Recent Posts

6/recent/ticker-posts

কালা যাদু-০৬ (পিশাচ যোগ : হারানো কুন্ডলিনী শক্তির পুনরুদ্ধার)

 


*#বৃষ্টি ভেজা সন্ধ্যাটা যেন একটু বেশিই নীরব ছিল সেদিন। জঙ্গলের কিনারে, গহন বনের ঠিক মাঝে এক ছোট্ট কুটির, আর তার মাঝখানে বসে আছেন সেই রহস্যময় মানুষ—নূর ভাই। তাঁকে ঘিরে প্রচলিত আছে নানা অলৌকিক কাহিনী। কেউ বলে তিনি দিব্যদৃষ্টিসম্পন্ন, কেউ বলে এক সিদ্ধপুরুষের পুনর্জন্ম। সাধারণ মানুষ তাঁকে শ্রদ্ধায় করে, আবার বিপদে পড়লেই ছুটে আসে তাঁর দ্বারে।
*#সেই দিন সন্ধ্যায় কুটিরের সামনে এসে দাঁড়াল এক যুবক—জয়ন্ত। বয়স প্রায় ত্রিশ ছুঁই ছুঁই। চোখে ঘুমহীনতা, চেহারায় ক্লান্তি আর ভেতর থেকে বেরিয়ে আসা একরকম গাঢ় দুঃখ। কাপড়ে ধুলো, মুখে হতাশার রেখা—জয়ন্ত যেন জীবনসংগ্রামে হেরে যাওয়া এক সন্ন্যাসী, যে আসলে কখনও সন্ন্যাস নেয়নি, শুধু নিয়ত বিদ্ধ হয়েছে জীবনের শূন্যতায়।
*#নূর ভাই চুপ করে তাঁর দিকে তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। কিছু জিজ্ঞেস না করেই উঠে গিয়ে একটি জলভরা পাত্র আর কিছু তুলসীপাতা এনে তাঁকে দিলেন। জয়ন্ত জল পান করে নিলো। “আমি মা লক্ষ্মীর উপাসক”, সে বলল ধীর স্বরে, “বছরের পর বছর ধরে প্রতি তিথিতে উপবাস করেছি, মা লক্ষ্মীর আরাধনা করেছি, দান করেছি, পূজা করেছি—তবুও আমি আজও নিঃস্ব। চাকরি হয়, কিছুদিন পরেই চলে যায়। সংসার ভাঙনের সূর, বন্ধুরা দূরে সরে গেছে। মাঝে মাঝে মনে হয় আমি নিজের শরীরের মধ্যেই বন্দী। কেউ যেন আমায় ব্যবহার করছে... এমন কিছু করাচ্ছে যা আমি চাই না। আমার কি শাস্তি হচ্ছে?”
*#নূর ভাই চোখ বন্ধ করলেন। কয়েক মুহূর্ত যেন সময় স্তব্ধ হয়ে গেল। তারপর চোখ খুললেন ধীরে, গভীর স্বরে বললেন, “তুমি পিশাচ যোগে আক্রান্ত, জয়ন্ত।”
জয়ন্ত হতভম্ব হয়ে তাকাল তাঁর দিকে। “পিশাচ যোগ?” তাঁর গলায় কাঁপুনি।
নূর ভাই মাথা হেলালেন। বললেন, “হ্যাঁ। এমন এক জটিল, অদৃশ্য গ্রন্থি যা আত্মা ও শরীরের সংযোগস্থলে বাঁধন দেয়। এই যোগে কুন্ডলিনী শক্তি নিজের গতি হারায়। স্বভাবতই, তোমার মধ্যে কামনা, ক্রোধ, হীনমন্যতা, ভয়, আত্মদ্বন্দ্ব—এসব প্রবল হয়ে উঠেছে। নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ নেই, কারণ চেতনা নিম্নচক্রে আটকে আছে।”
*#তিনি বোঝাতে শুরু করলেন—কীভাবে পিশাচ ভাব শরীরের চক্রে প্রভাব ফেলে।
“স্বাধিষ্ঠান চক্রে পিশাচভাব এলে, মানুষ কামনাবদ্ধ হয়ে পড়ে—সে চাইলেও আসক্তি থেকে মুক্তি পায় না।
মণিপুর চক্রে পিশাচপ্রবেশ মানেই উগ্র রাগ, আত্মঘাতী চিন্তা, নিজের উপর নিয়ন্ত্রণের অভাব।
আনাহত বন্ধ হলে করুণা শুকিয়ে যায়, হৃদয় শুকিয়ে কাঠ হয়ে যায়।
বিশুদ্ধি চক্র বন্ধ হলে মানুষ নিজের সত্য বলতেও ভয় পায়, ভিতরে বিষ জমে থাকে।
তুমি হয়ত মনে করো, তোমার ভাগ্য খারাপ। কিন্তু আমি বলি, ভাগ্য নয়—তোমার চেতনা বন্দী হয়েছে।”
*#জয়ন্ত চুপ করে শুনে যাচ্ছিল। চোখের কোনায় জল জমেছে। এই প্রথম কেউ তাঁর সমস্যাকে এমন নিখুঁতভাবে ব্যাখ্যা করল—বিনা প্রশ্নে, শুধু অনুভবে।
নূর ভাই এবার নিজের সাধনক্ষেত্রে জয়ন্তকে বসালেন। সূর্য অনেক্ষন আগেই গাছের পেছনে মিলিয়ে গেছে। বাতাসে ধূপের গন্ধ, পাখির কাকলি মিলিয়ে যেন এক রহস্যময় সন্ধ্যা সৃষ্টি করেছিল।
তিনি শুরু করলেন প্রতিকার—স্তরে স্তরে, ধাপে ধাপে।
*#প্রথমেই একটি আত্মিক বলয় গঠন করা হলো। আগুনের ছোট একটি প্রদীপ চারদিকে ঘুরিয়ে তিনি বললেন, “এই বলয় তোমার অন্তঃকরণকে রক্ষা করবে। পিশাচ ভাব মানে কেবল ভূত-প্রেত নয়, মানে সেই অশুভ শক্তি যারা জীবনের গতি আটকে দেয়, কেড়ে নেয় তোমার বিকাশের দিশা। এরা তোমার বাইরের নয়, অনেক সময় তোমার ভিতরেরই এক ছায়া।”
*#পরবর্তী ধাপে তিনি জয়ন্তর গলায় পরালেন সূক্ষ্ম একটি রক্ষাকবচ। একটি যন্ত্রও পরালেন বক্ষে—সূর্যবিন্দু যন্ত্র, যা আত্মবিশ্বাস ও ব্যক্তিত্ব শক্তি জাগ্রত করে। মন্ত্রোচ্চারণে তার চারপাশ যেন কেঁপে উঠছিল। ওই কক্ষে যেন এক ঝাপসা আলো জমা হচ্ছিল ক্রমশ, যা চোখে দেখা না গেলেও অনুভবে বোঝা যাচ্ছিল।
*#তৃতীয় ধাপে নূর ভাই করলেন পিশাচনাশী হোম। রাত্রির অন্ধকার তখন ঘন হয়ে এসেছে। হোমের আগুনে গন্ধক, নীল সরিষা, কেশর, হিঙ্গুল একে একে পড়ছে। প্রত্যেকটি উপাচার পিশাচ শক্তির বদ্ধ রূপরেখায় আঘাত করছিল। নূর ভাই জপ করছিলেন তন্ত্রমন্ত্র—যার শব্দ কানে নয়, মনে প্রবেশ করছিল।
*#তারপর জয়ন্তকে বুঝিয়ে দিলেন, কীভাবে রাতে শোয়ার আগে সুরক্ষা বলয় আঁকতে হবে—কেশরের গুঁড়ো দিয়ে একটি ত্রিকোণ, মাথার দিকে এক চুম্বকপাথর, এবং পাশে এক তামার পাত্রে গঙ্গাজল রাখা। বললেন, “রাত্রি মানে শুধু নিদ্রা নয়, আত্মার স্বাধীন বিচরণও। রাত্রি সুরক্ষিত না হলে পিশাচ চেতনা আবার প্রবেশ করবে।”
*#পঞ্চম ধাপে, তিনি নিজেই গিয়েছিলেন কালীমূর্তির সামনে। জয়ন্তর জন্য বিশেষ প্রার্থনা করে, মা-র কাছে কৃপা চাইলেন। “এ জীবন ভোগ করেছে বহুবার, এবার আশীর্বাদ দাও মা।”
*#শেষ ধাপে, মধ্যরাতের নিঃস্তব্ধতায় তিনি বসলেন ধ্যানস্থ হয়ে—জয়ন্তর কুন্ডলিনীতে নিজের প্রজ্ঞা শক্তির প্রবাহ ঘটানোর জন্য। এটি এক বিপজ্জনক প্রক্রিয়া, কারণ এতে নিজের আত্মশক্তি হ্রাস পায়। কিন্তু নূর ভাই জানতেন—এই যুবক, যিনি ঈশ্বরকে ডাকতে জানেন, তাঁকে রক্ষা না করলে আধ্যাত্মিক বিপর্যয় ঘটবে।
ধীরে ধীরে জয়ন্তর শরীর কাঁপতে শুরু করল। তার চোখে জল, ঠোঁট কাঁপছে, নিঃশ্বাস ঘন হয়ে আসছে। সে চিৎকার করে উঠল, “আমি কে? কেন এতদিন আটকে ছিলাম?”
আর এক মুহূর্ত পর, এক নিঃশ্বাসে সে বলে উঠল—“আমার ভিতর আলো প্রবেশ করছে। আমি যেন জন্ম নিচ্ছি নতুন করে…”
*#সেই রাতের পরে জয়ন্ত আর আগের মানুষ ছিল না।
আজ সে এক প্রতিষ্ঠিত আধ্যাত্মিক পরামর্শদাতা, যিনি আধুনিক মনোবিজ্ঞান আর আধ্যাত্মিক বিজ্ঞান মেলিয়ে মানুষের জীবনে পথ দেখান। সে জানে—ভাগ্য মানে কেবলই দৈব নয়, আত্মিক গতির ছায়া। আর সেই গতি থেমে গেলে মা লক্ষ্মীও কৃপা করতে পারেন না।
তাঁর কন্ঠে আজও মাঝে মাঝে শোনা যায় সেই অভিজ্ঞতার কথা—
“আমি সত্যিই বিশ্বাস করতাম, মা লক্ষ্মী আমায় ত্যাগ করেছেন। কিন্তু আসলে আমি নিজেকেই ত্যাগ করেছিলাম। নূর ভাই আমায় সেই নিজেকে ফিরিয়ে দিয়েছেন।”
আর নূর ভাই?
তিনি এখনও বসে থাকেন, হয়তো আপনার জন্য -- হাতে ধূপ, চোখে আলোর ভাষা। কেউ তাঁর কাছে এসে যদি প্রশ্ন করে—“এইসব সত্যিই কি সম্ভব?”, তিনি মুচকি হেসে বলেন—
“অন্ধকার কারও শত্রু নয়। কিন্তু যদি তুমি তা চিনে না ফেলো, সে তোমার ভিতর ঢুকে পড়ে। আর তখনই প্রয়োজন হয় আলো দেখাবার একজনকে—যে জানে, অন্ধকার কেবল ভয় নয়, মুক্তির দ্বারও বটে।”
চলবে.................
✍️ রতন কর্মকার
(whatsapp: +8801715982155)


Post a Comment

0 Comments