Recent Posts

6/recent/ticker-posts

বালুচিস্তানের হিংলাজ পীঠ

 



*#বালুচিস্তানের_হিংলাজ_পীঠ

আজ আলোচনা করব আজকের ভারতের সীমানার বাইরের, প্রাচীন গান্ধার দেশের এক শক্তিপীঠের কথা। বর্তমান পাকিস্তানের বালুচিস্তান প্রদেশে রয়েছে একান্ন পীঠের অন্যতম, হিংলাজ মহাপীঠ। একান্ন পীঠের পৌরাণিক ব্যাখ্যা অনুযায়ী এখানে সতীর ব্রহ্মরন্ধ্র পড়েছিল। 

হিংলাজ পীঠ বালুচিস্তানের লাসবেলা জেলায় হিঙ্গোল জাতীয় উদ্যানের মধ্যে এক গভীর গিরিখাতে পাহাড়ের গুহায় অবস্থিত। গিরিখাতের মধ্য দিয়ে হিংলাজ পীঠের গুহাকে পশ্চিমতীরে রেখে বয়ে যাওয়া নদীটির নামও হিঙ্গোল। 

বর্তমান যুগে যাতায়াত ব্যবস্থার অনেক উন্নতি হওয়ায় হিংলাজ যাত্রা তুলনায় সহজ হয়েছে; তবে আগে হিংলাজ একান্ন পীঠের মধ্যে সবচেয়ে দুর্গম পীঠগুলির একটি ছিল। কালিকানন্দ অবধূত মহাশয়ের 'মরুতীর্থ হিংলাজ' বইটিতে হিংলাজ যাত্রার বর্ণনা পাওয়া যায়। লেখক তেরোশো তিপ্পান্ন বঙ্গাব্দের আষাঢ় মাসে করাচি থেকে হিংলাজের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেন। সেযুগে করাচি শহর থেকে দল বেঁধে রওনা হয়ে হাব নদী পেরিয়ে হেঁটে ষোলদিনের পথ পেরিয়ে হিংলাজ পৌঁছাতে হত। স্থানীয় কিছু মানুষ বংশানুক্রমে এই যাত্রায় তীর্থযাত্রীদের পথপ্রদর্শকের কাজ করতেন; যাত্রায় তাঁদের হাতে থাকত হিংলাজ থেকে আনা একটি গাছের ডাল, তাই তাঁদের 'ছড়িদার' বলা হত। জনমানবশূন্য মরুভূমি, কাঁটাবন, নদী-পাহাড় পার হয়ে ছিল পথ। পথে জল, খাদ্যের অভাবে, মরুভূমিতে পথ হারিয়ে, দস্যুর আক্রমণে, রোগে বহু মানুষের মৃত্যু হত। বর্ষায় পথের নদীগুলিতে জল আসার আগেই যাত্রা শেষ করে করাচি ফিরতে না পারলে সঙ্গের রসদ ফুরিয়ে গিয়ে না খেয়ে মরতে হত। সব মিলিয়ে, হিংলাজ ভ্রমণ সম্পূর্ণ করে ফিরে আসা অতি অল্প পুণ্যার্থীর ভাগ্যেই ঘটত। এখন অবশ্য গাড়িতে করাচি থেকে মাত্র চার ঘন্টাতেই হিংলাজ পৌঁছানো সম্ভব। তাই ইদানীং বহু মানুষ হিংলাজ যান, এপ্রিল মাসে চারদিনের একটি বিশেষ হিংলাজ যাত্রা উৎসব হয়।

হিংলাজ পীঠেশ্বরী হিংলাজ মাতা তন্ত্রে হিঙ্গুলা বা কোট্টরী নামেও পরিচিত। হিংলাজ উপত্যকাটি প্রকৃতির এক বিস্ময়। গুহামন্দিরে পৌঁছানোর পথে কাছাকাছি চন্দ্রকূপ পাহাড় দেবীর ক্ষেত্রপাল ভৈরবরূপে পূজিত; আগে তীর্থযাত্রীরা হিংলাজ উপত্যকায় প্রবেশের আগে চন্দ্রকূপ পাহাড়ে পুজো দিতেন বিশেষ উপাচারে, যার মধ্যে শুকনো নারকোল অন্যতম। ভক্তদের বিশ্বাস অনুযায়ী, চন্দ্রকূপ ভৈরবের কাছে জীবনের যাবতীয় পাপ নিজমুখে স্বীকার করলে পাপমুক্তি হয়। চন্দ্রকূপে পাপ স্বীকার করে শুদ্ধ হলে তবেই হিংলাজ মাতার কাছে যাওয়ার অধিকার হয়। এই চন্দ্রকূপ পাহাড় প্রকৃতপক্ষে একটি 'মাড ভলক্যানো' - পাহাড়ের মাথার গহ্বর দিয়ে মাটির তলা থেকে অনবরত উত্তপ্ত ফুটন্ত কাদার স্রোত নির্গত হচ্ছে। সেই কাদার প্রস্রবণের মুখই চন্দ্রকূপ দেবের রূপ। অন্যদিকে হিংলাজের উপত্যকা, হিংলাজের গুহার তলদেশ আবার প্রাকৃতিক গ্যাসের এক বিপুল সঞ্চয় ধারণ করে রেখেছে। গুহার ভিতরে মায়ের আদি রূপ প্রকৃতপক্ষে সেই ভূগর্ভের গ্যাসের তেজে জ্বলতে থাকা এক অনির্বাণ অগ্নিশিখা। সেই অগ্নিশিখাকেই মা হিঙ্গুলা জ্ঞানে পুজো করা হয়ে আসছে। সমগ্র উপত্যকাটিকেই তাই মায়ের মূর্ত রূপ মনে করা হয়, এই উপত্যকার প্রতিটি গাছ-পাথর পবিত্র ভক্তদের কাছে। মরুভূমির মধ্যে অগ্নিরূপা হিংলাজ মাতা ও তাঁর ভৈরব চন্দ্রকূপের আগ্নেয় রূপ - যেন চারপাশের পরিবেশের সঙ্গে সাযুজ্য রেখেই ভীষণ, অগ্নিময়।

হিংলাজ মাতা স্থানীয় ভাষায় 'বিবি নানী' নামেও পরিচিত। নামটি কুষাণযুগের সিংহবাহিনী নানা দেবীর থেকে আসা সম্ভব। আবার বালুচিস্তানে সিন্ধু সভ্যতার অংশ একটি দুর্গনগরীর সন্ধান মিলেছে, যার গঠন অনেকটা তন্ত্রোক্ত যন্ত্রের মতই। এই অঞ্চলে দেবী ইনন্নার পুজো হত, সম্ভবত ইনন্না থেকেই 'নানা' নামটি এসেছে। ইনন্না আবার সুমেরীয় দেবতাদের আদিমাতা ও চন্দ্রদেবতার কন্যা, পর্বতবাসিনী। হিংলাজ সম্ভবত উপমহাদেশে সিংহবাহিনী, গিরিনন্দিনী মাতৃকার উৎসরণের আদিপীঠ। আবার অগ্নিশিখার পাশাপাশি হিংলাজের গুহায় একটি সিঁদুরচর্চিত শিলাখণ্ডেও মায়ের পুজো হয়। হিঙ্গুল অর্থই সিঁদুর। এই সিঁদুর হরপ্পা যুগ থেকেই পরমাপ্রকৃতির প্রতীক। অগ্নিশিখা রূপে দেবীর পুজোর প্রথা জালন্ধরের জ্বালামুখী ও নৈনিতালের মা নৈনীকেও মনে করায়। নৈনী নামটিও 'নানা' থেকে আসা সম্ভব।

আরেকটি কিংবদন্তির কথা বলে শেষ করি। বলা হয়, পরশুরামের ক্ষত্রিয়কুল সংহারের সময়ে ক্ষত্রিয়দের একাংশ হিংলাজ মায়ের শরণ নেন। মা ভয়ঙ্করী রৌদ্ররূপে পরশুরামকে প্রতিরোধ করেন। সেই থেকে দেবী ক্ষত্রিয়দের কোনো কোনো সম্প্রদায়ের কুলদেবী - এমন বলা হয়। এই কাহিনী বিশেষ ইঙ্গিতবাহী, সন্দেহ নেই। সম্ভবত অবৈদিক তন্ত্রধর্মীয়দের উপর বৈদিক আগ্রাসনের একটি প্রচেষ্টা এখানে সেসময় প্রতিহত হয়।

বালুচিস্তান সেই প্রাচীন যুগ থেকে মাতৃসাধনার পীঠস্থান ছিল। তন্ত্রাশ্রিত মহাযান বৌদ্ধধর্ম এখানে জনপ্রিয় হয়েছিল। ইসলামিক মৌলবাদ সেই অতীতকে মুছে ফেলতে চেয়েও সফল হয়নি। মরুভূমির বুকে অগ্নিশিখা হয়ে মা হিংলাজ আজও অধিষ্ঠান করছেন। 

বাঙালির মাতৃধর্মের পীঠস্থান এভাবেই উপমহাদেশ জুড়ে ছড়িয়ে। তিনি নগরে প্রান্তরে জলে স্থলে সর্বত্র। তিনি স্বয়ং পরমাপ্রকৃতিরূপা আদ্যাশক্তি।

জয় মা।

ছবিতে দর্শন করুন হিংলাজ মায়ের শিলাময়ী রূপ।

(কৃতজ্ঞতা : রক্তিম মুখার্জি, তমাল দাশগুপ্ত)

Post a Comment

0 Comments