Recent Posts

6/recent/ticker-posts

শ্রীমদ্ভগবদগীতা : আধুনিক সংকটে চিরন্তন আধ্যাত্মিক দিশা

 



শ্রীমদ্ভগবদগীতা : আধুনিক সংকটে চিরন্তন আধ্যাত্মিক দিশা



শ্রীমদ্ভগবদগীতা ভারতীয় আধ্যাত্মিক দর্শনের একটি শ্রেষ্ঠ রত্ন। এর মূল শিক্ষা ধর্ম, কর্ম, জ্ঞান, ভক্তি ও আত্মসমর্পণের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। মহাভারতের এক মহাকাব্যিক মুহূর্তে, যুদ্ধের প্রাক্কালে কুরুক্ষেত্রে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের মুখনিঃসৃত এই জ্ঞান কেবলমাত্র অর্জুনের দুঃখ-দ্বিধা নিরসনের জন্য নয়, সমগ্র মানবজাতির আত্মোদ্দেশ্য উপলব্ধির পথনির্দেশ রূপে বিবেচিত। গীতা কোনো নির্দিষ্ট ধর্মীয় সম্প্রদায়ের পবিত্র গ্রন্থ নয়, বরং এক বিশ্বমানবিক সাধনাশাস্ত্র। এই গ্রন্থে বেদান্ত, সংখ্য, যোগ, ভক্তি ও কর্মের মহাজ্ঞান একই সঙ্গে মিশে আছে। গীতা শুধু দর্শন নয়, এটি এক নিরন্তর জাগ্রত চেতনার আহ্বান। আধুনিক জীবনের গভীর দ্বন্দ্ব, মানসিক উদ্বেগ, কর্তব্য-অকর্তব্যের গ্লানিতে নিমজ্জিত মানুষের কাছে গীতার বাণী আজ আরও অধিকভাবে প্রাসঙ্গিক।


শ্রীমদ্ভগবদগীতার মৌলিক অবস্থান নিরপেক্ষ জ্ঞানবোধে। এতে বলা হয়েছে—কোনো কাজ ত্যাগ করো না, কিন্তু তার ফলে জড়িয়ে পড়ো না। আধ্যাত্মিক উন্নতির জন্য গৃহত্যাগ আবশ্যিক নয়, গীতার ভাষায় “যঃ সর্বত্রানভিস্নেহঃ তত্তৎ প্রাপ্য শুভাশুভম, নাভিনন্দতি ন দ্বেষ্ঠি তস্য প্রজ্ঞা প্রতিষ্ঠিতা।” অর্থাৎ, যার ভিতরে আসক্তি নেই, যিনি শুভ-অশুভ দুটির প্রতিতেই অবিচল, তিনিই সত্যজ্ঞানে প্রতিষ্ঠিত।


গীতা আমাদের শেখায় কীভাবে সংসারে থেকে নিরাসক্ত থাকা যায়। এই নিরাসক্তি কোনো নিষ্ক্রিয়তা নয়, বরং এক তীব্র সক্রিয়তা যা আত্মজ্ঞান দ্বারা পরিচালিত। একজন গৃহী, কর্মব্যস্ত মানুষ যখন নিজের প্রতিটি কর্মকে ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করে, তখনই সেই কর্মই তার যোগসাধনা হয়ে দাঁড়ায়। এই হল কর্মযোগ। শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে বলেন—“কর্মণ্যে-বাধিকারস্তে মা ফলে-ষু কদাচন।” অর্থাৎ, তুমি কেবল কর্ম কর, ফলের আশা করো না।


গীতার অন্যতম গভীর উপলব্ধি হলো—অন্তরস্থিত আত্মা অজন্মা, অবিনাশী ও চিরস্থিত। যখন মানুষ নিজেকে কেবল শরীর মনে করে, তখন সে দুঃখ, ভয়, ক্রোধ, অহংকার, লোভ ও মোহে আক্রান্ত হয়। কিন্তু যখন কেউ নিজেকে আত্মা হিসেবে চেনে, তখনই মুক্তির সূচনা ঘটে। এই আত্মজ্ঞানে পৌঁছানোই গীতার লক্ষ্য।


এখানে আসে জ্ঞানযোগের কথা। জ্ঞানযোগ হল আত্মার প্রকৃত পরিচয় অনুধাবনের এক গভীর পথ। এই পথ অনুসরণ করতে গেলে বৈরাগ্য, একাগ্রতা, চিত্তের নিয়ন্ত্রণ ও গুরুপদেশ প্রয়োজন। গীতার মতে—“তদ্বিদ্ধি প্রণিপাতেন পরিপ্রশ্নেন সেবয়া। উপদীক্ষন্তি তে জ্ঞানং জ্ঞানিনস্তত্ত্বদর্শিনঃ।” অর্থাৎ, জ্ঞানীদের নিকট শ্রদ্ধাভক্তিসহকারে প্রশ্ন করে, তাদের সেবা করে জ্ঞান গ্রহণ করতে হয়। এই শিক্ষা আজকের আধুনিক মানুষকেও নির্দেশ করে—নির্মল হৃদয়, বিনয়ী মন, এবং কৃতজ্ঞতায় পূর্ণ চিত্ত না থাকলে প্রকৃত জ্ঞান লাভ সম্ভব নয়।


এই জ্ঞানযোগই একসময় পরিণত হয় ধ্যানযোগে। গীতায় বলা হয়েছে—“যোগী নামপি সর্বেষাং মদ্গতেনান্তরাত্মনা, শ্রদ্ধাবান্ ভজতে যো মাং স মেযুক্ততমো মতঃ।” অর্থাৎ, সকল যোগীর মধ্যে সেই ব্যক্তি সর্বোৎকৃষ্ট, যিনি অন্তর থেকে আমাকে ধ্যান করে। এই ধ্যান মানে কোনো আড়ম্বর নয়, এটি একান্ত হৃদয়দর্শনের অভ্যন্তরীণ সাধনা। আধুনিক জীবনে যেখানে মন সর্বদা ছুটে বেড়ায় বহির্বস্তুর পেছনে, সেখানে ধ্যান হয়ে ওঠে অন্তর্জগতে স্থিতির একমাত্র উপায়।


গীতার সবচেয়ে ব্যাপক ও সহজপথ হল ভক্তি যোগ। এক্ষেত্রে ভগবান নিজে বলেন—“পত্রং পুষ্পং ফলং তোয়ং যো মেযক্ত্য প্রয়চ্ছতি, তহং ভক্ত্যুপহৃতমশ্নামি।” অর্থাৎ, যে কেউ একান্ত ভক্তি সহকারে একটি পত্র, পুষ্প, ফল বা জল আমাকে প্রদান করে, আমি তা আনন্দ সহকারে গ্রহণ করি। এই উপদেশে গীতার হৃদয় প্রতিফলিত—ভক্তি, হৃদয়পূর্ণ নিবেদন ও নিরহঙ্কারী প্রেমই পরমেশ্বরের নিকট পৌঁছানোর প্রধান পথ। এখানে জাতি, লিঙ্গ, সম্প্রদায় বা ধন-সম্পদের কোনো স্থান নেই।


গীতার অপর এক মূখ্য শিক্ষা হল স্বধর্ম ও কর্তব্য। “শ্রেয়ান্ স্বধর্মো বিগুণঃ পরধর্মাৎ স্বনুষ্ঠিতাৎ।” অর্থাৎ, নিজের কর্তব্য পালন করা, তাতে অল্প ত্রুটি থাকলেও উত্তম, অপরের কর্তব্য অনুসরণ করে যতই সফল হোক না কেন, তা অনর্থকর। আধুনিক মানুষ প্রায়শই পরের সাফল্য দেখে নিজের পথ থেকে বিচলিত হয়, নিজের ধম্ম বা কর্তব্যকে তুচ্ছ ভাবে। গীতা আমাদের শেখায়—নিজের অন্তর্জাত স্বভাব অনুযায়ী বাঁচা, নিজের কর্ম যথাযথভাবে পালন করাই পরম ধর্ম।


আজকের কর্মব্যস্ত, উদ্বেগপীড়িত মানুষ যখন গীতার দিকে ফিরে তাকায়, তখন সে আবিষ্কার করে এক গভীর সান্ত্বনা। গীতা আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, আমরা শুধু একজন কর্মী নই, আমরা চেতন, অনন্ত আত্মা—চরিত্র গঠনের কারিগর, ধ্যানের উদ্যানপালক, নীরব প্রেমিক ঈশ্বরের, এবং অসীম চেতনার অংশ। আত্মজ্ঞানের এই বোধ মানুষকে শক্তি দেয়, দুঃখ থেকে মুক্ত করে, অহং থেকে আলাদা করে, এবং তাকে সত্যের পথে পরিচালিত করে।


এখানে স্মরণীয় যে গীতার পাঠ কোনো আচার নয়, কোনো দর্শনীয় বই পড়া নয়, এটি জীবনের প্রতিটি স্তরে প্রয়োগের বিষয়। কর্মক্ষেত্রে, পারিবারিক জীবনে, সামাজিক ব্যবহারে, অর্থনৈতিক সিদ্ধান্তে—সবখানে গীতার বাণী প্রযোজ্য। “সমত্ত্বং যোগ উচ্যতে”—এই সমত্ব বা সমদর্শিতা আসল আধ্যাত্মিকতা। অর্থাৎ, সুখে ও দুঃখে, লাভ ও ক্ষতিতে, জয় ও পরাজয়ে সমভাবে থাকাই প্রকৃত যোগ। আধুনিক জীবন যেখানে স্পর্ধা, প্রতিযোগিতা, ইর্ষা ও হিংসায় ভারাক্রান্ত, সেখানে গীতার সমত্ববোধ এক বিপ্লব।


এখানে আসতে হয় গীতার সর্বশেষ ও সবচেয়ে গভীর ঘোষণায়—“সর্বধর্মান্ পরিত্যজ্য মামেকং শরণং ব্রজ।” গীতার এই উপদেশ এক আধ্যাত্মিক আত্মসমর্পণ। ধর্ম মানে কেবল আচরণ নয়, এটা জীবনের দায়িত্ব, কর্তব্য, মনোভাব, বোধ। সমস্ত সীমাবদ্ধ ধারণা ত্যাগ করে যখন আমরা ঈশ্বরের উপর পূর্ণ নির্ভরতা রেখে আত্মসমর্পণ করি, তখনই শুরু হয় প্রকৃত মুক্তির পথ। আত্মসমর্পণ মানে দাসত্ব নয়, বরং অহংকারের বিলুপ্তি; স্বাধীনতা নয়, বরং ঈশ্বরচেতনার অধীনতা—যেখানে জীবনের সমস্ত কর্ম পরিণত হয় উপাসনায়।


এই দৃষ্টিভঙ্গি আধুনিক যুগেও বিপুল প্রাসঙ্গিক। যখন মানুষ বিভ্রান্ত, ক্লান্ত, দিশাহীন—গীতার পথ তাকে নিরাশ করে না। এটি তাকে বলে—তোমার ভেতরেই আছে আত্মার শক্তি, ঈশ্বরের বিভা। গীতা মানুষকে নিজ স্বরূপে প্রতিষ্ঠিত হতে শেখায়, এবং সেই স্বরূপ হল—সচ্চিদানন্দ।


আজ যখন আমরা ভোগবাদী জীবনযাত্রায়, ভ্রান্ত মূল্যে, ক্লান্ত আত্মায় দিশেহারা হয়ে পড়ি, তখন গীতাই আমাদের আধুনিক সন্ন্যাস—যেখানে সংসার ত্যাগ না করেই আমরা আত্মার মুক্তি, কর্মের পবিত্রতা ও ঈশ্বরচেতনার দিকে এগিয়ে যেতে পারি।


✍️ ব্যাখ্যাঃ রতন কর্মকার

(whatsapp: +8801811760600)

Post a Comment

0 Comments