কালা যাদু (৫ম পর্ব)
নগরের এক প্রান্তে, পুরনো লাল ইটের গাঁথুনির পাশ ঘেঁষে ছোট্ট এক চায়ের দোকান। নাম ‘আড্ডাঘর’। নামকরণ সঠিক—কারণ এই দোকান কোনো সাধারণ দোকান নয়, বরং বহু জীবনের প্রতিচ্ছবি। সকাল থেকে রাত—চা, বিস্কুট আর কথার স্রোতে ভেসে চলে জীবনের নানা রং।
এই দোকানের এক নীরব অথচ অতি পরিচিত মুখ—নূর ভাই। মাথাভর্তি চুল-দাড়ি, মুখে নিরাবেগ শান্তি। কেউ কেউ বলেন তিনি এককালে সাধক ছিলেন, কেউ বলেন সন্ন্যাস ছেড়ে সংসারে ফিরেছেন, আবার কেউ বলেন তিনি ঈশ্বরের প্রেরিত কেউ। কিন্তু নূর ভাই নিজে কিছুই বলেন না। প্রতিদিন আসেন, এক কোণায় বসেন, চুপচাপ চা খান, আর দূরে তাকিয়ে ভাবেন।
সে দিনটাও ছিল তেমন এক শেষ বিকেল। দোকানে প্রচুর ভিড়, ধোঁয়ায় ঢেকে আছে বাতাস। কথার ঢেউয়ের মধ্যে, নূর ভাই বসে আছেন নিজের নির্ধারিত কোণে। দোকানের পাশে একটা নিমগাছ, তার নিচেই সেই প্রিয় আসন।
আজ তার মনটা একটু ভারি। তিনি ভাবছিলেন এক পুরোনো স্বপ্নের কথা—যেখানে একজন মানুষ পাথরের মতো দুঃখ বয়ে বেড়াচ্ছে, আর সেই দুঃখ তাকে ভিতর থেকে খেয়ে নিচ্ছে।
এই ভাবনার মধ্যে হঠাৎ পাশে বসা একজন লোকের ফোনালাপ কানে এলো।
“না ভাই, আর সম্ভব না... ব্যবসা চালাতে পারবো না... লস এতটাই হয়েছে যে এখন স্টক কিনার পয়সাও নেই... বাচ্চার স্কুল ফি, মা’র ওষুধ, সব আটকে গেছে... কী করবো আমি? কী করবো?”
লোকটির কণ্ঠ ভারী হয়ে উঠছিল। চোখ টলমল করছিলো, কিন্তু সে নিজেকে শক্ত রাখার চেষ্টা করছিল। দোকানের অন্যান্য লোকজন একটু চুপ করে গেলো—দুঃখের কণ্ঠ মানুষের কথার স্রোতকেও থামিয়ে দিতে পারে।
নূর ভাই ধীরে চোখ তুললেন, লোকটির দিকে এক দৃষ্টিতে তাকালেন।
“ভাই,” তিনি বললেন, “আমি কি আপনাকে কিছু সাহায্য করতে পারি?”
লোকটি চমকে তাকাল। এমন করুণ মুহূর্তে এমন নরম স্বর যেন অবাক করে। মুখে অবিশ্বাস, কিন্তু চোখে একটা ক্ষীণ আশা। সে বললো, “আপনি… কে?”
নূর ভাই হাসলেন না, শুধু বললেন, “আমি একজন সাধারণ মানুষ। চলুন, একটু হাঁটি।”
দু’জনে রওনা হলেন নদীর দিকে। পথটা শান্ত, পুরনো। দুইপাশে ঝোপঝাড়, পাখির ডাকা, দূরের কুয়াশায় ঢাকা একটা মন্দিরের সিঁড়ি দেখা যায়। তারা হাঁটতে হাঁটতে একসময় নদীর ঘাটে এসে পৌঁছালো।
নদীর পাড়ে বসে নূর ভাই তার সব কথা শুনলেন। ব্যবসার কথা, সংসারের চাপ, সামাজিক লজ্জা, ব্যর্থতার গ্লানি—সব কিছু।
তারপর তিনি চুপ করে গেলেন। চোখ বন্ধ করলেন। কিছুক্ষণ পর নিজের কোমরের কাছ থেকে একটা পুঁটলি খুলে আনলেন। সেখানে ছোট্ট কিছু বস্তু ছিল—তামার পাত, রুদ্রাক্ষ, কিছু ভস্ম, আর একটা ছোট পুঁথি। তিনি কিছু বললেন না, শুধু মন্ত্র পড়তে শুরু করলেন—মৃদু স্বরে, যেন নদীর স্রোতের সাথে একাত্ম হয়ে যাচ্ছে।
কিছুক্ষণ পরে তিনি একটি কবচ প্রস্তুত করলেন—তামায় মোড়া, তান্ত্রিক চিহ্নে আঁকা। সেটি লোকটির হাতে দিয়ে বললেন, "এটা গলায় পরে রাখবেন। এবং সাত রাত ধরে এই বিশেষ নিয়মে প্রার্থনা করবেন। কিছু জিনিস ঘরে রাখতে হবে—লাল চন্দন, গোটা লবঙ্গ, ও একটি সরষে তেলের প্রদীপ। নির্দিষ্ট নিয়মে এই অনুষ্টান করুন, ফলের চিন্তা না করে। বিশ্বাসই সবচেয়ে বড় সম্পদ।”
লোকটি কবচ হাতে নিয়ে স্তব্ধ। না জানি কী জাদু ছিল সেই সন্ধ্যার বাতাসে, বা নূর ভাইয়ের চোখের চাহনিতে—সে কিছু না বুঝেই মাথা নাড়লো।
“আমি চেষ্টা করবো ভাই, আর কিছু না হোক, আপনি যা করলেন, তার জন্য আমি চিরঋণী।”
দুই সপ্তাহ পর
নূর ভাই বাড়ির উঠোনে বসে সিগারেট খাচ্ছিলেন। হঠাৎ দূর থেকে চিৎকার,
“নূর ভাই! ভাই ! আমি বাঁচলাম!”
তিনি তাকিয়ে দেখেন—সে লোকটি। এবার আর তার মুখে সেই ভাঙা কান্না নেই, চোখে আলো, মুখে উচ্ছ্বাস। হাতে একটা বিশাল মিষ্টির বাক্স, ফলমূল, ও একটি সোনালি মোড়ানো শাল। ছুটে এসে নূর ভাইয়ের পা জড়িয়ে ধরলো।
“ভাই, আপনার আশীর্বাদ ছাড়া এটা সম্ভব হতো না! ব্যবসা আবার চালু হয়েছে, আগের সব দেনা উঠেছে, এমনকি নতুন অর্ডারও পাচ্ছি। কোথা থেকে এত ক্রেতা এলো জানি না! আমি... আমি কথা খুঁজে পাচ্ছি না...”
নূর ভাই শুধু মাথায় হাত রাখলেন। ধীরে বললেন, "সব উপরওয়ালার ইচ্ছা। আমি শুধু একটি মাধ্যম মাত্র। কিন্তু তুমি বিশ্বাস করেছিলে—সেটাই আসল জিনিস। ঈশ্বরও তখন সাহায্য করেন, যখন মানুষ নিজে চাইতে শেখে।”
লোকটি চোখের পানি ফেলছিল, কিন্তু এবার তা ছিল আনন্দের। সে সেই দিন থেকে মাঝে৷ মাঝে নূর ভাইয়ের বাড়িতে আসে। এলাকার মানুষ বুঝে গেল—নূর ভাই শুধু একজন চা-প্রেমিক নন, তিনি একজন আলোকিত পথপ্রদর্শক।
এই পৃথিবীতে কিছু মানুষ থাকেন, যাদের ছায়া হয় ধরা যায় না, কিন্তু যারা সঠিক সময়ে ঠিক জায়গায় পৌঁছে যান। তারা ঈশ্বর নন, ফেরেশতাও নন—তবে ঈশ্বরের কাছে নতজানু কিছু আলোকিত প্রাণ, যারা অন্যের জীবনে আলো জ্বালিয়ে যান।
নূর ভাই তেমনই একজন।
চলবে.......................
✍️ রতন কর্মকার
(whatsapp: +8801715982155)
0 Comments