , তা তোমার কৃপায় সম্পূর্ণ হোক এবং যেন আমার সঙ্কল্প সদাই সিদ্ধ হয় ।
হে জগদম্বে , সদ্যই তোমার এই স্তব পাঠ করার সময় ভক্তিতে বা অভক্তিতে , তাড়াতাড়ি পরার ফলে , স্পষ্ট বা অস্পষ্ট উচ্চারিত হওয়ায় এবং অনুস্বার , বিসর্গ , পদ , সমাস , বা বর্নাদির যে বিচ্যুতি ঘটেছে – যা মোহরূপে বা অজ্ঞানতার কারণে পাঠ করা হয়েছে বা পাঠ করা হয়নি , হে বরদায়িনী দেবী ভগবতী , তোমার প্রসাদে সে সকলই পূর্ণ হোক । হে দেবী , তুমি আমার প্রতি প্রসন্না হও ।
হে জননী ভগবতী , তুমি আমার প্রতি প্রসন্না হও । হে ভক্তবৎসলে , আমার প্রতি প্রসন্না হও । হে দেবী আমাকে কৃপা কর । হে দেবী দুর্গে , তোমাকে ভক্তিভরে প্রনাম করি ।
হে শঙ্করপ্রিয়ে , তোমার এই মাহাত্ম্য – যার জন্য পাঠ করা হল , তার বাড়ীর ও শরীরের সর্বদা কল্যাণ বা শান্তি হোক ।”
******---********
Continue-13
বিভিন্ন_ধর্মে_"ওম"
"ওম" সকল ধ্বনির সার; ঈশ্বরের সার্বজনীন প্রতীক। বেদে উল্লেখিত ‘ ওম ’ হল তিব্বতীদের পবিত্র ‘ হম ’ , মুসলমানদের ‘ আমিন ’ এবং মিশরীয় , গ্রীক , রােমান , ইহুদি ও খৃষ্টানদের ‘ আমেন্ । হিব্রু ভাষায় উল্লিখিত ‘ আমেন্ ' কথার অর্থ ‘ নিশ্চিত ’ ও ‘ বিশ্বাসী ‘।
*#ওম্ হল পবিত্র আত্মা, অদৃশ্য মহাজাগতিক কম্পন ; ঈশ্বরের সৃষ্টির রূপ। ' ওম ' থেকে সৃষ্ট সর্বব্যাপী ধ্বনি; বাইবেলে লিখিত শব্দ বা কথা : সৃষ্টি - ধ্বনি —প্রতি অনুতে ঐশ্বরিক উপস্থিতির প্রমাণ । ধ্যানাভ্যাসের দ্বারা ‘ ওম ' ধ্বনি শ্রুত হতে পারে । এই সব কথা বললেন আমেন , যিনি বিশ্বাসী এবং সৎ সত্য সাক্ষী , ঈশ্বরের সৃষ্টির সূত্রপাত । ” — রেভেল্যেশান্ ৩ : ১৪ । "
*#প্রথমেই সৃষ্ট হােল ‘ শব্দ ’ এবং শব্দ ছিল ঈশ্বরের সাথে যুক্ত এবং ঈশ্বরই শব্দ " •••• সবকিছু তারই ( শব্দ বা ওম্ ) সৃষ্ট ; সৃষ্টির কোন কিছুই তার ইচ্ছা ব্যতিরেকে হয় না । ” — জন ১ : ১ , ৩ ‘
*#জ্ঞান_গঙ্গায়_অবগাহন
*#শাস্ত্রে আছে , মহামায়া শ্ৰী শ্রী গঙ্গা দশহরার দিন মার্তে আগমন করেছিলেন । দশহরা অর্থে যিনি জীবের দশবিধ পাপ হরণ করেন , তিনিই দশহরা ; অথবা তিনি যেদিন এই মর্ত্যে পতিতােদ্ধারিণীরূপে সাক্ষাৎ জ্ঞানময়ীরূপে অবতীর্ণ হয়েছিলেন , সেই দিনের নামই দশহরা । যাইহোক , তাঁর আবির্ভাবে পাপী তাপী মর্তবাসীর যে দশপ্রকার মহাপাপ বিনষ্ট বা বিধৌত হয় তাও এই প্রসঙ্গে সকলের জেনে রাখা দরকার ।
*#দশবিধ পাপ যথাঃ-
( ১ ) অদত্ত বস্তুর গ্রহণ বা অপহরণ
( ২ ) অবৈধ বা বিনাযজ্ঞে হিংসা , ( ৩ ) পরদার বা পরপুরুষে গমন অর্থাৎ ব্যভিচার এই তিন প্রকার কায়িক মহাপাপ ;
( ১ ) পীড়াদায়ক বাক্য বা পরুষ ব্যবহার ,
( ২ ) মিথ্যা কথন ,
( ৩ ) ক্রুরতাপূর্ণ ও অসংবদ্ধ প্রলাপ বাক্য এবং
( ৪ ) পরনিন্দা এই চারিপ্রকার বাচিক মহাপাপ ।
( ১ ) শাস্ত্রে , গুরুবাক্যে ও সত্যে অবিশ্বাস বা মিথ্যা অভিনিবেশ , ( ২ ) অন্যের কোন বস্তুলাভে ইচ্ছা বা পরদ্রব্যে লােভ এবং
( ৩ ) মনে মনে পরের অনিষ্ট চিন্তা এই তিন প্রকার মানসিক মহাপাপ
*#সব মিলে জীবের এই ১০ প্রকার মহাপাপ ভক্তি যুক্ত অন্তরে গঙ্গাস্নানে দূর হয় । গঙ্গা জ্ঞানময়ী বা জ্ঞান প্রবাহিনী । শ্রীভগবান শঙ্করাচাৰ্য্য " জ্ঞান প্রবাহা- বিমলাদি গঙ্গা ” অর্থাৎ ত্রিভুবন জননী ও ব্যাপিনী জ্ঞানকে গঙ্গা বলে অভিহিত করেছেন । মহাত্মা রামপ্রসাদও এই জ্ঞানকে খড়্গরূপে বর্ণনা করে ধর্ম ও অধর্ম বা , পুণ্য ও পাপরূপ অথবা আসক্তি বা বিরক্তিরূপ অজাদ্বয়কে অর্থাৎ ভােগ বন্ধন দুইটিকে বিনাশ করার ভাব প্রকাশ করেছেন । ভাবই জীবের ধর্ম ও অধর্ম , বিরক্তি ও আসক্তি অথবা প্রবৃত্তি ও নিবৃত্তি বস্তুর আধার । নামরূপাত্মক লৌকিক ও অলৌকিক ভাবময় সাধন ক্রিয়া অবলম্বন দ্বারা জীব অবিদ্যা নাশ ও অজ্ঞানতা হতে চিরমুক্ত হতে পারেন ।
*#সাত্ত্বিক জ্ঞানই প্রকৃত গঙ্গাস্নান পদবাচ্য । তখন সত্ত্বগুণের আর্বিভাবে রজস্তমঃ ভাব নষ্ট হয়ে সমস্ত পাপ হতে সাধক মুক্তিলাভ করেন । এটিই জ্ঞান-গঙ্গায় অবগাহন ।
*#তারা_মায়ের_১০৮_নামঃ
তারা, তারিনী, তন্বী, তরলা, তরুনবল্লভী, তীব্ররুপা, তনুশ্যামা, তুরীয়া, উগ্রতারা, উগ্রশ্রবা, স্থূলপয়োধরা, একজটা, গামিনী, তরুনা, উগ্রা, ঈশ্বরী, জয়া, চন্ডা, নীলা, কৃশ্না, নীলসরস্বতী, ছিন্নভালা, শ্রীভদ্র তারিনী, শাম্ভরী কামিনী, গগনবাসিনী, আরাধ্যা, অট্রহাস্যা, করালাখ্যা, রুধির ভূষিতা, যজ্ঞবিদ, বলবতী, বলবতী, শ্রী দূর্গা, বলা, বলরতা, বলরাম, অর্ধকেশেশ্বরী, রক্তাক্ষী, কেশবেশবিভূষিতা, রক্তপ্রিয়া, কেশা, অনলবাহিনী, বয়স্যা, ইন্দ্রপূজ্যা, শোভিত, দিতি পূজ্যা, মত্তনা, হরিপূজ্যা, নিত্যনতুন, বরদা, চন্ডিকা, দ্বিতীয়া, দক্ষা, নিত্যা, নবীনা, বিজয়া, নায়ত্রী, পদ্মমালা, কামাক্ষ্যা, পর্বত নন্দিনী, পদ্মাক্ষী, দক্ষিনা, বারাহী, দক্ষজা,কুসুম ভূষিতা, মাহাদেব প্রিয়া, কৌমারী, পঞ্চমী, বৈষবী, ইড়া, পিংগলা, সুষুমা, গান্ধারী, কামদাত্রী, মহাগৌরী, সংকটা, শান্তি, বারুনী, সর্বানী, কাত্যায়নী, বৈনায়িকা, শ্রীভীমবদনা, জগতপালনকর্তী, সর্ব যোগ হরা, দশভূজা, ত্রিলোচনা, কাশীশ্বরী, মালা কমন্ডলুধারী, ত্রিশুলধারী, অভয়দায়িনী, জ্ঞানদাত্রী, ডমরুধারিনী, দর্পবিহারিনী, ব্রক্ষানী, আগ্নোয়ী, ঐন্দ্রী, অক্ষয়া, সম্মোহনী, ইন্দিমুখী, মদন-মোহিনী, জাহুবী, কুরগাক্ষী, ভক্তিদাত্রী, দয়াময়ী, ইন্দিরা, পাতালঈশ্বরী, আদ্যা, অচিন্তা, ইচ্ছাময়ীতারা।
১০৮ নাম হল সমাপন
গুরুপদে কর কৃপা
দুঃখ বিমোচন।
Continue-14
অমরত্ব
*#আলেকজান্ডার চেয়েছিলেন অমর হতে। তাই তিনি ভারতে এসেছিলেন অমরত্বের সন্ধানে। অনেক খোঁজাখুঁজির পর এক যোগীর সন্ধান পান তিনি। সম্রাটের আদেশে তাঁর সৈন্যরা সেই যোগীকে গিয়ে বলল, "আমাদের সাথে এক্ষুনি যেতে হবে"। "আমি কোথাও যাই না, সম্রাটের ইচ্ছে হলে এখানে আসতে পারে", যোগী জানায়।
*#এই কথা শুনে সৈন্যরা মূহুর্তে তরবারি বের করে বলে চল নাহলে তোমার মুন্ডু নিয়ে যাব। যোগী নির্বিকার, হাসল, বলে তাহলে তাই কর। সৈন্যরা এরকম আশ্চর্য জিনিস দেখে নি যার মৃত্যুভয় নেই। কিছুক্ষণ অবাক হয়ে থেকে তারা ফিরে গেল এবং সম্রাটকে সমস্ত জানাল।
*#আলেকজান্ডার অগত্যা নিজেই এলেন কারণ অমরত্ব বড় বালাই। যোগীকে জিজ্ঞেস করলেন, "তুমি কি আমায় অমরত্বের সন্ধান দিতে পারো?" যোগী তাকে এক স্বচ্ছ জলের সরোবরের সন্ধান দিলেন এবং সেই জল পান করতে বললেন।
*#আলেকজান্ডার যোগীর নির্দেশিত পথে যাত্রা শুরু করলেন এবং যেমন যেমন বলেছিল যোগী, তেমন তেমন মিলে গেল। তিনি সেই স্বচ্ছ জলের সরোবরের সন্ধান পেলেন।
*#কিন্তু যেইমাত্র তিনি হাতে আঁজলা করে জল নিয়ে পান করতে যাবেন, আওয়াজ এল, "খেয়ো না, খেয়ো না"! অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখলেন একটা কাক, তাকে সতর্ক করছে। কাকটা বলল জানো আমার কি কষ্ট! আমি অমর। আমার মৃত্যু নেই কারণ আমি এই জল পান করেছিলাম কত হাজার বছর আগে। আমার একটুও বেঁচে থাকতে ইচ্ছে করে না। কিন্তু কি করব! আমার সাধ, আহ্লাদ কিছু নেই! এইভাবে বেঁচে থাকা যে কি কষ্ট তা কল্পনাও করতে পারবে না! আমি আত্মহত্যাও করতে পারি না!
*#আলেকজান্ডার কিঞ্চিত থমকে গেলেন। জীবনে এই প্রথম দোর্দন্ডপ্রতাপ সম্রাট ঘাবড়ে গেলেন, হাতের জল গলে পড়ে গেল। কি একটা ভেবে প্রচন্ড ভয় পেলেন। উঠে দাঁড়ালেন এবং ধীরে ধীরে পিছন ফিরে চলে গেলেন।
*#মৃত্যু সুন্দর, খুব সুন্দর। একটা পূর্ণ জীবন কাটিয়ে নির্দিষ্ট সময়ে পৃথিবী ছেড়ে চলে যাওয়াটা যে কত সুন্দর ও বাঞ্ছনীয়, তা যারা সেই সুযোগ দেরীতে পায় তারাই একমাত্র অনুভব করতে পারে। সবথেকে আনন্দের জিনিস হলো আমরা জানি যে আমাদের একদিন মৃত্যু হবে। তাই যতদিন আছি আনন্দ করে বাঁচি, এটাই আশা করা উচিত। জীবন দীর্ঘ নয়, আনন্দের হোক।
*#অমরত্ব লাভ হোক ভাবনায়, কর্মে, অনুভবে, চেতনায় ....শরীরে নয়। যোগীদেরও মৃত্যু হয়। যোগ মানে অমরত্ব নয়, যোগ মানে সংবেদনশীল জীবনযাপন।
*#শ্রীকৃষ্ণের_নিমন্ত্রণ_গ্রহণ
*#একদিন ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে যুধিষ্ঠির এবং দুর্যোধন উভয়েই খাবার জন্য নিমন্ত্রণ করিলেন । কিন্তু তাঁদের ওখানে যেতে যেতে কৃষ্ণ পথে বিদুরের ঘরে চলে গেলেন ।
*#বিদুর তখন বাড়ি ছিলেন না , বিদুর অত্যন্ত গরীব ছিলেন । বিদুর পত্নী কৃষ্ণাগমনে আনন্দে আত্মহারা হয়ে পাদ্যঅর্থ দ্বারা তাঁর পাদ বন্দনা করলেন । কিন্তু ঘরে সামান্য দু চারিটি পাকা কলার ছড়া ছাড়া আর কিছুই ছিল না ।
তিনি কৃষ্ণকে আসনে উপবেশন করিয়ে কলা ছাড়িয়ে ছাড়িয়ে খাওয়াতে লাগলেন , এবং মাঝে মাঝে তাঁর কুশল প্রশ্ন জিজ্ঞেস করতে লাগলেন ।
*#ইতিমধ্যে বিদুর বাড়ি ফিরে দেখলেন , কৃষ্ণ বসে আছেন আর তার স্ত্রী ভাবে বিভোর হয়ে ভগবানকে কলার পরিবর্তে তার খোসা খাওয়াচ্ছেন । ভগবানও খুব তৃপ্তির সাথে মহানন্দে সেই খোসাই খাচ্ছেন আর তাঁর মনে হচ্ছে এরূপ সুস্বাদু বস্তু তিনি আর কখনও খান নাই । পত্নীর এই বোকামি দেখে বিদুর অত্যন্ত দুঃখিত হলেন এবং বললেন , তুমি কি করছ ? কলার পরিবর্তে ভগবানকে খোসা খাওয়াচ্ছ ? বিদুর পত্নী চমকে উঠলেন এবং নিজের দোষের জন্য ক্ষমা চাইলেন । বিদুরও অনুনয় করে বলতে লাগলেন প্রভু খোসা তো অনেক খেলেন এইবার এক আধটা কলা খেয়ে আমাকে কৃতার্থ করুন।
*#তখন ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বললেন, বিদুর আমার পেট তো ভরে গেছে আর খোসার এমন স্বাদ ছিল যে , তার চেয়ে উত্তম খাদ্য দ্রব্য দুর্লভ ।
তোমার স্ত্রী যতক্ষণ ভেদভাব ভুলে গিয়ে আমাকে খাওয়াচ্ছিলেন ততক্ষণ আমি ছিলাম , কিন্তু এখন তো খোসা আর কলার ভেদ এসে গেছে অতএব আর আমি নাই ।
*#অতএব, ভগবানের কাছে কোন ভেদ নাই ।
*#ভগবান_শ্রীকৃষ্ণের_প্রকৃত_প্রনাম_মন্ত্র
*#যুবতী রাধার সাথে যুবক কৃষ্ণের প্রেমের কোনো ঘটনার প্রমান, হিন্দু শাস্ত্রের প্রামান্য কোনো গ্রন্থ, যেমন- চার বেদ, রামায়ণ, মহাভারত, গীতা, ১২টি উপনিষদ, মূল সংস্কৃত ভাগবত, বেদব্যাসের নামে চালানো ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ ছাড়া বেদব্যাস প্রণীত অন্য ১৭টি পুরাণ এবং ৬টি মহাপুরাণের কোথাও নেই; আছে ভারতের তৎকালীন শাসনামলে লেখা বেদব্যাসের নামে চলা ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণে, জয়দেবের ‘গীত গোবিন্দে’, বড়ুচণ্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যে এবং কয়েকজন বৈষ্ণব কবির লেখা বৈষ্ণব পদাবলীতে। এসব থেকে বোঝা যায়, কৃষ্ণের জন্ম প্রায় ৫ হাজার দুইশ বছর আগে হলেও, রাধার সাথে কৃষ্ণের প্রেমের জন্ম আসলে ১২০০ খ্রিষ্টাব্দের পর ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ রচনার মাধ্যমে।
*#শ্রীকৃষ্ণ হলেন হিন্দুধর্মের প্রান পুরুষ, এই কৃষ্ণের চরিত্রকে খারাপ দেখিয়ে, হিন্দুদের ধর্ম বিশ্বাসকে দুর্বল করে দিয়ে, হিন্দুধর্মকে বিলুপ্ত করার পরিকল্পনার অংশ হিসেবে তৎকালীন শাসকরা বেদব্যাসের নাম ব্যবহার করে কোনো হিন্দু পন্ডিতকে দিয়েই রচনা করায় ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ, এই পুরাণে কৃষ্ণ চরিত্রকে সম্পূর্ণ বিকৃতভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে, যা সম্পূর্ণ অনৈতিক পরকীয়া প্রেমে লিপ্ত।
*#যেহেতু ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ বেদব্যাসের নাম দিয়ে প্রকাশ করা হয়েছিলো, সেহেতু বেদব্যাস প্রণীত ২৪টি পুরাণের মধ্যে এই পুরাণ খুব সহজেই মিশে যায় এবং লোকজন এটা বিশ্বাস করা শুরু করে যে, সত্যিই রাধার সাথে কৃষ্ণের প্রেম ছিলো; এর ফলে এই ষড়যন্ত্রকে বুঝতে না পেরে, ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণের বিষয়বস্তু, রাধা কৃষ্ণের প্রেমকে ভিত্তি করে সংস্কৃত ভাষার কবি জয়দেব লিখে ‘গীত গোবিন্দ’, এবং তারপর একই ভুল ক’রে বড়ুচণ্ডীদাস লিখে ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্য’।
*#এরপর আবির্ভাব ঘটে চৈতন্যদেবের এবং তিনি রাধা কৃষ্ণের প্রেমকে সত্য মনে করে নিজেকে রাধা কৃষ্ণের যুগল অবতার হিসেবে তুলে ধরেন এবং তার কয়েকজন অনুসারী কবি, রাধা-কৃষ্ণের প্রেমকে পুঁজি করে রচনা করে বৈষ্ণব পদাবলী; এসবের মাধ্যমে রাধা কৃষ্ণের প্রেমের ৪০০ বছরের এই মিথ্যা কাহিনী হিন্দুদের মাথায় শেকড় গেড়ে বসে, যা কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে হিন্দু সমাজকে; কারণ, রাধা হচ্ছে হিন্দুধর্ম ও সমাজের জন্য একটি স্লো পয়জন ও বর্তমানে ভেকধারী বৈষ্ণবদের ব্যবসার পুঁজি।
*#হিন্দুশাস্ত্রের প্রাচীন কোনো গ্রন্থে রাধার উল্লেখ না থাকলেও, বৈষ্ণবদের মূল ভিত যেহেতু রাধা-কৃষ্ণ, সেহেতু তারা রাধার অস্তিত্বকে শাস্ত্রের মাধ্যমে প্রমান করার জন্য দুটি খেলা খেলে, খেলা দুটি হলো- গীতামাহাত্ম্যে এবং কৃষ্ণ প্রণাম মন্ত্রে রাধাকে ঢোকানো।
*#কৃষ্ণ প্রণাম মন্ত্রে রাধার ফাঁকি আসলে কৃষ্ণ প্রণাম মন্ত্রেই আছে, শুধু একটু গভীর দৃষ্টি দিলেই তা চোখে পড়বে, তাই নিচে গভীর দৃষ্টি দিয়ে পড়ুন মন্ত্রটা:
"হে কৃষ্ণ করুণা সিন্ধু দীনবন্ধু জগৎপথে।
গোপেশ গোপীকা কান্ত রাধা কান্ত নমহস্তুতে ।। ১
ওঁ ব্রহ্মণ্য দেবায় গো ব্রহ্মণ্য হিতায় চ।
জগদ্ধিতায় শ্রীকৃষ্ণায় গোবিন্দায় বাসুদেবায় নমো নমঃ ।।" ২
*#এরপর প্রথম দুই চরণ এবং শেষ দুই চরণের পার্থক্যটা খেয়াল করুন। ভালো করে লক্ষ্য করুন, শেষ দুই চরণ পুরোটাই সংস্কৃত এবং প্রথম দুই চরণ- ‘নমহস্তুতে’ শব্দ ছাড়া পুরোটাই বাংলা। কৃষ্ণ প্রণাম মন্ত্র, কৃষ্ণের লীলা প্রকাশের পর সেই মহাভারতের যুগ থেকেই আছে, তাই সেটা পুরোটা সংস্কৃতে হওয়ায় স্বাভাবিক এবং তাই আছে এবং সেটা হলো-
ওঁ ব্রহ্মণ্য দেবায় গো ব্রহ্মণ্য হিতায় চ।
জগদ্ধিতায় শ্রীকৃষ্ণায় গোবিন্দায় বাসুদেবায় নমো নমঃ ।। ২
কিন্তু এর আগে- হে কৃষ্ণ করুণা সিন্ধু দীনবন্ধু জগৎপথে। গোপেশ গোপীকা কান্ত রাধা কান্ত নমহস্তুতে - এলো কোথা থেকে ? এটাই হলো ভন্ড বৈষ্ণবদের খেলা। তারা রাধার অস্তিত্বকে প্রমান করতে গিয়ে সংস্কৃত কৃষ্ণ প্রণাম মন্ত্রের আগে নিজেদের রচিত মন্ত্র জুড়ে দিয়েছে; কিন্তু অপরাধীরা যেমন অপরাধের সূত্র তাদের অপর্কমের সাথে রেখে যায়, তেমনি তারাও তাদের অপরাধের সূত্র, তাদের রচিত শ্লোকের মধ্যে রেখে দিয়েছে, আর সেটা হলো- মন্ত্রটা সংস্কৃতে না লিখে বাংলায় লিখে।
*#খেয়াল করুন- হে কৃষ্ণ করুণা সিন্ধু দীনবন্ধু জগৎপথে। গোপেশ গোপীকা কান্ত রাধা কান্ত নমহস্তুতে- এর প্রত্যেকটা শব্দ বাংলা এবং এই শ্লোকের- ‘রাধা কান্ত’ শব্দের মাধ্যমে তারা কৃষ্ণকে, রাধার স্বামী বানিয়ে দিয়েছে; কারণ, কান্ত শব্দের অর্থ স্বামী। বৈষ্ণবদের অপরাধের মাত্রাটা খেয়াল করুন, অস্তিত্বহীন রাধাকে তারা শুধু কৃষ্ণের অনৈতিক প্রেমিকা হিসেবেই স্বীকৃতি দেয় নি, রাধাকে কৃষ্ণের স্ত্রীও বানিয়ে দিয়েছে, বাস্তবে যার ভিত্তিই নেই; কারণ, কৃষ্ণের ১০ বছর ২ মাস বয়সের পরবর্তী ১১৫ বছরের জীবনে রাধা বলে কেউ ছিলোই না।
*#বর্তমানে ভারতীয় বাংলা টিভি চ্যানেল 'স্টার জলসায়' বাংলায় ডাবিংকৃত "রাধাকৃষ্ণ" সিরিয়ালের দেখানো হচ্ছে রাধা মহাভারতের যুদ্ধেও আছে। এমনকি শ্রীকৃষ্ণ রাধার পরামর্শ ছাড়া কোন কাজই করছেন না। এমন বিকৃত উপস্থাপনের জন্য ঢালা হয়েছে ১২০ কোটি টাকা। বুঝে নিন, যাদের লাভ, যারা রাধা-কৃষ্ণের প্রেমকে পু্ঁজি করে গত অর্ধশতাব্দী ধরে ব্যবসা করে যাচ্ছে তারাই এই অপকর্মটি করেছে।
*#সুতরাং কৃষ্ণকে প্রণাম করতে হলে প্রচলিত কৃষ্ণ প্রণাম মন্ত্র থেকে প্রথম দুই চরণ বাদ দিয়ে-
ওঁ ব্রহ্মণ্য দেবায় গো ব্রহ্মণ্য হিতায় চ।
জগদ্ধিতায় শ্রীকৃষ্ণায় গোবিন্দায় বাসুদেবায় নমো নমঃ ।। ২
এটা বলতে হবে।
*#এছাড়াও গীতা মাহাত্ম্যের ৬ নং শ্লোকটিকে কৃষ্ণ প্রণাম মন্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা যায়, সেটি হলো-
সারথ্যমর্জুনস্যাদৌ কুর্বন্ গীতামৃতং দদৌ।
লোকত্রয়োপকারায় তস্মৈ কৃষ্ণাত্মনে নমঃ।
এর অর্থ হলো- যিনি অর্জুনের সারথি পদে অধিষ্ঠিত হয়ে জগতের উপকারার্থে গীতা রূপ অমৃত দান করেছেন, সেই পরমাত্মা শ্রীকৃষ্ণকে নমস্কার করি।
আশা করছি, উপরের এই আলোচনার মাধ্যমে- কৃষ্ণ প্রণাম রাধা কিভাবে এলো এবং প্রকৃত কৃষ্ণপ্রণাম মন্ত্র কোনগুলো হওয়া উচিত তা বোঝাতে পেরেছি।
*#হে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হিন্দুরা,
এখন সময় হয়েছে, প্রেমিক শ্রীকৃষ্ণ নয় বরং চক্রধারী শ্রীকৃষ্ণের পূজা করার।
Continue-15
যৌগিক_ব্যাখ্যায়
দুর্গাপূজার_মহাষষ্ঠী
🌷🌷🌷🌷🌷🌷🌷
" প্রপদ্যে শরণং দেবী দুং দুর্গে দুর্গতিহরা ৷ "
(—দেবী উপনিষদ্ )
*#দুর্গা ব্রক্ষ্মময়ী ৷ তিনি প্রথমে আকাশরূপে,তারপর বায়ু,অগ্নি,জল ও ক্ষিতিরূপে আবির্ভূত হন ; ক্রমে স্বেদরূপে,তৃণলতারূপে,অবশেষে বীজরূপে ও বীজ থেকে জীবরূপে দেখা দিলেন ৷এই বিশ্বে আমরা যা কিছু দেখছি,সবই দুর্গার নব নব মূর্তি ৷
*#শাস্ত্রে আছে — 'দুর্গে দুর্গে রক্ষণি স্বাহা' ৷
আমাদের মনোময় দুর্গে যে অনন্তকোটি বৃত্তি আছে,সেসব বৃত্তির মধ্যে যদি কেউ শান্ত হয়ে বৃত্তিরূপিণী দুর্গার দর্শন করতে পারে,তবে নিশ্চয়ই তার সব দুর্গতি দূর হবে ৷ এজন্যে শাস্ত্রে বলেছে —'মহাপ্রতিসরে মাং রক্ষ রক্ষ স্বাহা' ৷অর্থাৎ আমার যে মহাভ্রান্তি,তার নিচে তুমি আছো ৷তাই তোমাকে অনুভব করলে মহামরণ থেকে আমি রক্ষা পাবো ৷
*#দুর্গাপূজার আগে কল্পারম্ভের বিধি আছে ৷কল্প মানে সংকল্প,অঙ্গীকার ৷অর্থাৎ প্রতি জীবের মধ্যে তীব্র ইচ্ছা হবে দুর্গাকে লাভ করে সমস্ত দুর্গতি দূর করার ৷এই অটল সংকল্প না হলে দুর্গাপূজা সম্পন্ন হতে পারে না ৷দুর্গাপূজা তিনটি কল্পে হয়ে থাকে —নবম্যাদি কল্প,প্রতিপদাদি কল্প ও ষষ্ঠ্যাদি কল্প ৷ভারতের পূর্বাঞ্চলে এরই প্রচলন বেশী ৷দুর্গাষষ্ঠীর দিনে এই কল্প হয় ৷
*#এই দিনেই বোধন ৷বোধন অর্থে বোধশক্তির উন্মেষ ৷তার মানে,সমস্ত বোধকে দুর্গাভাবে রূপান্তরিত করাই বোধন ৷শাস্ত্রে আছে —' সায়াহ্নে বোধনং কুর্যাৎ ' ৷সন্ধ্যায় বোধনের কারণ,সম্যক ধ্যানের দ্বারা এই বোধন হতে পারে ৷সকল বোধের মধ্যে শুধু দেবী দুর্গাই বিরাজ করছেন —এরকমভাবে রূপান্তরিত হয়ে থাকাই সন্ধ্যায় বোধনের তাৎপর্য ৷সমস্ত জীবভাব ও মনোবৃত্তি সংলীন হলেই বোধন সম্ভব ৷
*#যে দুর্গাষষ্ঠীতে বোধনের কথা বলা হল,সেটি আসলে শুক্লপক্ষের ষষ্ঠী ৷আমাদের মেরুদণ্ডের মধ্যে যে ছয়টি গ্রন্থিযুক্ত সুষন্মা নাড়ি আছে সেটি শুক্লবর্ণ,পবিত্র ৷ওই ছয়টি গ্রন্থি হল ষট্ চক্র ৷যেমন—মূলাধার,স্বাধিষ্ঠান,মণিপুর,অনাহত,বিশুদ্ধ ও আজ্ঞাচক্র ৷এই ছয়টি চক্রই হচ্ছে যথাক্রমে প্রতিপদ,দ্বিতীয়া,তৃতীয়া,চতুর্থী,পঞ্চমী,ষষ্ঠী ৷ষষ্ঠীতে ষট্ চক্রে যেতে না পারলে দুর্গাবোধন হতে পারে না ৷ষষ্ঠচক্রে অর্থাৎ আজ্ঞাচক্রে ওই দ্বিদলপদ্মেই দুর্গার আবাসভূমি ৷
তথ্য ঋণঃ
পরমহংস হরিহরানন্দ
*#যৌগিক_ব্যাখ্যায় *#দুর্গাপূজার_মহাসপ্তমী
🌷🙏🌷🙏🌷🙏🌷
*#ষষ্ঠীর পরে তিনদিন দুর্গাপূজার বিধি ৷শাক্ত কবির গানেও পাই,কৈলাস থেকে তিন দিনের জন্যে গিরিপুরীতে দুর্গার আগমন ৷পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের ওপরে আজ্ঞাচক্রে যে স্থান,তাকেই গিরিপুরী বলা হয় ৷ শরীরের উত্তর দিকে রয়েছে বলে তা গিরিপুরী ৷তাছাড়া গিরি শব্দের মানে স্তবার্হ,অথবা যে গ্রাস করেছে,ব্যাপ্ত হয়ে আছে ৷ ওই স্থানে গেলে নিচেকার সমস্ত বৃত্তি দমিত হয় ৷আজ্ঞাচক্র থেকে সহস্রার অবধি যে স্থান,তাই গিরিদেশ ৷সেখানেই ভগবতী মহাশক্তি দুর্গা পরিব্যাপ্ত ও ক্রিয়াশীল ৷আর পুর হচ্ছে শরীর ৷পুরী মানে তত্ত্বপূর্ণ ৷শাস্ত্রে আছে —'সর্বাসু পুর্ সু পুরী শয়হ ' ৷অর্থাৎ সমস্ত জীবের দেহরূপ নবদ্বারযুক্ত পুরে যিনি শয়ন করে থাকেন,তিনিই পুরী ৷
*#সপ্তমীতে মহামায়া দুর্গাকে মনোময়ীরূপে পূজা করা হয় ৷অর্থাৎ সমস্ত মনের এবং মনের সকল বৃত্তির নিয়ন্তা দেবী দুর্গা — এই বোধে সপ্তমীতে দুর্গাপূজা হয় ৷এই মনোময়ী দুর্গার স্থান হৃদয়ের মধ্যস্থল থেকে দ্বিদলপদ্ম পর্যন্ত অবস্থিত ৷ইন্দ্রিয়ের চালক হল মন,মনের চালক হল বায়ু ৷ বাতাসের চালক হল আকাশ ৷কানে যখন অনাহত ধ্বনি শ্রুত হয় তখনই বুঝতে হবে মন বিজ্ঞানে রূপান্তরিত হয়ে চিদাকাশে বিরাজ করছে ৷এই প্রাণবায়ু স্থির রাখার অর্থই হল প্রাণময়ী দুর্গাতে স্থিতি লাভ করা ৷শ্বাসবায়ুকে শান্ত করলে সপ্তমীপূজা সম্যকভাবে হয়ে থাকে ৷একেই প্রাণায়াম বলে ৷
*#সপ্তমীর দিন দুর্গাকে নবদুর্গারূপেও পূজা করা হয় ৷সেজন্যে নয়টি গাছের নয়টি শাখা একত্র করে শ্বেত অপরাজিতা লতার দ্বারা বেঁধে দুর্গাবোধে অভিষেক ও স্নান করিয়ে বস্ত্রের দ্বারা আবরিত করে গণেশের দক্ষিণপাশে রাখা হয় ৷একে বলা হয় নবপত্রিকা ৷এই নয়টি পত্রিকা হল কদলী,দাড়িমী,ধান্য,হরিদ্রা,মানক,কচু,বিল্ব, অশোক,জয়ন্তী ৷এই নবপত্রিকার তাৎপর্য হচ্ছে,এই নয়টি গাছ থেকে যে ফল-রস-ঔষধ তৈরি হয় তা-ই জীবের জীবন ৷অর্থাৎ এমনিভাবে দুর্গাই প্রতি জীবে জীবীভূত ৷সেজন্যে এই নয়টি গাছকে একত্রে নবদুর্গা বলে পূজা করা হয় ৷অপরাজিতা লতার তাৎপর্য হচ্ছে অ-পরাজিতা ব্রক্ষ্মবিদ্যা ৷এই অ-পরাজিতা ব্রক্ষ্মবিদ্যার দ্বারা সংবদ্ধ না হলে নবপত্রিকার পূজা অর্থাৎ দুর্গাপূজা হতে পারে না ৷আমাদের মনে নিত্য নতুন যে বৃত্তি ও ভাবধারা পল্লবিত হচ্ছে তাদের নব-নব দুর্গারূপে উপলব্ধি করাই নবদুর্গার পূজা ৷এটাই আত্মজাগরণ ও দুর্গাজাগরণ ৷
*#যৌগিক_ব্যাখ্যায় *#দুর্গাপূজার_মহাষ্টমী
🙏🌺🌹🌺🌹🌺🙏
*#অষ্টমীতে দুর্গাকে পূজা করা হয় বোধময়ীরূপে ৷সেই বুদ্ধি জীবের নিজের শরীর থেকেই দুহিত ও প্রকাশিত হয় বলে দুহিতা বা কন্যারূপে দুর্গাপূজার বিধি ৷ মন্ত্রে আছে —'মম কন্যায়ৈ দুর্গায়ৈ দুর্গায়ৈ স্বাহা '৷ সেই সঙ্গে এও বলা হয় —'যোগিনীকোটিপরিবৃতায়ৈ ভদ্রকাল্যৈ দুর্গায়ৈ স্বাহা '৷তার মানে,মানুষের যে কোটি কোটি বৃত্তি,সে সবই দুর্গা ; গোদোহনের মতো দোহন করেই নিজে জীবের মধ্যে প্রসূত ও প্রকাশিত হচ্ছেন ৷সেজন্যেই কন্যারূপে তাঁর পূজা ৷
*#যে কোটি যোগিনীর কথা বলা হল,তারও নিহিত অর্থ আছে ৷মানুষের মধ্যে অনন্ত কোটি কালের কর্মসংস্কারগুলো কোটি যোগিনীরূপে প্রকাশ পেতে চায় ৷এছাড়া প্রতিদিন আমাদের মধ্যে যে নিত্য নতুন ভাবধারা উদ্রেক হচ্ছে,তারাও কোটি যোগিনী ৷তাদের মধ্যে দুর্গাকে উপলব্ধি করাই চৌষট্টি কোটি যোগিনীর পূজায় সিদ্ধিলাভ করা ৷
*#আমাদের মধ্যে জীবন্ত দুর্গা হল শ্বাস-প্রশ্বাস ৷যার শ্বাস-প্রশ্বাস নেই ,সে মৃত ৷তার পক্ষে দুর্গতিনাশ ও দুর্গাপ্রাপ্তি সম্ভব নয় ৷চব্বিশ ঘন্টাই আমরা শ্বাস-প্রশ্বাস নিচ্ছি ৷আমাদের তিনটি বৃত্তি —সত্ত্ব রজঃ তম ৷যখন নিদ্রিত থাকি,তখন বিশ্ববোধ থাকে না ৷ কাজেই দুর্গাবোধও থাকে না ৷রজোগুণ আট ঘন্টা,সত্ত্বগুণ আট ঘন্টা ৷এসময়ে নিদ্রা নেই ৷ আছে যোগনিদ্রা ৷অর্থাৎ দুর্গার সঙ্গে যুক্ত অবস্থা ৷এটা সাধনসাপেক্ষ এবং অবশ্যই গুরুমুখী বিদ্যা ৷আমরা সাধারণত মিনিটে স্বাভাবিকভাবে ১৮বার শ্বাস-প্রশ্বাস নিই ৷কাজেই ৬০মিনিটে ১০৮০টি শ্বাস-প্রশ্বাস নিয়ে থাকি ৷১৬ঘন্টা কর্মজগতে থাকার সময় নিই ১৭২৮০টি ৷এইভাবে প্রশ্বাস ও প্রাণরূপী দুর্গাকে পঞ্চেন্দ্রিয় মারফত ব্যবহারিক জগতে নিরন্তর অত্যন্ত শ্রদ্ধার সঙ্গে অনুভূতির মধ্যে রাখতে পারলে একুশ বছরে চৌষট্টি কোটি যোগিনীর পূজা হয় ৷যার ফলে আমরা নিত্য নিজেকে দুর্গাবোধে রূপান্তরিত করতে পারি ৷এজন্যেই অষ্টমীতে চৌষট্টি যোগিনীর পূজার বিধি ৷
*#মন ও বুদ্ধি বহিঃপ্রসারিণী শক্তি ৷এই শক্তি বহির্জগৎ ছেড়ে সহসা দুর্গাবোধে রূপান্তরিত হতে চায় না ৷এই অষ্টমীতে মন ও বুদ্ধির সঙ্গে লড়াই হয়ে থাকে ৷অষ্টমীর শেষদিকে বুদ্ধি পরিপক্ক হলে তা জ্ঞানে-বিজ্ঞানে রূপান্তরিত হয় ৷জ্ঞান উপার্জিত হলে 'কেবলং জ্ঞানমূর্তিং''—এইভাব আসে ৷জ্ঞানই আলো,অজ্ঞান অন্ধকার ৷এই জ্ঞানালোক উদিত হলে অষ্টমীপূজার শেষ অর্থাৎ সন্ধিক্ষণ ৷তখনই অজ্ঞানরূপ মনের পশু দুর্গাত্বে রূপান্তরিত হতে থাকে ৷কুসংস্কার দুর্গাসংস্কারে পরিণত হয় ৷কুবৃত্তি বা পশুবৃত্তিগুলি দুর্গাবৃত্তিতে রূপান্তরিত হয় ৷এই মিলন বা সন্ধি।
*#যৌগিক_ব্যাখ্যায়
*#দুর্গাপূজার_মহানবমী
🙏🌺🌺🙏🌺🌺🙏
*#শাস্ত্রে আছে— "নবম্যাং প্রভূতং বলিং কুর্যাৎ" ৷অর্থাৎ নবমীতে প্রভূত বলি দিতে হবে ৷এর প্রকৃত অর্থ হল, যে মানুষ বাস্তবে প্রতি ঈক্ষণে বাহ্যবস্তুতে আকৃষ্ট হচ্ছিল,সে সাধারণ মানুষই থাকল ; কিন্তু তার প্রতি বোধের মধ্যে,প্রতি বৃত্তির মধ্যে,প্রতি ভাবের মধ্যে নবনবরূপে দুর্গাকেই দেখতে পেল ৷চণ্ডীতে আছে—যা দেবী সর্বভূতেষু বৃত্তিরূপেণ সংস্থিতা ৷এরকম ভাব নিয়ে থাকলেই কেবল মুক্তি বা কৈবল্যমুক্তি লাভ হয় ৷ "যতো বৃত্তি ততো দুর্গা" —এই সদা দুর্গাদর্শনই প্রভূত বলি
*#সর্ববৃত্তির মধ্যে দুর্গাদর্শনই যে যথার্থ বলিদান,এই যৌগিক সংকেত আমাদের বাহ্যপূজার মধ্যেও আছে ৷তবে তা আছে প্রতীকরূপে ৷যেমন,ছাগ বলি,মহিষ বলি,ইক্ষু দণ্ড বলি,কদলী বলি,কুষ্মাণ্ড বলি,সুপুরি বলি ৷পূজায় এই সব জিনিস বলির বিধি আছে ৷কিন্তু সেগুলো ছেদন করার বিধি নেই ৷
*#প্রভূত বলির তাৎপর্য হচ্ছে,প্রত্যেক অভিব্যক্তির মধ্যে,কাম-ক্রোধ-লোভ-মোহ ইত্যাদির মধ্যে প্রত্যেক অবস্থায় সর্বস্বরূপে সর্বশক্তি সমন্বিতে বা সর্ববিধ রূপের মধ্যে ভগবতীর উপলব্ধি ও জীবভাব ত্যাগ ৷কূটস্থে দ্বিদল পদ্মের ওপরে যে বিন্দুস্বরূপা মহাশক্তি বিন্দুবাসিনী বসে আছেন,সাধনার দ্বারা সেখানে লক্ষ্য স্থির রেখে দুর্গার প্রকৃত রূপ উপলব্ধি করা যায় ৷এটাই বলবর্ধন বা বলি ৷ তিনি সগুণা স্বরূপা হলেও নির্গুণা নিরূপা ৷
*#বাক্-প্রাণ-মন-রূপ-রস-গন্ধ-লাবণ্যের মধ্যে বিজড়িত থাকলেও তিনি যে অবাঙ্মনসগোচরা ক্রিয়াযোগ সাধনায় তা জানা যাবে ৷এই নবমীতে ষোড়শ উপচারে দুর্গাপূজা হয়ে থাকে ৷অর্থাৎ মানুষের মধ্যেকার জ্ঞান-গুণ-ভাব-অভিব্যক্তি সমস্তই যে দুর্গা,তার আস্বাদন হয় ৷তার নিজের অস্থি-মাংস-মজ্জাও যে দুর্গা—এই বোধে সে রূপান্তরিত হয়ে পড়ে ৷এমন কি তিনি শ্বাস-প্রশ্বাস না নিলে কাম-ক্রোধ-লোভ ইত্যাদিও যে মানুষের মধ্যে প্রকাশিত হতে পারে না—এই বিশ্বাসে সে অটল হয় ৷দুর্গা মনস্কা,দুর্গা বিচিন্তা,দুর্গা বিচেষ্টা,দুর্গা ভাবা— এইভাবে মানুষ উদ্বুদ্ধ হয় ৷
*#এই দিন যজ্ঞানুষ্ঠানের বিধি ৷ 'যজ্ঞ' শব্দের 'য' মানে যে,আর 'জ্ঞ' মানে জানে ৷ যে সেই বাক্-প্রাণ-মন-বুদ্ধিময়ী দুর্গাকে জানে ৷যজ্ঞের অর্থ সম্যক্ উপলব্ধি করলে সাধক বুঝতে পারেন, যে অগ্নি বাইরে প্রজ্জ্বলিত তা বহিরগ্নি নয় ৷তা আত্মা ৷দুর্গারূপা অগ্নি প্রতি জীবের মধ্যে দীপ্যমান ৷অগ্নিস্বরূপিণী তেজোময়ী প্রাণময়ী দুর্গা শরীরের মধ্যেই অধিষ্ঠিত ৷ এবং আমরা বাক্-প্রাণ-মন-বল ও ইন্দ্রিয় দিয়ে যা কিছু করছি তার সবই যে দুর্গাতে আহুতি দেওয়া হচ্ছে—এটা উপলব্ধি করাই হোমের তাৎপর্য ৷
*#যৌগিক_ব্যাখ্যায়
*#দুর্গা_পূজার_মহাদশমী
🌺🌺🌺🌺🌺🌺🌺🌺
প্রথমে ষষ্টী, সে দিন বোধন।বিল্লমূলে সে দিন দেবীকে জাগাতে হয়। বেল ডাল মেরুদন্ডের প্রতীক,তার মূলে,অর্থাৎ মূলাধারে কুলকুন্ডলিনী শক্তিকে প্রথমে জাগাতে হবে। সেখান থেকে শক্তিকে উপরে নিয়ে যেতে হবে।তাই সপ্তমীতে দেবী আসবেন স্বাধিষ্ঠানে। ব্রহ্মগ্রন্থি ভেদ করে শক্তি তার আপন স্থানে অধিষ্ঠিত হন। তাঁর ঔজ্জ্বল্য বেড়ে যাবে আর তিনি চলে আসবেন মণিপুরে। এর পর অষ্টমীতে প্রধান অঞ্চল ছাড়ার সময় রাজসিক প্রসাদ, মাংস ভোগ। বিষ্ণু গ্রন্থি ভেদ করে শক্তি অবস্থান করেন অনাহত পদ্মে। তার পর আসে রজ কে অতিক্রম করার সন্ধি ক্ষন। শক্তি চলে আসেন বিশুধ্যাক্ষে নবমীর দিন। দশমীতে রুদ্র গ্রন্থি ভেদ করেশক্তি চলে আসেন আজ্ঞা চক্রে। সর্বের উপর অর্থাৎ ছয় চক্রের উপর বিজয় প্রতিষ্ঠা হয় সেদিন। তার পরই রূপ থেকে অরূপে চলে আসেন শক্তি।তাকেই বলে নিরঞ্জন। এটাই বিজয়, বিজয় দশমী।
*#চলুন সামগ্রিক ভাবে দুর্গাপূজা কি দেখা যাক।
দুর্গা মাকে জানা বা পাওয়া খুবই কঠিন। তাই তাঁর নাম দুর্গা।
মায়ের দশ হাত। অর্থাৎ দশদিকেই তিনি রয়েছেন, সর্বত্রই তাঁর অস্তিত্ব। পাশে শিব, সাথে লক্ষ্মী-সরস্বতী, কার্তিক-গণেশ। মায়ের কৃপায় সাধক সবকিছু পান। শিব বা ব্রহ্মজ্ঞান যেমন পাওয়া যায়, তেমনি লাভ করা যায় বিদ্যা সম্পদ শৌর্য সিদ্ধি। চণ্ডীতে আছে, সুরথ ও সমাধি একই সাথে তপস্যা করেছিলেন। কিন্তু মায়ের বরে সুরথ ফিরে পেলেন তার রাজ্য, সমাধি লাভ করলেন ব্রহ্মজ্ঞান।
*#অনেকে মায়ের মন্ডবের কলাগাছকে বলেন গণেশের বউ! না। একে নবপত্রিকা বলা হয়। সাত রকম গাছ। পত্রিকা=যার পত্র (পাতা) আছে তাকে বলে পত্রিকা। কলা, কচু, হলুদ, জয়ন্তী, বেল, দাড়িম, অশোক, মান ও ধান। নব দুর্গার অন্য রূপ। এরও পুজো হয়।
*#মন্ডপে মায়ের প্রতিমা মাটির। আর অষ্টমীর দিনে কুমারী পুজো। মাকে পুজো করা হচ্ছে গাছ, মাটি, মানুষ রূপে। মাটি জড়, গাছ যেন জড় ও জীবের মধ্যে (প্রাণ আছে কিন্তু সচল নয়), আর কুমারী হলো মানুষ। অর্থাৎ মাকে তিন রূপে আবাহন করা হয়। বিভিন্ন রূপে তিনিই রয়েছেন সর্বত্র।
*#মাতৃপ্রতিমার সামনে ঘট রাখা হয়। ঐ ঘট হলো ভক্তের প্রতীক। ঘট=শরীর। ঘটের মধ্যে জল = মন । ঘটের মুখে আম পাতা = ইন্দ্রিয়। আর জলের নীচে রাখা সোনা = জীবাত্মা। অর্থাৎ সমবেত ভক্তদের প্রতীক এই ঘট।
*#দেবতাদের সমবেত শক্তির ফলে মায়ের আবির্ভাব। অর্থাৎ ঐক্যই শক্তি। আজ সমাজে ভাল লোকেরা, সৎ মানুষেরা কেন নিজেদের অসহায় মনে করে? কারণ তারা ঐক্যবদ্ধ নয়, যেখানে অসৎ লোকেরা দলবদ্ধ। চণ্ডীর তাৎপর্য এটাই। সংঘে শক্তি কলৌ যুগে = কলিযুগে সংঘবদ্ধ হলেই শক্তি।
*#মায়ের হাতে অস্ত্র কেন? কারণ ভাল লোকদের হাতেই অস্ত্র থাকা দরকার। তারাই সঠিক প্রয়োগ করতে সক্ষম। অসৎ লোকের হাতে অস্ত্র সমাজের পক্ষে ক্ষতিকর।
*#শিবের তেজে সৃষ্টি হলো মায়ের মুখ। শিব সারাক্ষণ ধ্যানস্থ। অর্থাৎ কঠিন পরিস্থিতি এলে শান্ত মনে তার মোকাবিলা করতে হয়, এই শিক্ষাই দেওয়া হচ্ছে এখানে।
*#বিষ্ণুর তেজে মায়ের হাত। বিষ্ণু স্থিতি বা পালনের দেবতা। এর তাৎপর্য, আমাদের কর্মের দ্বারা জগতের বা সমাজের কি কোনো উপকার হচ্ছে, অথবা শুধু নিজের জন্যই কাজ করি? যদি অন্যদের উপকারের জন্য হয় তবে তা দিব্য কর্ম।
*#ব্রহ্মার তেজে মায়ের পা। চলতে হয় পদক্ষেপ নিতে নিতে। ব্রহ্মা সৃষ্টির দেবতা। কিন্তু আমাদের পদক্ষেপ বা কাজ কি সৃজনশীল ? চণ্ডীর উপদেশ, গতানুগতিক কাজের উপরে উঠে সৃষ্টিশীল হও।
*#শিব নিজের ত্রিশূল দিলেন মাকে। ত্রিশূল অর্থাৎ সত্ত্ব, রজ, তম। এই তিনের উপরে উঠতে পারলেই প্রকৃত জ্ঞান লাভ হবে। দন্ডের একমুখে ত্রিশূল, অন্যমুখে এক শূল। জগতের দুই রূপ। একদিকে ত্রিগুণের খেলা, অন্যদিকে অদ্বৈত অনুভব। মহিষাসুর ত্রিগুণে মত্ত ছিল বলে মা তাকে এক শূল দিয়ে মুক্তি দিলেন।
*#বিষ্ণু নিজের চক্র দিলেন মাকে। চক্র অর্থাৎ সংসারের আবর্তন। চক্র সবসময়েই ঘুরছে, পরিস্থিতি বদলাচ্ছে সর্বদা। কিন্তু চক্রের মাঝে যে ছিদ্র, ঐ কেন্দ্রে আঙ্গুল রাখলে স্থির থাকা যায়। অর্থাৎ ঈশ্বরকে ধরে কাজ করো।
*#ব্রহ্মা মালা দিলেন। এই মালা ফুলের নয়, রুদ্রাক্ষের মালা। সাধনার মালা। তাৎপর্য? মানুষের জীবন এক সাধনা। পশু জন্ম থেকেই পশু, পাখী ডিম ফুটে বাইরে বেরিয়েই পাখী। কিন্তু মানুষ জন্মের পর এক জীব মাত্র। তাকে সাধনা করতে হয় মনুষ্যত্ব লাভের জন্য। এই কথারই ইঙ্গিত চণ্ডীতে।
🙏শু
Continue-16
তন্ত্রে_নৈবেদ্য_উপচার_বা_বলি_প্রদান
(১ম পর্ব)
*#তন্ত্রে ইষ্টদেবতার উদ্দেশ্যে নৈবেদ্য বা বলি প্রদান ছাড়া পূজা সম্পাদন অচিন্ত্যনীয়। আগেই বলা হয়েছে, বীরাচারীদের সাথে পশ্বাচারীদের বিশেষ পার্থক্য হলো, বীরাচারে মদ্য-মাংসের ব্যবহার আছে, পশ্বাচারে তা নিষিদ্ধ। কিন্তু উভয় আচারেই পশু-বলির বিধান আছে।
এখানে উল্লেখ্য, বলি মানে উৎসর্গ, ইষ্টদেবতার প্রতি সাধকের প্রিয় বস্তুর উৎসর্গ। শাস্ত্রে বলা হয়, বলি দুই প্রকার– রাজসিক ও সাত্ত্বিক। মাংস-রক্তাদিবিশিষ্ট বলিকে রাজসিক, এবং মুদ্গ, পায়েস, ঘৃত, মধু ও শর্করাযুক্ত রক্ত-মাংসাদি বর্জিত বলিকে সাত্ত্বিক বলি বলা হয়। সমাচারতন্ত্রে বলা হয়েছে–
সাত্ত্বিকোবলিরাখ্যাতো মাংসরক্তাদিবর্জিতঃ।- (সমাচারতন্ত্র)
অর্থাৎ : রক্ত-মাংসাদি বর্জিত বলি সাত্ত্বিক বলি বলিয়া উক্ত হইয়াছে।
*#এক্ষেত্রে বস্তুত পশু বলিদান তন্ত্রোক্ত শক্তি-উপাসনার একটি প্রধান-অঙ্গ। তন্ত্র-ব্যবস্থায় গো ব্যাঘ্র মানুষ্য প্রভৃতি কোন জীবই পশু-বলির অযোগ্য নয়। যেমন কালিকাপুরাণে বলা হয়েছে–
পক্ষিণঃ কচ্ছপা গ্রাহা মৎস্যা নববিধা মৃগাঃ।
মহিষোগোধিকা গাবশ্ছাগোবভ্রশ্চ শূকরঃ।।
খড়্গশ্চ কৃষ্ণসারশ্চ গোধিকা সরভো হরিঃ।
শার্দুলশ্চ নরশ্চৈব স্বগাত্ররুধিরন্তথা।
চণ্ডিকাভৈরবাদীনাং বলয়ঃ পরিকীর্তিতাঃ।
বলিভিঃ সাধ্যতে মুক্তির্বলিভিঃ সাধ্যতে দিবম্ ।।- (কালিকাপুরাণ)
অর্থাৎ : পক্ষী, কচ্ছপ, কুম্ভীর, মৎস্য, নয় প্রকার মৃগ, মহিষ, গোধিকা, গো, ছাগ, নকুল, শূকর, গন্ডার, কৃষ্ণসার, সরভ, সিংহ, ব্যাঘ্র, মনুষ্য, স্বীয় শরীরের রক্ত এই সমুদায় বস্তু চণ্ডিকা-ভৈরবাদির বলি। বলি দ্বারা মুক্তিসাধন হয় এবং বলি দ্বারা স্বর্গ-সাধন হয়।
*#বিভিন্ন তন্ত্রাদি পুরাণ ও অন্যান্য অনেক গ্রন্থে দেবাদির উদ্দেশ্যে প্রাণিবধের সবিশেষ ব্যবস্থা রয়েছে বটে, কিন্তু কোন কোন শাস্ত্রে এটি আবার নরক-সাধন বলেও উক্ত হয়েছে। যেমন পদ্মপুরাণে দেখা যায়–
মদর্থে শিব কুর্বন্তি তামসা জীবঘাতনম্ ।
আকল্পকোটি নিরয়ে তেষাং বাসো ন সংশয়ঃ।।- (পদ্মপুরাণ)
অর্থাৎ : পার্বতী কহিলেন, শিব! যে সমস্ত তামস-গুণাবলম্বী ব্যক্তি আমার নিমিত্তে জীব হত্যা করে, কোটিকল্প পর্যন্ত তাহাদের নরকবাস হয় তাহার সংশয় নাই।
এবং পদ্মপুরাণে আরো দেখতে পাই, বলা হয়েছে–
উপদেষ্ট বধে হন্তা কর্তা ধর্তা চ বিক্রয়ী।
উৎসর্গকর্তা জীবানাং সর্বেষাং নরকং ভবেৎ।।- (পদ্মপুরাণ)
অর্থাৎ : পশু-বলির উপদেষ্টা, হন্তা, কর্তা ও ধারণ-কর্তা এবং পশু বিক্রেতা ও উৎসর্গ কর্তা এই সকলেরই নরক-বাস হয়।
*#এ প্রেক্ষিতে কালিকা দেবীর উদ্দেশ্যে প্রয়োজনীয় নৈবেদ্য বা বলির উপচার প্রসঙ্গে কুমারীতন্ত্রের চতুর্থ পটলে (কুমারীতন্ত্র-৪/১-১০) বর্ণিত শ্লোকসমূহ উদ্ধৃত করা যেতে পারে–
শ্রীদেব্যুবাচ–
দেবদেব মহাদেব সর্ব্বজ্ঞ পরমেশ্বর।
কালিকায়াঃ প্রীতিকরানুপচারান্ বদস্ব মে।। ৪/১
শ্রীভৈরব উবাচ–
প্রথমে তু সুরা পূজ্যা গৌড়ী মাধ্বী তথৈব চ।
পৈষ্ঠী দেব্যৈ তদভাবে অনুকল্পং ভবেৎ প্রিয়ে।। ৪/২
নারিকেলোদকং কাংস্যে তাম্রপাত্রে স্থিতং মধু।
গব্যঞ্চ তাম্রপাত্রস্থং সুরাতুল্যং ঘৃতং বিনা।। ৪/৩
অন্যানি চ নৈবেদ্যানি সাধকানাং শৃণু প্রিয়ে।
তাম্বুলঞ্চ সকর্পূরং নারিকেলং সর্শকরম্ ।। ৪/৪
পায়সং সঘৃতঞ্চৈব আর্দ্রকং সগুড়ং তথা।
সতণ্ডুলং তিলঞ্চৈব দধি চৈব সসৈন্ধবম্ ।। ৪/৫
জম্বীরং পনসঞ্চৈব আম্রং আম্রাতকং তথা।
কদলীং তিন্তিড়ীঞ্চৈব শ্রীফলং ফলমুত্তমম্ ।। ৪/৬
করঞ্জ-বকুলং চৈব তাল-খর্জ্জুরমেব চ।
অন্যানি চ সুগন্ধানি স্বাদুনি সুফলানি চ।। ৪/৭
নরঃ শ্লাঘ্যতমো মেষো মহিষঃ শশকস্তথা।
শল্বকঃ শূকরশ্চৈব বলয়ঃ পরিকীর্ত্তিতঃ।। ৪/৮
কৃষ্ণসারাদয়োহপ্যন্যে দাতব্যা মন্ত্রবিত্তমৈঃ।
এতেষাঞ্চৈব রক্তানি দেয়ানি পরমেশ্বরি।। ৪/৯
জলং সুবাসিতং দেয়ং কুলক্ষালনমেব চ।
প্রধানানি নৈবেদ্যানি কথিতানি ময়ানঘে।
যস্মিন সন্তুষ্যতে কালী কিমন্যৎ শ্রোতুমিচ্ছসি।। ৪/১০
অর্থাৎ :
পার্বতী কহিলেন– হে দেবদেব মহাদেব! আপনি সর্বজ্ঞ ও পরমেশ্বর। কালিকাদেবীর প্রীতিকর পূজোপচারসমূহ আপনি আমার নিকট বর্ণনা করুন। ৪/১।।
*#চলবে.....
***#তন্ত্রে_নৈবেদ্য_উপাচার_বা_বলি_প্রদান
(২য় ও শেষ পর্ব)
*#ভৈরব কহিলেন– হে প্রিয়ে! প্রথমে সুরার অর্চনা করিবে। দেবীকে গৌড়ী (গৌড়দেশ জাত), মাধ্বী (মধু হইতে উৎপন্ন) এবং পৈষ্টী (পিষ্টদ্রব্য হইতে প্রস্তুত; ধেনোমদ) সুরা দ্বারা অর্চনা করিবে। এই সকল সুরার অভাবে অনুকল্প দ্রব্য পান করিব। (পাঠান্তর বিধানানুসারে এই সকল সুরার অভাবে প্রচলিত দেশজাত সুরা দ্বারা দেবীর অর্চনা করিবে)। ৪/২।। কাংস্যপাত্রস্থিত নারিকেল-জল, তাম্রপাত্রস্থিত মধু, তাম্রপাত্রস্থিত গো-দুগ্ধ, ঘৃতসংযুক্ত না হইলে সুরাতুল্য গণ্য হয়। ৪/৩।।
হে প্রিয়ে! সাধকানুকুল অন্যান্য নৈবেদ্য বিবরণ শ্রবণ কর। কর্পূরসংযুক্ত তাম্বুল, শর্করাসংযুক্ত নারিকেল, ঘৃতসংযুক্ত পায়স, আর্দ্রকসংযুক্ত গুড়, তন্ডুলসংযুক্ত তিল, সৈন্ধবসংযুক্ত দধি, জম্বীর, কাঁঠাল, আম্র, আম্রাতক (আমড়া), কদলী, তিন্তিড়ী, শ্রীফল, করঞ্জ, বকুল, তাল, খর্জ্জুর এবং এবং অন্যান্য সমস্ত প্রকার স্বাদু ও সুগন্ধযুক্ত ফলই দেবী নৈবেদ্যার্থে প্রদান করিবে। ৪/৪-৭।। (পাঠান্তরানুসারে– নর, ছাগ,) মেষ, মহিষ, শশক, শজারু, শূকর, বলয়, কৃষ্ণসার মৃগ প্রভৃতি পশু মন্ত্রসাধক বলিরূপে প্রদান করিবে। হে পরমেশ্বরি! এই সকল পশুর রক্তও নৈবেদ্যরূপে প্রদান করিবে। ৪/৮-৯।।
সুবাসিত জল এবং কুলাগার প্রক্ষালিত জলও নৈবেদ্যরূপে প্রদান করিবে। হে অনঘে! প্রধান নৈবেদ্য দ্রব্যসমূহ তোমার নিকট বর্ণনা করিলাম। এই সকল নৈবেদ্য দ্বারা কালিকা দেবী পরিতৃপ্ত হন। ৪/১০।।
*#এক্ষেত্রে আবার অন্তর্যাগ-সাধনে প্রবৃত্ত যে সমস্ত বীরাচারী ব্যক্তি মদ্য-মাংসাদি দ্বারা ভগবতীর অর্চনা করে, কুলতন্ত্রের মতে তারাই তাঁর প্রিয় সাধক। তাই কুলার্ণবতন্ত্রে বলা হচ্ছে–
তথান্তর্যাগনিষ্ঠা যে তে প্রিয়া দেবি নাপরে।
সমর্পয়ন্তি যে ভক্ত্যা করাভ্যং পিশিতাসবম্ ।। (কুলার্ণবতন্ত্র)
অর্থাৎ : সেইরূপ, যে সকল অন্তর্যাগ-নিষ্ট ব্যক্তি ভক্তি পূর্বক স্বহস্তে মদ্য-মাংস অর্পণ করেন, তাঁহারাই প্রিয়; দেবি! তদ্ভিন্ন কেহ প্রিয় নয়। (সূত্র: অক্ষয় কুমার দত্ত / ভারতবর্ষীয় উপাসক সম্প্রদায়)
*#এই বলি কেবল শাক্ত-উপাসকের জন্যই প্রযোজ্য নয়, অন্য সকল উপাসক-গোষ্ঠীর ক্ষেত্রেই তা প্রযোজ্য বলে কৌলতন্ত্র এই ব্যবস্থা দিয়েছে। আমরা কুলার্ণবতন্ত্রে দেখতে পাই, বলা হচ্ছে–
শৈবে চ বৈষ্ণবে শাক্তে সৌরে চ গতদর্শনে।
বৌদ্ধে পাশুপতে সাংখ্যে ব্রতে কলামুখে তথা।।
সদক্ষবামসিদ্ধান্তবৈদিকাদিষূ পার্বতি।
বিনালিপিশিতাভ্যাঞ্চ পূজনং বিফলং ভবেৎ।। (কুলার্ণবতন্ত্র)
অর্থাৎ : শৈব, বৈষ্ণব, শাক্ত, সৌর, বৌদ্ধ, পাশুপত, সাংখ্য, কলামুখ ব্রত, দক্ষিণাচার, দার্শনিক, বামাচার, সিদ্ধান্তাচার এবং বেদাচারাদি সমুদায় মতে মদ্য-মাংস ব্যতিরেকে পূজা করিলে সে পূজা নিষ্ফল হয়।
*#তবে আশ্বস্তের কথা হলো, আন্তর্যাগের প্রকৃত রূপ সম্বন্ধে এই তন্ত্রেই আবার এমন উক্তি রয়েছে, যা থেকে পূর্বোক্ত ব্যবস্থাটিকে রূপক হিসেবে ব্যাখ্যা দিয়ে নির্দোষ প্রতিপন্ন করে। যেমন, এই মদ্য-মাংস সম্পর্কেই কুলার্ণবে আবার বলা হয়েছে–
সুরা শক্তিঃ শিবোমাংসং তদ্ভক্তোভৈরবঃ স্বয়ম্ ।
তয়োরৈক্যাত্ সমুৎপন্ন আনন্দোমোক্ষ এব চ।। (কুলার্ণবতন্ত্র)
অর্থাৎ : সুরা শক্তি-স্বরূপ, মাংস শিব-স্বরূপ এবং ঐ শিব-শক্তির ভক্ত লোক স্বয়ং ভৈরব-স্বরূপ। এই তিনের একত্র সংযোগ হইলে আনন্দরূপ মোক্ষের উৎপত্তি হয়।
*#শাস্ত্রের তত্ত্বকথা সত্যিই সূক্ষ্ম ও জটিল বটে। এ-প্রসঙ্গে মহাশয় অক্ষয় কুমার দত্তের উক্তিটি প্রণিধানযোগ্য বলে মনে হয়–
‘মনুষ্যের মনের ভাব সর্বত্রই সমান। এই বিধি অনুসারে শাক্তেরা যেরূপ মাংসকে শিব এবং মদ্যকে শক্তি মনে করিয়া ভোজ পান করেন সেইরূপ রোমান কেথোলিক নামক খ্রীষ্টীয় সম্প্রদায়ীরা পিষ্টককে খ্রীষ্টীয় মাংস এবং মদ্যকে তাঁহার রক্ত বোধ করিয়া গ্রহণ করিয়া থাকেন।’
সমাপ্ত।
*#আজ_মহালয়া ।
আজকের এই দিনে দেবীপক্ষের সূচনার মধ্য দিয়ে জগতের সকল অসুর ও আসুরীক শক্তি নিধনের জন্য সর্বশক্তির অধিকারী জগৎজননী মহামায়া শ্রী শ্রী দূর্গা মায়ের আহবানের মধ্য দিয়ে মাকে জাগ্রত করা হয় । মা দূর্গা এই পৃথিবী জগতে মহালয়ার দিনে ১০ দিনের জন্য এসে, জগতের সকল অশুভ শক্তি ধংস করে, জগৎকে তাঁর মায়াই আবদ্ধ করে আবার দশমিতে চলে যায় । তাই জাগ্রতিক কল্যানের জন্য আসুন আমরা সবাই শ্রী শ্রী মহামায়া দূর্গার আহবান করি এবং তাকে পূনরায় জাগ্রত করি ।
*#আশ্বিনের শারদ প্রাতে বেজে উঠেছে আলোকমঞ্জিত ধরনীর বহিরাকাশে অন্তরিত মেঘমালা, প্রকৃতির অন্তরাকাশে জাগরিত । জ্যোতির্ময়ী জগন্মাতার আগমন বার্তা, আনন্দময়ী মহামায়ার পদধ্বনি, অসীম ছন্দে বেজেউঠে, রূপলোক ও রসলোকে আনে নবভাবনা ধূলির সঞ্জীবন, তাই আনন্দিতা শ্যামলী মাতৃকার চিন্ময়ীকে মৃন্ময়ীতে আবাহন । সাথে সাথে শেষ হবে পিতৃপক্ষ ও সূচনা হবে দেবীপক্ষের ।
*#পিতৃপক্ষ পূর্বপূরুষের তর্পণাদির জন্য প্রশস্ত এক বিশেষ পক্ষ। এই পক্ষ পিত্রৃপক্ষ, ষোলা শ্রাদ্ধ, কানাগাত, জিতিয়া, মহালয়া পক্ষ ও অপরপক্ষ নামেও পরিচিত। হিন্দু বিশ্বাস অনুযায়ী, যেহেতু পিতৃপক্ষে প্রেতকর্ম (শ্রাদ্ধ), তর্পণ ইত্যাদি মৃত্যু-সংক্রান্ত আচার-অনুষ্ঠান পালিত হয়, সেই হেতু এই পক্ষ শুভকার্যের জন্য প্রশস্ত নয়। দক্ষিণ ও পশ্চিম ভারতে গণেশ উৎসবের পরবর্তী পূর্ণিমা (ভাদ্রপূর্ণিমা) তিথিতে এই পক্ষ সূচিত হয় এবং সমাপ্ত হয় সর্বপিতৃ অমাবস্যা, মহালয়া অমাবস্যা বা মহালয়া দিবসে। উত্তর ভারত ও নেপালে ভাদ্রের পরিবর্তে আশ্বিন মাসের কৃষ্ণপক্ষকে পিতৃপক্ষ বলা হয়। পুরাণ অনুযায়ী, জীবিত ব্যক্তির পূর্বের তিন পুরুষ পর্যন্ত পিতৃলোকে বাস করেন। এই লোক স্বর্গ ও মর্ত্যের মাঝামাঝি স্থানে অবস্থিত। পিতৃলোকের শাসক মৃত্যুদেবতা যম। তিনিই সদ্যমৃত ব্যক্তির আত্মাকে মর্ত্য থেকে পিতৃলোকে নিয়ে যান। পরবর্তী প্রজন্মের একজনের মৃত্যু হলে পূর্ববর্তী প্রজন্মের একজন পিতৃলোক ছেড়ে স্বর্গে গমন করেন এবং পরমাত্মায় (ঈশ্বর) লীন হন এবং এই প্রক্রিয়ায় তিনি শ্রাদ্ধানুষ্ঠানের উর্ধ্বে উঠে যান। এই কারণে, কেবলমাত্র জীবিত ব্যক্তির পূর্ববর্তী তিন প্রজন্মেরই শ্রাদ্ধানুষ্ঠান হয়ে থাকে; এবং এই শ্রাদ্ধানুষ্ঠানে যম একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। সূর্য কন্যারাশিতে প্রবেশ করলে পিতৃপক্ষ সূচিত হয়। লোকবিশ্বাস অনুযায়ী, এই সময় পূর্বপুরুষগণ পিতৃলোক পরিত্যাগ করে তাঁদের উত্তরপুরুষদের গৃহে অবস্থান করেন। এর পর সূর্য বৃশ্চিক রাশিতে প্রবেশ করলে, তাঁরা পুনরায় পিতৃলোকে ফিরে যান। পিতৃগণের অবস্থানের প্রথম পক্ষে হিন্দুদের পিতৃপুরুষগণের উদ্দেশ্যে তর্পণাদি করতে হয়।
*#মহাভারত অনুযায়ী, প্রসিদ্ধ দাতা কর্ণের মৃত্যু হলে তাঁর আত্মা স্বর্গে গমন করলে, তাঁকে স্বর্ণ ও রত্ন খাদ্য হিসেবে প্রদান করা হয়। কর্ণ ইন্দ্রকে এর কারণ জিজ্ঞাসা করলে ইন্দ্র বলেন, কর্ণ সারা জীবন স্বর্ণই দান করেছেন, তিনি পিতৃগণের উদ্দেশ্যে কোনোদিন খাদ্য প্রদান করেননি। তাই স্বর্গে তাঁকে স্বর্ণই খাদ্য হিসেবে প্রদান করা হয়েছে। কর্ণ বলেন, তিনি যেহেতু তাঁর পিতৃগণের সম্পর্কে অবহিতছিলেন না, তাই তিনি ইচ্ছাকৃতভাবে পিতৃগণকে স্বর্ণ প্রদান করেননি। এই কারণে কর্ণকে ষোলো দিনের জন্য মর্ত্যে গিয়ে পিতৃলোকের উদ্দেশ্যে অন্ন ও জল প্রদান করার অনুমতি দেওয়া হয়। এই পক্ষই পিতৃপক্ষ নামে পরিচিত হয়।
এই কাহিনির কোনো কোনো পাঠান্তরে, ইন্দ্রের বদলে যমকে দেখা যায়। মহালয়া পক্ষের পনেরোটি তিথির নাম হল প্রতিপদ, দ্বিতীয়া, তৃতীয়া, চতুর্থী, পঞ্চমী, ষষ্ঠী, সপ্তমী, অষ্টমী, নবমী, দশমী, একাদশী, দ্বাদশী, ত্রয়োদশী, চতুর্দশী ও অমাবস্যা।
*#যে ব্যক্তি তর্পণে ইচ্ছুক হন, তাঁকে তাঁর পিতার মৃত্যুর তিথিতে তর্পণ করতে হয়। পিতৃপক্ষে পুত্র কর্তৃক শ্রাদ্ধানুষ্ঠান হিন্দুধর্মে অবশ্য করণীয় একটি অনুষ্ঠান। এই অনুষ্ঠানের ফলেই মৃতের আত্মা স্বর্গে প্রবেশাধিকার পান। এই প্রসঙ্গে গরুড় পুরাণ গ্রন্থে বলা হয়েছে, “পুত্র বিনা মুক্তি নাই।” ধর্মগ্রন্থে গৃহস্থদের দেব, ভূত ও অতিথিদের সঙ্গে পিতৃতর্পণের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। মার্কণ্ডেয় পুরাণ গ্রন্থে বলা হয়েছে, পিতৃগণ শ্রাদ্ধে তুষ্ট হলে স্বাস্থ্য, ধন, জ্ঞান ও দীর্ঘায়ু এবং পরিশেষে উত্তরপুরুষকে স্বর্গ ও মোক্ষ প্রদান করেন। বাৎসরিক শ্রাদ্ধানুষ্ঠানে যাঁরা অপারগ, তাঁরা সর্বপিতৃ অমাবস্যা পালন করে পিতৃদায় থেকে মুক্ত হতে পারেন। শর্মার মতে, শ্রাদ্ধ বংশের প্রধান
ধর্মানুষ্ঠান। এই অনুষ্ঠানে পূর্ববর্তী তিন পুরুষের উদ্দেশ্যে পিণ্ড ও জল প্রদান করা হয়, তাঁদের নাম উচ্চারণ করা হয় এবং গোত্রের পিতাকে স্মরণ করা হয়। এই কারণে একজন ব্যক্তির পক্ষে বংশের ছয় প্রজন্মের নাম স্মরণ রাখা সম্ভব হয় এবং এর ফলে বংশের বন্ধন দৃঢ় হয়। ড্রেক্সেল বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরাতাত্ত্বিক উষা মেননের মতেও, পিতৃপক্ষ বংশের বিভিন্ন প্রজন্মের মধ্যে সম্পর্ ককে সুদৃঢ় করে। এই পক্ষে বংশের বর্তমান প্রজন্ম পূর্বপুরুষের নাম স্মরণ করে তাঁদের শ্রদ্ধা নিবেদন করে। পিতৃপুরুষের ঋণ হিন্দুধর্মে পিতৃমাতৃঋণ অথবা গুরুঋণের সমান গুরুত্বপূর্ণ। জীবিত ব্যক্তির পিতা বা পিতামহ যে তিথিতে মারা যান, পিতৃপক্ষের সেই তিথিতে তাঁর শ্রাদ্ধানুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়। তবে এই নিয়মের কিছু ব্যতিক্রমও রয়েছে। পূর্ববর্তী বছরে মৃত ব্যক্তির শ্রাদ্ধ হয় চতুর্থী (চৌথা ভরণী) বা পঞ্চমী (ভরণী পঞ্চমী) তিথিতে। সধবা নারীর মৃত্যু হলে, তাঁর শ্রাদ্ধ হয় নবমী (অবিধবা নবমী) তিথিতে। বিপত্নীক ব্যক্তি ব্রাহ্মণী নারীদের শ্রাদ্ধে নিমন্ত্রণ করেন। শিশু বা সন্ন্যাসীর শ্রাদ্ধ হয় চতুর্দশী (ঘট চতুর্দশী) তিথিতে। অস্ত্রাঘাতে বা অপঘাতে মৃত ব্যক্তিদেরও শ্রাদ্ধ হয় এই তিথিতেই (ঘায়েল চতুর্দশী)।
সর্বপিতৃ অমাবস্যা দিবসে তিথির নিয়মের বাইরে সকল পূর্বপুরুষেরই শ্রাদ্ধ করা হয়।
*#মহালয়ার দিন অতি প্রত্যুষে চণ্ডীপাঠ করার রীতি রয়েছে। আশ্বিন শুক্লা প্রতিপদ তিথিতে দৌহিত্র মাতামহের তর্পণ করেন। মহালয়ার দিন পিতৃপুরুষের শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠিত হয় দ্বিপ্রহরে নদী বা হ্রদের তীরে বা শ্রাদ্ধকর্তার গৃহে। অনেক পরিবার বারাণসী বা গয়ায় গিয়ে শ্রাদ্ধানুষ্ঠান করেন । মৃত ব্যক্তির পুত্র (বহুপুত্রক হলে জ্যেষ্ঠ পুত্র) বা পিতৃকুলের কোনো পুরুষ আত্মীয়ই শ্রাদ্ধানুষ্ঠানের অধিকারী এবং শ্রাদ্ধ কেবলমাত্র পূর্ববর্তী তিন পুরুষেরই হয়ে থাকে। মাতার কুলে পুরুষ সদস্য না থাকলে সর্বপিতৃ অমাবস্যায় দৌহিত্র মাতামহের শ্রাদ্ধ করতে পারেন। কোনো কোনো বর্ণে কেবলমাত্র পূর্ববর্তী এক পুরুষেরই শ্রাদ্ধ করা হয়। পূর্বপুরুষকে যে খাদ্য উৎসর্গ করা হয়, তা সাধারণত রান্না করে রুপো বা তামার পাত্রে কলাপাতার উপর দেওয়া হয়। এই খাদ্যগুলি হল ক্ষীর, লপসি, ভাত, ডাল, গুড় ও কুমড়ো।
*#মহালয়া মন্ত্র
যা চণ্ডী মধুকৈটভাদিদৈত্যদলনী যা মাহিষোন্মূলিনী
যা ধূম্রেক্ষণচণ্ডমুণ্ডমথনী যা রক্তবীজাশনী ।
শক্তিঃ শুম্ভনিশুম্ভদৈত্যদলনী যা সিদ্ধিদাত্রী পরা
সা দেবী নবকোটীমূর্তিসহিতা মাং পাতু বিশ্বেশ্বরী ।।
*#আশ্বিনের শারদপ্রাতে বেজে উঠেছে আলোক মঞ্জীর; ধরণীর বহিরাকাশে অন্তরিত মেঘমালা; প্রকৃতির অন্তরাকাশে জাগরিত জ্যোতির্ময়ী জগন্মাতার আগমন বার্তা। আনন্দময়ী মহামায়ার পদধ্বনি অসীম ছন্দে বেজে উঠে রূপলোক ও রসলোকে আনে নব ভাবমাধুরীর সঞ্জীবন। তাই আনন্দিতা শ্যামলীমাতৃকার চিন্ময়ীকে মৃন্ময়ীতে আবাহন। আজ চিৎ-শক্তিরূপিনী বিশ্বজননীর শারদ-স্মৃতিমণ্ডিতা প্রতিমা মন্দিরে মন্দিরে ধ্যানবোধিতা।
সিংহস্থা শশিশেখরা মরকতপ্রখ্যা চতুর্ভির্ভুজৈঃ
শঙ্খং চক্রধনুঃশরাংশ্চ দধতী নেত্রৈস্ত্রিভিঃ শোভিতা ।
আমুক্তাঙ্গদ-হার-কঙ্কণ-রণৎ-কাঞ্চীক্বণন্নূপুরা
দুর্গা দুর্গতিহারিণী ভবতু নো রত্নোল্লসৎকুণ্ডলা ।।
#মহামায়া সনাতনী, শক্তিরূপা, গুণময়ী। তিনি এক, তবু প্রকাশ বিভিন্ন— দেবী নারায়ণী, আবার ব্রহ্মশক্তিরূপা ব্রহ্মাণী,
কখনো মহেশ্বেরী রূপে প্রকাশমানা, কখনো বা নির্মলা কৌমারী রূপধারিণী, কখনো মহাবজ্ররূপিণী ঐন্দ্রী, উগ্রা শিবদূতী, নৃমুণ্ডমালিনী চামুণ্ডা, তিনিই আবার তমোময়ী নিয়তি। এই সর্বপ্রকাশমানা মহাশক্তি পরমা প্রকৃতির আবির্ভাব হবে, সপ্তলোক তাই আনন্দমগ্ন।
বাজলো তোমার আলোর বেণু,
বাজলো তোমার আলোর বেণু,
মাতলো যে ভুবন।
আজ প্রভাতে সে সুর শুনে
খুলে দিনু মন।
অন্তরে যা লুকিয়ে রাজে,
অরুণ বীণায় সে সুর বাজে;
এই আনন্দ যজ্ঞে সবার
মধুর আমন্ত্রণ।
আজ সমীরণ আলোয় পাগল
নবীন সুরের বীণায়,
আজ শরতের আকাশবীণায়
গানের মালা বিলায়।
তোমায় হারা জীবন মম,
তোমারি আলোয় নিরুপম।
ভোরের পাখি উঠে গাহি
তোমারি বন্দন।
হে ভগবতী মহামায়া, তুমি ত্রিগুণাত্মিকা;
তুমি রজোগুণে ব্রহ্মার গৃহিণী বাগ্দেবী,
সত্ত্বগুণে বিষ্ণুর পত্নী লক্ষ্মী,
তমোগুণে শিবের বণিতা পার্বতী,
আবার ত্রিগুণাতীত তুরীয়াবস্থায় তুমি অনির্বচনীয়া, অপারমহিমময়ী, পরব্রহ্মমহিষী;
দেবী ঋষি কাত্যায়নের কন্যা কাত্যায়নী,
তিনি কন্যাকুমারী আখ্যাতা দুর্গি,
তিনিই আদিশক্তি আগমপ্রসিদ্ধমূর্তিধারী দুর্গা,
তিনি দাক্ষায়ণী সতী;
দেবী দুর্গা নিজ দেহ সম্ভূত তেজোপ্রভাবে শত্রুদহনকালে অগ্নিবর্ণা, অগ্নিলোচনা।
এই ঊষালগ্নে, হে মহাদেবী, তোমার উদ্বোধনে বাণীর ভক্তিরসপূর্ণ বরণ কমল আলোক শতদল মেলে বিকশিত হোক দিকে-দিগন্তে;
হে অমৃতজ্যোতি, হে মা দুর্গা, তোমার আবির্ভাবে ধরণী হোক প্রাণময়ী।
জাগো! জাগো, জাগো মা!
জাগো, জাগো দুর্গা, জাগো দশপ্রহরণধারিণী।
অভয়া শক্তি, বলপ্রদায়িনী, তুমি জাগো।
জাগো, তুমি জাগো।
প্রণমি বরদা, অজরা, অতুলা,
বহুবলধারিণী, রিপুদলবারিণী, জাগো মা।
শরন্ময়ী, চণ্ডিকা, শঙ্করী জাগো, জাগো মা।
জাগো অসুর বিনাশিনী, তুমি জাগো।
জাগো দুর্গা, জাগো দশপ্রহরণধারিণী।
অভয়া শক্তি, বলপ্রদায়িনী, তুমি জাগো।
জাগো, তুমি জাগো।
দেবী চণ্ডিকা সচেতন চিন্ময়ী, তিনি নিত্যা, তাঁর আদি নেই, তাঁর প্রাকৃত মূর্তি নেই, এই বিশ্বের প্রকাশ তাঁর মূর্তি।
নিত্যা হয়েও অসুর পীড়িত দেবতা রক্ষণে তাঁর আবির্ভাব হয়।
Continue-17
মহাভারত_এর_প্রতিকী_চরিতসমূহঃ
মানব জীবনের ঘাত প্রতিঘাত, আশা হতাশা, ধর্ম অধর্ম- সেই সব কিছুর চরিত্রায়নই হলো মহাভারত।
*#কুরুক্ষেত্র হচ্ছে মানুষের চিন্তার চারণভূমি। সেই চিন্তার চারণভূমিতে, প্রতিদিন লোভের সঙ্গে ত্যাগের সংঘাত, সত্যের সঙ্গে মিথ্যের সংঘাত ঘটছে।
কৌরবরা হচ্ছে মানুষের যত ধ্বংসাত্মক গুণাবলী। আর পান্ডবরা হচ্ছে মানুষের যত গঠনাত্মক গুণাবলী।
*#কৌরবদের_মধ্যেঃ
*দুর্যোধন হচ্ছে আমাদের লোভ আর দম্ভ।
*দুঃশাসন হচ্ছে আমাদের কামনা আর লাম্পট্য।
*ধৃতরাষ্ট্র আমাদের অন্ধ স্নেহ, অন্ধ ভালোবাসা।
*শকুনি আমাদের কুটিলতা
*কর্ণ আমাদের অভিমান
*ভীষ্ম আমাদের গর্ব আর প্রতিজ্ঞা
*দ্রোণাচার্য্য আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা
*শিখন্ডি আমাদের দুর্বলতা
*কর্ণের রথের "চাকা" বসে যাওয়া আমাদের দুর্ভাগ্য
*দেহতত্ত্বের বিশ্লেষনে পাঁচ পান্ডবদের স্থান এবং তাঁদের নামের গুরুত্বঃ
*#সহদেবঃ
'সহ' হচ্ছে সহিত আর 'দেব' হচ্ছে যে খেলা করে । অর্থাৎ দেবের সহিত যে খেলা করে সে সহদেব । সহদেব হলো পৃথ্বীতত্ত্ব , যার গুন - শব্দ , স্পর্শ , রূপ , রস ও গন্ধ । এই পাঁচ গুনের সঙ্গেই জীবের ঘনিষ্ঠতা বেশি । এই ঘনিষ্ঠতার জন্যই শরীরাভিমান প্রবল । সহদেব কে পঞ্চভূতের মধ্যে ক্ষিতি অর্থাৎ পৃথিবীর সাথে তুলনা করা হয় । ছয় জ্ঞান সাধনার মধ্যে সহদেবকে ' শম ' এর সাথে তুলনা করা হয় ।
লৌকিক ব্যাপার হতে মনকে নিবৃত্তি করা বা দূরে সরিয়ে রাখাই হলো ' শম ' ।
ষটচক্রের মধ্যে মূলাধার চক্রে স্থান হয় সহদেবের ।
*#নকুলঃ
নকুল হলো রসতত্ত্ব । যার গুন - শব্দ , স্পর্শ , রূপ ও রস । যত প্রকারের রস আছে , তা ভোগ করে শেষ করতে পারা যায় না , অর্থাৎ ভোগের দ্বারা রসের কুল বা সীমা পাওয়া যায় না ; এই জন্য রসতত্ত্বের নাম নকুল । নকুল কে পঞ্চতত্ত্বের মধ্যে অপ্ অর্থাৎ জলের সাথে তুলনা করা হয় ।
ছয় জ্ঞান সাধনার মধ্যে নকুল কে ' দম ' এর সাথে তুলনা করা হয় ।
ভোগ্য বস্তুর প্রতি আসক্তি না রাখা বা নিজের পঞ্চইন্দ্রিয়কে দমিয়ে রাখাই হল ' দম ' ।
ষটচক্রের মধ্যে স্বাধীষ্ঠান চক্রে স্থান হয় নকুলের ।
*#অর্জুনঃ
অ + রজ্জু + না = যিনি পাশমূক্ত নন ; অর্থাৎ সংসারবদ্ধ জীবাবস্থার নাম অর্জুন । সাধনমার্গের সাধককেই অর্জুন বলা হয় । ধন = বিভূতি , অর্থাৎ জন্ম , মৃত্যু , সুখ , দূঃখ , ক্ষুধা ও তৃষ্ণা যিনি জয় করেছেন ; বিভূতি বিজয়ী যিনি , তিনিই ধনঞ্জয় ।
অর্জুন হল তেজতত্ত্ব , যার গুন - শব্দ , স্পর্শ ও রূপ । বায়ুও তেজ এর দ্বারা বইতে থাকে । কাজেই যা কিছু শক্তির বিকাশ , তা তেজের দ্বারাই হয় । পঞ্চভূতের মধ্যে তেজ অর্থাৎ অগ্নিই হল অর্জুন । ছয় জ্ঞান সাধনার মধ্যে অর্জুনকে ' তিতিক্ষা ' এর সাথে তুলনা করা হয় । শীত হোক কিংবা উষ্ণতা যেকোনো আবহাওয়া সহ্য করে মন স্থির রাখাই হলো ' তিতিক্ষা ' ।
ষটক্রের মধ্যে মণিপুর চক্রে স্থান হয় অর্জুনের ।
ষটক্রের মধ্যে মণিপুর চক্রে স্থান হয় অর্জুনের ।
*#ভীমঃ
ভীমের আরেক নাম ' বৃকোদর ' । 'বৃক' হচ্ছে অগ্নি আর 'উদর' হচ্ছে পেট ; অগ্নি উদরে আছে বলে ভীমের নাম হয়েছে বৃকোদর । বৃকোদর হল ' বায়ুতত্ত্ব ' , যার গুন - শব্দ ও স্পর্শ । অগ্নি বায়ু হতে উৎপন্ন হয় , আবার বায়ুতেই লয় হয় ; এজন্য বলা যায় যে বায়ুর মধ্যে অগ্নি রয়েছে ।
পঞ্চভূতের মধ্যে ভীম হল মরুৎ বা ' বায়ুতত্ত্ব ' ।
ছয় জ্ঞান সাধনার মধ্যে ভীমকে ' উপরতি ' এর সাথে তুলনা করা হয় । জ্ঞান লাভ করবার প্রতিবন্ধক কর্মকে পরিত্যাগ করাই হলো ' উপরতি ' ।
ষটচক্রের মধ্যে অনাহত চক্রে স্থান হয় ভীমের ।
*#যুধিষ্ঠিরঃ
যুদ্ধে যে স্থির অর্থাৎ যুদ্ধ করে যাঁকে টলাতে পারা যায় না তিনিই যুধিষ্ঠির । পঞ্চভূতের মধ্যে যুধিষ্ঠির হলেন ' ব্যোম ' বা আকাশতত্ত্ব । যার গুণ হলো শব্দ । ছয় জ্ঞান সাধনার মধ্যে যুধিষ্ঠিরকে ' শ্রদ্ধা ' এর সাথে তুলনা করা হয় । ঈশ্বরের প্রতি বিশ্বাস বা আস্তিকতাই ' শ্রদ্ধা ' ।
ষটচক্রের মধ্যে বিশুদ্ধ চক্রে স্থান হয় যুধিষ্ঠিরের ।
*#শ্রীকৃষ্ণঃ
ইনি পান্ডব না হলেও , পান্ডবদের পথপ্রদর্শক । এনাকে ' হৃষীকেশ ' ও বলা হয় । হৃষীকা = ইন্দ্রিয়সমূহ , ঈশ = নিয়ন্তা ; যিনি ইন্দ্রিয়ের নিয়ন্তা । যাঁর জোরে ইন্দ্রিয়গুলো নিজের নিজের কাজ করে তিনিই হৃষীকেশ । শ্রী কৃষ্ণ হলেন চৈতন্য - তত্ত্ব ; যার গুন হল - সৎ - চিৎ - আনন্দ ।
ছয় জ্ঞান সাধনার মধ্যে শ্রীকৃষ্ণকে ' সমাধান ' এর সাথে তুলনা করা হয় ।
নিদ্রা ও আলস্য পরিত্যাগ করে ঈশ্বরের প্রতি চিত্তের একাগ্রতাই ' সমাধান ' ।
ষটচক্রের মধ্যে আজ্ঞা চক্রে স্থান হয় শ্রী কৃষ্ণের ।
অর্থাৎ পান্ডবদের মধ্যে-
*#যুধিষ্ঠির আমাদের সত্য, ধর্ম আর ত্যাগ
*#ভীম আমাদের পৌরুষত্ব আর বীরত্ব
*#অর্জুন আমাদের নিষ্ঠা আর শ্রম
*#অভিমন্যু আমাদের সাহস ও যৌবন শক্তি
*#বিদূর আমাদের বিবেক
*#কৃষ্ণ আমাদের আত্মা। যা পরমাত্মার অংশ। যা আমাদেরকে আলোর পথে চালিত করে।
*#দ্রৌপদী আমাদের আত্মার সন্মান।
*#দ্রৌপদী একসাথে পাঁচ ভাইয়ের স্ত্রী; কারন যারা ধর্ম আর পৌরুষত্বের পূজা করে, তাদের সকলেরই আত্মার সম্মান থাকে। আত্মার সম্মান সব বীরেরই প্রিয়তমা। পান্ডবরা ধার্মিক আর বীর, তাই তাদের সকলেরই আত্মার সম্মান বা দ্রৌপদী আছে।
*#দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ আমাদের আত্মার লাঞ্ছনা।
*#কুন্তীর কুমারী মাতৃত্ব হচ্ছে সমাজের প্রথার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ।
মহাভারতে, মানুষের সব দোষ আর গুনগুলোকে, এক একটা চরিত্র বানিয়ে গল্পের আকার দেওয়া হয়েছে।
অর্জুনের উদ্দেশ্যে শ্রীকৃষ্ণের গীতার বাণী জীবনের দর্শনকে, টুকরো টুকরো করে ব্যাখ্যা করা হয়েছে।
মানুষ যদি মনুষত্বে উত্তীর্ণ হতে চায়- তাহলে তাকে পান্ডব হয়ে, কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে জয়ী হতে হবে।
*#কলমে-
গীতা সর্ম্পকে কিছু বহিরঙ্গা জ্ঞানঃ
১। গীতা হচ্ছে সমস্ত শাস্ত্রের সারতিসার এমনকি গীতায় এমন কিছু আছে যা অন্যান্য কোন শাস্ত্রে পাওয়া যায় না । যেমন – ৫ম পুরুষার্থ
২। মহাভারতের ভীষ্মপর্বের ২৫ থেকে ৪২ নং অধ্যায়ের এই ১৮ টি অধ্যায় হল ভগবদগীতা বা গীতোপনিষদ ।
৩। গীতায় আছে ৭০০ শ্লোক (কেউ বলে ৭৪৫ শ্লোক) আছে । তার মধ্যে ধৃতরাষ্ট্র বলেন ১টি শ্লোক, সঞ্জয় বলেন ৪০টি শ্লোক, অর্জুন বলেন ৮৫টি শ্লোক, ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলেন ৫৭৪টি শ্লোক । আর পুরো গীতায় ৯৫৮০ টি সংস্কৃত শব্দ আছে ।
৪। গীতার ১৮টি অধ্যায়ের মধ্যে প্রথম ৬টি অধ্যায়কে বলে কর্মষটক, মাঝখানের ৬টি অধ্যায়কে বলে ভক্তিষটক, আর বাকি ৬টি অধ্যায়কে বলে জ্ঞানষটক ।
৫। গীতা পড়লে ৫টি জিনিষ সর্ম্পকে জানা যায় – ঈশ্বর, জীব, প্রকৃতি, কাল ও কর্ম ।
৬। যদিও গীতার জ্ঞান ৫০০০ বছর আগে বলেছিল কিন্তু ভগবান চতুর্থ অধ্যায় বলেছেন এই জ্ঞান তিনি এর আগেও বলেছেন, মহাভারতের শান্তিপর্বে (৩৪৮/৫২-৫২) গীতার ইতিহাস উল্লেখ আছে । তার মানে গীতা প্রথমে বলা হয় ১২,০৪,০০,০০০ বছর আগে, মানব সমাজে এই জ্ঞান প্রায় ২০,০০,০০০ বছর ধরে বর্তমান, কিন্তু কালের বিবর্তনে তা হারিয়ে গেলে পুনরায় আবার তা অর্জুনকে দেন ।
৭। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে মাত্র ৪০ মিনিটে এই গীতার জ্ঞান দেন ।
৮। গীতার মাহাত্ম্য অনেকে করে গেছেন তার মধ্যে শ্রীশঙ্করাচার্য, স্কন্দপুরাণ থেকে শ্রীল ব্যাসদেব, শ্রীবৈষ্ণবীয় তন্ত্রসারে গীতা মাহাত্ম্য আর আছে পদ্মপুরাণে দেবাদিদেব শিব কর্তৃক ১৮টি অধ্যায়ের মাহাত্ম্য বর্ণনা করেছেন ।
৯। গীতাতে অর্জুনের ২০টি নাম আর কৃষ্ণের ৩৩টি নামের উল্লেখ করা হয়েছে ।
১০। গীতাতে মাং এবং মামেব কথাটি বেশি আছে, যোগ শব্দটি আছে ৭৮ বার, যোগী আছে ২৮ বার আর যুক্ত আছে ৪৯ বার ।
১১। গীতার ২য় অধ্যায়কে বলা হয় গীতার সারাংশ ।
১২। ভগবান যখন বিশ্বরূপ দেখান তখন কাল থেমে যায় ।
১৩। ভগবান শুধু যুদ্ধের আগেই গীতা বলেনি ১৮ দিন যুদ্ধের মাঝখানেও গীতা বলেছে ।
১৪। গীতায় অর্জুন ১৬টি প্রশ্ন করে আর কৃষ্ণ তার উত্তর দেন, কৃষ্ণ তা ৫৭৪টি শ্লোকের মাধ্যমে উত্তর দেন ।
১৫। পুরো গীতার সারমর্ম মাত্র ৪টি শ্লোকে বর্ণনা করা হয়েছে, ১০ অধ্যায়ের ৮ থেকে ১১ নং শ্লোক ।
১৬। পুরো গীতায় অর্জুন ৪৫ নামে কৃষ্ণকে সম্বধোন করছেন, আর কৃষ্ণ অর্জুনকে ২১টি নামে সম্বধোন করেছেন ।
১৭। গীতার ৫ম অধ্যায় ১৩ থেকে ১৬ নং শ্লোকে তিনজন কর্তার কথা বলা হয়েছে ।
১৮। গীতায় ৩টি গুণ, ৩টি দুঃখ আর ৪টি আমাদের প্রধান সমস্যার কথা বলেছে ।
১৯। ত্রিশ্লোকী গীতার জ্ঞান ঃ যা বেদ ও বেদান্তের সার, ১৫ অধ্যায়ের ১৬ থেকে ১৮ নং শ্লোক ।
২০। গীতায় ২৬টি গুণের কথা বলা হয়েছে আর ৬টি আসুরিক প্রবৃত্তির কথা বলা হয়েছে ।
২১। নরকের ৩টি দ্বারের কথা বলা হয়েছে (কাম, ক্রোধ ও লোভ)
২২। গীতার ১৮ অধ্যায় ব্রাক্ষ্মনের ৯টি গুণ, ক্ষত্রিয়ের ৭টি গুণ, বৈশ্যের ৩টি গুণ আর শুদ্রের ১টি গুণ ।
২৩। ৩টি কর্মের প্রেরণা আর ৩টি কর্মের আশ্রয়ের কথা বলা আছে ।
২৪। বেদান্ত শাস্ত্রের সিধান্ত অনুসারে কর্মসমূহের সিদ্ধির উদ্দেশ্যে ৫টি নির্দিষ্ট কারণ কথা বলা হয়েছে ।
২৫। গুণ অনুসারে ৩ প্রকারের ত্যাগের কথা বলা হয়েছে ।
২৬। ৩ প্রকারের আহার, যজ্ঞ, তপস্যা, শ্রদ্ধা, পূজা ও দানের কথা বলা হয়েছে ।
২৭। ২টি স্বভাবের জীবের কথা বলা হয়েছে ।
২৮। ২ প্রকার জীবের কথা বলা হয়েছে ।
২৯। ১৮টি আত্মজ্ঞানের সাধনার গুনের কথা বলা হয়েছে ।
৩০। ব্রক্ষ্ম উপলব্ধির ৫টি স্তরের কথা বলা হয়েছে ।
৩১। ভক্তদের ৩৬ টি গুণের কথা বলা হয়েছে ।
৩২। গীতায় ২৫ জন সৃষ্টের কথা বলা হয়েছে যারা স্থাবর, জঙ্গম ও সমস্ত প্রজাদের সৃষ্টি করেছেন ।
৩৩। গীতায় নারীর ৭টি গুণের কথা বলা হয়েছে ।
৩৪। ৪ প্রকার সুকৃতিবান ব্যক্তির কথা বলা হয়েছে । আর ৪ প্রকার দুষ্কৃতিবানের কথা বলা হয়েছে ।
৩৫। জড়া প্রকৃতির ৮টি উপাদানের কথা বলা হয়েছে।
ক্রিয়াযােগ কি ? (০১)
"শাস্ত্ৰণ্যাধীত্যাপি ভবন্তি মূর্খাঃ যস্তুক্রিয়াবান্ পুরুষঃ স বিদ্বান্ । ”
শাস্ত্র অধ্যয়ণ করেও লােক মুর্খ থাকে কিন্তু যিনি ক্রিয়াবান তিনিই বিদ্বান। যােগ শব্দটি বহু প্রাচীন। ঋগ্বেদেই এই শব্দটির প্রথম ব্যবহার হয়। শাস্ত্রানুযায়ী “যােগ ” অর্থ যুক্ত হওয়া বা সংযােগ সাধন। বর্তমান কালে “যােগ ” শব্দটি বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিভিন্ন ভাবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। যেমন অংকশাস্ত্রে “দুই বা ততােধিক সংখ্যার সংযুক্তি করণের প্রক্রিয়াকে যােগ বলা হয়।" আবার সমধর্মবিশিষ্ট একাধিক বস্তুর সংযােগকেও যােগ বলা হয়। সাংখ্যদর্শনের মতে, "অনাদি পুরুষের সঙ্গে প্রকৃতির মিলনকে যােগ বলা হয়।” হিন্দু দর্শনশাস্ত্রে, “পরমাত্মার সঙ্গে জীবাত্মার মিলনকে যােগ বলা হয়।” শৈবগণের মতে
“শিব এবং শক্তির মিলনকে যােগ বলা হয়।" বৈষবগণের মতে, “রাধা এবং কৃষ্ণের মিলনকে যােগ বলা হয়।” শ্রীমদ্ভগবদগীতায় যােগের সংজ্ঞা বলা হয়েছে ,
“সিল্কসিন্ধেদ্ধঃ সমম্বা সমত্ব যােগ উচ্যতে" ( ২/৪৮ )
অর্থাৎ,কর্মের সিদ্ধি এবং অসিদ্ধিতে সমভাব জ্ঞানই যােগ। আবার অন্যত্র বলেছেন, “যােগঃ কর্মসুকৌশল। ” অর্থাৎ কর্মের সুকৌশলই যােগ । যে অবস্থা লাভ করে সাধক অন্য লাভকে অধিক বলে মনে করেন না, যে অবস্থায় স্থিত হলে অতিরিক্ত দুঃখ দ্বারাও বিচলিত হন না, সেই দুঃখ সংযােগের বিয়ােগরুপ অবস্থাকেই যোগ বলা হয়। জ্ঞানসঙ্কলিনী তন্ত্রে বলা হয়েছে- “সর্বচিন্তা পরিত্যাগে নিশ্চিন্তে যােগ উচ্যতে।” অর্থাৎ সর্বচিন্তা পরিত্যাগকেই যােগ বলে।
ক্রিয়াযোগ কি?
(২য় পর্ব)
পাতঞ্জল যােগ দর্শনের ভাষায় বলা যায়, "যােগশ্চিত্তবৃত্তি নিরােধঃ।” অর্থাৎ চিত্তের বৃত্তিগুলাের নিরােধকেই যোগ বলা হয়। শিব সংহিতার মতে,
“মন্ত্রযোগে হঠলৈ লয়যােগস্তৃতীয়তঃ । চতুর্থো রাজযােগঃ স্যাৎ স দ্বিধাভাব বর্জিতঃ।।”
অর্থাৎ যােগ প্রধানত চার প্রকারঃ
(১ ) মন্ত্রযোগ
(২ ) হঠযােগ
(৩ ) লয়যােগ
(৪ ) রাজযােগ
এছাড়াও ভারতবর্ষে সাধকসমাজে বহু প্রাচীনকাল থেকে আরও বহু প্রকার যােগ পথের নির্দেশ পাওয়া যায়। তার মধ্যে প্রায় সবই ছিলেন সাধু - সন্ন্যাসী মহলে অতি গুপ্ত। সে সব যােগের প্রক্রিয়া সাধারণ গৃহীদের যেমন নাগালের বাইরে ছিল তেমনি দুঃসাধ্যও ছিল। সাধারণ মানুষ যারা প্রাচীনকালের কঠিন যােগ ক্রিয়া করতে সমর্থ নয়, সেই সমস্ত সাধারণ গৃহীদের জন্য কাশীবাসী যােগিরাজ শ্ৰীশ্ৰীশ্যামাচরণ লাহিড়ী মহাশয় যে সহজ যােগক্রিয়া প্রচলন করেছিলেন তাই "ক্রিয়াযােগ” বা “ক্রিয়া" নামে পরিচিত। শাস্ত্রমতে এই সাধন পথকে আত্মবিদ্যা , অধ্যাত্মবিদ্যা বা ব্রহ্মবিদ্যা বলা হয় । অনেক সিদ্ধ মহাপুরুষের মতে আজ পর্যন্ত যে সব মুক্তির উপায় বের হয়েছে তার মধ্যে এই ক্রিয়াযােগই হচ্ছে সর্বাপেক্ষা সহজ। ক্রিয়াযােগ প্রকৃতপক্ষে যে এক প্রকার যােগ বা সাধন প্রণালী তা নয়। গীততাক্ত শ্রীকৃষ্ণ যে সুপ্রাচীন যােগমার্গ প্রিয় শিষ্য অর্জুনকে শিক্ষা দিয়েছিলেন যা আবালবৃদ্ধবনিতা এমন কি জরাবৃদ্ধ গৃহস্থ লােকেও সহজে এ কৌশল অবলম্বন করতে পারে। ত্রিকালজ্ঞ ঋষি শ্ৰীশ্ৰীবাবাজী মহারাজ বহু যুগের বিস্মৃতির অন্তরাল থেকে সেই সুকৌশল ১৮৬১ সালে কাশীবাসী যােগিরাজ শ্রীশ্রীশ্যামাচরণ লাহিড়ী মহাশয়কে রাণীক্ষেতের জঙ্গলে অলৌকিক কৌশলে ডেকে নিয়ে সেই যুগােপযােগী ক্রিয়াযােগের সহজতর কৌশল শিখিয়ে জনসমাজে লােকশিক্ষার জন্য পাঠিয়েছিলেন। সেই কৌশল আজও সারা বিশ্বে “ক্রিয়াযোগ” নামে পরিচিত । সত্যিকারের আত্মজ্ঞান পিপাসু লােকের কাছে এই ক্রিয়াযােগ সাধন গুরুমুখী বিদ্যারূপে প্রিয় জিনিসের মত সমাদর পেয়ে আসছে।
ক্রিয়াযোগ কি?
(৩য় পর্ব)
সেই শুভদিনে শ্রীশ্রীবাবাজী মহারাজ শ্রীশ্রী লাহিড়ীমহাশয়কে ক্ৰিয়াদীক্ষা দেবার
সময় গীতার অনুকরণে বলেছিলেনঃ "আজকে এই উনবিংশ শতাব্দীতে তোমার হাত দিয়ে আমি জগৎকে যে ক্রিয়াযােগ দান করছি তা হচ্ছে সেই একই বিজ্ঞানের পুনরুজ্জীবন, যা শ্রীকৃষ্ণ হাজার হাজার বছর আগে অর্জুনকে দিয়েছিলেন।” শ্রীভগবান গীতায়া বলেছেন -
ইমং বিবস্বতে যােগং প্রােক্তনহমবষম্ । বিবস্বান্মনবে প্রাহ মনুরিক্ষৰাকহেরবীৎ ।। এবং পরম্পরা প্রাপ্তমিমং রাজয়াে বিদুঃ । স কালেনেহ মহতা যােগাে নষ্টঃ পরন্তপ ।।
- গীতা ( ৪১-২ )
অর্থাৎ আমি সুৰ্য্যকে এই অক্ষয় এবং অব্যয় যোগ বলেছিলাম । সূৰ্য্য ( স্বপুত্র ) মনুকে এবং মনু ( স্বপুত্র ) ইক্ষাকুকে বলেছিল । নিমি, জুনকাদি, রাজর্ষিগণ এরূপে পুরুষ পরম্পরা প্রাপ্ত এ যােগ জেনেছিলেন । হে পরন্তপ, ইহলােকে সেই যােগ দীর্ঘকাল পরে নষ্ট হয়েছে। শ্রীভগবান তার এক প্রাচীনতম অবতার কালে এ অব্যয় এবং অক্ষয় যােগ সাধন প্রণালী প্রাচীন প্রনালী বিবস্বানকে দিয়েছিলেন ( বিবস্বান থেকে যে বংশের উৎপত্তি তাকেই সূৰ্য্য বংশ বলে। কেননা বিবস্বান শব্দে সূর্য্য বুঝায় ) বিবস্বান মনুকে দান করেন ( মানবধর্ম শাস্ত্র বা মনুসংহিতার রচয়িতা )। এ সকল মানবধর্ম শাস্ত্রানুমোদিত রীতিনীতি বা প্রথা আজও ভারতবর্ষের নানা জায়গায় প্রচলিত আছে। মনু আবার তার নাসাপুট থেকে উৎপন্ন পুত্র ইক্ষাকুকে এ জ্ঞান দান করেন। এভাবে জড়যুগ পর্যন্ত বংশ পরম্পরাক্রমে এ যোগ সাধন প্রণালী মুনিঋষিদের দ্বারা প্রচারিত হয়ে আসছে। বহু কাল ধরে এভাবে যােগ প্রচারিত থাকার পর কালক্রমে মুনি ঋষি এবং ব্রাহ্মণদের মন্ত্রগুপ্তি আর মানুষের ধর্ম পিপাসার অভাবের দরুন এই পরম পবিত্র যােগ ক্রমশঃ সাময়িকভাবে বিলুপ্ত হয় অর্থাৎ ভস্মাচ্ছাদিত আগুনের মত লুকিয়ে থাকে। চিরন্তন সত্য চিরদিনের মত কখনও বিলুপ্ত প্রাপ্ত হয় না। একেই গীতায় কালক্রমে যােগনষ্টের কথা উল্লেখ করেছেন। প্রাচীনকালে এ যােগক্রিয়াগুলাে মুনি ঋষির অভ্যাস করতেন। ভগবান শ্রীকৃষ্ণের মানব দেহে জন্মের আগেও এ যোগের প্রচলন ছিল। বর্তমানেও আছে , চিরকাল থাকবে ।
ক্রিয়াযোগ কি?
(৪র্থ পর্ব)
এ যােগের নাম অমর যােগ। কাল প্রভাবে মাঝে মাঝে যখনই মলিন হয় তখনই কোন মহাপুরুষের আর্বিভাব হয়ে এ যােগের পুনঃস্থাপন করেন। শ্ৰীশ্ৰীলাহিড়ী মহাশয় প্রচারিত ক্রিয়াযােগ প্রকৃতপক্ষে যে অন্য এক প্রকার যােগ বা শাস্ত্রে বহিভূত যােগ বা সাধন প্রণালী তা নয় । পাতঞ্জল যােগদর্শনে এই ক্রিয়াযােগের উল্লেখ আছে।
“তপঃ স্বাধ্যায়ের প্রাণিধানানি ক্রিয়াযােগঃ।”
( সাধন পাদ ১ সূত্র )
অর্থাৎ “তপস্যা, স্বাধ্যায় ও ঈশ্বর প্রাণিধানই হচ্ছে ত্রিয়াযােগ।”
যােগসিদ্ধির উদ্দেশ্যে প্রক্রিয়া সহকারে পরমাত্মার সহিত সংযােগ স্থাপনই ক্রিয়াযােগ। তার ভাষায় ক্রিয়াযােগ সম্বন্ধে আরও বলা যায় –“ক্রিয়াযােগ হচ্ছে অতি দ্রুত সকল দুঃখ ক্লেশমুক্ত সকল বাধা বন্ধনহীন অনাদি অনন্তু পরমাত্মার স্বরূপ দেখতে পাওয়ার চাবিকাঠি। যার দ্বারা দেহকারাগারের বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে পরমাত্মার সঙ্গে মিলিত হওয়া যায়। ” তান্ত্রিক এবং বৈদিক উভয় মতেই ক্রিয়াযােগ সাধন প্রণালী একই প্রকার। এবং ক্রিয়াযােগ পথৈঃ পুমান বৈদিক তান্ত্রিককৈঃ । অন্যভয়তঃ সিদ্ধিং মন্দ্রো বিন্দত্যভাপসিতাম্ ।। – শ্ৰীমদভাগবদ ১১ স্কন্ধ । ( ২৭-৪৯ ) অর্থাৎ, এই প্রকার ক্রিয়াযােগ পথে বৈদিক ও তান্ত্রিক সাধকগণ উভয়ে অর্চণা করে স্ব স্ব অভীষ্ট সিদ্ধিলাভ করেন। বলাবাহুল্য এই ক্রিয়াযােগ একটি অধ্যাত্ম কর্ম, যার দ্বারা আত্মজ্ঞান লাভ করা যায়। গীতায় শ্রীভগবান আবার বলেছেন-
“এষা তেহভিহিতা সাংখ্যে বুদ্ধিযোগেমিং শৃণু । বুদ্ধ্যা যুক্তো যয়া পার্থ কর্মবন্ধং প্রহাস্যসি ।।”
অর্থাৎ, জ্ঞানীদিগের এই মত যে জ্ঞান প্রাপ্তির জন্য চৈতন্য প্রকাশক ক্রিয়ায় নিযুক্ত হওয়া প্রয়ােজন। কারণ এর দ্বারা সমস্ত কর্মবন্ধন হতে মুক্ত হওয়া যায়। এই ক্রিয়াযােগই গীতােক্ত কর্মযােগ। প্রাণাপানয়ো কর্মোতি। – প্রাণ ও অপানের কৰ্ম্মই ক্রিয়া।
“যােগঃ কসু কৌশল।”
(গীতা ২/৫০ ) ক্রিয়াযােগ শাস্ত্রোক্ত পরমজ্ঞান লাভের এক বিজ্ঞান সম্মত সাধন প্রণালী।
"জানং বিজ্ঞান সহিতং যজ জ্ঞাত্বা মােক্ষ সেহশুভাৎ।"
- বিজ্ঞান সম্মত উপায়ে ব্রহ্মজ্ঞান লাভ করলে সংসার বন্ধন হতে মুক্তি প্রাপ্ত হওয়া যায়।
ক্রিয়াযোগ কি?
(৫ম পর্ব)
ক্রিয়াযােগ সাধনে অনুভবসিদ্ধ অজ্ঞান প্রাপ্তি হয়। এটিই বিজ্ঞান সম্মত উপায়। অর্থাৎ, প্রত্যক্ষ জ্ঞানানুভূতিমূলক আত্মবিজ্ঞান। ক্রিয়াযােগের মাধ্যমে প্রত্যক্ষ অনুভূতি লাভ করা যায় এবং ক্রমে পরমাত্মার সঙ্গে একীভূত হওয়া যায়। যা মনুষ্য জীবনের শ্রেষ্ঠ সম্পদ। তখন যে কী আনন্দ তা বলে বা লিখে প্রকাশ করা যায় না। কারণ বলার কোন উপায় থাকে না। সেই অপার শাশ্বত আনন্দ শুধু নিজ বােধগম্য। শ্রদ্ধেয় আনন্দ মােহন লাহিড়ীর মতে, "ক্রিয়াযােগ এবং ইহার বিজ্ঞান সম্মত বিস্ময়কর পরিণতির কথা ভারতীয় যেগিগণ সবিশেষ অবহিত আছেন কিন্তু অনেকেই ভুলে গেছেন যে এই ক্রিয়াযােগ মূলতঃ ঈশ্বরে পরানুরক্তিমূলক আধ্যাত্মিক অভিব্যক্তির স্বাভাবিক ফলস্বরূপ সাধন প্রয়াস। যদিও আত্মিক উন্নয়নের প্রচেষ্টার সঙ্গে সঙ্গে যুগপৎ দেহমনের পরিবর্তন স্বতঃই হয়ে থাকে, তবু ইহা পরীক্ষা - নিরীক্ষার দ্বারা জানবার চেষ্টা চলছে যে দৈহিক মানসিক পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে আমরা চৈতন্য রাজ্যে ফিরে যেতে পারি কিনা। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশতঃ অনেকেই অন্তর্মূখীন শেষ লক্ষ্যের কথা বিস্মৃত হয়েছেন এবং আত্মানুসন্ধানের লক্ষ্যপথে প্রযত্নশীল না হয়ে ঐন্দ্রজালিকরূপে রূপান্তরিত হয়ে পড়েছেন। বর্তমানে যােগসাধন বিষয়টিকে যেভাবে ব্যবহার করা হয়, তা যেন ভগবদ্ সম্পর্ক লেশহীন স্বতন্ত্র এক বিজ্ঞান চর্চা মাত্র।" পরমহংস যােগানন্দের মতে - "এই ক্রিয়াযােগের বিধি সনাতন। এ গণিতশাস্ত্রের মতাে একেবারে অভ্রান্ত যােগ বিয়ােগের সহজ প্রণালীর মত ক্রিয়াযােগের বিধিও কখন নষ্ট হতে পারে না। গণিত শাস্ত্রের সমস্ত পুস্তক অগ্নিতে আহুতি দিলেও যুক্তিবাদী মন যেমন এর সত্য সব ঠিক পুনরায় আবিষ্কার করে ফেলবে, তেমনি যােগশাস্ত্রের সমস্ত বই নষ্ট করে ফেললেও যদি একজন প্রকৃষ্ট যােগী আবির্ভূত হন - যার মধ্যে যদি শুদ্ধাভক্তি ও শুদ্ধাজ্ঞানের সমন্বয় ঘটে তাহলে তিনি মূলবিধি সবই পুনরায় আবিষ্কার করে ফেলতে পারবেন। ” যােগিরাজের শিষ্য শ্ৰীযুক্তেশ্বর গিরি মহারাজ বলেছেন - "ক্রিয়াযােগ হচ্ছে এমন একটি উপায় যার দ্বারা মানব জাতির বিবর্তন খুব দ্রুত সাধিত হতে পারে। প্রাচীন যােগীরা আবিষ্কার করেছিলেন যে, ব্রহ্মজ্ঞানলাভের রহস্য শ্বাস প্রশ্বাস নিয়ন্ত্রনের সঙ্গে খুব ঘনিষ্টভাবে বিজড়িত।"
0 Comments