Recent Posts

6/recent/ticker-posts

রাধাকৃষ্ণের মিলন: অন্তঃসত্তায় আত্মজ্ঞান ও চৈতন্যের অভ্যুদয়

 





রাধাকৃষ্ণের মিলন: অন্তঃসত্তায় আত্মজ্ঞান ও চৈতন্যের অভ্যুদয়

আমরা যখন ‘রাধাকৃষ্ণ’ কথাটি শুনি, তখন আমাদের মনে প্রেমের, ভক্তির, ও রূপকথার এক অপার সৌন্দর্য ভেসে ওঠে। কিন্তু এই রাধাকৃষ্ণ কেবল ব্রজমণ্ডলের লীলাত্মক সম্পর্ক নয়, বরং অন্তর্জগতের গভীরতর এক আধ্যাত্মিক প্রতীক। আমাদের মন, প্রাণ, চেতনা ও সাধনার অন্তর্গত এক ঐক্যবদ্ধ সুর এই ‘রাধাকৃষ্ণ’—যেখানে মিলিত হয় বহির্মুখী মন ও অন্তরস্থ প্রাণ, বহিরঙ্গ চিন্তা ও অন্তঃস্থিত চৈতন্য।

চঞ্চল মন কখনোই সত্যের ধ্যান ধারণ করতে পারে না। সে ছুটে বেড়ায় বাহ্যজগতের নানা প্ররোচনায়, আকর্ষণে, ভয় ও বাসনায়। এই মন যখন ক্রমে ধ্যান ও সাধনার দ্বারা স্থির হয়—সেই মুহূর্তেই এক অভ্যুদয় ঘটে। সেই স্থির চৈতন্যই কৃষ্ণ।কৃষ্ণ এখানে কোনো বাহ্যিক রূপ নয়, বরং এক অচঞ্চল প্রাণচৈতন্য—যিনি সবকিছুর মধ্যেই আছেন, কিন্তু নিজে সকল প্রলয়ে স্থির, নির্লিপ্ত, এবং অনাদি।

চঞ্চলহীন মনই কৃষ্ণ— এটিই কৃষ্ণতত্ত্বের সার। আমাদের মনপ্রবাহ, চিন্তার ধারা সাধারণত বাইরে প্রবাহিত হয়—বস্তু, মানুষ, ঘটনা, ভবিষ্যতের দুশ্চিন্তা ও অতীতের স্মৃতির দিকে। এই বহির্মুখী স্রোতই সংসার। কিন্তু যখন এই স্রোত ফিরে আসে অন্তরলোকে—অর্থাৎ চেতনার গভীরে প্রবেশ করে, তখনই তা হয়ে ওঠে রাধা। রাধা মানে ‘যিনি ধাবিত হন’, কিন্তু এবার তাঁর গন্তব্য কৃষ্ণ, অর্থাৎ প্রাণচৈতন্য।

রাধা তাই শুধুমাত্র প্রেমিক নয়, রাধা হলেন শক্তি, ভাব, আকর্ষণ ও আত্মসন্ধানী চিন্তার প্রতীক। রাধার কৃষ্ণ-সন্ধান মানেই আত্মার চৈতন্যে প্রত্যাবর্তন।

যখন ভাবধারা অন্তর্মুখী হয়ে যায় এবং প্রাণচৈতন্যে স্থিত হয়—তখনই সেই মিলন ঘটে, যাকে বলে ‘রাধাকৃষ্ণের মিলন’। এ মিলন শরীরের নয়, মনের নয়—এ হল আত্মার সঙ্গে আত্মার, চিন্তার সঙ্গে চৈতন্যের, শক্তির সঙ্গে সদা-স্থিত প্রাণের মিলন। এই মিলনের ফল হল আত্মজ্ঞান। সেই মুহূর্তেই আমরা বুঝতে পারি—“আমি কে?”—এই অনন্ত প্রশ্নের এক মৌন জবাব।

এই অবস্থায় মানুষ নিজের মধ্যেই ঈশ্বরের সান্নিধ্য পায়। তাই বলা হয়— নর নারায়ণ।অর্থাৎ, প্রতিটি মানুষের মধ্যেই অবস্থান করছেন সেই নারায়ণ—যিনি চৈতন্যস্বরূপ। বাহিরে তাঁকে খোঁজা বৃথা, কারণ তিনি হৃদয়দেশে অধিষ্ঠিত।

কিন্তু মন তো সহজে স্থির হয় না। তাই প্রয়োজন ধ্যান। ধ্যান মানে শুধু বসে চোখ বন্ধ করে থাকা নয়, ধ্যান মানে হল ‘মনকে নিজের অন্তঃকেন্দ্রে ফিরিয়ে আনা’। ধ্যান মানেই চেতনার সেই গভীরতর স্তরে পৌঁছনো, যেখানে কৃষ্ণ আছেন। এই চঞ্চল মন যখন ধ্যানের মাধ্যমে কূটস্থ চৈতন্যে স্থির হয়—তখনই কৃষ্ণপ্রাপ্তি ঘটে।

এই ধ্যানই হল রাধার কৃষ্ণে পৌঁছনোর যাত্রা।

যখন এই আত্মজ্ঞান অর্জিত হয়, তখন দেখা যায়—সব মানুষের মধ্যেই সেই এক ‘প্রাণকৃষ্ণ’ বর্তমান। তখন আর বিভেদ থাকে না। তখন জাতি, ধর্ম, শ্রেণি, ভাষা সব বিলীন হয়ে যায়। তখন শুধু এক অনুভব থাকে—“সকলেই আমার, আমি সকলের।” এই অবস্থায় পৌঁছেই সাধক অনুভব করে—সত্যিকারের মুক্তি মানেই বিভেদের অন্ত।

কিন্তু এই রূপান্তরের জন্য চাই এক সৎগুরু। গুরু ছাড়া আত্মজ্ঞান সম্ভব নয়। গুরু মানে শুধু বাহ্যিক শিক্ষক নয়, গুরু হলেন সেই অভ্যন্তরীণ আলোক, যিনি শিষ্যকে আত্মস্বরূপের দিকে চালিত করেন। তাই বলা হয়— গুরু ছাড়া নিজেকে জানা অসম্ভব। গুরুই সবকিছু। গুরু সেই সেতু যাঁর মাধ্যমে রাধা তাঁর কৃষ্ণে পৌঁছায়, শিষ্য তাঁর চৈতন্যে মিলিত হয়, নর হয়ে ওঠে নারায়ণ।

এই সাধনার পথের যিনি যাত্রী, যিনি নিজেকে রূপান্তরিত করতে উদ্যোগী, তিনিই প্রকৃত দেবতা। কারণ দেবতা মানেই শক্তি ও চৈতন্যের একতা। প্রতিমা নয়, উপাসক নিজেই তখন ঈশ্বর-রূপে জাগ্রত হন।

রাধাকৃষ্ণের মিলন কাহিনি কোনো মিথ নয়, কোনো পুরাণ নয়। এটি মানুষের আত্মার অন্তর্গত এক অনন্ত যাত্রা। এটি সেই পথ, যেখানে বহির্মুখী রাধা অন্তর্মুখী হয়ে কৃষ্ণে মিলিত হন, যেখানে ভাব ও চৈতন্য একত্রিত হয়ে জাগিয়ে তোলে আত্মজ্ঞান। সেই মিলনের মাধ্যমে মানুষ বুঝে ফেলে—তার মধ্যেই রয়েছে নারায়ণ, কৃষ্ণ, গুরু এবং দেবতা।

এই উপলব্ধিই চূড়ান্ত মোক্ষ। এই মিলনই প্রকৃত যোগ। এই চেতনা-রূপ কৃষ্ণই মানবজীবনের পরম অর্থ।

✍️ রতন কর্মকার

(+8801811760600)

Post a Comment

0 Comments