Recent Posts

6/recent/ticker-posts

কালা যাদু পর্ব ২: লোহার ভিতরে ভাঙনের শব্দ

 



কালা যাদু

পর্ব ২: লোহার ভিতরে ভাঙনের শব্দ

লোহার ভিতরে ভাঙনের শব্দ

*#কালা_যাদু : ২য় পর্ব

আমার বাবা, রমেশ কর্মকার, ছিলেন একজন অসাধারণ পরিশ্রমী মানুষ। লোহার ব্যবসা করতেন—গ্যারেজ, দোকান, নির্মাণস্থল, গ্রামের মেলা থেকে শহরের বাজার—সব জায়গাতেই তার দোকানের নাম ছিলো সমাদৃত। গায়ের রং ছিল শ্যামলা, চেহারায় ছিল অনড় একটা দৃঢ়তা। লোহার মতোই ছিল তার মনোবল, আর শরীর ছিল যেন রীতিমতো পাহাড় মতোই দৃঢ়। খুব একটা অসুস্থ হতেন না কখনো।

আমার ছোটবেলা কেটেছে লেখাপড়া আর বাবার দোকানে সময় দিয়ে—লোহার গন্ধ, হাতুড়ির টুংটাং শব্দ, আর বাবার কণ্ঠের কড়া হুকুমে আমি শক্তির সংজ্ঞা বুঝতে শিখেছিলাম। ভাবতাম, এই মানুষটাকে কিছুতে ভাঙা সম্ভব না।

কিন্তু একটা অদ্ভুত ব্যাপার আমরা বারবার লক্ষ করতাম, যেটা তখন শিশুমনে খুব একটা গুরুত্ব না পেলেও পরে, বড় হয়ে ভেবে দেখেছি—এটা কি শুধুই কাকতালীয় ছিল?

প্রতি বছর যখন দোকানের ব্যবসার সিজন আসতো—বিশেষ করে পূজোর আগে, বা মেলার মরশুমে—যখন বাবার দোকানে পাইকাররা লাইন দিয়ে আসতেন, আর পুরো পরিবার সিজনের চাপ সামলাতে ব্যস্ত হয়ে যেতো, ঠিক সেই সময় হঠাৎ করে বাবা অসুস্থ হয়ে পড়তেন।

কখনো জ্বর, কখনো পেটের সমস্যা, আবার কখনো পুরো শরীর অসাড় হয়ে যেতো। ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলে বলা হতো—স্ট্রেস, খাবারের সমস্যা, বা ভাইরাল ইনফেকশন। ওষুধ চলত, ইনজেকশন চলত, কিন্তু ব্যবসার মূল সময়টা যেন কোনো অদৃশ্য শক্তি বাবাকে শয্যাশায়ী করে রাখত।

তখন মা খুব চুপ হয়ে যেতেন। কখনো কখনো দেখতাম, মা খুব ধীরে দরজা বন্ধ করে ঠাকুরঘরে ঢুকে যাচ্ছেন, আবার অনেকক্ষণ চুপ করে বসে থাকছেন, যেন কারো সঙ্গে নীরব আলাপ চলছে তার।

যখন ব্যবসার চাপ কমে যেতো, আর দোকানে খালি খালি ভাব, ঠিক তখনই বাবা আবার ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াতেন। খাবার খেতে পারতেন, স্বাভাবিক চলাচল করতেন। আর আমরা ভাবতাম—এতদিন কি সত্যিই অসুস্থ ছিলেন উনি?

এই ঘটনা একবার নয়, বারবার ঘটেছে। প্রতিবছরই।

একবার মা অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন, তখন আমি বাবার দোকানে বেশি সময় দিতাম। ঐ সময়টা ছিল সিজনের মাঝপথ। হঠাৎ একদিন বাবাকে দোকানের ভেতরে বসে থাকতে দেখলাম—অদ্ভুত চেহারা। চোখ লাল, কপালে ঘাম, যেন অজানা কোনো আতঙ্ক জমে আছে মগজে। আমি বললাম, "বাবা, তুমি ঠিক আছো?"

তিনি শুধু বললেন, "ভালো লাগছে না রে জয়ন্ত... শরীরটা কেমন লাগছে।"

আর পরদিনই আবার সেই পুরনো চিত্র—শয্যাশায়ী বাবা, বাড়িতে টানাপোড়েন, দোকান অচল।

এখন বুঝি, তখনকার দিনে মা অনেককিছুর আঁচ পেয়েছিলেন। একদিন সন্ধ্যায় মা আমাকে খুব নিচু গলায় বলেছিলেন, “তোর কাকারা বাবাকে সহ্য করতে পারত না রে। ওদের চোখে ছিল শুধু হিংসা। হয়তো..."

কথাটা শেষ করেননি মা। কিন্তু তার চোখে একটা তীব্র কষ্ট আর ভয় দেখেছিলাম।

আমি তখনও অল্পবয়সী। এসব কিছু বুঝলেও পুরোটা বোঝার মতো মানসিক পরিপক্বতা ছিল না।

কিন্তু বড় হয়ে, যখন জীবনের অনেক কিছু দেখেছি, বুঝেছি—তখন আর সন্দেহ থাকে না। এটা ছিল পরিকল্পিত। হয়তো তাবিজে বাঁধা কিছু, শ্মশানে বা কবরে কিছু গাড়া, হয়তো পুরোনো শত্রুতার অভিশাপ—যা দিয়ে তারা একের পর এক সিজনের দিনগুলোতে বাবাকে শারীরিকভাবে অক্ষম করে দিত।

আমরা কোনোদিন প্রমাণ পাইনি। কখনো তাদের মুখে কিছু শুনিনি। কিন্তু প্রতিবার বাবা সুস্থ হয়ে উঠলে তাদের চোখে এক ধরনের হতাশা দেখতাম। যেন কেউ ভেবেছিল, এবার বুঝি সে শেষ—কিন্তু হয়নি।

এতদিন পর বুঝি, লোহার ভিতরে ফাটল ধরা যেমন দেখা যায় না, তেমনি কালো যাদুর আঘাতও বাহ্যিক নয়। সেটা ভেতর থেকে ধীরে ধীরে একজন মানুষকে গুঁড়িয়ে দেয়।

আমার বাবার মতো শক্ত মানুষও তার শিকার হয়েছিলেন।

তবে তখন, আমার পাশে ছিল আমার বন্ধু—নূর। আমার বয়সী, আমাদেরই পাড়ার ছেলে। ছোটবেলা থেকে একসঙ্গে বড় হয়েছি। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সে যেন এক অদ্ভুত পরিণত বোধ নিয়ে হাজির হয়েছিল জীবনে। বাবার অসুস্থতা, দোকানের টানাপোড়েন, মায়ের নীরব ভয়—সবকিছুর মধ্যে সে ছিল আমার সবচেয়ে বড় সাপোর্ট।

সে শুধু পাশে ছিল না, ধীরে ধীরে এমন কিছু প্রশ্ন তুলতে শুরু করল, যা আমায় ভাবতে বাধ্য করল—এই রোগ কি আসলেই শরীরের ছিল, না এর পেছনে আছে অন্য কোনো অদৃশ্য খেলা?

আর ঠিক সেই জায়গা থেকেই, একদিন সে আমায় এমন কিছু দেখাল, যা আমার বিশ্বাস, যুক্তি আর বাস্তবতার ধারনাকে একেবারে পালটে দিয়েছিল।

চলবে......................

✍️ রতন কর্মকার

Post a Comment

0 Comments