যোগ সাধনা সম্পর্কে শ্রীরামকৃষ্ণের মতামত
যোগ সাধনা সম্পর্কে শ্রীরামকৃষ্ণের মতামত তাঁর দার্শনিক ও আধ্যাত্মিক শিক্ষার কেন্দ্রবিন্দু। তিনি জীবনের প্রকৃত উদ্দেশ্য হিসেবে ঈশ্বরলাভ এবং চৈতন্য উপলব্ধির ওপর জোর দিয়েছেন। শ্রীরামকৃষ্ণের মতে, যোগ সাধনা মানুষের আধ্যাত্মিক উন্নতির একটি গুরুত্বপূর্ণ পথ, তবে তিনি সবসময় যোগ সাধনার সহজ এবং সরল পদ্ধতির ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন। এখানে তাঁর মতামত বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হলো:
*#যোগের মূল উদ্দেশ্য, ঈশ্বর উপলব্ধি :
শ্রীরামকৃষ্ণ বলেছেন, যোগ সাধনার মূল উদ্দেশ্য হলো ঈশ্বরের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করা। তিনি মনে করতেন, যোগ শব্দের অর্থ হলো সংযোগ বা মিলন, যা জীবাত্মা ও পরমাত্মার মিলনে পরিণত হয়। তাঁর মতে, যোগ সাধনার লক্ষ্য হতে হবে মনের সম্পূর্ণ একাগ্রতা ও ইন্দ্রিয়ের নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে ঈশ্বরকে উপলব্ধি করা।
*#যোগের বিভিন্ন পথের প্রতি শ্রদ্ধা :
শ্রীরামকৃষ্ণ বিভিন্ন যোগপথ যেমন রাজযোগ, কর্মযোগ, ভক্তিযোগ, এবং জ্ঞানযোগের প্রতি গভীর শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, প্রতিটি পথই একজন সাধকের আধ্যাত্মিক উন্নতির জন্য উপযোগী হতে পারে।
*#রাজযোগ: মনের একাগ্রতার মাধ্যমে ঈশ্বরচিন্তা।
*#কর্মযোগ: নিঃস্বার্থ কর্মের মাধ্যমে চিত্তশুদ্ধি।
*#ভক্তিযোগ: ভক্তি ও প্রেমের মাধ্যমে ঈশ্বরলাভ।
*#জ্ঞানযোগ: জ্ঞানচর্চার মাধ্যমে আত্মার স্বরূপ উপলব্ধি।
*#যোগের সরলীকরণ ও ভক্তির গুরুত্ব :
শ্রীরামকৃষ্ণ মনে করতেন যে, কঠোর নিয়ম মেনে যোগ সাধনা করা সাধারণ মানুষের পক্ষে সবসময় সম্ভব নয়। তাই তিনি সহজ ও সরল উপায়ে ঈশ্বরকে চিনতে বলতেন। তিনি ভক্তির পথকে সবচেয়ে সহজ ও মধুর পথ হিসেবে দেখিয়েছেন। তাঁর মতে, প্রেম ও ভক্তির মাধ্যমে ঈশ্বরলাভ করা সহজ এবং এটি সরাসরি আত্মার সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করে।
*#মনঃসংযম ও চিত্তশুদ্ধি :
যোগ সাধনার জন্য শ্রীরামকৃষ্ণ মনঃসংযম এবং চিত্তশুদ্ধির ওপর বিশেষ জোর দিয়েছেন। তাঁর মতে, যোগীর প্রধান কাজ হলো মনের চঞ্চলতাকে প্রশমিত করা এবং ঈশ্বরচিন্তায় নিবিষ্ট হওয়া। চিত্তশুদ্ধি ছাড়া যোগে সফল হওয়া সম্ভব নয়।
*#গুরু ও সাধনায় আস্থা :
শ্রীরামকৃষ্ণের মতে, যোগ সাধনায় গুরু অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলেছেন, “গুরুর কাছে শরণাপন্ন হও, কারণ গুরুই সাধককে সঠিক পথ দেখাতে পারেন।” তাঁর মতে, সঠিক সাধনা এবং গুরুর নির্দেশনা ছাড়া ঈশ্বরলাভ করা কঠিন।
*#যোগে একাগ্রতার প্রয়োজনীয়তা :
তিনি বারবার বলতেন, একাগ্রতা ছাড়া যোগ সাধনা সফল হয় না। যোগীর উচিত সমস্ত ইন্দ্রিয় ও মনের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ঈশ্বরের চিন্তায় নিমগ্ন হওয়া। তিনি বলেন, “মনের ভাবনাগুলি ঈশ্বরের দিকে কেন্দ্রিত করতে হবে, যেমন একটি সূঁচ চুম্বকের দিকে আকৃষ্ট হয়।”
*#আত্ম-অনুসন্ধান এবং আনন্দের উপলব্ধি :
শ্রীরামকৃষ্ণ মনে করতেন, যোগ সাধনা শুধু দেহের নয়, মনেরও এক আধ্যাত্মিক প্রশিক্ষণ। এটি সাধককে আত্মিক জগতে নিয়ে যায় এবং চরম আনন্দ উপলব্ধির সুযোগ দেয়। তিনি বলেন, “যিনি যোগের পথে ঈশ্বরলাভ করেছেন, তিনি জীবনের পরম সুখ বা আনন্দ লাভ করেছেন।”
*#শ্রীরামকৃষ্ণের উক্তি যোগ সাধনার প্রসঙ্গে:
১. “ঈশ্বরলাভই জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য। যোগের মাধ্যমে সেই লক্ষ্য অর্জন করা যায়।”
২. “মনের একাগ্রতা সাধনের জন্য যোগ প্রয়োজন। মন ঈশ্বরচিন্তায় নিবিষ্ট হলে পরম শান্তি লাভ হয়।”
৩. “তোমার মনকে চঞ্চল হতে দিও না। এটি ঈশ্বরের দিকে নিয়ে যাও, তাহলেই যোগ সাধনার প্রকৃত ফল লাভ করবে।”
*#শ্রীরামকৃষ্ণ যোগ সাধনাকে জীবনের একটি অপরিহার্য অংশ হিসেবে দেখেছেন। তবে তিনি এও বলেছেন, সাধকের উচিত সর্বদা সরলতা, আন্তরিকতা এবং ভক্তি বজায় রাখা। তাঁর দৃষ্টিতে, যোগ সাধনা শুধু তাত্ত্বিক নয়, বরং এটি সাধকের জীবনে ঈশ্বর উপলব্ধির একটি কার্যকর মাধ্যম।
✍️ রতন কর্মকার
0 Comments