Recent Posts

6/recent/ticker-posts

নৈঃশব্দ্যের আরাধ্য

 



নৈঃশব্দ্যের আরাধ্য

মনই সাধনার পথে প্রধান অন্তরায়, আবার মনকেই ভেঙে, নিঃশেষ করে না ফেলা পর্যন্ত সাধনা পূর্ণ হয় না। এই মন, যা নিজেই নিজের মধ্যে কল্পনার সাগর বয়ে নিয়ে চলে, তা কখনোই নিজের ভিতর লীন হতে চায় না। মন চায় দৃশ্য, রূপ, শব্দ, ভাবনা, সম্পর্ক। আর সেই চাওয়াগুলোই ধারালো ফাঁদ হয়ে পথ আগলে দাঁড়িয়ে থাকে।

মনই তো সৃষ্টি করে দেবতার রূপ, মনই তো আঁকে পূজার ছাঁচ। কল্পনার ভাসে ভগবানের মূর্তি— কখনো শ্যাম, কখনো শ্যামা, কখনো মাতা, কখনো পিতা। অথচ, যে মহাশূন্যতা থেকে এই সকল রূপের উদ্ভব, সেই শূন্যতাকেই মন ভয় পায়। নিরাকারে ভয়, নিস্তব্ধতায় অস্বস্তি। তাই সে ঢোল বাজায়, শাঁখ ফুঁকে, কাঁশি আর ঘণ্টার শব্দে সেই নিরবতাকে ঢেকে রাখতে চায়।

এইভাবেই মন পূজার আড়ালে নিজেকে কল্পনার দেবতার মধ্যে গেঁথে রাখে। অন্তরে ঈশ্বর নেই— কারণ সেখানে কল্পনা নেই বলেই ভয়। বাইরে গড়ে তোলা হয় এক বিশাল সিংহাসন— সাজানো রূপ, অলংকার, শাস্ত্রবদ্ধ নিয়ম, নির্দিষ্ট অর্ঘ্য, নির্দিষ্ট সময়, নির্দিষ্ট ভাষা। যেন বিধির নাগপাশে বাঁধা পড়ে গেছেন সেই যিনি নিজেই নিয়মের ঊর্ধ্বে।

ভক্তি শব্দটা আজকাল ভারী হয়ে উঠেছে। সেটাও তো মনপ্রসূত— চোখের জল, বুকের ব্যথা, সুরে সুরে মিনতি— সবই মনের তৈরি। অথচ, আত্মার স্তব্ধতা যে সত্যিকারের আরাধনার দরজা খুলে, তা ভুলে গেছে সাধক। সে চায় কান্না, চায় অনুভূতির বিস্ফোরণ— যেন অনুভব করলেই ঈশ্বর এসে পড়বেন। এই অনুভূতিই তাকে কল্পনার ঘূর্ণিপাকে ধরে রাখে।

সাধনার সত্য দিক হলো — কোনো কিছু অনুভব না করার গভীরে ডুবে যাওয়া। এমন এক নীরবতা, যেখানে মন নিজেই কুন্ঠিত হয়ে যায়, ভাবনারা থেমে যায়, কল্পনারা ফিকে হয়ে আসে। সেখানে না রূপ থাকে, না আকৃতি, না শব্দ— শুধু থাকে এক অভিজ্ঞতাতীত উপলব্ধি, যা কোনো ভাষায় প্রকাশযোগ্য নয়।

এখানে এসে জীব জানে— ঈশ্বর বলে কিছু নেই। আর সেই জানার মধ্যেই উন্মোচিত হয় ঈশ্বরতত্ত্ব। যে অন্তর ছেড়ে দিয়েছে সকল চিত্র, শব্দ, আকাঙ্ক্ষা— সেখানে নিজে থেকেই জেগে ওঠে এক অরূপ চেতন— সে-ই ‘অন্তর্যামী’।

তার জন্য দরকার চুপ হয়ে যাওয়া। কেবল চুপ, একেবারে গভীর স্তরে। কল্পনার ঢেউ থেমে গেলে যে নির্জনতা আসে— সেইখানে সে ধরা দেন। তিনি কিসের পূজিত হবেন? কিসের অর্ঘ্য, কিসের মন্ত্র? তিনি তো কোনো কিছুতে বাঁধা পড়েন না, এমনকি ‘ভক্তি’ নামক অনুভবেও না। তিনি অন্বেষণ চান না— তিনি চান আত্মবিসর্জন। একেবারে নিঃশেষে। সম্পূর্ণ আত্মত্যাগ।

যতদিন মনে কল্পনা, ততদিন সেই আত্মত্যাগ সম্ভব নয়। কল্পনা থাকলেই ঈশ্বর একটা ছবি, একটা অভিজ্ঞতা, একটা ভাষা, একটা নাম হয়ে যান। কল্পনা বিলীন হলেই ঈশ্বর হয়ে ওঠেন নামাতীত, রূপাতীত, ভাবনাতীত।

তখন আর পূজার দরকার হয় না। তখন নিজেরই প্রতিটি নিঃশ্বাস এক প্রার্থনা, নিজের নিঃশব্দ উপস্থিতিই এক পবিত্রতা। আর সে নিঃশব্দতায়, অভিজ্ঞানহীন সেই চেতনায়ই, তিনি থাকেন।

✍️ রতন কর্মকার, ঢাকা, বাংলাদেশ।

(whatsapp: +8801715982155)

Post a Comment

0 Comments