Recent Posts

6/recent/ticker-posts

অক্ষয় তৃতীয়া: অনন্ত কল্যাণ ও আধ্যাত্মিক অভিযাত্রার এক পবিত্র তিথি

 



অক্ষয় তৃতীয়া: অনন্ত কল্যাণ ও আধ্যাত্মিক অভিযাত্রার এক পবিত্র তিথি

‘অক্ষয় তৃতীয়া’—হিন্দু ধর্মের এক মহাশুভ দিন। বৈশাখ মাসের শুক্লপক্ষের তৃতীয়া তিথিতে উদযাপিত এই দিনকে বলা হয় “অক্ষয়”—যার ক্ষয় নেই। বহুবিধ পৌরাণিক কাহিনী, আধ্যাত্মিক তত্ত্ব, লৌকিক রীতি ও অলৌকিক অভিজ্ঞতার সংমিশ্রণে এই দিনটি হয়ে ওঠে চিরন্তন কল্যাণের দ্বার। হালখাতা, দান, স্নান, পিতৃতর্পণ, মন্ত্রজপ, উপবাস, ব্রত ও পুজো—সবই এইদিন অক্ষয় ফলদায়ী বলে বিশ্বাস করা হয়। কিন্তু এর অন্তর্নিহিত আধ্যাত্মিক তাৎপর্য কোথায় নিহিত?

‘অক্ষয়’ শব্দের আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যা:

‘অ+ক্ষয়’—যার কোনো ক্ষয় নেই। এই শব্দটি উপনিষদের ভাষায় নির্দেশ করে সনাতন সত্য, যা সময়-নিরপেক্ষ, পরিবর্তনহীন ও চিরন্তন। ‘অক্ষয়’ সেই তত্ত্ব যা দেহ, মন, কাল ও স্থান-সীমার ঊর্ধ্বে। গীতায় ভগবান বলেন:

“ন জায়তে ম্রিয়তে वा কদাচিন্

নায়ং ভূত্বা ভবিতা বা ন ভূম্যঃ।

অজো নিত্যঃ শাশ্বতো'য়ং পুরাণো

ন হন্যতে হন্যমানে শরীরে॥”

(গীতা ২.২০)

অর্থাৎ, আত্মা জন্ম নেয় না, মরে না, চিরন্তন, পুরাতন, অজ। এই চিরন্তন আত্মারই প্রতীক অক্ষয় তৃতীয়া। এইদিনে আত্মা ও সৎকর্মের পথে যা শুরু হয়, তা সময়ের ক্ষয়ছায়ায় নষ্ট হয় না।

*#পুরাণ ও উপনিষদের দৃষ্টিতে এই তিথির ঘটনাবলি:

*#গঙ্গার_আগমন — চেতনার প্রবাহ ও পাপশুদ্ধি

অক্ষয় তৃতীয়ার দিনই গঙ্গা মর্ত্যে অবতীর্ণ হন। মহর্ষি ভগীরথের তপস্যার ফলেই ব্রহ্মা গঙ্গাকে মুক্তি দেন, আর গঙ্গার বেগ ধারণ করেন শিব। এই ত্রয়ী চেতনা:

ভগীরথের তপস্যা = সাধকের দৃঢ় সংকল্প

ব্রহ্মার অনুমতি = চেতনাশক্তির মুক্ত দ্বার

শিবের ধারকতা = চিত্তের সহনশীলতা

গঙ্গা এখানে আত্মসাধনার চেতনারূপিণী, যিনি প্রেতাত্মাকে মুক্তি দেন—অর্থাৎ, মানসিক ও কার্মিক দুঃসহ স্মৃতির শুদ্ধি ঘটান।

*#ধূমাবতী_মহাবিদ্যার_আবির্ভাব — বৈরাগ্য ও শূন্যতার সিদ্ধি

এই তিথিতে দশমহাবিদ্যার অন্তর্গত ধূমাবতী দেবীর আবির্ভাব ঘটে। তিনি অনন্য—

স্বামীহীনা

বার্ধক্যে আবৃতা

ঝাঁটা ও শূর্পধারিণী

কাকধ্বজে রত

তিনি সেই আধ্যাত্মিক চেতনা যিনি রূঢ় সত্য, শূন্যতা, বিচ্ছিন্নতা ও বৈরাগ্যের রূপ। তাঁর আবির্ভাব এই দিনে একটি বার্তা বহন করে—

পরিতৃপ্তি নয়, অপূর্ণতার মধ্যেই চিরন্তন সত্য লুকিয়ে থাকে। এই অনুভবই আমাদের স্থায়ী করে, আত্মনির্ভর করে।

*#পরশুরাম — তপস্যা ও ধর্মরক্ষার তীব্রতা

অক্ষয় তৃতীয়ায় ভৃগুবংশে জন্ম নেন ভগবান পরশুরাম। যিনি তপস্যা করে ‘পরশু’ পান এবং ক্ষত্রিয়দের অহঙ্কার দমন করেন।

এই কাহিনির অন্তর্নিহিত শিক্ষা—

জ্ঞান ছাড়া শক্তি হিংসা

শক্তি ছাড়া জ্ঞান দুর্বলতা

পরশুরাম দুইয়ের সংমিশ্রণ, আত্মতপস্যা ও ন্যায়প্রতিষ্ঠার পথ তিনি সময়ের কণ্ঠে উচ্চারিত এক ধ্বনি: “অধর্মের বিরুদ্ধে দাঁড়াও, তবেই আত্মজ্ঞান স্থায়ী হবে।”

*#দ্রৌপদী ও অক্ষয়পাত্র — ঈশ্বর-ভক্তি ও ভরসার চরম নিদর্শন

অক্ষয় তৃতীয়ার দিনে সূর্যদেব দ্রৌপদীকে ‘অক্ষয়পাত্র’ দেন। এর আধ্যাত্মিক অর্থ—

সৎচিন্তায় স্থায়ী সমৃদ্ধির উৎস, ভক্তি ও আত্মসমর্পণে অলৌকিক সহায়তা

শ্রীকৃষ্ণ সেই পাত্র থেকে অন্ন নিয়ে কেবল শারীরিক নয়, সমগ্র জগতের ক্ষুধা নিবারণ করেন। দুর্বাসার সংকট এড়ানো কেবল এক অলৌকিক ঘটনা নয়, বরং শিক্ষা দেয়—

যখন আর উপায় নেই, তখন “উপায়রূপী” কৃষ্ণ আসেন।

*#বেদব্যাস ও গনেশ — জ্ঞানরূপ কর্মের সূচনা

এই দিনেই ব্যাসদেব ও গণেশ মহাভারত রচনা শুরু করেন। এই ঘটনাটি ‘অক্ষয় তৃতীয়া’কে জ্ঞানযজ্ঞ আরম্ভের তিথি হিসেবে চিহ্নিত করে। বেদব্যাস, যিনি জ্ঞানসমুদ্র, এবং গনেশ, যিনি বিঘ্ননাশক ও শুদ্ধবুদ্ধির দেবতা—তাঁদের সম্মিলনে তৈরি হয় এক অনন্ত কাব্য, যা আজও পথপ্রদর্শক।

*#অন্নপূর্ণা ও কুবের — অভাব থেকে ঐশ্বর্যের অভিযাত্রা

অন্নপূর্ণা দেবী এইদিন আবির্ভূত হন। তিনি খাদ্য দেবী হলেও, আধ্যাত্মিক অর্থে তিনি অভ্যন্তরীণ অপূর্ণতার পরিপূরণ।

অন্যদিকে কুবেরের এইদিনে প্রাপ্ত ঐশ্বর্য হল আত্মার ঐশ্বর্য—যা দানযোগ্য, অপচয়হীন।

“যা দান করেও কমে না, তাই সত্য ঐশ্বর্য।” — এই বোধই অক্ষয় তৃতীয়ার মর্ম।

*#রথ নির্মাণ ও মন্দিরের দ্বারোদ্ঘাটন — আত্মার যাত্রাপথ

পুরীতে আজ থেকে জগন্নাথদেবের রথ নির্মাণ শুরু হয়। এই রথ কেবল কাঠের নয়, বরং তা আত্মার ঈশ্বরাভিমুখী যাত্রার প্রতীক।

কেদার-বদরী মন্দিরের ছয়মাস পর খোলার দিনে আগের জ্বালানো প্রদীপ এখনও জ্বলছে—এই দৃশ্যই “অক্ষয়”-এর শ্রেষ্ঠ প্রতীক।

এটি এক আধ্যাত্মিক সত্য:

“যা সত্য, তা কখনো নিভে না। শুধু সময় বুঝে তা আবার দীপ্ত হয়।”

*#অক্ষয়_তৃতীয়া—জীবনের স্থায়ী ভিত্তি নির্মাণের দিন

অক্ষয় তৃতীয়ার তাৎপর্য কেবল এক শুভ মুহূর্তে দান, পূজা বা কেনাকাটায় সীমাবদ্ধ নয়। এই দিন আমাদের শেখায়—

চিরন্তন সত্যকে উপলব্ধি করো, সৎকর্ম শুরু করো, ভগবৎ-স্মরণে আত্মবিশ্বাস রাখো এবং জ্ঞানের ভিত্তিতে আত্মাকে গঠন করো।

এই দিন মর্ত্যে অনন্তত্বর স্পর্শের দিন—যেখানে ক্ষণিক জীবনের ভেতরেই চিরকালীন সাধনার বীজ রোপণ করা যায়। তাই এই দিনটি শুধু শুভ নয়, নির্বাণমুখী। শেষে প্রণাম জানাই সেই অক্ষয় চেতনাকে, যে চিরজীবন আমাদের অন্তরে আলো জ্বালিয়ে চলেছেন।

অক্ষয় তৃতীয়ার পরম শুভেচ্ছা। 🙏

✍️ রতন কর্মকার

Post a Comment

0 Comments