Recent Posts

6/recent/ticker-posts

"নমস্কার" এর যোগতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ

 



"নমস্কার" এর যোগতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ

*#নমস্কার বা প্রণাম—যা আমাদের প্রতিদিনকার জীবনে একটি সাধারণ অভিবাদনের রূপে প্রতিভাত হয়—তার অন্তর্নিহিত তাৎপর্য যদি যোগতত্ত্বের আলোকে বিশ্লেষণ করা হয়, তাহলে বোঝা যায় এটি একটি গভীর সাধনার একান্ত অঙ্গ। যোগশাস্ত্রে প্রতিটি শারীরিক ভঙ্গি, মনোভাব এবং চেতনার গতি একটি নির্দিষ্ট শক্তিপথ বা নাড়ী-র সঙ্গে যুক্ত। সেই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে নমস্কার একটি শক্তিসঞ্চালনের সূক্ষ্ম প্রক্রিয়া, যেখানে শরীর, মন ও আত্মা একত্রিত হয়ে পরম চেতনার দিকে ধাবিত হয়।

*#যোগতত্ত্বে দুই হাত জোড় করে বুকে বা কপালে ঠেকানোকে বলে আঞ্জলি মুদ্রা—যার আক্ষরিক অর্থ ‘উপহার বা অর্ঘ্য প্রদান’। এই মুদ্রাটি আমাদের মধ্যে বিরাজমান ইড়া ও পিঙ্গলা নাড়ীকে সামঞ্জস্যে আনে। ইড়া হল চন্দ্রনাড়ী—শীতল, গ্রহণশীল, মানসিক; আর পিঙ্গলা হল সূর্যনাড়ী—উষ্ণ, উদ্দীপক, কর্মপ্রবণ। যখন দুই হাত জোড় করা হয়, তখন এই দুই বিপরীত শক্তি একত্রে মিলিত হয়—তৃতীয় শক্তি, অর্থাৎ সুষুম্না নাড়ী সক্রিয় হয়, যা আমাদের কেন্দ্রীয় চেতনাপথ।

এই সুষুম্না নাড়ীই হল যোগসাধনার রাজপথ—যা মূলাধার থেকে ব্রহ্মরন্ধ্র পর্যন্ত প্রসারিত। নমস্কার সেই সুষুম্নাকে সক্রিয় করার এক অতি সরল কিন্তু গভীর পদ্ধতি।

*#নমস্কার করার সময় আমরা মূলত দুটি গুরুত্বপূর্ণ চক্রকে জাগ্রত করি—অনাহতা চক্র (হৃদয় কেন্দ্র) ও আজ্ঞা চক্র (ভ্রূমধ্য)।

অনাহতা চক্র প্রেম, সহানুভূতি ও ঈশ্বরভক্তির কেন্দ্র। আজ্ঞা চক্র হলো সিদ্ধান্ত, জ্ঞান ও অন্তর্দৃষ্টির কেন্দ্র। যখন আমরা হাত বুকে রাখি, তখন হৃদয় থেকে অনুভূতি জাগে। আবার কপালে হাত ঠেকালে তা গুরু বা ঈশ্বরজ্ঞানের প্রতি আত্মসমর্পণের চিহ্ন হয়ে দাঁড়ায়। এই দুই চক্রের মিলনে একটি সম্পূর্ণ আধ্যাত্মিক পরিবাহ তৈরি হয়, যেখানে ভক্তি ও জ্ঞান একসূত্রে গাঁথা হয়।

*#যোগশাস্ত্রে ‘ওঁ’ ধ্বনি হল সর্বশ্রেষ্ঠ মন্ত্র, যা তিনটি ধ্বনির সমন্বয়—অ + উ + ম = ওঁ। এই ধ্বনির গতিপথ অনুরূপ অনাহত থেকে আজ্ঞা হয়ে সহস্রার পর্যন্ত বিস্তৃত। নমস্কারের অভ্যন্তরীণ গতিপথও ঠিক তেমন। প্রণামের সময় শরীরের ঝুঁকে পড়া, দুই হাতের সংযোগ, মস্তিষ্ক ও হৃদয়ের কেন্দ্রীভূত মনোযোগ—এই সব মিলিয়ে একটি ধ্যানময় পরিবেশ তৈরি হয়, যা আমাদের চেতনার ওঁ স্পন্দনের সঙ্গে সামঞ্জস্যতা রচনা করে।

*#নমস্কার একরকম প্রণবসাধনার অভিব্যক্তি। এটি শব্দহীন ‘ওঁ’-র অনুরণন—যেখানে শরীর হল অকার, হৃদয় উকার এবং কপাল বা সহস্রার মকারের প্রতিনিধিত্ব করে।

যোগের মূল উদ্দেশ্য হল অহং (অহঙ্কার বা পৃথক সত্তা)-কে ত্যাগ করে আত্মার (সর্বজনীন সত্তা) সঙ্গে মিলন ঘটানো। নমস্কার করার সময় আমরা আত্মকে অবনত করি, এবং এটি কেবল দেহের নমন নয়—বরং ‘আমি’ ভাবের নমন। এই নত হওয়া নিজেকে ক্ষুদ্র ভাবার জন্য নয়, বরং মহত্ত্বের কাছে আত্মসমর্পণের জন্য। এই আত্মসমর্পণই যোগের মূল দর্শন—যেখানে ‘পৃথক আমি’ বিলীন হয়ে যায় ‘সমগ্র আমি’তে।

এই কারণে অনেক আধ্যাত্মিক পথিক বলেন, যোগের চূড়ান্ত স্তর হল নমস্কার যোগ—যেখানে সাধক জ্ঞানে, ভক্তিতে, কর্মে বা ধ্যানে যতই সিদ্ধ হন না কেন, শেষ পর্যন্ত তাঁকে মাথা নত করতে হয়; কেবলমাত্র সেই নত হওয়াতেই মেলে চূড়ান্ত মুক্তি।

*#যোগতত্ত্বে কুন্ডলিনী শক্তি মূলাধারে সুপ্ত অবস্থায় থাকে এবং ধীরে ধীরে চক্রসমূহ জাগ্রত করে উপরে ওঠে। নমস্কারের মাধ্যমে সুষুম্না সক্রিয় হওয়ায় এই কুন্ডলিনী শক্তির গতি প্রভাবিত হয়। প্রতিবার প্রণামের সময় মনের যে নিরব অবনমনা, তা মুলত কুন্ডলিনীর আরাধনা। কারণ সেই অবস্থায় মন, প্রান ও চেতনা এক বিন্দুতে স্থির হয়। এই স্থিরতাই কুন্ডলিনীকে আহ্বান করে।

*#যোগতত্ত্বে নমস্কার শুধুমাত্র একটি দেহভঙ্গি বা মনের নম্রতা নয়—বরং এটি শরীর, মন, প্রাণ ও আত্মার সম্মিলিত চেতনা। এই চেতনা তখনই পরিপূর্ণ হয়, যখন আমরা নমস্কারকে শুধুমাত্র আচার বলে না মেনে, তা-কে আত্মার এক নিঃশব্দ আরাধনা রূপে আত্মস্থ করি। নমস্কার তাই এক অনন্ত যোগ—যেখানে অহং নত হয়, চেতনা জাগে, এবং ব্যক্তি আত্মা বিশ্ব আত্মায় মিলিত হয়। এই মিলনই যোগের সার, নমস্কারের সিদ্ধি।

✍️ রতন কর্মকার

Post a Comment

0 Comments