অশ্বথ এবং ক্রিয়াযোগ
“অশ্বথ” শব্দটি এক গভীর আধ্যাত্মিক তাৎপর্যের বহিঃপ্রকাশ, যা শরীর, চেতনা এবং সৃষ্টির ক্ষণস্থায়ী প্রকৃতি বোঝাতে ব্যবহৃত হয়। এই শব্দটি শারীরিক অস্তিত্বের একটি গভীর রূপক এবং ক্রিয়াযোগের দর্শনে এর বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। প্রাচীন যোগশাস্ত্র এবং উপনিষদে “অশ্বথ” কে জীবনের অস্থায়ী প্রকৃতির প্রতীক হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে, যা আমাদের অস্তিত্ব, পরিবর্তনশীলতা এবং আত্ম-অন্বেষণের পথে দিকনির্দেশ করে।
অ = নাস্তি (অর্থাৎ যা চিরস্থায়ী নয়)।
থ = আগামী দিনের প্রত্যভকাল পর্যন্ত স্থিতির ভরসা।
এখানে "অশ্বথ" এমন এক ধারণা বোঝায়, যা অনিত্য, পরিবর্তনশীল এবং অবলম্বনহীন। এটি একটি বৃক্ষের মতো, যা জন্মায়, বৃদ্ধি পায়, এবং শেষে ধ্বংস হয়ে যায়। আমাদের শরীরকেও একইভাবে দেখা হয়—এটি একটি ক্ষণস্থায়ী রূপ, যা প্রকৃতির নিয়মে বৃদ্ধি পায়, ক্ষয়প্রাপ্ত হয় এবং একদিন বিলীন হয়ে যায়। এখানে "অশ্বথ" দ্বারা শরীর থেকে নিঃসৃত বায়ু (নিঃশ্বাস) এবং তার শাশ্বত অনিশ্চয়তার কথা বলা হয়েছে।
“নিঃশ্বাস” শব্দের বিশ্লেষণে বোঝা যায়, এটি একটি ক্ষণস্থায়ী প্রক্রিয়া। প্রতিটি শ্বাস, যা শরীর থেকে বের হয়, তা আবার ফিরে আসার নিশ্চয়তা দেয় না।
যোগশাস্ত্রে নিঃশ্বাসকে জীবনের প্রতীক হিসেবে ধরা হয়। তাই, একসময় নিঃশ্বাস শরীর থেকে চিরতরে বেরিয়ে যাবে এবং আর ফিরবে না—এটি শরীরের মৃত্যু এবং অশ্বথের প্রকৃতি নির্দেশ করে।
*#ক্রিয়াযোগ মতে, শরীর হলো আত্মার অস্থায়ী বাহন। শরীরের মতো জীবনও অনিত্য, যা একটি অশ্বথ বৃক্ষের রূপক দিয়ে বোঝানো হয়।
যেমন একটি বৃক্ষ জন্মায়, বিকশিত হয় এবং ধ্বংস হয়, তেমনই শরীরও প্রকৃতির নিয়মে পরিবর্তনশীল।
যোগীদের কাছে শরীরের অস্থায়িত্ব উপলব্ধি করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, এটি চেতনাকে ক্ষুদ্র ইন্দ্রিয়সুখ থেকে মুক্তি দিয়ে চিরন্তন সত্যের পথে পরিচালিত করে।
নিঃশ্বাসকে “ক্ষণপ্রলয়” বলা হয়। এটি যোগশাস্ত্রের একটি গভীর বিষয়।প্রতিটি শ্বাসের বাইরে যাওয়ার সঙ্গে শরীর সাময়িকভাবে প্রলয়ের অভিজ্ঞতা লাভ করে।
একদিন যখন নিঃশ্বাস আর ফিরে আসবে না, তখন তা চূড়ান্ত প্রলয় বা মৃত্যুর সূচনা করবে।
ক্রিয়াযোগ শিখিয়ে দেয়, এই নিঃশ্বাস-প্রলয়ের অনুশীলনের মাধ্যমে আমরা নিজেদের অস্তিত্বের গভীরতর সত্য উপলব্ধি করতে পারি।
*#অশ্বথের রূপক আমাদের শেখায় যে, জীবন অস্থায়ী। এই অস্থায়িত্ব উপলব্ধি করলে বৈরাগ্য (বিচ্ছিন্নতা) জন্মায়। বৈরাগ্য হলো আত্মার মুক্তির প্রথম ধাপ, যা ক্রিয়াযোগে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
ক্রিয়াযোগ অনুসারে, আত্মা শাশ্বত, কিন্তু শরীর ক্ষণস্থায়ী। অশ্বথ বোঝায় যে, শরীর একটি বৃক্ষের মতো ক্ষণিকের জন্য বিদ্যমান। এটি প্রকৃতির অংশ, যা নিয়ম অনুযায়ী জন্ম নেয় এবং ধ্বংস হয়। যোগী শরীরের পরিবর্তনশীলতাকে স্বীকার করে আত্মার প্রতি মনোনিবেশ করেন।
“অশ্বথ” শরীরের নামরূপে সীমাবদ্ধ হলেও চেতনাশ্রয়ে একতার প্রকাশক। এটি বোঝায় যে, আমাদের অস্তিত্বের মূল হলো ব্রহ্ম। যোগীদের জন্য, “অশ্বথ” ধারণাটি ব্যক্তিগত চেতনা থেকে মহাবিশ্বীয় চেতনায় উত্তরণ ঘটানোর মাধ্যম।
*#অশ্বথের ধারণা আমাদের জীবনের প্রকৃতি সম্পর্কে একটি গভীর দৃষ্টিভঙ্গি প্রদান করে। এটি আমাদের শেখায় যে, শরীর এবং জীবন কেবলই একটি ক্ষণস্থায়ী ধাপ। ক্রিয়াযোগ এই উপলব্ধিকে গভীরতর করে এবং আমাদের আত্মার সঙ্গে সর্বোচ্চ চেতনার সংযোগ স্থাপন করতে সাহায্য করে। অশ্বথ বৃক্ষ যেমন নিজে ক্ষণস্থায়ী, তেমনই এটি একটি উচ্চতর সত্যের প্রতীক, যা আমাদের আত্মার শাশ্বত অবস্থার দিকে পরিচালিত করে। যোগীর জন্য, অশ্বথ কেবল একটি রূপক নয়; এটি এক নিরন্তর অনুসন্ধানের পথে দিকনির্দেশ।
✍️ ব্যাখ্যাঃ রতন কর্মকার (whatsapp: +8801811760600)
0 Comments