মা তারা : বোধিসত্ত্বের করুণাসঙ্গিনী
*#বৌদ্ধতন্ত্রের জগতে ‘তারা’ এক অতি গুরুত্বপূর্ণ ও প্রসিদ্ধ দেবী। তিনি কেবল এক কল্পিত সত্তা নন, বরং এক বাস্তবিক জীবনের চরম সঙ্কট থেকে মুক্তির আশ্বাস। তাঁকে বলা হয় ‘অষ্টমহাভয় তারা’, অর্থাৎ যিনি আটটি ভয়ের থেকে উদ্ধার করেন – আগুনে পোড়ার ভয় (অগ্নিভয়), দস্যুর দ্বারা আক্রান্ত হবার ভয় (দস্যুভয়), শত্রুর দ্বারা বন্ধনে আবদ্ধ হবার আশঙ্কা (বন্ধনভয়), জলে ডুবে মৃত্যুর আতঙ্ক (মজ্জনভয়), এমনকি সর্পদংশনের (সর্পভয়) মতো দৈনন্দিন অথচ ভয়ঙ্কর সম্ভাব্য বিপদেরও প্রতিকারক। এই সব ভয় সেকালের মানুষের কাছে কল্পনা নয়, বরং জীবনের অংশ ছিল। তাই তারাকে শুধু দেবী হিসেবে নয়, এক আশ্রয় হিসেবে মান্য করা হতো।
তারাদেবীকে আরো এক নামে ডাকা হয় – ‘মৃত্যুবঞ্চনা তারা’। বিশ্বাস ছিল, তাঁর কৃপায় মৃত্যুও ধরা দিতে পারে না। তাঁকে পূজা করলে প্রাণ অমর হয়। বুদ্ধধর্মের কঠোর জীবনদর্শনের মাঝেও তাই তারারূপী করুণাময়ীর এক শৈথিল্যপূর্ণ প্রতিমূর্তি সৃষ্টি হয়। কিন্তু কালের প্রবাহে এই বৌদ্ধ তারাই হিন্দু শাক্ততন্ত্রে আত্মসাৎ হন ‘দশমহাবিদ্যা’র অন্যতমা রূপে।
শাক্ত ধর্মে তারা কেবল ভয়নাশিনী নন, তিনি ব্রহ্মময়ী। এই ‘ব্রহ্মময়ী’ ধারণা এসেছে আদ্যন্ত উপনিষদীয় ব্যাখ্যান থেকে। শাক্ত পণ্ডিত নীলকণ্ঠের ভাষায়, শক্তিপূজা আদতে ব্রহ্মজ্ঞানের এক রূপ – এক ‘মায়াময়’ আচ্ছাদনের আড়ালে ব্রহ্মোপাসনা। তাই তারার পূজা শুধু ভক্তির বিষয়ে নয়, জ্ঞান ও মুক্তির এক অপরিহার্য পথও। এই দৃষ্টিভঙ্গি বৌদ্ধধর্মের নিরাবেগ উপাসনার থেকে সম্পূর্ণ আলাদা এক অন্তর্গত আবেগ ও রূপের সঞ্চার ঘটায়।
বৌদ্ধ তান্ত্রিক দেবতাদের মধ্যেও এই পরিবর্তনের ধারা লক্ষণীয়। ‘অবলোকিতেশ্বর’ বা ‘লোকেশ্বর’ ছিলেন সবচেয়ে জনপ্রিয় বোধিসত্ত্ব, যাঁর পত্নীরূপে তারার অবস্থান। বোধিসত্ত্ব অবলোকিতেশ্বর এখনো বুদ্ধত্ব লাভ করেননি, কিন্তু নির্বাণের একেবারে দ্বারপ্রান্তে অবস্থান করছেন। এই অবস্থাটি হিন্দু উপনিষদের সেই দর্শনের সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ, যেখানে দেবত্ব এক ট্রানজিটরি অবস্থা – চিরন্তন নয়, ব্রহ্মত্বের পূর্ণ প্রকাশ নয়। এই ভাবনাই পরবর্তীকালে শাক্ততন্ত্রে এক নতুন মাত্রা পায় – যেখানে দেবতারা শুধুই দেবতা নন, তাঁরা ব্রহ্মের অভিব্যক্তি।
বৌদ্ধতন্ত্রের অন্য দেবদেবীরাও এক এক করে হিন্দু তন্ত্রে স্থান করে নেন। যেমন, বৌদ্ধ দেবতা হেরুকা, দেবী একজটা ও নৈরাত্ম্য – যাঁরা মূলত অমূর্ত ভাব বা আধ্যাত্মিক ধারণার প্রতীক, ক্রমে হিন্দু তন্ত্রেও তাঁদের প্রতিচ্ছবি দেখা যায়। আবার মরীচি নামক দেবীর উদাহরণেও দেখা যায় এক সাংস্কৃতিক সংযোগ। বৌদ্ধ মরীচি রথে চড়েন, তাঁর রথ টানে সাতটি শূকর – যেখানে হিন্দু সূর্যদেব মার্তণ্ডের রথ টানে সাতটি ঘোড়া। মরীচির দোর্দণ্ড প্রতাপে হিন্দু দেবতাদের স্তুতিও যুক্ত হয়েছে। এই প্রতিচ্ছবির মধ্যে দিয়ে বোঝা যায় কিভাবে দেবতাত্বের ধারনাগুলি এক ধর্ম থেকে আর এক ধর্মে রূপান্তরিত হয়, আবার নিজস্ব বৈশিষ্ট্যও লাভ করে।
বৌদ্ধদের ‘ষট্কর্ম’ সাধনার অন্যতম দেবী ‘কুরুকুট্টা’ ক্রমে হিন্দুদের ‘ছিন্নমস্তা’ রূপে স্থান পান। বিক্রমপুরের বজ্রযোগিণী মূর্তি আজ ছিন্নমস্তা রূপে দশমহাবিদ্যার অন্যতমা। এই পরিবর্তন শুধু মূর্তির নয়, দর্শনেরও।
একইভাবে ‘গণপতি’ বা ‘গণেশ’-এর অবস্থানেও দেখা যায় পরিবর্তনের রেখা। বৈদিক গণপতি এখন হিন্দুদের অন্যতম ‘পঞ্চোপাস্য’ আরাধ্য, সর্বসিদ্ধিদাতা দেবতা – অথচ বৌদ্ধ ধর্মেও তাঁর এক আলাদা রূপ আছে। বৌদ্ধ তন্ত্রে তিনি বরং অন্তরায়নাশক ও বশীকরণকারী দেবতা।
এখানে যে প্রবাহটি আমরা দেখতে পাই তা হল, বৌদ্ধতন্ত্র ও হিন্দু তন্ত্রদর্শনের মধ্যে এক অন্তর্নিহিত সংলাপ ও আত্মীকরণ। দেবতারা এক ধর্ম থেকে অন্য ধর্মে স্থানান্তরিত হন, তবে কেবল নামান্তর হয় না – পরিবর্তিত হয় তাঁদের দর্শন, ভূমিকা, সাধনার পদ্ধতি এবং দর্শকের মনোজগতে তাঁদের স্থান। তারাই এই পরিবর্তনের কেন্দ্রবিন্দু, যাঁর মাধ্যমে এক ধর্মের আধ্যাত্মিক শিকড় অন্য ধর্মে বিস্তার লাভ করে।
✍️ রতন কর্মকার
0 Comments