Recent Posts

6/recent/ticker-posts

কালা যাদু- ০৭ (আয়নার ওপারে এক সাহসী মানুষ ছিল)

 


দুপুরের রোদটা তখন ঠিক মাথার ওপরে। শহরের পুরনো এক অলিগলি দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে এক বিক্ষিপ্ত মানুষ। পরনে ছেঁড়া জামা, পায়ে জুতো নেই। কাঁচাপাকা জট বাঁধা চুল, মুখে ধুলো আর দাগ। পথচলার ভঙ্গিমা বোঝায়, সে যেন কিছু খুঁজছে—কিন্তু কী, তা সে নিজেও জানে না।
রাস্তার ধারে দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা লোকজন তাকে দেখে হেসে ওঠে। একজন কৌতুক করে বলে ওঠে, "ওই দেখ, মাস্টার্স পাস পাগলটা আবার বেরিয়েছে। নাম জানো? বিধান রায়। শুনেছি এক সময় ইউনিভার্সিটিতে লেকচার দিত। বড়লোকের মেয়ের প্রেমে পড়ে সব হারিয়েছে। মেয়ের বাবা নাকি এক তান্ত্রিককে দিয়ে এমন কালা যাদু করিয়েছে, যে সে এখন পাগল। আত্মীয়-স্বজনরা, বন্ধু-বান্ধব নেই, মানসিক ভারসাম্য নেই, কেউ নেই।"
আরও কয়েকজন টিটকিরি মারে, কেউ আবার থুতু ফেলে পাশ কাটিয়ে চলে যায়। কিন্তু তাদের ভিড়ের মাঝে একজন মানুষ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকেন। চোখে করুণা নেই, আছে এক গভীর প্রশান্তি। তার দৃষ্টিতে ছিল উপলব্ধির শীতল আলো। এই মানুষটির নাম নূর ভাই।
নূর ভাই দীর্ঘদিন ধরেই শহরে আছেন। কারও দৃষ্টিতে তিনি অদ্ভুত, কারও চোখে অলৌকিক। কেউ বলেন, তিনি এককালে বাউল ছিলেন, কেউ বলেন সাধক, কেউ বলেন তিনি এক সময়ে গুপ্ত সাধক ছিলেন।
নূর ভাই ধীরে এগিয়ে এলেন বিধানের দিকে।
বিধান তখন ফুটপাতের এক কোণে বসে একটানা বিড়বিড় করে কী সব বলছে। কখনও নিজের সাথেই কথা বলছে, কখনও চোখে জল। তার সেই অসংলগ্ন কথা হঠাৎ থেমে গেল, যখন নূর ভাই তার কাঁধে হাত রাখলেন।
হঠাৎ সে কেঁপে উঠল, তারপর তাকাল—তাকাল সেই চোখে, যেটা বহুদিন কেউ দেখেনি। চোখে জমে থাকা একটা ক্লান্তি, একটা হারিয়ে যাওয়া স্মৃতি, আর একটা জিজ্ঞাসা—"তুমি কে? না... না... তুমি তো আলো... কে তুমি?"
নূর ভাই শুধু বললেন, "তোমার ঘরে ফেরার সময় হয়েছে বিধান। অনেক হয়েছে। এবার ফিরে যাও নিজের ঠিকানায়।"
এরপর নূর ভাই তাকে নিজের বাড়িতে নিয়ে এলেন। একটা ছোট, শান্ত বাড়ি — ধ্যানমগ্ন পরিবেশ। বিধান প্রথমে কিছুই বুঝল না। সে বোবা হয়ে রইল দিনের পর দিন। খেতো না, ঘুমাত না, শুধু একভাবে বসে থাকত। নূর ভাইয়ের অলৌকিক চিকিৎসা চলছে।
তিন দিন পর এক সন্ধ্যায় সে হঠাৎ উঠে এসে বলল, “আমার জীবনটা শেষ হয়ে গেছে। আমি কি মরবো, নাকি আবার বাঁচবো?”
নূর ভাই বসে ধ্যান করছিলেন। তিনি চোখ না খুলেই বললেন, “তুমি যদি মরতে, আমি তোমাকে ফিরিয়ে আনতাম না। তুমি এখনো বেঁচে আছো। তুমি শুধু নিজের পথ ভুলে গেছো। আমি শুধু আয়না ধরব, চেহারা দেখবে তুমি নিজেই।”
এরপর শুরু হলো এক অদ্ভুত চিকিৎসা—যেটা কোনো হাসপাতালের ছিল না। নূর ভাই তাকে শেখাতে লাগলেন “স্বর সাধনা”, “শক্তিচক্র জাগরণ”, “প্রাণায়াম”, এবং কিছু গূঢ় মন্ত্র যার মানে বিধান প্রথমে বুঝত না, কিন্তু অনুভব করত।
তার চোখে আলো ফিরল, চেহারায় ফিরে এল স্থিরতা। আর সবচেয়ে বড় কথা, বিধান ধীরে ধীরে ভুলে যেতে লাগল সেই যন্ত্রণা যা তাকে পাগল করে দিয়েছিল।
তিন মাস পর, বিধান আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ছিল। সে নিজের দিকে চেয়ে বলল—"আমি তো বিধান। আমি তো ভালোবাসতে জানতাম। আমি তো মানুষ ছিলাম। আমি হারাইনি—আমাকে হারানো হয়েছিল। এখন আমি আবার ফিরে এসেছি।”
সে ধীরে নূর ভাইয়ের পায়ের কাছে এসে বসে পড়ে।
“আপনি আমার জীবনে আলো ফিরিয়ে এনেছেন। আমি কৃতজ্ঞ। কিন্তু আপনি শুধু কালা যাদু থেকে ত্রান কর্তা নন, আপনি আমার পথ প্রদর্শক।”
নূর ভাই মৃদু হেসে বলেন, “আমি শুধু পথ দেখাই। হাঁটতে তো তোমাকেই হবে।”
তারপর, একদিন সকালবেলা দরজায় কড়া নাড়ে এক অচেনা অতিথি। বিধান দরজা খুলে দেখে, সেই মানুষটি এসেছে—যে তার জীবন ভেঙে দিয়েছিল।
অর্পিতার বাবা।
মুখ থমথমে, গলা কাঁপা।
“আমি জানি, আমি অপরাধী। আমি নিজের মেয়ের প্রেমে বাঁধা দিয়েছিলাম। আমি তোমাকে ধ্বংস করেছি। কিন্তু এখন আমার মেয়ে বাঁচবে না যদি তোমাকে না পায়। আমি তোমার কাছে হাতজোড় করছি। আমি চাই, তুমি আমার জামাই হও।”
বিধান কিছু বলল না। সে চুপ করে শুনল, তারপর শুধু বলল, “আমি আমার গুরু নূর ভাইয়ের কাছে জিজ্ঞেস না করে কিছু করি না।”
সন্ধ্যায় নূর ভাইকে সে সব খুলে বলল। নূর ভাই শান্ত মুখে তাকালেন তার দিকে। তারপর চোখে এক মৃদু হাসি ঝরে পড়ল।
“তুমি তো এবার নিজের আলোর সন্ধান পেয়েছো। এখন সময়, সেই আলোয় ফিরে যাওয়ার। প্রেম শুধু ত্যাগ নয়, প্রেম মুক্তি ও বটে। এগিয়ে চলো। আমি আশীর্বাদ করছি।”
কয়েক বছর পর.........
এক গ্রামে, সবুজে ঘেরা ছোট্ট একটি বাড়ি। সেই বাড়ির আঙিনায় রঙিন কাগজের ঝালর, মিষ্টির হাঁড়ি, ফুলের মালা। আজ এক শিশুর জন্মদিন।
সে শিশু বিধান ও অর্পিতার সন্তান। আশেপাশে হাসিমুখে অনেকে। আত্মীয় স্বজনরা, প্রতিবেশীরা সবাই যারপরনাই খুশি।
হঠাৎ এক সাদা পাঞ্চাবী পরা এক ব্যক্তি বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ান। বিধান ছুটে গিয়ে তার পা ছুঁয়ে বলে— “আপনি না থাকলে, তো আমি থাকতাম না। আমার আজ এই সুখের সংসার-- সে তো আপনারই দান।”
নূর ভাই মাথায় হাত রাখেন, মৃদু হাসেন।
“আমি শুধু আয়না ধরেছিলাম, তুমিই নিজের মুখ চিনেছিলে। আলোর সন্ধান তুমি নিজেই পেয়েছো। এখন সেই আলোতেই অন্যরা পথ খুঁজে পাবে।”
এমন হাজার হাজার বিধান রায় আজও এই সমাজে হারিয়ে যেতে বসেছে। কারও প্রেমে, কারও হতাশায়, কারও অবিচারে। কিন্তু যদি একটা আলো জ্বলে—একটা নূর ভাই আসে—তবে ফেরানো যায় মানুষকে নিজস্ব আলোয়।
আর প্রেম—সে তো সর্বদা মুক্তির পথ। শুধু চাই সত্যের সাহস, আর আলোর সন্ধান।
✍️ রতন কর্মকার
(01715982155)


Post a Comment

0 Comments