স্তব্ধতায় সত্তার সন্ধানে
সমস্ত শব্দ, চিন্তা, ব্যস্ততা এবং উদ্বেগ যখন স্তব্ধ হয়ে যায়, তখন মনের মধ্যে উদ্ভাসিত হয় এক গভীর নিরবতা। এই নিরবতা শুধু বাহ্যিক নয়, এটি এক অন্তর্জগতিক স্তর যেখানে ব্যক্তি নিজেকে অনুভব করে জগতের কোলাহল থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত। এই স্তরেই আত্মা প্রবেশ করে এক নিঃশব্দ অভিজ্ঞতায়, যেখানে জাগতিক ধ্বনির বদলে ধরা দেয় আধ্যাত্মিক প্রশান্তি।
এই স্তব্ধতার মধ্যে চরাচর—অর্থাৎ সারা সৃষ্টি—জেগে ওঠে এক অভ্যন্তরীণ শান্তিতে। প্রকৃতি তখন কোলাহলহীন হয়ে ওঠে না, বরং আমাদের মন তখন এতটাই শান্ত হয়ে যায় যে প্রকৃতির সত্য স্বরূপ অনুভব করা যায়। তখন মনে হয়, সব কিছু যেন এক ছন্দে স্থির—গভীর ধ্যানমগ্ন। এটি সেই অবস্থান যেখানে অন্তরের শান্তি চরাচরের সঙ্গেও মিল খুঁজে পায়। মনে হয়, সৃষ্টির প্রতিটি কণা যেন এক অপার নীরবতায় ভাসছে, আর সেই নীরবতা প্রকৃতির সঙ্গে ব্যক্তিকেও যুক্ত করে এক অপূর্ব ঐক্যে।
এই ঐক্যের অভিজ্ঞতা তখন এমন এক উপলব্ধিতে রূপ নেয়, যেখানে ব্যক্তি অনুভব করে সে আর আলাদা কিছু নয়। সে নিজেই সেই বৃহত্তর সত্তার মধ্যে বিলীন, অথচ নিজেকে হারায়নি। একা থাকলেও সেখানে কোনো ভয় নেই, কারণ সেই একাকিত্বের মধ্যে ঈশ্বরের চেতন উপস্থিত। এই একাকিত্ব পরিত্যক্তির অনুভব নয়, বরং চরম নিরাপত্তা—যেখানে কেউ জানে সে চিরন্তন সত্তার অঙ্গে অবস্থান করছে।
সেই সত্তা কোনো একটি জায়গায় সীমাবদ্ধ নয়। তিনি রয়েছেন সমস্ত মহাবিশ্বে, স্থান ও কালের বাইরে। সমস্ত সৃষ্টি, সমস্ত স্থান ও সময়—সবকিছুতেই তাঁর বিস্তার। ব্যক্তি যখন নিজের ভিতরে সেই বিস্তারের স্পর্শ পায়, তখন সে আর নিজেকে ক্ষুদ্র মনে করে না। তার ভেতরের ‘আমি’ তখন মিশে যায় চেতন মহাসত্তার সঙ্গে, যে আছেন সমস্ত মহাশূন্যে, অনন্ত কালের ধারায়, এবং সৃষ্টি-লয়ের অবিচ্ছিন্ন চক্রে।
এই উপলব্ধি কোনো বইয়ে লেখা থাকে না, কোনো শাস্ত্র পাঠে পাওয়া যায় না। এটি এক গভীর ধ্যান, আত্মসমর্পণ এবং নিজেকে পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে আসে। তখন ব্যক্তি বুঝে নেয়—সে একা নয়, সে সেই একেরই অংশ, এবং সেই এক চেতনা সর্বত্র বিরাজমান।
এই উপলব্ধিই প্রকৃত মুক্তি, আত্মজ্ঞানের দ্বার। এটি এমন এক আত্মিক অবস্থান, যেখানে ভয়, দ্বন্দ্ব বা বিচ্ছিন্নতার আর কোনো স্থান থাকে না। কেবল থেকে যায় এক নীরব, নির্ভয়, সর্বব্যাপী সত্তা—যার মধ্যে ব্যক্তি নিজেকে নিঃশঙ্ক চিত্তে খুঁজে পায়।
✍️ রতন কর্মকার
(+8801715982155)
0 Comments