Recent Posts

6/recent/ticker-posts

কালা যাদু (পর্ব: ০৩) অসুখহীন অসুখের ছায়া

 



কালা যাদু

(পর্ব: ০৩) অসুখহীন অসুখের ছায়া

*#কালা_যাদু

পর্ব: ০৩

অসুখহীন অসুখের ছায়া

আমার মায়ের নাম শোভা কর্মকার। সবার কাছে তিনি ছিলেন এক আত্মত্যাগী, পরিশ্রমী, নম্র স্বভাবের নারী—যিনি সারাজীবন নিজের প্রয়োজনের থেকে সংসারের প্রয়োজনকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। ছেলেমেয়ের ভবিষ্যৎ, স্বামীর সম্মান আর সংসারের চাকা যেন তার সমস্ত স্বপ্নের কেন্দ্রবিন্দু।

আমরা যদি একপলক তাকাতাম মায়ের চোখে, তাহলে দেখতে পেতাম এক গভীর সমুদ্র—যেখানে ত্যাগ, যন্ত্রণা আর ভালোবাসার ঢেউ একসঙ্গে হাহাকার করে। কিন্তু মা নিজে কিছু বলতেন না। বলতেন না, কারণ তার মুখে সবসময় হাসি থাকত।

তবে এই মুখের হাসি, চোখের উজ্জ্বলতা, কণ্ঠের প্রশান্তি—সব কিছু অদ্ভুতভাবে ফিকে হয়ে যেত একেক সময়। মা প্রায়ই অসুস্থ হয়ে পড়তেন।

না, সেটা সাধারণ অসুস্থতা ছিল না। কোনো জ্বর, ঠান্ডা বা মাথাব্যথা নয়। এটা ছিল এমন একধরনের অসুস্থতা যার ব্যাখ্যা আমরা খুঁজে পেতাম না, ডাক্তাররাও না।

মাঝেমধ্যে হঠাৎ করে মা ক্লান্ত হয়ে পড়তেন, যেন দিনের পর দিন না খেয়ে থেকেছেন। একদিন সকালে রান্নাঘর থেকে এসে বলতেন, “হাঁটতে পারছি না জয়ন্ত, শরীর যেন শুন্য হয়ে গেছে।”

আমরা ভেবেছি—শরীরে রক্ত কমে গেছে হয়ত, আয়রনের অভাব, কিংবা অন্য কোন গোলমাল।

নিয়ে যেতাম হাসপাতালে। ডাক্তাররা একের পর এক টেস্ট করাতেন। ব্লাড প্রেশার, সুগার, থাইরয়েড, আলট্রাসোনো, হার্ট, কিডনি—সব কিছুই করা হতো। কিন্তু শেষে রিপোর্ট হাতে পেয়ে তারা বলতেন—“রোগী একদম সুস্থ, কোনো অসুস্থতা নেই।”

তখন কেমন যেন একটা বোবা কান্না ছড়িয়ে যেত মায়ের মুখে। যেন শরীরের যন্ত্রণাকে প্রমাণ করতে না পারা, তাকে আরও বেশি অসুস্থ করে দিচ্ছে।

আর আমাদের দিকে তাকিয়ে বলতেন, “সবাই বলে শরীর ঠিক আছে। তাহলে এই শরীরটা কেন আমাকে বয়ে বেড়াতে ভারী লাগছে?”

শুধু একবার না—প্রতি ৩/৪ মাস পর পর এই দৃশ্য আমরা দেখেছি। মা অসুস্থ, হাসপাতালে ভর্তি, নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা—আর শেষে “কিছু ধরা পড়েনি” বলে ছুটি। কিন্তু সেই কয়েকদিনে যা খরচ হতো, তা আমাদের সঞ্চয়ের অনেকটাই চলে যেতো।

আমরা যতবার কিছুটা টাকা জমিয়ে কিছু করার কথা ভাবতাম, বা নতুন কিছু কেনার পরিকল্পনা করতাম, ঠিক তার কিছুদিন পরেই মা অসুস্থ হয়ে যেতেন।

আমার ভেতরে তখন ক্ষোভের আগুন জ্বলতে থাকত। কারা করল এমন অভিশাপ? কেন আমাদের বারবার শুধু অস্পষ্ট রোগ আর অসহায়তার মধ্যে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে?

একদিন মায়ের শয্যার পাশে বসে জিজ্ঞেস করেছিলাম, “মা, তুমি কি কিছু টের পাও? এমন হয় কেন বারবার?”

মা একটু চুপ করে থেকে বললেন, “জানি না জয়ন্ত... কিন্তু মনে হয় যেন কেউ চায় না আমি বাঁচি... আমার শরীরটা যেন কারো বোঝা হয়ে গিয়েছে। যেন আমাকে আস্তে আস্তে শেষ করে দিচ্ছে...”

আমি স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। সেই চোখে আমি এক ভয় দেখেছিলাম—শুধু রোগভীতি নয়, তারও গভীরে লুকিয়ে থাকা এক আতঙ্ক।

তখন থেকেই আমি অনুভব করতে শুরু করেছিলাম—এই অসুখ কোনো প্রাকৃতিক ব্যাখ্যায় বন্দি নয়। এটা কোনো কৌশল, কোনো ষড়যন্ত্র, যা আমাদের সংসারের অর্থ, শক্তি আর স্থিতি ধীরে ধীরে চুষে নিচ্ছে।

আমার আত্মীয়দের পরিবার ছিল আশেপাশেই। খুব কাছের। কিন্তু কেমন যেন দূরত্বের দেয়াল উঠেছিল ধীরে ধীরে। তারা কখনোই খোঁজ নিত না মায়ের, অথচ প্রতিবার শুনতাম, আমরা হাসপাতালে যাওয়ার দিন তারা হঠাৎ খুব ‘বন্দনা’ করেছে, কেউবা নাকি দূরের এক ‘শক্তিশালী’ সাধুর কাছে গেছে মানত করতে।

মা বলতেন, “ওরা মুখে যতই আপন বলে, মনে তাদের আগুন। আমরা একটু উঠে দাঁড়ালেই তারা যেন কষ্ট পায়।”

আমি তখন সবকিছুর মাঝে দাঁড়িয়ে বুঝেছিলাম—আমরা শুধু অসুস্থ হচ্ছি না, আমাদের অর্থ, মনোবল, সংসারের সুখ—সব কিছু ধ্বংসের টার্গেটে পরিণত হয়েছে।

ওরা চায় না আমরা কিছু জমিয়ে রাখতে পারি। ওরা চায়, আমরা সর্বদা চিকিৎসার পেছনে, অকারণ দৌড়াদৌড়ির পেছনে জীবন কাটিয়ে দিই। যেন উঠতে না পারি, দাঁড়াতে না পারি, বাঁচতে না পারি।

আর এই ছায়া—এই কালো ছায়া—যেটা চোখে দেখা যায় না, কিন্তু ঘর জুড়ে থাকে। যেন একটা আত্মা, এক নিষিদ্ধ হাত, যে অদৃশ্য থেকে প্রতিটি নিঃশ্বাসে বিষ ছড়িয়ে দিচ্ছে।

তখনো জানতাম না কীভাবে প্রতিকার পাবো। তখনো মনে শুধু ভরসা ছিল একটাই—ঈশ্বর।

মা প্রতিদিন সন্ধ্যাবেলা ঘরে গঙ্গাজল ছিটাতেন, প্রদীপ জ্বালাতেন, আর গুনগুন করে নারায়ণ স্তোত্র পাঠ করতেন। আমি জানতাম, সেটা কোনো সাইন্টিফিক ওষুধ নয়।

কিন্তু তার মাঝেই কিছু একটা ছিল—যা আমাদের ঘরকে ধসে পড়তে দিচ্ছিল না।

হয়তো সেটা ছিল মায়ের বিশ্বাস।

হয়তো সেটা ছিল ঈশ্বরের কৃপা।

অথবা, হয়তো লড়াইয়ের শেষ কথা তখনো লেখা হয়নি।

ঠিক তখনই, আমাদের জীবনে এক আলো নিয়ে এল আমার বন্ধু—নূর।

নূরের সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব ছোট বেলা থেকে। চুপচাপ, একটু রহস্যময়, কিন্তু চোখে একটা অদ্ভুত দীপ্তি ছিল তার। আমরা কখনো ভাবিইনি, এই ছেলেটাই একদিন আমাদের জীবনের সবচেয়ে অদৃশ্য অথচ ভয়ঙ্কর যুদ্ধের সহযোদ্ধা হয়ে উঠবে।

মায়ের এই অসুস্থতার চক্র যখন আবারও ফিরে এলো, তখন একদিন নূর আমাদের বাড়িতে এল। মায়ের কপালের দিকে তাকিয়ে, কিছুক্ষণ চোখ বুজে রইল। তারপর নিচু গলায় বলল, “জয়ন্ত, কেউ তোমাদের সংসারকে আটকে রাখার জন্য কাজ করছে। এটা সাধারণ অসুখ নয়... এটা প্রেরিত।”

আমি হতবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “তুমি বুঝলে কিভাবে?”

নূর বলল, “আমার পরিবারে কেউ একজন আছেন যিনি আলোকপথের জাদু জানেন—রুহানি দোয়া আর রক্ষার তাবিজ তৈরি করেন। আমি ওনাকেই বলেছিলাম তোমাদের ব্যাপারে।”

তারপর শুরু হলো এক নতুন অধ্যায়। নূর কিছু নির্দিষ্ট দিনে মা’র জন্য সোলেমানিয়া সূরা আর হিন্দু স্তোত্রের মিলিত রক্ষাপাঠ করত। আমাদের ঘরে এনে দিল ছোট ছোট রক্ষাতাবিজ, গঙ্গাজলের সঙ্গে মিলিয়ে দেওয়া এক বিশেষ জল।

এগুলো কোনো ধর্মীয় গোঁড়ামি নয়, বরং বিশ্বাস আর আশ্রয়ের এক নতুন পথ।

ধীরে ধীরে মা’র সেই “অসুখহীন অসুখ” কিছুটা কমতে লাগলো। সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার—সেই আগুনে আত্মীয়দের হঠাৎ দূরত্ব তৈরি হলো,তারা সহজে আমাদের ঘরে পা রাখতো না।

তখনই বুঝেছিলাম—নূর শুধু বন্ধু নয়, এক অদৃশ্য প্রহরী। কালো ছায়ার বিরুদ্ধে যার হাতে ছিল আলোর অস্ত্র। তখন জানতাম না, এই নূর বড় হয়ে এমন একজন সাধক হবে-যে প্রায় সকল সমস্যা সমাধান করতে পারবে।

তবে আমি তখন বুঝতে শিখেছিলাম—কখনো কখনো, শত্রু অদৃশ্য হয়। আর তাকে জিততে না দিতে হলে, তোমাকেও জাগতে হয় ভেতরের ঈশ্বরকে নিয়ে।

চলবে.......................

✍️ রতন কর্মকার

Post a Comment

0 Comments