Recent Posts

6/recent/ticker-posts

ঋষিদের প্রদর্শিত জ্ঞানের আলো: জীবন, ধ্যান ও মুক্তির পথ

 

 




ঋষিদের প্রদর্শিত জ্ঞানের আলো: জীবন, ধ্যান ও মুক্তির পথ

মানুষের ইতিহাসে কিছু কিছু সত্তা এমনভাবে আবির্ভূত হয়, যারা কেবল জ্ঞানচর্চা করেন না—তাঁরা জ্ঞান হয়ে ওঠেন। তাঁরা জিজ্ঞাসা করেন না কেবল, “সত্য কী?”, বরং তাঁরা সেই সত্যে অবগাহন করে বলেন, “অহম্ ব্রহ্মাস্মি”—আমি সেই সত্য। এই বোধ যাঁদের মধ্যে জন্ম নিয়েছিল, তাঁরা হলেন ঋষি। বেদের ঋষিগণ এমনই এক চেতনার শিখরে পৌঁছেছিলেন, যেখানে ব্যক্তি-সত্তা বিলীন হয়ে যায়, আর উদ্ভাসিত হয় বৈশ্বিক আত্মার আভা। তাঁদের কোনো প্রতিষ্ঠান ছিল না, কোনো ধর্মীয় পদবী ছিল না; তাঁরা ছিলেন নির্জন বনে ধ্যানস্থ, অন্তর্দৃষ্টি-প্রাপ্ত, প্রকৃতির ছায়ায় আত্মায়তন গড়া সেই মহাজন, যাঁদের কণ্ঠে ধ্বনিত হয়েছিল সৃষ্টির প্রথম সত্যবাক্য।


ঋষিগণ ছিলেন আক্ষরিক অর্থে “দ্রষ্টা”—যাঁরা শ্রবণ করতেন চেতনাজগতের শব্দ, ও সেই শব্দকে রূপ দিতেন মানব ভাষায়। বেদকে বলা হয় শ্রুতি, কারণ এটি তারা ‘শুনেছেন’; কিন্তু এই শোনার অর্থ কানে শোনা নয়—এটি অন্তরের গভীর স্তরে ঈশ্বরীয় অনুরণন ধরা পড়া। যাঁরা সেই অনুরণনকে ধারণ করতেন, তাঁরা ঋষি, এবং সেই অনুরণনের স্ফুটনই বেদ।


আধুনিক জীবনে দাঁড়িয়ে যখন আমরা এই ঋষিদের স্মরণ করি, তখন আমাদের মনে প্রশ্ন জাগে—এই আদি ঋষিদের অভিজ্ঞতা আজ আমাদের কী উপকারে আসতে পারে? উত্তর সহজ: মানুষের আদি সমস্যা ও আজকের সমস্যার মূলে কোনো পার্থক্য নেই। প্রাচীন যুগে যেমন মৃত্যু ছিল, ভয় ছিল, অহংকার ছিল, তেমনি আজও আছে। তেমনি যেমন আত্মাকে ভুলে মানুষ বাইরের বস্তুতে সুখ খুঁজতো, আজও তাই। তাই ঋষিদের আত্মজ্ঞান, তাঁদের অন্তর্জ্ঞান—এখনও আমাদের মুক্তির পথ।


এই আত্মজ্ঞান কেবল চিন্তার বিষয় নয়, এটি জীবনযাপন। ঋষিরা নিজেরাই সেই পথ হেঁটে দেখিয়েছেন। তাঁদের জীবনধারা ছিল সরল, নির্মল, প্রাকৃতিক ও আত্মনিবেদিত। তাঁরা শিখিয়েছেন—যতক্ষণ না তুমি নিজেকে জানো, ততক্ষণ সব বাহ্যিক অর্জন অর্থহীন। “Know thyself”—এই একবাক্যেই সমস্ত ঋষিদর্শন সঙ্কলিত। তাঁরা বলেননি ঈশ্বর কোথায় থাকেন, তাঁরা দেখিয়েছেন কীভাবে ঈশ্বর-সত্তা নিজের মধ্যেই প্রকাশ পায়।


বেদের মর্মবাণী তাই আধ্যাত্মিক আত্মসন্ধান—“আত্মানং বিদ্ধি” (আত্মাকে জানো)। এই আত্মা শরীর নয়, মন নয়, ইন্দ্রিয় নয়, এটি সাক্ষীস্বরূপ; এই আত্মা যখন ব্রহ্মের সঙ্গে যুক্ত হয়, তখনই সে মুক্ত হয়। এই মুক্তি কেবল মৃত্যুর পরের নয়—এই জীবদেহেই সম্ভব। ঋষিরা বলেন—“জীবন্মুক্তি” সম্ভব, যদি তুমি আত্মাকে উপলব্ধি করো। আর আত্মাকে উপলব্ধি করতে হলে, বস্তুর পিছনে দৌড়ানো থামাতে হবে, সংযম শিখতে হবে, ধ্যান করতে হবে, প্রকৃতির সঙ্গে, নিজের সত্তার সঙ্গে একাত্ম হতে হবে।


ঋষিগণ প্রমাণ করেছিলেন—ধর্ম মানে কেবল বিশ্বাস নয়, এটি প্রত্যক্ষ উপলব্ধি। তাঁরা দর্শনচর্চা করতেন না, তাঁরা দর্শনপ্রাপ্ত ছিলেন। তাঁদের কাছে ব্রহ্ম কোনো তাত্ত্বিক চিন্তা নয়, এটি এক জীবন্ত অভিজ্ঞতা। তাই তাঁরা বলেছিলেন—“ব্রহ্মবিত্ ব্রহ্মৈব ভবতি”—যে ব্রহ্মকে জানে, সে ব্রহ্মই হয়ে যায়।


এই উপলব্ধির আলোকে, আমরা যদি আধুনিক জীবনের দিকে তাকাই, দেখি মানুষের চিন্তা-বৃত্তি এখন বাইরের দিকে, তথ্য ও প্রযুক্তির দিকে ছুটছে। কিন্তু ভিতরের দিকে তাকানোর সময় নেই। আত্মার স্তব্ধতা হারিয়ে গেছে ব্যস্ততার চিৎকারে। সেখানে ঋষিদের পথ আবার প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে। তাঁরা আমাদের শিখিয়েছেন—সত্য, শান্তি, সুখ এই বাইরের জগতে নেই। সেগুলো অন্তর্জগতে। আর সেই অন্তর্জগতে প্রবেশ করতে হলে চাই সাধনা, সংযম, একাগ্রতা।


ঋষিদের জীবনযাপন ছিল এক ধ্যানঘন প্রক্রিয়া, যেখানে কর্মও ছিল ত্যাগে রঞ্জিত। তাঁরা কৃষিকাজ করতেন, সন্তান প্রতিপালন করতেন, শিক্ষাদান করতেন, কিন্তু তাঁদের সব কর্ম ছিল ব্রহ্মার্পণ। আধুনিক মানুষ মনে করে সংসার আর আধ্যাত্মিকতা আলাদা জিনিস। কিন্তু ঋষিরা সংসার ত্যাগ না করেও আত্মজ্ঞান লাভ করেছিলেন। তাঁদের পথ ছিল গৃহী ঋষিপথ—যেখানে সংসার ধর্ম আর আত্মধর্ম একসঙ্গে চলে।


এই সমন্বয় আজ খুবই প্রয়োজনীয়। কারণ আজ আমরা এক চরম বিভাজনের যুগে বাস করছি—যেখানে ধর্মকে মনে করা হয় কুসংস্কার, আধ্যাত্মিকতাকে মনে করা হয় অলসতা, সংসারকে মনে করা হয় বাঁধন, আর মুক্তিকে ভাবা হয় পালানোর পথ। অথচ ঋষিদের দর্শন বলে—সত্যিকারের মুক্তি পালিয়ে যাওয়ায় নয়, নিজেকে জানায়। সংসারে থেকেও আত্মাকে অনুভব করা যায়। কারণ আত্মা সর্বত্র, আর ব্রহ্ম ও জগত এক।


ঋষিদের জীবনের কেন্দ্র ছিল জিজ্ঞাসা—“কে আমি?” এই প্রশ্নের গভীরতাই তাঁদের সমস্ত সাধনার ভিত্তি। আজকের দিনে এই প্রশ্নই হারিয়ে গেছে। মানুষ নিজের নাম জানে, পদবী জানে, জাতি জানে, পেশা জানে, কিন্তু নিজের সত্তা জানে না। এই না-জানার অন্ধকারেই জন্ম নেয় ভয়, লোভ, হিংসা, অশান্তি। ঋষিরা বলেন—এই অন্ধকার দূর করতে হলে জ্ঞান চাই, আর সেই জ্ঞান কেবল বই থেকে আসে না, আসে অন্তর্জ্ঞান থেকে।


এই জন্যই বেদের অন্যতম ধ্রুববাক্য—“তমসো মা জ্যোতির্গময়”—আমাকে অন্ধকার থেকে আলোয় নিয়ে চলো। এই আলো বাইরের আলো নয়—এটি আত্মার বোধের আলো, যেটি জ্বলে ওঠে যখন মানুষ অন্তরে দেখে নিজের চেতনাকে, যখন সে টের পায়—সে কোনো সীমাবদ্ধ অস্তিত্ব নয়, সে অনন্ত চেতনার অংশ।


ঋষিগণ প্রকৃতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তাঁরা গাছ, নদী, পশুপাখিকে আত্মীয় বলে ভাবতেন। তাঁদের কাছে প্রকৃতি ছিল শিক্ষক, সাধনক্ষেত্র, ঈশ্বরের প্রকাশ। এই দৃষ্টিভঙ্গি আজকের পরিবেশ-সংকটে এক নতুন আলো এনে দেয়। যদি আমরা প্রকৃতিকে আবার সেইভাবে দেখি—ঋষিদৃষ্টিতে—তাহলে এই পৃথিবীর ও নিজেদেরও উদ্ধার হতে পারে। ঋষিদের কাছে পৃথিবী কোনো বস্তু নয়, এটি এক জীবন্ত শক্তি, যাকে বলা হয় ভূমাতা। আধুনিক বৈজ্ঞানিক চিন্তা আজও যা উপলব্ধি করতে পারেনি, ঋষিগণ হাজার বছর আগে তা প্রাণ দিয়ে উপলব্ধি করেছিলেন।


তাঁদের শিক্ষা ছিল মৌন, গভীর, হৃদয়গ্রাহী। তারা কোনও বাহ্যিক প্রমাণে বিশ্বাস করতেন না, বরং প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার ওপর জোর দিতেন। তারা বলেননি—"আমার কথা মানো", বরং বলেছেন—"নিজে অনুসন্ধান করো"। এই অনুসন্ধানের পথই সাধনা, এই পথই আত্মজ্ঞান, এই পথই মুক্তি।


ঋষিদের এই নিরাভরণ, নির্মোহ, গভীর জীবন আজকের মানুষের জন্য সবচেয়ে বড় দৃষ্টান্ত। যদি আমরা আজ সেই জীবনশৈলীর কিছু অংশ গ্রহণ করতে পারি—মনকে সংযত করতে পারি, প্রকৃতিকে আপন করে নিতে পারি, হৃদয়ে নিরন্তর এক জিজ্ঞাসা বাঁচিয়ে রাখতে পারি—তাহলে আমাদের মধ্যেও সেই ঋষিত্ব জেগে উঠবে।


ঋষি হবার জন্য দরকার নেই আশ্রমে যাওয়ার, দরকার আত্মমুখিতা। দরকার কিছু নীরবতা, কিছু নির্জনতা, কিছু ধ্যান, কিছু হৃদয়ের প্রার্থনা। আধুনিক জীবনেও আমরা ঋষিপথে চলতে পারি, যদি আমরা নিজেদের জীবনের মূল উদ্দেশ্যকে ভুলে না যাই। যদি আমরা অন্তরজগতের ভাষা শুনতে পারি। আর তখনই আমরা বুঝব—ঋষিরা কোনো কালের জন্য নয়, তাঁরা কালাতীত। তাঁরা শুধু অতীতের স্মৃতি নন, তাঁরা ভবিষ্যতের দিশারী।


ঋষিদের সেই বোধ, সেই পথ, সেই অভিজ্ঞতা, আজও প্রতিটি মানুষের মধ্যে সম্ভাবনা হয়ে জেগে আছে। শুধু দরকার সেই আলো জ্বালিয়ে দেওয়া, যা তাঁরা হাজার বছর আগে জ্বালিয়ে গিয়েছিলেন। সেই আলোয় আলোকিত হলে, আমাদের জীবনও হয়ে উঠবে বেদময়—অর্থাৎ জ্ঞানময়, প্রেমময়, সত্যময়।


✍️ ব্যাখ্যাঃ রতন কর্মকার

(whatsapp: +8801811760600)

Post a Comment

0 Comments