শ্রীমদ্ভগবদগীতার আলোকে আধ্যাত্মিক চিকিৎসা

 

শ্রীমদ্ভগবদগীতার আলোকে আধ্যাত্মিক চিকিৎসা

পর্ব : ০১: উদ্বেগ ও দুশ্চিন্তা – গীতার আলোয় মানসিক চিকিৎসা

*#রোগ_পরিচিতি: উদ্বেগ (Anxiety)

উদ্বেগ একপ্রকার অভ্যন্তরীণ মানসিক অস্থিরতা, যা ভবিষ্যৎ ভীতির ধারণা থেকে জন্ম নেয়। দেহে কর্টিসল ও অ্যাড্রেনালিন হরমোনের মাত্রা বেড়ে যায়, যার ফলে হৃদস্পন্দন বেড়ে যায়, নিঃশ্বাস অনিয়মিত হয় এবং স্নায়বিক চাপ জন্ম নেয়। দীর্ঘদিন ধরে উদ্বেগ বজায় থাকলে এটি পরিণত হয় উচ্চ রক্তচাপ, অনিদ্রা, হজমের গোলমাল বা হৃদরোগে।

আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞান উদ্বেগের চিকিৎসায় ওষুধ, থেরাপি বা মেডিটেশনের পরামর্শ দেয়। কিন্তু আধ্যাত্মিক পথের অনুসারীরা প্রাচীন শাস্ত্রের মন্ত্র ও দর্শনের মধ্যে এক গভীর নিরাময়ের পথ খুঁজে পেয়েছেন। গীতার শ্লোক—এখানে হয়ে ওঠে চেতনার ওষুধ।

*#গীতা_শ্লোক – ২/১৪

“মাত্রাস্পর্শাস্তু কৌন্তেয় শীতোষ্ণসুখদুঃখদাঃ।

আগমাপায়িনো অনিত্যাস্তাংস্তিতিক্ষস্ব ভারত॥”

বাংলা অনুবাদ:

“হে কুন্তীপুত্র, ইন্দ্রিয়ের সংস্পর্শে যে শীত-উষ্ণতা এবং সুখ-দুঃখ অনুভূত হয়, তা আসা ও যাওয়ার মতোই অনিত্য; তাই তুমি ধৈর্য ধারণ কর।”

*#আধ্যাত্মিক_ব্যাখ্যা_ও_মানসিক_উপকারিতা:

এই শ্লোকটি শুধুমাত্র দার্শনিক নয়, এটি এক বাস্তব চিকিৎসাবিদ্যা। যা-ই আসছে তা যাবে—এই উপলব্ধি যদি হৃদয়ে গেঁথে যায়, তাহলে মন আর কোনো মুহূর্তের সঙ্গে অতিমাত্রায় যুক্ত থাকে না। উদ্বেগ সৃষ্টি হয় কারণ আমরা ভবিষ্যতের শঙ্কা নিয়ে বেঁচে থাকি, বর্তমানকে গ্রহণ করতে পারি না। গীতা শেখায়—সমস্ত অনুভূতি, ঘটনা, বেদনা, এমনকি উদ্বেগ নিজেও অনিত্য। এই উপলব্ধি মানসিক ভারসাম্য ফিরিয়ে আনে, এবং স্নায়বিক শান্তি নিশ্চিত করে।

*#ধ্যান_ও_পাঠপদ্ধতি (প্রতিদিন ১০ মিনিট):

পর্যায়ক্রমে করুন—

১. একটি শান্ত স্থানে বসুন, পিঠ সোজা রাখুন, চোখ বন্ধ করুন।

২. ৩ বার গভীর শ্বাস নিন ও ছাড়ুন।

৩. এবার শ্লোকটি ৭ বার উচ্চারণ করুন ধীরে ধীরে—

“মাত্রাস্পর্শাস্তু কৌন্তেয় শীতোষ্ণসুখদুঃখদাঃ।

আগমাপায়িনো অনিত্যাস্তাংস্তিতিক্ষস্ব ভারত॥”

৪. প্রতিবার উচ্চারণের পর মনে মনে বলুন:

“আমার উদ্বেগ আসছে এবং চলেও যাবে। আমি ধৈর্য ধরছি।”

৫. এবার ৫ মিনিট নিঃশব্দে বসে শুধু অনুভব করুন— “আমার চেতনা গভীর, শান্ত, উদ্বেগ ক্ষণস্থায়ী। আমি স্থিত।”

*#মানসিক_শারীরিক_উপকারিতা:

শ্রীমদ্ভগবদগীতার আলোকে উদ্বেগ ও দুশ্চিন্তার মানসিক-শারীরিক উপকারিতা

(শ্লোক: ২/১৪ — “মাত্রাস্পর্শাস্তু কৌন্তেয়...”)

মানসিক উপকারিতা:

১. ভবিষ্যতের ভয় হ্রাস পায়:

এই শ্লোক আমাদের শেখায় যে, জীবনের সব অভিজ্ঞতা—সুখ-দুঃখ, আরাম-অসুবিধা—সবই ক্ষণস্থায়ী। এই বোধ মনকে ভবিষ্যতের অজানা ভয় ও দুশ্চিন্তা থেকে মুক্ত করে।

২. বর্তমান মুহূর্তে ফিরে আসার শক্তি দেয়:

উদ্বেগ মূলত বর্তমান থেকে মনকে সরিয়ে ভবিষ্যতের জাল বুনতে থাকে। গীতার এই শ্লোক ধ্যান ও পুনরুচ্চারণের মাধ্যমে মনকে 'এখানে ও এখন'—এই মুহূর্তে ফিরিয়ে আনে।

৩. ধৈর্য ও সহনশীলতা বৃদ্ধি পায়:

"তিতিক্ষা" অর্থাৎ সহিষ্ণুতা চর্চার মাধ্যমে উদ্বেগ সৃষ্টিকারী মানসিক চাপের প্রতিক্রিয়া কমে যায়। ফলে চিন্তা-ভাবনা স্থির ও শান্ত হয়।

৪. চেতনার গভীরতায় মন প্রশান্ত হয়:

নিয়মিত এই শ্লোক পাঠ ও ধ্যান করলে মনের অগোচরে এক গভীর বিশ্বাস গড়ে ওঠে—"এটিও কেটে যাবে", যা দুশ্চিন্তার প্রবাহে বাঁধ দেয়।

শারীরিক উপকারিতা:

১. স্নায়বিক শান্তি ও কর্টিসলের মাত্রা হ্রাস:

উদ্বেগজনিত কর্টিসল ও অ্যাড্রেনালিন হরমোনের স্রোত এই ধ্যানপদ্ধতির ফলে হ্রাস পেতে শুরু করে, কারণ মন ধীরে ধীরে শিথিল ও স্থির হতে থাকে।

২. হৃদস্পন্দন ও নিঃশ্বাস স্বাভাবিক হয়:

শ্লোক পাঠ ও নিঃশ্বাস নিয়ন্ত্রণের ফলে সিম্প্যাথেটিক নার্ভাস সিস্টেম শান্ত হয়, যার ফল হৃদপিণ্ড ও শ্বাসযন্ত্রের কার্যক্রম স্বাভাবিক হয়ে আসে।

৩. উন্নত ঘুম ও হজমশক্তি:

উদ্বেগ কমার সাথে সাথে ঘুমের গুণমান ভালো হয়, এবং হজমপ্রক্রিয়াও প্রভাবিত হয় না, কারণ মস্তিষ্ক হাইপোথ্যালামাস-পিটুইটারি-অ্যাড্রেনাল (HPA) অ্যাক্সিসকে চাপমুক্ত রাখে।

৪. রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে থাকে:

ধৈর্যের অভ্যাস ও ধ্যানমূলক উচ্চারণ রক্তচাপের ওঠানামা নিয়ন্ত্রণে রাখতে সাহায্য করে, যা উদ্বেগের অন্যতম বড় দেহগত উপসর্গ।

*#ব্যবহারিক_পরামর্শ:

সকালবেলা বা রাতে ঘুমানোর আগে এই অনুশীলন করুন। উদ্বেগ সৃষ্টি হলে চোখ বন্ধ করে ১ মিনিটে শ্লোকটি মনে মনে বলুন।

গীতার এই একটি শ্লোক—যদি অন্তরে ধারণ করা যায় ও নিয়মিত চর্চা করা হয়, তবে তা হয়ে উঠতে পারে উদ্বেগ ও দুশ্চিন্তার এক চিরন্তন নিরাময়। এটি শুধুমাত্র আত্মার পুষ্টিই দেয় না, শরীরকেও করে তোলে ভারসাম্যপূর্ণ ও সুস্থ। আধুনিক চিকিৎসার সাথে এই আধ্যাত্মিক অনুশীলন একত্রে প্রয়োগ করলে জীবনে আসে মানসিক শান্তি ও সামগ্রিক সুস্থতা।

চলবে......................

✍️ রতন কর্মকার

(ঢাকা, বাংলাদেশ ; whatsapp: +8801715982155)

https://divyosadhona.blogspot.com/